একদিন নববর্ষা -১৮,১৯

0
193

একদিন নববর্ষা -১৮,১৯
অদ্রিজা আশয়ারী
১৮

বাবা নেই। সবকিছু ছাপিয়ে তাই ব্যাবসাটা আমাকে দেখতেই হবে। তাছাড়া এই কদিন সবকিছু থেকে বিছিন্ন, ঘটনাবিহীন জীবনটা বড় পানসে ঠেকছিল। ঘরে বসেই তাই কাজের তদারক হাতে নিলাম। আম্মার ঘর ছেড়ে স্থানান্তরিত হলাম নিজের ঘরে।
ফ্যাক্টরির অবস্থা বিশৃঙ্খল। বেশ কয়েকদিনের বিচ্ছিন্নতায় যে ফাঁক তৈরি হয়েছে তা পূরণ করতে দিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। তবু ভেবে স্বস্থি হল। অন্তত কাজের ব্যস্ততায় আকণ্ঠ ডুবে থেকে বিষাক্ত স্মৃতি গুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে ।

ভালোবাসার বিষবাষ্প ছেঁয়ে থাকে আকাশ আমার। যে আকাশের নিচে পুরো পৃথিবীটা লিখেছিলাম তোমার নামে।
অথচ তুমি দূরে সরে গেছ অকারণ অভিমানে। আমার মনের বারান্দায় আর তোমার আনাগোনা হয়না।
বলো প্রিয়তমা, এভাবেও ভালো থাকা যায়?

কেউ জানে না মনে মনে সত্যিই আমি ভালো নেই। সারাক্ষণ ল্যাপটপে ফ্যাক্টরির কাজ দেখছি। যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি ব্যাস্ত রাখছি নিজেকে। তবুও একটু ফাঁক পেলেই ভুতের মতো দুর্বিষহ স্মৃতিরা এসে হানা দেয় হৃদয়গহরে। ওরা বারবার ফিরে আসে। আমি সয়ে যাই…।

***

সকালে থেকেই আজ আকাশ মেঘলা। খোলা বাতায়ন পেরিয়ে ফুরফুর করে আসছে শীতল বাতাস। বাতাসের আধিক্যে দুল্যমান পর্দাকে মনে হচ্ছে দুরন্ত পাখির ডানা ঝাপটানি। নিতিন দরজায় কড়া নেড়ে মুখ বাড়িয়ে রইল। ওকে ডাকলাম। নিতিন ভেতরে এলো তবে বসল না। বিছানার গা ঘেঁষে বাতায়নের কাছে গা হিম করা বাতাসে আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিতিনের এমন আচরণ বিরল।
-“কিরে বুড়ি। কি হয়েছে? ”

এই কথায় নিতিন জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় আমার পাশে বসল। আচ্ছন্ন মুখটা হঠাৎ তুলে বলল
-” দাভাই, আম্মা আর বড়মামা মিলে মতলব আটছে। এবার তোমাকে বিয়ে করিয়েই ছাড়বে। ”

আমি হাসলাম।
-“তাই নাকি? তা কদ্দূর এগিয়েছে ওদের শলাপরামর্শ?”

নিতিনের মুখে মেঘের ছায়া পড়ল। সে গম্ভীর মুখে বলল,
-“সবকিছুই ঠিক। শুধু এখনো তোমাকে জানানো বাকি। দাভাই, মেয়ের নাম জানতে চাইবে না?”

নিতিনের কথা যে গুরুতর আমি হঠাৎ বুঝলাম। আম্মা সত্যিই এতটা এগোবে, আমাকে না জানিয়ে। ভাবতে পারিনি। মেয়ের নাম কি তার চেয়ে এই ব্যাপার টা অনেক বেশি গুরুতর। দায়সারা ভাবে বললাম,
-“কি নাম?”

নিতিন আড়চোখে আমার দিকে চাইল। অপরাধীর মতো মুখ করে বলল,
-” বর্ষা ”

আমি সঙ্গে সঙ্গে চাইলাম নিতিনের মুখে। ওর অভিসন্ধি কি বুঝতে চেষ্টা করলাম।

নিতিন মাথা নুইয়ে ফেলল,
-” নাম একই হলেও এই বর্ষা একদম নয় ওই মেয়েটির মতো। মামার ভাষায় পাত্রী হিসেবে একেবারে ফার্স্টক্লাস।”

-“আর এইসব কিছুতে আম্মার ভূমিকা?”

ভূমিকা বলতে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি নিতিন জানে। সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল
-” আম্মার কোনো দোষ নেই দাভাই। বড়মামা নিজেই সব ঠিক করেছে। তোমাকে যে এখনো কিছু জানানো হয়নি। সেই প্ল্যানটাও বড় মামার। তুমি তো জানোই আম্মা তার ভাইয়ের কেমন ভক্ত! বড় মামা যা বলছে তাতেই সায় দিয়ে মাথা- ”

-“নিতিন।”

দরজায় দাঁড়িয়ে আম্মা কড়া গলায় ডাকলেন।
নিতিনের কথা শেষ হলো না। ভরকে গিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে ফিসফিস করে বলল,
-“এই রে। এখন কি হবে! আম্মা কি আমার সব কথা শুনে ফেলেছে? আমি এখন যাই দাভাই। তুমি সামলিও আম্মাকে। ”

নিতিন দৌড়ে বেরিয়ে যাবার পর দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত আম্মা অপেক্ষা করলেন। তারপর ঘরে এসে বিছানার অন্যপাশে বসে বিনা ভূমিকায় গম্ভীর মুখে বললেন,
-” তোমাকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এবার আর কোনো অজুহাত নয়। তোমাকে বিয়ে করতে হবে নবু। ”

সিরিয়াস মুহুর্ত ছাড়া আম্মা আমাকে কখনো তুমি সম্মোধনে ডাকেন না। আমি মনের আঙিনায় বলার মতো যুতসই কিছু শব্দ হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম। অনেক চেষ্টার পর
-” আমি বিয়ের জন্য এখনো তৈরি নই।” এই ক-টা ছাড়া আর কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম না।

আম্মা কঠিন চোখে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর দৃঢ় গলায় বললেন,
-” অথচ তুমিই কিছুদিন আগেই ওই জোচ্চর, থার্ড ক্লাস মেয়েটাকে বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া ছিলে। বংশের মান, সামাজিক মর্যাদার কথা ভুলে আমিও রাজি হয়েছিলাম ওদের সাথে সম্পর্ক গড়তে। আর তারপর?

নবু, তুমি তো ছোট নও। একা হাতে বাবার এতবড় ব্যাবসা সামলাচ্ছ। তুমি এখন যথেষ্ট পরিণত।
তোমার বাবা নেই। শহরের বাইরে তোমার বাবা যা কিছু গড়েছিল সবের ওপর এখন তোমার বাবার চাচাদের হাত। এই বাড়িটাই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তোমার বাবা জীবিত থাকাকালীন বদ্যন্যতা দেখিয়ে নিজের চাচাদের উজার করে দিয়েছিলেন সবকিছু। এখন তারাই আমাদের সম্পত্তির ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করছে।
ঘরে তোমার একটা ছোট বোন আছে। তারও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আমি কতদিন বাঁচি না বাঁচি…। তার আগে অন্তত তোমাকে সংসারী দেখে যাই। এদিকে মায়েরও বয়স বেড়েছে। শরীরে নানান রোগ বাসা বেঁধেছে। কখন কি হয়ে যায় কে বলতে পারে। তুমি তার প্রথম নাতি। তোমাকে নিয়ে মায়ের অনেক আশা। অথচ তুমি একটা মেয়ের বিরহে দেবদাস হয়ে দিনের পর ঘরবন্দী হয়ে বসে আছো। তোমার দাদির সঙ্গে চোখের দেখাটা পর্যন্ত করছো না। যে মেয়ে তোমার আবেগ অনুভুতির মূল্য দেয়নি কোনোকালে। তার জন্য তুমি প্রতিনিয়ত নিজের পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছ।
নবু, যখন দেখি পুরো দিন পেড়িয়ে তোমার মুখে একফোঁটা হাসি নেই, কেবলই দীর্ঘ নিশ্বাসের ছড়াছড়ি। তখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। বারবার মনে হয় মা হয়েও আমার সন্তানের দুঃখ আমি কেন দূর করতে পারছি না?
বাবা-মা না হলে এই কষ্ট তুমি কোনোদিন বুঝবে না। ”

আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আম্মা ফের বললেন,
-“নবু, আব্বা। তুই আর না করিস না। এইবার আমি মরে যাবো। সত্যি মরে যাবো। আর সহ্য হচ্ছে না। তোর আব্বা এভাবে হুট করে চলে গেল। সেই শোক পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। তার আগেই এতকিছু ঘটে গেল। এইবার তুই আমার কথাটা শোন।”

আম্মার চোখ বেয়ে বড় বড় ফোঁটায় অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। কি করুণ দেখালো তখন আম্মার মুখখানা! কতদিন আমি আম্মার মুখটা ভালো করে খেয়াল করি নি। চোখের কোল ভর্তি আম্মারও যে এত কষ্ট লুকোনো ছিল কে জানতো! পুরুষ মানুষ না হলে আজ নির্ঘাত আমিও নিতিনের মতো পাখির বেশে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতাম।

আম্মা উত্তরের অপেক্ষায় আমার মুখে চেয়ে আছেন। এখনো গাল বেয়ে জলের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে। আমি আম্মার হাত নিজের হাতের ওপর নিলাম। গালের সঙ্গে চেপে ধরে বললাম,
-“আজ থেকে তুমি যা চাইবে তাই হবে। তোমার সিদ্ধান্তে আর কখনো অসুখী পাবে না আমাকে। কথা দিলাম।”

_________________

ঘুমের গাড়ি পাশ কেঁটে যায়, রাত ছুঁয়ে দেয় সকালটাকে;
বিভোর হয়ে তোমার গল্পঃ শোনাই আমি শূন্যতাকে।

প্রিয়দের স্মৃতিচারণও কেন এতো মধুর হয়! যে ছেড়ে গেছে, ভালোবাসার বিপরীতে যে কখনো ভালোবাসেনি তাকে ভেবেও কেন এত সুখ! কখনো সখনো ভাবি। এ বোধহয় আমার পুরুষোচিত সভাবের পরিপন্থী কাজ।
কিন্তু ভালোবাসার প্রজাপতিকে শেকল পড়িয়ে পিঞ্জরবদ্ধ করা এতো কি সোজা?

প্রথম প্রেম নাকি কোনোদিন চিরতরে হারিয়ে যায় না। থেকে থেকে ফিরে আসে জোয়ারের স্রোতের মতো।
আমি কি কখনো বর্ষার প্রথম প্রেম হতে পেড়েছিলাম? হয়তো না। তা নাহলে সে আমাকে এত সহজে ছেড়ে গেল কি করে?

আজকের দিনটা আমার জন্য বিশেষ হওয়ার কথা ছিল। ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র সেজে নবীনতম ভালোবাসাকে সাদর সম্ভাষণ জানাবার কথা ছিল অম্লান বদনে হেসে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর খেয়ালে মুখের হাসিটুকু ধরে রাখাও কঠিন মনে হচ্ছে। দুটি আলাদা সত্তাকে একসঙ্গে জুড়ে দেয়ার এইযে আয়োজন। সে নিয়ে চারপাশে কতশত ব্যগ্রতা। সকলের চোখে কত রঙিন স্বপ্ন। স্বপ্ন নেই শুধু আমার চোখে। স্বপ্ন দেখার সুবিশাল আকাশটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি! স্বপ্ন দেখবো কার ঠিকানায়?

***

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘের পর মেঘ জমতে শুরু করেছে। বাইরে কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন চারদিক।
ঘরে নববিবাহিতা স্ত্রী রেখে ধানমন্ডি লেকের স্বচ্ছ জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। যে মেয়েটির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে এখন পর্যন্ত তার মুখ দর্শন করিনি আমি। ইচ্ছে জাগেনি।
মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে লেকের জলে তাকালাম। রাতের আবছা আলোয় লেকের কালো জল ঝিলিক দিচ্ছে।
মধ্যরাতের শহর ডুবে আছে বিষন্নতায়। টিপটিপ ঝরতে থাকা বৃষ্টি যেন সেই বিষন্ন শহরের চোখের জল!
এই শহরের বুকে জমে থাকে কতশত গল্প। ভালোবাসা গড়ে ওঠার গল্প, ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার গল্প। আমার হারানোর গল্পটাও শহরের দেয়ালে সাদা স্কচটেপ দিয়ে সেটে দিলাম সন্তর্পণে। ভালোবাসা হারিয়েছে যারা, তাদের দলে যোগ হলো আরও একটি নতুন নাম। নাব্য ইমতিহান।

বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। উত্তরে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে, তেছড়া ভাবে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। পেটের কাটা জায়গাটায় আকস্মিক যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। যদিও এমন হবার কথা না। সেই ঘটনার পর ইতোমধ্যে একমাস পেড়িয়েছে। এতদিনে ঘা শুকিয়ে যাওয়ার কথা।
বাড়ি ফেরার অভিপ্রায় কিংবা জোর কোনটিই নেই। রাতটা নিশ্চিন্তে কাটাবার মতো কোনো একটা আশ্রয় পেলে ভালো হত।
কিন্তু একজন লেখককে কেউ মাঝরাতে নিজের বাড়িতে স্বাগত জানাবে না। এমনকি নিজের কাছের বন্ধুও না। তাকেও একটা যথোপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে। সেও পত্রিকার হেডিং হতে পারে এমন একটা অভিসন্ধি খুজতে চাইবে। এরচেয়ে কত ভালো হত যদি আমি সাধারণ কেউ হতাম!

রাতবিরেতে পথে হেটে বেড়াতাম একা।
কেউ জানতে চাইলে অকপটে বলতাম,
‘ বড় সাধ করে একটা রুপোলি কৌটোয় কিছু প্রজাপতি জমিয়ে ছিলাম গো। কিন্তু হঠাৎ সেই কৌটো হাত থেকে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। প্রজাপতিরা সব আকাশে উড়ে গেছে ডানা মেলে। বড় দুঃখ আমার। তোমরা কি কেউ এনে দিতে পারো প্রজাপতি গুলো? ‘

চলবে…….

একদিন নববর্ষা -১৯
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার কথা:
_______
সুবিশাল ঘরটিতে একা বধু বেশে যে মেয়েটি বসে আছে তার নাম বর্ষা। গায়ে জড়ানো গাঢ় লাল সিল্ক শাড়ি। মাথায় আধঘোমটা। ঘোমটার নিচে মুখটি বড় সুন্দর। পুতুল পুতুল গড়নের গোলগাল মুখের ওপর বড় বড় দুটি চোখ, ছোট্ট মিষ্টি নাক, পুরু লাল ঠোঁট।
ইতস্তত ভাবে ভেতর থেকে তার গোলগাল মুখটা বাইরে উঁকি দিচ্ছে কখনো কখনো। প্রচন্ড গরমে হাসফাস লাগছে। আড়ষ্টতায় ঘোমটা খুলে ফেলতেও সংকোচ হচ্ছে। ঘরে এসি আছে। কিন্তু কেউ এসে চালু করে দিয়ে যায়নি।

বর্ষা নামের ভীষণ লাজুক মেয়েটি অপেক্ষা করতে লাগল। তার অদেখা স্বামীর জন্য। শুনেছে লোকটির নাম নাব্য। মজার ব্যাপার হলো বিয়ে হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একবারের জন্য স্বামীর মুখদর্শন করেনি সে । স্বামী নামের প্রাণীটি দেখতে কেমন, কেমন তার স্বভাব কিছুই জানা নেই তার।

সে বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছে সেই কবে। বয়স এখন ঊনিশের কোঠায়। অথচ যেন মানসিক পরিপক্বতা সেই দরুন বাড়েনি। পৃথিবীকে খুব সরল করে দেখতে শিখেছে সে। এর ভেতরের জটিলতা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। ছোট কালে সে রুপকথার গল্পের ভীষণ পোকা ছিল। সেসব প্রতিটি গল্পের শেষেই রাজকন্যা রাজপুত্রের মিলন ছিল অবধারিত। বর্ষার সেসব গল্প ভীষণ ভালো লাগত। একবার একটা রুপকথার গল্প নিয়ে তৈরি ছবি সে দেখেছিল। অনেক বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে যেখানে রাজকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে রাজপুত্র একহাজার ফানুস উড়িয়ে রাজকন্যাকে ভালোবাসা নিবেদন করে। শীতল রাত্রির চাঁদোয়ার নিচে একটি শান্ত নদীর মাঝখানে নাও ভিরিয়ে তারা দুজন বসে আছে। মাথার ওপর শতশত ফানুস উড়ছে জ্বলজ্বল করে। ফানুসের গৈরিক আলোয় আলোকিত দুজনের মুখ।

এই ছিল বর্ষার দেখা শেষ রুপকথা। তারপর আর কখনো দেখা হয়নি। ছবি টুকু তাই স্থানী ভাবে গেঁথে রইল মানসপটে।

বর্ষার ধারণা হলো তার জীবনেও একদিন এমন রাত আসবে। কোনো এক ভিনদেশী রাজপুত্র সেরাতে তাকেও এভাবে ভালোবাসা নিবেদন করবে। তাদের বিয়ের রাতে।

কিন্তু এই রাজপুত্র তো এখনো এলোই না। ঘরে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলল বুঝি! ভেবে ভেবে বর্ষা আকুল হয়। মাথায় গোজা বেলী ফুলের গাজড়া থেকে প্রগাঢ় সুঘ্রাণ এসে বারি খায় বর্ষার নাকে। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে বর্ষার। তার একটা প্রচ্ছন্ন অভিলাষ ছিল। বিয়ের প্রথম রাতে নিজের অর্ধেক দ্বীনের সঙ্গে একই জায়নামাযে সালাত আদায় করবে। স্বামী ইমামতী করবে। স্বামীর পেছনে আল্লাহু আকবর বলে সিজদায় যাবে সে। আল্লাহর কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাবে।

কিন্তু তা আর হলো কই! সে তো এলো না। অপেক্ষা করতে করতে একসময় বর্ষার চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। ঘুম ভাঙ্গল ফজরের সালাতের এলার্মে। বর্ষা লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। পাশ ফিরল সঙ্গে সঙ্গে। অবাক হয়ে দেখল তার পাশের জায়গাটুকু তখনো শূন্য। রাতে কি লোকটা তাহলে আর ফেরেইনি! এমনও কি কখনো হতে পারে?

ওয়াক্ত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা দ্রুত উঠে ওজু করতে গেল। ওজু শেষে বেরিয়ে এসে পড়ল ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’

সালাতে সিজদায় গিয়ে বর্ষার চোখ বেয়ে হঠাৎ একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল জায়নামাযে। বড় সহজ মেয়ে বর্ষা। ভীষণ সরল তার চিন্তাধারা। পুরো রাত পেড়িয়েও যখন স্বামী ফিরল না, তখনো সে বুঝল না এর পেছনে নিগূঢ় কোনো কারণ থাকতে পারে। রবকে সে নিজের সবচেয়ে বড় ও আস্থাভাজন অভিভাবক মানে। তাই না চাইতেও অভিমানী মন সল্প ব্যাথায় কাতরিয়ে রবের সঙ্গে সাক্ষাত মাত্র কেঁদে উঠল। বর্ষা জানলো না এই কান্নাই হলো এখন থেকে তার নিত্যসঙ্গী।

সকাল তখন সবে আটটা। নানান ঊনিশ-কুড়ি ভাবনা ভাবতে ভাবতে বর্ষার তন্দ্রা এসেছিল। ফজরের সালাতের পর বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া কাঁচের দরজা ঘেষা ডিভানে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুমটা গাঢ় হয়নি। হঠাৎ ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ মেলে উঠে বসল। অভ্যেসের বশে শাড়ির আঁচল টেনে নিজেকে আবৃত করল।
তারপর অকস্মাৎ ঘরে একজন পুরুষকে দেখে থমকে গেল বর্ষা। বড় হওয়ার পর নিজের বাবা, ভাই, চাচাদের ছাড়া খুব বেশি লোকের সামনে কখনো যায়নি সে।

এদিকে নাব্য তখন ভীষণ গম্ভীর। ঘরে অন্যকারো উপস্থিতির পরোয়া না করে আলমিরা খুলে পোশাক নিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে গেল। তার মিনিট দশেক পর শুধু একটা ট্রাউজার পড়েই বেরিয়ে সোজা রওনা হলো পাশের লাইব্রেরি রুমে। লাইব্রেরি রুমে যাওয়ার একটাই পথ। সেটাও এই ঘরের মধ্য দিয়েই। ঘরটা নাব্যর লেখালেখির সুবিধার্থে শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া রাখা হয়েছিল। দুই ঘরের মাঝে নেই কোনো দরজা। শুধু একটা সফেদ পর্দা ঝোলানো।

বর্ষার মুখের ওপর পর্দা টেনে দিয়ে নাব্য সেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বর্ষা বসে রইল কিয়ৎকাল। যে সুপুরুষ লোকটি এতক্ষণ বিচরণ করে বেরালো ঘরজুড়ে সে-ই কি বর্ষার স্বামী! এত সুন্দর! একেবারে বর্ষার মনের মাপসই।
কিন্তু স্বামীই যদি হয় তবে বর্ষার দিকে একবারের জন্য তাকালে তার কি অসুবিধে ছিল! ঝড়ের বেগে এসে, ধুপধাপ নিজের কাজ করে আবার ঝড়ের বেগে চলে গেল। এঘরে যে আরও একটি প্রাণীর অস্তিত্ব আছে সেকথা যেন সে জানেই না!

বর্ষার এলোমেলো লাগছে সবকিছু। এই লোকটাই তার বর এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কিন্তু আর কে সারা রাত শেষে, এই সাতসকালে এঘরে এসে এভাবে হানা দেবে অকস্মাৎ!

বর্ষা উঠে দাঁড়াল। একবার ভাবল উঁকি দেয় পাশের ঘরে। কিন্তু মনোভাব পালটে ফেলল। যা কটমটে মেজাজ দেখল লোকটার। যদি বর্ষাকে এক ধমক দিয়ে বসে!

ভীষণ অস্থিরমতি বর্ষার সময় কাটানো এক দুঃসহ ব্যাপারএ পরিনত হলো। কোনো ভাবেই সময় আর কাটছে না। এক সুটকেস বোঝাই বই গুছিয়ে বাড়িতে ফেলে আসতে হয়েছে। বাবা বলছিল প্রথম যাত্রায় শশুরবাড়িতে এসব নিয়ে গেলে লোকে আড়ালে মন্দ কথা বলবে। শুনে বর্ষা বাধ্য মেয়ের মতো নামিয়ে রেখেছিল সুটকেস টা। মনের কোণে একটা ভাবনাও ঢেউ খেলে গেছিল। সত্যিই তো! সে নবোঢ়া মেয়ে মানুষ। শশুর বাড়িতে এত লোকের সামনে বই হাতে বসে থাকা কি তাকে মানায়? আর সে সময়ই বা তার হবে কই! নতুন স্থান, নতুন বন্ধন। কতশত ব্যাস্ততা সেসব ঘিরে। ইশশ্ এখন মনে হচ্ছে বড্ড ভুল ভেবেছিল সে। কেউ তাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না এবাড়িতে! কাল রাতে সেই যে শাশুড়ী মা তাকে এখানে বসিয়ে রেখে লাপাত্তা হয়েছেন। আর তো খোঁজ নেননি।
বলতে বলতেই বর্ষার শাশুড়ী দরজায় কড়া নাড়ে।

আর কিছু না ভেবে বর্ষা সেদিকে পা বাড়ায়। দরজা খুলে সালাম জানায় শাশুড়ীকে। সালামের জবাব দিয়ে কেমনতরো দৃষ্টিতে একবার বর্ষাকে দেখে নিয়ে রাফিয়া তথা নাব্যের মা একটা প্যাকেট বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দেন। রাশভারী গলায় বলেন,
-“ফ্রেশ হয়েছো? ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ে ফেলো। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি। তোমার দাদি শাশুড়ী তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওনার কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে। জলদি কোরো। ”

বর্ষা মাথা নাড়ে। রাফিয়া চলে যেতে গিয়েও আবার পেছন ফেরেন।
-“নাব্য কোথায়? ঘুমোচ্ছে এখনো? ”
কয়েক মুহূর্ত কি বলবে ভেবে পায় না বর্ষা। তারপর কিঞ্চিৎ থেমে কিছু না বলে স্রেফ মাথা নাড়ে।

রাফিয়া চলে গেলে বর্ষা হঠাৎ চিন্তিত হয়। তখন শাশুড়ী মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ভালো করে কিছু না ভেবেই সে মাথা নেড়েছে। পাশের ঘরে লোকটা কি করছে? সত্যিই ঘুমোচ্ছে তো? তা যদি না হয়! একটা মিথ্যে কথার দায় বর্ষার জীবন খাতায় এসে যোগ হবে নতুন করে।
বর্ষা হঠাৎ একটা কাজ করল৷ প্যাকেট টা নামিয়ে রেখে চট করে একবার উঁকি দিল পাশের ঘরে। নাহ! কোনো সন্দেহ নেই। লোকটা সত্যিই ঘুমোচ্ছে। তবে সোফায় উপুড় হয়ে। এটা খুব খারাপ। উপুড় হয়ে তো শয়তান ঘুমায়। লোকটা কি সেকথা জানে না? বর্ষার মুখভার হলো। সে ঠিক করল তাদের মধ্যে যখন ভাব হয়ে যাবে, একদিন সে লোকটা কে বলবে যেন উনি আর কখনো এভাবে না ঘুমায়।

ফ্রেশ হয়ে বর্ষা শাশুড়ীর দেয়া লালচে খয়েরী রঙা জামদানী শাড়িটা পড়ল। কিঞ্চিৎ আদ্র চুলগুলো হাত খোঁপায় বেঁধে নিয়ে মুখ ফেরাল আয়নায়। সেখানে প্রতিবিম্বিত হওয়া মুখটি যেন একটি আস্ত আরক্তিম পুতুল! দোহারা প্রাংশু দেহে, গোলগাল মুখখানা একেবারে মানানসই। পুতুপুতু বাদামি ভাসা চোখজুড়ে রাজ্যের ভ্রুকুটি। কিন্তু নিজের রুপে বর্ষাকে সন্তুষ্ট মনে হলো না। কি একটা যেন বাদ পড়েছে। ভ্রু কুচকে আয়নায় তাকিয়ে রইল সে একদৃষ্টে। আচমকা সেখানে আরও একটি কায়া প্রতিবিম্বিত হলো। বর্ষা এতটা চমকালো যে চোখ সরাতেও ভুলে গেল। আয়নার মধ্যে দিয়ে চারচোখ এক হলো। নাব্যর চোখদয়ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হয়ে উঠল স্বৈরাচারী। সে ভুলে গেল চোখ সরাতে। মেয়েটিকে সে এর আগে কখনো দেখেনি। আজ সকালে প্রথম যখন ঘরে এলো তখনো না।

দুজনের ঘোর ভাঙ্গল দরজার কড়াঘাতে। রাফিয়া ভেতরে আসার আগেই নাব্য ফ্রেশ হতে চলে গেল। বর্ষা যেন কটাক্ষের কারাগারে রুদ্ধ হয়েছিল। এবার সে হাফ ছেড়ে বাঁচল।

চলবে……..

★অদ্রিজা আশয়ারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here