একদিন নববর্ষা -২০,২১

0
215

একদিন নববর্ষা -২০,২১
অদ্রিজা আশয়ারী
২০

রাফিয়ার সঙ্গে দাদি শাশুড়ীর ঘরে এসে বর্ষা প্রথমেই দাদিকে সালাম জানাল। সালামের জবাব দিয়ে দাদি শাশুড়ী সহাস্যে তাকে টেনে বসান বিছানায়, নিজের কাছে। মাথার আঁচল ফেলে মুখটা টেনে নিয়ে আচমকা বিষম একটা চুমু খান কপালে। সঙ্গে সঙ্গে ফিক করে হেসে ওঠার শব্দ। বর্ষা লজ্জাজরিত চোখে সেদিকে তাকায়। দাদি শাশুড়ীর পুরনো আমলের পালঙ্কের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে হাসছে এক কিশোরী। এই মেয়েটিকে সে চেনে। তার ছোট ও একমাত্র ননদ নিতিন। ভীষণ সুন্দর পাখির মতো ছটফটিয়ে মেয়ে। কাল যখন প্রথম মেয়েটিকে দেখেছিল। মনে হয়েছিল যেন একটু অহংকারী। আজ মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না।

দাদির যে নাতবউ পছন্দ হয়েছে সেকথা বলাই বাহুল্য। নানান কথার পর বর্ষাকে নিতিনের কাছে বসিয়ে তিনি সহসা বেরিয়ে গেলেন। নিতিনের সঙ্গে বর্ষার প্রত্যক্ষ পরিচয় এখনো ঘটেনি। ঘর ফাঁকা হতেই তাই সে জড়তা কাটিয়ে কথা বলার অভিপ্রায়ে নিতিনের দিকে ফিরল।

–“আসসালামু আলাইকুম। ”

জবাব দিতে নিতিনের কিঞ্চিৎ দেরি হলো। জবাব দেবে কি, সে বিস্ময়েই হা। তার থেকে বয়সে এবং সম্পর্কে বড় একজন তাকে সালাম দিচ্ছে! তার ওপর মেয়েটির সম্পর্কে তার মনোভাব ঠিক ইতিবাচক নয়। অন্তত দা ভাই যেখানে অন্য একজনের প্রতি এখনো অনুরক্ত ভীষণ ভাবে। সেখানে এই মেয়েটির এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসাটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছে না তার ঝোড়ো মন।

নিতিন আরম্ভিক গলায় জবাব দেয়। তারপর আবার চুপ।
বর্ষাই ফের কথা শুরু করে। প্রীত স্বরে মৃদু হাসির ঝংকার তুলে বলে,
–” তোমায় কি মিষ্টি দেখতে! একদম কিচিরমিচির চড়ুই ছানার মতো। ”

নিতিন এবারও কিঞ্চিৎ অবাক হয়। কারণ এই মেয়েটির কথার ধরন একেবারে দা ভাইয়ের তাদৃশ! ছোট কাল থেকেই দা ভাই সবসময় ওকে পাখির সঙ্গে আনুরূপ্য করেছে। আর কেউ কখনো নয়। কিন্তু আজ এই মেয়েটিও সেকথাই বলল ঠিক দা ভাইয়ের সুরে।

নিতিন বর্ষার চোখে চেয়ে ইষৎ হাসে। ভালো করে খেয়াল করে দেখে মেয়েটিকে। একেবারেই অনাড়ম্বর, সাদাসিধে মেয়ে। দা ভাইয়ের বর্ষার ধারে-কাছে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই এর। ছবিতে দেখেছিল সে বর্ষাকে। সেই বর্ষার ধারালো সৌন্দর্যের কাছে এই মেয়ের আড়ম্বরশূন্য সরল মুখখানা যেন কিছুই নয়।
তীক্ষ্ণ নাসা, ডাগর চোখ, আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। তার ছয় ফুট এক ইঞ্চির দা ভাইয়ের চিবুক ছুই ছুই ছিল বর্ষার উচ্চতা। দেহকান্তি অনন্য সাধারণ!
অথচ এই মেয়েটি লম্বায়ও খুব বেশি নয়। বড়জোর দা ভাইয়ের বুক পর্যন্ত পৌছাবে হয়তো।
তাছাড়া এসব কিছুর ঊর্ধ্বে যে ব্যাপার টা মুখ্য তা হলো দা ভাই এখনো ওই বর্ষাতেই পুরোদস্তুর ডুবে আছে। সে জানে। দা ভাইকে সে মায়ের মতো বোঝে। ঠিক সেভাবে, ছোট কালে দা ভাই তাকে যেভাবে বাবার মতো বুঝতো, ভালোবাসতো।

দাদি ফিরলেন। পেছনে হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে এলো নাব্য। বিরক্তির আতিশয্যে কুঞ্চিত তার মুখের সকল রেখা। দাদি তাকে জোর করে টেনে বসালেন বর্ষার পাশে। একপাশে নাব্য আর অন্যপাশে নিতিন। মাঝখানে পড়ে বর্ষার বেহালদশা। এই প্রথম বরের খুব কাছে বসেছে । লজ্জায় সে এতটুকু হয়ে গেল। নাব্যের মুখ দেখে মনে হল তাকে যেন এইমাত্র একগ্লাস নিমপাতার রস জোর করে গেলানো হয়েছে। বেচারা সইতেও পারছে না, উগড়ে ফেলে দিতেও বাঁধছে। তাই বসে আছে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে। মুখ ভীষণ গম্ভীর!

নিতিন আচমকা জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল। গিয়ে দাঁড়ালো দাদির পাশে। দাদি কপোত-কপোতীদয়কে একসঙ্গে মনভরে দেখলেন। খুশিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল মুখখানা।
নিতিনের ভীষণ হাসি পেল। মনে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো নববিবাহিত দম্পতি তার সামনে বসে আছে। দুজনেরই চোখ মাটির দিকে, দুজনেই ভীষণ গম্ভীর, অস্বস্তিতে কাঠ! এবার শুধু দা ভাই মুখে একটা রুমাল চাপা দিলেই বেশ হতো। তারপরের দৃশ্যটা একটা সাদাকালো ছবির ফ্রেমে আটকে রাখতে পারলে…..। নিতিনের মাথায় আচমকা নতুন ভূত চাপল। দৌড়ে বেরিয়ে গেল তার ছোট ক্যামেরাটা আনার উদ্দেশ্যে। দাদিও অকস্মাৎ নিজ জায়গা ছেড়ে চললেন আলমিরার কাছে। নাব্যর অস্বস্তি বাড়ল। আর বর্ষার আড়ষ্টতা।

দাদি এতক্ষণ আলমিরার কাছে কি করছেন কে জানে! বর্ষার মনে হচ্ছে যেন তিনি ইচ্ছে করেই ফিরছেন না। যতই হোক না বর। তবু এভাবে পাশাপাশি বরের গা ঘেঁষে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। অবশ্যি ভালো যে একটুও লাগছে না তা বললে মিথ্যে বলা হবে। মনের ভেতর বহুদিন বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা ঘাসফড়িং গুলোর হঠাৎ যেন আগল খুলে দিয়েছে কেউ। একে একে ছাড়া পেয়ে ঘাসফড়িং গুলো এলোমেলো হয়ে উড়তে শুরু করেছে মনের আকাশে। এই বিচিত্র অনুভব বর্ষার জীবনে একেবারেই নতুন। আনকোরা হৃদয়ে তা আনন্দের অন্য এক সুর বাজিয়ে যাচ্ছে। একটা পুরুষালি ঘ্রাণ এসে বাড়ি খাচ্ছে নাকে। তার কেমন শীত শীত করছে। উষ্ণ ভালোলাগার এক নিঃসীম স্রোতে ডুবে আছে সে। এমন আর কখনো হয়নি।

ঠিক তখুনি দাদি ফিরলেন। হাতে একটা কাঠের গয়নার বাক্স নিয়ে। সেটা থেকে একটা হাল ফ্যাশনের, পাথর বসানো ভারি সোনার আংটি তিনি নাব্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-“নাতবউয়ের হাতে এইডা পড়ায়া দে।”

কথাটা যেন বোধগম্য হয়নি। নাব্য এমন ভাবে তাকাল দাদির মুখে।
-“হা কইরা আসস কেন? মনে হইতাসে যেন পরের বউরে জাবরায়া ধরবার কথা কইছি! তাড়াতাড়ি পড়ায়া দে।” শেষটায় দাদি ধমকে উঠলেন।
অগত্যা নাব্য পানসে মুখে দাদির কথা মান্য করতে বাধ্য হল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রোষপূর্ণ ভাবে অনেকটা অন্ধের মতো হাতড়ে বর্ষার হাত টেনে আঙ্গুলে আংটি পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঘস্বরে বলল
-” দাদি, এক্ষুনি একবার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। আমি এখন আসছি। ” বলে আর এক মুহুর্ত রইলো না সেখানে।

নাব্য চলে গেল। ওর গমনপথে চেয়ে হঠাৎ অবিদিত এক যাতনায় মর্ম সংকুচিত হয়ে এলো বর্ষার। হৃদয়ের এই অপরিচিত অবস্থার নাম সে জানে না। এসব অনুভূতির সাথে জীবনে এই তার প্রথম পরিচয় !

***

রাফিয়া পুরো ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধান্বিত বোধ করছেন। কার্যত কিছু সুক্ষ্ম বিষয় মাথায় রেখেই তিনি নাব্যর বিয়ে নিয়ে এমন তাড়াহুড়ো করেছেন। মেয়ের পারিবারিক অবস্থান নিজের অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও।
এক্ষেত্রে তিনি বড় ভাইয়ের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। রাফিয়ার ভাই রফিক জর্জ কোর্টের নামি উকিল। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নাব্যর বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউকে পাশে প্রয়োজন। এমন কাউকে যে কিনা নাব্যের অতীত দূর্ঘটনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না কখনো। বরং ক্লেশহীন ভাবে, বিনা শর্তে তার পাশে থেকে, তাকে সুস্থ মননে ফিরতে সহযোগিতা করবে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। উচ্চশিক্ষিতা, ধনী পরিবারের মেয়ের পক্ষে যেটা আদতেই অসম্ভব। সে মেয়ে বিনা সার্থে ভালোবাসবে না, আর না আগলে রাখবে নাব্যকে। সর্বদা বিনিময় চাইবে। তার অনেক চাহিদা, মর্জি, খেয়াল থাকবে। যেগুলো অপূরণ থেকে গেলেই দাম্পত্য কলহ ধীর পায়ে এগিয়ে আসবে ওদের জীবনে। তাছাড়া নাব্যের বর্তমান মানসিক হালচাল বেজায় নড়বড়ে। এই নিয়েও প্রশ্ন উঠবে বিস্তর….। অতএব এমন কাউকে প্রয়োজন যার চাহিদা কম, পায়ের নিচের মাটি দূর্বল। ঠিক এই কথাটা ভেবেই রফিক খুঁজে বের করেছেন বর্ষাকে। মেয়েটির পরিবার নিম্ন মধ্যবিত্ত। বয়স বেড়ে গেছে বিধায় বাবা চাকরি খুইয়েছেন। ভাইটি সবে পড়া শেষ করে ঢুকেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে৷ বেতন অল্প। ইতোমধ্যে বিয়ে করেছে। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। মাসের শেষে আয়কৃত সামান্য অর্থ দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। মেয়েটি তাদের ঘাড়ে একরকম বোঝার মতো চেপে ছিল। সেই মুহুর্তে রফিক প্রস্তাব করলেন সমাজের এমন উচ্চশ্রেণির একটি পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক গড়ার জন্য। রফিক বর্ষার পরিবারকে আগে থেকেই চিনতেন। বর্ষা মেয়েটির রুপ গুনের প্রসিদ্ধি পুরো এলাকাজোড়া!
বর্ষার বাবাও আর অমত করলেন না। অমত করার মতো আসলে কিছু ছিল না। তার মেয়েটির যে এমন পরিবার থেকে বিয়ের সম্মন্ধ আসতে পারে এ কথাই তিনি ভাবেননি কোনোদিন! অতএব অচিরেই সবকিছুর ব্যাবস্থা হয়ে গেল। বর্ষা বাঁধা পড়ল এক দুর্বোধ্য, জটিল সমীকরণে। যার নাম নাব্য!

_____________________

নাব্যর কথা :
————–

আকাশে অশনিপাত! মেঘ গম্ভীর চারিধার। ছাইবর্ণ জলীয় মেঘে মেঘে সমাকীর্ণ আকাশের মধ্যিখান। ঘর অন্ধকার। খোলা বাতায়ন পেরিয়ে আসছে শীতল উত্তরে সমীরণ। মুহুর্তে গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমার। সন্ধ্যা লগ্নে বারান্দার কিনারায় দাঁড়িয়ে আমি আসু আগমনী বর্ষণের অপেক্ষা করছি। ঘনঘোর বর্ষণের এই ভাষা পূর্ণ রুপ আসলে অনেক কিছু বলে যায়… । অনেক গোপন ব্যাথা, না বলা কথা, চিরতরে হারিয়ে যাওয়া অনেক স্মৃতি….. তারা সবাই ফিরে আসে এই আষাঢ়ে ক্ষণে। ভিজিয়ে দিয়ে যায় বুকের শুষ্ক ঊষার মরুপ্রান্তর। আমার বুকেও সেই ভেজা স্মৃতির প্রলেপ। কিছু স্বপ্ন সময়ে’রা, সেসব যেন অন্য এক জনমের কথা। শুধু আমার আর বর্ষার কথা……

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে_
মনে হয় যেন শত জনমের আগে _
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে ‘

সেদিনও ছিল এমন বর্ষণমুখর রাত্রি। রাত্রিটা আশাহীন করে সদ্য লেখা উপন্যাসের পৃষ্ঠা গুলো গুছিয়ে জানালার পাশে এসে বসেছি বৃষ্টি দেখতে। সে বৃষ্টি দেখার মতো বৃষ্টিই ছিল বটে। গরানবনে যখন বৃষ্টি নামে, তা যেন একেবারে আকাশের কোনো এক ভিন্ন প্রান্তর থেকে নেমে আসা বারিদকণা। এত সবুজের ঘ্রাণ, মাটি থেকে জেগে ওঠা সোঁদা গন্ধ, ঝিঁঝি পোকাদের ডাক, বাতাসের বেগে গাছের পাতা ঝাপটানি যেন আর কোথাও নেই। বৃষ্টির তালে তালে প্রকৃতির এই আদিম নৃত্য যেন কেবল গরানবনেই সম্ভব!

এমন গাঢ় বৃষ্টির রাতে বারান্দায় কারো পদধ্বনি শুনলাম। গায়ে শিহরণ জাগল। এই বৃষ্টির রাতে কে আসতে পারে? দোর খুললাম। বিস্ময়াভিভূত হয়ে চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ সামনে উপস্থিত মানবীর দিকে। সে তখন খিলখিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। চোখে দুর্বোধ্য রহস্যের ইঙ্গিত!
মুখ ফুটে প্রথম যে শব্দ বেরুলো,
-“একি! পাগল হয়ে গেছ তুমি! এতো রাতে, এই বৃষ্টির মাঝে কিভাবে, কেন এলে……”

সে আমার মুখের কথা কেড়ে নিল। পরোয়াহীন হয়ে বলল
-“এমনি! ”

আমার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
-” এমনি মানে? এমনি কেউ এতো রাতে বৃষ্টিতে ভেজে? তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজে এদ্দূর……. ”

সে কেন যেন হঠাৎ বিষম রেগে উঠল
-” তাইলে চলি যাই?”

-“আমি কি সেকথা বলেছি? কিন্তু এভাবে আসাটা কোনো ভালো কাজ হয়নি। তোমার আম্মা দেখেনি তোমায়?”

সে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসল।
-” দেখিছে। তবে কিছুই বলেনাই। এমনেই আমি মাঝে মধ্যে রাইতে বৃষ্টিতে ভিজি। আম্মা সেই কথা জানে।”

আমার ভীষণ রাগ হলো। এতো রাতে একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে একা এদ্দূর আসার সাহস করবে কেন?
-” আশ্চর্য! তোমার ভয় করল না? যদি কোনো বি…..”

সে রেগে আগুন হলো। কণ্ঠে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝরিয়ে বলল,
-” ধুর.. আর থাকমুই না এইনে। থাকেন আপনি আপনের ভীতু মন নিয়া। আমি গেলাম।”

-“আরে! সত্যি চলে যাচ্ছ নাকি? আমি তো এমনেই…. শোনো…. কথা শোনো বর্ষা।”

সেই গোমড়া মুখো মেঘকন্যা পেছন ফিরে, তার তির্যক দৃষ্টি হেনে আমাকে বিদ্ধ করল। শুকনো ঢোক গিলে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম আমি। কত সময় পেরোলো কে জানে!

হঠাৎ মনে হলো মেয়েটির সাথে এই একক ঘরে বন্দি আমি যেন ভীষণ অসহায়। ভয়ংকর কিছু ঘটে গেলে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। অথচ বর্ষাকে মনে হলো নির্বিকার। সে কি এই একলা ঘরেও আমাকে একটু ভয় পাচ্ছে না?

দুরূহ এই পরিস্থিতিকে কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য কোনো একটা অজুহাত খুঁজতে লাগলাম। তারপর আচমকাই মনে পড়ল বর্ষা বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। কাপড়ের স্তুপ থেকে আলগোছে টাওয়েল তুলে নিয়ে বর্ষার মাথায় চেপে ধরলাম। অধৈর্য স্বরে বিরক্তি ঝরিয়ে বললাম,
-“মাথা মোছো তাড়াতাড়ি। জ্বর না বাঁধিয়ে দেখছি ছাড়বে না। ”

বর্ষার মুখ দেখে মনে হলো আবার রাগতে শুরু করেছে মেয়েটা। দ্রুত বললাম,
-” আ….ব….গরম চা খাবে? আমি কিন্তু দারুণ চা বানাই!”

ঘরে একটি মাত্র পিদিম নিভু নিভু জ্বলছে। বাইরে তখনো আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির রেশ যেন আমাদেরও ঘরজুড়ে। বর্ষা আমার পাশে বসে খামখেয়ালি চোখজোড়া জানালায় রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিল। টাওয়েলটা তার গায়ে চাদরের মতো জড়ানো। জানালা সংলগ্ন টেবিলে থাকা একটা খোলা বইয়ের পাতা মাঝেমাঝে ফরফর করে উড়ছে, উলটে যাচ্ছে পৃষ্ঠা। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট কখনো কখনো এসে শীতল হাতে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাদের। বর্ষা সেদিকে চেয়ে অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে বলল,
-” কি সুন্দর! ইশশ্ এই সময়টারে যদি কোনোভাবে বাঁইধা রাখতে পারতাম! ”

সে’ সময়ের মুগ্ধতায় আটকেছিল। আর আমি তার মুগ্ধতায়। সেদিন পৃথিবীর মাঝে থেকেও
‘কেউ নেই, কেউ নেই আমি তুমি ছাড়া_’
এমন নিগূঢ় ভাবে একা হয়েছিলাম আমরা।

(শিরোনামের কবিতা – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।)

______________________

সেই রাতের, সেই সময়ের ছবি যুগযুগ ধরে থেকে যাবে হয়তো আমাদের হৃদয়ে গহরে। না! আমাদের নয়। কেবল আমার হৃদয় গহরে। সে তো ভুলেছে সবই..।

তখনি বুক চিরে হাহাকারের একটা কঠিন জোয়ার যেন ঢেলে বেরোতে চাইল। বর্ষা! আমার বর্ষা, কোথায় গেল সে? আমার বুকের ভেতর টা চিরে, সমস্ত জীবন সুধা শুষে নিয়ে সে হারিয়ে গেল! একবারও কি ভাবলো না এই জীবন সুধা ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো?
প্রতি রাতে যখন দুঃস্বপ্নরা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, আমি অতন্দ্র প্রহরীর মতো অহর্নিশ জেগে থাকি, পাশে কাউকে একটা খুঁজি, একটা বিশ্বস্ত হাত।
আমার শ্বাস প্রশ্বাস তখন থমকে আসে। বুকে হয় ভীষণ তীব্র হাহাকার। কোনদিন কি সেই সময়ে, সেই মধ্যরাতের কালহরণে, বর্ষা একটা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের বাতাস টের পায় না?
বর্ষাকে কি আমার হাহাকারের ঊষ্ম নিশ্বাসেরা স্পর্শ করে না কখনো?

নিষ্ঠুর, কৃতঘ্ন…
আমার আকাশ, বাতাস জুড়ে করা এতো নালিশও বর্ষার মনকে টলাতে পারলো না?
লেখলেই কি কেউ অমানুষ হয়ে যায়?
তবুও যদি যদি বলত, ‘নাব্য, তুমি আর কোনদিন লেখবে না।’
সত্যিই আমি আর লিখতাম না। আমার হৃদয়ে পুষে রাখা সমস্ত কাব্যকে বর্ষার এক কথায় আমি টেনে হিচড়ে বের করে পুড়িয়ে দিতাম মহাঅনলে। তবুও বর্ষা ফিরুক। একবার পেছন ফিরে তাকাক। দেখুক নাব্য কতটা পুড়ছে তাকে ছাড়া….

চলবে……
অদ্রিজা আশয়ারী

একদিন নববর্ষা -২১
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

রাফিয়া বুঝতে পারছেন ছেলে বউয়ে বনিবনা হচ্ছে না। নাব্য এখনো অবগাহন করে সেই বর্ষা নামক নদীতে। যে নদী তার ক্ষুরধার স্রোতে পলে পলে নাব্যকে কেবল আরও অতলে টেনেছে। এতটা দূর্বল করেছে যে আজ সে মাথা উঁচু করতে গিয়ে বারবার ঠেকে যাচ্ছে।
নাব্যর মন, স্মৃতি, মস্তিষ্ক সর্বত্র জুড়ে এখনো ওই একটি নারীর বিচরণ! তবে কোনো এক সময় হয়তো নাব্য বেরিয়ে আসবে পুরনো স্মৃতির সেই অর্ঘ্য রোমন্থন থেকে। এই মেয়েটির সঙ্গে আর পাঁচটা যুগলের মতো সেও একটা নিয়মমাফিক স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কে আবদ্ধ হবে। এ তিনি মনে প্রাণে আশা করেন।

ছেলে বউয়ে যে সখ্য গড়ে ওঠেনি। এই ব্যাপার টা আড়ালে রাখার জন্য প্রথম থেকেই রাফিয়া যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন। বিয়ের দুদিন পর বৌভাতের আয়োজন করা হলো। বাড়ি ভর্তি লোকজন। বিয়ে বিয়ে একটা ঘ্রাণে ভুরভুর করছে চারিধার। সেখানেও তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। এবং শেষে পুত্রবধূর নওয়ারি ফেরার সময় নাব্য যখন কঠিন ভাবে রায় দিলো সে যাবে না। সেই ঘটনাও তিনি সযত্নে ধামাচাপা দিলেন।
অতঃপর বিয়ের তৃতীয় দিনে একরাশ ভোতা, কর্দয অনুভূতির শূন্য ঝুরি নিয়ে বর্ষা ফিরে গেল তার জীর্ন কুটিরের সুখঠাঁইয়ে।

***

বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে ফিরল সে। নাব্যর ব্যক্তিগত কালো টয়োটা ল্যান্ড ক্রুইজারটা ওকে পৌঁছে দিয়ে গেল বাড়ি পর্যন্ত। অবশ্যি পুরোপুরি বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারেনি গাড়িটা। গলিটা সরু, বিধায় ওটাকে থেমে যেতে হয়েছিল মাঝপথে। বাকি পথটুকু হেটে ফিরেছে বর্ষা। পেছনে বাবা, ভাই, রশু আর ড্রাইভার এসেছে হাতভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে। কয়েক দফায় এনে সেই বাজার রাখা হলো বর্ষাদের বাড়ির উঠোনে। রাফিয়া সকালেই রশুকে পাঠিয়ে বাজারকার্য সমাধা করেছিলেন। সেই বাজার পৌছানোর দায়িত্বও দিয়ে পাঠানো হয়েছে রশুকে।
পুরো এলাকায় ঢিঁ-ঢিঁ পড়ে গেল। বর্ষার কপাল দেখে ঈর্ষান্বিত হয়নি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। সকলের চোখ ছানাবড়া।
সারাজীবন আড়ালে আড়ালে মুখ লুকিয়ে বেরানো অন্তঃপুরবাসিনী মেয়েটা হঠাৎ কিসের জোরে, কোন বিশেষ যোগ্যতার বলে ওমন বাড়ির বউ হয়ে গেল ভেবে পায় না কেউ!

অভাবে স্বভাব নষ্ট।
এই প্রবাদটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রাখা অমূলক। গরিব মাত্রই তারা বড়লোক হতে চায়। তাদের কাছে সুখী হওয়ার একমাত্র মূলমন্ত্র প্রচুর টাকার মালিক বনে যাওয়া। জীবনে টাকা ছাড়া সুখের কোনো অস্তিত্ব নেই।
ঠিক এইরকম একটা মনোভাব বড়লোকেরাও পোষণ করে। তাদের কাছে সুখই সব। সুখের হাতছানি কখনো টাকা দিয়ে পাওয়া সম্ভব না। অর্থাৎ জীবনে সুখ ছাড়া কেবল টাকার কোনো মূল্য নেই।

স্বভাবতই বর্ষার মা নাসিমা প্রথম দলে পড়েন। তিনি মেয়েকে দামি গাড়ি থেকে নামতে দেখে, আর তারপর কালো বসন অর্থাৎ বোরকার আড়ালে অঙ্গে জড়ানো দামি সিল্ক শাড়ি, কানে ভারি দুল, হাতে মোটা বালা। এসবের সঙ্গে আবার এত এত বাজার! বাজারে এমন সব জিনিস, যেসবের নাম পর্যন্ত জীবনে কখনো শোনেননি তিনি! সব দেখে নাসিমার চোখ ঘুরিয়ে পড়ে যাবার যোগার হলো।

বর্ষার সারা গা আভিজাত্যের আতিশায্যে ঝলমল করছে। বুনোফুলের মতো কোমল সুগন্ধি জর্জরিত গায়ে ফিনফিনে গোলাপি সিল্ক শাড়িটা ওকে অপ্সরাতুল্য করে তুলেছে। জীবনে কখনো কানে একটা সামান্য সোনার দুল পড়ার সুযোগ যেখানে হয়নি। আজ সেখানে মেয়েটার গা ভর্তি সোনা! বর্ষার মা মেয়েকে দেখে খুশি না হয়ে পারলেন না।

যদিও বৌভাতের অনুষ্ঠানে তারা সপরিবারে গেছিলেন। তবে সেখানে নাসিমা বর্ষার সাথে দু-দন্ড একা হতে পারেননি। ওবাড়ির লোকজনেরাই ওকে ঘিরে ছিল সবসময়। তার ওপর ক্ষমতাবান বেয়ানকে কিছু বলতেও তো মুখে বাধে। তাই তিনি অপেক্ষা করেছেন মেয়ের বাড়ি ফেরার। নিজেও অনুষ্ঠান শেষে বিনা বাক্যব্যয়ে পুত্রবধূ ফাবিহাকে নিয়ে ফিরে এসেছেন।

নাসিমার কাছে কোনোকালে বর্ষার বিশেষ মূল ছিলনা। এই মেয়েকে দিয়ে কিছু হবে এমনটা জীবনে কোনোদিন আশা করেননি তিনি। সর্বদা লোক-চোখের অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করত বর্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বই পড়া আর ধর্মীয় কাজকর্মে বর্ষার আগ্রহ ছিল বেশি। মেয়েকে জোর করেও একটু সাজিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে পারেন নি কখনো। কালো একটা পোশাককেই নিজের নিত্যসঙ্গী করে নিয়েছিল সে। ভীষণ সাধাসিধে, আটপৌরে জীবন কাটাতো মেয়েটা। বর্ষার মায়ের ভয় ছিল মেয়ের জন্য। ভেবেছিলেন বুঝি শেষতক মেয়েটার একটা মোটামুটি ঘরে হলেও বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না। আজকের যুগে এমন সেকেলে মেয়েকে কে বিয়ে করে! সবাই তো অপ্সরী খোঁজে। শিক্ষিতা, আধুনিক অপ্সরী!

নাসিমা অনেকক্ষণ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে রইলেন। অজস্র চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন সারা মুখ। ফাবিহা খাবার গোছাতে গোছাতে সেদিকে আড়চোখে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। যেই না মেয়ের বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে, অমনি বাবা মায়ের তার জন্য দরদ উথলে উঠেছে!
কই? আগে তো মেয়ে সারাদিন না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকলেও তারা পরোয়া করতেন না। অথচ এখন দেখো! আসার পর থেকেই মেয়েকে কেমন স্তুতি করে যাচ্ছে।
কি খাবি, আহারে দুইদিনেই একদম শুকায়ে গেছিস, একটু জিরায়া নে, ঠান্ডা শরবতটা তো একটু মুখে দে…..কত ঢঙের কথাই বলছে দেখো! ন্যাকামি দেখে ফাবিহার গা জ্বলে যায়!

***

বর্ষাদের বাড়িটা সাভারে। একেবারে জাঁকজমকপূর্ণ শহর নয়। কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশেই বলা চলে। নাসিমার কাছ থেকে ছাড়া পেয়েই বিকেলে বর্ষা ওদের একতলা ছোট বাড়িটির ছাদে উঠে গেল। বাড়ির আশেপাশের জায়গা জুড়ে বিস্তীর্ণ খোলা ভূমি। অনেক অনেক পুকুর। বাড়িগুলো একটি অপরটি থেকে ভীষণ দূরে দূরে। অপূর্ব মনোরম এক পরিবেশ সবকিছু মিলে। একসময় রাত্রিদিন পাখির মতো ফুড়ুৎফাড়ুত এই ছাদে এসে বসে থাকত সে। সঙ্গে থাকতো কোন ঔপন্যাসিকের লেখা প্রিয় বই বা নবিজির(সা:) জীবনী গ্রন্থ। হেমন্তের বাতাস কিংবা শরতের মেঘখণ্ড। প্রকৃতির সব রূপেই বর্ষা মুগ্ধ হতো ভীষণ!

ক্ষুদ্র ছাদটা তিলে তিলে নানারকম গাছে সাজিয়েছে সে। রোজ নিয়মিত পানি দিত গাছগুলোয়। খেয়াল করে দেখল। সব গাছের মাটি শুকিয়ে কাঠ। এই তিনদিনে এক ফোঁটা পানি পড়েনি ওদের গায়ে!
বর্ষা ব্যস্ত হয়ে পড়ল গাছগুলোর সিঞ্চনকাজে। সহসা কাজে বাঁধা পড়ল মিরার আগমনে। মিরা বর্ষার ছোট কালের বন্ধু। এক পাড়াতেই বাড়ি। বিধায় যোগাযোগ টা এখনো অক্ষুণ্ণ। মিরা এসেই নানান কথার পর শুধালো,
-” নওয়ারি তে একা ফিরলি যে! তোর বর এলো না কেন? নাকি আমাদের নজর থেকে হেফাজতে রাখার জন্যই ফেলে এসেছিস?”

হাসিখুশি বর্ষার মনে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো মুহুর্তে। এই প্রথম একটা ব্যাপার ওকে ভীষণ পোড়াতে লাগল। সত্যিই তো! বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়ি ফেরার সময় সব মেয়ের সঙ্গেই তো বর থাকে। অথচ সে ফিরেছে একা। একদম একা। এর চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের তিনদিন পেরিয়ে গেলেও বর্ষার সঙ্গে এখন পর্যন্ত একটি বাক্য বিনিময় করেনি ওর বর! মিরা কি সেকথা জানে? জানলে সে কি বলত ?
সে কি বলত, “আরে! এমন তো হয়ই! ভালোবাসার মতো জটিল ব্যাপার কি একদিনে হয়ে যায় নাকি! ভালোবাসা হলো চরকায় সুতো কাটার মতো। ধৈর্য নিয়ে, খুব ধীরে, পলে পলে পা বাড়াতে হয়। তাতে কত বাঁধা, কত অসংহত সময়ের মুখোমুখি যে হতে হয়….। তবুও চেষ্টা করে যেতে হয়। তবেই না সত্যি ভালোবাসার দেখা মেলে!”
কই মিরা এভাবে বলল না তো! বর্ষা খুব করে চাইছিল কেউ একজন এভাবে বলুক। একটু ভরসার জল দিক বর্ষার বিষাদ মেঘমনে। বলুক, যা-কিছু ঘটছে সেসব কোনো অশুভ সময়ের ইঙ্গিত নয়। বরের সঙ্গে তারও ভীষণ সুন্দর, দুর্দান্ত একটা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র!

____________________________

‘অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে।’

বৃষ্টি কি বর্ষার মনের মাটিতেও ঝরছে না? আপনাকে আপনিই শুধায় সে। উত্তর আসে হ্যাঁ। ভীষণ প্রগাঢ় বর্ষণ সেখানে। মনের নিবিড় একলা ভূমিতে।
বিষাদ রঙের সব ছবি গুলো সে এক সুতোয় বাঁধতে চেষ্টা করে। আর থেকে থেকে ফেলে প্রলম্বিত দীর্ঘ শ্বাস!

দুদিন পেরিয়ে গেল সে এখানে এসেছে৷ এর মাঝে শাশুড়ী ছাড়া ওবাড়ির আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেনি বর্ষার। মা, ভাবি বারকয়েক ভ্রু কুঞ্চিত করেছে। মা অনুসন্ধিৎসা চোখে জিজ্ঞেস করেছে, “কি রে, জামাই ফোন দেয়না তোরে? কথা বলতে তো দেহি না কুনো সময়!”
এটা-ওটা বলে উত্তর টা এড়িয়ে গেছে সে।

ভাবি শ্লেষের হাসি হেসে বলেছে, ” হ্যাঁ গো বর্ষা, এতো জলদি জলদিই ফুরিয়ে গেল তোমাদের প্রেম! লেখক সাহেবের বুঝি সত্যিকারের মানসপ্রিয়ার চেয়ে উপন্যাসের কল্পিত প্রিয়াই বেশি পছন্দ?
সত্যিই! এত আলগা আলগা ভাব তোমাদের বিশ্বাস করাই দায়!”

(শিরোনামের পঙক্তি – অমিয় চক্রবর্তী)

-“বর্ষা!”
মধ্য দুপুরে, আলস্য ভরে ছাদের দেয়ালে গা হেলিয়ে বসে ছিল বর্ষা। ডাক শুনে সিড়ির অভিমুখে চাইল। ফাবিহা অস্থির পদক্ষেপে এগিয়ে এসে বলল,
-” তুমি এখানে বসে বসে আরাম করছো আর ওদিকে আম্মা তোমাকে খুঁজে হয়রান। ”

-“কি হয়েছে ভাবি? তুমি এমন তাড়াহুড়ো করে আসতে গেলে কেন? একটু সাবধান থাকবে তো। নিচ থেকে ডাকলেই হতো। একেতো বৃষ্টির মরশুম। ছাদ পিচ্ছিল…..”

-” এইরে! বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম তো। একদম খেয়াল ছিল না। ঘটনা শুনলে তুমিও লাফিয়ে উঠবে।”

মন খারাপের রেশটা বর্ষার তখনো রয়ে গেছিল। সে দায়সারা গোছের প্রশ্ন করল -” কি ঘটনা ভাবি?”

ফাবিহা দুষ্ট হেসে বলল
-“উহুম……..উহুম…. লেখক সাহেবের হঠাৎ মর্জি হয়েছে। আজ এবাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে আসছেন। সাহিত্য লিখতে লিখতে বোধহয় আচমকা বেচারার মনে পড়েছে। যে তারও একটা কাগজে-কলমে লিখিত নিজের বউ আছে। তাই হয়তো আসতে চাইছে হঠাৎ। তোমার দারোগা শাশুড়ী তো ফোন করে সেরকমই জানালো।”

কথাটায় বর্ষার মুখে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটল। মুহুর্তেই তার দায়সারা ভাব কেটে সেখানে একরাশ অস্থির শিরার দোলাচল লক্ষনীয় হয়ে উঠল। মন্থর ভাবটা উবে গেল হুট করে। ওই লোকটা নিজে থেকে এবাড়ি আসতে চাইছে ? অবিশ্বাসযোগ্য কথা। রীতিমতো অসম্ভব!

যদি সত্যি আসার কথা বলে থাকে তবে এর পেছনে নিশ্চয়ই শাশুড়ী মা কিংবা দাদির হাত আছে। আড়াল থেকে তারাই কলকাঠি নেড়েছেন। কথার বিপরীতে বর্ষা কিছু বলার আগেই নিচ থেকে নাসিমার তারস্বরে চিৎকার শোনা গেল। ননদ- ভাবি তাড়াহুরো করে সিড়ি ভেঙে চলল সেখানে।

মেয়ের জামাই এই প্রথম আসছে। কিভাবে তাকে আপ্যায়ন করবেন না করবেন এসব নিয়ে নাসিমা চিন্তায় অস্থির। হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়েছেন। চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছেন একটু পর পর। একমাত্র ছেলে সোহাগকে দোকানে পাঠিয়েছেন কিছু জিনিসপত্র কিনে আনার জন্য। ঘর সাফসুতরো চলছে নতুন উদ্দামে। বর্ষা মায়ের এমন চাঞ্চল্য দেখে হতবাক। মনে হচ্ছে কিয়ৎক্ষন পর প্রাইম মিনিস্টার সয়ং এবাড়িতে এসে উপস্থিত হবেন যেন!

মায়ের এসব বাড়াবাড়ি তার একদম পছন্দ হলো না। বরং টের পেল মনের অলিগলিতে কোথায় যেন খুব সন্তর্পণে একটা চিনচিনে ক্রোধের শিখা দপদপ করে জ্বলছে। ওই নিষ্ঠুরতম হৃদয়হীনকে নিয়ে সকলের কিসের অত আদিখ্যেতা!

***

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। সরু গলির শেষ যেখানে। একটা গাড়ির হর্ন শোনা গেল। জানালায় কৌতুহলী চোখ রেখে ফাবিহা চেঁচিয়ে বলল,
–“আম্মা, এসেছে এসেছে। ”

নাসিমা এক ধমক দিলেন।
–“থামো বউ! শুইনা ফেলব তো।”

বর্ষা বসার ঘরের দরজায় গা হেলিয়ে বাড়ির লোকের চাঞ্চল্য দেখতে লাগলো দায়সারা চোখে।
পরমুহূর্তেই বেল বাজল।
তৎক্ষণাৎ লম্বা বেণী দুলিয়ে বর্ষা সদর্পে হেটে চলে গেল ভেতরে। সেখান থেকে বসে শুনতে লাগল নাব্যর প্রতি বাড়ির সকলের আহ্লাদিত বাক্যবাণ!

নাসিমা হঠাৎ এসে বর্ষার গায়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে বললেন,
–“তুই এইহানে এমনে বইসা আসস কে? জামাই আইছে। যা কথা ক। আর এইডা কি শাড়ি পরসস? এহনি বদলা। ওই সুন্দর জাফরানি রঙের শাড়িডা পড়। মুখে একটু সুনু, পাউডার দে। ”

মনে মনে বর্ষা মহা বিরক্ত হলো। এ ঘর থেকে ওঘরে যেতে শাড়ি কেন বদলাতে হবে! আশ্চর্য!
মুখে আবার কিসব মাখতে বলছে আম্মা। আম্মার কথাবার্তা গুলো এতো আজগুবি কেন!
বর্ষা ক্রোধ দমিয়ে নরম স্বরে বলল,
–” উফফ আম্মা। এইতো সামনের ঘর। ওখানে যাওয়ার জন্য আবার শাড়ি বদলানোর কি প্রয়োজন? আর এই শাড়িটা কি খারাপ নাকি?”

–” তুই জীবনে আমার কথা শুনছিলি? যাহ এহন। তাড়াতাড়ি যা ওইনে। পোলাডা বয়া আছে। ”

যাবে না। এই কথা বলার সাহস বর্ষার নেই। অগত্যা সে পা বাড়াল। গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল। সেখানে বাবার সঙ্গে আলাপে ব্যাস্ত নাব্য। বর্ষা এই ফাঁকে একবার নাব্যর দিকে চাইল। প্রগাঢ় তামাটে সৌষ্ঠব গাত্রবর্ণে ফর্মাল পোশাক, ঘাড় ছুঁই ছুঁই মাথার বড় চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো, গাল ভর্তি ছন্নছাড়া দাড়ি৷ এই ভীষণ সৌম্যদর্শন পুরুষটি তার বর ভাবতেই ভারি আশ্চর্য লাগে বর্ষার!

পেছন থেকে নাসিমা আরেকবার ধাক্কা দিতেই বর্ষার ভাবনা ছুটে গেল৷ নাসিমা ফিসফিস করে বললেন,
–” তুই যাস নাই কেন এহনো? যাইবি নাকি…”

বর্ষা মায়ের দাব/ড়ানি খেয়ে জড় পা দুটোকে সামনে বাড়াল।
মেয়েকে আসতে দেখে সংক্ষেপে কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে হাত কচলে জায়গা ছেড়ে সরে এলেন বর্ষার বাবা। পুরো ঘরে নাব্যর সঙ্গে একা হয়ে পড়ল বর্ষা। একটা ধূসর রঙা সুতির শাড়ি তার অঙ্গে জড়ানো। সাজহীন, অলংকার শূন্য একেবারে নির্মল হয়ে এসেছে সে। নাব্য যে সোফায় বসেছে তার কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছে।
কি করবে ভেবে না পেয়ে শাড়িতে আঙ্গুল পেচাতে লাগলো বর্ষা। তার সমস্ত মনোযোগ তখন ওই আঙ্গুল পেচানোয় নিবদ্ধ।
সেই সময় নাব্য হঠাৎ, হয়তো জীবনে এই প্রথম, বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল ,
–“আমরা এখনি ফিরছি। তৈরি হয়ে নাও।” তার স্বর মেঘের মতো গম্ভীর শোনালো।

চলবে…….

অদ্রিজা আশয়ারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here