একদিন নববর্ষা -২২,২৩

0
202

একদিন নববর্ষা -২২,২৩
অদ্রিজা আশয়ারী
২২

সন্ধ্যের পর সাভার থেকে বর্ষাদের গাড়ি ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে বেরুল। বিকেলেই ফিরে যাবার অভিপ্রায় ছিল নাব্যের। বর্ষার জন্য সময় পেছাতে হয়েছে।
মাগরিবের সালাত শেষ না করে বেরুলে পৌঁছে নিশ্চয়ই কাযা আদায় করতে হবে। তাই বর্ষা চাইছিল সালাত শেষ করে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে বেরুতে।

অতঃপর ওদের প্রস্থান লগ্নে। বর্ষা যখন মুখ ঢেকে, হাতমোজা পড়ে, কালো বোরকায় আবৃত হয়ে বেরিয়ে এলো। এসে নাব্যর পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানালো। নাব্য তখনো বুঝতে পারে নি তার পাশের মেয়েটিই বর্ষা! আদতে নাব্য কখনো বর্ষাকে বোরকা পরিহিতা অবস্থায় দেখেনি। সে ভারি বিভ্রান্ত বোধ করল। ওদের বিদায়বেলা সহসা কে এই অপরিচিতা নারী এসে হাজির হয়েছে। আর ওই মেয়েটাই বা কোথায় হারালো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!
বর্ষা বাইরে বেরিয়ে যাবার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নাব্য। একটা সময় পর সকলের আচরণ দেখে সে উপলব্ধি করতে পারল ওই মেয়েটি আর কেউ নয় বর্ষা।

সায়ংকালের পর, সন্ধ্যা ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ শেষে যখন আকাশ থেকে আঁধারের নিগূঢ় কালিমা সবে নামতে শুরু করেছে। গাড়িটা মফস্বলের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠল তখন। মনোযোগী ছাত্রের মতো দৃষ্টি সামনে সমাহিত করে নাব্য গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশে অস্বস্তিতে নিমিষহারা হয়ে বসে আছে বর্ষা। সে নিশ্বাস টাও ফেলছে খুব ধীর লয়ে, মেপে মেপে। পাছে লোকটা টের পেয়ে যায়! গাড়ির ভেতর এসি চলছে। জানালার কাঁচ তাই ওঠানো ছিল। ভীষণ হাসফাস লাগছিল বর্ষার।
নাব্য চোখের কোণে ব্যাপার টা খেয়াল করে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। মুহুর্তেই গা জুড়ানো ফুরফুরে বাতাসের দাপাদাপি ওদের উদ্রিত করে তুলল।

আজ হাইওয়েটা অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা। মাঝে সাঝে দু একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এর একটা কারণ হতে পারে বোধহয় আজকের আবহাওয়া। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা। ইতোমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তির্যক বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে ওদের গায়ে। বর্ষা হঠাৎ একটা কাজ করল। রাতের অন্ধকারে নিকাব খুলে জানালার বাইরে বাতাসের দাপাদাপির মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দিল সে। বাইরে মুখ বাড়িয়ে জানালায় হেলে পড়ে মুদিত আঁখিজোড়া বৃষ্টির কোলে মেলে দিয়ে স্থবির হয়ে বসে রইল। বৃষ্টির তোড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইতে লাগল বাতাস। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার চিটচিটে শব্দটা কি সুন্দর শোনাচ্ছে! প্রকৃতির এতো আয়োজন দেখে বর্ষা তার পাশে নাব্যর অস্তিত্বের কথাই যেন ভুলে গেল ক্রমশ। কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছ্বাসিত হয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগল সে। বৃষ্টি ততক্ষণে গতি বাড়িয়েছে। বর্ষার হাত, মুখ, পোশাকের ঊর্ধ্বাংশ ভিজে একাকার। অথচ সে পরোয়াহীন! নির্বিকার!

একটা সুখ সুখ অনুভবের আবর্তনে ঘিরে আছে তার মন, শরীর সবকিছু…..। বাতাসের প্রবলতায় সামনে তাকানো দায়। তবু সেদিকেই মুখ বাড়িয়ে চেয়ে রইল বর্ষা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় বর্ষার চোখ সরু হয়ে এলো। দুচোখে নেমে এলো ঘুম….।

নাব্য আড়চোখে দেখছিল পাশে বসা পাগলাটে মেয়েটির ভীষণ উচ্ছ্বাসিত খেয়ালী কর্মকাণ্ড!
এবার সে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবিষ্ট করল। রাত বাড়ছে, রাস্তাটা বলতে গেলে প্রায় জনমানবহীন। গাড়ি ৮০ কি.মি ঘন্টাবেগে চলছে। গাছপালা গুলো পাশ কেঁটে যাচ্ছে চোখের নিমিষে। গাড়ি চালাতে চালাতে সহসা নাব্য খেয়াল করল তার বা-পাশের ঘাস ফড়িংয়ের মতো চঞ্চল মানবীটি আর ছটফটাচ্ছে না। ঘাড় বাঁকিয়ে পরখ করার অভিপ্রায়ে সেদিকে তাকাল সে। তারপর সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই গাড়ির গতি কমিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষন।

কিঞ্চিৎ পর বুঝল মেয়েটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার নির্মল দেহখানি জানালায় সম্পুর্ন ঝুকে রয়েছে বিপদসংকুল ভাবে। একটি হাত তখনো গাড়ির বাইরে। নাব্য কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বা দিকে ঝুকে বর্ষার নিদ্রিত দেহটাকে সন্তর্পণে জানালা থেকে সরিয়ে এনে পুনরায় কাঁচ উঠিয়ে দিল।

গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এসে থামল তখনো বর্ষার নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। বৃষ্টি থেমেছে। বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটার এখানে ওখানে ছিপছিপে পানি। গাড়ির শব্দ পেয়ে রাফিয়া বেরিয়ে এলেন। পেছনে দেখা গেল ধীর পায়ে দাদিও আসছেন। নাব্য নামতে দেরি করছে দেখে রাফিয়াই প্রাঙ্গণে নেমে এলেন। মা কে দেখে নাব্য জানালার কাঁচ নামালো।
-“কিরে, বেরোচ্ছিস না কেনো তোরা। রাস্তায় কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”

-” না। কিন্তু….”
বা পাশে ঘুমন্ত বর্ষার ওপর চোখ নির্দেশ করে গম্ভীর স্বরে বলল, ” ও এখনো ঘুমোচ্ছে। ”

-“ঘুমোচ্ছে তো ডাক ওকে!”

-” ডেকেছি। সারা নেই! তুমি দেখো আমি ভেতরে গেলাম।” বলে নাব্য ত্বড়িতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে এতক্ষণ রাফিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাদি এবার ভেতর থেকে চেঁচালেন,
-“কি গো রাফু। হইসে ডা কি?”

রাফিয়া বর্ষাকে ডাকছিলেন। মেয়েটার মরা’র ঘুম। কিছুতেই ভাঙ্গছে না। এই অর্বাচীন মেয়েটাকে শুধুমাত্র নিজের ছেলের কথা ভেবেই সহ্য করে যাচ্ছেন তিনি। বিরক্ত গলায় বললেন,
-“তেমন কিছু না আম্মা। আপনার নাতবউ গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকছি উঠছে না।
এই বর্ষা…..এই….. ওঠো।”

নাহ! লাভ হচ্ছে না। মেয়েটা বেহু’শের মতো ঘুমোচ্ছে। দাদি এগিয়ে এলেন। পিটপিটে চোখে চেয়ে রইলেন মুহুর্তক্ষণ। সেই চাহনিতে মায়া ঝরে ঝরে পড়ছে। তারপর আপ্লুত গলায় বললেন,
-“আহা গো! ছুডু মানুষ তো। হের ওপর এতক্ষণ জার্নি কইরা আইসে। পেরেশান হয়া গেসে মনে হয়।”

উত্তরে রাফিয়ার বলতে মন চাইল।
-” আপনার ছুডু মানুষ নাতবউ বসে বসে আরাম করে এসেও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমার নবু যে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে আবার ওকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কাহিল হয়ে ফিরে এলো। সেটা আপনার চোখে পড়ল না? ”
কিন্তু তিনি শাশুড়ীর মুখের ওপর কিছু না বলে চুপ রইলেন।

দাদি কি যেন ভাবলেন। অতঃপর বললেন
-” রাফু, নবুরে কও আয়া ওরে নিয়া যাইতে।”

-“আশ্চর্য! নবু এসে ওকে কিভাবে নিয়ে যাবে আম্মা?” রাফিয়া অবাক চোখে প্রশ্ন করলেন। কণ্ঠে তার অপ্রসন্নতা।

রাফিয়ার শাশুড়ী সুলভ ঈর্ষা বুঝতে পেরে দাদি মুচকি হেসে উত্তর করলেন,
-“বিয়ার পরে আমার পোলা তোমারে যেমনে লয়া যাইত..।”

শাশুড়ীর এমন রাখঢাকহীন বেশরম কথার বিপরীতে আর কিছু বলা চলে না। রাফিয়া ছেলেকে ডাকতে ভেতরে গেলেন।
বাইরে এসে দাদির কথা শুনে নাব্যের বিরক্তি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল। দাঁতে দাঁত চে’পে ক্রোধ টাকে দমিয়ে দাদির আদেশ মান্য করতে সতেজে দরজা টেনে খুলতেই বর্ষা ওর গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল বেচারি। কাছাকাছি এতগুলো মুখ দেখে সে হকচকিয়ে গেছে। দাদি এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। সোহাগ করে বললেন,
-” বুবু তুমি আইসো। আহো, ভিতরে আহো। চোখে মুখে পানির ছিটা দেও। ঘুমডা কাটুক। নবু তোরে আর লাগবো না তুই ঘরে যা।”
নাব্য যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। দাদির কথা শেষ হওয়া মাত্র বাধ্য ছেলের মতো জায়গা ছেড়ে চলে গেল। রাফিয়া শাশুড়ী বউয়ের এসব আহ্লাদী দেখে পানসে মুখে ভেতরে পা বাড়ালেন।
বর্ষার গালে, কপালে টুপটাপ কয়েকটা চুমু দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে দাদিও রাফিয়ার পশ্চাদগামী হলেন।

***

দাদির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে রাতে শুতে এসে বর্ষা বিভ্রান্তিকর এক অবস্থায় পড়ল। বিয়ের পর এখানে যে দুদিন ছিল সেসময় নাব্য ঘুমাত লাইব্রেরি রুমে। আজ দেখা গেল সে বিছানাতেই শুয়েছে। তবে এমন ভাবে যে আশেপাশে কারো বসবার স্থানটুকু পাওয়ার সাধ্যি নেই! হাত পা ছড়িয়ে বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে দুপাশে বালিশের বর্ডার বানিয়ে রেখেছে। এখনো ঘুমোয় নি। ফোন স্ক্রল করছে।
শুভ্র সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজারে কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। অথচ মুখখানা দেখো! করে রেখেছে জলদগম্ভীর!

বর্ষা ঘরে এসে এটা সেটা করার অজুহাতে আড়চোখে দেখছিল ব্যাপার টা। তার মুখজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টির আসন্ন ইঙ্গিত! অভিমানে ফোলা ফোলা গালদুটোর স্ফীতি আরও বর্ধিত হয়েছে। সে এখন কি করে? লোকটা এমন কেন করছে? সে কি জিজ্ঞেস করবে কিছু?
নাহ। ভরসা হলো না যে কিছু বলে। যা রুদ্রমূর্তি লোকটার। যদি বিষম এক ধমক দিয়ে বসে ওকে !

নাকি সে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই এভাবে ওকে শাস্তি দিচ্ছে লোকটা। গাড়িতে ঘুমানো কি কোনো অপরাধের পর্যায়ে পরে? জানা নেই বর্ষার।

রাত বাড়ছে। বর্ষা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে ভাবনার অতলে ডুবে যায়। ক্রমশ বিষন্নতার স্রোতে অবগাহন করে তার ছলাকলাহীন অচতুর মন। বৃষ্টির উত্তরকালীন স্বচ্ছ শীতল ঝিরিঝিরি বাতাস তখন বারান্দা জুড়ে। শহরের বাতিগুলো সব নিভে গেছে। রাতের অন্ধকারের ঘনিষ্ঠতা ওকে আরও নিবিড় ভাবে একলা করে তুলছে। ঘরের বাতিটাও তখনি নিভিয়ে দিল নাব্য।
বর্ষা ভেবেছিল এইবার হয়তো সে আসবে। কান খাড়া রেখেছিল সে। না! কেউ আসেনি!
কিয়ৎক্ষন পর পেছন ফিরে দেখল নাব্য নিশ্চিন্তে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাত্রির কালিমা যেন আঁধারের অমসৃণ প্রলেপ ঢেলে দিয়ে গেল বর্ষার বুকজুড়ে। সে যে কোনোদিন আসবেও না, এই সহজ কথাটা হুট করে বুঝে গেল বর্ষা। সাথে আরও একটা ব্যাপার যেন ভাসা ভাসা বুঝল। কিছু একটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে। খুব সন্তর্পণে, মনের অজান্তে….।
একটা অদ্ভুত, অচেনা অনুভূতির সতেজ পরিমল তার নাকে এসে লাগছে। বর্ষা জানে। এই সতেজ-সুগন্ধি পরিমল মানুষের জীবনে খুব অল্প সংখ্যক বার আসে। যখন আসে। আয়োজন করে, একরাশ ঐশ্বরিক আভা নিয়ে, খুব সঙ্গোপনে এসে মনস্য জীবনে বিস্তার লাভ করে। বর্ষাও কি তবে সেই আভার দেখা পেল? তাও এমন ভুল সময়ে!

তবে কি সেও ভালোবাসতে শুরু করেছে? যদি তা নাই হয়, এই অন্তঃকরণ জুড়ে কেন এত তীব্র হাহাকারের নিনাদ? কেন বারবার সেখানে অনুরণিত হচ্ছে একটি নাম? হৃদয়ের ঝরোকা বেয়ে যে যাতনা ক্রমশ সঞ্চারিত হচ্ছে তার রুপ যে এতো ভয়াবহ। কোনোদিন তা জানা ছিল না বর্ষার। এই ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? কার জন্য সঞ্চিত রাখবে সে এই অনুরক্তি?
‘ভালোবাসা যে রাত্রির নিগূঢ় আঁধারেরই মতো জীবনে এসে জড়ায়। যেখানে রাত্রি নেই সেখানে ভালোবাসাও নেই! ‘

প্রলম্বিত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বর্ষা একটা কবিতার পঙক্তিমালা বলে উঠল বিরবির করে –

তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।

তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।

তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;

তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।
এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।

দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।
______নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চলবে…….
★অদ্রিজা আশয়ারী।

একদিন নববর্ষা -২৩
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

একটি কবিতার মতো মেয়ে সারাদিন বিচরণ করে বেড়ায় আমার ঘরজুড়ে। কবিতার মতোই স্নিগ্ধ তার সকল কথামালা। সে যখন হাটে, কটাক্ষ-বানে নিবদ্ধ করে চারপাশ। তা যেন কবিতার লহু পঙক্তির মতো অসামান্য হয়ে ধরা দেয়। সে যা বলে তাই যেন কবিতা হয়ে ওঠে। আমি অনুভব করি, আমার সাদাকালো ঘরে আজ রাশি রাশি রঙ্গিন কিরণের অপচ্ছায়ার জড়ো হওয়া তার সন্ধানে।

সেই কবিতার মতো মেয়ে। আমার কাগজে কলমে লিখিত স্ত্রী। যাকে আমি ভালোবাসি না। সারাবেলা শুধু অনুভব করি একটা ভীষণ স্নিগ্ধ সুন্দর কবিতার মতো। আমার জীবনের কোনো বাঁকে, কোনো চোরাভূমে ওর অস্তিত্ব নেই। শুধু লেখক বলেই, নিজের তৃতীয় সাহিত্যিক চক্ষু দ্বারা ওকে আমি বিশেষ ভাবে নিরিখ করতে পারি। ওর জন্য চাহনিতে আমার কোনো ভালোবাসা কিংবা মুগ্ধতার স্থান নেই! প্রকৃতির সবুজ যেমন আমাদের চোখকে আরাম দেয়। জঞ্জালে ভরা শহর দেখে অভস্ত্য চোখে, সবুজ দেখলে যে প্রশান্তির পর্যাপ্তি আসে। সেই পর্যাপ্তি আমি বর্ষাকে দেখলে পাই। এর বেশি আর কিছু না। মেয়েলি সৌন্দর্যে পুরুষোচিত যে আর্কষণ তা কখনো বর্ষাকে দেখলে আমার হয় না। সে শুধুই একটি স্নিগ্ধ পঙক্তিমালার কবিতা হয়ে আমার জীবনে কাঁটার মতো আঁটকে রয়েছে।

___________________________

আজকাল আর ব্যাপার গুলো সহজ, অতিক্রমযোগ্য থাকছে না। নিজেকে সম্পুর্ন একজনাতে উজার করে দিয়ে আমি যখন হয়েছি শূন্য, পরাভব। আম্মা তখন নিজের জেদ, দাবি মেনে নিতে বাধ্য করলেন আমায়। ভেঙেচুরে যাওয়া আমাকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয়ে জীবনের নতুন এক রঙ্গমঞ্চের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। আমি একজনের ঘোরে আটকে থেকে, স্ত্রীর মর্যাদা দিলাম অন্য আরেকজন কে। পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো, “পুরনো বাগদত্তাকে ছেড়ে, এবার পরিবারিক ভাবে অন্য একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন সময়ের জনপ্রিয় লেখক নাব্য ইমতিহান! নাব্যর এমন সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার ভক্তকুলের বড় অংশ। অনেকে এটাকে তার প্রাত্তন বাগদত্তার সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ”

চারিদিকে নানান গুঞ্জন উঠতে লাগলো। এসবের মাঝখানে খুব সুক্ষ্ম একটা ব্যাপার সবার নজর এড়িয়ে গেল। আমাদের এই মান অভিমানের গোপন দ্বন্দ্বে সম্পুর্ন নির্দোষী একটি মেয়ে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গেছে। সে কোনো অপরাধ করেনি। অথচ আমাদের সকল ক্ষোভের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছে। আমি কখনো এই বর্ষাকে ভালোবাসতে পারবো কিনা জানি না। ওকে দেখলেই আম্মার নেয়া ভুল সিদ্ধান্ত, বর্ষার আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া। এ সবকিছু একসাথে মনে পরে আমার। রাগের তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। তখন মনে হয় মেয়ে মানেই ছলনাময়ী। এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রম নয়! হয়তো সেও জীবনে বহু ছেলেকে নিজের সৌন্দর্যের ফাঁদে ফেলেছে, তারপর ফণিনীর ন্যায় রুপ বদলে ওদের অন্তঃকরণ আঘাতে জর্জরিত করেছে।

কাছের মানুষজন ও নিজের একক আবর্তন ছেড়ে আজকাল আমি যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করি। ওদের কাছে এলেই প্রতারণার প্রকট ভেপসা গন্ধ নাকে এসে লাগে। আর একা হলেই মস্তিষ্কে হা’না দেয় বর্ষার স্মৃতি….। এরচেয়ে সারাদিন অফিসে বসে, অচেনা লোকের ভিরে, মায়াহীন সময়ের আবর্তে আমি বেশ আছি। এখানে কারো থেকে কোনো বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই, স্মৃতি রোমন্থনের মতো বাজে কাজে ব্যায় করার পর্যাপ্ত সময়ও হাতে নেই। অতএব অফিস হয়ে পড়ল আমার স্বস্থিতে নিশ্বাস ফেলার একমাত্র স্থান!
এর মাঝেও নানান কিছু ঘটতে থাকল। যা বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা ছিলনা আমার।

***

বর্ষা মেয়েটি ভীষণ বোকা। হয়তো খুব অভিমানীও। আমরা একঘরে থাকি, ঘুমাই। আমাদের মাঝে কথা হয়না। চোখাচোখি হলে শীঘ্র দুজনে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেই। কখনো কখনো সে আমাকে নিভৃতে প্রত্যক্ষণ করে। আমি জানি।
হয়তো ভাবে লোকটা এমন অনুভূতি শূন্য পাথর কেন!
কেউ জানে না এক ঘরে থেকেও আমাদের দূরত্ব নিঃসীম! অচেনা লোকের মতো আমাদের বসবাস। একক ঘরে আমরা দুজন ভীষণ দূরের কেউ!

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমাদের ধূসর সময়। এক দুপুরে, ক্লান্ত থাকায় সেদিন দুপুরের খাবার পর অফিসে না গিয়ে ঘরে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। বর্ষা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এল। ঘরে এসে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এটাসেটা নাড়াচাড়া করতে লাগলো। একবার আড়চোখে ব্যাপার টা দেখে নিয়ে আমি আবার কাজে মন দিলাম। এমন আচরণ ওর নতুন নয়।
কালো পাড় দেয়া হলুদ মিহি সুতির শাড়ি, অনৃজু কটিদেশ পর্যন্ত ছেয়ে থাকা কোঁকড়া চুল, ঘামে চিকচিকে মুখে দুপুরের রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা। স্নিগ্ধ সেই কবিতার মতো মেয়েটি বিষন্ন, ঝিমধরা দুপুরকে যেন হাজার রঙে রাঙ্গিয়ে তুলল শুধু মাত্র ওর অস্তিত্বের স্নিগ্ধতার রেশে।
তারপর নিরবতা ভেঙে অকস্মাৎ কথা বলে উঠল সে। ঘরে কেউ না থাকার চেয়ে আমরা দুজনেই যখন ঘরে থাকি তখন ঘরটা নিশ্চুপ থাকে বেশি। আমি এলে বর্ষা ঠাই নেয় লাইব্রেরি রুমে। সেখানে বই হাতে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। জাননামাযেও সময় কাটায় বহুক্ষণ। পারতপক্ষে আমি ওর মুখোমুখি হইনা কখনো।

মুখে আঁধারের ভ্রুলেখা এঁকে মাথা নিচু করে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বর্ষা বলল,
“আমি বাড়ি চলে যাবো। আমাকে রেখে আসুন।”

আজকের আগে কখনোই সে নিজে থেকে যেচে এভাবে কথা বলেতে আসেনি আমার সঙ্গে। সেই প্রথম থেকে আমি ওকে উপেক্ষা করে আসছি বলেই হয়তো। বলতেই হবে, বোকা হলেও মেয়েটির আত্মসম্মান বোধ প্রবল! আমি ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে মনযোগী হলাম।
বললাম,
-” কেনো?”
বর্ষা একবার চট করে তির্যক দৃষ্টি হেনে তাকাল আমার দিকে। পরমুহুর্তে চোখ সরিয়ে নিল। তার বিষন্ন মুখে ছায়াপথ ঘটাল অসংখ্য অস্থির শিরার কম্পন। কেন যেন মনে হলো আমার প্রশ্ন ওর মনে ক্রোধের উদ্রেক করেছে। সে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে অস্থির ভাবে হাত কচলাতে লাগল। উত্তর করল না। কিঞ্চিৎ থেমে আমি বললাম,
-“ঠিকাছে। নিয়ে যাবো। ”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সরোষে বর্ষা বলল,
-” আমি আজকেই চলে যাবো । আমাকে এক্ষুনি রেখে আসুন।”

আমি ওকে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। বর্ষার মুখজুড়ে ক্রোধের প্রকম্পিত রেখা, পিঙ্গল চোখের কিনারায় জল জমেছে। যেন চোখ ফেটে রক্তবিন্দু হয়ে ঝরে পড়বে এক্ষুনি। এমন উত্তেজিত স্বরে সে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি!

প্রতুত্তরে মুখ গম্ভীর করে বললাম,
“আজ আমার সময় হবে না। কাল নিয়ে যাবো।”

-“থাক! আপনাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি একাই চলে যাবো।” বলে মুহুর্তে ঘুরে দরজায় দড়াম শব্দ করে ঘরছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। আমি কিয়ৎক্ষন স্তব্ধ হয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কি কারণে আজ ও এমন মরিয়া হয়ে চলে যেতে চাইছে।
আচমকা কাল রাতের ঘটনা টা মনে পড়ল। বর্ষা কি কাল অপমানিত বোধ করেছিল আমার আচরণে?

___________________________

জীবনে করা কোন পাপের মাশুল গুনছে আজকের এই অভিশপ্ত সময়ে এসে জানা নেই বর্ষার। তপ্ত দুপুরে, চিল গুলো যখন মধ্যাকাশে লক্ষ্যহীন ভাবে উড়ে বেড়ায়, দলছুট সাদা মেঘেরা নেমে এসেছে পৃথিবীর খুব কাছে। নাব্যদের দিতল বাড়ির ছাদে নিবিড় হয়ে বসে বর্ষা তখন জীবনের হিসেব কষে। এইমাত্র সে নাব্যর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। রাগে, দুঃখে, অপমানে বর্ষার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে অবিরত। বারবার চোখ ফেরাচ্ছে সে ছাদের কার্নিশে। ওখান থেকে লাফিয়ে পড়লেই তো হয়, জীবনের সব জ্বালা চিরতরে জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এটা সে কখনো করতে পারে না। যে জীবনের মালিক সে নিজে নয়। রবের পক্ষ থেকে মাত্র কিছুদিনের জন্য আত্মাটা তাকে সপে দেয়া হয়েছে শুধু। সেই জীবন নিয়ে যা খুশি তা করতে পারে না সে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারের হিসেব যখন দিতে হবে, সেই সময়ের ভয় করে বর্ষা!

বর্ষা আকাশের দিকে অভিমানী চোখে তাকায়।
মনে পড়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত।
“আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানোকে আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। ”

আকাশের বিশালতার পানে একদৃষ্টে চেয়ে মনে মনে সে বলে,”হে আল্লাহ, আমি আপনার অতি দুর্বল, গাফেলের চেয়েও গাফেল বান্দা। আপনি আমাকে পরীক্ষায় ফেললে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো। আপনি আমাকে অনুগ্রহ করুন। আপনার অপরিসীম ক্ষমা ও রহমত দ্বারা আবৃত করুন। আপনি আমার জন্য সহজ করে দিন সকল পরিস্থিতি। আর আমাকে সবর করার তাওফিক দিন। ”

বলে বর্ষা আকাশের পানে চুপচাপ চেয়ে থাকে। জল গড়িয়ে পড়তে থাকে গাল বেয়ে। চোখে ভেসে ওঠে গতরাত্রির ঘটনা –

আগের দিন দুপুরে। সকলে যখন ডাইনিংয়ে খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। বর্ষাও এসে দাড়িয়েছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে রাফিয়া নাব্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন -“নবু বিকেলে বর্ষা কে নিয়ে একটু ঘুরে আয়। বিয়ের এতদিন হয়ে গেল কোথাও গেলি না তোরা। আজ যা।”

নাব্য হ্যাঁ-না কিছু না বলে মাথা নিচু করে খেতে লাগলো। ওপাশ থেকে দাদি আর নিতিন একযোগে মাথা নেড়ে এই রায়ের পক্ষে সায় দিলো। রাফিয়া বর্ষার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আপন মনে বললেন -“বিকেলে তৈরি থেকো।”
নাব্য উত্তর করল,
“বিকেলে আমার অন্য কাজ আছে। কোথাও যেতে হলে সন্ধ্যের পর যেতে হবে। ”

রাফিয়া বললেন,
“আচ্ছা তোর যখন ইচ্ছা। রাতে তাহলে বাইরেই ডিনার করবি তো। নাকি?”
নাব্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,
“হ্যাঁ। ”

-” বর্ষা শুনেছো তো? তৈরি থেকো কিন্তু। ”
শাশুড়ী মার কথা শুনে বর্ষা কেবল ওপর নিচ মাথা নাড়লো।

সেদিন সারা বিকেল বর্ষা ঘরজুড়ে অস্থির পায়চারি করে নানান কথা ভাবল। নাব্যর তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে রাজি হওয়ার কোন কারণ নেই। তাই তৈরি হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।অথচ শাশুড়ী মার অবাধ্য হতেও তার মন সায় দিচ্ছে না।

রাতে এশার আজান কানে আসতেই লাফিয়ে উঠে বসলো বর্ষা। মাগরিবের সালাতের পর ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারে নি। আযানের পর ইকামতের সময় দো’আ করাটা বর্ষার অভ্যেসে পরিনত হয়েছে। আজকাল ওর দো’আর একটা বড় অংশ বাধিত থাকে নাব্যর জন্য। আজও সে অনেক সময় নিয়ে দো’আ করল নাব্যর জন্য, নাব্যর হিদায়াতের জন্য, সার্বক্ষণিক সুস্থতার জন্য। তারপর ওযু করে এসে সে সালাতে দাড়ালো। সালাত শেষে হওয়ার পরও অনেকক্ষণ জায়নামাযে বসে রইল।

-“ভাবি তুমি এখনো তৈরি হও নি? আম্মা আমাকে দেখতে পাঠালো তোমরা বেড়িয়েছ কিনা।” নিতিন দরজায় কড়া নেড়ে মুখ বাড়িয়ে বলল।

বর্ষা কি বলবে ভেবে পেল না। তৈরি হয়ে বসে থেকে হবেটা কি? নাব্য আদৌও আসবে কিনা সেটারই তো নিশ্চয়তা দেয়নি ওকে।
-“হচ্ছি, এখনি তৈরি হচ্ছি।” বলে সে চুপ করে গেল। একবার ভাবলো নিতিন কে জিজ্ঞেস করে তার ভাই কোথায়। সে আদৌ যাবে কি না। কিন্তু এই প্রশ্ন টা যে নিতান্তই অযৌক্তিক সাথে সাথেই বুঝতে পারলো সে।

-“ভাবি দেরি করো না। দাভাই কিন্তু কারো জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা একদম পছন্দ করে না। ”
বর্ষা মনে মনে ভেংচি কেটে বললো -“তোমার দাভাই শুধু এটা কেন আরও একটা জিনিস ভীষণ অপছন্দ করে। সেটা হলো আমি। হ্যাঁ আমাকেই তো সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে তোমার দা ভাই!”

নিতিনের আজকাল একটু একটু ভাব জমতে শুরু করেছে বর্ষার সাথে। সে উৎসুক হয়ে বলল -“আচ্ছা! আজ কোন ড্রেসটা পড়বে তুমি আমাকে দেখাও তো!”

-“বোরকাই তো!” বর্ষা দায়সারা উত্তর দিল।

-“আজকেও বোরকা পড়বে ভাবি? সিরিয়াসলি! এই কালো পোশাক টা একদম মানাবে না আজকের উপলক্ষের সাথে। অন্তত একটু সাজগোছ তো করতে পারো।”

বর্ষা মুচকি হাসল -” হুমম….আচ্ছা তুমিই বলো তো রবের সন্তুষ্টির জন্য যে সবসময় নিজেকে আবৃত রাখে। প্রচন্ড গরমে ঘেমে একাকার হলেও শুধু আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যই এই কালো কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাখে। তারপর সে যদি কোনো কারণে একদিনের জন্য নিজেকে অনাবৃত করে ফেলে। সেটা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেল না?
আল্লাহর সমস্ত বিধান আমাদের ভালোর জন্যই। একটি মেয়ে আটসাট কাপড়ে, সেজেগুজে রাস্তায় বেরোলে মানুষ রুপি হায়নারা কি জঘন্য দৃষ্টিতে তাদের দেখে তুমি খেয়াল করেছো কখনো? আমরা কি এতোই ঠুনকো! ইসলামে মেয়েদের তুলনা করা হয়েছে রানীর সাথে। আমরা তাই রানীর বেশেই থাকব। রাস্তার ওসব মশা-মাছি আমাদের দেখবে, মন্দ কল্পনা করবে আমাদের নিয়ে। এতো সস্তা আমরা কেনো হবো? আরেকটা ব্যাপার কি জানো? সবাইকে সবার নিয়তের ওপরেই প্রতিদান দেয়া হবে পরকালে। পর্দাকে আমরা যদি নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাবহার সামগ্রী করে তুলি সেটা হাশরের ময়দানে আমাদের বিরুদ্ধেই কথা বলবে। ”

নিতিন ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে বর্ষা কোনো ভুল কথা বলেনি।
কিঞ্চিৎ থেমে সে বলল, “পুরোপুরি ভুল বলনি ভাবি। আচ্ছা তুমি বোরকাই পড়ো।”

বর্ষা তৈরি হয়ে বসে রইল। মুখ থমথমে। চিন্তায় অস্থির। আজ বোধহয় বাড়ির সকলের সামনে তাকে অপমানিত হতে হবে। নাব্য তো তাকে নিয়ে যাবেই না। মাঝখান থেকে সবার অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে বর্ষা চোখের কোণ দিয়ে সিড়ির দিকে তাকাতেই দেখল নাব্য শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নামছে। আকাশি রঙা মেন্ডারিন কলার শার্টে ওকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বর্ষার মন আদ্র হয়ে এল। মনের কোণে কোথায় যেন একটা কথা অনুরণিত হতে লাগলো।
– এই সুন্দর, সুপুরুষ বরটি শুধু আমার! ”

_______________

গাড়িটা জিয়া উদ্যানের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। ওদের গন্তব্য কোথায় এখনো জানে না বর্ষা। সে জানালায় হেলান দিয়ে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। প্রচন্ড বাতাস বারবার নাব্যর গোছানো চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। বর্ষা খানিক পর পর আড় চোখে সেদিকে তাকাচ্ছে।
শুক্লপক্ষের মস্ত রুপোলী চাঁদটা ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলোর উজ্জ্বল রেখা।
সহসা নাব্যর ফোনে কল এলো। গাড়ি থামিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সে। অনেকক্ষণ ধরে রিং হচ্ছিল। রিসিভ করে সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে গেল কথা বলার জন্য। বর্ষা দেখলো কিছুক্ষণ পর রাস্তার পাশে ওদের ঠিক সামনেই আরেকটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে এক দম্পতি বেরিয়ে সোজা এগিয়ে গেল নাব্যর দিকে। জানালায় মুখ রেখে পুরো ব্যাপারটাই বর্ষা প্রত্যক্ষ করছিল। সে স্পষ্ট দেখল সেই লোকটি ও তার পাশের মেয়েটিকে দেখে নাব্যর মুখের রেখা কেমন মুহুর্তে পালটে যেতে। মনে হলো যেন কি ভয়ানক, দুঃসহ এক ছবি ভেসে উঠেছে ওর সামনে। লোকটি অনেক কথা বলে গেল। কিন্তু তার পাশের মেয়েটি কিংবা নাব্য কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। একসময় তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে সেই মেয়েটি আড়চোখে তাকালো গাড়ির ভেতর বসে থাকা বর্ষার চোখে। তার চোখের চাহনি অস্বাভাবিক। এই দৃষ্টির মানে কি বর্ষা জানে না!

প্রায় বিশ মিনিট পেড়িয়ে গেল। নাব্য ফিরছে না। বর্ষার অস্থিরতা বাড়ছে। কি এত কথা! কার সঙ্গে এত কথা বলে লোকটা ফোনে?
আর এভাবে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বর্ষা ডানে ঝুকে নাব্যর সিটের দরজাটা ধা’ক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল। বর্ষা বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। নাব্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বর্ষা সেদিকে এগিয়ে গেল। পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে নাব্য ঘুরতেই বর্ষা অবাক হয়ে দেখল মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেট ফুঁকছে নাব্য। মুখের রঙ ভীষণ ফ্যাকাসে। চোখদয় রক্তিম।
বর্ষা কিয়ৎক্ষন হা করে তাকিয়ে থেকে আহত স্বরে বলল,
-“আপনি স্মোক করেন?”

নাব্য প্রতুত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। হাটতে আরম্ভ করল গাড়ির দিকে। বর্ষা তার পশ্চাদপসরণ করল৷ কিন্তু নাব্যর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাটা অসম্ভব। রীতিমতো দৌড়ে তার নাগাল পেতে হলো বর্ষাকে। গাড়ির সামনে গিয়ে সজোরে দরজা খুলে বর্ষাকে একপ্রকার জোর করে টেনে ভেতরে বসিয়ে দিল নাব্য। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ল বর্ষা। কিছু বুঝে উঠবার আগেই সুইচ টিপে গাড়ির কাচ নামিয়ে, চাবি পকেটে পুরে অন্যপাশের দরজাটা লাগিয়ে উল্টো পথে হাটাল ধরল নাব্য। বর্ষা গাড়িতে বসে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামনে দিয়ে নাব্য হেটে চলে গেল। সে প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। জানালার বন্ধ কাচে দুহাতে আঘাত করে বলতে লাগল,
-” শুনছেন, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাকে একা ফেলে এভাবে চলে যাচ্ছেন কেন? বিদুৎ চমকাচ্ছে। খানিক বাদেই যে বৃষ্টি নামবে। আমার খুব ভয় করছে। আপনি যাবেন না। প্লিজ… ”

বোকা মেয়েটা জানে না বদ্ধ কাচের ভেতর থেকে বাইরের পৃথিবীকে দেখা গেলেও ভেতরের মানুষটিকে দেখেনা কেউ। ডাকলে সেই ডাক পৌছায় না কারোর কানে।

চলবে……..।
★অদ্রিজা আশয়ারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here