একদিন নববর্ষা -২৪,২৫

0
186

একদিন নববর্ষা -২৪,২৫
অদ্রিজা আশয়ারী
২৪

রাত বাড়ছে। বাইরে প্রকৃতি জুড়ে ঝড়ের প্রলয় হুংকার। গাড়ির গায়ে বৃষ্টির সুচ্যগ্র বিন্দু ভীতিকর শূন্যতার সঞ্চার করছে মনে। বর্ষা মতিচ্ছন্ন হয়ে একলা বসে আছে সেই নিবিড় বদ্ধস্থানে। সে যেন চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মাথাটা সম্পুর্ন ফাঁকা লাগছে ওর। সে কি আবারও খানিক কাঁদবে? কাঁদলে কি এই দুর্বোধ্য সময়ের জাল থেকে বের হতে পারবে সে? কি অপরাধে, কোন দুঃসাহসের পরিণামে আজ এসব ঘটছে তার সঙ্গে! জানা নেই এর কোনো বিশ্লেষণ!

জন্মের পর বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন বর্ষা। অথচ সেই বর্ষা নামের মেয়েটি কোনো এক অজানা কারণে ছোট কাল থেকেই বৃষ্টিকে ভয় পেতে শিখল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলেই ওর আত্মা খাঁচাছাড়া পাখির মতো ছটফট করত! ভয়ে বাবা-মায়ের শিয়রে গিয়ে বসতো সে।

আজকের রাত্রির এই বৃষ্টি ভয়ের সাথে সাথে ডানায় ভর করে বর্ষার জন্য নিয়ে এসেছে একরাশ যাতনা আর হৃদয় খা খা করা শূন্যতার ভেজা অসুখ! আতঙ্ক আর বিষাদের জটিল মিশ্রণে বুদ হয়ে, গাড়ির এক কোণে জড়োসড়ো, সিটে গা হেলিয়ে বসে রইল বর্ষা। এভাবে বসে আছে সে নাব্য চলে যাওয়ার পর থেকেই। কতক্ষণ কাটল কে জানে! সময়ের হিসেব রাখেনি সে। শীতল ভেজা চোখে মাঝে মাঝে সে দেখল সাঁইসাঁই করে গাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ওকে। সবার যে ঘরে ফেরার তাড়া ভীষণ। এমন বৃষ্টির রাত্রিতে একক এবং নিঃসঙ্গ হয়ে কে বা বাইরে থাকতে চায়!

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে দিল সে। দিশেহারা চোখদুটো জানালায় রেখে বসে রইল নির্নিমেষ। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষন নেই তখনো। আচমকা ছাতা মাথায় গাড়ির বাইরে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখল বর্ষা। লোকটা গাড়ির চারপাশে চক্কর কাটল একবার। তারপর এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। না, কখনোই এটা নাব্য নয়। নাব্যর প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যন্ত বর্ষার মুখস্থ!

মুহুর্তে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল বর্ষার। যাওয়ার সময় গাড়িটা বাইরে থেকে লক করে গেছিলো নাব্য। অতএব চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই ওর। তার এবং সেই আগন্তুকের মাঝে এখন কেবল একটি সিট ও একটা দরজার দুরত্ব। সে আরও গুটিসুটি মেরে বসল। বৃষ্টির সময় দো’আ করলে তা কবুল হয়। তাই সে মনে মনে বারবার আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে দো’আ করতে লাগল৷

লোকটা চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলতেই বর্ষা ভীষণ চিৎকা’র করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে রশু নম্র স্বরে বলল,
–“ভাবি আমি রশু। নবুদা আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

বলে ছাতা হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল গাড়ির বাইরে।
বর্ষা তখনো কুঁকড়ে বসে আছে। এখনো ঠিক ঠাওর করতে পারছে না সে ব্যাপার টা।
অন্যপাশ নিশ্চুপ দেখে বিরতি নিয়ে রশু ফের বলল,
-” ভাবি, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। আপনি একটু কষ্ট করে পেছনের সিটে এসে বসুন।” বলে সে নিজেই হেটে বর্ষার পাশের দরজা খুলে ছাতা বাড়িয়ে দিল বর্ষার দিকে। বর্ষা আড়ষ্টভাবে বেরিয়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসল।

তুলনামূলক কম সময়েই গাড়ি পৌঁছে গেল ধানমন্ডি। একেই বর্ধিত রাত, তার ওপর বৃষ্টি। পুরোটা সময় বর্ষা তমসাছন্ন হয়ে বসে রইল। নিজেকে তার মনে হতে লাগলো কোনো পুরনো বাড়ির অকেজো হয়ে যাওয়া আসবাব! স্বামীর কাছে তার মূল্য এতটা অর্থহীন যে বিনা অপরাধে ওকে এভাবে আধরাতে রাস্তায় একা ফেলে চলে যেতেও ওই লোকটির বাধে নি। নূন্যতম বিবেক বোধ দেখাতেই বোধহয় এখন সেক্রেটারিকে পাঠিয়েছে ওকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য।

গাড়ি থামলে স্থবির পা দুটোকে কোনো মতে টেনে নিয়ে তুলল বর্ষা ওপরে। ঘরে গিয়ে দেখল লোকটা তখনো ফেরেনি।
দরজাটা বন্ধ করে বর্ষা ওখানেই বসে পড়ল ধপ করে। নাব্য ঘরে থাকলে এঘরে তাই ঠাই মেলে না। চলে যায় সে লাইব্রেরি রুমে। সেখানেই ছোট-খাট একটা আপনা-ভূমি গড়ে নিয়েছে সে নিজের জন্য। আজ নাব্য নেই। তাই সেসব নিয়ে ভাবনাও নেই।

জীবনে এমন চরমভাবে অপমানিত এর আগে কখনো হয়নি সে। রশুও নিশ্চয়ই জানে নাব্য ওকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে গেছিল। কাল নিতিন জানবে, শাশুড়ী মা জানবে। এবাড়িতে একমাত্র দাদিই ওকে সত্যিকার ভালোবাসে। সেই দাদিও নিশ্চয়ই জানবে! ভেবে অনুভূতি শূন্য মনে বিদ্রোহের ঝড় ওঠে বর্ষার৷ ভেজা শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে সে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। আর কিছুই ভাববার মতো শক্তি নেই ওর। জীবনের বাস্তবতার তিক্ত স্বাদের উপলব্ধি না পাওয়া আনকোরা মনে অকস্মাৎ এতো ঝড় নিতে পারছে না সে। এসব কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে….. কাকে সে প্রশ্ন করে? কে দিতে পারবে এর জবাব….?
নাব্যর ভালো না বাসার কারণ……?

________________________

বৃথা মনোরথে, আশু অভিসারে, পড়িলাম সুনীল বেশ;
কাতর নয়ানে, সলাজ মুখানে, ফুলেতে সাজাই বেনি-কেশ।
আমি আবার চলি মোহন অভিসারে;
বলো আমি এতো দুঃখ পাই কোথায়ে রে…

বর্ষা আয়নার সামনে দাড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে।
গাঢ় বাদামি রঙা করমচা চোখ। সেই চোখে মোটা করে কাজল আঁকা। হালকা পুরু লাল ঠোঁট, ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট তিল, ঠিক নাকের ডগায় আরও একটা। খোপায় লাগানো শুভ্র নাগচাঁপা ফুল।
গায়ে একরঙা খয়েরী সুতির শাড়ি। হাতে একই রঙের রেশমি চুড়ি। আয়নায় যে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে সেই মেয়েটি কি সুন্দরী নয়? এমন মেয়েকে কি ভালোবাসা যায় না?
তবে ওই লোকটা কেন একবার ফিরেও তাকায় না! সে কি দেখতে এতটা বাজে? এখন যদি সে এভাবে রাস্তায় বেরিয়ে যায় কেউ কি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবে না ওর দিকে? কেউ কি বলবে না, ‘শোনো কাজল চোখের মেয়ে, এই আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, শুধু একবার ভরসা করে দেখো!’
বর্ষা যদি তখন সেই বাড়ানো হাতে হাত রাখে তবুও কি ওই লোকটা চুপ করে থাকবে। তখনো কি তার একটুও হিংসে করবে না?
বর্ষার হঠাৎ চোখ ভিজে ওঠে। সে তো চায় ওই লোকটা হিংসে করুক। চোখে অজস্র ক্ষোভ নিয়ে কঠিন স্বরে বলুক,
-‘বর্ষা, তোমার এতো সাহস! তুমি এভাবে সেজেগুজে রাস্তায় বেড়িয়ে এলে? তুমি জানো না, কেউ তোমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকালে আমার কষ্ট হয়!’

বর্ষার চোখ বেয়ে বড় বড় ফোটায় অশ্রু ঝরতে থাকে। সে নাক টেনে দৃঢ় চোখে আয়নার দিকে তাকায়। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে। দুহাতে ঘষে লেপ্টে দেয় চোখের কাজল। হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলে লিপস্টিক। কাঁচের চুড়ি গুলো খুলে ছুড়ে ফেলতেই সেগুলো ঝনঝন শব্দে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। যত্ন করে বাঁধা খোপাটাও সজোরে টেনে খুলে দেয় সে। খুলতেই একরাশ কোঁকড়ানো চুল ওর পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে। দীঘল সে চুল গিয়ে ঠেকে কোমরে। বর্ষা কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়। সেখানে গিয়ে ঝরনা ছেড়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। মনের কোনে তার আলপনা এঁকে যায় অজস্র বিক্ষিপ্ত কল্পনা। থেকে থেকে তার মনে হয় সে বুঝি কোনোদিন আর খানিক ভালো সময়ের দেখা পাবে না।

__________________________

বাবা হীন পৃথিবী টা আজকাল ভীষণ রুক্ষ লাগে নিতিনের৷ ছোট কাল থেকে বাবা ওকে একটা ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো আগলে বড় করেছেন। বাবাময় সেই পৃথিবীতে দুঃখ নামক কোনো শব্দের উপস্থিতি ছিল না। নিতিনের আবদার যত অযৌক্তিকই হোক। সেটা পূরণে বদ্ধ পরিকর ছিলেন এমদাদ সাহেব।

নিতিনের বর্তমান বয়সটা বিপজ্জনক। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। ওর ক্লাসের সিংহভাগ মেয়ে যেখানে প্রেম নামক অসুখে আক্রান্ত হয়ে অহর্নিশি দিবাস্বপ্ন দেখায় ব্যাস্ত। সেখানে নিতিনের চিন্তার স্রোত এখনো সম্পুর্ন অন্য দিকে প্রবাহিত । তার আকাশ জুড়ে এখনো কেবল বাবার স্মৃতি, বাবাকে একটু ছোঁয়ার আকুতি, বাবার মুখটা খানিকের জন্য হলেও দেখতে পাবার তীব্র আকাঙ্খা।
আজকাল মা শাসন করলে তাই নিতিনের আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। এতো বেশি কষ্ট অনুভূত হয় যে সব ছেড়ে ছুড়ে অসীমে, তারাদের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ওর।

মানুষ এভাবে হুট করে চিরতরে হারিয়ে যায়! অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত আর অবশিষ্ট থাকে না। এত নির্দয় কেন এই পৃথিবীর নিয়ম! তবুও নিতিন সয়ে যায়। এই ভেবে যে পরকালে তো নিশ্চিত ভাবে বাবার সঙ্গে ওর ফের সাক্ষাৎ হবে। সেই সাক্ষাতের পর তারা একে অপরের থেকে আর কখনো আলাদা হবে না এক মুহুর্তের জন্য। পরকালে আবার সবাই একসাথে হওয়ার ব্যাবস্থা যদি না থাকত। তাহলে হয়তো কেউই তাদের প্রিয়জন দের মৃত্যু এত অনায়েসে মেনে নিতে পারতো না।

একটা সময় পর সবার চোখের জল শুকায়। ওপারে মিলিত হওয়ার আশায়, এপাড়ে থেকেও বুকে স্বপ্ন জমায় কতো লোক। সদ্য জন্মানোর পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিষ্পাপ শিশুটির মা, স্বামী হারানো শোকাভিভূত স্ত্রী, পিতা-মাতা হারানো কত এতিম সন্তান….। তারা সবাই স্বপ্ন বোনে। ওপাড়ে একদিন নিশ্চিত ভাবে দেখা হবে এপাড়ে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে। নিতিনও তাদের একজন। নিতিনের জানতে ইচ্ছে করে বাবা কেমন আছে ওই পৃথিবীতে। যেখানে জীবন ফুরাবার নয়।

এসব ভেবে নিতিনের চোখ ভিজে ওঠে। নিজের ঘরে বসে কাঁদতে থাকে সে। শাশুড়ীর আদেশে নিতিনকে ডাকতে এসে বর্ষা হতবাক হয়ে যায়। রাফিয়া আজ মেয়েকে একটু শাসন করেছিলেন। পিতৃসোহাগী মেয়ে। রাফিয়ার অপরাধবোধ হচ্ছিল। তাই বর্ষাকে নিতিনের খোঁজে পাঠিয়েছিলেন তিনি।

বর্ষা দৌড়ে এসে নিতিনের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে। কোমল গলায় বলে,
-“কি হয়েছে আপু? তুমি কাঁদছো কেন? বলো আমাকে।”

নিতিন চোখ মুছে মরিয়া হয়ে বলে,
-” ভাবি, তুমি তো অনেক কথাই বলো। আমাকে একটা কথা বলো তো। যারা চিরতরে ওপাড়ে চলে যায় তারা কেমন আছে, ভালো আছে কিনা..সেসব জানার কই কোনো উপায় আছে ? বাবা কেমন আছে আমি জানতে চাই।”

বর্ষা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান্ত স্বরে বলে,
-“সেখানে কে কেমন আছে সেটা একমাত্র আমাদের রব-ই সবচেয়ে ভালো জানেন গো আপু। তবে পরকালে নিজের বাবা-মায়ের ভালো থাকার পথটা কিছুটা হলেও যেন ত্বরান্বিত হয় সন্তান হিসেবে সেই চেষ্টা আমরা অবশ্যই করতে পারি। বাবা-মা পৃথিবীতে নিজেদের জন্য সবচেয়ে উপকারী যে জিনিস টা রেখে যায় সেটা হলো একজন ভালো সন্তান। তোমার বাবাও মারা গেছেন। আমলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে ওনার৷ এখন কিছু নেকি অর্জনের জন্য তিনি তোমাদের পথ চেয়ে আছেন। তোমার নফল রোজা, নফল সালাত, সাদকা, উত্তম কাজ, কুরআন পাঠ সমস্ত কিছুই ওনার শান্তি, নেকি অর্জনের অছিলা হতে পারে যদি তুমি চাও!”

অনেকক্ষণ পর এইবার নিতিনের মুখে একটু স্বস্থির চিহ্ন দেখা যায়। সে উদগ্রীব হয়ে বলে,
-“সত্যি ভাবি? তাহলে আজ থেকেই আমি সেসব কিছু করবো যা করলে বাবা ওখানে খুব ভালো থাকবে।”

বর্ষা ইষৎ হাসে।
-“একদম সত্যি। তুমি যদি এই সময়ে বাবার জন্য কিছু করতে পার তাহলেই তুমি হবে বাবার শ্রেষ্ঠ সন্তান। ”

বর্ষার মুখে তাকিয়ে নিতিনের হঠাৎ ভীষণ খা খা করে ওঠে ভেতর টা। বর্ষার জন্য সহসা একরাশ মায়া সঞ্চার হয় তার শহুরে, কঠিন মনে। এই নিরপরাধী মেয়েটিকে ভয়ংকর কষ্টের মাঝে দিনাতিপাতে বাধ্য করছে ওর প্রিয় দা-ভাই। ভেবে খারাপ লাগে ওর।
চলবে…….

★অদ্রিজা আশয়ারী।

একদিন নববর্ষা -২৫
অদ্রিজা আশয়ারী

___________

তোমাকে বরং কাছ থেকে আজ দেখি।
জটিল দু’চোখে ক’খানা সরলরেখা,
তুমি বাচলেও ভালোবাসা বাচবে কি?
এসব প্রশ্ন পরাজয় থেকে শেখা।

সে’রাতে রাহিলের পাশে বর্ষাকে দেখার পর প্রথম যে কথাটা মাথায় এসেছিল,’ওরা কি একে অপরকে ভালোবেসে একসঙ্গে থাকছে ?’

চিরকাল আমি জেনে এসেছি ভালোবাসা হলো এক জটিল সমীকরণ। কালির প্রলেপের মতো। একবার যেথায় পড়ে, চিরকাল তার দাগ রয়ে যায়। আমি বর্ষাকে সে কথা জেনেই ভালোবেসেছিলাম। এখনো বোধহয় বাসি। অথচ স্পষ্ট বুঝি ‘ও আমায় ভালোবাসেনি । অসীম এ ভালোবাসা ও বোঝেনি..’
তবু স্মৃতিরা ঊর্ণাজাল হয়ে বারংবার ফিরে ফিরে আসে। কি দোষ করেছিলাম আমি? কি ভুল ছিল আমার ভালোবাসায়?

আমার একপেশে মন কখনো কখনো বর্ষাকে নির্দোষ ভাবতে চায়। একটি গ্রাম্য, অপরিনত বয়সের মেয়ে, কিইবা তার ক্ষমতা! সে হয়তো সত্যিই ভালোবেসেছিল আমায় কোনো এককালে। হয়তো সেদিন বিয়ে বন্ধের শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল সে। কিন্তু ওর সেসব দুর্বিষহ দিনে আমি তো পাশে থাকিনি। বর্ষা হয়তো হার মেনেছিল। বাধ্য হয়েছিল শেষটায় সবকিছু মাথা পেতে মেনে নিতে।

কিন্তু সেদিন বাংলোয় রাহিলের পাশে দাঁড়ানো ওর হাস্যজ্বল মুখের আভায় কোনো কৃত্রিমতা তো ছিল না। ভালো থাকার অভিনয় ছিল না সেটা। ওকে সেদিন সত্যিই সুখী দেখাচ্ছিল। ‘মানিয়ে নিতে হবে’ এই সহজ সত্যটা বুঝতে পেরেই হয়তো সে সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছিল।

এখন আমারও সে সময় এসেছে। এই কথার অনুবন্ধে আমারও উচিত সবকিছু মেনে নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা।
অথচ আমি পারছি না। প্রতিবার ভীষণ রুক্ষ একটা রোষাবেশের দেয়াল বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের মাঝে। বুঝতে পারছি এখনো ভালোবাসা না কি যেন একটা বিষাক্ত আস্বাদনে ছেয়ে আছে আমার ভেতর টা পুরনো সেই বর্ষার জন্য। এ অন্যায্য, ন্যায়বিরুদ্ধ জানি! তবুও আমার অন্তঃকরণ আমার অনিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে…।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চোখ বুঝলাম। এখন বোধহয় শেষরাত্রি। চুপচাপ জেগে শুয়ে থেকে মনে মনে হাজার কথা আওড়াচ্ছি। ঘুম ভেঙেছে একটা বাজে স্বপ্নের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। তারপর থেকে কতশত বিক্ষিপ্ত কল্পনার আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছে মস্তিষ্ক। ক্লান্ত চোখে তবুও নিদ্রা হেলেনি। ভীষণ এক অস্থিরতা আঁকড়ে ধরেছে আমায়। কোথাও যেন কিছু নেই। সবকিছু থেকেও ভয়াবহ নিঃসঙ্গ আমি।

মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতার অপরিহার্যতা অসীম। একটা সময়ের পর সেটা বুঝতে পেরেছি। যখন থেকে পরিণত হতে শুরু করেছিল আমার মস্তিষ্ক। আমার বাবা সাধারণ ভাবে মানুষ হিসেবে ধার্মিক ছিলেন। বাবার এত বড় ব্যাবসা সত্ত্বেও তাই ঢাকা শহরে আমাদের অগণিত বাড়ি/ গাড়ি হয়ে ওঠেনি। বাবা সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। সুসম্পর্ক রেখে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আল্লাহর সাথে। ছোট বেলায় আমাদের ভাইবোনের ইসলামি শিক্ষায় যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

তারপর একটা সময় আমার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলেন। সুযোগ পেয়ে আমি আমার নিজের মতো একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিলাম। যেখানে সালাত-সিয়াম বা আল্লাহর জন্য কোনো সময় নির্ধারিত ছিল না। ছিল না পরিবারের কোনো স্থান। অথচ প্রতিটি মানুষ মাত্রই তাকে কোনো কিছুর দাসত্ব বরণ করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে কেউ বেছে নেয় তার প্রতিপালকের দাসত্ব। আর কেউ বেছে নেয় নিজের নফসের দাসত্ব। আমি দ্বিতীয় টাকে বেছে নিলাম। যখন যা মন চাইত তাই করতাম। এরপর আমার ভালো না থাকার কোনো কারণ ছিল না। অথচ আমি ভালো থাকিনি। দেহ-মন জুড়ে কোথায় যেন সার্বক্ষণিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোথায় কোথায় না গিয়েছি আমি। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য। স্বস্তি মেলেনি কোথাও। সেই অস্বস্তি আজও রয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই মাথাচারা দিয়ে ওঠে ভেতরের সেই অজানা অধীরতা।

ঠিক আজ যেমন হচ্ছে । মুসলিম হিসেবে চিরায়ত ভাবেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ব্যার্থ হৃদয়ে আফসোসের সুর বাজে মাঝেমধ্যে। মালাকুল মউত এসে হাজির হওয়া মাত্রই দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চ নিষ্ফল প্রতিপন্ন হবে। এই ভাবনা যে আমার মধ্যেও কখনো উদয় হয়নি এমন নয়। এই মুহুর্তেও ঠিক এই চিন্তাই করছি আমি। ভেতরে ভয়ানক হাসফাস, নিশ্বাসের উষ্ম রেশ দেহের সবটুকু জুড়ে।

ঠিক সেই মুহুর্তে আমার চিন্তার সাথে সন্ধি রেখেই যেন কুরআন তিলাওয়াতের একটা মৃদু সুর কানে এসে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য অনুভব করলাম। স্থবির দেহটাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে শব্দের উৎস অনুসরণ করে গিয়ে পৌঁছালাম লাইব্রেরি রুমে। বাইরে সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তখনো আবছা অন্ধকার। পাখিদের কুহুরবে নিস্তব্ধ আঁধার ভেঙে সূর্যের উদয় হবে ক্ষানিক পরে। রক্তিম আকাশ তারই জানান দিচ্ছে। জানালার সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে নিমগ্ন হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছে বর্ষা। এমন সম্মোহনী সুর বুঝি আমি কতকাল শুনি নি! কিছু না ভেবে আমি ওর থেকে কিঞ্চিৎ দূরে মেঝেতে বসে পড়লাম। অনুভব করলাম ধীরে ধীরে আমার ভেতরের অস্থিরতা ক্রমশ বিলীন হয়ে আসছে। এতো ভালোবেসে, দিব্য আভা মিশিয়ে, একাগ্রভাবে কেউ কুরআন পড়তে পারে জানা ছিল না আমার!

খেয়াল করলাম পড়তে পড়তেই হঠাৎ হঠাৎ বর্ষার গলা কাঁপছে। সে নিশব্দে কাঁদছে। কুরআন পড়ে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে! দেখে আমি অবাক হলাম।

হঠাৎ বর্ষা পড়া থামিয়ে পেছন ফিরল। ভোরের নির্মল আবছা আলোয় ওর পেলব মুখ শিশিরের ফোঁটার মতো শুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ওর ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা চোখ বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। ভুত দেখার মতো চমকে কিঞ্চিৎ সময় তাকিয়ে রইল সে আমার দিকে। মুহুর্তের জন্য আমিও কেমন অপ্রতিভ হয়ে পড়লাম। খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-“ফজরের সালাতের সময় কি শেষ? ”

বর্ষার উত্তর করতে কিছুটা বিলম্ব হলো । ওর বুঝি বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল।
বলল, ” না, তবে বেশি সময় বাকি নেই। সালাতের হারাম সময় শুরু হয়ে যাবে একটু পরেই।”

দীর্ঘদিনের বিরতির পর আমি সেদিন সালাতে, আমার রবের মুখোমুখি হলাম। মনে এত স্নিগ্ধ অনুভুতি সঞ্চারনের ঘন সন্নিবেশ বোধহয় একযুগ পর পেলাম। স্বীকার করতেই হবে এর পেছনে অবদান অনেকটাই বর্ষার।

মনে হতে লাগল, সে যেন আমার পাপের সাম্রাজ্যে, পুন্যময়ী সম্রাজ্ঞীর আসনে অধীন, কোনো আকাশ লোক থেকে নামা নারী হয়ে এসেছে!

***

দাদি ডেকে পাঠিয়েছেন। ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে ডেকে বললেন,
-” কেডা, নবু? আয়। ”

আমি ভেতরে পা বাড়ালাম। বরাবরের মতো দাদি পালঙ্কের ওপর পানের বাটা নিয়ে বসে আছেন। আমি আসতেই ভাজ পড়ে যাওয়া মুখে চওড়া হাসি ফুটল। পাশে বসিয়ে দু-একটা সৌজন্য কথাবার্তার পর দাদি সোজা আমার চোখের দিকে তাকালেন। কিয়ৎক্ষন পর কেমন লীন হয়ে আসা গলায় বললেন, ” নবু, তুই সত্যি ভালো আছোস তো? আমার লগে মিছা কথা কইস না দাদু। তোর লাইগা আমার পরাণডা দিনরাইত পোড়ে। ”
দাদির আদ্র প্রকম্পিত স্বরে কান্নার অনুরক্তি খুব স্পষ্ট ভাবে টের পেলাম।
দাদির ঘরে এলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি পাওয়া যায়। যান্ত্রিকতা হীন, প্রাচীন ভেজা ভেজা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে। আমি কিছু না বলে দাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সামনের দেয়ালে।
দাদি চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একসময় নিজ থেকেই বললেন,
-“বিশ্বাস কর রে দাদু। পরের বউরে কাইরা আনা যদি গুনার কাম না হইত সেই কবেই আমি ওই মাইয়ারে তোর কাছে আইনা দিতাম!
কিন্তু এইডা তো আর সম্ভব না। মাইয়া মানুষ হইল মায়ার কাঙ্গাল। যেইহানে একটু মায়া, ভালোবাসা পাইব সেইহানেই নিজের শিকড় ছড়ায়া গাছের মতো সবাইরে ছায়া দিতে শুরু করবো। কিন্তু গাছ একবার শিকড় বিছাইলে যে আর কখনো উঠতে পারে না। তহন তারে সরাইতে গেলে পুরা গাছটাই কাইটা ফেলতে হয়। ওই মাইয়াও মায়ায় আটকাইছে। বিয়া যার লগেই হোক। ভালোবাসা কম-বেশি যাই হোক! একসঙ্গে থাকতে থাকতেই মাইয়া মানুষের শিকড় ডালপালা মেইলা আরও বিস্তৃত হয়। আজ তুই ওই মাইয়ার লাইগা দুনিয়া উজার কইরা দিলেও সে আর ফিরব না। সে এহন ওই সংসারের মায়ায় পড়ছে। সেইটা আর ছাড়তে পারব না। ”

আমি টের পেলাম আমি চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। দাদির একটু প্রশ্রয়ের আভাস পেয়ে লাগামহীন হয়ে পড়েছে ভেতরের পলকা হৃদয়! রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে সে হৃদয়ের ডহর বিরহকোণ থেকে।

দাদি উদাস চোখে সামনে তাকিয়ে আবারো বললেন,
” মায়া বড় কঠিন জিনিস রে দাদু। ভালোবাসলে সেই ভালোবাসা একসময় ঘৃণায় পরিনত হইতে পারে। কিন্তু একবার মায়ায় জড়াইলে সেই মায়া আর কহনো কাটানো যায় না। সারাজীবন বুকে আগুন নিয়া কষ্ট পাইতে হয়৷ কারণ মায়া এমন এক জিনিস যার বিপরীতে কোনোদিন ঘৃণা আসে না।
তুই তারে ভুলবার পারস নাই জানি। এই বাড়ির সবাই জানে। নাতবউয়ের প্রতি তোর আচরণে সেইডা অহরহ প্রকাশ পায়। সেই বেচারি আরও মহা মুসিবতে পড়ছে। তোরে সে ভালোবাসে, তোর জন্য তার মায়াও হয়। এতো কষ্টের পরও তাই সে যাওয়ার নাম করে না। দুঃখের কথা কাউরে কিছু কইতেও পারে না। একা একা লুকায়া কাঁন্দে। ওর কান্দোন আমার সহ্য হয় না। বুক ফাইটা যায়। কেন যায় তুই জানোস? ”

এবারেও সম্পুর্ন নিরুত্তর রইলাম আমি। দাদি সন্তর্পণে আমার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে আলমিরার কাছে চলে গেলেন।
একটা ছবি উল্টো করে বুকে চেপে ধরে ফিরে এসে আবার বসলেন পূর্বের স্থানে। বালিশের নিচ থেকে আরও একটা ছবি বের করলেন দাদি। ছবি দুটো একসঙ্গে হাতে নিয়ে গভীর বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই ছবির দিকে। তার মধ্যে একটা ছবি আমার স্ত্রী বর্ষার। ফুলহাতা গোল জামা পড়নে, লম্বা বেণী একপাশে দুলিয়ে হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। অন্য ছবিটি দেখে আমি অবাক না হয়ে পাড়লাম না। সেই ছবিটিতে থাকা মেয়েটির মুখের আদল হুবহু বর্ষার মতো। তবে ছবিটি সাদাকালো। সাদাকালো ছবির সেই মেয়েটির পড়নে ডুরে শাড়ি। কাঁধের দুপাশে দুই বেণি ঝুলিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে আরক্তিম মুখে। দাদি হঠাৎ বললেন,
-” তোর ইরির কথা মনে আছে? অবশ্য মনে না থাকবারই কথা। তুই যহন জন্মাইছস তহন সে আঠারো বছরের মাইয়া। তোরে সারাদিন কোলে নিয়া পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ঘুইরা বেড়াইতো। নিমিষেই চোখে হারাইত তোরে। আমারে কইত,
“আম্মা, তোমার নাতি তো আমার কলিজার ভিতরে ঢুইকা পরছে। কিছুতেই বাইর করতে পারতাছি না৷ ও সামনে না থাকলেও আমি খালি দুই চোখে ওরেই দেখি। শোনো আম্মা, তোমার সাথে আগেই কথা ফুরায়া রাখি। আমার যখন মেয়ে হইব তখন ভাইয়ার ছেলের সাথেই ওরে বিয়া দিমু আমি। আমার নবু বাবারে আমার থেকে দূরে হারাইতে দিমু না৷
নাব্যর সাথে মিলায়া আমার মেয়ের নাম রাখমু বর্ষা। দুইজনই প্রকৃতির অনন্য দুই রুপ। ঠিকাছে না আম্মা?”

দাদি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন
-“ইরি তোরে কি যে ভালোবাসতো! মাঝে মাঝে রাফিয়া পর্যন্ত বিরক্ত হইত তোর প্রতি ইরির টান দেইখা। ”

কিন্তু ইরির মনের আশা আর পুরন করা হইলো না। তার অনেক আগেই সে আমগোরে রাইখা ওইপাড়ে গিয়া পাড়ি জমাইল। সেই আঠারো বছরের ইরি একদিন হুট কইরা অসুখে ভুইগা মৃত্যুর কোলে ঢইলা পড়ল। যাওয়ার আগেও শেষবার তোরে একটু কাছ থাইকা দেখার লাইগা, ছোঁয়ার লাইগা কি ছটফট করতাছিল। সে জানতো তার হাতে আর সময় বেশি নাই। তুই ছিলি রাফিয়ার সঙ্গে নানার বাড়ি। শেষ দেখা হইল না।

ইরি আছিল ওর বাপের কলিজার টুকরা। বাপ মারা যাওয়ার মাত্র তিনবছর পর ইরিও চইলা গেল। কি এক অসুখ করল মাইয়াডার। মরণ রোগে ধরল। নাইলে তুই ক, এত কম বয়সে কেউ মরে? এহন তোর বাপও গেল গা। বাপ, ভাই-বোন সব আমারে ফালায়া ওইপাড়ে গিয়া ঘর বানছে। শুধু আমি রয়া গেছি। আমারে কেউ সাথে নেয় নাই ওরা। ”

দাদির গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের উষ্ণ স্রোতে। সত্যিই! কত একা হয়ে গেছে দাদি। স্বামী, সন্তানের মৃত্যু চোখের সামনে দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ভয়াবহ ব্যাপার! নিজের প্রিয় মানুষ গুলোকে একে একে হারিয়ে যেতে দেখেছে দাদি চোখের সামনে৷
আমি দাদির হাত চেপে ধরলাম।
-“কেঁদোনা দাদি৷ আমরা আছি তো। আমাদের ছেড়ে কোথাও যেবে দেব নাকি তোমাকে? নিতিন কত ভালোবাসে তোমায়। আমিও তো খুব ভালোবাসি। সেসবের কি কোনো মূল্য নেই? তুমি আর কাঁদবে না দাদি। কেমন?”

দাদি চোখ মুছে সাদাকালো ছবিটা দেখিয়ে বললেন,
-” এই হইলো তোর ফুফু ইরি। ওর ছবিডা বহুদিন আমার সিন্দুকে তোলা আছিল। দেখতে মন চাইলেও কহনো বাইর করতাম না। কষ্ট হইত। বর্ষা আওনের পর বাইর করছি সিন্দুক থাইকা। নাতবউ যহন হাসে, কথা কয়, মনে হয় যেন আমার ইরি ফিরা আইসে। ইরির ছবি দেখলে তহন আর জ্বালাপোড়া হয়না অন্তরে।”

আমি ছবিদুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই আশ্চর্য মিল দুটো মানুষের মাঝে। দাদি ফের বললেন,
-“নবু, নাতবউরে কহনো কষ্ট দেইস না তুই। ওর কষ্ট হইলে আমারও কষ্ট হয়। ইরির কথা মনে পড়ে….।

তোরে একটা ব্যাপার জানানোর কথা। রাফিয়া কইবার সাহস পাইতাসে না। আমারে দায়িত্ব দিসে। সেই কথা কইবার লাইগা ডাকছিলাম তোরে। অথচ দেখ হাবিজাবি কত কিছু কয়া ফালাইলাম! ”

আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
-“কি ব্যাপার দাদি?”

দাদি কিছুটা বিরতি নিয়ে বললেন,
-“তোর বড়মামা কক্সবাজারে রিসোর্ট না কি জানি বুক করছে তোগর লাইগা। বিয়ার পর এহনো তোরা কোনোখানে ঘুরতে গেলি না…সেইজন্য।
রাফিয়া আমারে অনুরোধ কইরা কইসে, যেভাবেই হোক তোরে রাজি করাইতে। নাইলে ভাইয়ের সামনে ওর মান সম্মান কিছু থাকবো না৷
নবু, আমিও কই, তুই যা নাতবউরে নিয়া। তোর বড়মামা কেমন একরোখা তুই তো জানোস! সে যেভাবেই হোক তোরে নিয়াই ছাড়বো।
বউডার কথাও একটু ভাব। বিয়া কইরা সেই বেচারি যেন পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখি হয়া গেসে। ওর মুখে হাসি নাই। তোরা ঘুইরা আয়। অন্তত আমার কথা ভাইবাই যা তুই।”

আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে দাদি ফের তাড়া দিলেন। -“কি রে, যাবি না? বল? ”
উত্তরে কি বলব ভেবে পেলাম না। আর কতবার অন্যের ইচ্ছায় নিজেকে সোপর্দ করব আমি? জানা নেই! নিশ্বাস ফেলে, ” যাবো। ” বলেই বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে।

চলবে…
★অদ্রিজা আশয়ারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here