একদিন নববর্ষা -৩২,৩৩

0
190

একদিন নববর্ষা -৩২,৩৩
অদ্রিজা আশয়ারী
৩২

একটি ফুটফুটে রাজপুত্র বর্ষার কোল জুড়ে দা’পাদা’পি করছে। দীর্ঘ ঘুম শেষে আড়মোড়া ভাঙছে হাত পা ছুড়ে। বর্ষা উৎসুক দৃষ্টি মেলে শিশুটিকে দেখছে। তার মুখে উজ্জ্বল হাসির রেখা। এই প্রথম কোলে নিয়েছে নিজের ভাতিজাকে। ওর চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। প্রথম অবস্থায় বাচ্চাদের চেহারা ভালো করে বোঝা যায় না। তবুও সবাই বলছে বাচ্চাটা নাকি একদম বর্ষার চেহারা পেয়েছে। সেই একই মুখের আদল, একই হাসি আর চাহনি।

চারমাস আগে বৌভাতের পর বাবার বাড়ি এসেছিল। তারপর এতোদিন পেরিয়ে বর্ষা ফের নিজ বাড়িতে পা রাখল। এসেই দেখা পেল নতুন অতিথির। গতকাল মাত্র ছেলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে ফাবিহা।

এক লাগেজ বোঝাই জামাকাপড় নিয়ে এসেছে বর্ষা। আর সঙ্গে সবার জন্য ছোটখাট কিছু উপহার। ঠিক করে এসেছে এবার অনেকগুলো দিন বাবার বাড়িতে কাটাবে। কিন্তু তিনদিন যেতে না যেতেই বর্ষার মনোভাব বদলে গেল। সে অবাক হয়ে খেয়াল করল এবাড়িতে আর কোনোভাবেই সে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। যতটা ওখানে করে আজকাল। মন টিকছে না এখানে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির অনুভব করছে। ও বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্য পুড়ছে ওর মন! বিশেষ করে দাদির জন্য।

নাব্য তো রয়েছে অনেক দূর। সারাদিনে এক-দুবার মাত্র কথা হয় ওর সঙ্গে। কখনো কখনো সেটুকুও হয়না। নেটওয়ার্ক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মাঝখানে। আরও একজন আছে, যাকে ছাড়া মন পোড়ে। নিতিন। এই তিনদিনে নিতিন অসংখ্য বার কল করেছে বর্ষাকে। খানিক পর পর কল করে দু চারটে হাবিজাবি কথা…ব্যাস! বর্ষা জানে, নিতিন মেয়েটা কত ভালোবাসে ওকে। কিন্তু নাসিমা এসব বোঝেন না। নিতিনের কিশোরী সুলভ দুরন্তপনায় তিনি যারপরনাই বিরক্ত। কতবার তো মুখ ফুটে বলেও ফেলেছেন,
-‘মায়ের চেয়ে দেহি মাসির দরদ বেশি! জামাইরে তো দেহি না তোরে এতবার ফোন দিতে? এই মাইয়া এত ঢং করে কেন? সবখানে বড়লোকি না ফলাইলে চলে না। হুহ্!’
মা কে কিছু বোঝানো দায়। উত্তরে কিছু না বলে তাই বর্ষা নিরব থেকেছে।

এখানে চারপাশে এতো লোকজন। প্রত্যেকেই কতো আপন ওর। তবুও এতো খালি খালি লাগছে কেন সবকিছু! মাত্র তিন রাত্রি যাপন শেষেই বর্ষা সিদ্ধান্ত নেয় ওবাড়ি ফিরে যাবার। নাসিমা হাজার বলেও মেয়েকে ধরে রাখতে পারলেন না। বড় ভাই সোহাগের সাথে বর্ষা চলে গেল। যাবার আগে ভাতিজার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিল। আর অজানা কারণে বাবার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদল। কেন এতো কাঁদল সেদিন, তার কারণ সে নিজেও জানে না। শুধু জানে বাবাকে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল!

____________________________

হেমন্ত শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। বিকেলের উত্তরে হাওয়ায় শীত শীত ঘ্রাণ। বিছানার সঙ্গে লাগোয়া জানালা ঘেঁষে বর্ষা বসে আছে। ওখান থেকে বারান্দার ছোট ছোট টবে লাগানো লাল, সাদা ফুল নজরে আসে। ফুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে হেমন্তের মাতাল বাতাসে। বর্ষা একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে আছে। মস্তিষ্ক টা শূন্য লাগছে। কোনোকিছুই ভাবতে ভালো লাগছে না।

গুনে গুনে বাইশ দিন পেড়িয়েছে নাব্য চট্টগ্রাম গেছে। এখনো ফেরেনি। তার ওপর আজ সকালের পর থেকে একটি বারের জন্য কল করেনি বর্ষাকে। ও নিজে থেকে যে দেবে সে পথ বন্ধ। আজ সকালেই নাব্য কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করেছে ওকে। যেন সে আর কখনো নিজ থেকে কল না দেয়। যখন সময় হবে নাব্য নিজেই কল করবে। সাপেক্ষে যুক্তি দিয়েছে যখন তখন এভাবে কল করে কথার ফুলঝুরি খুলে বসে বর্ষা নাকি ওর কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। হিসেবনিকেশে গন্ডগোল বাঁধিয়ে দেয়। নিজের বিরুদ্ধে এমন অপমানজনক অভিযোগের আখ্যা শোনার পর বর্ষা কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়েছিল লাইনটা। তারপর নাব্যও আর কলব্যাক করেনি।

কিন্তু বর্ষার এবার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। নাব্যর সঙ্গে যোগাযোগ হীনতার মেয়াদ যত দীর্ঘ হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওর অস্থিরতা। ধীরে ধীরে নিশ্বাসের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। বর্ষা বুঝতে পারছে না এটা তার ভ্রম কিনা! তবে যাই ঘটুক না কেন, আজ সে কিছুতেই নিজে থেকে কল করবে না ওই গোমড়া মুখো মেঘকে। ম’রে গেলেও না। অথচ মস্তিষ্কের এই সিদ্ধান্তটাও বেহায়া মন মানতে নারাজ। মন চাইছে একছুটে গিয়ে নাব্যর নাম্বারে ডায়াল করে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতে।

শুধু একবার নাব্যর গলার স্বরটা শুনবে সে। আর কিচ্ছু না। তার পরই নিজ থেকে কেটে দেবে লাইন। এতেও কি বিরক্ত হবে নাব্য? রাগ দেখাবে বর্ষার প্রতি? বর্ষার খুব কান্না পাচ্ছে। আজকাল এমনি হয়। খুব অল্প, একেবারে সামান্য থেকে সামান্যতম ব্যাপারে চোখ ছলছল করে ওর। বর্ষা বোঝে না ধীরে ধীরে সে এমন কেন হয়ে যাচ্ছে। কেন এত ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে ওর ভেতর টা?

বার দুয়েক ঠকঠক কড়া নেড়ে নিতিন দরজার বাইরে থেকে মুখ বাড়াল।
–‘ভেতরে আসব?’
পেছন ফিরবার আগেই বর্ষার খেয়াল হলো ওর দুই গাল সিক্ত করে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। নিজের কাছেই এবার ভারি লজ্জিত বোধ করল সে। চোখের জলের এমন অবাধ্য অহনির্শি পতন অবশ্যই অন্যকে জানিয়ে বেড়াবার মতো বিষয় নয়। বর্ষা দ্রুত চোখ মুছে ফেলল। নিতিন দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিল। কাছে এগিয়ে এলো।
-‘ কি করছিলে?’ জিগ্যেস করে পাশে বসল। তারপর আলাপে মশগুল হয়ে পড়ল সমবয়সের ও সমমনের দুই সখী।

বাইরে তখন ঘোর সন্ধ্যা। পশ্চিম আকাশ জুড়ে রক্তিম মেঘের ছড়াছড়ি। নীড়ের সন্ধানে বিহঙ্গের দল উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের পাণে, সেই লালিমাকে লক্ষ্য করে। সব পাখিরা কেন সন্ধ্যায় পশ্চিম মুখী হয়েই ফেরে জানতে ইচ্ছে করে বর্ষার। চায়ে চুমুক দিয়ে কথাটা বলবার উদ্দেশ্যে সে নিতিনের অভিমুখে ফিরল। কিন্তু তখনি অকস্মাৎ কাশতে শুরু করল। কমার বদলে ধীরে ধীরে কাশিটা বাড়তে লাগল। বর্ষা শাড়ি আঁকড়ে ধরল। কাশির সঙ্গে এখন বমিও পাচ্ছে ওর। বমি নামক জিনিসটা কে ছোট কাল থেকে ভীষণ ভয় করে। এবং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করে। এখনো তাই করল। কিন্তু ক্রমাগত কাশতে কাশতে সহসা ওর মুখ রক্তিম হয়ে উঠল।
চোখের সামনে অন্ধকার ঠেকল সবকিছু। চোখ বুজেই একসময় মেঝেতে উবু হয়ে বসে পড়ল সে। গড়গড় করে বমি করল। সঙ্গে সঙ্গে ভীত স্বরে আর্তনাদ করে উঠল নিতিন। ওর চিৎকারে ভারি হয়ে উঠল চারপাশের বাতাস।
নিতিন কিছু বলতে পারছে না। চিৎকার দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বর্ষার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে।

পুরো ব্যাপারটা ঘটে গেল কয়েক মুহুর্তের মধ্যে। অতর্কিতে সৃষ্ট এই পরিস্থিতি আর নিতিনের তারস্বরে চিৎকার বর্ষাকে আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। এবার সত্যিই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। শ্বাস নেয়ার জন্য মুখটা ক্ষানিক ওপরে তুলল সে। চোখাচোখি হল নিতিনের সঙ্গে। নিতিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার নিজের নাকে হাত রাখল। হাতে তরল জাতীয় কিছু একটা ঠেকল।
হতবিহ্বল বর্ষা নিতিনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে এই প্রথম নিজের হাত ও মেঝের দিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল ওর। তার পরের ব্যাপার গুলো আরও দ্রুত ঘটল। নাক দিয়ে তখনো র’ক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সেই অবস্থাতেই ঘুম কিংবা অচেতনতায় মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে গেল বর্ষা।
চিৎকার শুনে রাফিয়া ততক্ষণে কাজের মেয়ের সঙ্গে ছুটে এসেছেন। নিতিন তখনো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ষার নাক ও মুখ থেকে নির্গত টাটকা র’ক্তের দিকে।

___________________________

তার দুদিন পর সন্ধ্যায় ফিরল নাব্য। এই দু’দিনে রাফিয়া অসংখ্য বার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। সফল হননি একটি বারের জন্য। গত কাল রশু ফোন করে জানিয়েছে নাব্য নিজের সেলফোন টা হারিয়ে ফেলেছে। আপাতত কথা বলবার পথ নেই। সে ঢাকায় ফিরেই একবারে কথা বলবে। রাফিয়া ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,
-‘নবুকে ডাকো। বলো তোমার ফোন দিয়েই আমার সঙ্গে দু মিনিট কথা বলতে। জরুরি দরকার। ‘ উত্তরে রশু মিনমিনে গলায় জানাল নাব্য ওর পাশে নেই। চাইলেও নাব্যকে এখন ফোনটা ধরিয়ে দিতে পারছে না সে।

রাফিয়া অস্থির হলেন। দুশ্চিন্তায় পড়লেন সেই আগেকার মতো। বরং তখনকার চেয়েও বেশি৷ যখন নাব্য পরোয়াহীন হয়ে, কাউকে না জানিয়ে দিনের পর দিন পরিবার ছেড়ে বন জঙ্গলে পড়ে থাকত।

নাব্য ফিরল সন্ধ্যা লগ্নে। রাবেয়া মঞ্জিলে শুনশান নীরবতা। নিচে কারো দেখা না পেয়ে নাব্য সোজা ওপরে উঠে এলো। বর্ষা সালাত শেষে সবে জায়নামাজ ভাজ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। নাব্যকে ঘরে আসতে দেখে সে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেল। মুহুর্তে আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ওর দেহমন। ওকে এতটা আড়ষ্ট হতে দেখে নাব্য কিছুটা অবাক হলো। মনে হলো কিছু একটা যেন আজ অন্যরকম। আজ ওকে দেখে সালাম দিতেও এগিয়ে আসেনি বর্ষা। অথচ কখনো সে এই ব্যাপারে ভুল করে না।

-‘কি হয়েছে? ‘
কয়েক পা এগিয়ে বর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধাল নাব্য।
বর্ষা অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর করল,
-‘কিছু না।’
-‘এদিকে তাকাও। কি হয়েছে বলো? আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
বর্ষা নিশ্চুপ।
-‘কিছু বলবে না? আমি চলে গেলে খুশি? তবে আমি চলে যাচ্ছি.. ‘
নাব্য সত্যি ঘুরে দরজার দিকে যেতে লাগল। তাই দেখে বর্ষা ছুটে গিয়ে ওর জামা টেনে ধরল।
-‘কোথায় যাচ্ছেন? ‘
নাব্য ফের ঘুরে তাকাল বর্ষার দিকে।
-‘ আমার ফেরাতে তো কেউ খুশি হয়নি তাই চলে যাচ্ছি।’
-‘ কেউ খুশি হয়নি বলেছে আপনাকে?’ বর্ষার গলার স্বর কাঁপছে। কম্পন টের পেয়ে নাব্য এবার হেয়ালি ছেড়ে গম্ভীর হয়। স্বরে আদ্রতা মিশিয়ে বলে
-‘কি হয়েছে বর্ষা? ইজ এভরিথিং ওকে?’
বর্ষা উত্তর না দিয়ে দু পা এগিয়ে নাব্যর গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। নাব্য দু’হাতে ওকে আলিঙ্গন করতেই ওর বুকে মুখ লুকিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায় একসময়। বর্ষা তবুও থামে না।
জড়ানো স্বরে কিছু একটা বলতে থাকে। কিন্তু কান্নার প্রকোপে ওর বলা কথা অস্পষ্ট শোনায়। অনেক চেষ্টার পর নাব্য বর্ষার কথার অর্থোদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করবার জন্য বলে
-‘ আসতে কেন দেরি করেছি? ব্যাস এটুকুই ! এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এভাবে কাঁদে কেউ? কাজে আটকে গেছিলাম। সেজন্য ফিরতে দেরি হয়েছে। এর মধ্যে সেলফোনটা হারিয়ে গেল। রশুকে বলেছিলাম তোমাদের ইনফর্ম করতে। কেন রশু কিছু বলেনি?’
নাব্য বুঝল বেকার কথা বলছে সে। বর্ষা কিছু শোনার বা বোঝার মতো অবস্থায় নেই। কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। নইলে অত অবুঝ মেয়ে তো বর্ষা নয়!

সে কিছুটা সময় দিল বর্ষাকে সামলে ওঠার জন্য। তারপর ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘বর্ষা, এবার কি বলবে আমাকে কিছু? প্লিজ ?’
কান্নায় বসে যাওয়া গলা আর ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে বর্ষা নাক টেনে বলল,
-‘আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচবো না।’ তারপর সেদিন সন্ধের ঘটনাটা জানাল নাব্যকে। শেষে বলল,
-‘আমি মরে গেলেই আপনি ওই বর্ষাকে বিয়ে করবেন। তাই না?’ ফের কান্না শুরু।

নাব্য এবার সত্যি কিছুটা বিরক্ত।
-‘নাক, মুখ দিয়ে র’ক্ত বেরোলেই কেউ মরে যায় না বর্ষা। আচ্ছা আমি দেখছি। কাল ডক্টরের কাছে যাব আমরা। ‘

নিচ থেকে রাফিয়ার ডাক ভেসে এলো। নাব্যর ফেরার খবর টা নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্রচার হয়ে গেছে।
আরও খানিকক্ষণ বর্ষাকে বুঝিয়ে নিচে চলে গেল নাব্য। ডাইনিং এর এককোণে বসে নিতিন ওটস খাচ্ছিল। নাব্য তার পাশের চেয়ার টেনে বসল।
নিতিনের নাক টেনে দিয়ে বলল,
-‘ কেমন আছিস বুড়ি?’
-‘ভালো।’
-‘একি নবু! ফ্রেশ না হয়েই চলে এসেছিস যে?’ রান্নাঘর থেকে ফিরে রাফিয়া বললেন।
-‘আর ফ্রেশ! আসতে না আসতেই বর্ষা বিলাপ করে কান্না জুড়ল। ও নাকি আর বেশিদিন বাঁচবে না। নাক, গলা দিয়ে র’ক্ত বেরিয়েছে তাই!’

নিতিনের খাওয়া শেষ। তিনবার দম নিয়ে ঢকঢক করে পানি গলঃধকরণ করে ডাইনিং ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আর কিছু বলেনি ভাবি?’
-‘আর কি বলবে?’
-‘আচ্ছা বাকিটুকু নাহয় এখন আম্মার মুখেই শুনে নাও। আমি গেলাম। ‘ বলে নিতিন সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে গেল। বোকার মতো হা করে তাকিয়ে রইল নাব্য।
রাফিয়া ফিরে এলেন পুত্রের প্রিয় ধোঁয়া ওঠা আলুর পরোটা নিয়ে।
-‘নিতিন কি বলছিল আম্মা? আচ্ছা, ওসব ছাড়ো। রশুকে বলেছিলে জরুরি কথা বলবে আমার সঙ্গে। বলো কি জরুরি কথা।’
নাব্য গুরুতর মুখ করে মায়ের পানে তাকিয়ে রইল। রাফিয়া বিলম্ব করছেন দেখে গ্লাসে পানি ঢেলে মুখে দিল সে। পরোটার ওপর ক্ষানিক ঘি ছড়াতে ছড়াতে তখনি রাফিয়া বললেন,
-‘বর্ষা প্রেগন্যান্ট। এখনি বেশকিছু কমপ্লিকেশন ধরা পড়েছে। আপাতত একজন ডক্টরের সঙ্গে কনসাল্ট করেছি আমরা। তবে ওনার ওপর আমার ঠিক ভরসা হচ্ছে না। তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখিস তো ভালো…..’
রাফিয়ার কথার মাঝখানেই গলায় পানি আটকে নাব্য উজিয়ে উঠল। গ্লাসের পানি পড়ে ভিজে গেল পরনের বাদামি রঙা শার্ট। কাশতে কাশতে এবার নাব্যর চোখ মুখও লাল হয়ে উঠল।
রাফিয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,
-‘আরে… আরে…শার্টটা পুরো ভিজে গেছে। তুই ঠিক আছিস তো নবু?’
নাব্য যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল
-‘হ্যাঁ। ‘
-‘ খাচ্ছিস না কেন? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!’
-‘ পরে খাবো আম্মা। শার্টটা বদলে আসি।’ রাফিয়ার আর কোনো বারণ না শুনে নাব্য সিড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেল।

চলবে……

একদিন নববর্ষা -৩৩
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

ভালোবাসা ব্যাপার টাই বড় বেশি জটিল। কে কাকে ভালোবাসে, কতটা ভালোবাসে কিংবা আদতেই ভালোবাসে কিনা… এই সত্যের ব্যাপারে ষোলোআনা ওয়াকিবহাল হয় না কেউ।
যার সান্নিধ্য জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত আমরা কামনা করি। হয়তো সেই সান্নিধ্যে থাকার প্রয়াসকেই অন্য নামে আমরা সঙ্গায়িত করি ভালোবাসা হিসেবে। কিন্তু নিপাট ভালোবাসা বোধহয় এই সমস্ত মানবিক নিয়ম মেনে চলে না। ভালোবাসার দুর্বোধ্য রসায়নে মানবতার কোনো বালাই নেই। ভালোবাসা ততক্ষণ ভালোবাসে না, যতক্ষণ না সেই ভালোবাসার জন্য আমরা দাসত্ব বরণে স্বীকৃত হই। সেজন্যই হয়তো হৃদয়ের একক প্রকোষ্ঠে আমরা খুব বেশি লোককে ঠাই দিতে পারি না একসঙ্গে । আমাদের হৃদয় তো শুধুমাত্র একটি সত্ত্বাকে ভালোবাসার উপযোগী করেই গড়া। যে সত্ত্বা এই সমস্ত ভালোবাসার কারিগর।
সেই সত্ত্বাকে অন্তরে ঠাই দেয়ার পর আর যা কিছু কে আমরা ভালোবাসা বলি সেসব আসলে শুধুই মায়া। যা সেই অদ্বিতীয় সত্ত্বারই দান করা অনন্য এক নিয়ামত।

নাব্য চিন্তিত। আল্লাহ প্রদত্ত সেই মায়া আদৌও কি সে ধারণ করতে পেরেছে বর্ষার জন্য? যে মায়া সে তার মা-বাবা, বোন, দাদি আর…..হয়তো গরানবনের সেই বর্ষা কেও করে।
সে মায়া কি ওর অনাগত সন্তানের মা বর্ষার জন্য তার আছে? এর উত্তর নাব্য সত্যি জানে না। আর জানে না বলেই ওর মন এত উদ্রিত হয়। দ্বিচারিতার মতো জঘন্য অপবাদের কালীমা ওর গায়ে লাগুক কখনো চায় না নাব্য। অথচ ওর মনের আনাচে-কানাচে.. কোথাও যে আজও পুরনো সেই বর্ষার জন্য কিছু একটা রয়ে গেছে.. তা সে স্পষ্ট অনুভব করে। এই স্থিতিহীন অনুভুতির কি নাম সে দেবে?

নাব্য আলগোছে ওর বা পার্শ্বে তাকায়। কম্বল জড়িয়ে বর্ষা গুটিসুটি মেরে শুয়ে, ডুবে আছে ঘুমের অতলে। ওকে খুব বেশি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। ওর হাতের মুঠোয় একটা দলা পাকানো সাদা রুমাল। রুমালের অধিকাংশ র’ক্তের লালিমায় রাঙানো। বর্ষার এই অজানা অসুখটা আজকাল নাব্যের একটা বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ে অসময়ে বর্ষার নাক, গলা দিয়ে র’ক্ত আসে। ডক্টরের শরণাপন্ন হয়েও এর কোনো সমাধান মেলেনি। ডক্টর বলেছে এতে গর্ভকালীন কোনো বড় সমস্যা দেখা দেবে না। কিন্তু তবুও নিশ্চিত হতে পারছে না কেউ।
এই কয়েকদিনেই বর্ষার ওজন সাত কেজি কমেছে।
লো ব্লাড প্রেশার, অসহ্য শারিরীক যন্ত্রণা। তার সঙ্গে সবসময় বমি আর নাক, গলা দিয়ে নিয়মিত এই র’ক্তক্ষরণ ওকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে।

___________________________

সবে অগ্রহায়ণের শুরু। ঢাকা শহরে কোনো কালেই শীতটা জাঁকিয়ে পড়েনা। তবে এবার শীতের প্রকোপ অন্যসময়ের চেয়ে কিছুটা বোধহয় বেশি৷ পূর্ব মুখী বারান্দায় বেতের দোলনায় পা মুড়ে বসে সকালের রোদ পোহাচ্ছে বর্ষা। দোলনাটা স্থির থাকছে না এক মুহূর্তের জন্য। খুব ক্ষীণ ভাবে দুলছে।
সেই দোলনার গায়ে হেলে, রোদ্দুরে সরু হয়ে আসা চোখ মেলে, হাতে থাকা কফির কাপের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে। কতদিন পেড়িয়ে গেল চা-কফি কিছুই খাওয়া হয়না ওর। আজকের কফিটা নাব্য নিজে তৈরি করে দিয়ে গেছে। নাব্যের তৈরি কফি সবসময় সেরা। কিন্তু তবুও এক চুমুকের বেশি মুখে রোচেনি।
আজকাল প্রায় সারাটা দিন একক- নিঃসঙ্গ কাটে বর্ষার। নিতিন নিজের মতো ব্যাস্ত থাকে। অনেক গুলো সিড়ি ভাঙতে হবে, এই ভয়ে দাদির কাছেও বর্ষার যাওয়া হয়ে ওঠে না খুব একটা।

কফির কাপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই অকস্মাৎ কেঁদে ফেলে বর্ষা। সকালের সোনালী রোদ্দুরে, ওর গৌড়বর্ণ মুখে, অশ্রুবিন্দু টা হীরকখন্ডের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে হঠাৎ! সে ব্যাপারে সম্পুর্ন বেখেয়াল, ভাবনায় নীরন্ধ্র আচ্ছন্ন মেয়েটা চুপচাপ রোদে মুখ করে কাঁদতে থাকে। কান্নাটা এখন ওর নৈমিত্তিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যখন-তখন, কারণে অকারণে আজকাল কাঁদে সে। তবে এখনকার মতো কান্নার একটা ক্ষুদ্র কারণ খুঁজে বার করে। নিতিনের সঙ্গে ওর সখ্যতার অন্তরায় ঘটেছে। নিতিন ওকে এড়িয়ে চলে আজকাল। সারাদিন নিজের ঘরে, রুদ্ধদারের ওপাশে কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে নিতিন। বর্ষার সঙ্গে দেখা হলে দু’চারটা বাক্য বিনিময় শেষে ফের নিজ আবর্তে ফিরে যায়।

সকল ক্লান্তি আর আলস্য ঝেড়ে ফেলে, গায়ে জাফরানি রঙা কা’শ্মীরি শাল জড়িয়ে বেতের দোলনা ছেড়ে উঠে আসে বর্ষা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ধীর পদক্ষেপে সিড়ি ভেঙে নামতে শুরু করে। উদ্দেশ্য দাদির ঘর।
দাদির ঘরে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে দাদির মুখে পুরনো দিনের গল্প শুনে সময় কেটে যায় ওর। মাঝে মাঝে নিতিনের হাসির ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এসে ওর কানে বাড়ি খায়। এই ঘরটা থেকে খুব বেশি দূরে নয় নিতিনের ঘর।

বৃদ্ধ বয়সে কথা বলার বাতিকের সঙ্গে আরও একটি বাতিক আপনাতেই এসে আশ্রয় নেয় দেহে। যখন তখন ঝিমুনির বাতিক। পুরনো দিনের কথা বলতে বলতেই দাদি একসময় ঝিমুতে শুরু করেন। সেদিকে আড়চোখে লক্ষ্য করে, দাদিকে বুঝতে না দিয়ে সাবধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বর্ষা। নিতিনের ঘরের যত কাছাকাছি যেতে থাকে, কারো সঙ্গে খোশগল্পে মগ্ন নিতিনের হঠাৎ হঠাৎ রিমঝিম হাসির শব্দ তত তীক্ষ্ণ হয়ে আসতে থাকে ওর কানে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে নিতিন। কথাগুলো চাপা স্বরে বললেও খানিক পর পর সে বেশ উচ্চস্বরে খিলখিলিয়ে হাসছে।
–‘নিতিন ‘ দরজায় দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডেকে, বর্ষা সেখানেই অপেক্ষা করে।
কান থেকে ফোন নামিয়ে নিতিন মুহুর্তে ঘুরে তাকায়। ওকে কেমন বিব্রত দেখায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে, ফোনটা বিছানায় ছু’ড়ে অপ্রতিভ হেসে বর্ষার কাছে আসে।
–‘ ভাবি তুমি এখানে? নিচে আসতে গেলে কেন? একটু বাদে আমিই তো যাচ্ছিলাম ওপরে। ‘
–‘ না এমনি। একা একা ভালো লাগছিল না। দাদির সঙ্গে একটু গল্প করতে এসেছিলাম। কিন্তু… ‘
–‘কথার মাঝখানেই দাদি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই না?’
বর্ষা কিছু না বলে হাসল। নিতিনের মুখটা হঠাৎ খেয়াল করে বলল,
–‘তুমি কি করছিলে নিতু পাখি? তোমাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় সেজেছিলে বুঝি?’
নিতিন পিঙ্গল ঠোঁটে ফিচেল হাসল,
–‘এই একটু লিপস্টিক লাগিয়েছিলাম। তুমি বুঝে ফেললে? তারমানে তো বাকি সবাইও বুঝবে। তাহলে তো আর দেয়াই যাবে না!’
–‘ কেন? কেউ বুঝুক সেটা চাওনা বুঝি? তাহলে আর লিপস্টিক দেয়া কেন?’
–‘এমনিই!’
রাফিয়া রান্নাঘর থেকে চেঁচালেন, ‘নিতিন, তুই স্কুলে যাবি না?’
–‘ যাচ্ছিই। ইশশ্! দেখেছো স্কুলে যাবার কথাটা একদম ভুলে বসেছিলাম! তুমি বসো ভাবি আমি স্কুলের জন্য তৈরি হই।’
–‘ না নিতিন পাখি। ভালো লাগছে না। ওপরে চলে যাব।’
বর্ষা নিশব্দে ওপরে চলে এলো। এতো বড় ঘরটাতেও ওর দমবন্ধ লাগে আজকাল। শরীর যখন ভালো থাকে, দিনের বেশিরভাগ সময় ওই মস্ত খোলা বারান্দায় সময় কাটায় সে।

বেতের দোলনার সম্মুখে, কার্নিশ ঘেঁষে বিছানো মেট্রেসের ওপর পাতা শতরঞ্জিতে বসল বর্ষা। সেখানে বসেই কিঞ্চিৎ সময় পর দেখল নিচে ড্রাইভার সাহেদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। পরিপাটি সাজগোছ করে নিতিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এল খানিক পর। বাহ্যিক সাজপোশাকে নিতিনের অকস্মাৎ এই বিশেষ খেয়াল, বর্ষার মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য হলো।
বর্ষা বুঝল। নিতিনের দুরন্ত মনে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ওর ডানায় রঙিন প্রলেপ পড়েছে। আজকাল আর স্থির থাকছে না ওর উড়ু মন!

এশার সালাত শেষ করে উঠতেই বর্ষা অনুভব করল ওর নাক দিয়ে ফের রক্ত গড়াচ্ছে। নাকে রুমাল চেপে ধরল সে। এই অসুখের কোনো আলাদা যাতনা নেই। নাকে কিংবা গলায় সামান্যতম যন্ত্রণাও কখনো হয়না ওর। কিঞ্চিৎ সময় পর আপনাতেই রক্তপ্রবাহ টা থেমে গেল। কিন্তু যেন কিছু একটা রেখে গেল মাথার ভেতর। হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো ওর। বর্ষা জানে এই যন্ত্রণা টা এবার আস্তে আস্তে পুরো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়বে। একসময় নেমে আসবে দুচোখে, মুখের পেশিতে। এভাবে আস্তে আস্তে সর্বাঙ্গে….। বর্ষা বিছানায় শুয়ে ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

রাত্তিরে সেদিন একটু আগে আগেই ফিরল নাব্য।
ও ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আঁচল দিয়ে নাক চেপে ধরল বর্ষা। নাব্য ভ্রুকুটি করে কাছে এগিয়ে এলো।
-‘কি হলো? ‘
-‘আপনি স্মোক করেছেন?’ ধীর গলায় চাপা ক্রোধে শুধাল বর্ষা।
মিথ্যেটা নাব্যের ঠিকমতো আসে না। যুতসই একটা উত্তর দিতে না পেরে সেজন্য নাব্যের ঈষৎ রাগ হলো। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলল,
-‘মুখ ঢাকলে কেন? আমাকে দেখে কি বমি পাচ্ছে তোমার?’
-‘আপনাকে দেখে না। সিগারেটের গন্ধে বমি পাচ্ছে আমার। আপনি কি কখনো এই বিষাক্ত অভ্যেস টা ছাড়বেন না?’
-‘ এখন খাইনি তো। অনেকক্ষণ আগে একটা খেয়েছিলাম। আচ্ছা আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
নাব্য বাথরুমে যাওয়ার পর শোয়া থেকে উঠে বসে দুহাতে মাথা চে’পে ধরল বর্ষা। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। তার মাঝে এখন আবার বমি পাচ্ছে। এর দায় সম্পুর্ন নাব্যের। সে নিজের সাথে সাথে ঘরে একরাশ সিগারেটের বাজে গন্ধ না নিয়ে এলে এমন হতো না।

নাব্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখল বর্ষা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছে। ভয়ে ভয়ে পাশে গিয়ে বসে বর্ষার মাথায় আলতো করে হাত রাখল সে,
-‘কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? বিকেলে মেডিসিন নিয়েছিলে?’
প্রতুত্তর না করে বর্ষা এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিল।
-‘সরুন আপনি। দূরে গিয়ে বসুন।’
-‘কেন? এখনো সিগারেটের গন্ধ নাকে লাগছে তোমার। ইম্পসিবল! আচ্ছা আগে বলো তো, শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে ? ফের ব্লিডিং হয়েছিল? এই বউ, কি হলো তোমার?’
-‘ যা খুশি তাই হোক! আমি ম’রি কিংবা বাঁচি তাতে আপনার কি? আপনার জীবনে কি আমার কোনো আবশ্যকতা আছে? নেই তো! থাকলে আমার কথারও একটা দাম থাকত অন্তত।’ কথা বলতে বলতেই বরাবরের মতো অশ্রুবিন্দু জমতে শুরু করলো বর্ষার চোখে।

নাব্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওর পাণে। কেন যেন বর্ষার এসব আচরণে ওর চরম বিরক্তি এলো আজ। সারাদিন পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরে এসব নাকিকান্না দেখতে কারোরই ভালো লাগে না বোধহয়! অন্যসময় বর্ষা কাঁদলে ওর জন্য খানিক হলেও মায়া হয়। আজ শুধুই রাগ হচ্ছে!

-‘দেখো বর্ষা, বললাম আর ছেড়ে দিলাম। ব্যাপার টা এতো সহজ নয়। আমি চেষ্টা করছি। খুব শীগ্রই ছেড়ে দেব।’
-‘দিনে পনেরো-বিশটা বেনসন না খেলে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। এ-ই কি তাহলে আপনার সিগারেট ছেড়ে দেবার নমুনা? ‘
-‘এসব তোমায় কে বলল?’
-‘ যে করেই হোক আমি জেনেছি।’
-‘ বর্ষা বলো আমায় কে বলেছে? ‘
-‘রশুভাই।’
-‘রশুকে তুমি কোথায় পেলে?’
-‘আমি পাইনি। নিতিনকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছি?’
-‘নিতিন জিজ্ঞেস করেছে!’
-‘হ্যাঁ করেছে। আমি বলেছিলাম তাই করেছে। কেন আমার কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন বুঝি? ‘

অযাচিত রাগটা দমনের চেষ্টার পরও বেশ কঠোর শোনাল নাব্য গলা,
-‘ শোনো বর্ষা, আমাকে অবিশ্বাস করে আমার সেক্রেটারিকে এসব ব্যাপারে টেনে এনে তুমি ছোট মনের পরিচয় দিয়েছ এবং অবশ্যই ভুল কাজ করেছ। আর স্ত্রী হয়েছ বলেই আমার ব্যাক্তিগত সকল অভ্যেস, বদঅভ্যেস নিয়ে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি। সেটা তুমি নিশ্চয়ই বোঝো। অন্তত এতটুকু আশা বোধহয় আমি করতে পারি তোমার কাছ থেকে। তাই না?
আজকের পর থেকে কখনো আমার ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলবে না তুমি।’ কথা শেষ করে পাশের লাইব্রেরি রুমে চলে গেল নাব্য। চেয়ার টানার শব্দ শুনে বর্ষা বুঝল নাব্য লিখতে বসেছে।
সেখানেই পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে নাব্যের বলা কথাগুলো বর্ষা পুনরাবৃত্তি করতে লাগল মনে মনে।
সেই শুরু থেকে, সবকিছু উজার করে ভালোবেসেছে সে নাব্যকে। অথচ আজও নাব্যের আচরণে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, এখনো কতটা আগন্তুক সে নাব্যের পৃথিবীতে!

___________________________

নির্জন দুপুর। মধ্যাহ্নের শেষ বেলা। রাবেয়া মঞ্জিল প্রগাঢ় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। পায়ের হিল জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে, ডানে-বায়ে একবার নজর বুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুট দিল নিতিন। ঘরে পৌঁছে দোর বন্ধ করে সবার আগে লিপবাম লাগিয়ে ঠোঁটের গাঢ় খয়েরী ম্যাট লিপস্টিক ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দ্রুত মুখ ধুলো। বাথরুম থেকে ফিরে গোলাপি রঙা কটন স্লিকের ঝকঝকে দামি জামাটার পরিবর্তে সুতির সর্ট গাউন গায়ে জড়ালো। অতঃপর খোলা চুলে ক্লিপ আটকে চোখ রাখল আরশিতে। নাহ! ওকে দেখলে এবার আর ভ্রুকুটি করবে না আম্মা। সন্দিহান স্বরে জানতে চাইবে না এত সাজগোজের কারণ!

তবুও অকারণে নিতিনের বুক ধুকপুক করতে লাগল। জীবনের প্রথম স্কুল ফাঁকি দিয়ে আজ প্রণয় অভিসারে গিয়েছিল সে। রাফিয়া কে নিতিন বাঘের মতো ভয় পায়। সুযোগ টা হাতে পেয়েছে সকাল সকাল রাফিয়া ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পর।

দোর খুলে একটা গান গুনগুন করতে করতে নিতিন সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠে সোজা নাব্যের ঘরের দরজায় গিয়ে থামল। বারকয়েক কড়া নেড়ে বর্ষা ঘুমোচ্ছে ভেবে ফিরে এসে ঢু মা’রল দাদির ঘরে। দাদি ঘুমোচ্ছে। পায়ের কাছে বসে কাছে রিনা নামের কাজের মেয়েটি দাদির পা মালিশ করছে।
-‘রিনাবু, আম্মা এখনো ফেরেনি?’
-‘না।’ উত্তর শুনে একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে নিতিন ফের জিজ্ঞেস করল,
-‘ভাবির কাছে গিয়েছিলে? ‘
জোরে কথা বললে দাদির ঘুম ভেঙে যেতে পারে। রিনা তাই বিছানা ছেড়ে উঠে নিতিনের কাছে সরে এলো। অধৈর্য চাপা গলায় বলল,
-‘ভাবির মতিগতি তো কিছু বুঝতাছি না আপা মণি। সক্কাল সক্কাল খালাম্মা, ভাইজান বাইরইয়া গেলো গা। হের পরে আপনেও বাইরে গেলেন। আমি তখন নাস্তা নিয়া ভাবিরে ডাকবার গেসিলাম। ভাবি দোর খুলল না। বারোডার সময় ফল কাইটা নিয়া গেলাম। তখনো দোর না খুইলা ভিতর থাইকাই ফিরায়া দিল। এখন ভাত নিয়া গিয়াও ফিরা আইলাম।’
-‘কি বলছো তুমি রিনাবু? তারমানে ভাবি সকাল থেকেই না খেয়ে আছে!’
-‘মনে হয় রাইত থাইকাই। কাল রাইতেও ভাবি ভাত খায় নাই।’
নিতিন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ফের ছুটল দোতলার উদ্দেশ্যে।
দরজায় শব্দ করে ডেকে চলল বর্ষাকে। বিপরীত দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে একসময় নিতিন বাধ্য হয়ে কল করল নাব্যকে। সব শুনে নাব্য শুধু বলল,
-‘তুই অপেক্ষা কর। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি।’
আধঘন্টার কথা বললেও পঞ্চাশ মিনিটের আগে বাড়ি পৌছানো সম্ভব হলো না নাব্যের পক্ষে। বাইরে তখন বিকেলের শেষ আলোয় চারদিক ভীষণ মৃদুতায় ঝলকাচ্ছে।
নাব্য এসে কালবিলম্ব না করে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খুলল। দরজা খোলার পর ভেতরে তাকিয়ে ওরা ভাইবোন থমকে গেল মুহুর্তের জন্য।
বারান্দার দরজার কাছে বর্ষা মাটিতে পড়ে আছে। মুখ আর নাক থেকে প্রবাহিত র’ক্ত জমে গিয়ে ততক্ষণে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই কালচে বর্ণের সরু একটা রেখা নাক থেকে গড়িয়ে ওর গলায় গিয়ে থেমেছে। দীর্ঘক্ষণ মেঝেতে পড়ে থাকায় ঠান্ডা হয়ে গেছে সারা গা।
নিতিন কয়েক পা এগিয়ে ভীত চোখে বর্ষার পানে তাকিয়ে কান্না জুড়ে দিল। নাব্য দৌড়ে গিয়ে বর্ষার মাথাটা কোলে তুলে নিল। গালে কয়েকবার মৃদু চাপড় দিয়ে অনবরত ডাকতে লাগল,
-‘বর্ষা, এই বর্ষা… চোখ খোলো। আমি সত্যি আর কোনোদিন স্মোক করবো না৷ প্রমিজ। এই মেয়ে….চোখ খোলো….বর্ষা…’
বর্ষার নাকে কাছে হাত রেখে নিশ্বাসের গতি পরীক্ষা করে ওকে দ্রুত মাটি থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে ওর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিল। চোখ-মুখে পানির ছিটা দিয়ে নিতিন আর রিনাকে নির্দেশ করল হাত পায়ে তেল মালিশ করার জন্য।
নাব্য, নিতিন আর রিনার বুকের হাতুড়ি পেটা থামিয়ে একসময় চোখ মেলল বর্ষা।
নাব্য পরিস্থিতি ভুলে ওদের সামনেই বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কপালে, মাথায় অজস্র চুম্বন করে বলল,
-‘তোমার জেদের কাছে হার মানছি। আর কোনোদিন স্মোক করবো না।’
সেদিনের মতো ব্যাপার টা সেখানেই সমাপ্ত হলো। রাফিয়া কে জানানো হলো না কিছুই।

তার ঠিক এক মাস পর। এক সকালে। নাব্য সবে ফ্যাক্টরি তে এসে নিজের চেম্বারে বসেছে। কর্মচারী এসে জানালো একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছেন নাব্যের সঙ্গে। নাব্য ভ্রু কুঞ্চিত করল। দায়সারা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘কি নাম?’
-‘মিসেস বর্ষা সোবহান’

চলবে……….।
(অবশেষে ফের গরানবনের বর্ষার আগমন! গল্পের এই পর্যায়ে এসে কার অনুভূতি কি?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here