একদিন নববর্ষা -৩৬,৩৭

0
136

একদিন নববর্ষা -৩৬,৩৭
অদ্রিজা আশয়ারী
৩৬

বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে-
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যো‍‍‌ৎস্না এসে পড়ে
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

-জয় গোস্বামী।

———-

কিছু আঘাতের আগমণ জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত, যে সে আঘাতের রেশটুকুই জীবনচক্রের সকল স্বাভাবিকতাকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। থমকে গেছে বর্ষার জীবনচক্রও। একটি কলরব’ময় বিকেলে, দোকানের সেই অভিশপ্ত কাঁচের বাইরে চোখ ফেলার পর থেকে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে ওর অন্তঃকরণ। কিন্তু এইবার হৃদয় ভাঙ্গার আর্তনাদ কারো কান অব্ধি পৌছাঁনোর আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে বর্ষা। খেপাটে মাথার মেয়েটি এবার আর কোনো পাগলামি করেনি। বরং বড় বেশি শব্দহীন হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরে বর্ষা শুধু ভেবেছে এরপর কি অপেক্ষা করছে ওর জন্য? নাব্য আর কতবার সারপ্রাইজ দেবে ওকে? এতো চমকের ভার যে ওর ভঙ্গুর হৃদয় বইতে পারছেনা আর! চিরকাল একেবারে ঘটনা বিহীন, নির্জীব জীবন ছিল ওর। সে জীবন বড় বেশি পাসনে লাগত বর্ষার কাছে একসময়। মাঝে মাঝে আকাশের পানে চেয়ে, খুব সঙ্গোপণে সে কিছু একটা অভিযোগ করত রবের কাছে।
বোধহয় জীবনে একটু রংধনু ছড়ানোর আবদার ছিল সেসব। রব কিছুটা বিলম্বে হলেও,, তার সেসকল আবদার কবুল করে নিয়েছেন। কিন্তু বর্ষার আবদার চাওয়ার প্রক্রিয়ায় কিছু ভুল ছিল নিশ্চয়ই! সেজন্যই বুঝি আজ ওর ছোট্ট জীবনে একের পর এক শিহরণ জাগানিয়া ব্যাপার ঘটছে!
নাহ! আজ ওর জীবনে সত্যিই আর রঙের কোনো অভাব নেই। এতো রঙ! যে বর্ষার চোখে ধাঁধা লেগে যায় একেক সময়!

সেদিন সন্ধ্যায় বেবি শপ থেকে ফেরার পর বর্ষার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে গেল। ওর চোখের শীতলতা, অন্তরের অনেকটুকু আসঞ্জন যাকে ঘিরে। সেই নাব্যকে ওর প্রাত্তন প্রেমিকার সঙ্গে দেখেও একফোঁটা চোখের জল ফেললো না সে।

মনের সামান্যতম অস্থিরতায় সিজদায় পড়ে, চোখের জল ছেড়ে, মনের স্থিরতার জন্য দু’আ করত যে সবসময়। আজ সে, এতো বড় ব্যাপারের পরও সিজদায় গিয়ে একটুও কাঁদল না।

এশার আযান শুনে যখন হঠাৎ ওর ঘুম ভাঙল, নিজেকে সে আবিষ্কার করল জায়নামাজে। সিজদার মতো করে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাগরিবের সালাত কি পুরোপুরি শেষ করেছিল কিনা সেটাও মনে পড়ল না। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই বর্ষা আবার উঠে ওযু করে এলো।

কিছুটা হ্যালুসিনেশান হচ্ছে বোধহয় বর্ষার। বিভিন্ন সময়ের খাপছাড়া স্মৃতি বাস্তব রূপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ মেললেই বর্ষা দেখতে পারছে সেসব। ঘোর লাগা মস্তিষ্কে পুরো ব্যাপারটাকেই বাস্তব মনে হচ্ছে। আতঙ্কে হাত পা জমে গেল ওর। প্রায় টলতে টলতে এশার সালাত শেষ করল, ওভাবেই স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে। প্রতিবার সিজদায় যাবার সময় ওর মনে হচ্ছিল, এটাই বোধহয় জীবনের শেষ সিজদাহ্! আর উঠতে পারবে না সে।
‘আল্লাহ আমাকে সালাত টা শেষ করার তৌফিক দাও।’ মনে মনে শুধু এই দু’আ করতে করতে বর্ষা কোনোরকমে সালাত শেষ করল। আর একটি পদক্ষেপ ফেলার মতো শক্তি অবশিষ্ট রইল না ওর দেহে। বর্ষা সেখানেই, জায়নামাযে ঘুমে তলিয়ে গেল ফের।

___________

দুঃখেরা আসে এক এক করে। কখনো হয়না ওদের দেরি। ওরা জানে না পথ ভুলতে। তাই যার জীবনকে একবার দুঃখ নিজের গন্তব্য স্থির করে নেয়, তার জীবনে সমাপ্তির ঘন্টা বাজবার আগ পর্যন্ত ওরা নিরস্ত হয় না।
এবারে দুঃখদের নির্নিমিখ গন্তব্য যেন বর্ষা নামের সরল, অপ্রগলভ মেয়েটিকে ঘিরেই….।
অথচ! দু;খের এই জটিল ঘন সন্নিবেশ ওর স্বচ্ছ জীবনে, এতো প্রখর ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে তা ভেবেছিল কেউ কোনোদিন?

খবর টা এলো বিকেলে। রাফিয়া সালাত শেষে শাশুড়ী মায়ের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন। বৌ-শাশুড়িতে আলাপ হচ্ছিল সংসারের একেবারে মেয়েলি ব্যাপার গুলো নিয়ে। নাব্য-নিতিনের প্রিয় দাদি বার্ধক্যের শেষ পর্যায়ে পৌছালেও এখনো যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন সব ব্যাপারে।
সহসাই বেজে উঠল রাফিয়ার হাতে থাকা ফোন। আজকাল তিনি কাছের জিনিস ঝাপসা দেখেন। ফোনটি তাই একটু দূরে সরিয়ে, ওপরের নাম পড়ার চেষ্টা করলেন। ওপরে লিখা Unknown number…
রাফিয়া ভ্রু কুঁচকে ফোন কানে তুললেন।
–‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে…?’
রাফিয়ার কথার পৃষ্ঠে ওপাশ থেকে বেশ অনেকগুলো উত্তর এলো। রাফিয়ার মুখটা মলিন হয়ে এলো একসময়।
দাদি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলেন।
–‘আচ্ছা, আসছি আমরা এক্ষুনি।’ বলে ফোন রাখতেই দাদি বললেন,
–‘কেডা রাফু? কি কইল যে তুমি শুইনা এহনি যাইবার লাগছো?’
রাফিয়া ফ্যাকাসে মুখে শাশুড়ীর দিকে ফিরলেন। সে দৃষ্টি দেখা মাত্র দাদি বুঝলেন গুরুতর বাজে কিছু ঘটেছে।

বর্ষার দিনকাল ভয়ানক খারাপ যাচ্ছে সেকথা বলাই বাহুল্য। মনের শান্তির জন্য প্রচন্ড অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সন্ধ্যায় কুরআন নিয়ে বসলো সে। খুব ধীরে, যত্ন করে একটি একটি করে আয়াত পড়তে লাগলো অর্থ সহ।
কুরআন’কে কেউ অন্তর দিয়ে অনুভব করবে আর তার চোখে জল আসবে না এমন হতেই পারে না! বর্ষাও বোধহয় সত্যিই অনুভব করছিল সেসময়, কুরআন’এ বর্ণিত মহিমান্বিত রবের প্রত্যেকটি আয়াত কে। কারণ তার চোখ জলে পূর্ণ ছিল।

কোনো রকম পূর্বাভাস না দিয়ে আচমকা নিতিন ঘরে চলে এলো। কুরআন পড়ে বর্ষাকে কাঁদতে দেখে আজ সে কোনো প্রশ্ন তুললো না। তবে বর্ষা ঠিকই লজ্জা পেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেললো।
নিতিন তখনো স্থির দাঁড়িয়ে বর্ষাকে দেখছিল নিঃশব্দে। ওর চোখের কোণেও জল চিকচিক করছিল কোনো এক অজানা কারণে। বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে একটু কাঁদবার বাসনা জাগছিল কেন যেন হঠাৎ। কিন্তু নিতিন নিজের এই অবাধ্য আবেগকে রুখতে বাধ্য হলো। কয়েক পা এগিয়ে বর্ষার বাহু চেপে ধরে স্তিমিত গলায় বলল,
–‘ভাবি, বোরকা পড়ে নাও। আমরা একটু বাইরে বেরুবো এখন। ‘
অবাক বর্ষাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না সে। নিজে গিয়ে আলমিরা থেকে বর্ষার বোরকা বের করে আনলো। তাড়া দিল দ্রুত পড়ে ফেলার জন্য।
বর্ষা কিছু বুঝতে পারছিল না। তবে খুব বেশি কিছু বললো না সে। আজকাল কথার পিঠে কথা আসে না ওর। চুপ থাকতেই ভালো লাগে। তাই নিতিনের কথা নিঃশব্দে মেনে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল।

রিনা এবং আরও একজন মধ্যবয়সী গৃহকর্মীর দায়িত্বে দাদিকে রেখে ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ল। বর্ষার কাছে সবটা অদ্ভুত ঠেকছিল। এভাবে নিজ শাশুড়ী ও ননদের সঙ্গে একসাথে এর আগে কোথাও বেরোনোর সুযোগ হয়নি ওর। কোথায় যাচ্ছে সেটাও জানে না। রাফিয়া বরাবরই গম্ভীর। আজ একটু বেশিই। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা তো বহুদূর, তাকে সামনে রেখে নিতিনকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও বর্ষার ইতস্তত লাগছে।

মাগরিব পড়ে বেরিয়েছিল ওরা। নগরী ক্রমেই রাত্রির তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে এল। হঠাৎ, একদম অকস্মাৎ বর্ষা খেয়াল করল গাড়িটা সাভারে, ওর বাবার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার, তাই অতশত খেয়াল করেনি এতক্ষণ। সে দ্রুত পাশ ফিরল। নিতিনের হাত চেপে ধরল প্রবল ভাবে।
–‘নিতিন। কোথায় যাচ্ছি আমরা? সাভারে কার কাছে যাচ্ছি?’
নিতিনের ঠোঁট কেঁপে উঠল। তবুও শব্দ বেরুলো না। অজানা একটা আতঙ্ক ইতোমধ্যে বর্ষার মনে বিস্তার লাভ করেছে। ওর অস্থিরতা দেখে রাফিয়া বরাবরের মতো গম্ভীর মুখে বললেন,
–‘ তোমার বাবার বাড়িতেই যাচ্ছি আমরা। ‘
–‘কিন্তু কেন? এভাবে…. এভাবে হঠাৎ কিসের জন্য? কি হয়েছে? আমাকে কেউ কিছু বলছেন না কেন? আমি ভাইয়াকে ফোন করছি এক্ষুনি।’ ফোন খুঁজে না পেয়ে বর্ষা আরও অস্থির হয়ে উঠল।
–‘ফোন কোথায় গেল? নিতিন আমার…’
–‘ ফোনের ব্যাটারি ডাউন ছিল। তাই বন্ধ করে দিয়েছে ভাবি। তুমি এতো অস্থির হয়ো না। আমরা প্রায় চলে এসেছি।’
আর স্থির! বর্ষার হৃৎপিণ্ড পাকস্থলীর ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগল আশংকায়, অস্থিরতায়। সে বুঝে গেছে এরা কেউ বলবে না কি ঘটেছে। তবে নিশ্চয়ই ভয়ংকর বাজে কিছু ঘটেছে।
ওর ভাই-ভাবির বাচ্চাটা…..বাচ্চাটার কিছু হয়নি তো? এমন ছোট বাচ্চাদের তো কত কিছু হয়! এত নাজুক প্রাণ। কত অল্পতেই ঝরে যায় ওরা… বাচ্চাটার যদি সত্যিই কিছু হয়ে থাকে তাহলে ওকে আগে থেকে কেউ কিছু জানালো না কেন? সত্যিই বাচ্চাটারই কিছু হয়েছে নাকি অন্যকারো। বাবা, মা, ভাই, ভাবি…. ওদের প্রত্যেককে নিয়েই বর্ষার আশংকা হচ্ছে। বর্ষার ভেতর টা তড়পাচ্ছিল যন্ত্রণায়। কিন্তু সে কাঁদতে পারছিল না। সেদিন বিকেলের পর থেকে ওর চোখের সকল অশ্রুরা যেন চিরতরে ওকে ছেড়ে গেছে। তারপর থেকে প্রতি পলে পলে বর্ষা বুঝতে পারছে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে না পারার যন্ত্রণা কতখানি!

আগের বারের মতোই গলির মুখে, বর্ষাদের বাড়ি থেকে প্রায় অনেকটা দূরে গাড়ি থামল। এর বেশি যাবার ক্ষমতা নেই বিশাল গাড়িটির এই সরু গলির মধ্যে দিয়ে।
আতঙ্কে জমে, কম্পিত পায়ে গলিটা পেরিয়ে, ওদের মধ্যবিত্ত বাড়ির দরজায় পৌছে বর্ষা আরেকটা ধা-ক্কা খেল।
নাব্য দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে রশু। ওদের দুজনের মুখ থমথমে। সামনে দৃষ্টি ভিড়তেই বর্ষা বুঝে গেল কি ঘটেছে। সাত আসমানের ওপর থেকে নেমে, মালাকুল মউত আজ একবার ঘুরে গেছিল ওদের বাড়ি। কারণ উঠোনে খাটিয়ায় একটি সাদা কাফনের অংশ বাতাসে কাঁপছে তিরতির করে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে গেল বর্ষা।

চলবে…..

একদিন নববর্ষা -৩৭
অদ্রিজা আশআরী
__________
এমন মুহুর্তও কখনো জীবনে আসে। যখন কঠিন সময়ে, পরিস্থিতি আমাদের সুখ দুঃখ অনুভবের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে উপহাস করে। বর্ষার জীবনে আজ সেই ক্ষণ উপস্থিত। রুপকথার গল্পে জলজ্যান্ত মানুষ যেমন দৈব অভিশাপে পাথরে পরিনত হয়। আজকের এই রূঢ় বাস্তববাদী সময়ে বর্ষাও যেন তাই হয়ে গেল। জলোচ্ছ্বাসের ন্যায় একের পর এক হানতে থাকা আঘাতের শেষ আক্র-মণ টা ওকে একেবারে জড় পদার্থের মতো নিশ্চল করে দিল।

রাত বাড়ল। দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়েরা রাত্রিটা কাটাবার মতো একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়ে গুম হলো যে যার মতো। কোলাহল থেমে গেল। উঠোনের মাঝখানে খাটিয়ায় পড়ে রইল বর্ষার মৃত বাবার লাশ। অদূরে, চৌকাঠের সিড়ির ধাপে, মূঢ়ের মতো বসে রইল বর্ষা।

কান্নারও ক্লান্তি আছে। সেই ক্লান্তি নিষ্পেষিত করেছিল সকলকে। রাত্রি গাঢ় হতেই, তাই শোক’কে মুলতবি রেখে বাড়ির সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।
এই মাঝ রাত্তিরে এভাবে একা বর্ষার উঠোনে বসে থাকা নিয়ে আজ কারো কোনো মাথা ব্যাথা রইল না।

মধ্য রাত্রির নিস্তব্ধতায়, বৃহৎ আম গাছটির নিচে, ওদের মধ্যবিত্ত বাড়ির চৌকাঠ শেষ হয়েছে যেখানে। শুরু হয়েছে কয়েক ধাপ বিশিষ্ট সিড়ি। সেখানে অবিন্যস্ত খোলা চুল, আটপৌরে ছাইরঙা শাড়ি পরিহিত, বিষাদ ক্লিষ্ট অস্বাভাবিক মুখাবয়ব নিয়ে বসে রইল বর্ষা। ওকে ঠিক সাধারণ মানবী মনে হচ্ছিল না।

মধ্য রাত্রির হিম শীতল বাতাসে ভেসে আসছিল আগরবাতির ঘ্রাণ। তখনো খাটিয়ায় ওর মৃত বাবার গায়ে পেচানো কাফনের কাপড় তিরতির করে কাঁপছে। বর্ষা গভীর মনোযোগে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল বোধহীন যন্ত্রের ন্যায়। ওকে দেখাচ্ছিল অশরীরির মতো। দূর থেকে দেখলে যে কারো হৃদ স্পন্দন থমকে দিতে যথেষ্ট ছিল সে ছবি।

বর্ষার চোখে জল নেই। কাঁদেনি সে একটি বারের জন্যও। নেত্রমল বহু আগেই শুকিয়ে গেছে। অন্যসকল আঘাতের পাশাপাশি এ হলো তার উপরি পাওনা!

সন্ধ্যা রাতে উঠোনে লাশ দেখে যখন বর্ষা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল, তখনো ওর জানা ছিলনা কাকে হারিয়েছে সে। মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই ওকে ঘিরে একটা কোলাহল বাধল। নাসিমার কানে কেউ একজন পৌঁছে দিল মেয়ের আসার খবর। তিনি ছুটে এলেন। শরীরের এমন নাজুক অবস্থার ওপর সংজ্ঞাহীন হয়ে অকস্মাৎ এভাবে পড়ে যাওয়ায়, মুহুর্তে উপস্থিত সকলের চিন্তার মোড় ঘুরে গেল বর্ষার দিকে। কিছু সময়ের জন্য ওরা ভুলে গেল উঠোনে পড়ে থাকা মৃত দেহটির কথা।

নাব্য নিতিন আর নাসিমা বর্ষাকে ঘিরে বসল। ওকে ডেকে চলল অবিরত। মুহুর্তে চিৎকার, হট্টগোলে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠল। বর্ষার দেহ দ্রুত শিথিল হয়ে আসছে। হাত পায়ে টান ধরেছে ইতোমধ্যে। ওরা বুঝল বর্ষার খিঁচুনি উঠছে। সবে মাত্র একজন মারা গেছে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অদৃশ্য গন্ধ তখনো চারদিক জুড়ে। এর মাঝে বর্ষার বর্তমান অবস্থা দেখে ওরা স্বাভাবিক বুদ্ধি হারিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ল।

রাফিয়া তখনো হুশ হারান নি। ছেলেকে বললেন বর্ষাকে জলদি ভেতরে নিয়ে যেতে। এমন শীতল রাত্রিতে এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটবে। নাব্য ওকে তুলে ভেতরে নিয়ে গেল।

চারিদিকে রোনাজারির কাতর নিনাদ। তন্দ্রাঘোরে বর্ষা সব শুনছিল। বাবা আর নেই! এই ব্যাপার টা বুঝতে ওর খুব বেশি সময় প্রয়োজন হলো না। ওকে ঘিরে বসে থাকা ত্রাসিত মুখ গুলোকে আরও উদ্ধিগ্ন করে, একেবারে অকস্মাৎ চোখ মেলে উঠে বসলো শোয়া থেকে। নাসিমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য কাছে এগিয়ে এলেন। বর্ষা মাকে সম্পুর্ন রূপে উপেক্ষা করে বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হলো। কারো বাঁধাই মানলো না। শাড়ির ওপর বড় ওড়না জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে বর্ষার ভাই সোহাগের সঙ্গে নাব্য দাঁড়িয়ে ছিল। অদূরেই রাখা আছে লাশটি। লাশকে কেন্দ্র করে তখনো মানুষের ভীড়।

‘ ওইযে সাদা কাফন জড়িয়ে যে লোকটি শুয়ে আছে। সে লোকটি জীবিত থাকতে বড় নিরীহ ছিল। চিরকাল অন্যের ভয়ে ভয়ে জীবন টা কাটিয়ে দিল। মানুষ হিসেবেও ছিল বেশ অমায়িক….’ আরও কত কথা বলে চলল লোকে।

বোনকে এভাবে হঠাৎ বের হয়ে আসতে দেখে, আর পেছন পেছন নাসিমার উৎকণ্ঠিত গলা শুনে, সোহাগ লাশ ঘিরে থাকা লোক গুলোকে একটু সরে যেতে অনুরোধ করল। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যে উঠোন ফাঁকা হয়ে এল। বর্ষা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওর চিরনিদ্রায় শায়িত বাবার দিকে। নাসিমা পেছন পেছন যাচ্ছিলেন। সোহাগ মাকে রুখল।

চারপাশের জটলা কমে, ক্রমেই স্থানটা মনস্য বিহীন হয়ে এসেছে বুঝতে পেরে বর্ষা মাথার অবগুণ্ঠন একটু আলগা করল। মুখটা দৃশ্যতঃ হলো ওর। সে হাটু মুড়ে বসল বাবার মাথার কাছে। কম্পিত হাতে বাবার মুখের ওপর থেকে কাফন টা সরিয়ে দিল। বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর সারা গায়ে। বর্ষা অকম্পিত, শীতল ফিসফিস স্বরে ডাকল,
–‘আব্বা…’
ক্রমশ চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো ওর। মৃদু টলছে বুঝতে পেরে খাটিয়ার হাতল চেপে ধরল সে। অবাক হয়ে খেয়াল করল জীবনের এই ভয়ংকরতম মুহুর্তে এসে আজ একফোঁটা জল জমেনি ওর চোখে। কি পাষাণ হয়ে গেছে হৃদয়!
আবারও বাবাকে সম্মোধন করে ডাকল সে।
–‘আব্বা.. আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লহ। আপনার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।’ নিজ অন্তরকে খানিক শান্ত করবার জন্যই যেন সালামের অর্থটা শব্দ করে উচ্চারণ করল সে।
–‘আমি সুধারণা রাখি আপনি ওপারে ভালো থাকবেন। আমার মহান রব, আল-গফ্ফার আপনার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র সৎকাজ গুলোকে অসিলা করে, আপনাকে তাঁর নৈকট্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিক। আমিন।
আপনার ভালো সন্তান হতে পেরেছি কিনা, আজ থেকে তার পরীক্ষা শুরু। আমি চেষ্টা করবো আমার সামান্য আমলের দ্বারা আপনার জন্য রবের রহমত প্রাপ্তির পথ সহজ করতে। আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না। আমাদের আবার দেখা হবে। ইন শা আল্লাহ জান্নাতে।’

কথা শেষ করে বর্ষা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে…
নাসিমা দূরে দাঁড়িয়ে ছেলের বুকে মাথা রেখে চাপা স্বরে কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ পর বর্ষার পাশে এসে হাটু গেড়ে বসল নাব্য। হাত রাখল বর্ষার হাতের ওপর।
-‘ভেতরে চলো। ‘
বর্ষা বিনা বাক্য ব্যায়ে উঠে দাঁড়ালো নাব্যর সাহায্য নিয়ে। চলে যেতে গিয়ে শেষ মুহুর্তে উবু হয়ে বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-‘বহুবার বলতে চেয়েও একটা কথা আপনাকে কখনো বলা হয়ে ওঠেনি। আমি আপনাকে ভালোবাসি আব্বা। অনেক ভালোবাসি। এপাড়ে আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না। আপনি ওপারে অপেক্ষায় থাকবেন। আমি আসব।’

_____________

বাবা মারা যাবার পর থেকে এবাড়িতেই থাকতে শুরু করল বর্ষা। নাসিমা মনে মনে খুশি হলেন। মেয়েকে নিজের কাছে রাখার একটা সুযোগ না চাইতেই পাওয়া গেছে। ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাওয়া রাফিয়া অপছন্দ করতেন। ক্ষমতাবান বেহানের কথার বিপরীতে নাসিমার ও কিছু বলার থাকতো না। তবে এবার রাফিয়া ছাড় দিয়েছেন। তিনি নিজেই আজকাল নাব্যর সঙ্গে ঘনঘন ধানমন্ডি থেকে সাভারে আসা-যাওয়া করছেন। যদিও কিছুদিন যেতেই নিজে আসাটা কমিয়ে দিলেন। তবে শাশুড়ীর তাড়নায় ছেলেকে মাঝেমধ্যে পাঠান এখনো।

বর্ষার পরিবারের সকলে শোকাভিভূত ভাবটা ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে। নাব্য এলে যথেষ্ট সচেষ্ট থাকেন নাসিমা। আধঘন্টার জন্য এলেও আদর আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেন না৷ ফাবিহা আর সোহাগও সদা সতর্ক। এদের মাঝে একমাত্র বর্ষাই সবচেয়ে বিকারহীন। অনেককাল ধরে এবাড়িতে ওর জন্য নির্ধারিত, একটি ছোট্ট কুঠুরিতে সে বসে থাকে সারাক্ষণ। সালাত, জিকির আর কুরআন পাঠে সময় কেটে যায় ওর। কারো সঙ্গে বাড়তি কথা বলে না। মাঝে মাঝে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে চোখের ইশারায় খেলা করে। নাব্য এলেও বিন্দুমাত্র অবস্থার পরিবর্তন হয়না। নাসিমা বলে বলে ক্লান্ত। তবে জোর করতে পারেন না। পিতৃশোকে কাতর মেয়েকে কিছু বলতেও বাঁধে। তিনি এখনো বর্ষার এই নির্বিকার ভাবটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছেন। ধরে নিয়েছেন অধিক শোকে বর্ষা অমন দায়সারা গোছের আচরণ করছে। কিছুদিন পেরুলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্বামীকে হারিয়ে, ব্যাথা ভুলবার জন্য কিছু একটা আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন ছিল নাসিমার। তাই আজকাল সবটুকু মনোযোগ বর্ষার ওপর নিবদ্ধ করেছেন তিনি। এবং অনেকখানি সফলও হয়েছেন বলা যায়। মাস পেরুতে না পেরুতেই স্বামীর স্মৃতি ধূসর হতে শুরু করেছে মস্তিষ্কে। বর্ষাকে তিনি যে একেবারেই ভালোবাসেন না তা নয়। তবে নানার সংস্কারের বেড়াজালে পড়ে চিরকাল ছেলে সন্তানকে বড় করে দেখতে অভস্ত্য ছিল মন। বর্ষা যেমনই হোক, সোহাগের সঙ্গে ওর তুলনা চলে না। সোহাগ যদি তার আকাশের চাঁদ হয়, বর্ষা তবে কোনো নাম না জানা বহু দূরে অবস্থিত নক্ষত্র!

তার বয়সী অন্যসকল মহিলারা নিজেদের পোয়াতি মেয়ে ও তারপর নাতি নিয়ে আহ্লাদ, আনন্দের আতিশয্যে মেতে আছে দেখে একসময় নাসিমারও খুব ইচ্ছে জেগেছিল মেয়েকে নিজের কাছে রাখবেন। একটু আদর, আহ্লাদীও নাহয় করবেন। তাই অনেকটা ঝোঁক আর উত্তেজনার বসেই বর্ষাকে নিজের কাছে রাখার জন্য জোর করেছিলেন তিনি।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারলেন ফাবিহা বর্ষার এখানে পরে থাকাটাকে ভালো চোখে নিচ্ছে না। আজকাল কারণে অকারণে গাল ফোলাচ্ছে সে। সময়-সুযোগে দু কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ছে না।

ফাবিহার ভাইয়ের বদৌলতে চাকরিতে সোহাগের প্রমশন হয়েছে। কয়েক ধাপে বেতন বেড়েছে ওর। ফাবিহা আর আগের সেই নিরীহ মেয়েটি নেই। আজকাল ওর কথাতেই চলে নাসিমার সাজানো সংসার। ফাবিহার দাপট বেড়েছে। সোহাগেরও মৌন সম্মতি আছে তাতে। নাসিমা সব বোঝেন। তিনি এ-ও জানেন ছেলের সংসারে খেয়ে-পরে বাঁচতে হলে তাকে ওদের মর্জিমতো চলতে হবে। ফাবিহাকে অখুশি রাখা চলবে না।

ফাবিহা আজকাল যেসব কথা নিয়ে খোটা দেয়, বি-রোধ বাঁধাতে চেষ্টা করে তার অন্যতম একটি হলো বর্ষার সঙ্গে নাব্যর দাম্পত্য সম্পর্ক। ফাবিহা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে যে ওদের দাম্পত্য জীবন নাকি বাকি দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া সে আধুনিক মেয়ে। চোখ কান বুজে তো আর চলে না!
কত কথাই তো বাতাসে ভেসে বেড়ায়…… বিয়ের আগে নাব্যর একটি প্রেমিকা ছিল। যার জন্য নাব্য একপ্রকার উন্মাদ ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মেয়েটি ওকে ধোঁকা দেয়। তার পরই নাকি বর্ষাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নাব্য। তা নাহলে বর্ষাই বা কোনদিক থেকে নাব্যর স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে?
এইযে বর্ষা দিনের পর দিন এখানে পড়ে আছে। কই, একবার তো খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না নাব্য! প্রথম কিছুদিন এসে সৌজন্যতা দেখিয়েছিল। এই যা! ভালোবাসা থাকলে এমন কখনো হতে পারতো? নাব্য আসলে বর্ষাকে আর চায় না। সে সামর্থ্যবান পুরুষ। অর্থ, মেধা, সৌন্দর্য কোনোকিছুরই অভাব নেই। ও চাইলে বাঘা বাঘা লোকের মেয়েরা ওর দ্বিতীয় স্ত্রী হতে রাজি হয়ে যাবে অনায়েসে। বর্ষাকে ওর কি প্রয়োজন!

ফাবিহার এসব কথা শুনে নাসিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রাম্য মহিলা। এতসব জটিল জালে মেয়ের জীবন আটকা পড়েছে দুঃস্বপনেও সেকথা ভাবেননি।

ফাবিহার কথা শুনে তিনি দুচোখে অন্ধকার দেখলেন । ছোট কাল থেকে এই মেয়ে তাকে শুধু জ্বালা যন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে। এখনো শিক্ষা হয়নি। আর কতকিছু সহ্য করবেন তিনি এই অপয়া মেয়ের জন্য কে জানে!

চলবে……ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here