একদিন নববর্ষা-৪,০৫

0
204

“একদিন নববর্ষা-৪,০৫
অদ্রিজা আশয়ারী
০৪

বর্ষার কথায় আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। ততক্ষণে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে এসেছে তার। অন্যমনস্ক হয়ে সে যে একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলতে আরম্ভ করেছিল সেটুকু বুঝতে পেরে সহসা উদগ্রীব হয়ে উঠল।
–” উনুনে তরকারি। পুড়ি যাবে। ” বলে পালিয়ে গেল মুহুর্তে।

বর্ষার দুঃখটা এতক্ষণে গোচরে এল আমার। বর্ষার পরিবারের আর কেউ কুঠিবাড়িতে কাজ করে না। সে ছাড়া। নিজের মেয়ে হলে বসির শেখ নিশ্চয়ই কুঠিবাড়িতে কাজের জন্য তাকে একা ছাড়তেন না। অবশ্য একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। ওরা নিতান্ত হতদরিদ্র। অভাব যাদের নিত্য সঙ্গী, অল্পবয়সী মেয়ে বাড়ির বাইরে একা কাজের জন্য যাবে কিনা সে প্রশ্ন নিয়ে তাদের ভাবা চলে না। অভাব একটু হলেও ঘোচানোর জন্যই হয়তো মেয়েকে কাজে দিয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার যাই হোক। আমি এটুকু বুঝলাম বর্ষা তার জীবনে খুব একা।

***

এ গ্রামে যে গুটিকয়েক বাংলো বাড়ি আছে সেকথা আগেই জানিয়েছি। তার একটিতে উঠেছে রাহিল সোবহান নামে একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তিনি একা এসেছেন ছুটি কাটাতে। রাহিলের সাথে আমার পুরনো পরিচয়। সে শহরের নামকরা প্রকাশনীর মালিক। মাঝে বছর পাঁচেক ধরে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা চলে। এর আগেও যে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল এমন নয়। রশু তার আসার খবর জানালো। সেই সাথে এও জানালো রাহিল আজ বিকেলে তার ওখানে চায়ের দাওয়াত করেছে। এর কিছুক্ষণ পরই রাহিলের বাংলো থেকে লোক এল। তখন মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। লোকটা বলল রাহিল তাকে পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যেতে। সে নিজেই আসত। এতদূর জার্নির পর শরীর ক্লান্ত থাকায় নিজে আসতে পারেনি।

পাঞ্জাবি আমার বরাবরের পছন্দের পোশাক। হালকা ঘিঁয়া রঙা পাঞ্জাবি গায়ে চাপাতে চাপাতে রশুকে বললাম,
-” নির্জনে সাহিত্যসাধনা করতে এসেছিলাম। তার দেখছি বারোটা বেজে গেল। এই বোধহয় শুরু। এরপর আরও কত বিশিষ্ট ভদ্রলোক একে একে এসে হাজির হয়, আর আমাকে সৌজন্যতা দেখাতে যেতে হয় আল্লাহ ভালো জানেন।”

রশু হাসল।
-” বাকিদের কথা পড়েও ভাবা যাবে। আগে চলুন এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎটা সেরে আসি।”

কুঠিবাড়ি থেকে পাক্কা দশ মিনিট দক্ষিণে হাটার পর নজরে এল সাদা বাংলো বাড়ি। রাহিল যেখানে উঠেছে।
হ্যাজাক বাতির আলোয় আলোয় ছেয়ে আছে পুরো বাড়ি। আমরা সিড়ি ভেঙে ওপরের গাড়ি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মিনিট খানেক পরই রাহিল এল। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স। পোশাক ঝকঝকে। সাদা দাঁতে মৃদু হাসির ঝিলিক। শুনেছি কয়েকমাস আগেই তার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে।
রাহিলের সাথে আমার কখনো গভীর বন্ধুত্ব ছিল না। লেখালেখির সূত্রে পরিচয়। তারপর একসাথে ওঠাবসা। কিন্তু তার আচরণ দেখে মনে হলো এককালে আমাদের মাঝে ভীষণ সখ্যতা ছিল। মাঝের বছর খানেকের বিচ্ছিন্নতার কথা যেন সে বেমালুম ভুলে গেছে।

–” আজ রাতে কিন্তু তোমরা আমার এখানে ডিনার করছ। আমি গনীকে বলে দিয়েছি। স্পেশাল চুই ঝালের মাংস রানা হচ্ছে। খুলনা তথা সুন্দরবনের বিখ্যাত খাবার। সুন্দরবনে এসে এখানকার বিখ্যাত খাবার খাব না তা কি হয়!” বলে রাহিল হাসল।

অগত্যা সে রাতে খাবারটা ওখানেই সেরে আসতে হলো। এবং সৌজন্যতা খাতিরে রাহিলকেও ফিরতি ডিনারের দাওয়াত দিতে হলো।

পরদিন সকালে রশু বর্ষাকে অতিথি আসার ব্যাপার টা জানালো। বর্ষাকে দেখলাম একটা লম্বা বাজারের লিস্ট ধরিয়ে রশুকে বাজারে পাঠিয়েছে।

সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। বসার ঘরটাতে দিকে দিকে জ্বেলে দেয়া হয়েছে অনেকগুলো সাদা মোমবাতি। সাদা দেয়ালের সেই বড় ঘরটাতে গুটিকয়েক মাত্র আসবাব। মাঝে তিনদিক ঘিরে সোফা। তার সামনে খয়েরী গালিচা বিছানো। মোমবাতির হলুদাভ আলোয় নব্বই দশকের, রাতের শুটিং স্পটের মতো লাগছে ঘরটাকে। রাহিলের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই সদর দরজায় বাইরে তার গলার স্বর শোনা গেল। রশু তাকে নিয়ে এল ভেতরে। রাহিলের হাতে খুলনার বিখ্যাত ইন্দ্রমোহন সুইটস। আমি মনে মনে হাসলাম। রাহিলের হঠাৎ এত অধীরতার একটা মানে পাওয়া যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

খাবার পর বারান্দায় গোল করে পাতা চেয়ারে বসে রাহিল বলল,
–” আ….তোমার এখানে পান পাওয়া যাবে নাব্য? আজকাল খাবার পর সিগারেটের মতো পান খাওয়াটাও একটা নেশায় পরিনত হয়েছে। ”

রশু এই কথা শুনে ভেতরে চলে গেল পানের সন্ধানে। খানিক পরে এসে বলল,
–” এবাড়িতে পান নেই। তবে আমাদের রান্নার লোক আনতে গেছে ওর বাড়ি থেকে। নিয়ে এসে যাবে এক্ষুনি। ”

চেয়ারের সামনে পাতা ছোট টেবিলে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছিল টিমটিম করে। হ্যাজাকের আলোর প্রখরতায় ঝকঝকে পরিষ্কার ক্ষুদ্র বারান্দার চারদিক। রশু কোন কাজ না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
রাহিল হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলছিল। হঠাৎ বর্ষা এল হাতে পানের থালা নিয়ে। তার আগমন ভেপসা গরমে একপশলা বাতাস বওয়ার মতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। বর্ষা আজ সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে শুরু থেকেই আড়ালে ছিল।
তার পড়নে হালকা গোলাপি, মিহি সুতির সোনালি পাড় দেয়া শাড়ি। মাথায় আঁচল জড়ানো। বর্ষা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। তার হাত মৃদু কাঁপছে। আমি তাকিয়ে আছি। একমুহূর্তের জন্য ভুলেই গেছিলাম যে ঘরে আমি আর বর্ষা ছাড়াও আরও কেউ আছে। মনে হতেই রাহিলের দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখলাম রাহিল একদৃষ্টে চেয়ে আছে বর্ষার দিকে। কোনো রাখঢাক নেই। তার চাহনি অস্বাভাবিক। মুহুর্তে দুদর্মনীয় ক্রোধ জেগে উঠল ভেতরে। মনে হলো নিজের ভেতরের এই হঠাৎ জেগে ওঠা ক্রোধ টাও অস্বাভাবিক!
আর কিছু না ভেবে কেবল ঠান্ডা স্বরে বর্ষাকে বললাম,
–“ওটা টেবিলে রেখে তুমি যেতে পারো।”
কথা শেষ হওয়া মাত্রই বর্ষা পানের থালা টেবিলে রেখে চলে গেল।
সে চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে যেন রাহিল আবার স্বাভাবিক জগতে ফিরে এল। দরজায় বর্ষার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” হু ইজ শী?”
আমি থেমে শীতল স্বরে বললাম,
–” কাজের লোক। ” বলে তির্যক দৃষ্টিতে চাইলাম রাহিলের দিকে।
রাহিলের চোখে ঘোর লাগা দৃষ্টি। সেদিকে চেয়েই সে বলল,
–” শী ইজ বিউটিফুল! লাইক অ্যা ব্লসমড ফ্লাওয়ার।”

ক্রোদে দুচোখে অন্ধকার ঠেকল আমার কাছে চারদিক। নিজের অর্ধেকেরও কম বয়সী একটা মেয়ের দিকে এমন সাহিত্যিক উপমা ছুড়ে রাহিল তখনও অম্লান বদনে বসে আছে আমার সামনে। তার বলার ধরন আর বাঁকা চাহনি দেখে গা রিরি করতে লাগল আমার। পাঞ্জাবির ওপরের দুটো বোতাম খুলে আমি কলার ঝাঁকি দিলাম। মুখে সৌজন্যতার হাসি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে আমার জন্য। তখন রাহিল হঠাৎ আমার দিকে মনোযোগী হলো। ভুরু কুঁচকে বলল,
–“ঠিক আছো তো?”
আমি কেবল মাথা নাড়লাম। মুখের হাসি আগেই গায়েব হয়ে গেছে।
রাহিল গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলো। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
–” আ…. নাব্য। তোমার লেখালিখি কেমন চলছে? শুনলাম আজকাল নিয়মিত তোমার নাম বেস্টসেলার তালিকায় উঠছে। লেখার জন্য সময় দিতে পারছো না নিজের ফ্যামিলিকেও। তা একটা, দুটো লেখা তো আমাদেরকেও দিতে পারো। তোমার পরবর্তী উপন্যাসটাই দাও না আমার প্রকাশনীকে। একসময় তো নিয়মিতই তোমার বই বের হতো ‘কল্লোল’ থেকে। ”

আমি ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসলাম। এই তাহলে রাহিলের মৈত্রীজোট নবায়নের জন্য উঠে পরে লাগার প্রকৃত কারণ। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলাম রাহিলের দিকে। সে উত্তরের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে অতঃপর শীতল স্বরে বললাম,
–“আপাতত ‘অর্ধবিন্দু ‘ ছাড়া আর কোথাও লিখছি না আমি। সরি।”
বলে উঠে দাঁড়ালাম। বুঝিয়ে দিলাম যে এখানে আর এক মুহুর্তও বসতে চাইছি না আমি।

রাহিলকেও উঠতে হলো। এতক্ষণে তার মুখের হাসিতে ভাটা পড়েছে। স্বর নামিয়ে সে বলল,
–“তোমার সাথে একটা দূরত্ব গড়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম একসাথে কাজের মাধ্যমে আবার আমরা বন্ধুত্ব টাকে জিইয়ে তুলব। সে তুমি হতে দিলে না। কি আর করা। যাইহোক আজ আসছি।”

গম্ভীর মুখে তার কথায় সায় জানিয়ে আমি জায়গা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম।

***

মধ্যদুপুরের রোদ তির্যক হয়ে জানালা গলে এসেছে ঘরে। রোদের সাথে সাথে জঙ্গল থেকে নানা বিচিত্র, তীক্ষ্ণ সব শব্দও এসে মিশে যাচ্ছে। ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় এত প্রকার শব্দ তরঙ্গ তোলা ওই একটি মাত্র জানালাকে মনে হচ্ছে যেন একটা বড় আকারের সাদাকালো টিভি। ঝিরঝিরে তার সব দৃশ্যপট, কিন্তু শব্দের তরঙ্গ বেজায় প্রবল।

জানালার সামনের টেবিলে আমার সদ্য লেখা উপন্যাসের বিশটি পৃষ্ঠা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তার পাশে তিনটা চায়ের কাপ। সবগুলোর তলায় সামান্য কিছু চা তখনো অবশিষ্ট। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে আরও অসংখ্য পৃষ্ঠা। সেসব পৃষ্ঠার কোনো কোনোটাতে কেবল এক আধটা শব্দ লেখা। তারপর ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। সকাল থেকেই এই প্রক্রিয়া চলছে।

এবার আমি লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে শার্ট টা তুলে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। বর্ষনের হাত ধরে চললাম সেই নদীর ধারে, হাটতে।

ঘন্টাদেড়েক পর শাওয়ার নিয়ে ঘরে ফিরে আমার চক্ষু চড়কগাছ। টেবিলে একটা পৃষ্ঠাও নেই। মেঝেতেও পড়ে নেই কোনো পৃষ্ঠা। ওগুলো একেকটা আমার জন্য অমূল্য। একবারের সাহিত্য পরের বার রচনা করলে কখনোই সেটা প্রথমবারের মতো মৌলিক হতে পারে না। আমি মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে চেষ্টা করলাম যাবার আগে পৃষ্ঠাগুলো কোথাও রেখে গেছি কিনা। কিন্তু যতদূর মনে পড়ল। এখানেই ছিল ওগুলো। আমি চিৎকার করে রশুকে ডাকলাম। রশু প্রায় সাথে সাথে চলে এল। আমার মুখ দেখে সে বোধহয় আন্দাজ করতে পারল কিছু হয়েছে। আমি থমথমে গলার বললাম,
–” সকালে লিখা পৃষ্ঠাগুলো এখানেই রেখে গেছিলাম। এখন খুঁজে পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দেখো প্লিজ।”
রশু ব্যাপার টার গুরুত্ব বুঝে কোথাও খোঁজার বাকি রাখল না। কিন্তু পাওয়া গেল না একটা পৃষ্ঠাও। রশু এবার ভেবে বলল,
–” বর্ষাকে ডেকে আনি। ও কিছু জানলেও জানতে পারে। ” বলে সে চলে গেল।
আমি অনবরত মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগলাম। রাগ নিয়ন্ত্রণের এরচেয়ে সহজ উপায় আমার জানা নেই।

লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি ভীষণ সিরিয়াস। সেটা রশু জানে। এর পূর্বেও বাড়িতে কয়েকবার গায়েব হয়েছে আমার লেখার কাগজ। তখন আমার রুদ্রমূর্তি রশু দেখেছে। সেসব কাগজ কাজের লোক ভুল করে ফেলে দিলেও তার বেশিরভাগ অবশ্যি পুনোরুদ্ধার করা গেছিল।

বর্ষা এল। তার পেছনে রশু। রশু তাকে জিজ্ঞেস করল,
–” এই টেবিলের ওপর যে কাগজ ছিল। তুমি দেখছো সেগুলো কোথায়? ” রশুর মুখ দেখে মনে হলো সে খুব করে চাইছে বর্ষার উত্তর টা যেন না বোধক হয়।
বর্ষা একবার আমার দিকে চাইল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। আমি উত্তরের অপেক্ষায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে হাত কচলে আমতাআমতা করে বলল,
–“ও…ওইগুলা বাজে কাগজ ভাইবে আমি শুকনা পাতার সাথে পুড়ি ফেলছি।”
–“পুড়ে ফেলেছ?”
আমার আগে রশু চেঁচিয়ে উঠলো। তার চোখে হতাশার দৃষ্টি। আজ বর্ষাকে আমার ক্রোধানলের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
চলবে…..

অদ্রিজা আশয়ারী

একদিন নববর্ষা – ৫
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার মুখটা একখন্ড আদ্র মেঘের মতো হয়ে উঠল। ছুঁলেই যেন বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে শুরু করবে। সেই আদ্র মেঘের খন্ডের ওপর আঁকা, ভাসা ভাসা চোখ দুটো খনে খনে আমার দিকে ভীত দৃষ্টিতে চাইছে, ফের চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। দেখে আমি মুহুর্তে কাগজের কথা ভুলে বর্ষার ভয় কাটাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলাম। স্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললাম,
–” পুড়ে গেছে তাতে কি হয়েছে! আমি আবার লিখব। ওটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। তাছাড়া দোষ আমারই ছিল। কাগজগুলোতে চা পড়েছিল। ওগুলোকে বাজে কাগজ ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমারই উচিত ছিল বেরোনোর আগে ওগুলোকে সরিয়ে রেখে যাওয়া। ”
মুহুর্তে আমার অবস্থার এই পরিবর্তন অবাক করল সামনের দুজনকে। আমার কথা শুনে বর্ষা ঝট করে একবার তাকাল আমার দিকে। সে কি কিছু একটা বুঝল? বুঝুক!
আমি আদতেই আনকোরা। কাউকে ভালোবেসে, দুনিয়াকে চিৎকার করে জানিয়ে, দুদিনেই সেই প্রেয়সীকে সম্পুর্ণ অধিকার করে নেয়ার মতো দক্ষ প্রেমিক আমি নই।

বর্ষার মুখের মেঘ কাটতে শুরু করেছে। রঙ ফিরছে ধীরে ধীরে। সে নিচু স্বরে বলল,
–“আমি যাবো?” সেই স্বরে স্পষ্ট একটা স্বস্তির ইঙ্গিত।

–” যাও।”

বর্ষা চলে গেল। আমি রশুর দিকে তাকালাম। সে ভুত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি অস্বস্তি নিয়ে জানালার দিকে মুখ ফেরালাম। রশু থমথমে স্বরে বলল,” নবুদা, আপনি ঠিক আছেন তো? ”
গলা ঝেড়ে দূর্বল প্রতিবাদী স্বরে বললাম,” ঠিক থাকবো না কেন?”

–“না… এইমাত্র যা কিছু বললেন। সেসব দেখে আপনি ঠিক আছেন কিনা মনে সন্দেহ জাগল। ” রশু অল্পক্ষণ থামল।
–” আপনার মা অর্থাৎ চাচী আম্মা ছাড়া আর কারো সাথে আপনাকে এতটা কোমল হতে দেখিনি। বর্ষার সাথে হঠাৎ এত মেপে কথা বলার কারণ? ” রশু প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে উত্তর টা যেন নিজেই খুঁজে নিল। সে সামান্য হাসল৷ বারো বছরের পরিচয়ে এই প্রথম রশুর সাথে চোখাচোখি হতে লজ্জা পেলাম আমি।

***

তখন রাতের প্রথম প্রহর। বাইরে নিশুতি আঁধারের মধ্যে দিয়ে শুক্লপক্ষের চাঁদটা সবে পূর্বাকাশে উঠতে শুরু করেছে। চাঁদের চারপাশে হলুদ বলয়। শহরে রাতের আকাশে, চাঁদ মধ্যাকাশে স্থির হওয়া পর্যন্ত তার দেখা পাওয়া যায় না সাধারণত। আকাশচুম্বী অট্টালিকা গুলোর আড়ালে হলুদ আভা ছড়িয়ে, চাঁদ তৈরি হতে থাকে মধ্যাকাশে তার রূপালী আলো নিয়ে স্থির হওয়ার জন্য।
কিন্তু এখানে সন্ধ্যের আগেই গাছের ফাঁকে দেখা পাওয়া যায় আলোহীন পূর্ণ চাঁদের।
রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে সে চাঁদের আলোর তীক্ষ্ণতা।

আমি বসে আছি কুঠি বাড়ির সামনে, বাঁশের মাচার একপাশে। মনে হচ্ছে চাঁদ দেখার সুবিধার্থেই যেন এই মাচা তৈরি। একটা মিহি বাতাস বয়ে চলেছে। আশেপাশের ঝোপগুলোতে ঝিঁঝি পোকাদের দিকভ্রান্ত আর্তনাদ। একটু দূরে রশু বর্ষনের সাথে কোনো একটা বিষয়ে গুরুতর আলাপে ব্যাস্ত। এখান থেকে রান্নাঘরের একাংশ নজরে আসে। বর্ষা সেখানে পিদিমের গৈরিক আলোর নিচে ব্যাস্ত রান্নায়।

রশু হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এল। বর্ষন তখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি একটা আবোলতাবোল ছড়া কাটছে।
–“নবুদা, আমি ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। ”

আমি রান্নাঘরের দিকে ফিরলাম।
–“বর্ষার কাজ শেষ হয়নি বোধহয়। তুমি বর্ষনকে পৌঁছে দিয়ে এসো। ওর কাজ শেষ হলে আমি ওকে পৌঁছে দেব। ”

কেন যেন মনে হলো আমার কথা শুনে রশু একটু হাসল। জোৎস্নার ফুটফুটে আলোয় আমি তার ঠোঁটের কোণে সেই হাসির রেখা স্পষ্ট দেখলাম।
মাথা নুইয়ে আচ্ছা বলে সে চলে যেতে লাগল। আবার ফিরে এলো। দূরত্ব বজায় রেখে চাপা স্বরে বলল,
–” নবুদা, বর্ষনের বোনকে কি এখনো বর্ষা বলেই ডাকবো। নাকি নামের পেছনে আরও কোনো সম্মোধন যোগ করতে হবে? ”

রশু করছে রসিকতা! আমিও সেই সুরেই বললাম,
–“সে অনুমতি দিলে অবশ্যই ডাকতে পারো। তবে দেবে বলে তো মনে হয় না। বড় বেশি কড়া।”

–” কি করে দেবে বলুন তো! আপনি জানিয়েছেন কিছু? ”

–“সবকিছুই কি জানাতে হয়? নিজেও তো কিছু বুঝে নিতে জানতে হয়। ” কিছুটা অভিমানী স্বরে বললাম।

রশু হাসলো –” গল্পে কতো লোককে আপনি ভালোবাসতে শেখান। অথচ নিজের জীবনে ভালোবাসা নিয়ে এতো সংকুচিত। কিভাবে বলবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না। ভাবছেন বিপরীত মানুষ টা কেন নিজে থেকে বুঝে নিচ্ছে না। আসলে নবুদা মেয়েরা ভালোবাসার ক্ষেত্রে বড় বেশি জামানত চায়। নিজের মনকে সোপর্দ করার আগে পুরপুরি নিশ্চিত হয়ে নিতে চায়। যাকে সোপর্দ করা হচ্ছে সে আদতেও এর যথাযোগ্য সম্মান করতে পারবে কিনা।”

রশুর কথা যুক্তিযতই মনে হলো। আমি হেসে বললাম,
–” মনে হচ্ছে ভালোবাসা নিয়ে আজকাল বেশ ভাবছ। কবিতা লেখা শুরু করে দাও। রুদ্র গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এদেরকে ভুলে লোকে তোমার কবিতায় ডুব দেবে তারপর। ”
রশু আর কিছু বলবার আগে বর্ষন তাকে টেনে নিয়ে গেল।

***

বর্ষা আর আমি হাটছি জোৎস্নালোকিত পথে। চারপাশে সবকিছু থমকে আছে। সকল লৌকিকতা এখানে অনুপস্থিত। চাঁদের আলো ও এই অরণ্য পথ মিলে একটা অপার্থিব নিস্তব্ধতা সৃষ্টি করেছে। আমি পেছন ফিরে একবার দেখলাম। বর্ষা আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাটছে না। সে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
–“তোমাদের বাড়িটা কোনদিকে? ”
বর্ষা তর্জনী পূর্বে নির্দেশ করল।
–“ওইদিকে।”
–“আমি গান গাইলে তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?”
বর্ষা ডানে-বায়ে মাথা নাড়লো। আমি চাঁদের দিকে দৃষ্টি দিলাম। লেখালেখির মতো গানের ক্ষেত্রেও নাব্য দশজনের চেয়ে সেরা। পকেটে হাত রেখে হাটতে হাটতে আমি একটা গান ধরলাম।

“তোমারে লেগেছে এত যে ভালো
চাঁদ বুঝি তা জানে,
চাঁদ বুঝি তা জানে…

রাতের বাসরে দোসর হয়ে
তাই সে আমারে টানে,
তাই সে আমারে টানে….।”

রাতের ভয়ংকর নিস্তব্ধ এক পথে, যেখানে দুজন মানব-মানবীর উপস্থিতি ছাড়া আর সব ধূসর। গানটা সেখানে একটা দিব্য সুর তুললো। বর্ষা মাথা নুইয়ে হাটছে। তবুও আমার চোখ এড়ালো না তার ঠোঁটের এক চিলতে হাসি। একটা বেপরোয়া ইচ্ছে জাগল মনে। এই চাঁদনি রাতে, পথের অমানিশায় বর্ষার হাত ধরে হাটার ইচ্ছে।
আমি ধীরে পা ফেলে বর্ষার সাথে একই পদক্ষেপে হাটতে লাগলাম। বর্ষার হাত ধরলাম ভীত হাতে। তারপর হাটতে লাগলাম সেই হাত ধরে। এবং চাঁদের দিকে তাকিয়ে শপথ করলাম। পরের পঞ্চাশটি বছর আমি এই হাতেই হাত রেখে হেটে যাব।

নিয়তি বোধহয় আমার ঔদ্ধত্য দেখে হাসছিল সেদিন। সে জানতো, জীবনের সবচেয়ে বড় বিভ্রমে সেদিন নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম আমি!

***

–“বর্ষা, তোমার কি ফুল পছন্দ?” জঙ্গল ঘেঁষা ছোট্ট নদীর তীরে পাশাপাশি হাটতে হাটতে আমি বর্ষাকে জিজ্ঞেস করলাম। বিকেলের খরস্রোতা নদীর বুকের ওপর কয়েকটা চিল উড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেদের ভাষায় অদ্ভুত একটা শব্দে ডেকে উঠছে চিল গুলো । বর্ষা সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
–” কদল ফুল। ”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম
–” থামো। চোখ বন্ধ করে দাঁড়াও এখানে। ” বর্ষা ভ্রু কুঁচকে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পুরো মুখ জুড়ে অস্ফুট হাসির রেখা। দৌড়ে জঙ্গল ঘেঁষা গাছগুলোর দিকে গিয়ে আবার ফিরে এলাম আমি। বর্ষা তখনো ভ্রু জোড়া কুঁচকে, চোখ বুজে হাসি হাসি কৌতুহলী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার গাঢ় নীল রঙা শাড়ির আঁচল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমি বললাম
–“হাত পাতো।”
বর্ষা কলের পুতুলের মতো হাত পাতল।
একগুচ্ছ কদম আর গাঢ় নীল কাঁচের চুড়ি আমি তার হাতে তুলে দিলাম। বর্ষনের কাছ থেকে জেনে আগেই ওগুলো এনে রেখেছিলাম।
বর্ষা চোখ মেলে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। চোখ বড় বড় করে বলল,
–“আশ্চর্য! এইখেনে এইগুলা কই পাইলেন? ”
আমি হাসলাম,
–“ম্যাজিক!”
বর্ষা হেসে বলল,” কি সুন্দর! ” বলে সে কদম ফুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আমি চুড়িগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে নিলাম।
–“আমি পড়িয়ে দেই?”
বর্ষার ঠোঁটে আবার হাসির রেখা ঝিকমিক করে উঠল। হাসতে হাসতেই সে মাথা নাড়ল। বর্ষার বা গালে একটা তিল আছে। হাসলে সেই তিলটা টোলের মতো দেখায়। আমি চুড়ি গুলো বর্ষার দুহাতে পড়িয়ে দিয়ে তার দিকে ফিরেই হঠাৎ পেছাতে শুরু করলাম৷ বর্ষা অবাক হয়ে তাকাল। কিছুদূর পিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখতে লাগলাম বর্ষাকে।
বিকেলের ঝড়ো আবহাওয়ায়, নদীর তীর ঘেঁষে এক নীল শাড়ি পরিহিতা মেয়ে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, উড়ছে অবাধ্য নীল আঁচল, তার দুহাত ভর্তি গাঢ় নীল চুড়ি, হাতে একগুচ্ছ কদম। দৃশ্যটা মনে গেঁথে নিলাম। কখনো যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের মন, সেই আশংকায় পকেট থেকে ফোন বের করে টুপটাপ বর্ষার কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর আবার ফিরে চললাম বর্ষার কাছে।

***

–“তোমার বুবুকে বলে এসো আমাদের চা দিয়ে যেতে।” বর্ষন সঙ্গে সঙ্গে আজ্ঞা পালন করল। একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে মুহুর্তে ফিরে এসে বলল,
–“কইছি।”
চায়ের ব্যাপারে বর্ষনের আগ্রহ প্রবল। কিন্তু ছোট বলে আর গ্রামে এসবের খুব একটা চল নেই বলে বর্ষনকে চা খেতে দেয়া হয় না।
–” তোমার জন্যও চা দিতে বলেছ তো?”
বর্ষন গোমড়া মুখে বলল
–” কইছি, তয় দিবে বলি মনে হয় না। ”
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
–“দেবে না মানে? আলবাত দেবে! আজ চা না দিলে শাস্তি পেতে হবে ওকে। তুমি পড়া শুরু করো। আজ তোমাকে চা না দিয়ে দেখুক বর্ষা!”

বলতে বলতেই বর্ষা এল। হাতে একটা মাত্র চায়ের কাপ নিয়ে। আমি বললাম, ” বর্ষনের চা কোথায়?”
–“ওর চা খাওয়ার দরকার নাই। ” বর্ষা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল৷
–“দরকার অদরকারের প্রশ্ন পরে। তোমাকে বলার পরও তুমি বর্ষনের চা আনো নি কোন সাহসে? এখন তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। ”
দায়সারা ভাব ছেড়ে এবার সে ভীত চোখে তাকাল। আমি তাকে সত্যি সত্যি শাস্তি দিতে পারি এটা সে ভাবেনি বোধহয়।
আমি রূঢ় স্বরে বললাম, ” লেখাপড়া তো কোনো কালে শেখনি। অক্ষর চেনো?” বর্ষা ওপর নিচ মাথা নাড়লো।
–“বানান পড়তে জানো?”
বর্ষা নিচু স্বরে বলল,
–” একটু একটু..।”
আমি সামনে মেলানো বর্ষনের খাতা থেকে খানিক ছিড়ে তাতে খসখস করে কলম দিয়ে কিছু লিখে বর্ষাকে পড়তে দিলাম। গম্ভীর মুখে বললাম,
–“পড়তে না পাড়লে আগামী পাঁচদিন বর্ষনের কথামতো ওকে চা বানিয়ে দিতে হবে। ও যখন বলবে তখনি! ”
বর্ষা ফ্যাকাসে মুখে হাত বাড়িয়ে কাগজ টা নিল। কাগজের লেখার দিকে এমন ভাবে তাকাল যে মনে হল হিব্রু ভাষায় কিছু লেখা আছে ওতে।

বর্ষন তখন বোনকে এই মহা মুসিবতে পড়তে দেখে হাততালি দিয়ে হাসছে।
অনেক সময় নিয়ে কাগজের লেখাটা দেখার পর বর্ষা প্রথম অক্ষর টা উচ্চারণ করতে পারল। ততক্ষণে আমি অবশ্য আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
–” ভ… ভা…নো.. ভানো..” মাথা নেড়ে নিজেকে শুধ্রে নিয়ে বলল,
–” ভালো ” তারপর সরু চোখে চেয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ।
হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো চোখ বড় বড় করে একটানে বলল,
–” ভালোবাসি!” বলে ভ্রু কুচকে চোখ পাঁকিয়ে তাকাল আমার দিকে। কাগজ টা দলা পাঁকিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মেরে চলে গেল হনহন করে। আমি আর বর্ষন একযোগে হেসে উঠলাম। বর্ষনের দিকে ঘুরে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললাম,
-“তোমার বুবুকে তো শাস্তি পুরোপুরি দেয়া গেল না। পাড় পেয়ে গেল বানান টা পড়তে পেরে। ”

বর্ষাকে বানান পড়তে গিয়ে যে কসরত করতে হয়েছে সেটা দেখে বর্ষন তখন কিছুটা হলেও খুশি। তাই সে হাত তুলে করুণা করার ভঙ্গিতে বলল,” থাক থাক, এবারের মত ওরে মাফ কইরা দিলাম।” আমি আবার হেসে উঠলাম।

***

রাতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আজ একটু অন্যরকম লাগল। স্বাদটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা, চিনি বেশি। পেয়ালা হাতে নিয়ে, চেয়ার ছেড়ে উঠে উঁকি দিলাম রান্নাঘরে। অচেনা একজন মধ্যবয়সী মহিলা কাজ করছে। চা দিয়ে গেছে রশু, তাই রশুকেই ডাকলাম।
–“ব্যাপার কি? ইনি কে? আজ বর্ষা কোথায়?”

রশু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,” কিজানি। বর্ষার নাকি কি কাজ পড়ে গেছে। তাই ইনি এসেছেন। ইনি বর্ষার মা।”

–” ওহ! আমার হবু শাশুড়ী! ” মনে মনে বললাম।
রশু চলে গেল তার ঘরে। আমি এগোলাম রান্নাঘরের দিকে।
–“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন। ”
বর্ষার মা তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। ইশারায় সালামের জবাব দিয়ে হেসে ব্যাস্ত সরে বললেন, ভালো আছি বাপ। আপনে ভালো তো?”
হেসে মাথা নাড়লাম।
–” আপনি ব্যাস্ত হবেন না। কি কাজ করছিলেন করুন। ”
বর্ষার মা হেসে রান্নাঘরে ফিরে যেতে লাগলেন। দেখে বুঝলাম ইনি বেশি কথা বলেন না। চুপচাপ ধরনের। আমি ইতস্তত করে শেষে আবার বললাম,
–” আ….আজ বর্ষা বা বর্ষন কেউ এলো না যে। ওরা কোথায়? ”
তিনি উনুনে ফু দিতে দিতে বললেন।
–” দক্ষিণের বাংলোতে নতুন লোক এসিছে তো। ওখানেও বসষ্যার ডাক পড়িছে। আজ ও সেখানেই গেছে। তাই আমি এইখেনে এলাম।”

আমার নিশ্বাস আটকে গেল। আমি শুধু স্পন্দনহীন ভাবে বললাম,
–” কোন বাংলোয়? যেখানে রাহিল উঠেছে?”
বর্ষার মা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,
–” হ, নাম তো সেরুকমি শুনছি।”

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। রাহিলের বাংলোয় বর্ষা একা চলে গেছে। আমাকে না জানিয়ে। রাহিলকে আমি চিনি বহু বছর ধরে। শিকার কে বাগে পেলে সে কখনো বিনাকারণে তাকে ছেড়ে দেবে না। আর একমুহূর্ত ও না ভেবে ঘুরে হাটতে শুরু করলাম রাহিলের বাংলোর দিকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here