একদিন নববর্ষা – ৪৩

0
173

একদিন নববর্ষা – ৪৩
অদ্রিজা আশআরী

সে ওপর ওপর রাগ দেখিয়ে
ভেতর ভেতর কাঁদে,
হাতের মুঠো আলগা করে
বুকের ভেতর বাঁধে…

ফোঁপাতে ফোপাঁতে হাটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে বর্ষা। যতটা না শারিরীক যন্ত্রণায় তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি মানসিক বিপর্যস্ততায়।

নাব্য চলে গেছে! শূন্য ঘরে, তুষারিত বাতাসের গাঢ় প্রবহণে জানালার সফেদ পর্দার দোলাচলকে দেখায় অস্থির পাখির ডানাঝাপটানির মতো। নিরাবেগ নিচ্ছিদ্র শীতল ঝোড়ো সমীরণ, ক্ষণে ক্ষণে এসে বারি খায় বর্ষার গায়ে। বর্ষার চোখে অঝোর ধারায় অবিরত জল গড়ায়। বুকে জমে থাকা কষ্টের নোনা ঢেউ নির্গমনের পথ হারিয়ে ফেলে। শাড়ি আঁকড়ে ধরে, মুদিত নয়নে ও হঠাৎ শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। এমন ভয়াবহ মানসিক যাতনা….
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তলপেটের ব্যাথাটা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যেতে থাকে ওর দেহ। ব্যাথাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে পেটে হাত রেখেই একসময় মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে।

বর্ষাকে ঘিরে যেন সত্যিই কিয়ামত নেমে আসে। যন্ত্রণায় দুচোখে ঝাপসা দেখে চারপাশ। মৃত্যু যন্ত্রণা কি এর চেয়েও কঠিন? এর চেয়ে অধিক বিভীষিকাময় যন্ত্রণার অস্তিত্বও আছে পৃথিবীতে? বর্ষার জানতে ইচ্ছে করে। ও বোঝে, আজ কালরাত্রি এসেছে ওর জীবনে। সময় আসন্ন। এবার একটা অব্যর্থ পরিণামের মুখোমুখি হবে সে।

থেকে থেকে ওর মাথার ওপর বাজপাখির মতো চক্রাকারে ঘোরে দুঃসহ সময়ের হাতছানি। বর্ষা তখনো জানেনা এটা লেবার পেইন। শুধু যেন বোঝে ও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। দূরে, বিছানার অন্যপাশে অবহেলায় পড়ে আছে সেলফোনটা। বর্ষা অসাড় হাত জোড়া বাড়ায়, নাগাল পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ব্যার্থ হয়। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চায়। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ আসে না। পৃথিবীর বাকিসব কষ্ট অর্থহীন মনে হয় বর্ষার কাছে। মনে হয় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিললে আর কোনো কষ্টই ওকে ছুঁতে পারবে না কখনো। বর্ষা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। বোঝে, তখন অসহনীয় ব্যাথায় মুষড়ে পড়ে অবলীলায় মাটিতে বসে পড়াটা অনুচিত ছিল। কোনো প্রকার সাহায্য ছাড়া ভারী শরীরে এখন উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব মনে হচ্ছে।

মধ্যরাতের নিঃসঙ্গ ঘরকোণে, আলো আঁধারির আবছায়ায়, অনিশ্চয়তার সাগরে অবগহণরত বর্ষা বারবার শুধু আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। তার অস্পষ্ট ফিসফিস স্বরে বারবার অনুরণিত হয়, ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল!’

___________________________

আমি চোখের জল লুকোনোর বাহানায়
বৃষ্টিতে ভিজে যাই।
বৃষ্টি আমাকে ছুঁয়ে যায়, কিন্তু কষ্ট কেন
ধুয়ে যায় না?

ঝুম বৃষ্টির সহস্র নিনাদ বর্ষিত হয় নাব্যের ঝিম ধরা গায়ের ওপর। উদ্রিত তার গতি, তীক্ষ্ণ তার ধারাবর্ষণ। বুড়িগঙ্গার তীরে মোহাবিষ্টের মতো নাব্য বসে থাকে। নদীর ওপর বৃষ্টির বুলিন্দ ঝরে অবিরাম। জলে সেই শব্দের অনুরণন ছাড়া পুরো পৃথিবীটাকে মনে হয় যেন এক নিঃসাড় মৃতগ্রহ।

নাব্যর নিমেষহারা দৃষ্টি সেদিকে স্থির। কত সময় পেরিয়ে যায়.. নিঝুম ঝোড়ো রাত্রিটাও একসময় পৃথিবীকে বিদায় জানায়। ধূসরিত ম্লান সূর্য স্থাপিত হয় পূর্বাকাশে। সে সূর্যের না আছে কুসুমরঙা আলো, না আছে তেজ বা উত্তাপ। মেঘের আড়ালে ওর সমস্ত প্রতাপ চাপা পড়ে রয়।

সকাল হয়, কোলাহল বাড়ে নদীর ঘাটে। একসময় এই জায়গাটুকুও অসহনীয় হয়ে পড়ে নাব্যের জন্য। বুকে একরাশ ক্ষোভিত কালোমেঘ আর বেদনাবহ ভাবনার অনুযোগ নিয়ে নাব্য জায়গা ছাড়ে। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তার পাশে মসজিদটা অতিক্রম করতে গিয়ে ও আবার থামে। ওর ওপর স্থির হওয়া একজোড়া দৃষ্টি ওকে থামতে বাধ্য করে। মসজিদের সম্মানিত ইমাম দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার ওপারে, মার্বেল পাথরের সিড়ির ওপর। শেষরাতে এখানে ফজরের সালাত পড়েছিল নাব্য। রাত্রির শৈতময় আবহাওয়াকে পেরিয়েও ঠিক পাঁচটায় আযান ভেসে এসেছিল মসজিদ থেকে। নাব্য আর বসে থাকতে পারেনি। অরবে, ওর বিক্ষিপ্ত মন মহাপরাক্রমশালীর কাছেই আশ্রয় খুঁজছিল হয়তো। তিঁনি ছাড়া আর কে এই দুর্বহ মানবিক সংঘাতের অনুভূতি সম্পর্কে জ্ঞাত?

ইমাম তাকে দেখে মার্জিত হাসলেন। নাব্য অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর চোখের দৃষ্টি অকারণে ঝাপসা হয়ে এলো। সেটুকু আড়াল করতেই হঠাৎ মাথা নত করে অসাড় গলায় বলে উঠল, ‘আমি আসছি। আসসালামু আলাইকুম।’

ইমাম স্নেহভরে বললেন, ‘যাও। ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। কখনো মন আবার খেই হারালে ফের এখানে এসো। আল্লাহর ঘর সবার জন্য সবসময় খোলা। এ ঘরে এসে কেউ খালি হাতে ফেরে না। কখনো সালাত ছেড়ো না। যতবার মন অশান্ত হবে। সেজদায় লুটিয়ে পড়বে। পৃথিবীর কোনো দুঃখ আর তোমাকে শেকলবন্দী করতে পারবে না। মনে রেখো। যার আল্লাহ আছে, কিছু না রইলেও দিনশেষে তারই কিন্তু সব আছে। ‘

নাব্য চুপচাপ শোনে। কথা শেষ হতেই পা বাড়ায়। তখনো ওর মাথা নতই থাকে। অসম্বদ্ধ পদচারণা করতে করতে থেকে থেকে নানান বিচ্ছিন্ন ভাবনা এসে ভীড় জমায় ওর মনে। মনে হয় পৃথিবীর এই মানবীয় সম্পর্ক গুলো আসলে সব মিথ্যে। আপন স্বার্থে অনুমাত্র ঘাত লাগার সঙ্গে সঙ্গে সরূপ বদলে যায় সকলের। কারো সুখের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানোমাত্র সে পারস্পরিক ভালোবাসার কথা ভুলে, নিজের সুখ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সাদা চোখে যাকে নির্দোষী মনে হয়, অমোঘ নিয়মে সবাই ধরে নেয় তার বিপরীত মানুষটিই অপরাধী। আসলে পৃথিবীর সকল নিয়ম বড় বেশি সরল। সরল বলেই তা দিয়ে কারো জীবনের জটিলতা মেটানো এতো বেশি কঠিন!

জীবন জটিল। তার সমাধানের পথও হওয়া উচিত জটিল। খোলা চোখে আমরা যা দেখি সবসময় কি শুধু তাই সত্যি হয়? কারো হৃদয় তো আমরা চোখে দেখি না। তবে কেন যেটুকু দেখি তার ওপর ভিত্তি করে আমরা হৃদয়ের বিচারকার্য সমাধান করি অনায়েসে? রায় দিয়ে দেই এর পক্ষে বিপক্ষে?

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়। নাব্য কোথাও ফেরে না। না বাড়িতে, না অফিসে। সবখানেই ওকে জব্দ করার লোক উপস্থিত। আজ তাদের কারো মুখোমুখি হবার অভিপ্রায় জাগেনা ওর। নাব্যর উদভ্রান্ত পদচারণা একসময় আবার ওকে ফিরিয়ে আনে পূর্বের স্থানে। বুড়িগঙ্গার তীরের সবচেয়ে নিকটবর্তী মসজিদটির পাশে এসে ওর নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ শেষ হয়। মসজিদে তখন জোহরের আজান সমাপ্ত হয়েছে। মুসল্লিরা একে একে ভিরছে সালাতের জন্য। তাদেরই এককোণে নাব্য নির্বিকার নিশ্চুপ বসে থাকে। জামাত শেষ হয়। সকলে ফের বেড়িয়ে পড়ে জীবিকার তাগিদে। শুধু নাব্যেরই কোনো তাড়া নেই।

মিম্বারের অদূরে সমাচ্ছন্ন নাব্যর পাশে এসে দাঁড়ান ইমাম সাহেব। মুখে সকালের সেই বিশেষ আন্তরিক হাসি। ইমাম সাহেবের মুখপানে চেয়ে বিভ্রান্ত নাব্য ইতস্তত করে একটা প্রশ্ন করে, ‘আমি এখানে একটু শুতে পারি?’
–‘কেন নয়!’ ইমাম সাহেবের নির্মল হাসিমুখ প্রসারিত হয়।

সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেলে, এক আযান থেকে অন্য আযানে এসে থামে। নাব্যর ঘুম ভাঙে কপালে একটা শীতল স্পর্শের অনুভবে। মাইকে শোনা যায় আযানের তেজদীপ্ত ধ্বনি। ঠিক কোন কারণ টা ওকে জাগিয়ে তুলেছে বুঝতে পারে না সে। চোখ খুলতেই ইমাম সাহেব উৎকণ্ঠিত চাপা গলায় বলেন, ‘তোমার দেখি জ্বর। সারাদিনে কিছু খেয়েছিলে? কি হয়েছে বাবা? বাড়ি ফিরছো না কেন? পরিবারের সাথে বিরোধ?’

পেছন থেকে ইমাম সাহেবের ডাক পড়ে। উত্তর দিতে হয়নি বলে নাব্য স্বস্তি পায়। জামাত শেষে আরও একবার বিদায় নেয় ইমামের কাছ থেকে। তিনি কিছু খাবার মুখে নিতে অনুরোধ করেন। নাব্য দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে দেয়।
যাবার বেলায় তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘এবার সত্যি যাচ্ছো তো? দ্রুত বাড়ি ফিরবে কেমন?’
উত্তর না দিয়ে নাব্য তাকিয়ে থাকে। হয়তো জীবনে শেষ বারের মতোন।

____________________________

নিঃসঙ্গ রাত। প্রসস্থ খোলা আকাশ। তার গায়ে কতশত নক্ষত্রের প্রলেপ মাখানো। সেই সৌন্দর্য চোখে যত গাঢ় হয়ে প্রতিভাত হয়, নিজেকে তত ক্ষুদ্র মনে হয়। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে কত সামান্য মানুষের অস্তিত্ব। তবুও তাদের এতো অসার দম্ভ!

কিন্তু প্রকৃতির অবস্থান্তর ঘটে খুব দ্রুত। আকাশে অতর্কিতে জমতে শুরু করে কালো মেঘ। দিকে দিকে তার গর্জন অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। বাতাসের তোড় গাছের গায়ে আকুলি-বিকুলি ঢেউ তোলে। নাব্য অকুণ্ঠচিত্তে হেটে যায়। ওর বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে কতশত দুশ্চিন্তা, হাহাকারের ঝড় বয়ে যায়….
তবে এখন আর গন্তব্যহীন নয় সে। একটা ঠিকানা স্থির করেছে। আপাতত সেখানে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে যেতে হবে তাকে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে নাব্য নিরাহার। অন্য সব প্রয়োজনের সাথে সাথে খিদে নামক বস্তুটির প্রেষণাও হারিয়েছে ওর দেহ থেকে।

বৃহস্পতিবার রাত। শুক্লপক্ষ। আকাশে মেঘেদের অমন মুহুর্মুহু ঘনঘটা না থাকলে চাঁদের রুপোলী আলোর ছটায় নিশ্চয়ই মুখরিত হতো আজ চারপাশ। ভাবতে ভাবতে যাত্রাবাড়ীর একটি নির্দিষ্ট গৃহের উদ্দেশ্যে হেটে চলে নাব্য।

তখনি, নাব্যর মুখোমুখি এসে গাড়িটা হঠাৎ তীব্র ব্রেক কষে থামে। হেডলাইটের হলুদাভ আলো মুখে পড়তেই নাব্যর দুচোখে ধাধা লাগে। মিনিটের পেরোনোর আগে গাড়ির দরজা খুলে যে বেরোয়, তার উপস্থিতি এখানে বড় বেশি অপ্রত্যাশিত মনে হয় ।
রাহিলের ঠোঁটের কোণে হাসিটা তখনো জীবন্ত।
–‘ হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ! আবার দেখা হয়ে গেল আমাদের! বর্ষার কাছেই এসছো নিশ্চয়ই? তাই না?’

নাব্যর ভাবলেশ শূন্য দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাহিল দরাজ গলায় আবার বলে ওঠে,
–‘একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছো নাব্য? আমাদের যখনি দেখা হয় বিহাইন্ড দ্য সিন কোথাও না কোথাও বর্ষার উপস্থিতি থাকে।
বাই দ্য ওয়ে। এখানে কি তোমার নিয়মিত আসা হয়? ডোন্ট মাইন্ড। বর্ষাকে মিসট্রেস পদে আসীন করেছো নাকি?’

নাব্য এবারো উত্তর করে না। তবে ওর উদাস দৃষ্টি ধীরে ধীরে কঠিন হতে থাকে। রাহিল দমবার পাত্র নয়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজে থেকেই কথা বলে যেতে লাগলো অবিরত।
–‘ দেখো আমি ফ্র‍্যাঙ্কলি কথাটা বললাম দেখে তুমি রাগ কোরো না। বর্তমানে সবাই ঘরের বাইরে দু’ একজনকে রাখে। রোজকার বিরিয়ানিতে তিক্ততা এলে তখন রুচি বদলানোর প্রয়োজন পড়ে বৈকি!’

রাহিলের কথাগুলো ক্রমে নাব্যর মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে তুলছিল। এবার বিস্ফোরক স্বরে সে বলে বসে,
–‘ সবাই তোমার মতো নয় রাহিল। রক্ষিতা পোষার মতো পর্যায়ে এখনো বোধহয় যাইনি। আমি প্রয়োজনে ওর কাছে এসেছি। কিন্তু সবকিছু শেষ হবার পর তুমি কেন আজ এখানে এলে? ‘

–‘ দেখো, আমাকে যতটা খারাপ ভাবো তুমি ততটা কিন্তু আমি নই। আমিও প্রয়োজনেই এসেছিলাম। আমাদের সেপারেশন রিলেটেড ইস্যুতে।
কিন্তু…
যদি তোমার কথাই সত্যি ধরে নিই। অপ্রয়োজনে তুমি এখানে আসোনি। তবে বলবো ভুল সময়ে এসেছো নিশ্চিত। তোমার ফিরে যাওয়া উচিত! আড়ালে থাকা পাপাচার সম্পর্কে জেনে তিক্ত মনোভাব ধারণের চেয়ে পুরোপুরি অবিদিত থাকা ঢের ভালো। ‘

–‘কি বলতে চাইছো সরাসরি বলো।’

রাহিল জহুরি চোখে নাব্যকে দেখে নিল একবার। তারপর মুখে গম্ভীরতার প্রলেপ ফেলে বলল,
–‘ নাব্য তোমার অবস্থা বড় বেহাল মনে হচ্ছে। ঠিকঠাক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছো না। এসব এখন তোমার না শোনাই উচিত… ‘

–‘বাজে কথা বন্ধ করো। আমি শুনতে চাই।’

কিছু বলবার আগে রাহিল সময় নেয়।
-‘ সত্যি আমার বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু… ইউ হ্যাভ টু বি আন্ডারস্ট্যান্ড। টাইম হিলস এভরিথিং। ইট অলসো চেঞ্জেস এট দ্য সেম টাইম!

বর্ষা আর সেই গরানবনের অপরিণত মেয়েটি নেই। সময় ওকে বদলে দিয়েছে। বর্ষার এখন চোখ ফুটেছে, দুপাশে মজবুত দুটো ডানা গজিয়েছে। আজ এখানে এসে আবারও আমি উপলব্ধি করেছি। সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি আমি।
একটা ব্যাপার কি জানো তো? চিরকাল বড় সাদামাটা জীবনে অভস্ত্য থাকে যারা, হঠাৎ রঙিন দুনিয়ায় এলে ওদের পদস্থলনই আগে ঘটে। স্কুল কলেজে দেখোনি? গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েরাই বিপথগামী হতো বেশি?

এখনকার বর্ষা এমন অনেক কিছু ধারণ করে, গরানবনের বর্ষার ক্ষেত্রে যা হয়তো কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল!

নাব্য, চুড়ান্ত কথাটা বলবার আগে আমি আরও একটা ব্যাপার বলে নিতে চাই। তুমি আমাকে যাই ভাবো না কেন। আমি শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমাকে সাবধান করছি আসন্ন বিপদ থেকে। বিলিভ মি। আজ, অন্তত এখানে দাঁড়িয়ে আমি যা বলছি তার একটি শব্দও মিথ্যে নয়।

জানি তোমার জন্য একসাথে এতগুলো আকস্মিক আঘাত সহ্য করা কঠিন। ডোজটা বেশি পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ আমি বলবো বলে স্থির করেছি। এমন সুযোগ পরে নাও আসতে পারে..
তোমার অপাপবিদ্ধ কানে কথাটা বিশ্রী শোনাতে পারে কিন্তু..
রাহিলের গলার স্বর খাদে নেমে এলো।
‘বর্ষা কখনো এক পুরুষে সন্তুষ্ট থাকার মতো মেয়ে নয়। বিকৃত মনস্ক এবং বাজে ধরনের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য ওর মধ্যে প্রবল। আই নো। বিকজ আই স্ট্যেইড উইথ হার ফর অ্যা লং টাইম।

তোমার জন্য আরও একটা দুঃসংবাদ হলো বর্ষার এই বিকৃত অসুস্থতার প্রথম এবং প্রধান ভিক্টিম ছিলে তুমি। আমার সঙ্গে থাকার দিনগুলোতে বর্ষা শুধু তোমার জন্য হাসফাস করতো, অধীর হতো। আর অবশ্যই সেটা কোনো মনঘটিত ব্যাপার ছিল না। একটা কথা তো স্বীকার করতে হয়। তুমি আমাদের চেয়ে বেশি সুপুরুষ। শি ওয়াজ অবসেসড উইথ ইউ। এন্ড স্টিল নাও…..
হাস্যকর শোনাচ্ছে তবে সুযোগ পেলে ও সত্যি তোমাকে হ্যারেজড করতে ছাড়বে না।

আমাদের ডিভোর্সের পেছনের কারণটা বর্ষা কি বলেছে তোমাকে জানি না। তবে যাই বলে থাকুক সেটা একপাক্ষিক। এবার আমার দিকটাও শোনো। বর্ষার এসব নোংরা গায়ে পড়া স্বভাব আমি বিয়ের অল্পদিনেই টের পেয়েছিলাম। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতলব আটছিল ও। আমার অগোচরে আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গেই সদ্ভাব গড়েছিল। অন্তরঙ্গতা বাড়াচ্ছিল। ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াবার আগেই আমি জানতে পারি। বর্ষা ক্ষমা চায়। তারপর আমিও সব ভুলে গেছিলাম। কিন্তু এরপর আরও দুবার একই ভুল করেছে সে। দিন দিন বর্ষা ভীষণ উগ্র হয়ে উঠছিল। সারাক্ষণ শপিং, ফোনকলস, পার্টি..। আমার জীবন টা জাহান্নামে পরিণত করল কয়েক মাসেই। আমার বাচ্চাদের আর বৃদ্ধ মায়ের বিন্দুমাত্র পরোয়া ছিল না ওর। একটা সময় আমি বাধ্য হলাম সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে।

এ তো গেল আমার কথা। নাব্য তোমাকে মেনে নিতেই হবে। বর্ষা এখন নষ্ট মেয়েদের কাতারে পড়ে। আজ ওর বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে ফিরে এসেছি আমি। কেন জানো?
সামনের পার্কিংএর জায়গাটা ইতোমধ্যে ব্লক। ওখানে অম্লান বদনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সেই বন্ধুর গাড়ি। যার বুটিক হাউজে অনুকম্পা দেখিয়ে বর্ষাকে চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলে তুমি!’

বজ্রাঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া মানুষের মতো থমকে দাড়িয়ে রইল নাব্য। ওর ঠোঁট কথা হারিয়েছে, দৃষ্টিরা হয়েছে উদভ্রান্ত, নিশ্বাসের গতি স্লথ হতে হতে শূন্যে এসে পৌঁছেছে। আকাশে বজ্রনিনাদ ক্রমে বাড়ছে। জোর হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে। প্রকৃতির অঘোষিত বিদ্রোহ পরখ করে রাহিল অস্থির গলায় বলল,’ রাত বাড়ছে। বাড়ি ফিরতে হবে।
তুমিও ফিরে চলো। ও…..শিট! বলতে ভুলেই গেছিলাম। ‘
রাহিল থামল কয়েক মুহুর্তের জন্য, -‘আ……ব……তোমার ওয়াইফের কন্ডিশন কিন্তু ক্রিটিকাল। আজ সকালে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে ওকে। সবাই তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমার সৌভাগ্য। সে সময় কিছুটা সাহায্য করতে পেরেছিলাম। হসপিটালে ড্রপ করে দিয়েছিলাম তোমার ফ্যামিলিকে। অবশ্য তোমারই গাড়িতে।
বাড়িতে কিছু ঝামেলা বাধিয়েছো নিশ্চয়ই? অসময়ে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে ওর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছ। এদিকে রাত থেকে নাকি তুমি নিজেও উধাও। ফোন সুইচডঅফ। সকালে ওরা মহা বিপাকে পড়ে গেল হসপিটালে যাওয়া নিয়ে। ভাগ্যিস আমিও তখন ধানমন্ডিতে ছিলাম। তোমার ছোট বোন। আ…কি যেন নাম…। নিতিন! সাচ অ্যা প্রিটি গার্ল! ভীষণ বুদ্ধিমতিও বটে!
ও একা হাতে সব সামলেছে। তোমার এখন দ্রুত ফেরা উচিত। তুমি চাইলে আমি তোমাকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে পারি। ‘

একের পর এক মানসিক আঘাত। শিহরণ জাগানিয়া খবর কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছিল নাব্যকে।
তবে শেষ খবর টা অন্যসব কিছুকে ছাপিয়ে মস্তিষ্কে তীব্র বেগে আঘাত হান’লো। বর্ষা! বর্ষা বেচে আছে তো এখনো? ওর কিছু হলে নিজের সাথে সকল লড়া’ইয়ে হেরে গিয়ে নাব্য হয়তো সত্যি আত্মঘা’তী হয়ে পড়বে! এই মুহুর্ত পর্যন্ত যত আঘাত এসেছে ওর জীবনে। তা যত তীব্রই হোক। সব সয়ে নেবে নাব্য। শুধু বর্ষা এ যাত্রায় বেচে উঠুক!

–‘নাব্য। ঠিক আছো তুমি? হসপিটালে ড্রপ করে দেব তোমাকে?’

নাব্য জরাগ্রস্ত চোখে চাইল রাহিলের পানে।
–‘ হ্যাঁ। নি..নিয়ে চলো আমাকে।’ ওর ঠোঁট কাঁপছিল।

রাত্রির প্রথম প্রহর পেরিয়েছে বহু আগে। আসু বৃষ্টির সম্ভাবনায় রাস্তাঘাট ইতোমধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে। ঝোড়ো রাত্রির নির্জন হাইওয়েতে গাড়ি চলছে নব্বই কি.মি ঘন্টাবেগে। রাহিলের দৃষ্টি পাশের প্রাণশূন্য স্তম্ভিত মুখটির ওপর নিবদ্ধ। নাব্য এতটা ভেঙে পড়তে পারে তা ভাবনার অতীত। ওর দৃষ্টির অসংলগ্নতা, নিষ্প্রভ বিচরণ ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতোন নয়। কিছু একটা যেন ওকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এলোমেলো করে দিয়েছে স্নায়ুর গতিবিধি।
–‘ এসে গেছে। নাব্য তুমি যাও। এতোটা ভেঙে পড়ছো কেন? এভরিথিং উইল বি ফাইন। আর ওই প্রস্টি…যাই হোক। ওর কথা ভুলে যাও। এখন ফুল টাইম তোমার ওয়াইফের পাশে থাকা দরকার। বাই।’

রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে নাব্য ছুটে গেল লিফটের দিকে। ওর পা কাঁপছে। হৃদপিণ্ডটা তড়পাচ্ছে পাগলা ঘোড়ার মতো। বদ্ধ লিফটে একবার ওপরে তাকিয়ে চোখ মুদলো। মনে মনে একান্ত কিছু অনুরোধ পেশ করল রবের কাছে। আজ অনেক দিন পর পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ম করে পাঁচবার আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছিল সে। ইমাম সাহেবের কথা রেখেছিল। বিনিময়ে অন্তরে পেয়েছিলেন অবর্ণিত প্রশান্তি।
নাব্য করজোড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। আজ আর কিচ্ছু নয়। শুধু বর্ষার জীবিত থাকাটা নিশ্চিত করতে চায় সে। নবীন যে প্রাণটি পৃথিবীতে আসার জন্য দুর্নিবার বিদ্রো হে সমাসীন হয়েছে, তার প্রতিও বিশেষ কোনো টান অনুভব করছে না নাব্য। শুধু বর্ষা আবার আগের মতো হাটুক, চলুক, কথা বলুক….

অতর্কিতে আরও একটি একান্ত গোপন দুঃখবোধ নাব্যকে ঘিরে ধরল। ওদের অনাহুত বা হয়তো ইতোমধ্যে আগত সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে তা সে জানে না। বর্ষা কখনো ওকে বলেনি। বলার প্রয়োজন মনে করেনি বোধহয়। নাব্যর সদাসর্বদা নিস্ক্রিয় অভিব্যক্তি বর্ষার সেই জানানোর ইচ্ছেটাই কেড়ে নিয়েছিল হয়তো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here