একদিন নববর্ষা-৬,০৭
অদ্রিজা আশয়ারী
০৬
কাল রাতের প্রকৃতি ছিল জোৎস্নার আলোয় ধোয়া। অথচ তার ঠিক একদিন পর আজকের রাতের আকাশ মেঘ কালো অন্ধকার। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে পশ্চিম থেকে আসা মেঘেরা ভেসে চলেছে পূর্বাকাশে। উত্তাল হাওয়া, চারিদিকে তার শো শো গর্জন। গাছ বাড়ি খাচ্ছে গাছের গায়ে। ধূলো উড়ছে। বাতাস ও ধূলোর আধিক্যে সামনে তাকানো দায়। তার মধ্যে দিয়ে আমি ছুটছি , যতদ্রুত সম্ভব। তবুও মনে হচ্ছে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাংলোতে পৌঁছে দেখলাম গেট ভেতর থেকে বন্ধ।জোড়ে ধাক্কা দিতেই সেদিনের লোকটা বেরিয়ে এল। হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দেখল আমাকে। এই সময় আমাকে যে সে এখানে একদমই আশা করে নি সেটা তার মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সে ফ্যাকাসে মুখে থতমত গলায় বলল ,
–” সাহেব!”
–“সরো, আমি ভেতরে যাব।”
লোকটা ভীত চুপসে যাওয়া মুখে একটু প্রতিবাদের রেখা ফুটল।
–“ভেতরে এখন কেউ যাবার অনুমতি নেই সাহেব। স্যারের নিষেধ আছে। ”
এর সাথে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। ওকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। লোকটা কিছুদূর আমার পেছন পেছন এসে শুধু বলতে লাগল,
–“স্যার নিষেধ করেছে। আপনি যাবেন না সাহেব..”
বাংলোর ভেতরে পা ফেলতেই গুমোট আবহাওয়া টা টের পেলাম। ভেতরে একটা অস্বস্তিকর থমথমে ভাব। নিচ তলায়, ঘরের কোণে শুধু একটা মোমবাতির শিখা দপদপ করে জ্বলছে। কারো কোনো সারাশব্দ নেই। আমি দ্রুত পদক্ষেপে ওপরে উঠে গেলাম। পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম একেকটা দরজার নব। হঠাৎ একটা শব্দ এল কানে। কারো জোরে হেটে যাওয়া কিংবা চেয়ার টানার মতো মনে হল শব্দটা। মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে শব্দটার উৎস কোনদিকে সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দোতালাটা ভীষণ অন্ধকার। তাছাড়া পুরনো আমলের বাড়ি, মোটা দেয়ালের জন্য ভেতরের খুব কম শব্দই কানে আসে। কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে আলো তো আসার কথা। সেটা পাচ্ছিনা কেন। হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটার কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বাললাম। আলো জ্বলতেই চোখে পড়ল সামনের বাঁক টা। সেটার ডানপাশে এক চিলতে করিডর। ওইপথ ধরে এগোতেই শব্দটা প্রথম আমার কানে এল। রাহিলের কণ্ঠ হঠাৎ গর্জে ওঠার শব্দ। দ্বিতীয় বার না ভেবে মুহুর্তে দরজা ঠেললাম। কেউ আসবে না জেনে রাহিল কাঠের দরজাটা লাগানোর প্রয়োজন মনে করেনি। ধাক্কা দিতেই ওটা খুলে গেল। ঘরের সবকিছু যেন থমকে গেল মুহুর্তে। রাহিল বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে দাঁড়াল। তার কপালের দিকটা সামান্য চেড়া। সেখান থেকে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে। দৃষ্টিতে উগ্র হিংস্রতা। সে ঘরে তখন একটা মাত্র মোমবাতির শিখা দপদপ করে জ্বলছে। তার থেকে ছ-সাত হাত দূরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। তার হাতে একটা কাঁচের ফুলদানি। ফুলদানিটা ধরে আছে আক্র’মনাত্মক ভাবে। আমাকে দেখে যেন বর্ষার আটকে রাখা রুদ্ধশ্বাস আবার স্বাভাবিক হলো। রাহিল ক্রোধে, বিস্ময়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে গর্জে উঠে বলল,
–“নাব্য, তুমি এখানে?”
এই মানুষ রূপী পশুর প্রশ্নের জবার দেয়া তখন বাহুল্য। দু-পা এগিয়ে রাহিলের কলার চেপে ধরে বললাম,
–“কেন, আমাকে এখানে একদম আশা করিস নি বুঝি? তোর সাহস হলো কি করে বর্ষাকে এখানে ডাকার? ” শেষের দিকে উচ্চগ্রামে বাজল আমার গলার স্বর।
আমার কথা শুনে রাহিল একটুও ঘাবড়ালো না। বরং হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখে শয়তানি হাসি ফুটল।
–” রেগে যাচ্ছ কেন নাব্য? এতদিন ও তোমার সঙ্গে ছিল। একদিন নাহয় আমার সঙ্গে থাকবে। ওদের এসবে অভ্যেস আছে। তবে এই হারা’মজাদি টা সোজা কথায় রাজি হচ্ছিল না। আমার কপালে পিতলের গ্লাস ছুড়ে মেরেছে। তোমার সাথে শুতে রাজি অথচ এখানে এসেই যত ভঙ ধরেছে। ওর নখরা যদি আমি না ভাঙি…. ”
বাকি কথা শেষ করার আগেই রাহিলের মুখ বরাবর একটা ঘু’ষি পড়ল। তারপর আরও কয়েকটা ঘু’ষি দিয়ে ওকে মাটিতে ফেলে গ’লা চেপে ধরলাম। ক্রোধে তখন হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে আমার। হয়তো ওখানেই মেরে ফেলতাম। বর্ষা হঠাৎ ছুটে এসে চিৎকার জুড়ে দিল।
–“মরে যাইব, মরে যাইব। ছেড়ে দেন। অনুরোধ করছি ছেড়ে দেন। বর্ষনরে আগে খুঁজে বের করেন।”
শেষের কথাটা শুনে আমার টনক নড়ল। বর্ষনের কথাটা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি । রাহিলের কলার চেপে আবার চিৎকার করে উঠলাম,
–” কোথায় ও?”
রাহিল কাশির জন্য কথা বলতে পারল না, ভয়ে ভয়ে হাতের ইশারায় সামনের ঘরটা নির্দেশ করল।
–“ওর যদি কিছু হয় তোকে আজ আমি এখানেই খু’ন করব।”
আমি আর বর্ষা ছুটে গেলাম সেদিকে। ফ্ল্যাশলাইট টা হাতে নিলাম। বর্ষা ছিটকিনি খুলে ভেতরে বর্ষনের মুখে বাঁধা কাপড় খুলতেই সে গুঙিয়ে উঠল। ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল।
ভাইকে কোলে নিয়ে অতঃপর বেরিয়ে এল বর্ষা। আমি ফের রাহিলের দিকে এগোতে চাইলে সে একহাতে আমার বাহু চেপে বলল,
–” দোহাই আর যাইবেন না। আমার ভাইটা খুব ভয় পাইতাসে। ”
বর্ষা তার ভাইয়ের কথা বলল। কিন্তু তার নিজের অবস্থা ও যে খুব সুবিধের নয় আমি বুঝলাম। বর্ষনকে ওর কোল থেকে নিয়ে অন্যহাতে ওকে ধরে সিড়ি ভেঙে নামতে শুরু করলাম। বাইরের ঝোড়ো হাওয়া ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। ভেতরের এই বৈরীতায় ভুলতে বসেছিলাম বাইরের বৈরভাবকে। বৃষ্টির মধ্যেই চলতে শুরু করবো কিনা ভাবতে ভাবতেই বর্ষা হঠাৎ কথা বলে উঠল। এত অন্ধকার যে কিছু স্পষ্ট দেখার সুযোগ নেই। গলার স্বর শুনে মনে হলো সে কাঁদছে।
–“এইখেনে আর এক মুহুর্ত ও না। চলেন।”
বর্ষা আর আমি একযোগে নেমে পড়লাম পথে, শীতল অন্ধকার রাতের ঝুম বৃষ্টিতে। বর্ষন দুহাতে আমাকে ধরে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আমার সাদা পাঞ্জাবি বৃষ্টির তোড়ে লেপ্টে গেছে গায়ের সাথে। আমি একহাতে বর্ষনকে ধরে রাখলাম। অন্যহাতে বর্ষার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের কাছে চেপে আকাশের দিকে চেয়ে একটা বড় স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম। বর্ষা অন্য হাতে আমার বাহু চেপে ধরে রইল। আল্লাহ আজ অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। বর্ষার কিছু হয়ে গেল কি হতো! ভাবনাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা কথা বুঝলাম। বর্ষাকে আমি কতটা ভালোবাসি। বুঝলাম তাকে ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকে আমি কখনো এত ভালোবাসিনি। বাসতেও পারবোনা হয়তো কোনোদিন।
মাঝপথেই রশুর সাথে দেখা। সে টর্চ হাতে নিয়ে ছাতা মাথায়, আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। বর্ষা তাকে দেখে আমার হাত ছেড়ে দিল। রশু এগিয়ে এসে আমাদের দেখতে পেয়ে নিজে ভিজে ছাতা বাড়িয়ে ধরল আমাদের দিকে। আমাদের তিনজনকে একসাথে দেখে অবাক হয়েছে ভীষণ।
–” নবুদা, কোথায় গেছিলেন আপনি? ভেবে ভেবে আমার জান যাওয়ার জোগাড়। ভয় হচ্ছিল আগের বারের মতো নদী আপনাকে আবার টেনে নিয়ে গেল কিনা!
তাছাড়া ওদেরই বা কোথায় পেলেন? করিমন খালা ভীষণ চিন্তা করছেন। এতো রাত হল, তার ওপর বৃষ্টি। ওরা দুজন কিভাবে ফিরবে তাই ভেবে।”
রশুর বলার ভঙ্গিতে বুঝলাম করিমন খালা মানে বর্ষার মা। তার মায়ের ওপর আমার তখন ভীষণ রাগ। নাম শুনেই ভেতর টা কঠিন হয়ে গেল। টাকার জন্য লোভী ছাড়া আর কেউ নিজের মেয়েটা এভাবে বাঘের হাতে ছেড়ে দেয় না। এখানে বর্ষা রাঁধতে আসে। সেই সূত্রেই আমি পেয়েছি তার দেখা। তবুও বর্ষার এভাবে পরের বাড়ি রেঁধে দেয়ার ব্যাপার টা আমার অপছন্দ। প্রতুত্তরে কেবল
-“চলো।” বলে হাটতে শুরু করলাম।
সকালেই খবর পেলাম রাহিল তার দলবল নিয়ে বাংলো ছেড়ে চলে গেছে। এবার অবশ্যি আমাকেও ফেরার আয়োজন করতে হয়। রশু কদিন ধরেই কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রায় মাস পেরোতে চলল। এবার অন্তত একবার ফেরা উচিত। কিন্তু বর্ষাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চলে গেলে আবার কবে ফিরব…ততদিন বর্ষার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিছিন্ন থাকবে। তবুও যে যেতে হবে।
রশু এবার অনুমতি পেয়েই বন্দোবস্ত শুরু করে দিল। দুদিন পর আমরা যাত্রা শুরু করবো গরানবন ছেড়ে।
***
পিঙ্গল সন্ধ্যার আকাশে, সূর্য তখন বিদায় জানাচ্ছে পৃথিবীকে। আমি বসে আছি মাচায়। মাচার অন্যপাশে বর্ষা বসে পা দোলাচ্ছে। তার কানে গোঁজা নাগ চাঁপা ফুল, হাতে গাঢ় লাল রেশমি চুড়ি। পড়নে ঘিঁয়ে রঙা জমিনের, সোনালী পাড়ের সুতির শাড়ি। শেষ বিকেলের আলোয় আমার পাশে বসে থাকা, কানে ফুল গোঁজা মেয়েটিকে অপার্থিব দেখাচ্ছে। সে গুনগুনিয়ে গান গাইছে ফুরফুরে মেজাজে। এই মুহুর্তে বর্ষার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার মতো একটা খবর আমার কাছে আছে। তবে এখন সেটা বলতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না।
হঠাৎ দেখলাম গান বন্ধ করে বর্ষা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমিও তার দেখাদেখি ভ্রু উঁচু করলাম। বর্ষা এবার হেসে ফেলল।
–” কি হইসে?”
–” কিছু না। ”
বর্ষা মাথা কাত করে আদুরে গলায় বলল
–” মন খারাপ? ”
–” উহু। ”
–” বলেন না।”
আমি বড় করে একটা নিশ্বাস ফেললাম।
–“কাল চলে যাচ্ছি। রশু সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।” বলেই আমি ব্যাস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বর্ষাকে রেখে হাটতে শুরু করলাম কুঠি বাড়ির দিকে। বর্ষা বিহ্বল হয়ে সেখানে বসে রইল। পরো মুহুর্তেই আমি ফিরে এলাম। বর্ষার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত টেনে নিয়ে গুঁজে দিলাম হাজার টাকার দশটা নোট।
চলবে….
অদ্রিজা আশয়ারী
একদিন নববর্ষা – ৭
অদ্রিজা আশয়ারী
__________
বর্ষা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। মাচা থেকে নামতেই দূরত্ব টা কমে এল আমাদের মাঝে। তার হতবিহ্বল ভাব তখনো কাটেনি। হাতের নোট গুলোর দিকে একবার চেয়ে প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল আমার দিকে, ভ্রুতে গাঢ় কুঞ্চন এঁকে।
–” এগুলা কি? কেন দিসেন আমারে?”
বর্ষার একটা হাত তখনো আমার হাতে। আমি সেই হাতটা টেনে অধৈর্য হয়ে বললাম,
–” বর্ষা, আমাকে কথা দাও। আমি চলে যাওয়ার পর তুমি এক বারের জন্যও এবাড়িতে পা রাখবে না। এখানে যেই আসুক। তার রান্নার দায়িত্ব তুমি কোনো ভাবেই নিতে পারবে না। আপাতত এগুলো তোমার কাছে রাখো। যেকোনো দরকারে এখান থেকে খরচ করো। আমি খুব শীগ্রই ফিরে আসব। কিছু ব্যাপার সামলানোর জন্য ঢাকায় ফেরা জরুরি হয়ে পড়েছে। ততদিন তোমার এ বাড়িতে পা ফেলা পুরোপুরি নিষে’ধ।”
উত্তরে কিছু বলার বদলে বর্ষা মাথা নুইয়ে ফেললো। আকাশের মন খারাপে জমে থাকা কালো মেঘ দেখলে, বাতাস যেমন অধীর, বিদ্রোহী হয়ে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। বর্ষা মুখে হঠাৎ জমতে শুরু করা কালো মেঘ দেখে আমি তেমনি অধীর হয়ে উঠলাম। মনে হলো বর্ষার মুখে জমে থাকা মেঘ আমার বুকের ভেতর কালো বিষাক্ত ধোঁয়া হয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এর আগে কারো মন খারাপের এতটা পরোয়া আমি কখনো করি নি। অথচ মনে হচ্ছে বর্ষার এই নৈশব্দ মনোভাব যেন আমার ভেতরে কষ্টের বাণ তুলছে একের পর এক। ক্ষণে ক্ষণে জড়িয়ে যাচ্ছি আমি এই বিষাক্ত মায়ায়।
বুঝলাম খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছি আমি একটি গ্রাম্য মেয়ের প্রেমে।
***
মোংলার জলপথ ছেড়ে আরও খানিক স্থলপথে যাত্রার পর, যশোর টু ঢাকা আকাশপথে যাত্রা শেষে তখন সবে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়েছি। বা দিকে পার্কিং করে রাখা কফি রঙা হাইস টার দিকে ব্যাগ প্যাক নিয়ে এগিয়ে গেল রশু। ওটা বাড়ি থেকে আমাদের নিতে আরও আধঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছে।
যাত্রার পুরো সময়টা বিষন্ন কেটেছে আমার। এই প্রথম একটু ভালো লাগছে। বর্ষাকে ছেড়ে আসার সন্তপ্ত অনুভুতিটা এখন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। নিজের চিরচেনা শহরে, জনসমুদ্রের মাঝে নিজেকে হারাতে পেরে। সুন্দরবনের অরণ্য জীবনের সেই উদাস, এঁদো-সোঁদা গন্ধযুক্ত বন্য অনুভুতি টা আর পাচ্ছি না। যত এই জনারণ্যে প্রবেশ করছি তত ফিকে হয়ে আসছে অনুভুতি গুলো। শুধু বর্ষা ছাড়া।
গাড়ির পেছনে উঠে বসতেই একরাশ ধুলোর মেঘ মুখে এসে লাগল। তা দেখতে পেয়ে রশু জানালার কাঁচ বন্ধ করে দিল। বিরক্তি এসে গেল আমার।
–” কাঁচ নামিয়েই রাখ। বাতাস আসুক। সাথে শহুরে গন্ধ আর ধূলোর শুষ্ক ঘ্রাণও আসুক।”
আমার কথা শুনে রশু হেসে ফেলল।
–“ধূলোরও আবার ঘ্রাণ হয় নবুদা? আপনি পারেন বটে! ”
–“খবরের কাগজ রাখবেন সাব?”
জানালায় বাড়ানো ছোট মুখটার দিকে আমি আর রশু একযোগে তাকালাম। ধূলোময়লা মাখানো, হলদে গেঞ্জি পড়া ছেলেটার হাতে ডজনখানেক পত্রিকা তখনো অবশিষ্ট। ছেলেটার বয়স বোধহয় বর্ষনের মতোই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতে চলেছে। এই পত্রিকা গুলোর মেয়াদ প্রায় ফুরিয়ে গেছে। আর কেউ কিনবে না পত্রিকা। অবুঝ ছেলেটা সেটা বুঝতে পারছে না। ওয়ালেটে বের করে, হাতে যা উঠে এলো ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম,
–“একটা পত্রিকা দাও।”
ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে দায়সারা ভাবে বলল
–” একটার দাম তো মাত্র দশ টাকা সাব!”
খেয়াল করলাম ওর কপালের ওপর থাকা ঘন কালো চুল বেয়ে টপাটপ ঘাম নেমে আসছে। গরমের তীব্রতায় অতিষ্ঠ দুটি চোখ। ঠোঁটদয় রুক্ষ।
–“রেখে দাও।”
–“তাইলে আপনে সবগুলা কাগজই নেন।” বলে সে জানলা দিয়ে বাড়িয়ে ধরল পত্রিকা নামক সেই মূল্যহীন কাগজ গুলোকে। আমি তার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে পাশে রাখলাম৷
ছেলেটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এই ভর সন্ধ্যেতেও যে কেউ তার পত্রিকাগুলো কিনে নেবে, এত ভালো মূল্যে, সে ভাবতেই পারেনি!
ছেলেটা আর দাঁড়াল না। টাকাটা নিয়ে চোখ দিয়ে হেসে, আমাকে একটা অদৃশ্য ধন্যবাদ উপহার দিয়ে মুহুর্তে গায়েব হয়ে গেল। আমি ওপর থেকে একটা পত্রিকা নিয়ে সামনে মেলে ধরলাম। রশু সারহীন কণ্ঠে বলল,
–” এতো পত্রিকা কিনেছেন। বসে থেকে জ্যাম দেখে কি করব! দিন আমিও একটা পড়ি।”
ড্রাইভার সবে ভেতরের বাতি গুলো জ্বেলেছে। পত্রিকা আমার সবসময় শেষ পাতা থেকে পড়তেই ভালো লাগে। রশুকে একটা দিয়ে এবার নিজেও পত্রিকা মেললাম। শেষ পাতাটা মেলে ওপরে নজর বুলিয়ে নিচের হেডিংয়ে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত শরীর থেমে গেল। পত্রিকা সহ হাতটা কেঁপে উঠল একবার ।
সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা “জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নাব্য ইমতিহানের গোপন প্রেমের খবর ফাঁস!”
নিচে বিস্তারিত –
বর্তমান কালের অন্যতম জনপ্রিয় তরুণ কথাসাহিত্যিক নাব্য ইমতিহান। লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, প্রেমের উপন্যাস। তার লেখনীতে কাব্যিক ভাব আর হেয়ালিই মুখ্য। এমনকি বন্ধু ও আত্মীয় মহলের মতে তিনি নিজেও মানুষ হিসেবে ভীষণ হেয়ালি ও বেপরোয়া স্বভাবের। অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রয়েছে তার রয়েছে মিলিয়ন ফলোয়ার। সাহিত্যের পাশাপাশি নারী ভক্ত কূল এই তরুণ লেখকের হেয়ালিকেও ভালোবাসেন সমানভাবে। নাব্যের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়েও তারা চড়ম আগ্রহী। সাফল্যের শির্ষে পৌঁছেও কেন তিনি এখনো বিয়ে করছেন না সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে বারবার। এবার পাওয়া গেল উত্তর। জানা গেছে দীর্ঘদিন ধরেই প্রেম করছেন নাব্য। সেই প্রেমও হেয়ালিতে ভরপুর। গ্রামের অতি সাধারণ এক কিশোরীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছেন তিনি। নির্জনে সাহিত্যসাধনার উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের কোনো এক গ্রামে গিয়ে সেই মেয়েটির সাথে তার পরিচয় ঘটে।
শেষ কিছুদিন ধরে মিডিয়া, সাহিত্য কোথাও কোন পদচারণা নেই নাব্যের। শোনা যায় এখন তিনি সেখানেই আছেন। একসাথে থাকতে শুরু করেছেন তারা। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন শীগ্রই। কিছুদিন পর পর নাব্যের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার টার একটা যোগসুত্র খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই এই প্রেমের সাথে।
_______________
–“রশু!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
রশু পত্রিকা থেকে মুখ সরিয়ে দায়সারা ভাবে আমার দিকে ফিরল। ফিরেই অবাক হয়ে বলল,
–” আরে! কি হয়েছে নবুদা?”
আমি থমথমে স্বরে বললাম,
–“শেষ পৃষ্ঠার হেডিং দেখো।”
রশু দ্রুত পত্রিকা উল্টিয়ে দেখল। লেখাটা পড়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমার ভেতরে তখন একশো বিদ্যুতের ক্রুদ্ধ গর্জন। চোখে ঝিকিমিকি তারা। আমি দ্রুত ড্রাইভার সাহেদের দিকে তাকালাম। ও তো শহরেই ছিল। এসেছেও বাড়ি থেকেই। সে কি কিছুই শোনে নি!
সাহেদ যতটা সম্ভব মাথা নিচু করে গাড়ি চালাচ্ছে। অপরাধবোধে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখ। যেন ব্যাপার টা সেই ঘটিয়েছে। গাড়িতে বসে থাকা তিনজন এখন পর্যন্ত কেউ কারো সাথে এ বিষয়ে একটা কথা না বললেও আমরা জানি তিনজনের মাথায় একই ব্যাপার ঘুরছে।
রশু অধৈর্য গলায় সাহেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–” সাহেদ, বাড়িতে সবাই কি জেনে গেছে ব্যাপার টা?”
সাহেদ মিনমিনে স্বরে উত্তর দিল
–” জি।”
–“চাচী আম্মা কি বলছেন সব শুনে?” রশু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল সাহেদ কে।
সাহেদ থেমে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” খালাম্মা সকাল থেকে খাওয়া – দাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন। প্রেসারের বড়ি গুলাও খাননাই। প্রেসার বেড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। ”
রশু এবার ভয়ানক ভাবে চেঁচিয়ে উঠলো।
–” তুমি এতক্ষণ কিছু জানাওনি কেন আমাদের? হ্যাঁ? এতকিছু ঘটে গেছে আর আমরা এখনো কিছুই জানি না! ইডিয়ট। ”
বা হাতে মাথায় এলোমেলো আঙুল চালাতে চালাতে আমি পকেট থেকে বন্ধ ফোনটা বের করলাম। রশুকেও দেখলাম পকেট থেকে ফোন বের করল। ফোন চালু করে ডাটা অন করতেই হুড়মুড় করে আসতে থাকা অসংখ্য মেসেজ, নোটিফিকেশনের জোয়ারে ফোন হ্যাং হওয়ার যোগাড়। তারপর প্রথম যেই কলটা এল সেটা নিতিনের। নিতিন ইমরোজ। আমার একমাত্র ছোট বোন। বয়স চৌদ্দ। আমার সাথে তার বয়সের ফারাক টাও চৌদ্দ বছরের।
কল পিক করে কানে রাখতেই একশো সাইকেলের হর্ণ একসাথে বাজতে শুরু করল যেন। নিতিন তার রিনরিনে স্বরে একনিশ্বাসে বলতে শুরু করল নানান এলোমেলো কথা। প্রশ্নের পর প্রশ্নের বান ছুড়তে লাগল আমার দিকে।
শেষ প্রশ্নটা ছুড়ল,
-“দাভাই, তোমরা কি সত্যিই একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলে?”
নিজের ছোট বোনের মুখে এই প্রশ্ন শুনে প্রথম যে ভাবনাটা আমার মাথায় এল তা হল, যে এই গুজ*ব রটিয়েছে ওকে খুঁজে বের করে জ্যা*ন্ত পু*তে ফেলা।
আমি শুধু নিশ্বাস ফেলে বললাম,” ফোন রাখ। আমি আসছি। ”
গেটের পাশে, উচু প্রাচীলে বড় বড় সাদা অক্ষরে “রাবেয়া মঞ্জিল” লেখাটা দেখেই আমার হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেল কয়েক গুন। কিভাবে আম্মার মুখোমুখি হব শুধু সেটাই ভাবছিলাম এতক্ষণ। নামটা দেখে দাদির কথা মনে পড়ল। আমার প্রাচীন মনা দাদি তার নাতির নামে পেপারে লেখা কু-কীর্তির কথা গুলো কিভাবে হজম করেছেন কে জানে।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে ভেবে রাখলাম বসার ঘর খালি পেলে সোজা নিজের রুমে ঢুকে যাব। কিন্তু বাড়িতে এক পা রাখতে না রাখতেই নিতিন এসে হাজির। দু’হাতে দুটো ফোন নিয়ে সে দৌড়ে এল আমার কাছে। কম্পিত স্বরে বলল,
-“দাভাই, তুমি এসব কি করেছ?
আম্মার প্রেসার বেড়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। দাদি সারাদিন জায়নামাযে বসে কেঁদেছে। কাল বাবা সিলেট গেছে। কাজে আটকে আছে। এসব কিছু শুনেও ফিরতে পারছে না। চাচী, ফুফু, মামা, নানুভাই… সবাই ফোন করছে। বলছে,
নাব্য আমাদের বংশের মান কেড়েছে। বিয়ের আগেই একটা ফকিরনি মেয়ের সাথে….. ” নিতিন এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
নিতিনের অবস্থা টা বুঝতে পারলাম। বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান সে। বড় আদরের, আহ্লাদি মেয়ে । বাবা, আমি কেউ এখানে নেই, মা অসুস্থ, দাদি ভেঙে পরেছে। বেচারি একা একা সামলাচ্ছে সব দিক। তার ওপর আত্মীয় দের ফোন। আমি এগিয়ে নিতিনের মাথায় হাত রাখলাম। সে তার শত চিন্তা জর্জরিত ক্লান্ত মাথাটা আমার বুকে হেলিয়ে দিল। ওর মাথাটা বুকে চেপে একটা চুমু খেয়ে বললাম।
-” কিচ্ছু হয়নি আমার ছোট্ট পাখি। ভাইয়া এসে গেছে। এইবার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।”
নিতিন নাক টেনে বলল,
–“আচ্ছা আগে আম্মার কাছে চল।”
এতক্ষণে আমার আর বুঝতে বাকি নেই কে হঠাৎ আমাকে সকলের চোখে কালার করার জন্য খবরটা ছড়িয়েছে। রাহিল সোবহান।
একটা দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে আম্মার ঘরের দিকে এগোলাম। দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আম্মা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন। রাগের আতিশয্যে বিছানা থেকে বালিশ তুলে আমার দিকে ছুড়ে মেরে বললেন,
–” নবু, তুই কি করেছিস? পত্রিকায় যা বেরিয়েছে ওসব কি সত্যি কথা? তুই কি সত্যিই সুন্দরবনে গিয়ে একটা জংলী মেয়ের সাথে রাত কাটাচ্ছিস? তুই নাকি ওকে বিয়েও…. ”
বাকি কথা শেষ করবার আগেই আমি বালিশ তুলে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আম্মার পাশে গিয়ে বসলাম। আলতো করে আম্মার মাথায় হাত রেখে শান্ত করবার জন্য বললাম,
–” আম্মা…. আমার আম্মা। তুমি শান্ত হও। কিচ্ছু হয়নি। ওসব গুজব। মিথ্যে কথা।”
আম্মা বাচ্চা মেয়ের মতো চোখের পানি মুছে বললেন,
–“সত্যি?”
দূর্বল স্বরে প্রতুত্তর করলাম।
–” সত্যি। শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া।”
–” কি?”
মনে প্রবল সাহস সঞ্চয় করে বললাম।
–“মেয়েটিকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। ”
আম্মা ঝটকা মেরে আমার হাতটা সরিয়ে দিলেন।
চলবে…..