একদিন নববর্ষা -৮,০৯

0
185

একদিন নববর্ষা -৮,০৯
অদ্রিজা আশয়ারী
০৮

আম্মা আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধত হয়ে রইলেন। শেষে বিমূঢ় ভাবে বললেন,
–“কি বললি তুই?”

আমি কি বলব, কিভাবে ব্যাপার টা বোঝাব আম্মাকে ভাবতে লাগলাম। নিজেকে ভয়ানক অসহায় মনে হচ্ছে। আম্মার চোখের দিকে চাইলাম। ক্রোধ ও বিস্ময় মিশ্রিত ব্যাথাতুর চাহনিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
নিশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বললাম,
–” আম্মা, ব্যাপার টা যেমন ভাবছ তেমন নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যাপার টা সম্পুর্ন সত্যি না আবার…. পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। গরানবনে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে সত্যি। ওর নাম বর্ষা। বর্ষা সেখানে যাওয়া পর্যটকদের রান্নার কাজ করে।
বর্ষা ভীষণ অন্যরকম মেয়ে আম্মা। তুমি দেখলে, তুমিও ওকে ভালোবেসে ফেলবে।
আম্মা, একটা অনুভূতি আছে না….কাউকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়। আরে! আমি তো একে চিনি। এর সাথে তো আমার জনম জনমের পরিচয়।
বর্ষাকে প্রথম দেখে আমার ঠিক এই অনুভুতি টাই হয়েছিল। ”

আমার কথা শুনে আম্মা এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন। মনে হল যেন পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে চাঁদে যাওয়ার বায়না ধরেছে।
–“আর এতেই তোর মনে হল এই মেয়েটিকে তোর চাই! ” আম্মা ঠান্ডা গলায় বললেন।

ঘরে থমথমে নিরবতা। আমি প্রতুত্তর না করে আম্মাকে সময় দিলাম। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,
–” তুই ওই জংলী মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবলি কি করে। তোর লজ্জা করল না৷ একবার ভেবেছিস তোর আর ওর অবস্থানের ফারাক কতটুকু? তুই বই লেখিস। দেশের লাখ মানুষ তোকে চেনে। বড় বড় শিল্পপতি তোর বাবার পেছনে ঘোরে তোকে নিজের মেয়ের জামাই করার জন্য। সদ্য ইউনিভার্সিটির প্রফেসারিতে ঢুকেছে, কি যেন নাম মেয়েটার….. রেনুকা। ওদের এত আগ্রহের পরও রেনুকাকে তোর বাবা রিজেক্ট করেছে শুধুমাত্র তোর জন্য। তুই এখন বিয়ে করবি না বলে।

ছোট থেকে তুই সবকিছুর ওপরে নিজের জেদ কে প্রাধান্য দিয়েছিস। কখনো আমাদের ইচ্ছা, সম্মানের কথা ভাবিস নি।
আমার ছেলে পাইলট হবে। দিনরাত এই স্বপ্ন দেখত তোর বাবা। অথচ তোর কাছে নিজের জেদ টাই সবসময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। গ্রাউন্ড কোর্সের পর রেজাল্ট দেখার সময়টা পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারলি না। জেদ জুড়ে দিলি। লেখক হবো লেখক হবো বলে। পরীক্ষায় উতরে গিয়েও আর সেদিকে পা মারালি না। তখন চুপিসারে কত কেঁদেছে তোর বাবা। যেখানে তোর আকাশে ওড়ার কথা ছিল। আজ সেখানে তুই বনে বাদাড়ে ঘুরে কাগজের খাতায় সাহিত্য লিখিস। এখন একটা বন্য, জংলী মেয়ের প্রেমে পরেছিস। তোর হেয়ালির জন্য আত্মীয় মহলের কাছে রীতিমতো কৌতুকে পরিনত হয়েছে আমাদের পুরো পরিবার। ”

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ম্লান স্বরে বললাম,
–” মাফ করে দাও আম্মা। তোমাকে আর বাবাকে আমার কারণে যে কষ্ট পেতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সাধ্যি নেই আমার।
তবে এটা আমার জেদের কথা না। কাউকে ভালোবাসার ব্যাপার টা জেদ থেকে আসে না। তুমি যেসব রিজন দেখিয়েছ। আমি মানছি তার একটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু ছুড়ে দেয়া তীর যেমন আর ফেরে না। তেমনি কাউকে ভালোবাসলে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে, এক লহমায় সেটার দ্য এন্ড হয়ে যেতে পারে না। ”
আম্মার এত কথার পর যে আমি এমন একটা প্রতুত্তর করতে পারি আম্মা বোধহয় সেটা ভাবেননি।
হয়তো ভেবেছিলেন কিছুটা হলেও মন ভিজেছে আমার। তিনি আঘাত জর্জরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো আম্মার দুচোখ ফেটে এখনি নায়াগ্রা জলপ্রপাত বইতে শুরু করবে। আমি আর সেখানে বসলাম না। উঠে নিজের ঘরের দিকে এগোতে শুরু করলাম। যেতে যেতে শুনলাম আম্মার শেষ কথাটা।
–” নাব্য, তুই এত নির্দয়! বাবা মায়ের ইচ্ছার কোনো মুল্য নেই তোর জীবনে। আমার গর্ভের কলঙ্ক হয়ে জন্মেছিলি তুই। ”

আম্মার বলা শেষ কথাটা আমাকে পোড়ায়নি সেদিন। বর্ষাকে ভালোবেসে আর সকল ভালোবাসার সম্পর্ক তখন ম্লান হয়ে গেছিল আমার কাছে। তাই মায়ের পর দাদি আর বাবার প্রত্যাখ্যানের ভয়টাও আমি উপেক্ষা করে যেতে পেরেছিলাম খুব সহজে।

দাদি মায়ের মতো অত চিৎকার চেচামেচি কিছুই করেন নি। দাদি ভীষণ অভিমানী। সবসময়ের মতো আমি দাদির ঘরে গিয়ে বিছানায় তার পায়ের কাছে বসলাম। আমার দিকে পিঠ করে দাদি জায়নামাযে বসে ছিলেন। আমাকে দেখেও মুখ ফেরালেন না। আমি দাদির কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
-” দাদি, কথা বলো। ” দাদি কথা বললেন না। নড়লেনও না।
-” দাদি, আম্মা আমাকে অনেক বকেছে। বাড়ির কেউ কথা বলছে না আমার সঙ্গে। তুমিও কথা বলবে না? ”
দাদি আমাকে আকাশসম ভালোবাসেন। এই কথা শুনে তিনি হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় আদর করে দিলেন। কিন্তু কথা বললেন না।
-” পত্রিকায় যা বেড়িয়েছে সেসব সত্যি নয় দাদি। আমি কি এমন ছেলে যে তোমাদের কিছু না জানিয়েই নিজের বিয়ে নিজে ঠিক করে ফেলব!”

দাদি এবার ফিরলেন তির্যক দৃষ্টি নিয়ে।
-” তুই নাকি হেইনে গিয়া এক ছেমরির লগে প্রেম শুরু করসস। এইডাও কি মিছা কথা? ”

-“ইশশ্ নিতিন বুড়ি তোমাকে এসব বলেছে। তাই না? আম্মার সাথে কথা বলার সময় বাইরে থেকে সব শুনেছে ও। ”

-” এহন ক এইডা হাছা কথা না মিছা কথা?”

আমাকে মাথা চুলকাতে দেখে দাদি ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-” কস না কেন?”

আমি হেসে ফেললাম। দাদি সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বললেন।
-” কওন লাগতো না৷ বুঝছি। ” বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আমার ভ্রু কুচকে গেল,
-” কি বুঝেছ তুমি? ”

দাদি আড়চোখে ফের চেয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-” চেহারার সুরত খানা দেখসস আয়নায়? ভাবসাব বেকুবের মতো হয়া গেসে!”

আমি তাড়াতাড়ি মুখে হাত রেখে বললাম,
-“বেকুবের মতো মানে?”

-” সর এইহান থাইকা। আমি নামায পড়মু। ”

-” আগে বলো দাদি, তুমিও কি আম্মার মতো নারাজ আমার প্রতি? বিশ্বাস করো। বর্ষাকে দেখলেই তোমরা বুঝতে পারবে। ও একদম তোমার মনের মতো হবে। প্রাচীনপন্থী। তোমার না শহুরে মেয়ে একদম পছন্দ না? তাহলে বর্ষাকে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?”

-” সমস্যা আমার কিছু না। তোর বাপ মায়ের।”

-” তারমানে তুমি রাজি?”

-” আমার কোনো মতামত নাই। তোর বাপ মা যা কইব হেইডাই আমার মতামত। ”
দাদি আর কথা বললেন না।

__________________

সুন্দরবন ছেড়ে আসার সাত দিন পেরিয়েছে। মনে হচ্ছে এক হাজার বছর বর্ষাকে দেখি না। আমার হাতে বর্ষার একটা ফটোগ্রাফ। নদীর ধারে, নীল শাড়ি পড়া, এক গুচ্ছ কদম হাতে বর্ষার সেই ছবিটা। বর্ষার মুখে নিকষিত হাসির রেখা। ভ্রুতে একটু কুঞ্চন। বর্ষার ব্যাপার টা আর গোপন নেই। সকলেই জেনেছে, এবং এটাকে আমার আরেকটা হেয়ালি ভেবে মেনে নিয়েছে।

দরজায় কড়া ঘাত পেয়ে পেছন ফিরে দেখি নিতিন উঁকিঝুঁকি মারছে।
ছবিটা বইয়ের ভাজে রেখে বললাম
-” আয়।”

নিতিন একছুটে চলে এল। দুই কাঁধে দুই বেণি দুলিয়ে, ঝিকিমিকি হেসে বলল,
-” কি লুকিয়েছ তাড়াতাড়ি বের করো। ”

আমি নিশ্বাস ফেলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ছবিটা বের করে তার হাতে দিলাম। নিতিন অনেকক্ষণ মনোযোগী ছাত্রীর মতো দেখল ফটোগ্রাফ টা। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম।
-” কেমন দেখতে বলতো? খুব কি বাজে….? ” মা, দাদি আর বাবা তো আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এবার নিতিনও যদি বিমুখ হয় তাহলে ব্যাপার টা সামলানো কঠিন হবে আমার জন্য।

-” আরে এতো পুরো নায়িকা! ভাসা ভাসা চোখ, সুচালো নাক, সরু ঠোঁট…। মুখের আদল টায় একটা নির্মলতার ছোঁয়া আছে। ছবিটা দেখে একের পর এক সাহিত্যিক উপমা আসছে মনে। অথচ আম্মা যে বলছিল জংলী মেয়ে! আমি ভেবেছিলাম সেটা বুঝি সত্যি। দাভাই তুমি কোথায় এর দেখা পেলে? ”

আমি হাসলাম।

-” ওখানে কবে যাচ্ছ আবার? ” নিতিন উত্তেজিত গলায় বলল।

-” যাচ্ছি, খুব শীগ্রই। ভাবছি ওখানে গিয়ে উপন্যাসের বাকি লেখাটা শেষ করবো। ”

-” তাহলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চল। প্লিজ প্লিজ দাভাই।” নিতিন লাফিয়ে উঠল।

-” অসম্ভব। আম্মা আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করতে দ্বিতীয় বার ভাববে না তাহলে। নিজে সেখানে গিয়ে ফেঁসেছি। এবার তোকেও ফাঁসানোর প্ল্যান করছি।”

কথা শুনে নিতিন মুখ গোমড়া করে ফেলল।

-” রাগ করিস না বুড়ি। এমনেই বাড়ির সবাই আমার ওপর যথেষ্ট রাগান্বিত। তোকে নিয়ে গেলে ওরা আরও রেগে যাবে।”

তিনদিন পর আমি আবার আকাশে উড়লাম। বর্ষার কাছে, আমার হৃদয়ের প্রশান্তি যেখানে, সেখানে পৌছাবো বলে। আসার সময় নিতিন ছাড়া বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমার থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিজেকে আমার পরোয়া হীন মনে হচ্ছে। আমি এখন কেবলমাত্র বর্ষা, শুধু বর্ষারই অভিমানের পরোয়া করি। বর্ষার জন্য আর সব ভালোবাসার সম্পর্ক আমি ছেড়ে দিতে পারব অনায়েসে। বর্ষা কি কখনো বুঝবে? বুঝবে আমি তাকে কতটা ভালোবাসি? পরিস্থিতি যদি কখনো প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। সে কি পারবে সব ছেড়ে শুধুমাত্র আমার হাত ধরতে?
হয়তো পারবে বা হয়তো পারবে না। তবে ভালোবাসলে সবকিছু কে তুচ্ছ ভাবার এক অমোঘ শক্তি আসে। নবীন ভালোবাসার জন্য পুরাতন ভালোবাসার সম্পর্ক গুলোকে ঝেড়ে ফেলা যায় খুব সহজে। বর্ষার জন্য আমি সে পথে পা বাড়াতে রাজি আছি নির্দ্বিধায়।
বর্ষা পারুক কিংবা না পারুক। আমি চিরকাল বর্ষাকেই ভালোবেসে যাব….।

চলবে….

একদিন নববর্ষা – ৯
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

কুঠিবাড়ির দেখাশোনা করে যে লোকটি। তার নাম ফজলু মিয়া। সে মফঃস্বলের বাজার থেকেই আমার সঙ্গে সঙ্গে এল। দরজার তালা খুলে দিয়ে বলল,
-” সাব, আপনের রান্ধনের ব্যাবস্থা করতাছি। তয় আগে বাজার করতে হইব। আর বসির শেখের বাড়িতে গিয়া তার বৌ-ঝি রে একটা খবর দিতে হইব। ”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ওকে দিলাম।
-” ফজলু মিয়া, আমি এখানে যতদিন থাকব। তুমি প্রতিদিন আমার বাজার করে দিও। আমার সাথের ছেলেটা এবার আসতে পারে নি। তুমি রোজ বাজারটা করে দিলে ভীষণ উপকার হয়। আর হ্যাঁ, যে টাকা বাঁচবে ওটা তুমি রেখে দিও। ”

ফজলু মিয়া টাকা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল
-” আপনে ভাইব্বেন না সাব, আমি পত্তেদিন আপনের বাজার কইরা দিমু৷ আচ্ছা এহন আসি। বসির শেখের বাড়িতে খবর দিয়া বাজারে যামু।”

ফজলু মিয়া চলে গেল। আমি জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগলাম। ঘরজুড়ে একটা গুমোট ভেপসা গন্ধ। আমি যাওয়ার পর আর কেউ এখানে এসেছিল বলে মনে হয় না। জানালার খড়খড়ি টেনে সেখানে দাঁড়ালাম। বহুদিন পর আবার কানে আসতে লাগলো ঝিঁঝি পোকার মসৃণ ডাক, অচেনা পাখিদের তীক্ষ্ণ কলরব। সেইসাথে বুনো গন্ধ আর ভেজা হাওয়া।

কাঠের চৌকাঠে খট্ শব্দ শুনে সেদিকে ফিরতেই দেখি বর্ষন ছুটে আসছে৷ এসেই সে আমার একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি হাটু ভাজ করে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
-” ভালো আছেন বর্ষন সাহেব? ”

বর্ষন দ্রুত মাথা নেড়ে হাসলো। অধৈর্য হয়ে বলল,
-” আপনি এতদিন আসেন নাই কেন? আমি আর বুবু আপনের কথা কত মনে করছি…। রোজ রোজ বড় সড়কের ধারে গিয়া আমি অপেক্ষা করতাম আপনের জন্য। বুবুও মাঝে মাঝে যাইত আমার লগে। ”

-” ইশশ্ ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। কাজে আটকে গেছিলাম তো, সেজন্য আসতে এত দেরি হয়ে গেল। তোমার জন্য একটা গিফট আছে। দাঁড়াও দিচ্ছি। ”

লাগেজ খুলে চকলেট বারগুলো বের করে বর্ষনকে দিতেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
-“সবগুলা আমার?”

-” হুম, তোমার দাঁত গুলো ভীষণ সুন্দর তো। আমার ভারী হিংসা হয়। তাই দিলাম। খেয়ে দ্রুত দাঁতে পোকা করে ফেল। তাহলে আর হিংসেও হবে না আমার। ”

বর্ষন সবে একটা চকলেট খুলতে শুরু করেছিল। আমার কথা শুনে কাজ থামিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল।
আমি হেসে ওর নাক টেনে দিয়ে বললাম,
-” মজা করছিলাম। আচ্ছা, বর্ষন সাহেব। আজকের রান্নাটা কি তুমিই করবে? তোমার বুবু আসছে না যে?”

-” বুবু আইতাসে, আমি দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইছি তো, তাই আগে আইসা পরছি। ” বলে সে চকলেট খাওয়ায় মন দিল। মুখের চকলেট গুলো না গিলে হঠাৎই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-“আপনে বুবুর জন্য কিছু আনেন নাই? বুবুও তো আপনারে আমার মতো খুব পছন্দ করে। ”
বলেই মুখ গোমড়া করে ফেলল।

–“বুবুর জন্য কিছু আনলে আমার মতো সেও খুব খুশি হইত। কিন্তু….এহন শুনলে বুবু খুব কষ্ট পাইব।”

-” তাহলে তো বিরাট ভুল হয়ে গেল দেখছি! এখন কি করা যায় বলো তো?”

বর্ষন একটা চকলেট বার দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে ধরল।
-“আপনে এইটা বুবুরে দিয়েন। কইবেন ওর জন্যে আনছেন। তাইলেই হইব। ”

-“এটা তো তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। এখন কিভাবে ফেরত নিই! এরচেয়ে বরং লাগেজে খুজে দেখি দেবার মতো আর কিছু পাওয়া যায় কিনা।”

চকলেট বার টা আবার নিজের অধিকারে পেয়ে বর্ষন আর দ্বিমত করল না।

আমার জামাকাপড় আগেই বের করেছিলাম। লাগেজ খুলতেই তাই বর্ষার জন্য আনা কারুকাজ খচিত কাঠের বাক্সটা প্রথমে নজরে পড়ল। ভ্রু কুচকে বললাম,
-“এর ভেতর কি আছে চলো তো দেখি।”
বর্ষন ঝুঁকে এল। চিন্তাগ্রস্থ কৌতুহলী চোখে তাকাল বাক্সটার দিকে।

ভেতরের জিনিস সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এরকম একটা মুখভঙ্গি করে বাক্সটা খুললাম। খুলতেই প্রথমে নজরে পড়ল একটা সোনালি পাড়ের লাল শাড়ি, তার ওপর একটা চিরকুট, দুটো সোনার মিহি চুড়ি, অন্যপাশে বিভিন্ন রঙের পনেরো ডজন কাঁচের রেশমি চুড়ি।

-” এগুলো ছাড়া আর কোনো কিছু তো দেখছি না আপাতত। তোমার বুবু এসব দিলে রাগ করবে না তো?”

আমার লাগেজে বিনাকারণে কেন অতগুলো মেয়েলি জিনিস বোঝাই করা বর্ষনের ছোট্ট মস্তিষ্কে সেই প্রশ্ন এলো না। সে বরং চাকচিক্যে ঘেরা জিনিস গুলো দেখেই খুশি। বোনের উপহার দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। বর্ষন উত্তেজিত গলায় বলল,
-” শাড়ি, চুড়ি তো বুবুর খুব পছন্দ। বুবু এগুলা দেখলে কিযে খুশি হইব..।”

তখনি বর্ষা এল। আমি দ্রুত বাক্স বন্ধ করে একপাশে রেখে দিলাম। খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বর্ষা একটুখানি হাসলো। বর্ষা খুবই অচঞ্চল মেয়ে। কিংবা হয়তো বেশি দৃঢ়। সে এক পা ও এগিয়ে এলো না আমার দিকে। আমিই গেলাম।
-“কেমন আছো?” আমার গলার স্বরে অস্থিরতা ঝরে ঝরে পড়ছে।
-” ভালো। আপনি?”
-” এতক্ষণ কেমন ছিলাম বলতে পারবো না। তবে এখন খুব ভালো। ”
পেছন ফিরে একবার বর্ষনকে দেখে নিয়ে বললাম,
-” আমার প্রতি তোমার চেয়ে বোধহয় বর্ষনের আকর্ষণবোধই তীব্র। তুমি এসে পৌঁছানোর অন্তত কুড়ি মিনিট আগে বর্ষন এসে পৌঁছেছে।”

বর্ষা ফের হাসলো। চোখে কৌতুক খেলিয়ে বলল,
-“আমার আরও আগে আসার কথা ছিল নাকি? আইসা কি করতাম? বর্ষনের চকলেটের অংশীদার হইতাম? ”

-“আগে কিংবা পরে যখনই এসো। বর্ষনের চকলেটে তোমার কোনো অংশীদারত্ব নেই।”

-“তাইলে আর কি! আমি এহন যাই। আমার কাজ তো শুধু রান্ধন। ফজলু ভাই আসলে তখন ডাক আবার পাঠায়েন।” বলে সত্যি সত্যি ফিরতি পথ ধরল বর্ষা।

-” আরে! সত্যি চলে যাচ্ছ নাকি? কে বলল তোমার কাজ শুধু রান্না? এইযে আমাকে দেখছো। এই মূর্তিমান পুরো আমিটাই তো তোমার দায়িত্ব! ”

দরজার আগল ছেড়ে দাঁড়িয়ে বর্ষা বাঁকা চোখে তাকিয়ে মুখে ভেঙচি কাটল। তারপর বাড়ির সামনের সরু রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই সোজা উঠোন পেরিয়ে চলে গেল হেশেলের দ্বোর খুলতে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তায় তাকিয়ে দেখলাম ফজলু মিয়া গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাজার নিয়ে ফিরছে।

***

বিকেলের রোদে তেজ কমে এসেছে। বাড়ির সামনের প্রহরী গাছগুলোর নিচে মাচায় বসে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছি। বর্ষার আগমনের কোনো চিহ্ন নেই। অপেক্ষা টা অসীম মনে হচ্ছে। পেছনে বর্ষার আগমন পথের পানে আর চেয়ে না থেকে সামনে দৃষ্টি ভিড়ালাম। গাছপালার জঙ্গল ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ খোলা ভূমি। বেশিরভাগ টাই চলাচলের অনুপযুক্ত। জোয়ারের লবণাক্ত পানি নিরর্থ করে দিয়েছে বিশাল জমিটাকে। সেই ভূখণ্ডের পেছনে পাহাড়ের মতো আঁকাবাঁকা গাছের সারির ওপর সীমা শূন্য নীল আকাশ। পাহাড় প্রতিম গাছের সারি গুলোর একেবারে গা ঘেঁষে ভেসে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ। মেঘেরা দ্রুত উড়ে যাচ্ছে পুর্ব থেকে পশ্চিমে। সন্ধ্যের আগে নীড়ে ফেরার তাড়া যেন ওদেরও খুব। মনযোগী ছাত্রের মতো আকাশের গায়ে মেঘের এই লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে একবার আমার বা পাশে রাখা কাঠের বাক্সটার দিকে তাকালাম। তখুনি মাচাটা মৃদু দুলে ওঠায় হুট করে ডানে তাকাতেই দেখি বর্ষা উঠে বসেছে সেখানে। সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
-“এত ধ্যান ধইরে কি দেখতেছিলেন আকাশে?”

-” মেঘেদের খেলা।”

-” হু।” বলে বর্ষা তির্যক দৃষ্টিতে একবার বাক্সটার দিকে তাকাল।
-” কি এটা?”

-“খুলে দেখো। ” বলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম ওটা।

বর্ষা একটু দ্বিধা নিয়ে খুলল বাক্সটা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কাঁচের চুড়ি গুলোর ওপর হাত বুলিয়ে বলল,
-” এত্তো চুড়ি! ” তারপর শাড়িটা ধরতে গিয়ে সোনালি চুড়ি দুটো খেয়াল করল। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ শান্ত মুখে আমার দিকে ফিরে চাপা স্বরে বলল,
-“সোনার চুড়ি?”

উত্তরে আমি কেবল ছেলেমানুষী হাসলাম। বর্ষার মুখটা হঠাৎ গাম্ভীর্যে ছেয়ে গেল।
-” এইসব কেন আনছেন আপনি? কত টাকা নষ্ট করছেন! আমার এইসব লাগব না।”

আমি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললাম,
-“আরে, এসব তো আমি এমনেই তোমাকে দিয়েছি। আমার ভালোলাগে বলেই। তোমাকে চাইতে হবে নাকি! আমার ইচ্ছে হলে আমি দিতে পারি না? ”

-” তাই বইলা…. ” বর্ষা কোলের ওপর বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।

-” প্লিজ এটা নিয়ে আর কোনো কথা না। এখন হাত বাড়াও।”

বর্ষা ম্লানমুখে হাত বাড়িয়ে দিল। সোনার চুড়ি দুটো বর্ষার দু’হাতে পড়িয়ে দিয়ে বললাম।
-“কখনো খুলবে না। মনে থাকে যেন। নায়হ আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাবো। ”

শেষ কথাটা শুনে বর্ষা হেসে ফেলল। আমি ভ্রু কুচকালাম। মনে হল কথাটা আরেকটু দৃঢ় স্বরে বলা উচিত ছিল। রাগত্ব স্বরে বললাম,
-” হাসছো কেন?”
বর্ষা আমার রাগের একদমই পরোয়া না করে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“রেগে গিয়ে কি করবেন বলেন তো শুনি ?”

-“মুখ বেঁধে ঢাকায় নিয়ে চলে যাব। তারপর ভালো মালদার বিদেশি পার্টির কাছে পাচার করে দেব। এরপর শুধু টাকা আর টাকা….”

কথা শুনে বর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সন্ধ্যের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আদ্র স্বরে বলল,
-” এহন আসি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-” ভালোবাসি।”
এক চিতলে হেসে বর্ষা ত্রস্ত পায়ে হেটে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি সম্মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম দূর থেকে ভেসে আসা আযানের সুর।
চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here