একবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৫

0
1028

#একবারও_তুমি_বুঝলেনা,পর্ব_৫
#Alisha_Anjum

অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশ নিগূঢ় নিরবতায় আচ্ছন্ন। তিশুর গলায় অধরের হাত। অধর লাল লাল ভেজা চোখে গলা চেপে ধরেছে তিশুর। তিশু হাসছে।হাসতে হাসতে তার কাশি উঠে গেছে। আনন্দ বুকে চেপে সে অধরের হাতের উপর হাত দিয়ে গলা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অধর রাগ, ভালোবাসার পারস্পরিকতায় বলে উঠছে

— আর যাবি আমাকে ছাড়া? আর কখনো ভুল বুঝবি আমায়? তোকে ছাড়া আমার ছটফট লাগে তুই বুঝিস না?

অভীমানে অধরের চোখ দিয়ে জল পরছে। তিশু এখনো হাসছে অধরের পাগলামিতে।

— বাব্বা সে হাসে। দাদিম্মা হাসছে।

চার বছরের নিলীমার অস্থির বুলি। নিশান ফিরে চাইলো তিশুর দিকে। বন্ধ চোখে মুচকি মুচকি হাসছে তিশু। নিলীমার শরীীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। নিশান বুকে উপর নিয়ে জাপটে ধরে আছে। নিশানের মা তিশুর মাথায় পানি ঢালছিলেন। তিশুর রেসপন্স দেখে তিনি থেমে গেলেন। হন্তদন্ত হয়ে উঠে পরলেন। নিশানের উদ্দেশ্যে বললেন

— শুকরিয়া। মেয়েটা রেসপন্স করছে। ধীরে ধীরে ডাকবো?

— হ্যা ডাকো। পুরো একদিন অজ্ঞান হয়ে থাকলো।

— নিলীমার যে কিছু হয়নি এটাই যথেষ্ট।

নিশান তাকালো মেয়ের মুখের দিকে। নীলিমা তখন মুখে আঙুল পুরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। নিশান মেয়ের মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে নিতে নিতে বলল

— কে বলেছে কিছু হয়নি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ যে মায়ের স্বভাব পেয়েছে। সে অসুস্থ থেকে চুপ থাকলে পন্ডিতি করবে কে?

ছেলের কথায় নিলুফা রহমান হাসলেন। চোখ ফিরে তিশুর দিকে তাকদতে না তাকাতেই এক চিৎকার। তিশু অধর বলে চিৎকার করে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। সে এক্ষুনি দেখেছে অধর ভালোবেসে তার কপালে চুমু দিতেই অধরের মা আর নিধি তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছন দিকে। তিশু অধর অধর বলে চিৎকার করছে। অধর যাবে না তিশুকে ছেড়ে। সেও মা আর নিধির সাথে জোরজবর্দস্তি করছে।

তিশু ঘেমে গেছে। সে আশপাশ নজর করে দেখলো অধর কোথায়। তৃষ্ণার্ত চোখ জোরা ভীষণ খুঁজলো প্রিয়কে। কিন্তু দেখা মিলল। বরং দেখা মিলল অপরিচিত মুখের। তিশু অস্থির অবুঝ মন মুহূর্তেই থমকে গেল। ধুপ করে নেমে এলো চোখে প্রগাঢ় উৎসুকতা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো সে ঘরের প্রত্যেকটা সদস্যকে। নিলয়র উপর চোখ পরতেই খট করে যেন তার মস্তিষ্ক খুলে গেল। মনে পারে গেল গত রাতের কথা। হ্যা সে অধরের দিকে ছুটছিল। তারপর একটা বিজলির ডাক। অধর….। অধরের কথা মনে উদয় হতেই তিশু লাফিয়ে উঠলো। ভেজা চুল লেপ্টে গেল পিঠে। দূর্বল শরীর টলছে। কিন্তু এর কিছুই যেন প্রভাব ফেলতে পারলো না তিশুর মনে। সে বিছানা থেকে উঠে প্রথমেই গেল নিশানের কাছে। অস্থির কন্ঠে বলল

— আমার অধর কোথায়? আপনি আমাকে এখানে এনেছেন তাই না? আচ্ছা আপনি বলতে পারবেন আমার অধরের কি অবস্থা। ও কেমন আছে? আচ্ছা আমি কি ঢাকা থেকে অনেক দূরে আছি? আমায় একটু নিয়ে যাবেন ঢাকায়?

তিশুর একেরপর এক বিরতিহীন প্রশ্নে অধর অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আশ্বাস দিয়ে বলল সে

— আপনি বসুন। আমি সব বলছি। আপনি অসুস্থ। আপনি বসুন প্লিজ।

তিশুর চোখে রাজ্যের অস্থিরতা। তার মনে শান্তি নেই। তার অধর কেমন আছে? ঠিক আছে তো? নিশানের মা তোয়ালে নিয়ে আসলেন। তিশুর লম্বা চুল মুছে দিতে মনোযোগ দিলেন। তিশু হা হয়ে মায়াবী চোখে তাকিয়ে ব্যার্থ চেষ্টা করলো নিশানের মাকে দেখার। নিশান বলল

— আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন পারে কথা হবে।

নিশান এ কথা বলতেই তিশু উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো

— না না। আপনি এখুনি বলুন। আপনি এখুনি প্লিজ ঢাকায় রেখে আসুন।

— বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। আজ আপনি যেতে পারবেন না। আর এমনিতেও এটা চট্টগ্রাম। ঢাকা যেতে সময় লাগবে।

তিশু অসহায় ভবে চোখ নামিয়ে নিল নিশান থেকে। কখন যাবে সে অধরের কাছে?

.
রাতের অন্ধকারের হাত ছানি পরেছে। দূর্বল শরীর নিয়ে বেলকনিতে বসে আছে অধর। পাশেই দাড়িয়ে আছে তার আম্মা। প্রায় দু ঘন্টা হলো অধরকে বলছে একটু কিছু মুখে তুলতে। কিন্তু নাহ! অধরের মা যতোবার আসছে অধর ফিরিয়ে দিচ্ছে মাকে। তার একটাই কথা

— আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।

অধরের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সামান্যর জন্য ছেলের প্রাণ হানি ঘটেনি। ভাবতেই তার বুক কেঁপে উঠে। এ যেন আমার ভাগ্যের জোরে অধরের ফেরা। অধরের মা ছেলের মাথায় হাত রাখলোন। জ্বরে মাত্রাতিরিক্ত তাপ দেহে। তিনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। শুনবে না তো অধর! শুধু শুধু বলে শুণ্য লাভ। তিনি চলে গেলেন। অধর ফিরেও চাইলো না। তার দৃষ্টি ঐ দূর আকাশের নক্ষত্রের পানে। সে ভাবছে তার তিশু কোথায়? তাকে ছাড়া থাকতে পরছে? কষ্ট হয় না তিশুর? অধরের মন অভিমানে চিৎকার দিয়ে উঠলো। চোখ পুড়তে লাগলো। নাকের পাটা লাল হয়ে একাকার। যেন একটু টোকা দিলেই রক্ত ছিটকে পরবে।

— অধর? তোর জন্য বিরিয়ানি রান্না করেছি। একটু খেয়ে দেখ?

ভাবনার মাঝেই নিধির কন্ঠ। অধর ফিরে চাইলো না। শান্ত কন্ঠে বলল

— খাবো না। নিয়ে যা তুই। বিরক্ত করিস না।

নিধির কানে যেন কথাটা গেলোই না। সে আগলা দরদে যেন ভাসিয়ে দিতে চাইলো অধরকে। চেয়ার টেনে অধরের পাশাপাশি বসতে বসতে বলল

— এমন বললে তো হবে না! না খেলে তুই পুরোপুরি সুস্থ হবি কিভাবে? অনেক গুলো ওষুধ আছে তোর। খেতে হবে না ওগুলো?

অধর ফিরে চাইলো রাশভারি মুখে নিধির দিকে। নিধি প্লেটে হাত ডুবিয়ে বিরিয়ানির লোকমা বানালো। অতঃপর অধরের মুখের পানে ধরতেই অধর মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল

— চলে যা খাবো না। শুধু শুধু বিরক্ত করিসনা।

অধরের বাণীতে ঝড়ে পরলো বিরক্ত। তার অকারণেই নিধিকে ভালো লাগছে না। কোত্থেকে যেন ফালি ফালি রাগ এসে জেঁকে বসছে মনে। কিন্তু নিধি? অধরের পরিস্থিতি বুঝলো কিনা বলা বাহুল্য। তবে সে হাল ছাড়লো না। পিছু না হটে অত্যন্ত আবেগি কন্ঠে বলল

— আমি কষ্ট করে রান্না করেছি এটার কোন মুল্য দিবি না? অবশ্য আমি তোর কে? আমার রান্না তো খাবি না। শুধু খাবি বউয়ের রান্না।

কথাগুলো বলে নিধি মাথা নত করলো। ভাবখানা তার এমন যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী, অবহেলিত নারী সে। অধর স্থির নয়নে দেখলো নিধিকে। মিথ্যের গন্ডি না পেরুতে পেরে নিধির কথায় মোহিত হলো। মনে একরত্তি ইচ্ছেও নেই তার খাওয়ার। তবুও নিধির মন রক্ষার্থে বলল

— দে খাচ্ছি।

অধরের কথায় নিধি যেন মূল্যবান চাঁদটা জয় করার আনন্দ পেল। বশে আসছে তবে! তড়িঘড়ি করে এক লোকমা বিরিয়ানি নিধি অধরের মুখের দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু অধর কি এতো বড় নির্লজ্জ কাজ করবে? অজান্তেই অধর নিধির প্রফুল্ল চিত্তে শুকনো ভাব টেনে দিল

— আমি খেতে পারবো।

অধরের বিষন্ন, রসকষহীন কাঠখোট্টা কথা। নিধি দমে গেল। আর কিছু বলার সাহস তার জন্য জুটলো না।

মাঝারি একটা বাটিতে পানি নিয়ে অধরের মা দাড়িয়ে ছিলেন বেলকনির দরজার সন্নিকটে। হয়তো খেয়াল করেনি অধর নিধি কেউই। কিন্তু অধরের মা তাদের খেয়াল করেছেন সমস্ত সময়টাতে। তিনি নিধিকে দেখলেন পূর্ণ দৃষ্টিতে। অধর আর নিধি নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত। অধরের মা পিছু ফিরলেন। ছেলে আর ছেলের সংসার ঘাতকের অগোচরেই প্রস্থান করলেন তিনি। ফিরতি পথে তিশুর এই নির্মম শাশুড়ী মা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিশুর অনুপস্থিতিতে অধরের সংসার নতুন করে জোড়া পাকিয়ে দেবে নিধির সাথে।

.
সকাল সাতটা হবে। অধরের বাবা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। তার নিত্য দিনের কাজ ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে এসেই ড্রয়িং রুমে বসে বাসি খবরের কাগজ হাতড়ানো। এ লোক খুব মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়েন।

— বাবা কিছু কথা ছিল।

অধরের কন্ঠ। মোবারক হোসেন চোখ তুলে চাইলেন ছেলের দিকে। খবরের কাগজ পাশে রাখতে রাখতে বললেন

— হ্যা বলো।

— বাবা আমি পত্রিকায় নিউজ দিতে চাই।

অধরের বাবা অধরপর কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। রান্নঘর থেকে অধরের এহেন বাণী শুনে এগিয়ে এলেন অধরের মা। অধরের বাবা প্রশ্ন ছুড়লেন অধরের দিকে।

— কিসের নিউজ?

অধর শান্ত দৃষ্টিতে চাইলো বাবার চোখের দিকে। উত্তর করার জন্য উদ্ধত হতেই অধরের বিচক্ষণ মায়ের বাঁক

— তুমি কি তিশুর জন্য নিউজ ছাপাতে চাইছো?

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here