#একান্নবর্তী
#তৃতীয়
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী
খাবার ঘরের পাশেই ছিলো এক এক করে রাই দের নিজেদের ঘর ছাড়া ও মেজো,সেজো আর তারপর ছোট কাকাদের ঘর। তারপর যে ঘরটা ছিল সেটি আম্মার। আম্মা ‘র পাশে ছোট মতো ঘরটা ছিল বাড়ির কুল দেবতা মা মঙ্গল চন্ডী ‘র ঘর। বাড়ির ওপর তলায় মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই মা কে প্রতিষ্ঠা করবেন তা আম্মার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সব ইচ্ছে তো মানুষের পূরণ হয় না আম্মার ও হয়নি। মন্দির আর তৈরী হয় নি। বরং ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল পঁচিশ জন সদস্য নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারটা। কুল দেবতা মঙ্গল চন্ডী এখন মেজো কাকার বাগবাজারের নতুন বাড়িতে পূজিত হন।
একদিন ভোরে। আন্দাজ ছটা কী সাতটা । আম্মা সাধারণত ভোর বেলা ই উঠতো। সেদিন ও উঠেছিল। তারপর স্নান সেরে ঠাকুর কে তুলে তাকে পুরোহিত মশাই আসার আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতো। ঠাকুরের পরিচর্যার ক্ষেত্রে ও শিউলি ছাড়া আম্মা কারোকে বিশ্বাস করতে পারতো না। শিউলির ক্ষেত্রে তার সাত খুন মাপ। শিউলি যদি বাসি জামা কাপড়েও ঠাকুর ঘরে ঢুকেছে তাতেও আম্মার কোনো নিষেধ ছিলো না। আর এই ব্যাপারটিই রাই সহ আরো ভাইবোনেদের সাথে কাকিমনিদের ও রাগের কারণ ছিলো । মেজো কাকিমনি তো বলেই দিতো ” এক চোখো বুড়ি। কেবল শিউলি পেত্নি শিউলি পেত্নি করেই জীবন কাটিয়ে দিলো। আর যেন নাতি নাতনি নেই ওনার। ” মা অবশ্য এই ব্যাপারটাতে মনে মনে হয়তো খুশি অনুভব করতো কারণ তার কাছে যেন মনে হতো এই জগৎ সংসারে ওই বৃদ্ধা মানুষটিই তো আছেন যে তার কালো কুৎসিত মেয়েটা কে অন্তর থেকে ভালোবাসেন। আর কেউ ভালো না বাসুক শাশুড়ীর তার ছোট মেয়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা মনটাকে তার ভরিয়ে দিতো।
কিন্তু ঈশ্বর বোধ হয় অভাগী শিউলির কপালে তাকে ভালোবাসার জন্য কারো কে রাখতে চাননি। তাই সেদিন শীতের ভোরেই শিউলি প্রথম আবিষ্কার করলো তার সবচেয়ে প্রিয় ভালোবাসার মানুষ টা ঠাকুর ঘরেই মরে পড়ে আছে। চিৎকার করে শিউলি ডেকে উঠেছিল
“বাবা,মা,কাকু,কাকিমনি রা সবাই এসো আম্মা কোনো কথা বলছে না। ” রাই সহ বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ তখন উপস্থিত হয়েছিল ঠাকুর ঘরে। মাটিতে পড়ে আছে চক্রবর্তী বাড়ির প্রধানা বছর পঁচাত্তরের ভামিনী দেবী। ছোট কাকা ডাক্তার । তৎক্ষণাৎ পরীক্ষা করে বলেছিল ঘন্টা খানেক আগেই মারা গিয়েছে।
শীতের প্রকোপেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু মনে হয়।
সবাই বিশ্বাস করেছিল মানুষ টা নেই। কিন্তু শিউলি করেনি। আম্মার শরীর ‘টা তে বার বার ঠ্যালা মেরে বলে গেছে একটাই কথা” ও আম্মা ওঠো আজ যে বলেছিলে নলেন গুড়ের মিষ্টি ‘র পয়সা দেবে। তুমি আর আমি খাবো। ওঠো না আম্মা ওঠো না দাও পয়সা দাও। ” নিরুত্তর আম্মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো এক সময় উঠে গিয়েছিল শিউলি। যখন সবাই আম্মা কে নিয়ে চলে গিয়েছিল ও একবারের জন্যও ঠাকুর ঘর থেকে বের হয়নি কেন যেন ওর মনে হয়েছিল ওই ঠাকুর ঘরেই আম্মা আছে। এরপর দীর্ঘ এক বছর কেটে গিয়েছিল কারো সাথেই শিউলি সে ভাবে কথা বলতো না। মা কে ও আর শিউলির দুষ্টুমির শাস্তি হিসেবে বকাঝকা করতে হতো না। সে শিউলি যেন সম্পূর্ণ আলাদা।
“আচ্ছা রাই এই ঠাকুর ঘরেই তোমার আম্মা মারা গিয়েছিল তাই না? তখন তোমাদের কতো বয়স হবে?” সৌরভের কথাগুলি কানে যেতেই পুনরায় সম্বিত ফিরে পেল রাই। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল ” হ্যা আম্মা ঠাকুর ঘরেই মারা যায়। আমি আর শিউলি তখন বছর ষোলো সতেরো ।
” তার মানে শিউলি তখন জীবিত “? সৌরভের প্রশ্নে বুকের ভেতরটা আচমকা টনটন করে উঠল রাইয়ের। বলে উঠল ” হ্যা বেঁচে ছিলো। আর তখন ও শিউলির জীবনে সঞ্জীব দা আসে নি। ”
” সঞ্জীবকে, কে এন্ট্রি দিয়ে ছিল এই বাড়িতে? যার জন্য শিউলির মতো একটা সাদাসিধে মেয়ের জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল?” সৌরভের কথাগুলি ‘র প্রত্যুত্তরে পুনরায় একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রাই এগিয়ে গেল তার আর শিউলির ঘরের দিকে। যেখানে কিছু সময় আগেই দেখেছিল টিনের বাক্সটা এক কোণে আজও অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। ওই বাক্সটা রাই খুব ভালো করে চেনে। ওটা শিউলির বাক্স । শিউলি বেঁচে থাকতে ওই বাক্সে কোনোদিন হাত দিতে দেয় নি। এমন কী ওর মৃত্যুর পর মা ও ওটা খুলে দেখতে কারো কে দেয় নি। কাকিমনি রা সকলেই বলেছিল ওটা গঙ্গায় ফেলে দিতে মা বুকের মধ্যে বাক্সটা চেপে ধরে বলে উঠেছিল ” না খবরদার কেউ এই বাক্স হাত দেবে না। এ আমার শিউলির বাক্স। আমি কারোকে এটা হাত দিতে দেবো না।” সেদিন রাই বুঝেছিল শিউলির ওপর রাগের যে প্রকাশ মায়ের সে দেখেছে বছরের পর বছর ধরে তাতে স্নেহ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। মা শিউলি কে খুব ভালো বাসতো।
#ক্রমশ