একান্নবর্তী #দ্বিতীয়

0
444

#একান্নবর্তী
#দ্বিতীয়
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী

” রাই দেখো দেখো ঘরের দক্ষিণ কোণই বোধ হয় হবে ওটা একটা টিনের বাক্স। জং ধরে গেলেও অক্ষত। মনে হয় চোর ওটা দেখতে পায় নি বা দেখতে পেলেও আমাদের জন্য স্মৃতি স্বরূপ ওটা রেখে গেছে ” সৌরভ বেশ কৌতুকের সুরেই কথাগুলি বলে উঠলো যা রাইয়ের মোটেও ভালো লাগলো না বরং সৌরভের দৃষ্টি কে অনুসরণ করতেই ওর ও চোখ আটকালো টিনের বাক্সটার দিকে। এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকালো সৌরভের হঠাৎ করে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা একটি হাত পা ভাঙা কাঠের পুতুল মাটি থেকে তুলে তার দিকে এগিয়ে দিলে। বলে ওঠে” এই দেখো রাই এই কাঠের পুতুলটা ও চোর নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। মাইরি বলছি তোমাদের এখানকার চোর গুলো খুব ভালো। তুমি আসবে বলেই হয়তো পুতুল টা ফেলে গেছে। রাই দিদি ছোট বয়সে খেলতো।” রাই এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো পুতুলটা সৌরভের হাত থেকে। সেটি বার কয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো।

” এই দিদি এই দিদি জানিস আম্মা আমাকে এই পুতুলটা দিয়েছে। আম্মাকে কে যেন পুরী থেকে এনে দিয়েছিল। ” তখন বয়স কতো হবে দশ বছর রাই বা শিউলি দুজনের’ ই।
আম্মা মানে ঠাকুমা যে শিউলি কে অনেক ভালো ভালো জিনিস দেয় তা কখনোই পছন্দের ছিলো না রাইয়ের। বলে উঠেছিল” আম্মা তোকে দিলো আমাকে দেবে না? আর যদি না ই দেয় তাহলে এই পুতুলটা তোর ও হবে না। আমি এখনি ওটা ভেঙে দেবো। ” শিউলির হাত থেকে কাঠের পুতুলটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল রাই। মুহূর্তে কাঠের পুতুলটার হাত পা ভেঙে গিয়েছিল। সজল দুটি চোখে তাকিয়ে থেকে ছিল ভাঙা কাঠের পুতুলটার দিকে শিউলি। একটা একটা করে লবণাক্ত ফোঁটা গন্ড বেয়ে নেমে এসেছিল ওর। সেই দিকে মুহূর্ত খানেক তাকিয়ে থেকে মুখটা বেঁকিয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গিয়েছিল রাই। অনুশোচনা! না একটি বারের জন্য ও হয়নি সেদিন রাইয়ের।

কিন্তু আজ এতো বছর বাদে সেই কাঠের পুতুলটা কতো অনাদরে পড়ে আছে। একদিন যেটি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় শিউলির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আজ সেটিই পরম যত্নে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাই অনুশোচনায় বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। আপনমনে বলে ওঠে ” ক্ষমা কর শিউলি। সত্যিই আমি বড্ড হিংসুটে ছিলাম। তোর প্রতি আম্মার গভীর ভালোবাসা দেখে আমার খুব হিংসা হতো। অথচ আমি বাড়ির সকলের চোখের মণি বাবা,মা,কাকা,কাকিমনি সকলের। শুধু একজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম বলে তোকে হিংসা করেছি। তুই সকলের ঘৃণার পাত্র হোস্ সেটাই চেয়ে গেছি। তোর কালো কদাকার চেহারাটা আমাকে যে বিরক্ত করতো সব সময় । মনে হতো ” কেন কেন তুই আমার বোন হয়ে জন্মালি? আমি তো একটি মাত্র সন্তান হতে পারতাম বাবা ,মায়ের। ক্ষমা কর্ বোন ক্ষমা কর্। তখনো যে বুঝিনি তুই একদিন তোর জায়গাটা আমাকেই দিয়ে চলে যাবি অনেক অনেক দূর যেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না কেউ ।”

” এই রাই শিগগির তোমাদের রান্না ঘরটাতে এসো। দেখে যাও পাশাপাশি দুটো উনুন কেমন স্বমহিমায় আজও বিরাজমান । এই যা আরশোলা আর মাকড়সার বাসা বেঁধেছে। ”
কাঠের পুতুলটা দ্রুত নিজের হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে চোখের কোণে ফুটে ওঠা জলকণা অতি সন্তর্পণে রুমালের কোণ দিয়ে মুছে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে রাই।

সত্যিই তো আজ ও অক্ষত ওই দুটি মাটির নিকানো উনুন । একটিতে নিরামিষ অপরটিতে আমিষ রান্না হতো সে সময় । রান্নার দিদি সুধা দিদি ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে দুটো উনুনে দুটো মাজা হাঁড়িতে চালে জলে বসিয়ে দিয়ে মা কে আর মেজো কাকিমনি কে হাঁক দিতো ” ও বৌদি রা ভাত তো বসিয়ে দিয়েছি। রান্না কী হবে বলো ? রামু তো বেপাত্তা । কখন থেকে বলছি দু বালতি জল তুলে দে ইদারা থেকে তা কে কার কথা শোনে। তোমরা বাপু এসো আমি তো আর বেধবা মানুষ হয়ে আমিষের দিকে যেতে পারি না। ”

সকাল থাকতেই মা,মেজো কাকিমনি ,সেজো কাকিমনি, পড়ে ছোট কাকার বিয়ে হলে ছোট কাকিমনি ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে তারপর রান্নার কাজে হাত দিতো। মেজো কাকিমনি আমিষ রান্না আর মা নিরামিষ । সেজো আর ছোট কাকিমনি কুটনো আর বাটনা বাটাতে। সুধা দিদি’র কাজ ছিল হাতে হাতে সব এগিয়ে দেওয়া । সকাল নটার মধ্যে সব রান্না যে কমপ্লিট করতে হবে। বাড়ির পুরুষেরা কেউ অফিস,স্কুল,কেউ কোর্টে, কেউ বা হাসপাতালে দৌড়াতো।
ছোট ছেলেমেয়ে গুলোর একেবারে নিচু ক্লাস বাদ দিয়ে সকলেই প্রায় উঁচু ক্লাস তখন তাই দশ টার সময় স্কুল।

খাবার ঘরে সার দিয়ে আসন পেতে দিতো সুধা দিদি। ছোট বড় মিলিয়ে কুড়ি জন বসতে পারে খাবার ঘরের আকৃতি ছিল তেমনি । সকলে বসে পড়লে মা,আর কাকিমনি রা পরিবেশন করে যেত কাঁসার থালা আর বাটিতে পরিপাটি করে নানা পদের রান্না সাজিয়ে। ছোট কাকু ডাক্তার মানুষ আর বেশ আধুনিক মনস্ক মা কে বলে উঠতো ” বড় বৌদি এই সব কাঁসার বাটি ,থালা বন্ধ করে এবার থেকে স্টিলের বাসন থালা বেরিয়েছে সেগুলো ব্যবহার করো। হালকা আছে। তোমাদের এই বয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা রান্নাঘর থেকে কষ্টের লাঘব হবে খানিকটা ।” আম্মা তখনি বলে উঠতো ” এটা চক্রবর্তী বাড়ি ছোট খোকা ওসব কী বললি ইসটিলের না কীসের ওসব বাসন চলবে না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তো নয়। ” ছোট কাকা তখনকার মতো চুপ করে যেতো । আম্মার মুখের ওপর কথাবলা ‘র সাহস একমাত্র শিউলি ছাড়া আর কারো ছিলো না।

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here