একান্নবর্তী #পঞ্চম

0
654

#একান্নবর্তী
#পঞ্চম
#শম্পাশম্পি চক্রবর্তী

” চলো এবার রাই ফিরতে হবে। এখান থেকে কলকাতা বহুদূরে । একা ড্রাইভ করে তোমাকে এনেছি । সন্ধ্যা নেমে আসছে । পুরনো বাড়ি সূর্য ঢলে পড়লে তখন এই বাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা নানা ধরণের সরীসৃপ বেরিয়ে আসতে পারে। ” সৌরভের কথায় আলতো করে মাথা নাড়ল রাই। বলে উঠল ” হ্যা চলে তো যেতেই হবে। একদিন যেমন এই বাড়ির সবটুকু মায়া কাটিয়ে বাবা মায়ের সাথে চলে গিয়েছিলাম ব্যারাকপুরে বাবার সঞ্চয়ের অতিকষ্টে করা দু’কামরা ওলা বাড়িটাতে সে ভাবেই আজ ও চলে যেতে হবে । সেদিন মা এই বাড়িতে থাকতে পারেনি। শিউলির স্মৃতি পাগলের ন্যায় তাড়া করে বেড়াত মা কে। মা তখন বদ্ধ উন্মাদ । যাকে দেখ তো তার কাছেই ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো ” এই শিউলি এলি না কী? আয় মা তোকে সাজিয়ে দি। তোর আমার বিয়ের লাল বেনারসি টা বেশি পছন্দের তো আমি ওটা তোকেই পরিয়ে দেবো। রাই কে বোলবি না। ও বড্ড হিংসুটে । তোর থেকে কেড়ে নেবে। ” মায়ের এমন অদ্ভুত আচরণ বাড়ির সকলকে বিরক্ত করতো সে সময় । যে মানুষটা তার বিয়ের পর থেকে এই পরিবারের মুখে অন্ন জুগিয়ে গেছে হাসি মুখে সে ই সকলের চোখে পাগলি হয়ে গেল একটা ঘটনার পর। কারো কাছে সে বড় বৌদি পাগল, কারো কাছে জ্যেঠিমনি পাগল, কারো কাছে বড় জা পাগল।

মেজো,সেজো কাকারা ছোট কাকা কে তো একদিন বৈঠকখানা ঘরে ডেকে বলেই বসলো ” বড় বৌদি র জন্য মেন্টাল হসপিটালের ডাক্তারের ব্যবস্থা কর। কেউ বাড়িতে আসা যাওয়া করতে পারে না। শুধু পাগলামো। আচ্ছা শিউলি কে কী আমরা মেরেছি? না কী আমরা ভালোবাসতাম না? ও তো সুইসাইড করলো। কার সাথে কী করে সঞ্জীবের মতো একটা ব্রিলিয়ান্ট ভালো ছেলের নামে দোষ চাপিয়ে দিয়ে । এটাও তো বড় বৌদি বা দাদার ভাবা দরকার ছিল সঞ্জীব শিউলিকে ভালোবাসবে? এ ও কী সম্ভব? রাই হলে কথা হতো। মিথ্যা দোষারোপ যত্তসব। যাইহোক যদি ডাক্তার বলে মেন্টাল হসপিটালে রাখতে তাহলে বড় বৌদি কে তা ই রাখতে হবে। ওর জন্য তো আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারটা ভেঙে যেতে পারেনা। একটা সময় আসবে বড় বৌদি হয়তো সবাই কে মারতে আসতেও পারে।”
ছোট কাকা ওদের কথোপকথনের সবটুকু শুনে অবশ্য প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিল ” বড় বৌদি কে একটু সময় দাও তোমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি ই ঠিক হয়ে যাবে। আকস্মিক এতো বড় আঘাত বহন করা তো কম কষ্টের নয় মেজ দা, সেজ দা তোমরাই বলো। আমার বিশ্বাস আমরা যদি সহযোগিতা করি বড় বৌদি ভালো হয়ে উঠবে। ” “ছাই হবে আরো অবনতি হবে । তার চেয়ে মেন্টাল হসপিটালে রেখে চিকিৎসা করানো অনেক ভালো। ” কথাগুলি সেজ কাকার ছিল। মেজ কাকা সায় দিয়ে ছিল মাথা নেড়ে ।

বাবা আড়াল থেকে ওদের এই কথোপকথন শুনেছিল। অসহায় মানুষটার বুক চিরে হয়তো সেই মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছিল দীর্ঘশ্বাস । আর সেই দিন ই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল স্ত্রী কে মেন্টাল হসপিটালে রেখে চিকিৎসা করানোর পরিবর্তে এই বাড়ি যে বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শিউলির স্মৃতি তা থেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। যেখানে শিউলি নামে কারো চিহ্ন টুকু থাকবে না তাতেই স্ত্রী সুস্থ হবে। তাই একদিন একান্নবর্তী পরিবারের সকলকে বৈঠকখানা ঘরে ডেকে বাবা বলে উঠেছিল ” আমি স্বার্থপর কারণ যে পরিবার আমার কাঁধে ভর রেখে আগামীর দিকে এগিয়ে চলার কথা তা সে চলতে পারবে না কারণ আমি তাকে বহন করতে অপারগ। আমার কাঁধে আজ আর সে বল নেই যে বল একটা পরিবার কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আসলে শিউলির শেষ যাত্রার সময় শিউলি আমার সব বল টুকু শরীর থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভার পিতার কাঁধে সন্তানের মৃত শরীরের ভার। আর সেই ভার বহন করতে গিয়েই আমি আজ আমার শরীরের সব বল হারিয়ে ফেলেছি। তাই এই একান্নবর্তী সংসারের ভার আমি আর নিতে পারবোনা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার স্ত্রী মানে তোমাদের বাড়ির বড় বৌদি আর রাই কে নিয়ে চলে যাবো । যদি পারো তোমরা একান্নবর্তী এই সংসার টা আমার অভাবে ভেঙে ফেলো না । আর যদি না পারো জোর নেই নিজেদের মতো সুখী থাকার মতো সুখ খুঁজে নিও তোমরা। ”
“জানো সৌরভ সেদিন এই কথাগুলি বলতে গিয়ে বাবার বুকের ভেতরটা কতো টা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তা বুঝেছিলাম। দাদু মারা যাওয়ার পর স্বল্প মাইনের চাকরিতেই এই একান্নবর্তী সংসার টা কে তিল তিল করে বাঁচিয়ে রেখেছিল বাবা একা। মা আসার পর বাবার সুযোগ্য সঙ্গিনী হয়ে পাশে থেকেছে সব সময় । এমন কী যখন মেজো কাকিমনি দুই ছেলের মা হয়ে গেছে তখন ও মা সন্তান জন্ম দিতে পারেনি বলে আম্মা ‘র থেকে নানা গঞ্জনা শুনেও এই সংসারটাকে হাসি মুখে একটি মাত্র সুতোয় বেঁধে রেখেছিল। অথচ সেই একান্নবর্তী সংসার তাকে পাগল বললো দিলো না কেউ সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে । সন্তান হারা এক মায়ের হৃদয়ের নিদারুণ কষ্ট কেউ সেই দিন বুঝলো না এটাই বড় দুঃখের।”

রাইয়ের কথাগুলির প্রত্যুত্তর সৌরভ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। প্রত্যুত্তর কী দেবে? মানুষের স্বার্থপরতাই যে এক সময়ের একান্নবর্তী পরিবার গুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

” তুমি বরং গাড়িতে গিয়ে বোসো আমি আসছি সৌরভ। আমার একটা কাজ আছে। আসলে দীর্ঘদিন ধরে যে কৌতূহল মনের কোণে জমা রেখে এসেছি এখন যদি সেই কৌতূহল নিবারণ না করতে পারি আর কোনো দিন তা করা সম্ভব হবে না। তুমি যাও । আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসছি।”

” আমি যাচ্ছি বটে কিন্তু বেশিক্ষণ এই পুরনো ভাঙা বাড়িতে থাকা তোমার উচিত হবে না রাই। সন্ধ্যা নেমে আসছে। যাইহোক তুমি তাড়াতাড়ি এসো। আমি ততক্ষণ গাড়িতে গিয়ে বসছি। ” রাই কে দ্রুত কথাগুলি বলে সৌরভ জীর্ণ, উইপোকার বাসা বাঁধা সদর দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে গেল।

সৌরভ চলে যেতেই রাই আর কোনো দিকে তাকালো না। যতই তাকাবে ততই পুরনো স্মৃতি গুলো তাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইবে। সে সোজা তার আর শিউলির ঘরটাতে এসে দাঁড়াল । এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে । মাকড়সা ‘র জাল আর পুরু ধুলোর আস্তারণে সমগ্র ঘরটা তখন কোনো ভৌতিক গল্পের প্রেক্ষাপটে আঁকা ঘর গুলির মতো লাগছে। ক্ষণিকের জন্য কড়ি কাঠের দিকে তাকালো রাই । মুহূর্তে বুকের ভেতরটা গুমরে উঠলো। এই কড়িকাঠের থেকেই সেদিন রাতে দেখা গিয়েছিল শিউলির ঝুলন্ত দেহ। থরথর করে কেঁপে উঠলো সর্ব শরীর রাইয়ের। আপনা থেকেই বেরিয়ে এসেছিল কথাগুলি ” শিউলি কেন এমন করলি বোন? দুটো চোখে অবিশ্রান্ত ধারা। রুমালের প্রান্ত দিয়ে তা মুছে আরো একটু এগিয়ে গেল রাই। ঘরের দক্ষিণ কোণে রাখা টিনের বাক্সটা যা আজ ও দেখে অক্ষত মনে হচ্ছে ওটাতেই যে সব উত্তর আছে আজ ও মনে হয়। মা কোনো দিন কারোকে ওই বাক্স হাত দিতে দেয় নি। কী এমন ছিল শিউলির ওই বাক্সে যা মা কারোকে খুলে দেখতে দেয় নি। ব্যারাকপুরের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে মা কে ওই বাক্স থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল বাবা নিজেই। কারণ বাবা জানতো শিউলির ওই বাক্স সাথে থাকলে মা শিউলি ‘র থেকে নিজেকে কোনোদিন বার করতে পারবে না।

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here