এক কাপ কফি,প্রথম অধ্যায়

0
1641

এক কাপ কফি,প্রথম অধ্যায়
মৌপর্ণা

আয়, আরেকটি বার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়…………..

গানের আওয়াজটাকে পিছু করতে-করতে আকাশ যে মধ্য কলকাতার জীর্ণ বাড়ির উঁচু-উঁচু সিঁড়ি বেয়ে কখন সবুজ দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে নিজেও ঠিকঠাক করে লক্ষ্য করেনি…..

মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ দরজার বাইরে, দরজার দুই পাল্লার মধ্যে দু’আঙুলের ফাঁক থাকলেও তা দিয়ে, ভেতরে কে গান গাইছে তাকে দেখা যাওয়া অসম্ভব!
সত্যি কতদিন পর শুনছে, খালি গলায় এই গান……

গানটা হঠাৎ থেমে গেলো, আচমকা দরজাটা কেউ যেন হুড়মুড় করে ভেতর থেকে টেনে খুলে দিলো –
কি হলো, বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে কি দেখছেন বলুন তো? বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাটা শুনিয়ে দিলো দরজা খুলে বেরিয়ে আসা তরুণী…….

আকাশ বাকরুদ্ধ হয়ে থমথমে মুখে, বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তরুণীর দিকে…….

কি ব্যাপার বলুন তো! আপনি বাইরে…..

না না, আপনি যেরকম ভাবছেন তেমনটা নয় ম্যাডাম, আসলে আপনাকে হঠাৎ দেখে……….

হঠাৎ দেখে কি?

আমার মায়ের কথা মনে হলো…….

বাহঃ…..কি ইউনিক স্টাইল! কিন্তু আমাকে তো আপনি এক্ষুণি দেখলেন, তার আগে থেকেই তো উঁকি দিচ্ছিলেন…..
আপনি আগে এটা বলুন তো আপনি NGO তে এলেন কি ভাবে? নতুন এমপ্লয়ী? আর দেখুন আপনার মতন এমপ্লয়ীকে যদি ওরা…….

না না, ম্যাডাম, আমি তো গানটাকে পিছু করতে করতে……আ…আমি একটা MNC তে কাজ করি, সফটওয়্যার এ, মানে ইঞ্জিনিয়ার……

আজ্ঞে? এখানে কোনো কম্পিউটার তো খারাপ নেই, বা কোনো সফটওয়্যার এর কিছু…………

না না, আমাদের কম্পানি এর সাথে আপনাদের NGO এর Tie-up আছে, তাই আমরা এই NGO-র, বাচ্চাদের জন্য কিছু কন্ট্রিবিউট করি, আর তার সাথে একটু আধটু কম্পিউটার শেখানো…

ওহ! হ্যাঁ শিউলিদি বলেছিলো, উবুন্তু আরো কিছু কম্পিউটার লাঙ্গুয়েজেস…..গলার আওয়াজ টা বেশ নামিয়ে নেয় তরুণী…..

হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন……

আসলে, আমি এখানে খুব নতুন…..আমি আগের রোববার জয়েন করেছি…..আমি দৃষ্টি….আপনি? বেশ গুছিয়ে, এবারে নরম গলায় কথা টা বললো দৃষ্টি….

আমি! আমি আকাশ …..আমিও এই মাসখানেক হলো, শনিবার করে আসছি এখানে, আমাদের রোটা থাকে….রোটা মানে আমাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এখানে পাঠানো হয়, ওই যে বললাম কম্পানির সাথে কিছু চুক্তিবদ্ধতা আছে…..

বুঝলাম…..কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ….

দৃষ্টির কথা শেষ না হতেই, অনির্বাণ হঠাৎ পেছন থেকে এসে বলে উঠলো –
কি রে, আকাশ……মাথার ঠিক আছে তোর? সাপোর্টিং স্টিক নিয়ে, এই শেওলা আর উঁচু – উঁচু সিঁড়ি বেয়ে কখন উঠে এলি?

সাপোর্টিং স্টিক – কথা টা শুনতেই, দৃষ্টি চেয়ে দেখলো আকাশের পায়ের দিকে…..সত্যি তো, বাঁ হাতের সাথে, একটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা সেই সাপোর্টিং স্টিক……..দুটো পা অক্ষত, তবে যেন মনে হলো….ছোট বড়ো…..মনে হলো বাঁ পা টা যেন একটু মোড়া……লিম্প-এর সমস্যা আছে খুব সম্ভবত………

এইরকম ভাবেই শুরু হয় আকাশ আর দৃষ্টির প্রথম আলাপ….

*****************

আজ শুক্রবার, আকাশের অফিসে আজ সবার মেজাজটা বেশ ফুরফুরে……

শুক্রবার, সবাই একটু আগেই বেরিয়ে যায় অফিস থেকে, সপ্তাহের শেষ দিন বলে কথা….
কেউ নাইট শো দেখতে যায়, তো কিছু জন bar এ…আবার কেউ কেউ বাড়িতেই ফেরে তাড়াতাড়ি…..বিশেষ করে যাদের বাড়ি শহরের বাইরে…..

আকাশ কোনো দলেই পড়েনা এদের মধ্যে, সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ স্মার্ট ফোনেই দেখে, আর তাছাড়া অফিসের কলিগদের সাথে সিনেমা তে গেলে, ওরা আকাশ কে বড় সিম্প্যাথি দেখায়, সবসময় আকাশের দিকে বেশি নজর দেয়…যেমন খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে….. আকাশ ওদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারেনা যে….
এদিকে ড্রিংক করার ও অভ্যাস নেই আকাশের….

আর বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফেরা! সেটাই বা কার জন্যে? আকাশের মা গত হন, যখন আকাশ সাত বছরের – ক্লাস টু তে তখন সে….
আর আকাশের বাবা শহরের সব চেয়ে বড়ো ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন – বুটিক, রেশম খাদির ব্যবসা, তাছাড়াও বিভিন্ন ছোট বড় শেয়ার তো আছেই…….তিনি ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত সারাটাদিন …………

অন্যদিনের মতন কিউবিকলগুলো আসতে আসতে ফাঁকা হচ্ছে, কিন্তু আজ আর আকাশের একা লাগছে না একদম! বরং সে অপেক্ষায় আছে শনিবারের……
কি যেন নাম বলেছিলো মেয়েটা – দৃষ্টি…..
‘প্রথম দেখায় প্রেম!’ – না এই কথা টা তে আকাশ কোনোদিন বিশ্বাস করেনি….আজও করেনা, তবুও
মনটা কেন যে ছটফট করছে কে জানে? সত্যি মেয়েটার পোশাক, সাজ গোজ একদম মায়ের মতন………! আজকাল এইরকম মেয়ে দেখা যায়? বড় মায়া ভরা চোখ মেয়েটার……!

“আকাশ আমরা বেরলাম বুঝলি……বলছিলাম কাল তুই যাচ্ছিস তো teach for the nation…..”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ…..কাল আমি যাচ্ছি…..তোরা কাল এলে আমায় একবার ফোন করে নিস..”

*****************

মাস দুয়েক হলো আকাশ প্রতি শনি ও রোববার আসে NGO তে………
এই কিছুদিনে আকাশ ও দৃষ্টির গভীর বন্ধুত্ব না হলেও, দুজনের মধ্যে একটা সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে…..আজকে দৃষ্টি আসেনি…….আকাশের মনটা তাই বেশ খারাপ……..
দৃষ্টির স্মার্ট ফোন নেই, একটা সাদা কালো ফোন, তাই ওদের চ্যাটেও কোনোদিনও কথা হয়নি…..কখনো আকাশ ফোন ও করেনি দৃষ্টিকে, কিন্তু সাহস করে গত সপ্তাহে ফোন নাম্বার চেয়েছিলো …..
আচ্ছা – দৃষ্টি কিছু মনে করে NGO ছেড়ে দিলনা তো! না না, তা কেন, দৃষ্টিও তো কতসময় আকাশের সাথে নিজে থেকে কথা বলেছে, অফিসের গল্প শুনেছে………! তবে কিছু বললো না, আজ এলোও না যে……

*****************

বিকেলে বাড়ি ফিরে আজ কিচ্ছু ভালো লাগছে না আকাশের……বারবার মনে হচ্ছে, একটাবার ফোন করলে মনটা একটু হালকা লাগতো…..ঘন্টাখানেক নিজের মনের সাথে লড়াই চললো মাথার……আর তারপর ফোনটা করেই ফেললো সে –

হ্যালো দৃষ্টি….আমি আকাশ..

বলুন আকাশ বাবু…..কিছু দরকারি কথা ছিল?

না সেরকম কিছু নয়, তুমি ঠিক আছো? আজ এলে না তাই….

ওহ! হ্যাঁ আজ শরীরটা একদম ঠিক ছিল না…..শিউলিদিকে জানিয়েছিলাম…….ভীষণ ঠান্ডা লেগেছে…..

ওহ..আচ্ছা আচ্ছা…..এখন ঠিক আছো?

হ্যাঁ, আগের চেয়ে অনেকটা ভালো….

কাল আসছো?

হ্যাঁ কাল আসছি…….

ফোনটা রেখে বেশ হালকা লাগছিলো আকাশের মনটা ……
মাঝে মাঝে আকাশের মনে হয় দৃষ্টিকে বলেই ফেলুক যে তার পছন্দ দৃষ্টিকে!
এদিকে অফিসেও সবাই একটু আধটু সন্দেহ করছে…..সারা সপ্তাহে হাড়ভাঙা খাটনির পর, রোটার বাইরে প্রতি সপ্তাহে শনি ও রোববার উত্তর থেকে মধ্য কলকাতার যাত্রাটা যে নিছক সমাজ সেবা নয়, এই কথাটা পরিষ্কার সবার কাছে……

আগের দিন তো অনির্বাণ বেশ চেপে ধরেছিলো আকাশকে…

কিরে নিজে মুখে বল তো, ওই মেয়েটাকে পছন্দ নয়?

ছাড় এসব! কি যে বলিস না……..

কেন? ছাড়বো কেন? আরে বছর পঁচিশের ছেলে…..আজ অবধি কাউকে propose করিসনি….এতকাল বাদে একজনকে মনে ধরেছে……বলেই দে না….

পাগল হয়েছিস?

কেন? পাগল হওয়ার কি হলো? আরে বাবা ওরকম সোজা ভাবে কিছু না বলতে পারলে – এক কাপ কফির জন্যে তো বলতেই পারিস নাকি?

এক কাপ কফি…? আচ্ছা এটা তো বলা যেতেই পারে……তাইনা??

*************************

“দৃষ্টি, একটা কথা ছিল তোমার সাথে!”

“হ্যাঁ বলুন ……..” হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো দৃষ্টি…

ঢোঁক চিপে গলাটা পরিষ্কার করে আকাশ বললো –
” বলছিলাম, আজ তোমার ক্লাস আর এখানকার সব কাজ হয়ে গেলে…..আমরা…কোথাও…এক কাপ কফি…….মানে…..শুধু এক কাপ কফি খেতে….মানে আমি একটা জায়গা চিনি….খুব ভালো কফি বানায়…..বা তুমি যেখানে বলবে……”

ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি তাকালো আকাশের দিকে….
ঠোঠের কোণে হাসিটা এখনো মিলিয়ে যায়নি পুরোপুরি……বেশ নরম গলায় সে বললো –
“মানেটা কি……. কি বলছেন বলুন তো? কফি খেতে যাবো আমরা কোথাও একটা…..”

“হ্যাঁ শুধু আমরা দুজনে….মানে……”

কথাটা আজ কিছুতেই গুছিয়ে বলতে না পেরে মনে মনে বেশ রাগ হচ্ছিলো আকাশের….এদিকে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে কপালের ভাঁজে…..হৃদস্পন্দন প্রায় দ্বিগুণ….পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালের ঘামটা মুছে, আবার কথাটা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলো –
“দৃষ্টি…..শুধু এক কাপ কফি, তুমি আর আমি, তুমি যেখানে বলবে……কোনো কম্পালশন নেই….মানে তুমি না বললেও….”

“এক মিনিট…..এক মিনিট…..এক কাপ কফি রিকোয়েস্ট….ব্যাস এই ব্যাপার তো? এটা বলতে আপনি এতো নার্ভাস কেন? ”

“কই না তো! না..না..নার্ভাস নই তো!”

“হ্যাঁ, বুঝতে পারছি….আপনি নার্ভাস নন….! ” বলেই এবার দৃষ্টি হাসতে শুরু করলো…..
ওকে, নীচে শিউলিদি ডেকেছে…..আরো কিছু কাজ পরে আছে, আমি ওগুলো সেরে আসছি….কিন্তু আপনি…ততক্ষণ থাকবেন?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, যতক্ষণ সময় লাগে….আমি আছি…! বাচ্চাগুলোর সাথে….আর একটু সময় থাকছি…..কো..কোনো অসুবিধে নেই….!”
কথাটা শেষ করে রুমালটা কপালে বুলিয়ে নিয়ে আরেকবার…..

“হুমম…ঠিক আছে….কিন্তু বিকেল সাড়ে তিনটেই কফি….. ”

“না না, আপনি যা বলবেন! যখন বলবেন…..কফি খেতে হবে, এইরকম কিছু কথা নেই….মানে, মানে নেই! মানে….”

“মানে আমি বুঝেছি…….আচ্ছা….আপনি ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করুন…..আমি আসছি, ওহ! আপনি লাঞ্চ করেছেন?”

“হ্যাঁ….আমি তো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় রোজ খেয়েই আসি…..”

“কিন্তু সে তো ব্রেকফাস্ট….! লাঞ্চ, কখন করেন?”

“লাঞ্চ? লাঞ্চ….যখন সময় হয়…বিকেলে…বা….কখনো দুপুরে ফল খেয়েনি…..”

“আচ্ছা, আজ তাহলে আমার সাথে…লাঞ্চ করবেন!”

“হ্যাঁ? কোথায়?”

“এখানেই…..নীচের রুমে…মানে স্টাফ রুমে….. অবশ্য আপনার যদি কোনো সমস্যা….না থাকে…তবেই..”

“না, না, সমস্যা কিসের…..”

*****************

দৃষ্টি সব কাজ শেষ করে, আকাশকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ ……
নিজের টিফিনটা অর্ধেক অর্ধেক করে, প্রথম অর্ধেক ভাগ রেখেছে কৌটোতে, দ্বিতীয় অর্ধেকটা টিফিনের ঢাকনায়……
ভাগ শেষে, কৌটোর ভাগটা এগিয়ে দিলো আকাশের দিকে…….

“একি, তুমি তো পুরোটাই, আমায় দিয়ে দিলে….”
মনটা অনেকটাই শান্ত হয়েছে আকাশের…………ভেবে দেখলো, এবারে গুছিয়ে কথা বলতে পারছে সে……

“একদম সমান ভাগ করলাম তো! নিন এবারে খেয়ে নিন…….”

আকাশের মনটা একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠলো…..আকাশের মা চলে যাওয়ার পর…..কেউ এতো ভালো করে খাবার বেড়ে দেয়নি আকাশ কে………….ভালো করেই বা কেন? কেউ কখনো খাবারটা বেড়ে দেয়নি বললেই চলে…….খিদে পেলে খাবার বেড়ে নিয়েছে নিজেই।
আকাশের বাবা….ব্যবসায় বাইরে ব্যস্ত থাকতো দুপুরে, রাতেও অনেক দেরিতে ফিরত………বাড়িতে দু তিন জন পরিচারক থাকলেও, তারা ঘরের বাকি কাজ, রান্না বান্না, বাগান, বা বাবাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সারাদিন …..

“কি ভাবছেন! আকাশ বাবু…..শুরু করুন…….”

*****************

আকাশ যখন বাড়ি ফিরলো তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা…….এতদিন আকাশ শুধু বয়ে পড়েছিলো – ‘butterfly in the stomach!’
কথাটা…..আজ অনুভব করছে……..

মনটা কেমন যেন অস্থির…..মহাত্মা গান্ধীর পাঁচ মাথার মোড়ে যখন দৃষ্টিকে বাসে তুলে দিলো…..বুকটা যেন কেমন খালি হয়ে এলো……কিন্তু আজকের একটা দিনে এতো কিছু ঘটলো!
…….সত্যি বলতে কি বাকিদের জীবনে হয়তো এটা তেমন কোনো ঘটনাই নয়…..কিন্তু আকাশের জীবনে এইটার গুরুত্ব অনেকটা……..কারণ মূলতঃ দুটো –
এক এই প্রথম কেউ তাকে বলেছিলো – চলুন আজ আমার সাথে লাঞ্চ করবেন………! অফিসে তো সবাই শুধু জিজ্ঞেস করে তাকে……আকাশ আমাদের সাথে লাঞ্চ করবি?

দুই, এতদিন যাদের সাথে হেঁটেছে কলেজের বন্ধু বা অফিস কলিগ ….তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে এগিয়ে যেত অনেকখানি…..আর তারপর…..এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো- পেছন ফিরে আকাশের দিকে চেয়ে….কারো বা মুখে বিরক্তির ভাব…….এই ল্যাংড়াকে আনার কি দরকার ছিল…….যদিও সবাই সেটা ভাবেনি…..কেউ কেউ আবার বেশি সিম্প্যাথেটিক……এই আস্তে চল ! আকাশদা পারবে না এতো তাড়াতাড়ি যেতে…..!

আকাশ, না হয় ওদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনা…….কিন্তু ওরা কি কখনও চেষ্টা করেছে…..মুখে কিছু না বলে… আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার……….

অথচ আজ, দৃষ্টি কলেজ স্ট্রিট থেকে, আকাশের সাথে হেঁটেছে এতোটা রাস্তা……….আজ তো আকাশের এক বারো মনে পড়েনি তার বিকলাঙ্গতার কথা…….আবার এমনও মনে হয়নি….দৃষ্টি ইচ্ছে করে আস্তে হাঁটছে….বরং কত গল্প, হাসি……হাঁটতে-হাঁটতে…..….

এক কাপ কফি খাওয়া হয়ে ওঠেনি আজ…..ভালই হয়েছে ওটা না হয় তোলা থাক অন্য দিনের জন্যে!
কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে চায়ের দোকানের চা টা আজ বেশ লেগেছে আকাশের……..এমনি চা খাওয়ার খুব একটা অভ্যেস নেই আকাশের! তবুও আজকের চাটা অমৃত ছিল!

*****************

আজ রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না….আকাশের…..
দৃষ্টির সাথে বসে রুটি আলুভাজাটা, যে কোনো পাঁচতারার রেঁস্তোরার চেয়ে অনেক ভালো ছিল! আজ কত কথাই না হয়েছে দৃষ্টির সাথে……এক সাথে হাঁটতে-হাঁটতে গল্প আর দৃষ্টির প্রাণ খোলা হাসিটা বারেবারে চোখের সামনে ভেসে উঠছে আকাশের…….এপাশ ওপাশ করতে করতে, মোবাইল স্ক্রিনটাতে টাচ করতেই, দেখলো ২:৩৮! ওহঃ বাবা! কাল তো সোমবার………………

সোমবার ভেবেই মন টা হঠাৎ কেমন যেন করে উঠলো! উউফ আবার পাঁচটা দিন….!

এর আগে আকাশ শুনেছে, রোববার রাতে নাকি সবার মন টা কেমন করে, কিন্তু তার কোনোদিন এমনটা তো মনে হয়নি আগে….বরং অফিস থাকলেই তো ভালো লাগতো তার….সময়টা কেটে যেত তাড়াতাড়ি…
ছুটির দিনে এক ঘেয়ে ফেসবুক….আর ওয়েব সিরিজ……কতক্ষণই বা দেখা যায়?

*****************

আকাশের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন প্রায় সাত টা….আটটার অ্যালার্ম এখনো বাজেনি,
…..রাতে ঘুম কম হলেও, বেশ ঝরঝরে লাগছিলো আকাশের…..
জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলো দুহাত দিয়ে….এক ফালি রোদ এসে পড়লো আকাশের বিছানায়…..
আজ পুরোনো দিনে ভোর বেলায় উঠে গিটার বাজিয়ে গান করার কথাটা মনে পড়ছিলো….ভীষণ!
আগে ভোরে উঠে, কত গান গাইতো সে….কলেজের ফেস্টে সেই শেষ গান গাওয়া…..তারপর গিটারটা হোস্টেল থেকে আনলেও ছুঁয়েও দেখেনি শেষ পাঁচ বছর…..

সুবিনয়দার, গাড়িতে করেই রোজ অফিস যায় আকাশ, শেয়ার্ড রাইড….
গাড়ি সময়ে এসে দাঁড়ালো দমদম সেভেন ট্যাংকের সিগনালে…..
গাড়ি তে প্রতিদিনের মতন, ড্রাইভার সিটের পাশে বসে চঞ্চল দা……
আকাশ প্রতিদিনের মতন উঠে পড়লো, ব্যাক সিটে……
প্রতিদিনের মতন গাড়ির ভেতর টা আজও কনকনে ঠান্ডা ও নিশ্চুপ…..আজকাল এইরকম কাঁচ লাগানো ঘরে বা গাড়িতে, বিশেষ করে এরকম চুপচাপ সবাই বসে রইলে, দম বন্ধ হয়ে আসে আকাশের…..
গতানুগতিক নিয়ম বিধি মেনেই, আকাশ ব্যাগ থেকে ইয়ার ফোন টা বের করে লাগিয়ে নিলো কানে, তারপর গাটা এলিয়ে দিয়ে, ব্যাক সিটে মাথা রেখে…..চোখ বন্ধ করে চালিয়ে দিলো এফ এম….
এফ এম চালাতেই বেজে উঠলো –
Raho Mein Tanha Hoon …… Sath Le Chal Yun ……….
Sang Tere Safar Poora Karu
………………
আকাশের বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠলো দৃষ্টির হাসি মুখটা….গানের লিরিক্সটা যেন কেমন আকাশের না বলা মনের কথাগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে……..আজ প্রতিটা গান শুনে মনে হলো…..যেন গানগুলো আকাশ আর দৃষ্টিকে নিয়েই লেখা……!
বন্ধ চোখের সামনে আকাশ দেখতে থাকলো, দৃষ্টি আর সে কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি রাস্তায়…..শুধু ঘুরে বেরোচ্ছে তাও নয়, কখনো সে
ছুটে চলেছে দৃষ্টির পেছনে….. কখনো জড়িয়ে ধরেছে দৃষ্টি কে ……আবার কখনো খুনসুটি চলছে দুজনের ভেতরে…..

*****************
এভাবেই কেটে গেলো আরো দুটো মাস, কোনো চুক্তি, রোটার কারণে নয়, প্রতি শনি ও রোববার আকাশ, দৃষ্টির কারণেই যেতে থাকলো এনজিও তে…….
এর মধ্যে আর আকাশ কফি খেতে যাওয়ার কথাটা বলেনি দৃষ্টিকে….. প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে নিয়মিত লাঞ্চ করেছে একসাথে, আর তারপর একসাথে হেঁটেছে কলেজ স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী পাঁচমাথার মোড় অবধি……..এটাই বা কম কি আকাশের কাছে?

ইদানিং আকাশ লক্ষ্য করেছে, রোববার বাস স্টপেজ এলেই, দৃষ্টির মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখায়, আর তারপর দৃষ্টির নিজের হাতে লাঞ্চ বানিয়ে আনা আকাশের জন্যে, দৃষ্টির মনে কি কিচ্ছু নেই? তবে এতো প্রায়োরিটি দেয় কেন? করুণা করে? নাকি শুধু বন্ধু!

এই দুমাসে এতো কথা হয়েছে, ওদের মধ্যে, এনজিওর কথা, স্কুল, কলেজের গল্প, বিশেষ করে আকাশের অফিসের গল্প, আকাশের বাবার কিসের ব্যবসা, কোন ব্যবসার কেমন রিস্ক, আকাশের হোস্টেল জীবনের গল্প, দৃষ্টির বাবা মারা যাওয়ার পর দৃষ্টি ও দৃষ্টির মায়ের লড়াইয়ের গল্প, ইত্যাদি…….তবুও আজ পর্যন্ত, দুটো কথা কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারেনি আকাশ ১) দৃষ্টির জীবনে কেউ বিশেষ মানুষ আছে কি না? ২) দৃষ্টির মা বেঁচে আছেন, তবুও দৃষ্টি এখানে পেয়িং গেস্টে একা কেন থাকে?

আজ আরো একটা শনিবার, সকালে বাড়ি থেকে বেড়োনোর সময় আকাশ, মনে মনে ঠিক করলো – আজ না জানা দুটো প্রশ্ন সে জিজ্ঞেস করবে, দৃষ্টি কে, আচ্ছা আজ তো এক কাপ কফির কথা বলা যায়?

**************************************

” দৃষ্টি আজ এক কাপ কফি খেতে যাবে? মানে, তোমার আপত্তি না থাকলে”

“আচ্ছা বেশ, সামনেই কফি হাউস তো”

“না কফি হাউসে বড্ডো ভিড় থাকে আজকাল, তোমায় কিছু বলার ছিল দৃষ্টি, সিসিডি চলো?”

“সে তো এক কাপ কফির প্রায় দেড়শো টাকা বিল করে দেবে!”

“কিন্তু ভিড়টা একটু কম থাকবেই, আজ না বলোনা প্লিজ”

******************************************

বিকেল প্রায় পাঁচটা, যখন ওরা পৌঁছলো – সিসিডি তে

“দৃষ্টি দুটো কথা বলার ছিল আজকে!”

“হ্যাঁ বলোনা”

আকাশের হৃদস্পন্দন আবার দ্বিগুণ! মাথার কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, কিন্তু আজ কথাটা গুছিয়ে বলতেই হবে আকাশ কে –
“দৃষ্টি, আমি জানিনা, তুমি সবটা বোঝো কিনা…………..মানে তুমি না বুঝলেও আজ আমাকে বোঝাতেই হবে…………..তোমার জীবনে বিশেষ মানুষ আছে কেউ? মানে…………..কাউকে ভালোবাসো? আমি এইসব কথাগুলো তোমায় না জিজ্ঞেস করেই, অনেক স্বপ্ন দেখি আজকাল…………..আজ শুধু একবার বলো – আমার অধিকার আছে তো স্বপ্ন গুলো দেখার?”

দৃষ্টি কোনো উত্তর দেয়না, চুপচাপ চেয়ে থাকে আকাশের দিকে…………..

“দৃষ্টি, তোমার জীবনে অন্য কেউ যদি…………..”

“না সেরকম কেউ নেই…………..”

“আমাকে নিয়ে কি ভাব? আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কি ভাব? নিছক বন্ধু্ত্ব ? ”

“তুমি তাড়াহুড়ো করছো আকাশ ” বলেই কফির কাপে চুমুক দিলো দৃষ্টি …………..
তুমিটা শুনতেই আকাশের কেমন যেন হালকা লাগলো মন টা…………..

“তাড়াহুড়ো নেই আমার দৃষ্টি…………..শুধু একবার বলো তুমি থাকবে তো চিরকাল?”

“আমার একটু সময় চায়…………..”

“বেশ নাওনা সময়…………..তাতে কোনো অসুবিধে নেই…………..আমার এই লিম্প এর সমস্যা …………..এটার জন্যে আফসোস হবেনা তোমার”

“কি? কি বলছো – আকাশ ! একটা পা, একটা হাত ছাড়া, মানুষ ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পেরিয়ে যাচ্ছে…………..কেউ পা ছাড়া দৌড়োচ্ছে …………..স্টিফেন হকিংস! নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ তুমি?”

“না দৃষ্টি আমি তো এমনি…………..”

“না আকাশ…………..আমার সমস্যা এটা নয় যে তোমার একটা ছোট্ট লিম্পের সমস্যা আছে, সমস্যা এটা যে আমি তোমায় এতো বোঝানোর পরেও তুমি এটাকে এতটা গুরুত্ব দাও! গিটার ছেড়ে দিলে – কেন? শুধু এই জন্যে যে ওরা তোমায় বলেছিলো গিটারিস্ট নেচে নেচে স্টেজ জুড়ে না ঘুরলে attention পাবেনা…………..ব্যাস তোমার সেইটুকু কনফিডেন্স ছিলোনা যে তুমি পারবে করতে…………..”

“এক হাতে সাপোর্টিং স্টিক ধরলে দুহাত দিয়ে গিটার টা কি ভাবে প্লে করবো দৃষ্টি …………..”

“তাহলে ফেলে দাও …………..সাপোর্টিং স্টিক………পারবেনা স্টিক টা ছাড়া চলতে, বাঁ পায়ে ভর দিয়ে এগোতে………আর আকাশ! কখনো কোনো সিঙ্গার কে দেখোনি বসে – দুহাতে গিটার নিয়ে গাইতে ………নিজেকে ভালোবাসো? নিজেকে না ভালোবাসলে আমায় কি করে ভালো রাখবে? নিজের যত্ন নাও? আমার যত্ন কি ভাবে নেবে?
বাবা ঠিক করে কথা বলেনা বলে, তুমি বলোনা, বাবার সাথে মর্নিং ওয়াকে যেতে পারো তো! অফিসে ওদের সাথে বিকেলে চা খেতে কেন যাওনা? ওরা ইগনোর করে বলে? না আকাশ তোমার মনে হয় এটা যে তোমাকে ওরা ইগনোর করছে লিম্পের জন্যে!………আর যদি করেও, তাহলে ওদেরকে বলো তোমার সমস্যাটা, এভাবে একজনকে ঘিরে বাঁচা যায়না আকাশ! আকাশ, আমি আছি, তোমার জীবনে………কিন্তু একজনকে নিয়ে কেউ বাঁচতে পারেনা! এতো ডিপ্রেসিং মানুষের সাথে থাকা খুব কঠিন আকাশ আর হয়তো সেই জন্যেই আমি সময় টা চেয়েছি”

***************************************

দৃষ্টির এই একটা কথা তে আকাশ যে এতটা বদলে যাবে, এটা দৃষ্টিও কখনো ভাবতে পারেনি! পরের দিন থেকেই চৌধুরী বাবুর সাথে হাঁটতে বেড়োয় আকাশ, সাপোর্টিং স্টিক ছাড়াই, পুরোনো গিটার টিউনিং করেই, আবার শুরু হয়েছে রেওয়াজ সকালে, নিয়মিত ভাবে লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট …….অফিসে বিকেলে বন্ধুদের সাথে চা খেতে যাওয়া, অফিস থেকে ফিরে দৃষ্টির সাথে কথা বলা …….শনি ও রবিবার এনজিও বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর ফাঁকে দৃষ্টির সাথে লাঞ্চ ……. ক্লাসের শেষে দুজনের একসাথে হেঁটে বাস স্ট্যান্ড যাওয়া …….এনজিও থেকে বাস স্টপেজের আড়াই কিলোমিটার রাস্তাটা দুজনেরই কম মনে হয় আজকাল……….

ইদানিং সাজ পোশাকেও পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা! নতুন চশমার ফ্রেমে বেশ মানিয়েছে আকাশের মুখটা……….! কিন্তু তবুও সম্পর্ক টা একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে! দৃষ্টির আরো কিছুটা সময় চায়……………….

**********************************

আজ রাতে আকাশ সুবিনয় দার গাড়িতে ওঠেনি, নিউটউন থেকে আজ দমদম নয়, আজ গন্তব্য হাতিবাগান….

তাই আজ ধ্রুবজ্যোতি নস্কর নামে এক ভদ্রলোকের গাড়ি বুক করেছে আকাশ, শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় অবধি বুকিং…ওখান থেকে লাল গোলাপটা নিতে হবে যে……..

চকলেট কেকটা আগেই নেওয়া হয়েছে অফিস ক্যাম্পাসের এক কনফেক্শনারি থেকে….কিন্তু লাল গোলাপ কিছুতেই জোগাড় করা গেলোনা……অগত্যা বুকিং শ্যামবাজার অবধি, বাকি পথটা হেঁটেই নেবে আকাশ, আজকাল চার পাঁচশো মিটারের রাস্তা হাঁটা কোনো ব্যাপারেই নয় আকাশের কাছে…….

**********

শ্যামবাজারে নেমে এক গোছা লাল গোলাপ জোগাড় হলো এতক্ষণে…..ছোট্ট অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি ফোটা, পঞ্চাশটা টকটকে লাল গোলাপের গোছা……পুরো গোছাটা মোড়া সাদা স্বচ্ছ সেলোফিনে…..সঙ্গে লাল ফিতে….

*****

হাতিবাগান পৌঁছে, রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে, ফোনটা পকেট থেকে বের করলো আকাশ, ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো দৃষ্টির বাড়ির ঠিকানা টা….গুগল ম্যাপ অনুযায়ী যেখানে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে হেঁটে মিনিট পাঁচ…….এবার তাহলে দৃষ্টিকে একটা ফোন করাই যায়…….

হ্যালো…..

হ্যাঁ আকাশ, ফিরলে বাড়িতে!

না, এখনো নয়, ফিরবো একটু পরে….

কেন, এতক্ষণে কাজ শেষ হলো নাকি?

না……আমি তো অনেকক্ষণ বেড়িয়েছি অফিস থেকে…..এখন হাতিবাগান!

কেন হাতিবাগান কেন? কিছু দরকার ছিল নাকি ওই দিকে?

কেন মানে? তোমার বাড়ি আসছি তাই!

মানে? খুব অবাক গলায় বললো দৃষ্টি!

মানে কিছুইনা, তোমার ঠিকানাটা আমি এনজিওর ফাইল থেকে পেয়েছি! কাল জন্মদিন বলে কথা, ভাবলাম একটু সারপ্রাইজ দি…..
হ্যালো…..হ্যালো….হ্যালো….দৃষ্টি…..শুনতে পাচ্ছনা…..হ্যালো……
এতক্ষণ তো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিলো…..হঠাৎ কি হলো রে বাবা, আকাশ আবার ডায়াল করলো দৃষ্টির নম্বর টা –
উফফফ ব্যস্ত কেন লাইন টা…দৃষ্টি নিশ্চয় আমাকে ঘুরিয়ে ফোন করার চেষ্টা করছে…………
আকাশ দু মিনিট বাদে বাদে ফোন করেই যাচ্ছে….আর অটোমেটেড ভয়েস একই কথা বলে চলেছে –
‘ যে ব্যক্তির সাথে, আপনি যোগযোগ করার চেষ্টা করছেন, তিনি অন্য কলে ব্যস্ত, দয়া করে কিছু সময় বাদে আবার চেষ্টা করুন………..’

***********

মিনিট দশেক পর, আকাশের ফোনটা বেজে উঠলো

দৃষ্টি, কে ফোন করেছিলো? আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করছি তুমি জানো?

মা ফোন করেছিল আকাশ!

ওহঃ আচ্ছা……আরে আমি হাতিবাগান আমিনিয়ার সামনে! তুমি বলো এবারে কি ভাবে আসবো? এই বিরিয়ানি খাবে?

আকাশ….আকাশ…আমি তো হাতিবাগানে নেই! তুমি না বলে এরকম হঠাৎ করে চলে আসবে, আমি কি করে বুঝবো বলতো?

মানে? তুমি কোথায় তাহলে?

অনামিকা দির বাড়িতে……আমাদের সিউড়ির ওখানে বাড়ি……আজকে পিউ তো আরামবাগ গিয়েছে…………..তাই আমি ভাবলাম…..একা একা ….

আচ্ছা বেশ! ঠিকানাটা বলো অনামিকাদির?

আকাশ পাগল হলে নাকি? না না এখানে এসে কি করবে আকাশ! কাল দেখা করবো কেমন!
এনজিও তে! বা আমি নিজে তোমার বাড়ির….

আমি আসছি, বললাম তো………দৃষ্টি প্লিজ….ছেলেমানুষি করোনা…….ঠিকানা টা বলো…..!

********************************

অনেক কথা কাটাকাটির পর, আকাশ যখন অনামিকাদির বাড়ির সামনে এলো, রাত তখন প্রায় এগারোটা……
কোনো গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়াটার…..A3 টাওয়ারের সামনে গিয়ে, আকাশ আবার ফোন করলো দৃষ্টিকে……..

হ্যাঁ….নীচে দাঁড়িয়ে……3C বলেছিলে না?

হ্যাঁ!

*******************************

তিন তলায় উঠেই, দেখলো দৃষ্টি দাঁড়িয়ে দরজার বাইরে…..আজ পড়েছে….লাল সালোয়ার….একদম অন্য রকম লাগছে আজ!

কি হলো? মুখটা এরকম গম্ভীর কেন? ফর ইউ……. বলেই গোলাপের গোছা টা তুলে দিলো দৃষ্টির হাতে………

আকাশ, শোনো আমার কথা…..
….ফুল দেওয়া তো হয়ে গিয়েছে বলো …..এটা অনামিকাদির বাড়ি আকাশ! সে এসব পছন্দ করেনা বুঝলে…..দেখা হয়ে গিয়েছে……..জন্মদিনের শুভেচ্ছাও দেওয়া হয়ে গিয়েছে…….এবারে তুমি এসো কেমন! দেখো প্লিজ একটু বোঝো!

আমি কেক এনেছিলাম দৃষ্টি, কেক টা কেটে নাও….আমি চলে যাবো…..

ডিসেম্বরের শীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, দৃষ্টির কপালে……

জুতোটা বাইরে খুলে, আকাশ ঢুকে পরে অনামিকা দির ঘরে……ঘর ভর্তি ফাইল পত্র, অগোছালো……কিন্তু ঘরে আর কেউনেই……

দৃষ্টি? অনামিকাদি কোথায়?

এখনো ফেরেনি……

এগোরাটা দশ এখন দৃষ্টি…. এখনো ফেরেনি, কি চাকরি করে? আর তুমি ঘরে এলে কি ভাবে?

আমার কাছে, চাবি থাকে এই ঘরের……

তোমার এতো ভালো বান্ধবী…..ঘরের চাবি থাকে…..কই বলোনি তো কখনো?

আকাশ ছাড়োনা এসব ……কেক টা কেটেনি….তারপর তুমি চলে যেও…..কি বলতো রাত অনেক হয়েছে, আবার কাল তোমার অফিস……
কথাগুলো বলতে বলতে, এরইমধ্যে একটা থালা ও চাকু নিয়ে এসেছে দৃষ্টি রান্নাঘর থেকে…….

দৃষ্টি তাকাও আমার দিকে! বিশ্বাস করতো আমায়! তোমার কি মনে হচ্ছে দৃষ্টি? হমমম…..! এতো ভয় কেন পাচ্ছো? তোমায় একা পেয়ে কি আমি তোমায় জোর করবো! দৃষ্টি, তুমি আমার গার্ল ফ্রেন্ড হলেও, এমনকি আমার বিয়ে করা বৌ হলেও, তোমার কনসেন্ট ছাড়া আমি তোমায়……

না না….সেইটা ব্যাপার নয় আকাশ! ব্যাস রাত অনেক হয়ে গিয়েছে…..আর কিছু নয়….
অনামিকাদি চলে এলে কি ভাববে বলতো…তাই ওর আসার আগেই তুমি চলে…..

কেন? আজ তো আমি…তোমার অনামিকাদির সাথে দেখা করেই যাবো! আমি তো কোনো বাজে মতলবে এখানে আসিনি……তবে পালাবো কেনো? বলেই আকাশ বসে পড়লে বাইরে ঘরের সোফায়…..

আকাশ প্লিজ! তুমি……

আরে আকাশ যে! সারাদিন তোমার কথা বলতে থাকে দৃষ্টি……..
একজন মাঝবয়েসী মহিলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এলো….তারপর দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে এলো আকাশের দিকে…….হাতটা বাড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে…….তারপর বললো –
হ্যালো……আকাশ……nice meeting you! আমি অনামিকা……অনামিকা রায়……!

আপনি….আমাকে চিনলেন কি ভাবে? মানে আমাদের, তো আগে দেখা হয়নি…..বেশ হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো আকাশ…….

দৃষ্টি সারাদিন, আমার ফোনে তোমার ছবি দেখায়……সারাদিন শুধু আকাশ আর আকাশ……..!

আকাশের হৃদস্পন্দন টা বেড়ে গেল খানিক টা…..কান দুটো লাল হয়ে এলো…….সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গিয়েছে কথা টা শুনে……!
আসতে আসতে বললো – ও তাই নাকি……বলেই তাকালো দৃষ্টির দিকে……
কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দৃষ্টির মুখে কোনো হাসি নেই…..অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অনামিকাদির দিকে! যেন ভীষণ অবাক হয়েছে বা ভয় পেয়েছে……

কি হয়েছে দৃষ্টি……তুমি এখনো ভয় পাচ্ছো? অনামিকা দি কিচ্ছু মনে করেনি আমার আসা তে?

অনামিকাদি বলে ওঠে – হ্যাঁ মনে করার কি আছে? আকাশ….আজ কিন্তু ডিনার না করিয়ে তোমায় ছাড়ছি না…….!

না না….অনামিকাদি……দৃষ্টি এমনি নার্ভাস….আজ আমি উঠি……..

অসম্ভব……আরে…দৃষ্টির জন্মদিন বলে কথা……..

দিদি…..সত্যি বলছি….মাথাটা ভীষণ ধরেছে……আর বাড়ি গিয়ে ডিনার করবো……এগোরাটা কুড়ি…..এবার সত্যিই দেরি হচ্ছে……

চুপটি করে বসে থাকো…..আজ প্রথম বার এসেছো……কিছু না খেয়ে, কোথাও যাবে না…..

আচ্ছা বেশ…..তাহলে এক কাপ কফি….স্ট্রং ……মাথাটাও খুব ধরেছে…………..

অনামিকাদি ভ্রু কুঁচকে তাকালো আকাশের দিকে…….তারপর বললো বেশ! পাঁচ মিনিট…….ততক্ষণ প্রেম করো…!

**********

প্রেম তো দূরের কথা…..আজ দৃষ্টি তাকাচ্ছেও না ঠিক করে আকাশের দিকে! মুখে দু একটা কথা…যেন খুব টেনশনে আছে……বারবার রান্না ঘরের দিকে তাকাচ্ছে……

আকাশ…..! এই যে কফি……স্ট্রং ! বিস্কিট নাও?

নাঃ দিদি…..শুধু কফি….!

বসে বসে, খানিক গল্প করতে করতে, কফিটা শেষ করলো আকাশ…
দিদি আজ আমি উঠি….শরীরটা হঠাৎ কেমন যেন করছে! দৃষ্টি কেকটা কেটো পরে…ছবি পাঠিও….অনামিকাদির ফোন থেকে …….. হঠাৎ মাথাটা যেন ঘুরছে……!

সোফা থেকে উঠতেই, চোখের সামনে টা পুরো ঝাপসা হয়ে এলো আকাশের! মাথা টা ভীষণ ঘুরছে……..সামনের আলো গুলো আসতে আসতে কমে আসছে, কান দুটোয় হঠাৎ ধাপ ধরে এলো…..! শরীরের ভার না রাখতে পেরে আকাশ চিৎ হয়ে পরে গেলো সোফায়…….

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here