০৩
,
,
,
সাদাফ ভাই চলে গেলেন আসার ঘন্টা খানেক পরেই…….. নিজেকে খুব খারাপ মনে হচ্ছিলো……. এতো গুলো মিথ্যা আমি কিভাবে দিনের পর দিন বলে গেলাম সেটাই ভেবে পেলাম না…….. বার বার শুধু ভেতর থেকে একটা কথাই কানে আসছিলো সাদাফ ভায়ের কাছে আমায় মাফ চাইতে হবে….. আশ্চর্যজনক ভাবে আমি আমার অপরাধ বোধে এতোই জর্জরিত ছিলাম যে মারের ব্যাপার টা রীতিমতো ভুলেই গেলাম…..অথচ মা যখন রেগে দুই চার ঘা লাগাতেন তা নিয়ে আমি কতো কিছুই না করতাম…… নিজের দোষ থাকা স্বত্তেও সুদূর প্রবাসী বাবার কাছে বিচার দিয়ে মাকে হেস্তনেস্ত করতাম…… কিন্তু তখন মাথায় শুধু সাদাফ ভায়ের কাছে মাফ চাইতে হবে এই কথা ছাড়া আর কিছুই আসছিলো না…….
,
,
,
সেদিন সন্ধ্যায় প্রচুর ঝর হলো সাথে বৃষ্টি ও…… মা ফোন দিলো ঠিক ঝড় শুরু হবার পরেই…… সারাদিন জার্নি করে নানির কাছেই ছিলেন…… ফোন দিতে ভুলে গিয়েছেন বলেই এখন দেওয়া…… কি দিয়ে খেয়েছি….. সুফিয়া খালা আছে কি না….. কি করছি……রাতে দরজা জানালা ভালো করে যেনো বন্ধ করে ঘুমাই…… এতো সব কথার উত্তর যখন ভাবলেশহীন ভাবে দিচ্ছিলাম আনমনে ঠিক তখনি মা বললেন সাদাফ ভাই নাকি একবার ফোন দিয়েছিলেন……… কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে মা নাকি ধরতে পারেন নি….. কথা টা শুনেই ভেতর টা শুকিয়ে গেলো…… সাদাফ ভাই মাকে ফোন দিয়েছে!!!! কেন!!! ওনি কি আর পড়াবেন না বলে ফোন দিয়েছিলেন!!!
,
,
,
সেদিন রাতে হাড় কাপিয়ে জ্বর এলো আমার…… রোলারের প্রত্যেকটা আঘাত যেনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরির রুপ ধারণ করেছে…… সারা গায়ে এতো ব্যাথা যে নিশ্বাস টা ও জোরে ফেলতে পারছি না…… মায়ের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন থেকেই খারাপ লাগছিলো……. সুফিয়া খালা আমার এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন…… তিনি উপায়ন্তর না দেখে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ছুটে গেলেন আমার চাচির কাছে…… আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পরই আমার চাচার বাসা…… চাচি সুফিয়া খালাকে বকতে বকতে আমার ঘরে এলেন…… এমন অবস্থায় আমাকে একা রেখে যাবার জন্য…… চাচি মাথায় পানি ঢেলে চুল মুছে….. হাতের তালু পায়ের তালু মুছে দিলেন…… শরীর মুছে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমার নায়ের উপর আর কিছুই করতে পারেন নি….. ধোয়া উঠা গরম ভাত আলুভাজি আর ডাল দিয়ে মাখিয়ে খাইয়ে দিয়ে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন……….রাতে চাচি আমার সাথেই ঘুমালেন……. শরির ব্যাথায় সারারাত ই চোখের জল পরেছে….. অথচ যেই আমার চোখের জলের এতো সংকট…..
,
,
,
পরদিন ও জ্বরের জন্য চাচি আমায় স্কুলে যেতে দিলেন না….. সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে হাত মুখ ধুইয়ে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে গেলেন…….. আমাকে সাথে করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই যায়নি…….. মাকে খুব মনে পড়ছিলো……… চাচি বলেছিলেন ফোন দিয়ে জানাতে কিন্তু আমিই জানাই নি অযথা চিন্তা করবেন…… সামান্য জ্বর ই তো…… সেরে যাবে…..দুপুরে ও চাচি খাবার নিয়ে এলেন……
,
,
,
আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেলে সাদাফ ভাই আবার পড়াতে এলেন……. আমি তখন আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম পাশ ফিরে…… সুফিয়া খালা এসে জানিয়ে গেছে সাদাফ ভাইয়ের কথা…… পড়ার ঘরে যাবার আগে ভালো করে চাদরের মতো ওড়না টা দিয়ে নিলাম……. তারপর একপ্রকার পা খোড়াতে খোড়াতে সাদাফ ভায়ের সামনে গেলাম….. সাদাফ ভায়ের চেয়ার টা একেবারে দরজা বরাবর…… ঢুকতে গিয়েই চোখাচোখি হয়ে গেছে…… আমাকে মাথা মুড়িয়ে চাদরের মতন ওড়না নিতে দেখে ওনি বেশ অবাক ই হলেন…… তিনি তখন টেবিলের উপর আমার পরীক্ষার খাতা গুলো ঘাটছিলেন…..দরজা থেকে টেবিলে বসা পর্যন্ত আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন…… সাদাফ ভায়ের সামনে সেই মূহুর্তে নিজেকে খুব বড়সড় চোর মনে হচ্ছে…… কোনভাবেই স্বাভাবিক হয়ে মাথা তুলতে পারছিলাম না……. এদিকে সাদাফ ভাই ও কিছু বলছিলেন না…… তারপর একপ্রকার তোতলাতে তোতলাতেই ওনার কাছে মাফ চাইলাম….. আর এমন হবে না বলে কথা ও দিলাম……. আমি সাহস নিয়ে এতো কথা বলার পর ও সাদাফ ভাই কিছু বললেন না….. বেশ কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন…….. এবং সেটা খুব স্পষ্ট ভাবেই আমি শুনতে পেলাম……
,
,
,
——— দেখো তুলি তোমাকে আমি পড়ায় আজ ৩৪ দিন….. এতো দিন আমি তুমাকে সত্যিই গাধি দ্যা গ্রেট ভাবতাম…….. আর আমার এই ভাবনাটার জন্ম তুমিই দিয়েছো……তুমি এই একমাসে পড়াশোনাতে আমাকে কোন প্রকার ই হেল্প করো নি……. যা পড়া হয়েছে সেটা আমি তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছি……গনিত আর বিজ্ঞান ছাড়া বাদবাকি সব সাবজেক্ট এ তোমার মার্ক ৭৫-৮০ উপরে……… সেখানে তুমি গনিতে পেয়েছো ৭ আর বিজ্ঞানে ১১……. আর যাই হোক ইংরেজিতে ৮৫ মার্ক পাওয়া স্টুডেন্ট গাধা হতে পারে না…… মেইবি আ’ম নট পার্ফেক্ট ফর ইয়োর স্টাডি গাইডার…… আর গতকাল তোমাকে এভাবে মারা আমার ঠিক হয় নাই….. আসছি
,
,
——— সাদাফ ভাই…. না…. স্যার….. আই প্রমিস….. আই উইল শেয়ার উইথ ইউ মাই এব্রি উইকনেস রিলেটেড মাই স্টাডি…..
,
,
——— প্রমিস!!!!
,
,
——— প্রমিস
,
,
——— কাল টেবিলের উপর বই যেভাবে দেখে গিয়েছি ঠিক সেইভাবেই আছে…… কোন পড়াশোনাই করো নি সারাদিন!!!!
,
,
——— সাদাফ…… কাল সন্ধ্যা থেকেই তুলির জ্বর…….. দুপুরের দিকে ও বেশ জ্বর ছিলো…….. আজকে স্কুলে ও যেতে দিই নাই…… আপাও বাড়ি নেই….. আজ বাবা ওকে বকো না…..(চাচি)
,
,
,
সাদাফ ভাই আর সেদিন পড়ালেন না…….. কিন্তু অনেক ক্ষন পড়কশোনার ব্যাপারে আলোচনা করলেন……… আমার কাছ থেকেও মতামত নিলেন………. যাকে আমরা বলি সুস্থ আলোচনা……….. এই আলোচনা থেকে একটা সুবিধা হলো আর তা হলো আমি ওনার সাথে কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছি…….সেদিনের পর সাদাদ ভায়ের কাছে আমার আর মার খেতে হয় নি…….. খুব রেগে গেলে মাথায় খাতা রোল করে দু চারটে দিতেন দাত খিচিয়ে ………. তাতে বরং আমার আরাম ই লাগতো………… আমার ছোট ছোট ভুলএ বেশ রেগে যেতেন…….. দাতে দাত চেপে আবার বুঝাতেন……. একবার না পারলে একশো বার দেখাবো কথাটা আমি উসুল করেই ছাড়লাম…….. এমনও হয়েছ্এ একটা ম্যাথ ওনি আমাকে একঘন্টায় ছাব্বিশ বার বুঝিয়েছেন কিন্তু করতে গিয়ে আবার ভুল করেছি……. তখন নিজের কাছে নিজেরই খারাপ লাগতো……. এতো গাধা অঙ্কে আমি কি করে হলা……সাদাদ ভাই তখন দাতে দাত চেপে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেলে নিজের রাগ সংবরণ করে আবার নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করতেন……. মাঝেমাঝে আমি হাল ছেড়ে দিলে বলতেন তুমি হাল ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়ছি না…… এর শেষ আমি করেই ছাড়বো…….. সেদিন থেকে সাদাফ ভায়ের চায়ের পাশাপাশি আমার জন্য হলুদ মেশানো গরম দুধ বা বাদামে ফেটা দুধ বা কখনো হরলিক্স পড়ার সাথে যোগ হলো……. আর এসব হচ্ছিলো সাদাফ ভায়ের ই কথা অনুসারে……. আমাকে সময় ও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন…… আমার প্রতি সাদাফ ভায়ের পরিশ্রম দেখে মা নিজে থেকেই তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন……. বিজ্ঞানের জন্য ও ওনি নানান ট্রিক শিখিয়েছেন আমাকে……. খুব কঠিন গুলো নিজে মুখে মুখে পড়িয়ে মুখস্ত করিয়ে দিতেন…… আর বাকি গুলো গল্প আকারে থিম মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন……… সাহিত্য নিয়েও মজার মজার তথ্য গুলো বলতেন……..
,
,
,
পরের পরীক্ষায় গনিতে পেলাম ৪৯ আর বিজ্ঞানে ৬৭…….. রেজাল্ট দেখে সবচেয়ে খুশি আমি সাদাফ ভাইয়ের মুখেই দেখেছিলাম……. গম্ভীর মানুষটাকে হাসলে যে এতো সুন্দর লাগে সেদিন আরচোখে প্রথম দেখলাম… দেখতে দেখতে এসএসসি দিয়ে দিলাম……ততোদিনে সাদাফ ভাই অনার্স কম্পলিট করে সিটি কলেজে চাকরি পেয়েছেন……… ফাস্ট ক্লাস রেজাল্ট শুনে মা সাদাফ ভাইকে ডেকে আনিয়ে কলেজ ভর্তির দায়িত্ব টা ও দিয়ে দিলেন……. সাদাফ ভাই নিজে আমাকে নিয়ে সিটি কলেজে ভর্তি করে দিলেন…….কলেজে ভর্তির পর ও সাদাফ ভায়ের কাছে পড়া বহাল রইলো……… আমার সবকিছুতেই সাদাফ ভাইয়ের মতামত আবশ্যক………. মাও আমার ব্যাপারে সাদাফ ভায়ের উপর নির্ভরশীল খুব….. আর আমার সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করা সাদাফ ভায়ের মৌলিক অধিকার হয়ে গেছে ততোদিনে…… তুলি এভাবে চলবা…… ভালোভাবে কথা বলবা…… এমন করলে কেন!! আজকে ওখানে দেখলাম কেন….. এই সময় বাইরে কেন!! ফোনে এতো কথা কিসের……খাওয়া দাওয়া করো না কে!!
সবকিছু মানে সবকিছু তে…… মা,ও আমার সবকিছু সাদাফ ভাইকে বলে দেয়…… কবে যানি বলে আজকে এতো বার শ্বাস ফেললে কেন!!! কোনকিছু করতে গেলে মা বাবা কি বলবে তা মাথায় আসে না…… সাদাফ ভাই জানলে আস্ত রাখবে না এই কথাটাই মাথায় ঘুরে……..
,
,
,
০৪
,
,
,
কলেজ থেকে দুইজন বান্ধবি মিলে বাড়িতে না জানিয়ে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম….. অনেকটা জংলা টাইপের ছিলো তখন…… বন্ধবি দুজন তখন আমাকে আশেপাশে থাকতে বলে নিজেদের প্রেমিকের সাথে হাতে হাত রেখে ঘুরতে চলে গেলো……. রাগে দুঃখে নিজের মতোন হাটা ধরলাম…… খবিশ গুলোর মনে এই চলছিলো জানলে কখনো আসতাম না…… তবে নিরিবিলি এতো সুন্দর পরিবেশ পেয়ে শয়তান গুলোকে মাফ করে দিয়েছিলাম………….. আনমনে নিজের মতন গাছপালা হাতরে ঘুরেফিরে দেখছিলাম সব……. সামনে তাকিয়েই দেখি সাদাফ ভাই কার সাথে যেনো কথা বলছেন আর সিগারেট ফুকছেন……..সেদিনই প্রথম জানলাম সাদাফ ভায়ের সিগারেট খাবার কথা…….আমি ওনাকে দেখে কেটে পড়ার আগেই ওনি আমাকে দেখে ফেললেন……… তারপর সামনের লোক্টাকে কি যেনো বলে আমার সামনে এসে দারালেন……
,
,
,
——— তুমি এখানে কি করছো!!!!
,
,
এই কথা বলার সাথে সাথেই সাদাফ ভাইয়ের নাক মুখ ফোড়ে সিগারেটের ধোঁয়া আমার মুখের উপর এসে পড়লো……… সিগারেটের স্মেল একদম মুখে চলে গিয়েছে…… মনে হচ্ছে আমিই খেয়েছি সিগারেট………. উত্তর না পেয়ে সাদাফ ভাই দাত খিচিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসতেই আমি সাইড হয়ে হরহর করে বমি করে দিলাম……………… থেমে থেমে দুই দফায় বমি করতেই ওনি আমাকে টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন…… বার কয়েকবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কার সাথে এসেছি কিন্তু আমি মুখ খুলে নি কিভাবে করবো!!! হারামি গুলো গাছের আড়ালে দারিয়ে সমানে কান ধরে আকুতি মিনতি করে যাচ্ছে ইশারা ইঙ্গিতে…….. কারণ সাদাফ ভাই জানতে পারলে একেবারে পিলে চটকে দিবে……. কলেজের বাঘা স্যার বলে তো আর এমনে এমনে খ্যাতিমান না তিনি….. জবাব না পেয়ে টানা ত্রিশ মিনিট কড়া রোদে দার করিয়ে রেখেছে…… আর নিজে গিয়ে ছাউনির নিচে বসে রয়েছে……. ঘামে একেবারে নেয়ে গেছি…….. রোদে চোখ অন্ধকার দেখছি…….. দয়া হলো ওনার টেনে আমাকে ছাউনির নিচে নিয়ে গেলেন…….. প্রথমে নড়তে না চাইলে…….
,
,
,
——— ঘাড় দেখালে একদম ঘাড় ভেঙে এখানে পুতে রেখে দিবো বলে দিলাম……. কেউ টের ও পাবে না…………. চুপচাপ বসো এখানে……
,
,
,
আমাকে রেখেই ওনি সামনের দিকে চলে গেলেন…… বেশ কিছুক্ষন পর দুহাতে ডাব নিয়ে ফিরে এলেন….. একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন জলদি শেষ করতে…….আমার তখন কি হলো জানি না…… ডাব হাতে দেওয়া মাত্রই ফেলে দিলাম…… অন্য ডাব টা হাতে নিয়ে দশ মিনিট বসে রইলেন তিনি……. আমি তখনো দারিয়ে আছি ঠাই….. এদিকে রোদের ঝিলিক নিস্তেজ হয়ে আকাশে মেঘ করছে……. সাদাফ ভাই আমার হাত ধরেই ছাউনি থেকে বের হয়ে এলেন……. আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম…….. তিনি আর কিছু বললেন না……. উনার পিছু পিছু হেটে ভার্সিটি গেইট আসি সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলেন………. কলিং বেল চাপতেই মা দরজা খুলে দিলেন……. আমি সোজা ঘরে ঢুকে দরজার পিছনে চলে গেলাম…….
,
,
,
——— সাদাফ…. ভেতরে আসো
,
,
——— না খালাম্মা….. আমার কাজ আছে একটু….. এতে স্যালাইন গুলা আছে তুলিকে খাইয়ে দিবেন….. আসসালামু আলাইকুম……. মায়ের হাতে ডাবটা দিয়ে..
,
,
——— আলাইকুম আসসালাম
,
,
,
,
চলবে….
লেখনিতে: চৈত্র রায়