এক পশলা বৃষ্টি আর সে, পর্ব -৩

0
908

০৫
,
,
সাদাফ ভাই মায়ের হাতে ডাব ধরিয়ে দিয়ে যাবার পর থেকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে করতে মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে মা একেবারে…… আমার কাছে উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন….. হ্যারে তুলি তুই কি মাথা ঘোরে পড়ে গিয়েছিলি কলেজে!!! কিরে তোর মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন!!! এই তুই ছাতা নিয়ে যাস নি কেন!!! তোর যে রোদের তাপে প্রবলেম হয় তুই জানিস না!!! এখন তোর পিছনে ছাতা নিয়ে ছুটার জন্য আমার মানুষ রাখতে হবে নাকিরে…. হ্যা!! বিরতিহীন ভাবে বকেই চলেছে….. থামাথামি নেই উফফফফফ
,
,
সাদাফ ভাই আমাকে পড়াতে এলেন পরের দিন বিকেলে……. বিছানায় গল্পের বই নিয়ে পড়তে পড়তে সবে মাত্র চোখ টা লেগে এসেছিলো প্রায়….. এমন সময় সুফিয়া খালা এসে বলে গেছেন যে সাদাফ ভাই এসেছে….. কথাটা শুনে বেশ বিরক্ত হলাম….. ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে উঠি…… রাতে মাথা ব্যাথার জন্য ঘুমাতে পারি নি….. সব ঘুম যেনো এখন ভর করেছে আমার….. কোনমতে হেলেদুলে চোখে পানি ছিটিয়ে পড়ার রুমে চলে গেলাম…… বেশ ভয় করছে কালকের ঘাড় তেড়ামির জন্য….. নাজানি কি শাস্তি দেয় আবার……বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পড়ানো শুরু করলেন….. কিছুক্ষণ পড়িয়ে লিখতে দিলেন…… লিখছি এমন সময়….
,
,
,
——— বন্ধবিদের প্রেম করতে সাহায্য করা দোষের কিছু না….. এইরকম সাহায্য আমি নিজেও অনেক করেছি…… হাত দুটো মুঠো করে মুখের কাছে ঠেকিয়ে
,
,
——— দোষের না হলে আমার রোদে দারিয়ে থাকা ত্রিশ মিনিট ফেরত দিন…… হাতের কলম খাতার উপর রেখে
,
,
——— ছাব্বিশ মিনিট ছিলো…… এক কাজ করো কাল কলেজ ছুটির পরে আমার সাথে দেখা করো ছাব্বিশ মিনিট রোদে দার করিয়ে রাখবো
,
,
——— কেনো!!!
,
,
——— তুমিই না বললে রোদে দারানোর সময় টা ফেরত দিতে
,
,
,
বলেই জোড়ে হেসে উঠলেন….. নিজের কথায় নিজেই ফেসে গিয়েছি তাই কথা না বাড়িয়ে লিখায় মনোযোগ দিলাম….. লিখতে লিখতে একেবারে ঝিমুনি এসে গেছে প্রায়…… লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাই নি…… ঘুম ভাঙার পর বেশ চমকে গেলাম….. এতোক্ষন টেবিলে বসে বসেই ঘুমুচ্ছিলাম…… সাদাফ ভাই!!!! তার চেয়ারে তাকাতেই দেখলাম চেয়ার ফাকা…. আর তার সাথে আমার পড়ার টেবিল টাও গোছানো……. আড়মোড়া ভেঙে খাতা অফ করতেই দেখলাম কোনায় গোটা গোটা করে লিখা….. আর যেনো টেবিলে ঘুমাতে না দেখি…… ইশশশ কি লজ্জা কি লজ্জা…. আমি সাদাফ ভায়ের সামনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম….. লজ্জায় দুহাতে মুখ ডেকে বসে রইলাম কিছুক্ষণ…..
,
,
,
এর মধ্যেই সাদাফ ভাই মায়ের কাছে ফোন করে তিন চার দিনের ছুটি নিলেন……. আমাকে আর পায় কে তখন…… বাধন হারা ঘাস ফড়িং এর মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছি এই চারদিন।।।।।কিন্তু সাদাফ ভাই এলেন পুরো সাত দিন পর……পাঁচদিনের মাথায় শাম্মী আমার ছোট বেলার বান্ধবী এসে মাকে রাজি করিয়ে দুদিনের জন্য নিয়ে গেলেন……. বৃহস্পতিবার হওয়ায় মা আর বাধ সাধেন নি……. শনিবার সকালে মা শাম্মিদের বাড়ি ফোন দিয়ে জানালো সাদাফ ভাই নাকি বিকালে পড়াতে আসবেন……. আন্টি সেদিন আমায় দুপুরে কোন মতেই না খাইয়ে ছাড়লেন না………. শাম্মিদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি পৌছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছে……. শাম্মীর বড় ভাই শিমুল ভাইয়া সেদিন আমাকে বাড়ি দিয়ে গিয়েছে…… বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখি সাদাফ ভাই আর মা বসে কথা বলছে….. শিমুল ভাইয়া মাকে সালাম দিতেই জড়িয়ে ধরলেন……. কতকাল পরে দেখা….. আগেতো শিমুল ভাই রোজ আমাদের বাসায় আসতেন শাম্মি কে নিতে…… পড়াশোনার জন্য ভাইয়া আমেরিকা চলে যায়….. আজ প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা…… আদর করা জায়েজ…… শিমুল ভাইকে দেখে আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম…… সাথে খুশিও…… খুশি হবো না কেন!! প্রথম ভালোলাগা বলে কথা…… অবশ্য এ-ব্যাপারে শিমুল ভাইয়া বা শাম্মি কেউই কিছু যানে না…… ভাইয়া যখন আমেরিকা যায় তখন আমি ক্লাস সেভেনে……. যাওয়ার দুদিন আগে আণ্টিকে নিয়ে এসে মায়ের সাথে দেখা করে গেছে…… কত রাত যে কেদেছি ভাইয়াকে আর সামনে দেখতে পাবো না ভেবে…….মায়ের সাথে ভাইয়ার খুব ভাব…. কি সুন্দর করে হাসি দিয়ে কথা বলে…… ভাইয়ার নাকের ডগায় লাল তিলটা….আমেরিকা যাবার পর তো আরো ফর্সা হয়ে গিয়েছেন…….. সাথে স্মার্ট ও…… কি সুন্দর নিচের ঠোঁটের নিচে হালকা নিম দাড়ি……. সব গুলো দাত বের করে যখন নিশব্দে হাসে উফফফফ….. এই হাসিতে তাকায় থাকলেও ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে……. শিমুল ভাই আমাকে প্রথম দেখেই মাথায় চটি মেরে বললো কিরে তুলা তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না….. এতো সুন্দর কি খেয়ে হলিরে….. আমাকে আর পায় কে….. ভাইয়া আমাকে সুন্দর বলেছে…… এই তিন দিন ভাইয়া আমাকে যতোবারই তুলা ডেকেছে ততোবারই আমি হেসে হেসে মনে মনে বারংবার বলেছি শিমুলের তুলা…..
,
,
,
শিমুল ভাইয়া আমেরিকা থেকে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে এসেছে……মা বিয়ের কথা সবে মাত্র জিজ্ঞেস করেছে….. অমনিই সাদাফ ভাই দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ার রুমে চলে এলেন…….. পড়ায় কি আর মন বসে তখন!!! মা অইদিকে ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা বলছে….. পারিনা কান্টাকে সতেরো ইঞ্চি বড় করে মায়ের পাশে রেখে আসি…. ইশসসস….. সাদাফ ভায়ের হুঙ্কারেই বাস্তবে ফিরে এলাম…… খেয়াল করে দেখি ওনি আমার খাতা খুলে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে….. খাতার যে পৃষ্ঠায় ওনি বাড়ির কাজ লিখে দিয়ে গিয়েছিল এখনো সেই পৃষ্ঠাই বহাল আছে…… একটা কলমের দাগ ও পরে নি…… পড়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম…… কয়েক ঢুক গিলে সাদাফ ভায়ের দিকে তাকাতেই উনি খেপে গিয়ে টেবিলে এক থাবা দিয়েই একে একে আমার সাতদিনের রুটিন পাই টু পাই বলছেন……. মা এই কুটনামি টা যে করেছেন আমি ২০০% শিউওর……. চুপ করে থাকায় খাতা রোল করে কয়েকটা বারি ও খেলাম মাথায়…… সেদিন সাদাফ ভাই দেড় ঘন্টা পড়িয়েছে আর এই পুরু সময় টাই আমাকে বকে গিয়েছে….. আমার অবস্থা তখন ভেজা বিড়ালের মতো…….
,
,
,
সাদাফ ভাই যাবার পর মা রাতে আমার মাথায় তেল দিতে দিতে সাদাফ ভায়ের বাড়ি যাবার ব্যাপারটা বললেন…… ওনি আসলে এই ছুটি টা নিয়েছে তার মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য…..আমাদের কলেজের পেছনে ওনার বাবার করে যাওয়া একটা দুতলা বাড়ি আছে….. এতোদিন সেখানে ভাড়া ছিলো…….. সাদাফ ভায়ের এক ভাই ডেনমার্ক আছেন আর আরেক ভাই রাজশাহী….. বোনের বিয়ে হয়ে গেছে…… ওনার মা বাড়িতে একা থাকেন বলেই সাদাফ ভাই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন…….. এখন ওই বাড়িতেই নাকি ওঠেছেন….. গোছ গাছ করার জন্যই সাদাফ ভাই এতো দিন আসতে পারে নি….. সাদাফ ভাই ঢাকায় ছিলেন!!! এর জন্যই তো কেমন পট পট করে সব বলছিলেন………
,
,
,
এদিকে মা সাদাফ ভায়ের মাকে আর ওনাকে একদিন দুপুরে দাওয়াত দিলেন…… খুবই সাদামাটা একজন মানুষ…… আসার সময় পিঠা, নাড়ু, আমলকির আচার আরো কতোকি নিয়ে এলেন…… সাদাফ ভাই দেখতে ঠিক ওনার মায়ের মতোই হয়েছেন……. একই হাসি, একই চোখ…… দুজন মানুষ কে যে কেউ কিছুক্ষণ দেখলেই বলতে পারবে দুজনের মধ্যে কতটা ভালোবাসা আছেন…… সাদাফ ভাইয়ের মা সাদাফ ভাইকে বাবু বলে ডাকেন….. সেদিন খাবার টেবিলে জানলাম ব্যাপার টা….. ডাকটা শুনেই পেট ফেটে হাসি আসছিলো….. ওনাকে আদর করে বড়জোর যম ডাকা যায়….. বাবু!!!! হি হি হি
,
,
,
মা সাদাফ ভাইদের নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন…….. আমি ভয়ে আর সেদিকে আগালাম না…… ওবাবা….. এই যম ঠাকুরের সামনে গলা দিয়ে আমার খাবার নামবে না আর যাই হোক…… কিন্তু ওনার মা আমাকে জোড় করে বসিয়ে দিলেন….. সাথে সাদাফ ভাই ও বললেন….. আর না বসে যাই কই…..
,
,
,
০৬
,
,
,
সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে মায়ের খুব ভাব জমে গেছে….. আজকাল মা যেখানেই যায় ওনাকে সাথে করে নিয়ে যায়….. মাঝেমধ্যে ও কম্পলেক্সে ও ওনাদের আড্ডা চলে…..সকালে এক সাথে হাটা….. ঘুড়েফিড়ে বাজার করা…… আমার জন্য এটা সেটা বানিয়ে আনা….. এভাবেই যাচ্ছে দিনগুলো…… এর মধ্যেই বাবা ফোন করে জানালেন তিনি দেশে ফিরছেন কয়েকদিনের মধ্যেই……. সেই ক্লাস এইটে পড়া কালীন বাবাকে দেখিছি……. দিনগুলো যেনো কাটছিলো না আমার কবে বাবাকে পাবো……অবশেষে বাবা আসলেন….. দেখে চেনায় যাচ্ছে না…. একেবারে শুকিয়ে গেছেন…… বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রাগী মুডেই বলে দিলাম আর তাকে ছাড়ছি না….. বাবা আমার কথা শুনে বেশ হাসলেন….
,
,
,
বাবা এসেছে বলে আত্নীয় স্বজন সবাই কম বেশ আসছে দেখা করতে….. আমি তখন বাবার আনা গিফট আর চকলেট ভাগাভাগি করাতে ব্যাস্ত….. আম্মু সাদাফ ভায়ের সাথে আব্বুর পরিচয় করিয়ে দিলেন……. সাদাফ ভাইকে দেখলাম বেশ হাসি হাসি মুখ করেই কথা বলছেন……. লোক্টাকে হাসলে এতো ভালো লাগে অথচ তিনি হাসেই না….. এই তিন বছরে আমি বেশ হাতে গুনে বলতে পারবো ওনি কয়বার হেসেছেন………. সেদিন আব্বু নিজ হাতে সাদাফ ভাইকে টাইটানিক এর একটা ঘড়ি দিয়ে ব্যাবহার করতে বলেছেন……. একদিন সময় করে মা আব্বু কে সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন…… এর মধ্যে একদিন সাদাফ ভায়ের মা এসে আমাদের স্বপরিবারে নিমন্ত্রণ করে গেলেন দুপুরের খাবারের জন্য………. বেশ যাচ্ছিলো দিনগুলো……. সব কিছুতেই যেনো আনন্দ লাগে…… রাস্তা ঘাটে আবারো সেই আগের মতো শিমুল ভাইকে দেখি….. মাঝেমধ্যে কথা হয়…… আবার কখনো কখনো দূর থেকেই তাকিয়ে থাকি…….. উনার সব কিছুই যেনো ভালো লাগে আজকাল নতুন করে…… হাত নাড়িয়ে কথা বলা…… চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া….. টুপি পরে মসজিদে নামাজ পড়া….. সব……. আচ্ছা এতো ভালো লাগে ক্যান মানুষটাকে!!!???
,
,
,

চলবে…….

লেখনিতে: চৈত্র রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here