এক মুঠো রঙ,সূচনা পর্ব
ফারজানা আফরোজ
বয়ফ্রেন্ডকে চমকে দিতে এসে নিজেই এইভাবে চমকে যাবো ভাবা তো দূর কল্পনা পর্যন্ত করেনি সিমরান। ক্লাবের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সাদাত আর তৃনা। দাঁড়ানো অব্দি ঠিক থাকলেও তাদের ঘনিষ্ঠতা একদম ঠিক লাগেনি সিমরানের কাছে। সাদাত তৃণার কোমড় জড়িয়ে ধরে কথা বলছে তাও হেসে হেসে। হটাৎ করেই তৃণা সাদাতের গালে হাত রেখে কিছুটা উচু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলতে লাগলো……
—” নিজের বয়ফ্রেন্ডকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতে কার ভালো লাগবে সাদাত? এমনকি কাজিন হিসেবে পরিচয় দিতে হচ্ছে আমাকে।” অভিমানী সুরে বলল…….
তৃণার চোয়ালে হাত রেখে কপাল মিশিয়ে সাদাত বলল…..
—” আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো বেবি। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছি। সিমরানকে আমার পিছু বাঁদর নাচ না নাচালে কি হবে? জানো তো কত টাকার বাজি এইটা? ”
তৃণা হেসে বলল…..
—” শুধু মাত্র এই জন্যই তো কষ্ট সহ্য করছি।”
কথাগুলো বলে দুইজন তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল । সিমরান এক মুহুর্ত দেরি না করে ক্লাব থেকে বের হয়ে পড়ল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। যে সে কান্না নয় ভয়ানক কান্না, বুকে এক প্রকার ব্যাথা অনুভব করছে সে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে । রাত একটায় ফোন আসলো সাদাতের নাম্বার থেকে। গলা স্বাভাবিক করে ফোন রিসিভ করল…..
—” হ্যালো….!”
—” জান, তোমাকে কতবার বলেছি আজ আসতে জানো কত মজা হয়েছে? সবাই খুব মজা করেছে শুধু মাত্র আমি ছাড়া। তোমাকে ছাড়া তো আমার এই জীবন আঁধার। ক্লাবের এক কোণায় বসে বসে শুধু তোমার কথাই ভেবেছি।”
সিমরান হাসলো। ঐপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনে সাদাত আবার বলে উঠলো…..
—” আমার কথা শোনে তোমার হাসি পাচ্ছে?”
—” হাসি কেন পাবে আজব? আচ্ছা আমাকে তোমার এত মনে পড়ছিল একবারও তো ফোন দেও নি। ফোন দিলে অবশ্য মনটা ভালো থাকতো তাই নয় কি?”
সাদাত কেশে উঠলো। এক গ্লাস পানি পান করে গলাটা ঠিক করে আবারো আদুরী ও অভিমানী সুরে বলল…..
—” কেন ফোন দিবো হুম? তোমার সাথে তো আমার কোনো কথাই নেই। কতবার করে বলেছি জান আসো প্লিজ আসো। কিন্তু তুমি তো আসলেই না সেই জন্যই তো রাগ করে ফোন দেই নি। এখন দেখছি তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো না সেই জন্যই ফোন দিয়েছি তুমি তো আবার কঠোর মেয়ে।”
—” এত ভালোবাসো আমায়?”
—” সন্দেহ আছে হুম?”
—” আমাকে এতই ভালোবাসো সেই জন্য নিজের গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে আমাকে পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছো। গার্লফ্রেন্ডকে কাজিন বানিয়ে দিয়েছো। তোমার ভালোবাসা তো একদম খাঁটি ,জান। তোমার এই ভালোবাসা তো লায়লি মজনুকেও হার মানাবে।”
হকচকিয়ে উঠলো সাদাত। আমতা আমতা করে বলল…
—” কি বলছো এইসব?”
—” অবাক হলে তাই না? আজ তো দেখলাম পার্টির আড়ালে কি করছিলে তোমরা। এমনকি আমাকে বাঁদর নাচ নাচানোর জন্যও তো প্ল্যান করছিলে। ভুল বললাম কিছু……?”
সাদাত ফোন কেটে দিলো। সেইদিন রাতে সিমরানের আর ঘুম হলো না। মাথা ঘুরছে তার। তিনমাসের রিলেশনে ভালোই মায়া জন্মে গিয়েছিল সাদাত নামক আবর্জনার প্রতি। ভোরের দিকে ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই টেবিলের উপরে থাকা মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের উপর নওশীন নাম দেখে রিসিভ করতেই ঐপাশ থেকে নওশীন বলে উঠলো……
—-” সিমু কি হয়েছে তোর? গতকাল লুকিয়ে পার্টিতে গিয়ে আবার কাউকে কিছু না বলে চলে আসলি। সাদাতকে দেখলাম তার কাজিন কি যেন নাম? হ্যাঁ তৃণা ওর সাথে ভালোয় ড্যান্স করেছে। ওদের ঘনিষ্ঠতা ঠিক লাগেনি আমার কাছে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিমরান উত্তর দিলো…..
—” ওরা কাজিন নয় প্রেমিক-প্রেমিকা।”
গতকালের ঘটনা সব খুলে বলল নওশীনের কাছে। নওশীন রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল……
—-” আগেই বলেছিলাম শালা চরিত্রহীন। আমি মানুষের চোখ দেখেই চিনতে পারি তাছাড়া তৃণা মেয়েটা মিরমিরে টাইপের মেয়ে। এমন টাইপের মেয়েরা মোটেও ভালো হয় না। যে ছেলের চোখ সব সময় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই ছেলে শুধু লুচু নয় লুচু নাম্বার ওয়ান, হুহহহহ।”
—” আমার ব্রেকআপ হওয়ার কথা শোনে তোর কি খুশি হচ্ছে? তোর গলার স্বর বলছে তুই ভীষণ খুশি, কারণ কি?”
—” আরেহ দোস্ত খুশি তো হবো কজ তোর লাইফ থেকে আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে গেছে তাহলে আমি খুশি হবো না নাকি পাড়া পড়শী খুশি হবে। ”
দুইজন কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। সিমরানের চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেল।
সকাল দশটা…….
বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে সুপার মার্কেটের দিকে যাচ্ছিল সিমরান। মনে মনে সাদতকে শিক্ষা দেওয়ার প্ল্যান করেছে। একটা শিক্ষা না দিয়ে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে যেই পিছনে ঘুরবে আট বছরের এক বাচ্চা এসে ওর ওড়না ধরে বলতে লাগলো……
—” ভাবী, ভাবী তুমি এসেছো ভাবী।”
সিমরান বোকার মতো হেসে উঠলো। আশ পাশের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাত চোখ দুটি ছোট ছোট করে অবাক হওয়ার ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…….
সিমরান বাচ্চাটিকে নিয়ে সাদাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাগী গলায় বলল……
—” লজ্জা করে না ছোট ভাইকে দিয়ে ভাবী বলাতে। তৃণা কোথায় তাকে বলো ভাবী ডাকতে।”
—” বাজে বলা বন্ধ করো। এই ছেলেকে আমি চিনি না। আমি নিজেই তো অবাক। তোমার আবার কবে বিয়ে হলো সেই কথাই ভাবছি। তুমি তো দেখছি তলে তলে টেম্পু চালাও আর আমাদের সবার সামনে বলো হরতাল। ভালো মানুষের আড়ালে থেকে কত কিছুই না করছো।”
সিমরান আর কিছু না ভেবে মার্কেটের সামনে সাদাতের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। বাসা থেকে এই প্ল্যান নিয়েই সে এসেছে। মার্কেট ভর্তি লোকের সামনে একটা মেয়ের হাতে দাবাং মার্কা চড় খেয়ে মান-সম্মান হারাবে সাদাত। লোক লজ্জায় ভয়ে আর এমন বাজি ধরার সাহস সে পাবে না। সাদাত গালে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিমরানের উপর। সিমরান মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল…..
—” আরো করবি কোনো মেয়ের সাথে এমন নাটক? আরেকবার যদি তোকে আমার সামনে পাই হাত পা ভেঙ্গে তিন রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দিবো বলে দিলাম ।”
ছোট্ট ছেলেটি হেসে কুটিকুটি। লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে লাগলো…..
—” ইয়াহু ভাবীর কি সাহস। ভাবী আরেকটা চড় মারো আমি দেখবো।”
ছোট্ট অচেনা ছেলেটির কথাটা সিমরানের কাছে ভালো লাগলো। তাই আরেকটা থাপ্পড় বসালো। সাদাত এইবার রাগে গজগজ করতে করতে চড় উঠাতে নিলেই পিছন থেকে কেউ ধরে ফেলে। ছোট্ট ছেলেটি ওই লোকটির কাছে গিয়ে বলল……
—-” ভাইয়া দেখো এই পঁচা লোক ভাবীকে মারতে যাচ্ছে। তুমি এক্ষুনি এই লোকের হাত ভেঙ্গে ফেলো।”
লোকটি সাদাতের হাত মুচড়ে দিয়ে গরম চোখে বলল….
—” একটা মেয়ের কাছে থাপ্পড় খেয়ে লজ্জা লাগলো না আবার থাপ্পড় মারতে যাচ্ছেন। এখন যদি এই মেয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠে আর বলে, আপনি ওকে বিরক্ত করছেন তখন কি হবে জানেন আপনি? পাবলিক এসে আপনাকে এইখানে খুন করে ফেলবে। রাগের বশে কিছু করার আগে আশ পাশটা দেখে নিবেন, ওকে।”
সাদাত লোকটির কথা শোনে তার আশপাশ ভালো করে দেখে লোকটিকে বলল…..
—” ধন্যবাদ আপনাকে। আর সিমরান তোমাকে তো আমি দেখে নিবো বলে দিলাম।”
সিমরানকে হুমকি দিয়ে চলে গেল সাদাত। সিমরানের রাগ এখন আকাশ ছোঁয়া। লোকটির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল…..
—” আপনাকে আমি ভদ্র ছেলে ভেবেছি কিন্তু আপনি তো দেখছি মিচকা শয়তান। আজ আপনার জন্যই আমি পাবলিকের হাতে সাদাতকে মার খাওয়াতে পারলাম না।”
লোকটি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে চোখ দুটি ছোট ছোট করে বলল…..
—” পাবলিক প্লেসে একটা ছেলের হাতে থাপ্পড় খেলে বুঝি খুব ভালো লাগতো। ওকে আসুন আপনার ভালো লাগাটা আমি পূরণ করি। কোন গালে থাপ্পড় খাবেন ডান নাকি বাম?”
—” অসভ্য লোক তো আপনি। এখন বুঝলাম কেন আপনার ভাই আমাকে ভাবী ডাকছে। যার বড় ভাই এমন অসভ্য ছোট ভাই কেন হবে না।”
ছোট্ট ছেলেটি পেন্টের পকেট থেকে চশমা বের করে সিমরানকে চোখ টিপ দিয়ে বলল…..
—” বড় মিয়া তো বড় মিয়া, ছোট মিয়া তো সুবাহানাল্লাহ, ভাবীজান। ভাবী আপনার কোনো বোন আছে আপনার মতো? মানে আপনার মতই পুতুলের মতো তাহলে আমিও ভাইয়ার মতো বিয়ে করতাম।”
এত ছোট ছেলের কথা শোনে সিমরানের চোখ চড়ক গাছ। কি বলে এই ছেলে? এই বয়সে যদি এমন পেকে যায় তাহলে বড় হলে কি না কি করবে। আল্লাহ আল্লাহ বলে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো সিমরান। পিছন থেকে ছোট্ট ছেলেটি সিমরানের নাম আর ফোন নাম্বার চাইতে লাগলো।
সিমরান চলে যাওয়ার পর ছোট্ট ছেলেটি তার ভাইকে বলল…..
—‘ নীর ভাইয়া, দেখো ভাবী চলে গেছে। যাবার আগে এইটাও বলল না তার কোনো বোন আছে নাকি। এই নিবিড়কে এত্ত বড় অপমান করল ভাবী। এইটার প্রতিশোধ তার বোন থাকলে তাকে দিয়েই অসুল করব আমি, হুহহহ। ”
নিবিড়ের কথা শুনে হেসে দিল নীর। ছোট ভাইয়ের মাথায় হালকা চাপড় মেরে বলল…..
—” যাকে তাকে ভাবী ডাকা অফ কর, ডাফর। এমন যদি করিস তাহলে আমি আর এই জীবনে বিয়ে করবো না এমনকি তোরও আর বিয়ে করা হবে না। বড় ভাইয়ের বিয়ে না হলে তো আর ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে না তাই না?”
গাল দুটো টমেটোর মতো করে চোখ ছোট করে কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বলল…….
—” আমি বিয়ে করবো। একা একা পুতুল খেলা, গাড়ি খেলা, কানামাছি, বা যেকোনো কিছু খেলা কি ভালো লাগে? একটা বউ থাকলে বউয়ের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা খেলতে তো পারবো। একা একা বোরিং তো হবো না।”
নীর এইবার পৃথিবী কাঁপানো হাসি দিয়ে বলল…..
—” বাহ বিয়ে করার কারণ তাহলে খেলতে পারা! গুড ভেরি গুড আইডিয়া।”
চলবে…….