এক_কাপ_চায়ে : ০২ লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

0
305

#এক_কাপ_চায়ে : ০২
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

নবীন খু*নাখু*নির মামলা কীভাবে সামাল দিতে হয় জানে না। বলা ভালো, জানতে হয়নি কখনো। এহসানও কিছু বলছেন না। নবীন আমতা আমতা করে বলল,
— “স্যার, পুলিশকে জানালে মনে হয় ব্যাপারটা ভালো হতো।”
এহসান দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ালেন।
— “না, নবীন। তুমি পুলিশি ব্যাপার বোঝো না। আমার ঘরে লাশ পেলে আমাকেই ধরে নিয়ে যাবে।”
— “স্যার লাশ তো এতক্ষণ রাখা ঠিক হবে না? কিছুক্ষণ পর গন্ধ বেরোবে।”
— “সেটাই ভাবছি নবীন। কিছু লোক ঠিক করে গোসল করাতে হবে।”
নবীন চিন্তিত গলায় বলল,
— “স্যার, খুন হলে কী গোসল দিতে হয়? আর মেয়েরা তো এসব রক্তটক্ত ভয় পায়। কাজটা একটু কঠিন হবে।”
এহসান বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন।

নবীন জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। ওর গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।
— “স্যার, আপনার মেয়ের ব্যাপারটা তো কিছু বুঝলাম না। আপনার খারাপ লাগছে না? উনাকে কে খুন করলো আপনার জানতে ইচ্ছে করছে না?”
এহসান চোখ খুললেন না। বন্ধ রেখেই বললেন,
— “নবীন, তোমার ম্যাচিউরিটির প্রয়োজন আছে। কখন কোন প্রশ্ন করতে হবে শেখোনি।”
নবীন গম্ভীর হয়ে গেল। খানিকটা নম্র গলায় বলল,
— “আমি তাহলে আসি স্যার? মা টেনশন করছেন।”
এহসান যেতে বললেন।

নবীনের খুব কৌতুহল জাগলো মনে। নবীনের এখানে তেমন কিছু করার নেই। তবুও স্যার ডেকে ওকে এসব দেখালেন কেন? মেয়ে মরে গেলে মানুষ এত শান্ত থাকে কী করে? কথাগুলোও কী অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। নবীন একপর্যায়ে নিজের চাকরি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ল। চাকরিটা করা আদোও বৈধ হচ্ছে তো?

মানুষের বিশ্বাস এত নড়েবড়ে! সকালে যাকে আপন মনে হলো রাতের ব্যবধানে তাকে ভয়ানক খারাপ মনে হচ্ছে। নবীন বাসায় ফিরেও ঘুমাতে পারলো না। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে আসছে রক্তমাখা মেয়ের লাশটি।

নবীনের বুকের স্পন্দন বাড়ছে। জানালার পর্দাটার উড়োউড়ি দেখেও ভয় লাগছে। যানবাহনের হেডলাইটের আলো দেয়াল পড়ছে। সেই আলোতে প্রতিফলিত হচ্ছে রক্তশূন্য মেয়েটার মুখ। নবীনের গা ঝিমঝিম করতে লাগল।

মন বলছে, জীবনে একটা আপন মানুষ থাকা দরকার। একান্ত নিজের মানুষ। যাকে এমন ভয় পাওয়ার মুহুর্তে আশ্রয় করে পাওয়া যায়। থরথর করে কাঁপা বুকটার উদ্বিগ্নতার খবর বলে শান্ত হওয়া যায়।

এসব কল্পনা বৃথা। ও বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। আফরোজার দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে বলল,
— “মা, নম্রকে দাও। আমার ভালো লাগছে না।”
আফরোজা উঠে এলেন। ওর কপালে হাত ছুঁইয়ে চিন্তিত গলায় বললেন,
— “কী হয়েছে? শরীর খারাপ? আচ্ছা অত রাতে ওখানে গেলি কেন বলতো? চাকরি দিয়েছে বলে কী মাথা কেনা হয়ে গেছে?”

নবীনের হঠাৎই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। মনে মনে বলল,
— “মা, ছেলেদের সব কথা বলার নিয়ম নেই কেন? কান্না করায় বাধা কেন? এত কেন নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেললে আমাদের?”

ওকে হয়ত কেউ বলেনি, পৃথিবীর সব সৃষ্টিকেই নিজস্ব নিয়মে চলতে হয়। নিয়মের বেড়াজালে চলতে হয় বলেই আমরা পৃথিবীতে। বেনিয়মের পথে হাঁটতে শুরু করলে যে আমাদের পৃথিবীটা বিলুপ্ত হতে শুরু করবে!
.
.
পুষ্পকে স্কুলে এগিয়ে দিতে গিয়ে তনু হঠাৎ দেখলো স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে নাদুসনুদুস চেহারার মিষ্টি একটা বাচ্চা। মেইন রোডে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে বারবার। এত সুন্দর মুখের গড়ন! পাতলা ঠোঁট নেড়ে কথা বলছে। বাচ্চা পাগল মেয়েদের এই এক সমস্যা। আদুরে কোনো শিশু দেখলে চুমু খেতে ইচ্ছে করে, কোলে করে বিড়াল ছানার মতো পুষে রাখতে মন নিশপিশ করে। তনু এগিয়ে গেল। তনুর গায়ে সাধারণ ঢিলেঢালা বোরকা, তাড়াহুড়োয় পেঁচানো ওড়না।

বাচ্চাটা চোখ রাঙিয়ে আঙ্গুল উঠিয়ে বলল,
— “এই আমার গাল টানবে না। গাল টানা আমি পছন্দ করি না। চুমুও দেবে না। মেয়ে মানুষ চুমু দিলে আমার লজ্জা করে।”

তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
— “তাই? আচ্ছা যান, ছুঁলাম না, স্যার। আপনার নামটা জানতে পারি?”
— “উসমান গনি।”
— “বাহ্! আপনার নামের অর্থ কত সুন্দর বলতে পারেন? এই নামে আমাদের একজন খলিফা ছিলেন।”
ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। একই কথা শুনতে শুনতে সে বিরক্ত। তিক্ত গলায় বলল,
— “জানি জানি। কী বলবে এখন? ‘উসমান গনি, বিরাট ধনী, ভাত খায় গুনি গুনি’ বলে খেঁপাবে তাই না?”

তনু হাসি থামাতেই পারছে না। এই ছেলেটাকে কীসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মেয়েদের কত বিশেষণ! মায়াবতী, গুনবতী, রূপবতী…ছেলেদের কোনো সুন্দর বিশেষণ হয় না?
তনু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— “আমাদের বাসায় যাবেন? আপনাকে কেউ খেঁপাবে না। আমি সবাইকে বকা দিয়ে দেব।”

নম্র সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি নিয়ে দেখলো তার সামনে থাকা এই সুমিষ্ট ভাষী মেয়েটাকে। ছেলেধরাগুলো এভাবেই বাচ্চাদের পটিয়ে নিয়ে যায়? না। মেয়েটার কথা শুনে মায়া মায়া লাগছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
— “তুমিও কী মায়ের মতো বাইরে চলে যাও? ঘরে সবাইকে একা করে দাও?”

তনু দুদিকে মাথা নাড়াল। নম্র বড়দের মতো সিদ্ধান্ত নেবার ভান করতে লাগল। তনুর ভুবন কাঁপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। একটা শিশু এতটা আনন্দ বয়ে আনতে পারে?
কী ভেবে মাহবুবকে ফোন দিয়ে বলল,
— “এই শুনুন না?”
— “শুনছি, তাড়াতাড়ি বলো।”
— “আমি একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছি, নিয়ে আসি?”
— “কার বাচ্চা?”
— “জানি না।”
— “আশ্চর্য! মানুষের বাচ্চা তুমি নেবে কেন?”
— “কেন নিতে পারি না?”
মাহবুব ঘড়ি দেখল। ব্যস্ত গলায় বলল,
— “আচ্ছা নাও। ওর মায়ের নাম্বার নিয়ে ফোন করে জানিয়ে দিও। এত ছেলেমানুষী ভালো না, মৃত্তি। বাচ্চাটার পরিবার কী মনে করবে তোমাকে?”
— “আরে আমি তো জাস্ট….”

মাহবুব ফোন কেটে দিয়েছে। রাগ করেছে বোধ হয়। রাগারই কথা। কাজের সময় অকাজের কথা কারই বা ভালো লাগে। তনুর ধারণা, ছেলেরা অনেকটা যুক্তি নিয়ে চিন্তা করে। এরা আবেগ কম বোঝে। তনুর ছেলেদের নিয়ে আরো অনেক ধারনা আছে। সেসব এখন মনে নিলে চলবে না।
ও নম্রর হাত চেপে ধরে বলল,
— “আপনার বাসা কোথায়, স্যার?”
নম্র সামনে আঙ্গুল তাক করে বলল,
— “এই বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকি। তোমারটা কোথায়?”
— “কী বলেন! আমিও তো এখানে থাকি। একটু উপরে, চারতলায়।”

তনু বহুদিন ধরে এমন করে খুশি অনুভব করেনি। এখন তো আর ওকে ঘরে নিতে বাধা নেই।
.
.
শুভ অলস দেহে চায়ের দোকানে বসে আছে। ওর পাশে বসে মঈন দিব্বি মনের সুখে সিগারেট ফুঁকছে। শুভর বিরস মুখ দেখে তৃতীয় বারের মতো শুধালো,
— “এই নে, একটা খা। দেখবি সব টেনশন ধোঁয়ায় উড়ে গেছে।”

শুভর ইচ্ছে করলো একটা টান দিতে। কিন্তু নিলো না, পারিবারিক মূল্যবোধ কোথাও টোকা দিলো সতর্কবাণীর মতো। গরম চায়েই চুমুক দিলো এর বদল৷ বেকার ছেলের ঘরে বসে চা খাওয়ার আবদারটা তিতকুটে হয়, শুভর চাইতে ইচ্ছে করে না।

শুভ চা খেয়ে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে হেঁটে বেড়ালো। পরনের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে। টাকা চাইতে আজকাল এত সংকোচ লাগে! রোদে পুড়ে ফর্সা চামড়া বাদামিতে নাম নিয়েছে। ম্যাসেজের টুংটাং শব্দে দেখলো প্রেমিকার ম্যাসেজ,
— “তোমার মতো দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীনের সঙ্গে ব্যাস কথা পর্যন্তই সম্পর্ক রাখা যায়, বিয়ের চিন্তা করা যায় না। এই সম্পর্কের ভবিষ্যত নেই। তুমি ভালো থেক।”

এটুকু হওয়াই বাকি ছিল। শুভ কথা রাখল। হঠাৎ কি ভেবে একবার মসজিদের দিকে গেল। এইবারের ইমাম ছেলেটা ওর বয়সী। দারুণ তার কথা বলার ভঙ্গি। ভার্সিটির ছেলে। বুকের ভেতর খা খা করছে খরার মতো। ও মসজিদের ভেতরে বসে রইল। বেশিরভাগই বৃদ্ধ শ্রেণির লোকজন। শুভ অযু করতে গিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। ওর কেমন লাগছে নিজেই বুঝতে পারছে না।

বহুদিন বাদে মন উজাড় করে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আলাপ হলো। বাসায় ফিরে অর্ধেক খেয়েই বেসিনে গরগর করে বমি করে দিলো। বড় অসুখ টসুখ হয়ে গেলে ভালো হয়। এত সংকীর্ণ জীবন অসহ্য লাগে।

তনু উদ্বিগ্ন হয়ে মাহবুবকে ডাকল,
— “এই, শুভকে মনে হয় ডাক্তার দেখানো দরকার। ও কয়েকদিন ধরেই কেমন যেন হয়ে গেছে।”
মাহবুবের হেলদোল নেই। হেয়ালি গলায় বলল,
— “ওসব দুশ্চিন্তা থেকে হচ্ছে। এই বয়সে সবার হয়, বড় কোনো বিষয় না।”
— “আশ্চর্য! নিজের ভাইয়ের জন্য চিন্তা লাগছে না? এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়?”
— “শোনো মৃত্তি, জীবনকে ওদের চিনির মতো উপভোগ করতে শেখাবা না। মাঝেমধ্যে লবনের গুরুত্বও বোঝাবেন। আমরা তো ওদের পাশে সবসময় থাকবো না।”

তনুর চোখ ছলছল করে ওঠে। এত কঠিন করে মানুষ ভাবতে পারে? একটা মানুষের মনের খেয়াল রাখবে না?

পুষ্পও ভাইয়ের পর খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। শুভ কাঁপা কাঁপা পায়ে বিছানায় বসল। পুষ্প এসে ওর পায়ের কাছে বসে গেল। নিরীহ গলায় বলল,
— “ভাইয়া, তুই এত টেনশন করছিস কেন বলতো? শুন, আমি কদিন বাদেই বিয়ে করে ফেলব, বুঝলি? দেনমোহরের টাকাগুলো তোকে ধার দেব। তুই ব্যবসা খুলে পরে শোধ দিবি।”
শুভর এতকিছুর মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল। তবুও যথাসম্ভব মুখ গম্ভীর রেখে বলল,
— “পুষি?”
— “হুঁ?”
— “আমার পাশে এসে বস।”
পুষ্প পাশে বসতেই ওর মাথায় সজোরে আঘাত পেল। ওর রীতিমত মাথা ঘুরছে। কানে আসলো রামধমক,
— “নির্লজ্জ মেয়ে, তোর শরম করে না বিয়ের কথা বলতে? ছিহ্!”

অতঃপর বালিশ যুদ্ধ শুরু হলো। অনেক পশু-জানোয়ারের নাম জানা গেল। পুষ্প উপরে উপরে অনেক রাগ দেখালেও ওর ভেতরে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। ভাইদের মন খারাপ দেখতে তার এত কষ্ট হয়!

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here