এক_কাপ_চায়ে : ০৩ লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

0
227

#এক_কাপ_চায়ে : ০৩
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

দু’টোর দিকের ক্লাসটা শেষ করে রিকশায় বসতেই হুজাইফার কল৷ মাহবুব কপালে ভাঁজ ফেলে ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটা কাজের চেয়ে অকাজের কথা বেশি বলে।
— “আসসালামু আলাইকুম, স্যার। স্যার! সেই একটা কেস আসছে হাতে। একবার অফিসের দিকে আসবেন?”
— “কেমন কেস?”
— “ভদ্রলোকের মাথা খারাপ। নামিদামী মানুষ তাই ওরা প্রাইভেটলি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে চায়। মাইয়ার লাশ দেইখা পাগল হয়ে গেছে। পুলিশি ঝামেলা চায় না।”
— “তুমি সব ঠিকঠাক খবর নাও। আর যে কল করেছে তাকে অফিসে এসে কথা বলতে বলো।”
— “ওকে, স্যার। রাখি, স্যার। নিজের খেয়াল রাখবেন, স্যার।”

এক বাক্যে তিন-তিনবার স্যার! মাহবুব বিরক্তিকর শ্বাস ফেলল। কড়া রোদে ঝলসে যাচ্ছে চামড়া। ত্বকের মলিনতা নিয়ে উদ্বেগ নেই তার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিকশাচালকটির দিকে। মাঝেমাঝে বেঁচে থাকার এত দুঃখ হয়!

ভাড়া মিটিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখলো তনুর বড় আদরের স্যার মহাশয় মুখ কুঁচকে তার দিকে চেয়ে আছে। মাহবুব পায়ের জুতোজোড়া খুলে ওর গাল টিপে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর দমফাটা চিৎকার।
তনু দৌড়ে ছুটে এলো রান্নাঘর থেকে,
— “আরে! আরে! উনাকে কোনো রকমের ডিস্টার্ব করবেন না। যান, নিজের ঘরে যান।”
মাহবুব হেসে ফেলল।

খেতে বসতে গিয়ে আবার ওর সঙ্গে দেখা।
— “এই বাবু, তোমার কী লজ্জা নেই? মেয়েদের সঙ্গে ঘোরো কেন?”
— “তোমার লজ্জা নেই? তুমি তো মেয়ের সঙ্গে ঘুমাও।”
— “এভাবে অভদ্রের মতো কথা বলছো কেন? এই মেয়েটা আমার বউ হয়। তোমার কী?”
— “আমার ভাবী হয়।”
— “আমি তো তোমার ভাই না।”
— “প্রত্যেক মুসলমান মুসলমানের ভাই, তুমি কী কখনো হুজুরের কাছে পড়োনি?”
মাহবুব আর কিছু বলতে পারলো না। অকালপক্ব নাকি অত্যধিক মেধাবী কে জানে! একা একা খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। শুভকে ডাকলেও বাহানা করে।

একটা বয়সের পর মানুষের আত্মসম্মান কাজ করা শুরু করে। নিজের মানুষদের সঙ্গেও অবস্থান নিয়ে সংকোচ হয়। শুভর জন্য কি করা উচিত ভাবতে ভাবতে অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। মাথাপাগলজনিত ব্যাপারটাও দেখা দরকার।
.
.
— “আপনি বলছেন এই খুনের পেছনে আপনার স্যারের হাত আছে?”
ছেলেটা বিষম খেল এভাবে মুখের ওপর বলাতে।
— “আমি নিশ্চিত না স্যার। কিছুটা সন্দেহ হয়।”
— “যেমন?”
— “যেমন তিনি কখনোই তার মেয়ের ব্যাপারে আমাদের বলেননি। এমনকি কেউই জানতো না। তারপর হঠাৎ যখন লাশ পাওয়া গেল, উনি আমাকে ফোনে বললেন তার ভয় হচ্ছে। অথচ সেখানে গিয়ে দেখলাম তিনি লাশ কীভাবে লুকোবেন সেই চিন্তায় আছেন। এটাই একটু সন্দেহজনক!”

মাহবুব কিছুক্ষণ নিরব থাকল। নবীন আমতা আমতা করে বলল,
— “স্যার আপনাকে সত্যিটার জন্য বলে দিয়েছি। আমার স্যারকে এটা বুঝতে দেবেন না প্লিজ। আমি আসলে উনাকে অনেক বিশ্বাস করি, তবুও আজকাল নিজের মানুষকেই বিশ্বাস করা দায়!”
— “এসব বলতে হয় না। আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটা ব্যাপার, তোমরা খুনের মামলাটা পুলিশকে দিয়ে মীমাংসা করাচ্ছো না কেন?”
— “আসলে স্যারই আমাকে জানাতে দেননি। আজ হঠাৎ বললেন একটা সাইক্রিয়াটিস্ট নিয়ে এসো। তাই এলাম।”

ছেলেটার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে ক্রমাগত। ‘খুন’ শব্দটা অনেকের কাছে সহজ, কারো কাছে নিতান্ত অস্বাভাবিক কিছু। এই ছেলেটা হয়ত সাধারণ ঘরে বেড়ে ওঠা ছাপোষা মায়ের ভদ্র বড় সন্তানটি। তাই বারবার হাঁপিয়ে উঠছে এই শব্দের কাছে। মাহবুব কপাল কুঁচকে বললো,
— “পরে যদি পুলিশি পর্যবেক্ষণে আসে, তখন তো আমাকেও জবাবদিহি করতে হবে। আচ্ছা আমি একবার তোমার স্যারের সঙ্গে দেখা করব। তুমি যাও।”
— “আচ্ছা স্যার।”
— “তোমার নামটা?”
— “নবীন মাহমুদ। স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনাকে পরিচিত লাগছে।”
মাহবুব ডায়েরীতে নোট টুকতে টুকতে বললো,
— “তোমার ছোট ভাইয়ের নতুন একজন ভাবী হয়েছে। সারাক্ষণ তার গল্প করে তোমার কাছে। আমি তার সেই অসাধারণ ভাবীর বর।”

নবীন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। মাহবুব না দেখেই আঁচ করতে পারল। নবীন আর কিছু বলল না। ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

মাহবুব মনে মনে ভাবলো মেয়ের লাশ দেখে একটু ভয় পেয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। বাবাদের জন্য একটু বেশিই স্বাভাবিক। একে রোগের কাতারে ফেলা যাচ্ছে না। তবুও একবার ঘাটানো দরকার। মেয়েকে যদি খুন করে থাকেন তাহলে তা একটু কৌতুহলের বিষয়ই৷

মাহবুব অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে ভাবনা চালিয়ে গেলেও হুজাইফা চোখ বড় বড় করে বলল,
— “স্যার, দেখেছেন আজকাল যা দিনকাল! মেয়েকে বাবা মেরে ফেলছে। কদিন বাদে ওয়াইফ হাজবেন্ডকে খুন করবে। এমনকি করছেও! এসব এখন অহরহ হচ্ছে। কাকে যে বিশ্বাস করব!”
তার চমৎকার খেজুরে আলাপ জমলো না ঠিক। মাহবুব বললো,
— “ভদ্রলোকের বাড়িতে আমরা কাল যাচ্ছি। অবান্তর কোনো কথা বলে বিব্রত করবে না, বুঝতে পেরেছ?”
হুজাইফা ঢোক গিলল।
— “জ্বি স্যার।”

মাহবুব বেরিয়ে গেল। শুভর খোঁজখবর করা দরকার। ছেলেটা আজকাল নাকি ঘরে থাকছে না।
.
.
শুভ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রটির মতো প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদের মতো টেলিফোন করে বলবার মতো নামি-দামি চাকরি পায়নি। ও ইদানীং ঝালমুড়িওয়ালা মামা, চটপটি-ফুচকাওয়ালা চাচাদের সঙ্গে ভাব করছে। বিনা সংকোচে কোনো বেতন ভাতা ছাড়া সহযোগী হয়ে কাজ করছে।
পুকুর থেকে বালতি বালতি পানি এনে দিচ্ছে। তবুও মেয়েগুলোর একহাত হা করে গেলা দেখে ওর ভেতরের সব উগড়ে আসছে। শুভ চিন্তা করলো ওর দোকানে কোনো অস্বাস্থ্যকর পানি দিয়ে খাবার পরিবেশন হবে না। মনে মনে দোকানের নামও ঠিক করে ফেলল।

পায়ের ছেঁড়া স্যান্ডেলটা ফেলে দিলো রাস্তায়। মনে মনে ভাবলো নিজের টাকা আয় করা অব্দি কোনোরকম জুতো পায়ে দেবে না। বিভিন্ন রকম মশলার জাত-নাম রসায়নের বিক্রিয়ার মতো মুখস্হ করে ফেললো। প্রতিটি রান্নাই আসলে একটি বিক্রিয়া। ওর মনে হলো আরো আগেই শেখা উচিত ছিল। এতদিনে তাহলে তার একটা বলার মতো কোনো পরিচয় থাকতো। শুভ অন্যমনষ্ক হয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে লাগলো।

কাল থেকে সে শহীদ মিনারের পাশে ঝালমুড়ির ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিল। ওর অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে হয়ত, তবুও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন দেখা গেলো না। নিজের পরিশ্রমে টাকা কামাই হবে, লজ্জার কিছু নেই।
.
.
তনু বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে, অথচ কোনো দুঃখের ব্যাপার ঘটেনি। রান্নাবান্নার ঝামেলা শেষ। মাহবুবের ফিরতে বোধ হয় দেরি হবে। ওদের বিয়ের প্রায় দুবছর হতে চলল। কিন্তু তনুর মনে হয় ওরা জনম জনম ধরে এক সঙ্গে আছে। জন্মের পূর্ব থেকেই তারা পরিচিত। মধ্যবিত্তের সংসার মানেই অভাব অভাব খেলা। ওরা দুজন মিলেমিশে এই খেলাটা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই খেলছে।

তবুও তনুর মাঝেমাঝে বেশ মন খারাপ লাগে। পুষ্পর পছন্দের জামা কিনে দিতে না পারার আফসোস হয়। শুভর অগোছালো চলাফেরায় ওর এত খারাপ লাগে! শুভর একাকিত্ব অনুভব করা যায়। চঞ্চল মানুষদের একাকিত্ব খুব পোড়ায়। তনু মনে মনে দোয়া করে, শুভর জীবনে চমৎকার কেউ একজন আসুক। ওকে বুঝে নিক ওর মতন করে।

তনু উঠে দাঁড়ালো। আয়নার প্রতিবিম্বটা বেশ বাজে দেখাচ্ছে। তনু গোসল সেরে লালপেড়ে শাড়ি পরে বেরুলো। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। চুড়ি পরলো। গলায় পরলো সোনালি রঙা কৃত্রিম গহনা। চোখের কাজলটুকুতে ভূতের মতো দেখাচ্ছে। কবিদের কথামতো মোহময় কোনো ভাব নিজের কাজলকালো চোখে খুঁজে পেলো না।

আকাশ অন্ধকার দেখাচ্ছে। ঘর জুড়ে কোনো বিদ্যুৎ নেই। পুষ্প স্কুলে। শুভ সাধারণত এ সময়ে বাসায় থাকে না। শ্বশুড়-শাশুড়ি কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। তনু শ্বাশুড়ির যত্নে তুলে রাখা হারিকেনটা ধরালো। একটু ভয় ভয় করছে। হারিকেনের আলোয় তনুকে অসম্ভব মায়াবী লাগছে। তনু অপেক্ষা করতে লাগলো মাহবুবের চট করে মুগ্ধ হয়ে বিষম খাওয়ার।

মাহবুব এসে মুগ্ধ হবার বদলে অবাক হলো। অপ্রস্তুত গলায় বলল,
— “আজ কী কোনো বিশেষ দিন মৃত্তি? আমার কিছু মনে পড়ছে না।”
তনু হাসল।
— “মনে থাকার কথা নয়। আমার ধারণা কিছুকিছু ক্ষেত্রে সত্যি হয়। যেমন ছেলেরা বিশেষ তারিখ তেমন একটা মনে রাখে না। হয়তবা ওদের কাছে ওইদিনের আবেগটুকু মনে রাখার চেয়ে মানুষটাকে সুখে রাখাটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আমি কী ঠিক বলছি?”
মাহবুব হেসে ফেললো এবার। বলল,
— “সারাদিন কী এসবই ভাবো মৃত্তি?”
— “না তো। আরো অনেক কিছুই ভাবি।”
— “যেমন?”
— “যেমন এখন ভাবছি তুমি আমার এসব কথা শুনতে মোটেও আগ্রহী নও। তবুও কষ্ট দিতে চাও না বলেই শুনতে চাচ্ছো। তোমার চোখে এখন ক্লান্তির গোসল, রাজ্যের ক্ষুধা আর ঘুম।”
মাহবুব মুখ থেকে হাসি সরালো না।

গা থেকে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিটা খুলে রেখে বললো,
— “আর আমি ভাবছি তুমি আজকে আমাকে তুমি তুমি করে বলছো। এর কারণ হচ্ছে তুমি সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ভাবতে থাকো, কল্পনা কর। আর তুমি তোমার খুব নিকটতম মানুষদের ‘তুমি’ বলতে অভ্যস্ত। আমাকে সম্মান দিয়ে হয়ত বলো না, কিন্তু মনে মনে খুব কাছের ভাবো। আজকে তুমি তোমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের জন্য শাড়ি পরলে, তার অভিব্যক্তি কল্পনা করতে শুরু করলে, আর বাস্তবেও তোমার কল্পনার মতো আমাদের কথা হলো। তখন তুমি তোমার কল্পনার মতো আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করলে, ঠিক?”

বাহিরে বজ্রঝড় শুরু হয়েছে। সারা দুনিয়া কালো হয়ে ভয়ংকর বৃষ্টি। তনু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। মায়ের ঘরে হয়ত লুকিয়ে থাকবে। লজ্জা পেয়ে ঘর ছাড়ার নিয়ম হয়ত মেয়েদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। মাহবুবের সব চিন্তা হাওয়ায় ভেসে গেছে মনে হলো। প্রফুল্ল চিত্তে তাকিয়ে রইলো জানালায়। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ইচ্ছে করছে। মৃত্তিকে কী একবার ডাকবে?

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here