#এক_কাপ_চায়ে : ০৬
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
— “পরী?”
নবীন মাথা নাড়ালো।
— “তুমি বিশ্বাস করলে?”
— “জ্বীনের অস্তিত্ব হয়, স্যার। কুরআনে আছে।”
— “অস্তিত্বের কথা তো বলিনি। বললাম, তুমি তার কথা বিশ্বাস করলে?”
— “শোনার পর থেকে আমারও ভয় ভয় করছিলো স্যার। রান্নাঘরে কারো হাঁটার শব্দ শুনি, ঘরে মরা মরা বাড়ির গন্ধ পাই।”
মাহবুব চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, “তোমাকে একটা কাজ দেই। করতে পারবে?”
নবীন মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “কী কাজ, স্যার?”
— “খোঁজ নিয়ে দেখো তোমার স্যারের পরী নামে কোনো বান্ধবী ছিল কি না। হুজাইফাও তোমাকে সাহায্য করবে।”
নবীন চুপ হয়ে বসে রইল। মাহবুব জিজ্ঞেস করলো,
— “কতদিন ধরে কাজ করছো এহসান সাহেবের হয়ে?”
— “দেড় বছর হলো, স্যার।”
— “ভাই বলো আমাকে। স্যার, স্যার শুনতে ভালো লাগছে না। তোমার স্যারের ব্যাপারে এমন কিছু কি জানো না, ছোট তথ্য কিন্তু কাজে লাগতে পারে। উনার অসুখ টা কি আসলেই অসুখ নাকি বানোয়াট গল্প বুঝতে পারছি না।”
— “স্যার একটু অদ্ভুত ধরনের, ভাইয়া। যেমন বেশির ভাগ ঘুমিয়ে থাকতেন। না হয় অন্যমনষ্ক হয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন। দুএকটা কথা বলতেন, খাওয়াদাওয়া তেমন করতে পারতেন না। আমি ভেবেছি বয়সের কারণে এমন হচ্ছে।”
— “উনার কোনো বান্ধবীকে আসতে দেখেছ? পরিচিত কেউ আসত না?”
— “না স্যার। তবে ভার্সিটিতে থাকতে আমাদের একজন ম্যামকে নিয়ে গুঞ্জন উঠেছিলো যে, ম্যাম নাকি উনার ছোটবেলার প্রেমিকা। ম্যাম অবশ্য বিবাহিত। ছেলেও আছে উনার।”
মাহবুব সতর্ক হয়ে বসল।
— “ম্যামের নাম কী?”
— “রাহিলা শাবির ম্যাম। ম্যাম, মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। একটু কড়া ধাঁচের। কথাও বলেন কড়া কড়া করে। এই স্বভাবের জন্য সবাই একটু অপছন্দ করত।”
মাহবুব হুজাইফার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো। নবীন, তুমিও একটু খোঁজ নাও গুঞ্জন টা সত্যি কি না। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা এখানে আছে।”
নবীন মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। আমতা আমতা করে বলল,
— “ভাই, চাকরিটা কী ছেড়ে দেব? রুজি রোজগার হালাল না হলে তো সমস্যা। আম্মা মন খারাপ করবে জানলে।”
মাহবুব ওর কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলো।
— “ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে দেখি। তোমাকে এখানে দরকার। রিজিকের চিন্তা করার দরকার নেই। আল্লাহ সাহায্য করবেন।”
.
.
শুভর জন্য সত্যি সত্যি মেয়ে দেখা হচ্ছে। আজকে যাবে দক্ষিণ ক্যাম্পাসে। কোনো এক শিক্ষকের মেয়ে। শুভর বাবা আর সেই ভদ্রলোক নাকি একসঙ্গে শিক্ষকতা করতেন। ছোটবেলায় একসময় প্রতিবেশীও ছিল। শুভ অবশ্য গা দেখাচ্ছে না। মুড়িওয়ালাকে আজকাল কেউ বিয়ে করে না। ক্যাম্পাসের মেয়ে তো সেখানে দিবাস্বপ্ন।
ও সকাল থেকে পুষ্পকে খোঁচাচ্ছে বেজন্মার পরিচয় দেয়ার জন্য। পুষ্প পাত্তা দিচ্ছে না। বরং শুভকে দুটো পাঞ্জাবি দেখিয়ে বলল,
— “দেখতো ভাইয়া, কোনটা সুন্দর?”
শুভ দাঁত চেপে চেপে বলল,
— “তুই আগে নাম বল। শয়তানের বাচ্চাটাকে পুঁতে এসে জেলে যাব। বিয়ের দরকার নেই।”
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভুলে যা, ভাইয়া। মনে কর, কিছু হয়নি।”
শুভ ক্ষান্ত দিচ্ছে না। পুষ্পকে ওকে ঠেলে ঠেলে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলো। আয়নার কাছে দাঁড় করিয়ে বলল,
— “তোকে তো রাজপুত্তুরের মতো লাগছে রে, ভাইয়া।”
শুভ হুতুম পেঁচার মতো মুখ করে বলল,
— “মুড়িকুমারের মতো লাগছে।”
— “সারাক্ষণ এককথা বলিস কেন? কোন পেশা ছোট না। নবিজীও তো মেষ চরাতেন। উনি লজ্জা পাননি, তুই কেন পাবি? মুসলমানদের নেতা হয়ে তিনি মাটি কাটার কাজ করেছেন, তুই তো সামান্য ছেলে।”
শুভ ভ্রু কুঁচকে আয়নার ভেতর দিয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইল। হুট করে হেসে ফেলল। হেসে হেসে বলল,
— “চল মেয়ে দেখে আসি। তোর এত বুদ্ধি কেন রে পুষি? তোর বিয়ে দেব আমরা গাধা ছেলে দেখে। বুদ্ধিমান বরের সঙ্গে বুদ্ধিমতী বউ মানাবে না।”
পুষ্প ওর পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল।
— “আচ্ছা দিস। এখন নিজের বউ দেখে আয়।”
— “বউ তো এখনও হয়নি। দেখবি, মেয়েটা দশহাত ঠোঁটপালিশ দিয়ে মুখ মুচড়ে বলবে, ছিহ্ ড্যাডি, আমি সামান্য মুড়ির দোকানদারকে বিয়ে করব? আর ইউ ম্যাড? মেয়েদের ডিমান্ড সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?”
শুভ অভিনয় করে দেখালো। পুষ্প হাসিমুখে বলল,
— “এত নেগেটিভ ভাবছিস কেন? মেয়েটাকে তোর ভালো লাগবে। চমৎকার মেয়ে।”
শুভর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না ও বিশ্বাস করেছে। যে দিনকাল পড়েছে এখন!
.
.
শুভ ফিসফিস করে বলল,
— “এই পুষি, মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে তো।”
পুষ্প সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “আপু, আপনি আমার ভাইয়াকে চেনেন?”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ। বৃষ্টির সময় স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন দেখা হয়েছিল।”
শুভ চোখ বড় বড় করে ফেলল। অবাক হয়ে বলল,
— “জেনেশুনে মুড়ির দোকানদারকে বিয়ে করবেন?”
পুষ্প ওকে চিমটি দিলো। শুভ ‘উহ্’ করে উঠল। বৃষ্টি হেসে ফেলল। বলল,
— “আপনি কী মানুষ না? সৎপথে টাকা কামানোই আসল। কীভাবে আয় করছে দেখার বিষয় না।”
শুভ পুষ্পকে ফিসফিস করে বলল, “এত ভালো হজম হচ্ছে নারে, পুষি।”
তারপর আবার সোজা হয়ে বলল,
— “আসলে আমি মানুষ বেশি ভালো না। ভার্সিটিতে একটা প্রেমও করেছি। টাকা নেই দেখে ভেঙে গেছে। এখন অবশ্য একটু একটু উপরওয়ালার নিয়মকানুন মানার চেষ্টা করি। কিন্তু ওরকম ভালো কেউ না আরকি।”
পুষ্প শুভর কাছ ঘেঁষে বলল, “ভাইয়া, তোকে অ্যাবনরমাল লাগছে। স্বাভাবিক হ একটু। আপুটা কী মনে করবে!”
শুভ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার। তবুও মনে হচ্ছে অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি নিচু গলায় বলল,
— “আমরা কেউই সম্পূর্ণ ভাবে ভালো হতে পারি না। ভুল থেকে ফিরে আসতে পারলেই হলো। আপনি নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন না, এ বিষয়টাই আমার ভালো লেগেছে। আমাকে পছন্দ হলে, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
শুভ পাঞ্জাবির কলার ফাঁক করে থুতু দিলো বুকে। ওরা নিজেদের বিভিন্ন চাওয়া পাওয়া নিয়ে প্রশ্নোত্তর করল। আদর্শ পাত্রী দেখা। পুষ্প একটু দূরে গিয়ে বসল। ও মিটমিট করে হাসছে। তনুকে ফিরতি বার্তা পাঠালো,
“ভাবী, তোমার জা আসছে। ঝগড়াঝাটি করার জন্য তৈয়ার হও। মেয়ের বাবা বড় ভাইয়াকে বলেছে, ছেলেকে ওদের ভালো লেগেছে। মেয়েও রাজি। ভাইয়ার পা হালকা হালকা কাঁপছে। আমি খেয়াল করেছি।”
তনু হাসির ইমোজি পাঠালো। পুষ্প একটু শব্দ করেই হেসে ফেলল।
চলবে ~