এক_কাপ_চায়ে : ০৯ লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

0
192

#এক_কাপ_চায়ে : ০৯
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

ঘন বৃষ্টির গুমোট ভাব কেটে মস্ত বড় সূ্র্যটা আজ হাসছে। কেবল হাসছে না পুষ্প। গায়ে সাদা রঙের গাউন। প্রশস্ত ওড়নায় ঢাকা অবগুন্ঠনবতী গোলগাল মুখ। চুল মাঝ বরাবর সিঁথি করা।

তনু উঁকি দিয়ে বলল,
— “শোক পালন হচ্ছে?”
পুষ্পর গাল ফোলানো ভাবটা কমলো না। ঘন বর্ষার আবছায়া নিয়ে বলল,
— “ভাবী, আর কোনো ছেলে পেলে না? বেছে বেছে ওই লোকটাকে পেলে?”

তনু হাসলো। পুষ্প খেয়াল করলো তনু হাসার
সময় ভান করে না। ডান গালে হালকা একটু টোল পড়ে যায়। আচ্ছা ভাইয়া কী এটা খেয়াল করেছে কখনো? করার কথা। আবার নাও করতে পারে। একবার নিজের করে পেয়ে গেলে পুরুষদের হয়ত সেই নারীকে আর ভালো লাগে না।

— “তোমার ভাইয়া বলেছে, ও চমৎকার ছেলে। হার্ড ওয়ার্কিং, নরম মনের মানুষ। বাজে কোনো অভ্যাস নেই। তোমার চিন্তার দরকারও নেই। আফরোজা আন্টি বলেছেন, তুমি এখানেই থাকতে পারো। পড়াশোনা করবে, ওর মোটামুটি একটা খুঁটি হয়ে গেলে সমস্যা হবে না।”
— “আর আব্বু?”
তনু টেবিলের উপর বসে পা দুলাতে দুলাতে বলল,
— “আরে সেদিন দেখোনি ওকে পাওয়ার পর নিজের বিয়ের গল্প অব্দি করে ফেলেছে? আমাদের কখনো বলেছিলো? আমরা কথা বলবো না। ওকে?”

পুষ্প খাটের একপাশে বসে রইল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। নবীন চুপচাপ থাকলেও শেষ সময়ে মাহবুবকে ডেকে চুপিচুপি বলল,
— “ভাইয়া? পুষ্প কী রাজি হয়েছে? ওর ইচ্ছা টা তো জানা দরকার, তাই না?”
— “তুমি কথা বলবে?”

নম্রকে ওদের সাথে ছাদে পাঠানো হলো। পুষ্প একবারও চোখ তুলে তাকালো না। নিঃশব্দ রাত্রির মতো হেঁটে গেলো চুপচাপ। না কিছু জানতে চাইলো, না নিজ থেকে কিছু বলল। নবীন ছাদের রেলিঙের উপর হাত রেখে অস্তমান সূর্য দেখতে লাগলো। উদাসীন সময়।

জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে কথোপকথন শুরু করতে চাইলো,
— “পুষ্প একটা গল্প বলি, শুনবে?”

উত্তর নেই।

— “আমি জানি না তোমার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছে বা কী কারণে তুমি আমাকে পছন্দ করো না। কিন্তু জানো, আমাদের সবার জীবনে এরকম নিরব ঘাতকের মতো কিছু বিষাক্ত স্মৃতি থাকে। আমরা চাইলেও ভুলে থাকতে পারি না। তাই আমরা কী অন্যদের তার জন্য দায়ী করে যাব সবসময়? যে কষ্টটা পেয়েছি সেটাকেই তো এর মাধ্যমে বাড়ানো হয়।”

— “যার সঙ্গে হয় সে বুঝে, এমনিতে জ্ঞান দেয়া খুব সহজ, বুঝেছেন? আমার অনেক জ্ঞান আছে, জ্ঞান দরকার নেই।”

পুষ্পর চোখ টলমল করছে পানিতে। নবীন হালকা হেসে ওর দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়লো। পুষ্প দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো তৎক্ষণাৎ। নবীন হেসে বলল,
— “এইজন্য বললাম, একটা গল্প শোনো। আমার গল্প।”

নিরবতা বোধ হয় রাগী মেয়েদের সম্মতির লক্ষ্মণ। নবীন বড় শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,

— “আমার বয়স তখন ১৬ কি ১৭ ছিলো তখন। আমরা তখন গ্রামে থাকতাম। আর গ্রামে তো জানো? চাচী, মামী ধরনের কিছু মহিলা থাকে, খুব বাজে কথা বলে আমাদের বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতো। আমি সবে নিজেকে জানছি, দুনিয়ার ভোল বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু বড় কেউ ছিলো না যে বুঝিয়ে দেবে, এটা এমন না ওমন করে করবে। বাস্তবতা খুব একটা বুঝতে পারতাম না।

ব্যাটবল খেলার পোকা ছিলাম। খেয়াল করতাম, একজন মামী ছিলেন আমাদের, ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে চাইতেন। গায়ে হাত রাখতেন, আমার খুব মাথা গরম হয়ে যেত। উনি মাকে বলতেন, আমি বেয়াদব। মা আমাকে বকা দিতো। খেলা থেকে ডেকে দিয়ে বিভিন্ন কিছুর জন্য বাজারে পাঠাতেন, আমাকে ফ্রি মাইন্ড হওয়ার কথা বলতেন। তোমরা যেমন এখন অনেক কিছু বোঝো, আমরা গ্রামের দিকে থাকায় এসব বোঝার জন্য মাথা খাটাইনি কখনো। নিজের দুনিয়া নিয়ে সবসময় ব্যস্ত।

সবচেয়ে বিশ্রি একটা ব্যাপার ছিলো, এখন বলতে পারব না। শুধু শেষটা বলি। একদিন খুব আপত্তিকর কিছু বিষয় আমি দেখে ফেলি। চলে যাব এসময় উনি খুব জোরে কান্না শুরু করলেন। প্রথমে আমার মা-বাবাকে বললেন, এরপর বললেন উনার হাজবেন্ডকে। উনার হাজবেন্ড প্রায় মনে হচ্ছিলো আমাকে মেরেই ফেলেছিলেন, এই যে চোখে চশমা পড়ি তাই। আমার প্রায় সব আত্মীয় জেনে যায়, আমি উনাকে আপত্তিকর কিছু করেছি। আমার যে মেয়েটাকে বিয়ে করবার কথা ছিলো, সেও আমাকে বিশ্বাস করেনি। এরপর থেকে কখনো মেয়েটা আমার সঙ্গে কথা বলেনি।

কেউ বিশ্বাস করেনি জানো? আমার মা-ও ভাবছিলো, উঠতি বয়সের ছেলে তাই হয়ত ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মেয়েদের প্রতি এত ঘৃণা এসেছিলো তখন! মনে হতো মরে গেলে ভালো হবে। সবার আড়চোখের দৃষ্টি দেখতে দেখতে নিজের উপর অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই কেমন যেন একটা বিহেভ করতো। বাচ্চাদের কোলে নিতে দিতো না। বুঝতে পারছো, কত অসম্মানজনক জীবন ছিল এটা? প্রচন্ড ডিপ্রেশন থেকে উঠে আসি নিজে নিজে। তখন থেকে আমি চিন্তা করতাম, আমার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি, কিন্তু আমি কারো ছায়া হয়ে থাকবো।”

শেষ বিকেলের পশ্চিমা রোদে দুজনের ছায়া পাশাপাশি। নবীনের চোখ ভর্তি মনে হয় এক সমুদ্র কান্না, তবুও শুকনো গাল।

— “চলো আমরা ছায়া হয়ে যাই, পুষ্প? মাহবুব ভাই আমাকে বিশ্বাস করেছে জানো? তুমি কী বিশ্বাস করেছ? এই যে, এই নির্মম সত্যিটা পৃথিবীতে তোমরা দুজন আর সৃষ্টিকর্তা জানেন। আমি তোমাকে কেন বলেছি তুমি কী বুঝতে পারছো?”

পুষ্প অন্যদিকে তাকিয়ে। ওর চোখ টেনে টেনে পানি শুকানোর চেষ্টা করছে। কি আশ্চর্য, কোনোরকম সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এই ছেলেটার জন্য এক বিষন্ন ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলেছে। পুষ্প প্রথমবারের মতো চোখ তুলে তাকালো।

পাশের এই হাতটা শক্ত করে ধরার জন্য হলেও বলতে হবে,”ভাইয়া, আমি রাজি।”
.
.
শুভ একদফা চোটপাট দেখালো। রাগ রাগ গলায় বলল,
— “ভাইয়া, তুমি আমার জন্য পুষ্পকে কেন জড়াচ্ছো? ওকে প্লিজ ছাড়ো। শুধু শুধু কাঁদাবা না।”

মাহবুব প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ঠান্ডা গলায় বলল,
— “তোর জন্য আমি পুষ্পকে কেন কাঁদাবো?
— “তাহলে এসব কী?”
— “তুই চাস তোর বোন আজীবন একটা ট্রমার মধ্যে বেঁচে থাকুক? ওর কী সুস্থ ভাবে বাঁচার, চিন্তার অধিকার নেই? স্বাভাবিক পরিবেশকেও অস্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে। ওর এজন্য একটা মানসিক শান্তির জায়গা দরকার। নবীনের ব্যাপারে সব জানার পর, আমার মনে হয়েছে ও ভালো একটা ছেলে। আজ চাকরি পায়নি, কালকে পাবে! শুধু শুধু লেইম একটা বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে নেই। আর পুষ্প খুব নারাজ হলে ওকে তো জোর করব না আমি।”

শুভ মুখ ভোঁতা করে বলল,
— “দেখছো না ও কেমন করছে?”

মাহবুব হাসলো।
— “আসলে এটা মেয়েদের সাধারণ আচরণ। ও কী তোকে এসে বলবে, না আমি বিয়ে করব? প্রথমে একটু চোটপাট দেখায়, ব্যাপার না। দেখিস একটু পর রাজি হয়ে যাবে।”

ঠিক তখনি পুষ্প দরজা দিয়ে ঢুকলো ঘরে। হাসিমাখা মুখ। শুভ অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।
.
.
নবীন আগে নেমে চলে এলো। পুষ্প এলো পেছন পেছন। ঘরে উৎসবমুখর পরিবেশ। মা ব্যস্ত হাতে এটা ওটা করছেন। তনু ভাবী বোধ হয় ভেতরে। নবীন শুভর পাশে গিয়ে বসলো। শুভ হাসিবিহীন চেহারা নিয়ে বলল,
— “কী বললি ওকে? সামথিং স্পেশাল?”

নবীন মুচকি হাসলো। শুভ খেয়াল করলো এই ছেলেটা দেখতে কিছুটা আদুরে। কিছু কিছু ছেলেদের যেমন পেলে কাঁধের উপর হাত দিয়ে খোশগল্প করা যায়, ঠিক তেমন। কোনো নিয়মনীতি মানার ভয় নেই। এই প্রথম ‘তুই’ করে সম্বোধন করার পরও অবাক হয়ে তাকায়নি।

নবীন বলল,
— “এটা তো সিক্রেট, ভাইয়া। বলা নিষেধ।”
— “সিক্রেট হবে কেন? আমার বোন কে কী ধমকধামক দিয়ে রাজি করিয়েছিস জানতে হবে না?”
— “আমার অত সাহস আছে? আপনার মতো বাহাদুর বড় ভাই যার আছে, তাকে কীভাবে ধমক দেব?”

শুভ ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “সবাইকে পটানো শেষ, এখন কী আমার সঙ্গে ফাতরামি করা শুরু হয়েছে?”
নবীন চোখ বড় বড় করে তাকালো।
— “আস্তাগফিরুল্লাহ্। আমি কখন কাকে পটালাম?”
শুভ প্রশ্ন ঘুরিয়ে বলল,
— “তোর চোখ লাল লাল দেখাচ্ছে কেন বলতো? সিগারেট খাস নাকি কেঁদে কেটে বউ রাজি করালি?”
নবীন এবার শব্দ করেই হাসলো। চোখের পাশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শুভ কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে চেয়ে রইলো তার পানে, যদিও তার ভালো লাগছে।

এদিকে নম্র নিচে গিয়ে বলল,
— “আম্মা, এতক্ষণ তো শুধু ভাবী কাঁদছিলো, এখন ভাইয়াও কাঁদছে। তুমি ভাইয়াকে বলো, আমরা তাকে শশুর বাড়িতে পাঠাবো না।”

পুষ্প হেসে ফেলল। তনুর কাঁধে মাথা রাখলো নিশ্চিন্তে। ফিসফিস করে বলল,
— “ভাবী, আমার বিয়েতে কী উপহার দেবে?”
তনু অবাক হয়ে বলল,
— “তুই রাজি হয়ে গিয়েছিস? ও মাই গড!”

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here