#এক_কাপ_চায়ে : ১৫
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
আবহাওয়া আজ সহনীয় মাত্রায়। পুষ্প ফিরে এসেই শুভর ঘরে উঁকি দিলো। জানালার পর্দাগুলো দুলছে হাওয়ার স্পর্শে। শুভ মাথা নিচু করে বসে আছে। পুষ্প উদ্বিগ্ন হয়ে ওর কপালে হাত রেখে প্রশ্ন করলো,
— “ভাইয়া, তুই ঠিক আছিস?”
শুভ মুখ তুলে তাকালো৷ চোখ টেনে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল,
— “তোর মনে আছে আমরা মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম একবার?”
পুষ্প বিভ্রান্ত হয়ে মাথা নাড়লো। শুভ জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “তারপর কী হয়েছিল?”
পুষ্প কয়েকবার চোখের পলক ফেলে মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
— “ওরা তো মানা করে দিয়েছিলো আমাদের। বলেছিল, তোর চাকরি বাকরি নেই। এজন্য….”
শুভ পলকহীন তাকিয়ে রইলো অস্পষ্ট দৃষ্টিতে। কি যেন হয়ে গেল ওর। বহুকষ্টে উচ্চারণ করলো,
— “মেয়েটার নাম কী ছিলো?”
— “নওরিন।”
শুভর নিজেকে বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেলো। পুষ্প দিশেহারা বোধ করলো। ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আজ আবারও ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘহীন নীলাকাশ দেখে কবি কবি গলায় বলতে ইচ্ছে করছে,
“সুখকে খুব কাছ থেকে ছুঁতে চাইলাম,
সুখ আমাদের সঙ্গে আড়ি কাটলো।”
.
.
বাবুল ধরা পড়েছে। লিখিত স্বীকার উক্তিতে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ সে দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে,
হত্যার দিন এহসানের স্ত্রী মুক্তাকে চেয়ার থেকে ধাক্কা দিয়েছিলেন এহসানের প্রেমিকা পরী নামের কেউ একজন। তার ধারণা ছিলো, স্ত্রী মারা গেলে এহসানের সম্পত্তি শুধু তারই প্রাপ্য। মুক্তার আহত দেহকে সুইসাইডের রূপ দিতে তার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া সিলিং ফ্যানের সঙ্গে। বাবুল ও এহসান খুনের প্রত্যক্ষদর্শী। বাবুল ফরমায়েশ অনুযায়ী চাপাতি দিয়ে দড়ি কাটার সময় মুক্তার গায়ে লেগে যায়। টেবিলের পায়ায় রক্তের উৎস সেখান থেকেই।
এই ঘটনার পর অনেকটা সময় পরীর যাতায়াত বন্ধ ছিলো। এহসান বেশ কায়দা করে সামাল দিলেও সূক্ষ্ম অপরাধবোধ তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। শেষ যেদিন এহসান তাকে ডাকেন সেদিন মুক্তার পালিত কন্যা দেশে ফিরেছিলো। মায়ের পুরোনো স্টাডি রুমে গিয়ে ডায়েরি পেয়েই সে এহসানের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরী রাগের বশে ফুলদানি দিয়ে আঘাত করে মেয়েটার মাথায়। অধিক রক্তক্ষরণে মেয়েটার মৃত্যু হয়। এহসান কিছু বুঝে উঠতে পারেননি তৎক্ষনাৎ। বাবুল গিয়েছিল দেশের বাড়িতে। কিছু না বুঝে কল দিয়ে ফেলেন নবীনকে। সম্ভবত এটিই ছিলো তার মস্ত বড় বোকামি।
এহসান নিজের জবানবন্দিতে বলেছেন,
এসবকিছুই তিনি করেছেন রাহিলাকে ছোট করার উদ্দেশ্যে। যুবক বয়সের প্রত্যাখ্যান তিনি মেনে নিতে পারেননি। ভার্সিটিতে বদনাম রটিয়েও যখন রাহিলাকে নির্বিকার দেখালো, তিনি জেদের বশে পরী নামের এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যান।
মুক্তাকে তিনি কখনোই পরোয়া করেননি। মুক্তার শক্ত কোনো খুঁটি ছিলো না। ভাইয়ের সংসারে ফিরে গিয়ে বোঝা হওয়ার চাইতে এহসানের সঙ্গে থাকাকেই সে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করতো। মুক্তা তৈরি করেছিলো নিজস্ব আলাদা জগৎ। সে জগতে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি লেখালেখিও করতো সে। প্রমাণস্বরূপ ডায়েরিটি পাওয়া যায়নি। বাবুল সেটি বাগানে পুড়িয়ে ফেলেছিলো।
মইনুল হিসেব মিলিয়ে দেখলো, মুক্তার মেয়ে ডায়েরির সন্দেহজনক কিছু পাতা ছিঁড়ে কুরআন শরীফে সংরক্ষণ করে রাখে। সে যেন বুঝতে পারছিলো তার সঙ্গে ভালো কিছু হবে না। থাইগ্লাসে লেখা “Qu” তারই সংকেত। আলমারির উপরে কুরআনের ভাঁজে পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া গেছে।
মুক্তার জামাতা স্ত্রীর জন্য মিসিং কেস ফাইল করেছিলো। সহস্র ফাইলের ভীড়ে পড়ে আছে অবহেলায়। মা-মেয়ে নিঃশব্দ মধ্যরাতের মতো বিদায় নিয়েছিলো পৃথিবী থেকে। কী আশ্চর্য! মুক্তা তার নাম হলেও, কেউ যত্ন করে আগলে রাখেনি ঝিনুকের আবরণে। পৃথিবীতে সকলে আপন মানুষ পাওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে আসে না।
মাহবুব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের ঘরের অবস্থা ঠিক থাকলে সে এহসানের সঙ্গে একবার দেখা করতো নিশ্চয়ই। ফোন রেখে একবার সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষ্মণগুলো দেখতে লাগলো। এই রোগে মানুষ কল্পনা ও বাস্তবের পার্থক্য ধরতে পারে না।
.
.
তিন ভাইবোন মিলে বসে আছে ডাঃ ওমর কান্তির চেম্বারে। মাহবুব ভেতরে এলো না। শুভর থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবই জিজ্ঞেস করলেন উনি। পুষ্প কল্পনা ও সত্যি আলাদা করে দিলো। শুভ একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকালো না। মাথা নিচু করে থাকলো পুরোটা সময়।
ডাক্তার শুভর দিকে তাকিয়ে খুব স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন,
— “শুভ?”
— “হুম?”
— “বৃষ্টির কোনো আসবাব তুমি তোমার ঘরে পেয়েছ? তিনবাস যাবত বউ তোমার, কোনো ছোট জিনিসও কিন্তু পাওয়া যায়নি। গিয়েছে?”
শুভ কিছু বললো না। ওর কাঁধে হাত রেখে ডাক্তার আবার বললেন,
— “তুমি যেই বৃষ্টিকে দোকানে দেখেছিলে, ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলে, তাই না?”
শুভ চুপ করেই থাকলো।
— “তোমার ভাষ্যমতে মেয়েটা বোরকা, নিকাব পরে ছিলো। তাই নওরিনকে দেখে তোমার চেনা চেনা লাগার বিষয়টাও তোমার মনঘটিত। তুমি কী আমার কথা বুঝতে পারছো?”
ওদের দুজনকে বাহিরে বসতে বলে মাহবুবকে আসতে বললেন।
মাহবুব বসতেই তিনি চশমাটা খুলে রাখলেন পাশে,
— “দেখুন, মাহবুব সাহেব। উনার ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক। ভার্সিটির শেষ দিকে সবার চাকরি বাকরির জন্য প্রেশার কিন্তু আমাদের ছেলেদের জন্য একটা খারাপ সময়। এর ওপর উনার প্রেমিকাও ছেড়ে চলে যায় এই অজুহাতে। ঘরে তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না। এই অবস্থায় সুইসাইড করার চিন্তা চলে আসে অনেকের। তিনি হয়ত ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে সাহস করেননি।
কিন্তু এমন একজনকে কল্পনা করতে শুরু করেন, যে মেয়েটা তার খারাপ সময়ে পাশে থাকবে। উনি যখন ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দে থাকবেন, তখন তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দ্বিধা দূর করে দেবে। এটা তার মনের সঙ্গেই মনের যুদ্ধ।
আপনাদের উচিত ছিলো তাকে এই সময় সাহস দেয়া। ভালোবাসা দেয়া। যত্ন নেয়া। দিনশেষে আমরা সবাই একটু যত্নের কাঙাল।”
পুষ্প চেম্বারের বাইরে বসে শুভর ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো। তার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘Married’ দিয়ে রেখেছে। বন্ধুদের অভিনন্দন বার্তায় ভরে আছে ইনবক্স। পুষ্প শুভর হাত শক্ত করে ধরে বসে রইলো।
.
.
রাত বাড়ছে। পুষ্প, নবীন, শুভ শুয়ে আছে আলাদা বিছানায়। টপ টপ করে শুভর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। শুভ হাত দিয়ে পানি মুছে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। চোখের পানি মুছে দেয়ার জন্য আলাদা কোনো মানুষ থাকে না।
স্বত্তাগতভাবে পৃথিবীর সকলে একা। ভালোবাসার মানুষ, জীবনসঙ্গী কিংবা পরিবার কেউ এই একাকিত্বের ভার নিতে আসে না। দুঃখগুলো একান্ত নিজের। অপরজন চেয়েও পুরোপুরি তা বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু দুঃসংবাদ হলো, অনেকের সেই একজনও থাকে না।
রাতের আকাশটা পরিচ্ছন্ন খুব। নক্ষত্রের আকাশ দেখতে দেখতে শুভ আফসোস করতে লাগলো, যদি সে তারা হয়ে জন্মাতো! তিন অক্ষরের মানুষ শব্দটা এত বিষাক্ত কেন?
উপরতলা আর নিচতলার যুগলের ঘরেও আজ অশান্তি। উভয়পক্ষ ভাবছে, ইশশ সে যদি আমায় আমার মতো করে বুঝতো! অনিদ্রায় কেটে যায় রাত। মুয়াজ্জিন করুণ স্বরে ডাকতে থাকে, “ঘুম থেকে নামাজ উত্তম!”
অবাধ্য মনগুলো কাঁদে। স্রষ্টা ব্যতীত তাদের কেউ বোঝে না তো!
চলবে ~