এক_কাপ_চায়ে : ১৬ লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

0
217

#এক_কাপ_চায়ে : ১৬
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

বিষন্ন বিকেল কেটে যায়। হাসিখুশি রোদ মেখে আসে সকাল। শুভ কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে অনেকটা সুস্থ। ও রেস্তোরাঁ গড়ার কাজে শক্ত করে হাত লাগাচ্ছে। নবীনেরও একটা নতুন চাকরি হয়েছে। বেতন ভালো। মাহবুব সকাল সকাল বেরিয়েছে আজ। প্রায় অনেকদিন পর ওর মনে হলো, একবার এহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা করা যাক।

এহসান সাহেবের হাল-তবিয়ত ভালো নয়। জেলে কেউ ভালো থাকার জন্য আসে না। মাহবুব হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। নম্র গলায় বলল,
— “কেমন আছেন?”
এহসান মুখে হাত রেখে খুক খুক করে কাঁশলেন। ভাঙা গলায় বললেন,
— “ভালো।”
— “কেন করেছিলেন এসব?”
মাহবুবের দৃষ্টিতে কি যেন ছিলো! এহসান সাহেব মিঁইয়ে গেলেন।
আনমনা হয়ে ধীরস্থির কন্ঠে বলতে লাগলেন,
— “জানো মাহবুব, মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন সে ঠিক ভুলের বাছবিচারের যায় না। জীবন যেভাবে চলে, তার স্রোতে হারিয়ে যায় স্রেফ। ঠিক-বেঠিকের সংজ্ঞা মাথায় কাজ করে না। বরং, কেউ শুধরে দিতে আসলেও তাকে অসহ্য লাগে। আর যখন ভ্রম কেটে যায়, তখন মনে হতে থাকে, আসলে এসব আমি কেন করেছি? কী পাওয়ার আশায়?”

মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার হাতের উপর হাত রাখলো। এহসান সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলল,
— “আমাদের আশেপাশে কোকিলের সংখ্যাটা বেশি, বুঝলেন এহসান সাহেব? কাকের কন্ঠটা কর্কশ, কিন্তু অন্তত বাচ্চাদের অন্যের ঘরে রেখে আসে না। কোকিলের কন্ঠে আমরা মুগ্ধ হই, তাই বলে কোকিল আমাদের ডেসটিনেশন হতে পারে না। আপনার খুব বড় অপরাধ ছিলো নিজের স্ত্রীকে এভাবে অপমান করা। তার ভালোবাসা, সংসার জীবন বেছে নেয়াকে অপমান করেছেন আপনি। তার দোষ ছিলো, সে পরী নামের মেয়েদের মতো ছলনা করে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়নি। আর এমন একজন অপরাধীকে আমার পক্ষে মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব ছিলো না। I am not sorry for that!”

এহসান সাহেব কাঁদছেন। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে আসা এই পুরুষটির কান্না দেখে মাহবুবের মায়া লাগলো না। তার স্ত্রীও সম্ভবত এভাবে কেঁদেছিলেন অনুশোচনায়। নিজের ভাগ্যের অনুশোচনায়।
.
.
পুষ্প ভয়ে ভয়ে আজ নবীনের ঘরে পা রেখেছে। নবীন সেবার কথা কাটাকাটির জের ধরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। প্রয়োজন ছাড়া একটা শব্দও বের হয়না ওর মুখ থেকে। বিকেল তিনটা নাগাদ ঘরে ফিরলো সে। পুষ্প ওর বিছানার একপাশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। হাতে বই, “দুজন দুজনার”।

নবীন হেসে ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে পাশের টি-টেবিলে রাখলো। ওমনি চোখ মিটমিট করে মেলে তাকালো মেয়েটা। নবীন স্বাভাবিক চেহারায় পোশাক নিয়ে গোসলে গেলো। পরিপাটি হয়ে বের হতেই দেখলো, পুষ্প ভাত তরকারি সাজাচ্ছে। গামছা ব্যালকনিতে মেলে দিতে দিতে বলল,
— “চাকরি হয়ে গেছে আমার, তোমার আর অবস্থা সাপেক্ষে বিয়ের জন্য মন খারাপ করতে হবে না।”

পুষ্প আঁতকে ওঠা চোখে তাকালো। আজতক মনে রেখে দিয়েছে কথাগুলো। এইদিনের জন্য?
— “আপনি ভুল বুঝেছেন সেদিন। আমি এরকম কিছু বলতে চাইনি।”

নবীন মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো।
— “একদম ঠিক বলেছো তুমি। আমার চাকরি বাকরি নেই। তার ওপর নারী কেলেঙ্কারি। নিজেকে রক্ষার যোগ্যতা নেই। তোমাকে পেয়েছি ভাগ্যগুনে। এখন বলছি, আমার না এত দয়ার দরকার ছিলো না, পুষ্প। তুমি সাহসী, বুদ্ধিমান, বড়লোক সবদিক থেকে পারফেক্ট একটা হাজবেন্ড খুঁজে নিতে পারো। আমি তো সামান্য ছেলে, চাইলে ডিভো…”

“চুপ করুন আল্লাহর ওয়াস্তে”, পুষ্প ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। থেমে থেমে বলতে লাগলো,
— “আপনি শুধু শুধু নিজেকে ছোট ভাবছিলেন। আমি স্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেছি শুধু। ওই মহিলার ব্যাপারটা নিয়ে আপনার কিছুই করার ছিলো না। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের কৌশল ভালো ধরতে পারে, সেখানে আপনি উনাকে রিচ করতেন কীভাবে? আর আপনি এই বদনামের দায় নিয়ে কীভাবে সারাজীবন বেঁচে থাকতেন?

ভবিষ্যতে আপনার বাচ্চারা যখন হেঁটে যেত, কেউ হয়ত ফিসফিস করে বলতো, তোর বাবার ক্যারেক্টারে প্রবলেম ছিলো। আপনি বুঝতে পারছেন, এটা কত বড় একটা ট্রমা হতে পারতো ওদের জন্য? আমি নিজেই একটা ট্রমা ফেইস করে বড় হয়েছি, আপনার কেন মনে হয় আমি দয়া করছি আপনাকে?
এটা বড় কোনো কাজ ছিলোই না। জাস্ট ওই মহিলা বোকা ছিলো, তাই ধরতে পারেনি।

আমিও তো বলতে পারি আপনি আমাকে দয়া করেছেন বিয়ে করে। আমাকে কে বিয়ে করতো এসব জেনে? আমারও দয়া চাই না। আপনি একটা সুইট কিউট মেয়ে খুঁজে নিন, আমার খুঁজতে হবে না।”

পুষ্পর মুখটা লাল হয়ে আছে কান্নায়। ও বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে। নবীন কিছুক্ষণ নিরবতা পালন শেষে বলল,
— “এই তোমরা খুব ট্রিক শিখে আসো না? জানো, একটু কান্নাটান্না করলে আর রেগে থাকতে পারি না।”

পুষ্প রাগী চোখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। নবীন হাত ধরে ফেললো।
— “আরে দাঁড়াও! একটা কথা বলে যাও। তুমি তো আমি সহ কোনো ছেলেদের একদমই সহ্য করতে পারো না, আমার আগাম বাচ্চার জন্য এত চিন্তা করেছো ফের? সিস্টেম কী একটু নড়ে গিয়েছে? আই মিন, মনের সিস্টেম? মেইবি জাস্ট ফর মি?”

পুষ্পর চেহারায় পরিবর্তন এলো না। হাত ছাড়িয়ে শুধু নবীনের ঘরটাই ত্যাগ করলো, শশুড়বাড়ি নয়।
.
.
শুভকে জোর করে পুনরায় বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এবার সত্যি সত্যিই। ঘরসুদ্ধ লোক এই বিয়েতে উপস্থিত। পুষ্পর আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। নিয়ম কানুন পালনে একনিষ্ঠতা দেখিয়ে শুভকে মানতে বাধ্য করতে লাগলো। শুভ সেই পুরোনো ক্ষতের জের ধরে বউয়ের মুখ অব্দি দর্শন করলো না।

কৃত্রিম রোবটের মতো বিয়ে করলো সে। নবীন ওর পাশে বসে ফিসফিস করে বলল,
— “ভাইয়া, বিয়ে ছেলেদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। এইদিন ছেলেরা যতরকমে হাসা যায় হাসবে, অবশ্য শুধু বিয়ের দিনই। এরপর শুধু স্ত্রীরা হাসবে।”

শুভ চোখ গরম করে তাকাতেই ঠোঁট এলিয়ে বলল, “আমি খুব হাসছি দেখুন এখনও! টাফ কোনো ব্যাপার না। অল ইজ ওয়েল।”

পুষ্পকে দেখাচ্ছে পরীর মতো। সে প্রানবন্ত ঠিক বৃষ্টি পরবর্তী পরিবেশের মতো। সিরাজ সাহেব মেহমানদের সঙ্গে খোশালাপে মত্ত। রাবেয়া দাঁত মুখ খিচে সবাইকে গালাগাল করছেন। তনু ব্যস্ত হাতে কাজ করছে। মাহবুব তাকে ডেকেও পাচ্ছে না। ওকে দেখেই বলে উঠলো,
— “মৃত্তি, বুঝলাম না। পুরো ঘরের খেয়াল রাখতে পারো, আর যার খেয়াল রাখার জন্য তোমাকে এনেছি তার প্রতি কোনো মনোযোগ নেই?”

অভিমানী সুর দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স খুব কম। নিতান্ত বালক সে। অথচ, ঘরের লোকের চোখে সে’ই সবচেয়ে রাগী অভিভাবক। তনু মিষ্টি হাসলো। সেই পুরোনো টোল জায়গা করে নিলো গালে। এই মেয়ের উপর রাগ করা যায়?

বিয়ে শাদীর পর্ব শেষ হলো। বউকে বরের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। নবীন পুষ্প বেশ ধাক্কাধাক্কি করে শুভকে ঘরে পাঠালো। যাওয়ার আগে অভিজ্ঞ বিবাহিত যুগলের ন্যায় উপদেশও দিলো। পুষ্প নাক কুঁচকে বলল,
— “উনার কথা বাদ দে তো ভাইয়া। তুই আমার কথা শুন।”
নবীন গম্ভীর চাহুনি দিয়ে বলল, “আমার দাদা বলতো, যার বউ যত বেশি চালাক সে তত তাড়াতাড়ি মরে। সাচ্চা কথা।”

শুভ ওদের নাটক থেকে মুক্তি পেতে নিজেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার বউ একহাত ঘোমটা ফেলে বসে আছে। শুভ ওর সামনে বসে বলল,
— “তোমার নামটা যেন কী?”
— “মিতু।”

পরক্ষণেই মৃদু গলায় বলল, “ভালো নাম, বৃষ্টি আহসান।” শুভ শুনতে পেলো না। বাহিরে আজ সেই প্রতিক্ষীত পূর্ণিমা রাত। তনু তারিখ বেছে মাহবুবকে আবদার করেছিলো বিয়েটা যেন পূর্ণিমা রাতেই হয়। চাঁদের আলোর হালকা আলো বিছানায় তেরছাভাবে পড়ছে। শুভ ঘুমিয়ে আছে নির্বিকার চিত্তে। বৃষ্টি অবাক হয়ে দেখছে তাকে। বাসর ঘরে ঢুকে ধপ করে ঘুমিয়ে পড়লো ওর বর, অথচ দাদী ওকে কি সব কথাই না বলছিলো!

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here