এক_কাপ_চায়ে : ১৭ (শেষ) লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

0
388

#এক_কাপ_চায়ে : ১৭ (শেষ)
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ

বৃষ্টি বুঝতে পারছে ওর স্বামী ওকে খুব একটা পছন্দ করছে না। বিশেষ করে ওর নাম শোনার পর মুখ অমাবস্যার মতো করে বলেছিলো নাম বদলে ফেলতে। হুট করে জন্ম নিবন্ধন কার্ড বদলে ফেলা মুখের কথা? বৃষ্টি নামটা কী এমন খারাপ হলো?

ওর এক বান্ধবীর নাম ছিলো বেদানা। কই তাতে তো ওর বর মনখারাপ করেনি। বৃষ্টি মুখ কালো করে বসে রইলো। শুভর সঙ্গে ওর রোজ ঝামেলা হচ্ছে। শুভ যেন ওকে সহ্যই করতে পারছে না। সব কাজে নাক একহাত বাড়িয়ে ভুল ধরার জন্য বসে থাকে।

পুষ্প ওর কালো মুখ দেখে টেনে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো। তনু মিলে ওকে গান গাইতে বলল। জীবনে বিনোদন দরকার আছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে বৃষ্টির গান শোনার জন্য। মাহবুব বাসায় নেই, তাই সে গলা ছেড়ে গান গাইবে। বৃষ্টি অযথাই চোখ মুছে বললো,
— “প্রিয় শ্রোতা, আমি এখন একটি দুঃখের গান গাইবো, আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে দেখুন।”

নিজের শুষ্ক চোখ দুটিতে থুতু মাখালো। পুষ্প নাক কুঁচকে তাকালো। বৃষ্টি নাক টেনে টেনে বিলাপ ধরলো,
— “আমার মনের মানুষ
বন্ধু তুমি হইলা না,
জ্বালাই গেলা বুকের আগুন,
বন্ধু নিভাই গেলা না।”

শুভ নিজের ঘর থেকে কাককন্ঠী গান শুনে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বললো,
— “এই এই কুত্তাগুলা পুকুরে ঝাঁপ দিলো রে, দিলো। নিরীহ কুত্তাগুলারে আর এই গলা শুনায়ো না দয়া করে। মশাগুলা কয়েল ছাড়া মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে।”

বৃষ্টি চোখ মুছে যাচ্ছে। অথচ চোখে পানির ছিঁটেফোঁটাও নেই। চোখ মুছতে মুছতে ঘরে গিয়ে বললো,
— “মরলে তো ভালোই। আপনার কয়েল কেনার টাকা বাঁচলো। ভাগ্য নিয়ে এসেছে আপনার বউ।”

ঝগড়ার একপর্যায়ে ও ঠিক করলো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এই লোককে নিজের মুখ দেখাতে চায় না আর। শুভর মায়া লাগলো ওর কান্নাকান্না মুখ দেখে। সরাসরি কিছু বলতে পারলো না আর।
.
.
বৃষ্টি বিয়ের পরে একদিন খুব শখ করে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো। দুটো চায়ের কাপ একসঙ্গে ছবিতে, আর ক্যাপশনে লিখেছিলো,

“When I’m with you, I feel a little more happy, a little sad. Why my heart always singing the same song, “I Love You”. Do you feel the same?”

একমাত্র শুভই সেখানে হাহা রিয়েক্ট দিয়েছে। ওর প্রতিটা ইমোশনাল পোস্টেই শুভর একটা প্রতিক্রিয়া, হাহা। বৃষ্টি সেসব মনে করে কাঁদতে লাগলো। বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। না কোনো কল, না ফিরে যাওয়ার অনুরোধে করা বার্তা। কী নিষ্ঠুর মন তার!

তনু, পুষ্প, রাবেয়া সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। যার সাথে কথা বলার বাধ্যবাধকতা, তার কোনো খোঁজ নেই। বৃষ্টির চোখে পানি উপচে উঠলো যেন। মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো সে। মা বলতো, প্রেমের বিয়েতে শুদ্ধ ভালোবাসা নেই। ওর তো প্রেমের বিয়ে না, একটু অশুদ্ধ ভালোবাসাও তার বর দিচ্ছে না তাকে। বৃষ্টি ফেসবুক আইডি ডিএকটিভ করে দিলো। মন খারাপ হলে এই কাজটা করতেই তার ভালো লাগে।
.
.
আজ ছুটির দিন। মাহবুব তনুকে ডেকে দুকাপ চা করতে বলল। মাঝেমাঝে চা বিলাস খারাপ নয়। সে যদি নিজের মিষ্টি হাসির স্ত্রীর সঙ্গে হয় তাহলে তা মন্দ হবার প্রশ্নই আসে না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তনুর গালের হালকা টোল মনোযোগ দিয়ে দেখা যাবে। অনায়াসে পার হয়ে যাবে এক কাপ চায়ে যুগলবন্দী সন্ধ্যা।

চায়ের দিকে চেয়ে দেখতেই হঠাৎ মুক্তার লেখা ডায়েরীর কথা মনে হতে লাগলো। চা নিয়ে মুক্তা উদাহরণ টেনে লিখেছিলো,
“মানবজীবন এক কাপ চায়ের উড়তে থাকা ধোঁয়ার মতো ক্ষনস্থায়ী। ধীরে ধীরে চা ঠান্ডা হতে থাকে, নিথর হয় আমাদের দেহ। গরম থাকতে থাকতেই জীবনের পাথেয় যোগাড়ের চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। চায়ের উষ্ণতার বিভ্রমে অনেকেই ভুলে যায়, চা-টুকু ঠান্ডা হতে চলেছে।”

গভীর উপলব্ধি! মুক্তা পাথেয় যোগাড়ে বেশ এগিয়ে ছিলো। মাহবুবের মন খারাপ হতে লাগলো। পরীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। সে এহসান সাহেবের সম্পত্তি খসিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছে। মাহবুবের ধ্যান ভাঙলো তনুর গুনগুন করা গানে।

“আকাশ এত মেঘলা, যেও না’ক একলা,
এখনি কী নামবে অন্ধ…কা…র?”

মাহবুব হেসে বলে উঠলো, “একা যাওয়ার কী দরকার? তুমি আছো না?”

তনু হেসে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখতে লাগলো।
.
.
পুষ্প শুভকে ডেকে বলল,
— “ভাইয়া, তুই না একবার জিজ্ঞেস করেছিলি প্রেম মানে কী আমার কাছে?”
— “হুম, তো?”
— “তুই তো কখনো দেখিস নি, ভাবীর হাসি দেখে আমি একবার ভাবছিলাম ভাইয়া হয়ত এই চমৎকার মেয়েটাকে নিয়ে ভাবেই না। বউ বলে হয়ত খেয়ালই করে না, ভাবী কি সুন্দর করে হাসে! এরপর আমি অনেকবার ওদের লক্ষ্য করেছি জানিস?”
— “কী?”
— “ভাবী যখন হাসে, ভাইয়া একদমই রাগ করে থাকতে পারে না। সিরিয়াস ঝগড়ার মধ্যে ভাবী হঠাৎ করে হেসে ফেলে, আর ভাইয়া চুপ হয়ে যায়। আই থিংক, প্রেম ব্যাপারটা কিছুটা এমন। বৃষ্টির মতো।”
শুভ কপাল কুঁচকালো।
— “বৃষ্টি?”
— “হুম। বৃষ্টির মতো ভেজালহীন, বিশুদ্ধ। আবার আদম আর হাওয়া আলাইহিসালামের ঘটনাটা খেয়াল কর, আদম আলাইহিসসালাম কিন্তু জান্নাতে সব পেয়েও একা অনুভব করছিলেন। তাই আল্লাহ হাওয়াকে বানালেন। প্রেম স্বর্গীয় — কথাটা এক্ষেত্রে সত্যি কিন্তু।”

শুভ বৃষ্টির মাথায় চাটি মারলো।
— “দিনদিন প্রেম বিশারদ হয়ে যাচ্ছিস কীভাবে?”
পুষ্প হেসে ফেললো। শুভর নাকে টোকা দিয়ে বলল,
— “বুঝতে হবে। আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রেম আমার বর। সুতরাং, প্রেম নিয়ে গবেষণা করা খারাপ হচ্ছে না। তোকে বললাম, যেন বউকে একটু ফোন দিয়ে বলিস, বউ তাড়াতাড়ি চলে আসো। বাপের বাড়ি এতদিন থাকার কী দরকার?”

শুভ চোখ মুখ উল্টে একটা ভঙ্গিমা করলো। বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমেছে। ওরা দুজনেই নিজেদের বিয়ের দিনের কথা চিন্তা করতে লাগলো। কে জানত, তাদের জীবনটা এমনভাবে বদলে যাবে। একজন চমৎকার মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

পুষ্প নবীনকে ফোন দিয়ে বলল,
— “এই বৃষ্টির দিনে আপনার এত কীসের কাজ? ছুটি নিন এক্ষুনি। প্রেমময় আবহাওয়ায় প্রেয়সীকে সঙ্গ দেওয়া বাধ্যতামূলক। নাকি আমি আপনার প্রেয়সী না?”
নবীন হতচকিত গলায় বলল, “তোমার শরীর ঠিকঠাক? হঠাৎ এত প্রেম?”
পুষ্প রাগ করার ভান করে বলল,
— “কেন, আমি কী আপনার বউ না? আপনি আমার বর না? তাহলে আর কার সঙ্গে প্রেম করব? আপনার জানা উচিত, আপনি আমার জীবনের প্রথম, একমাত্র এবং শ্রেষ্ঠ প্রেম।”
বলেই ফোন রাখলো। নবীন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে। ওর সহকর্মী হাসছে। নবীন একটু লজ্জা পেলো।

শুভ কয়েকদিন যাবত হাহা রিয়েক্ট দিতে পারছে না। ওর খুব অস্হির লাগছে। কাজে যাবার আগে কাউকে নিয়ম করে পঁচাতে পারছে না। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বললেই মেয়েটা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলার ভান করতো। এখন আর ঘুম ভালো হয় না। রাতে কাঁথা টানার অজুহাতে ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টি থাকলে অভ্যাস মতো গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিতো। শুভ ছোট ছোট শ্বাস ফেলে বৃষ্টিকে ফোন করলো,
— “আমি আসছি। তুমি রেডি থেকো।”

বলে কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না। কিছু সময় বাদে ফোন টুং করে বেজে উঠলো। বৃষ্টি ম্যাসেজ করেছে।

“আমি কী চা করব? আপনি আসবেন সত্যি? আমি বাঙালি বউদের মতো আহ্লাদে একটা পোস্ট দেব, ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।’ আর আপনি সবসময়ের মতো একটা হাহা রিয়েক্ট দিয়ে যাবেন?”

সমাপ্ত।

[আমি এত বাজে লিখি যে স্বয়ং আমারও নিজের লেখা পড়ে বিরক্ত লাগে। তবুও লিখি এই আশায়, কাঁচা হাত পাকা হবে। আপনাদের এতটা সময় খোয়ানোর জন্য খুব দুঃখিত। শুভ রাত্রি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here