এক_খণ্ড_কালো_মেঘ #পর্ব_১০,১১

0
1005

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১০,১১
#নিশাত_জাহান_নিশি
১০

“এই ব্যথাটা তো রাদিফের দেওয়া কষ্টের চেয়ে বেশী কিছুনা তাইনা?”

আচম্বিতেই অয়ন্তীর হতবিহ্বল দৃষ্টি পড়ল রাফায়াতের রহস্যময় দৃষ্টিতে। ক্রমশ সেই অবাক করা চাহনি অয়ন্তীর কৌতূহল, উদ্দীপনা এবং জিজ্ঞাসায় পরিণত হলো। মুখের জবান অতি দ্রুত চলতে লাগল তার। জড়তা ভুলে গড়গড় করে বলল,,

“কী বললেন আপনি? রাদিফ? রাদিফ ভাইকে আপনি চিনেন?”

মাথা নুইয়ে নিলো রাদিফ! অয়ন্তীর কাঁটা ছেঁড়া জায়গাটিতে তুখোড় মনোযোগ দিলো। টপটপ করে এখনো র’ক্ত ঝড়ছে কাঁটা অংশটি থেকে। বন্ধ হওয়ার নামই নিচ্ছেনা। অধীর হয়ে উঠল রাফায়াত। কীভাবে র’ক্ত পড়া বন্ধ করবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। মেয়ে মানুষ এত ব্যথা সহ্য করতে পারে নাকি? দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হয়ত ভেতরটা। অয়ন্তী এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাফায়াতের দিকে। উত্তরের অপেক্ষা তাকে এতোটাই বিভোর করে রেখেছে যে তাকে ঘিরে রাফায়াতের এত শত অস্থিরতা তার চোখে পড়ছেনা! উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে রাফায়াত আরিফকে তার কাছে ডাকল। ভদ্রভাবে হেঁটে আরিফ রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাথার চুল টেনে রাফায়াত আরিফকে বলল,,

“এক্ষুণি একটা স্যাভলন আর একটা ব্যান্ডেজ এনে দে।”

কোঁমড়ে হাত গুজল আরিফ। কপাল কুঁচকে হঠকারি গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেছে আপনার ভাই? এত রাতে আমি স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ কোথায় পাব?”

“কেন? তুই না বলেছিলি এলাকায় তোর অনেক পাওয়ার? সেই পাওয়ার খাঁটিয়ে এনে দে!”

“ভাই সবাই এখন ঘুমে। ঘুমন্ত মানুষদের উপর আমি কেমনে পাওয়ার খাঁটাই বলেন? বিবেক বুদ্ধি তো আছে আমার নাকি?”

“পারবি না সেটা বল। শুধু মুখে মুখেই বড়ো কথা! আমার এলাকা হলে এখন দেখতিস। চুটকির মধ্যে কীভাবে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা করে নিতাম! পাওয়ার খাটানোর জন্য এলেম লাগে বস এলেম। সেই এলেম তোর মধ্যে নেই। কথায় আছে না? “যত গর্জে তত বর্ষে না!”

শরীরে হিট ওঠে গেল আরিফের! দাঁতে দাঁত সংঘর্ষ হলো তার। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে সে একরোঁখা গলায় বলল,,

“আপনি আমার এলেমে প্রশ্ন তুলছেন ভাই! এখন আমি কী করি দেখুন! আমিও দেখিয়ে দিব ভাই, এলাকা আমার। পাওয়ার আর এলেম দুইটাই আমার আছে।”

হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো আরিফ। অতিরিক্ত জেদ চেপে বসল তার মাথায়। চাপা হাসল রাফায়াত! আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“এই জেদটাই আমি তোর মধ্যে দেখতে চেয়েছিলাম আরিফ!”

ইতোমধ্যেই অয়ন্তী ঝট করে রাফায়াতের হাত থেকে তার পা টা সরিয়ে নিলো। হালকা করে পা টা নিচে নামিয়ে সে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। ব্যথায় ঈষৎ কুঁকিয়ে ওঠে সে থম মেরে বসে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো। গরম চোখে শুধালো,,

“বলুন আপনি কে? রাদিফ ভাইকে আপনি চিনেন কীভাবে?”

বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। অয়ন্তীর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে নিশ্চল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে সে এদিক-ওদিক তাকালো। প্রসঙ্গ ঘুরানোর পায়তারা খুঁজছে সে! এটাই সঠিক সময় নয় অয়ন্তীর সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার! রাফায়াত চাইছে অয়ন্তী নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করুক। চাইলেই হয়ত সব সম্ভব। অয়ন্তীর কাছে সে খোলা বইয়ের মত। যা চাইলেই পড়া যায়। পুনরায় রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। নরম স্বরে বলল,,

“আলিজার মুখ থেকে শুনেছিলাম রাদিফের কথা।”

“মিথ্যে বলছেন আপনি। রাদিফ ভাইয়ার সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমি আলিজাকে চিনতামও না। আমাদের তখন দেখাও হয়নি, পরিচয়ও হয়নি। তাছাড়া আমি কখনো আলিজাকে রাদিফ ভাইয়ার কথা বলিনি! বলার প্রয়োজনও মনে করিনি।”

থতমত খেয়ে গেল রাফায়াত। অতিসত্তর অয়ন্তীর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। থমথমে গলায় বলল,,

“আলিজা হয়ত কোনোভাবে রাদিফের কথা শুনেছিল। সেই শোনা কথা থেকেই আমাকে বলেছিল। বাই দ্যা ওয়ে। এসব প্রসঙ্গ বাদ দাও এখন। তোমার পা টা কীভাবে ঠিক করা যায় সেই চিন্তা করো।”

নির্ভেজাল দৃষ্টিতে অয়ন্তী রাফায়াতের নুইয়ে রাখা আতঙ্কিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইল। কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এই মুখের আড়ালে? কেন এই মুখখানি তাকে এত মোহমায়ায় জড়িয়ে রাখছে? কেন এই স্নিগ্ধ মুখখানির দিকে তাকালে তার হারানো অতীত মনে পড়ে যায়? কেন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়? আড়চোখে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। আচম্বিতেই এক গাল হেসে বলল,,

“আমি কিন্তু রাদিফ না ওকে? সো এভাবে আমার দিকে তাকানোর কোনো মানে হয়না! তাছাড়া এই মাঝরাতে সুন্দুরী মেয়েরা এভাবে আবেদনময়ী দৃষ্টিতে তাকালে ছেলে মানুষদের কিন্তু মাথা ঠিক থাকেনা!”

অবিলম্বেই চক্ষুজোড়া সংযত করে নিলো অয়ন্তী। মাথা নুইয়ে মন খারাপের রেখা টানল। আক্ষেপের স্বরে বলল,,

“ইশশ! যদি একটা ম্যাজিক হয়ে যেত। এই রাফায়াতই যদি রাদিফ ভাই হতো! কিন্তু তা তো এই জন্মে সম্ভব নয়। তাদের চেহারার মাঝে তো অনেক পার্থক্য!”

চাপা শ্বাস ছাড়ল রাফায়াত। অয়ন্তীর নুইয়ে রাখা মুখশ্রীতে বেদনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মনে মনে অভিসন্ধি কষিয়ে বলল,,

“যদি! যদি তুমি আমাকে চিনতে পারতে অয়ন্তী! মুখের গঠন বদলে গেলেই কি মানুষটা বদলে যায়? তার আচার-আচরণ, কথাবার্তার ধরণ, তার ভেতর বাহির, অনুভূতি সব বদলে যায়?”

ইতোমধ্যেই আরিফের আগমন ঘটল দুজনের মধ্যে। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। হাতে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজ! রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বেশ এলেম দেখিয়ে বলল,,

“কী ভাই? বলেছিলাম না আমার এলেম নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না? দেখেছেন তো? আমার এলেম কতটা? এসব ছোটো খাটো কাজ তো আমার বাঁ হাতের খেলা!”

আরিফের কথায় পাত্তা দিলো না রাফায়াত। ছোঁ মেরে আরিফের হাত থেকে স্যাভলন আর ব্যান্ডেজটা কেড়ে নিলো। অয়ন্তীর ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও রাফায়াত জোরপূর্বক অয়ন্তীর কাঁটা পায়ে স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। ব্যান্ডেজটা পায়ে ভালো করে পেঁচিয়ে অয়ন্তীর ব্যথায় কুঁকানো মুখশ্রীতে তাকালো। শান্ত স্বরে শুধালো,,

“আর ইউ ফাইন অয়ন্তী? ব্যথা লাগছে এখনো?”

“কেন ডেকেছেন সেটা বলুন? রাতে-বিরাতে আমাকে ডিস্টার্ব করতে এসেছেন?”

কথা বাড়াতে চাইলনা রাফায়াত। প্রসঙ্গ পাল্টাতে অস্থির হয়ে উঠল। দ্বিধায় জড়াতে লাগল। মাথা চুলকে বলল,,

“আচ্ছা তুমি বাসায় যাও। কাল দেখা হচ্ছে।”

প্রতিউত্তরে অয়ন্তীকে কথা বলার সুযোগ দিলোনা রাফায়াত। আরিফের কাঁধে হাত রেখে হাঁটা ধরল রাস্তার পাড় ঘেঁষে। রাগে গাঁ রি রি করে উঠল অয়ন্তীর! পেছন থেকে রাফায়াতকে ডেকে মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“ই’ডি’য়’ট রাফায়াতের বাচ্চা! আমাকে আ’হ’ত করে, রাতে-বিরাতে আমাকে রাস্তায় ডেকে এনে এখন কোনো কারণ না বলেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যাওয়া হচ্ছে? ওকে ফাইন মিঃ ব’দের হাড্ডি! আপনাকে আমি দেখে নিব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি ওকে?”

রাগে গিজগিজিয়ে অয়ন্তী খোঁড়া পা নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। মাথা ঘুরিয়ে রাফায়াত এবার পিছু ফিরে তাকালো। অয়ন্তীর যাওয়ার পথে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মুখশ্রীতে বিরহের ছাপ তার। ইশশ! আর একটুখানি যদি অয়ন্তী থেকে যেত! আরিফও মাথা ঘুরিয়ে রাফায়াতের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“হলোটা কী ভাই? আসলেন আবার চলে যাচ্ছেন। ভালো করে বাত চিতও হলোনা! তাহলে আসলেনটা কেন শুনি?”

আরিফের মাথায় গাড্ডা মারল রাফায়াত। কেমন যেন বিদঘুটে হাসল। অধীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“তুই বুঝবিনা রে চাঁদ! যেদিন আলিজাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবি সেদিন বুঝতে পারবি!”

নিশ্চুপ হয়ে গেল আরিফ। মাথা চুলকে বলল,,

“তাহলে কি সত্যিই আমার আলিজাকে ভালোবাসা উচিৎ?”

,
,

জুসের স্ট্রু মুখে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে আছে অয়ন্তী! তার পাশেই স্যান্ডুইচে কামড় বসালো আলিজা। জুসটা অয়ন্তী খাচ্ছে কম তবে নাড়াচাড়া করছে বেশী। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। আড়চোখে আলিজা অনেকক্ষণ ধরে অয়ন্তীকে প্রত্যক্ষণ করছে। এবার তার মুখ খুলে কিছু বলার সময় হয়ে এসেছে। নীরবতা ভাঙল আলিজা। মুখে খাবার নিয়ে অস্পষ্ট গলায় অয়ন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কী রে? কী হইছে তোর? খাচ্ছিস কম ভাবছিস বেশী। তা ভাবছিসটা কী তুই হ্যাঁ?”

“তোর রাফায়াত ভাইকে নিয়ে ভাবছি!”

“মানে?”

স্ট্রু থেকে মুখটা সারালো অয়ন্তী। চেয়ার টেনে এনে আলিজার গাঁ ঘেঁষে বসল। চোখে-মুখে তার বিশদ তৎপরতার ভাব। বেশ গুরুত্ব সহকারে আলিজাকে বলল,,

“শোন? তোর রাফায়াত ভাইয়ার সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই। জানা-অজানা সব ডিটেইলস। অনেককিছুই লোকটা আমাদের কাছ থেকে আড়াল করছে। যা তুই, আমি এবং আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা!”

“মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?”

“রাদিফ ভাইয়ার ব্যাপারে আমি কখনো তোকে কিছু বলেছিলাম?”

“রাদিফ ভাইটা আবার কে?”

“আমার কলেজের সিনিয়র ভাই ছিল! তখন আমি চট্টগ্রামে থাকতাম। সে এক লম্বা কাহিনী। আমার ফ্যামিলির বাইরে এই বিষয়টা কেউ জানত না। কিন্তু কাল রাতে হুট করে তোর রাফায়াত ভাই রাদিফ ভাইয়ের কথা বলে উঠল! এবার তুই বল? তোর রাফায়াত ভাই ঐ রাদিফ ভাইয়ার ব্যাপারটা কীভাবে জানল?”

ইতোমধ্যেই ঘটে গেল হুলুস্থুল কাণ্ড! বিক্ষুব্ধ অবস্থায় আরিফ একটা ছেলের কলার ধরে ছেলেটাকে টেনে হেঁছড়ে এনে ক্যান্টিনে আলিজার মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো! ঘাবড়ে ওঠা আলিজার মুখশ্রীতে আরিফ তার গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আলিজার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“এই ছেলেটাই কী তোমাকে ফোনে ডিস্টার্ব করত? তোমাকে বাজে বাজে মেসেজ সেন্ড করত?”

তাজ্জব বনে গেল আলিজা! আরিফের এই আমুল পরিবর্তন তাকে ভাবাতে লাগল। অয়ন্তীর তো মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো! এসব কী দেখছে কী তারা? কী হচ্ছেটা কী এসব? দিনের বেলাও তারা দিবা স্বপ্ন দেখেছে না তো? কম্পিত গলায় আলিজা কিছু বলার পূর্বেই আরিফের পেছন থেকে হঠাৎ রাফায়াতের আবির্ভাব ঘটল! চোখে কালো চশমা পড়ে হিরোদের মত তুখোড় ভাব নিয়ে রাফায়াত তার শার্টের কলারটা ঝাড়ল। মুখে কালো মাক্স লাগানো তার! চোখ দেখেই মানুষটাকে চিনতে বেশী বিলম্ব হলোনা অয়ন্তী এবং আলিজার! তেড়ে এসে রাফায়াত ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা আরিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

“আরে ভাই জিজ্ঞেসটা করছিস কী? শিওর না হয়েই আমরা নিশ্চয় এই ছেলেটাকে ধরিনি! তোর গার্লফ্রেন্ডকে ডিস্টার্ব করেছে সে। এবার এর পরিণাম তাকে বুঝিয়ে দে।”

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১১
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আরে ভাই জিজ্ঞেসটা করছিস কী? শিওর না হয়েই আমরা নিশ্চয় এই ছেলেটাকে ধরিনি! তোর গার্লফ্রেন্ডকে ডিস্টার্ব করেছে সে। এবার এর পরিণাম তাকে বুঝিয়ে দে।”

মুখে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল আলিজা এবং অয়ন্তী। ঘোর যেন তাদের কিছুতেই কাটছে না। দিনের বেলাতেও ভূত দেখার মত অদ্ভুত পরিণতি তাদের। পরিস্থিতি সামলে ওঠে অয়ন্তী মাথা ঝাঁকালো। রসগোল্লার মত দৃষ্টি তার আলিজার নিশ্চল দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল। মনে মনে আওড়ালো,,

“লা’ফা’ঙার আরিফের সাথে সাথে কী ঐ মা’স্তা’ন রাফায়াতটারও মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? কোনোভাবে এই রাফায়াত আবার আরিফকে ফুসলাচ্ছে না তো?”

বেশিক্ষণ একই জায়গায় বসে থাকতে পারলনা আলিজা। কারণ ক্যান্টিনে এতক্ষণে ছেলে- মেয়েদের ভীড় জমে গেছে। কেউ বিষয়টাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তো কেউ নানান রকম গসিপ তৈরী করছে। কম্পিত শরীর নিয়ে আলিজা বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। বিক্ষুব্ধ আরিফের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হইছে আরিফ? ক্যান্টিনে এসে এভাবে সিনক্রিয়েট করছ কেন? আর কত ক্ষতি করবা তুমি আমার হ্যাঁ? আর কত?”

আলিজার রাগে রাঙা মুখমণ্ডল দেখে রাফায়াত ইশারায় আরিফকে বলল ছেলেটিকে ছেড়ে দিতে! আলিজা যেহেতু এসব পছন্দ করছেনা তাই এই মুহূর্তে তার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। পরে না হয় সুযোগ বুঝে ছেলেটিকে সাইজ করা যাবে! রাফায়াতের ইশারা বুঝে মুহূর্তের মধ্যেই আরিফ ছেলেটির শার্টের কলার ছেড়ে দিলো। ভয়ে কাঁপতে থাকা ছেলেটির দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেটির কার বরাবর ফিসফিসিয়ে বলল,,

“তোকে আমি পরে দেখে নিব! এখান থেকে যা এখন।”

ছাড়া পেয়ে ছেলেটি জান নিয়ে দৌঁড়ে পালালো ক্যান্টিন থেকে। প্রতিবাদ করার একরত্তি সাহসও দেখালো না। মূলত ছেলেটি এখানে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। তাই তার দাপটও আরিফের তুলনায় কম। আশেপাশে চোখ তুলে তাকালো রাফায়াত। তার গরম চোখের অগ্নিঝরা চাহনি দেখে ক্যান্টিনের সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল! একটা অচেনা অজানা ছেলেকে এত ভয় পাওয়ার কী হলো? জায়গা থেকে ওঠে এলো অয়ন্তী। দু’কদম বাড়িয়ে এসে রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন তুলল,,

“আপনি আমাদের ভার্সিটিতে কী করছেন হ্যাঁ? এখানেও চলে এসেছেন গু’ন্ডা’মি করতে। নিজে তো এক মহাগু’ন্ডা সাথে আরেক চ্যালা নিয়ে এসেছেন?”

চ্যালা শব্দটা শুনতে আরিফের মাথাটা ফট করে গরম হয়ে গেল। মাথা চুলকে সে অয়ন্তীকে কিছু না বলে বেশ ভাবশূণ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে উগ্র গলায় বলল,,

“ভাই? ভাবিকে কিছু বলুন প্লিজ! আমাকে আপনার চ্যালা বলছে!”

আরিফের বোকামো দেখে অবিলম্বেই রাফায়াতের মাথায় হাত চলে গেল। ভয়ঙ্কর রাগী দৃষ্টিতে সে আরিফের দিকে তাকালো। ভয়ে আরিফ চুপসে গেল। মুখে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অয়ন্তী পূর্বের তুলনায় আরও অধিক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আরিফের দিকে তেড়ে এসে বলল,,

“এই কী বললা তুমি হ্যাঁ? কী বললা? ভাবি মানে? আমি তোমার কোনো ভাইয়ের ভাবি লাগি?”

আরিফকে সামনে থেকে সরিয়ে রাফায়াত ক্ষিপ্র অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। মুখ থেকে মাক্সটা সরিয়ে গরম শ্বাস ছাড়ল। রাফায়াতের সম্পূর্ণ মুখটা অয়ন্তীর দৃষ্টির সীমানায় স্পষ্ট হতেই অয়ন্তী সমস্ত রাগ ভুলে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! মাক্স পড়ে থাকার দরুন রাফায়াতের শুভ্র মুখের আদলটি লাল রঙ ধারণ করেছে। দেখতে অদ্ভুত লক সুন্দর দেখাচ্ছে। মুখের মাক্সটি রাফায়াত মুখে পড়ে নিলো। ট্যাড়া চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। হেয়ালি স্বরে বলল,,

“আরে বুঝলা না? আরিফ কোন ভাইয়ের কথা বলেছে? অভেয়সলি অনিকের কথা বলেছে! তাইনা আরিফ?”

আরিফের দিকে আগ্রাসিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাফায়াত দাঁতে দাঁত চেপে তাকে সায় জানাতে বলল। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে আরিফ অপরাধী দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,,

“হ্যাঁ ভাবি। আমি অনিক ভাইয়ার কথা বলছিলাম।”

যদিও আরিফের মুখের কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অয়ন্তীর তবে এই মুহূর্তে আরিফের মুখের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সে। অয়ন্তীর আশ্বস্ত ভাব দেখে রাফায়াত শার্টের কলারটা জাঁকালো। আরিফের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“যা ক্যালো করার করেছিস। এখন আলিজাকে নিয়ে ফুট এখান থেকে।”

রাফায়াতের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই আরিফ আলিজার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো! বাকরুদ্ধ আলিজাকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়গা পরিত্যাগ করল। আলিজা পিছু ঘুরে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। শুকনো গলায় বলল,,

“এসব কী হচ্ছে কী অয়ন্তী। প্লিজ আরিফকে থামতে বল।”

হন্ন হয়ে অয়ন্তী আলিজার পিছু নিতেই রাফায়াত পেছন থেকে অয়ন্তীর ডান হাতটি টেনে ধরল। বাঁকা চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। রসিক গলায় বলল,,

“হেই সুইটি! কাবাব মে হাড্ডি হতে যাচ্ছে নাকি?”

রাগে ফোঁস করে পিছু ফিরে তাকালো অয়ন্তী। এক ঝটকায় রাফায়াতের হাতটি তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,

“ইউ জাস্ট শাট আপ। একটা মা’স্তা’ন ছেলের সাথে আমি আমার বেস্টফ্রেন্ডকে একা ছাড়তে পারিনা।”

আলিজার পিছু নিলো অয়ন্তী। রাফায়াতও অয়ন্তীর পিছু পিছু ছুটল। পেছন থেকে চ্যাচিয়ে বলল,,

“আরেহ্ অয়ন্তী দাঁড়াও। আরিফ সত্যিই এখন ভালো হয়ে গেছে। তাছাড়া আলিজা আমার বোন। ভাই হয়ে আমি নিশ্চয়ই আলিজাকে কোনো ক্ষতির দিতে ঠেলে দিতে পারিনা।”

রাফায়াতের কোনো কথাই কানে তুললনা অয়ন্তী। ছুটে চলল ভার্সিটির পেছনের দিকের ফাঁকা এরিয়াটিতে। বাউন্ডারির পেছনের দিকটায় দৌঁড়ে যেতেই অয়ন্তী মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল! লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো তার। আলিজা স্ব-ইচ্ছায় আরিফকে জড়িয়ে ধরে সবেমাত্রই কাঁদতে কাঁদতে আরিফের বুকে মাথা রাখল। তাদের এই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অয়ন্তী তার উপস্থিতিতে বড্ড লজ্জা পেয়ে গেল। ঝট করে পেছনের দিকে মোড় নিতেই সে রাফায়াতের বলিষ্ঠ বুকে লেপ্টে গেল! ব্যগ্র হাসল রাফায়াত। দুষ্টু চাহনিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। নাক টেনে বলল,,

“কী মিস সুইটি? করলেন তো তাদের প্রাইভেট টাইমে ডিস্টার্ব?”

বেশ জোর খাঁটিয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের বুকের পাঁজর থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই ঘটনার আকস্মিকতায় রাফায়াতের হাত থেকে তার সেলফোনটি পড়ে গেল। হকচকিয়ে উঠল অয়ন্তী। জিভ কেটে উবু হয়ে বসে পড়ল নিচে। রাফায়াতের সেল ফোনটি হাতে তুলতেই ফোনের স্ক্রীণ জ্বলে উঠল। তৎক্ষনাৎ মেসেজের একটি নোটিফিকেশন তার চোখে পড়ল। মেসেজটিতে লিখাঃ

“এই কী খবর তোর? অয়ন্তীকে ভাগে আনতে পারলি? আর অনিক? অনিক তো তোকে হায়েনাদের মত খুঁজছে!”

মেসেজটি এক নজর দেখামাত্রই অয়ন্তীর চক্ষু জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। ফোনটি হাতে নিয়ে সে চোখ উঠিয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতের দিকে তাকালো। রাফায়াত এখনও কিছু টের পায়নি! তাই তার ঠোঁটে এখনও লেগে আছে ব্যগ্র হাসির রেখা। টালমাটাল শরীর নিয়ে ফোনটি হাতে নিয়ে অয়ন্তী বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চোখের কোণে তার জল চিকচিক করে উঠল। ফোনটি রাফায়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“আপনি আমার ক্ষতি করতে এসেছেন তাইনা?”

ক্ষণিকের মধ্যেই কপাল কুঁচকে নিলো রাফায়াত। মুখশ্রীতে তাজ্জব ভাব ফুটে উঠল। তাড়াহুড়ো করে অয়ন্তীর হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো। ফোনের স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে দেখল চঞ্চলের নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে! বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা অয়ন্তী সেই মেসেজ পড়ে নিয়েছে! আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল রাফায়াতের। শুষ্ক গলায় অয়ন্তীকে কিছু বলার পূর্বেই অয়ন্তী কাঁদতে কাঁদতে জায়গা পরিত্যাগ করল। ক্ষোভে চেঁচিয়ে বলল,,

“আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আমার ক্ষতি করতে এসেছেন। আমি এক্ষণি অনিককে সব বলব। অনিক জানত আপনি আমার ক্ষতি করবেন। তাই সে আপনাকে খুঁজছে। আমি এক্ষণি অনিককে সব ইনফর্ম করছি!”

মাথায় হাত চলে গেল রাফায়াতের। পুনরায় অয়ন্তীর পেছনে ছুটল সে। পেছন থেকে অয়ন্তীকে ডেকে বলল,,

“অয়ন্তী প্লিজ থামো। আমার কথা শোনো। পুরোপুরি ঘটনাটা না জেনে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারো না।”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here