এক_খণ্ড_কালো_মেঘ #পর্ব_১২,১৩

0
890

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১২,১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
১২

“অয়ন্তী প্লিজ থামো। আমার কথা শোনো। পুরোপুরি ঘটনাটা না জেনে তুমি আমাকে এভাবে ভুল বুঝতে পারো না।”

দৌঁড়ানোর গতি আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো অয়ন্তী। রাফায়াতকে তার প্রথম থেকেই সন্দেহ। সেই সন্দেহ এখন যেন অগাধ বিশ্বাসে পরিণত হলো! নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কীভাবে? তাই বিশ্বাস করতে বেশী বেগ পেতে হলো না যে, রাফায়াত সত্যি সত্যি তার ক্ষতি করতে এসেছে! এই মুহূর্তে সে অনিককে তার পাশে চাইছে, তাকে ভরসা করছে, তাকে বিশ্বাস করতে চাইছে। কোনোভাবে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বের হতে পারলেই সে প্রথমে অনিকের সাথে যোগাযোগ করবে। মূল ঘটনা অনিককে সব খুলে বলবে। সেই ভাবনা মাথায় রেখেই ভার্সিটির মেইন গেট পাড় হয়ে অয়ন্তী রাস্তায় উঠল। অমনি পেছন থেকে রাফায়াত তার হাতটা খপ করে টেনে ধরল। অয়ন্তীকে তার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে পর পর কয়েক দফা রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। মৃদু আওয়াজে বলল,,

“বলেছিলাম না আমার সম্পূর্ণ কথাটা শুনতে? কথার আগেই এত দৌঁড়াও কেন? পিচ্চি বাচ্চা তুমি হ্যাঁ? ছোটো আছো এখনো?”

রাফায়াতের দিকে আঙুল তাক করল অয়ন্তী। তুখোড় রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,,

“কারণ আপনি ডেঞ্জারাস। টু মাচ ডেঞ্জারাস। প্রথম দেখাতেই আপনি আমার গলা চেপে ধরেছিলেন। আর এখন তো আমি সব জেনে গেছি। আই ডোন্ট নো এখন আপনি আমার সাথে ঠিক কী কী করবেন!”

আগপাছ না ভেবে পিছু ঘুরে অয়ন্তী পুনরায় দৌঁড় দিলো। কখন সে রাস্তার মাঝখানে চলে এলো আঁচ করতে পারলনা! ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট। বিশাল জ্যামে ভরপুর। জ্যাম কিছুটা ছাড়তেই গাড়ি ঘোড়া সব ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগল। তক্ষুণি অয়ন্তী দৌঁড়ে এসে একটি পিক-আপের সামনে পড়ল! ভাগ্যিস পিক-আপটি সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক ধরতে পেরেছিল! চক্ষুজোড়া দুর্নিবার ভয় নিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অয়ন্তী৷ পিক-আপ ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে থেকেই অয়ন্তীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল! বেশ বকাঝকা করছিল। ইতোমধ্যেই তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দৌঁড়ে এলো রাফায়াত। অয়ন্তীকে টেনে রাস্তার ধারে নিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত করল। মাথায় প্রচণ্ড জেদ চেপে বসতেই সে ঠাস করে অয়ন্তীর গালে এক চড় বসিয়ে দিলো! একে তো অয়ন্তী ভয়ে জীর্ণশীর্ণ। মৃত্যুর মুখ থেকে সবেমাত্র ফিরে এসেছে সে। দ্বিতীয়ত রাফায়াতকে নিয়ে কৌতূহল, আতঙ্ক। গাঁ থেকে দড়দড়িয়ে ঘাম ঝড়ছিল তার। তৃতীয়ত, রাফায়াতের শক্ত হাতের চড়। সব মিলিয়ে অয়ন্তীর মাথা ঘুরে এলো। ধীরভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলনা সে। শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে অয়ন্তী যেইনা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে অমনি রাফায়াত অয়ন্তীকে তার বাহুডোরে আঁকড়ে ধরল। অয়ন্তীর জ্ঞানশূণ্য মুখমণ্ডলে তাকালো। দু’চোখে ঝাপসা জল নিয়ে ভরাট গলায় বলল,,

“সরি অয়ন্তী। এছাড়া আমার হাতে আর কোনো অপশন ছিলনা! খেলা শুরু করার আগে খেলাটা মাঝপথে এসে এভাবে শেষ হয়ে যাক আমি চাইনা। অনিকের মুখোশ খোলা এখনো বাকি আছে।”

,
,

গভীর রাত। আনুমানিক দুইটা কী তিনটা বাজবে তখন ঘড়িতে। ঠাণ্ডায় অয়ন্তীর গাঁ শিরশিরিয়ে উঠল। গাঁয়ের সমস্ত লোম পর পর দাঁড়িয়ে গেল। সহ্য করা যাচ্ছেনা এমন তীব্র শীতের প্রকোপ। চোখ বুজে অয়ন্তী ঘুমের ঘোরেই তার আশেপাশে কম্বল খুঁজছে। তার আইডিয়া অনুযায়ী কম্বলটা তার বালিশের পাশেই থাকবে। কারণ রাতে তার হুট করেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। আর তখনি সে বিনা পরিশ্রমে হাতড়ে তার বালিশের পাশ থেকে কম্বলটা হাতিয়ে নেয়৷ আজও ঠিক তাই করল৷ কিন্তু কম্বলটা সে হাতড়েও খুঁজে পেলনা। মিনিট পাঁচেক সে অন্ধকারে হাতড়ালো। পরক্ষণে বিরক্ত হয়ে সে ঝট করে ঘুম জড়ানো চোখ জোড়া মেলল। অমনি তার চিরশত্রু অন্ধকারকে সে তার চোখের সামনে উপলব্ধি করতে পারল৷ রাতে ঘুমানোর সময় সে সচরাচর রুমের ড্রিমলাইট অন করে রাখে। তবে আজ সম্পূর্ণ রুমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন! ভয়ে আঁতকে উঠল অয়ন্তী। ক্রমাগত রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল সে। চোখ দুটো অবিলম্বেই তার ভয়ার্ত রূপ ধারণ করল। ঠাণ্ডার প্রকোপ হ্রাস পেয়ে তার শরীরে গরম ভাবের উদয় হলো। গাঁয়ের লোমগুলো তার আতঙ্কে পুনরায় দাঁড়িয়ে গেল। মুখে হাত চেপে ধরে সে চিৎকার করে বলল,,

“আম্মুওওও। আমার রুমের লাইট অফ কেন?”

আচম্বিতেই অয়ন্তীর চোখের সামনে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল। ভয়াল চাহনিতে অয়ন্তী ফ্ল্যাশ লাইটের ঐ প্রান্তে তাকাতেই উন্মুক্ত শরীরে বসে থাকা রাফায়াতের শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটি আবিষ্কার করল! আতঙ্ক যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল অয়ন্তীর৷ জায়গা থেকে সরে এসে সে খাটের কার্ণিশের সাথে চিপকে বসল। শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,,

“আআআপনি? আআআপনি আআআমার রুমে কী করছেন?”

ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে রাফায়াত অয়ন্তীর দিকে তাকালো। ফোনটা কিঞ্চিৎ ঘেঁটে দেখল। তেমন কিছুই ঘটেনি ঠিক এমন একটা ভাব নিলো। নিতান্তই স্বাভাবিক স্বরে বলল,,

“আমরা এখন তোমার রুমে না। অন্য কোথাও আছি। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। এই অন্ধকার ঘর থেকে তোমার মুক্তি নেই!”

ঘাবড়ে উঠল অয়ন্তী। ফ্ল্যাশ লাইটের মিটিমিটি আলোতে সে পুরো রুমটিতে একবার করে চোখ বুলালো। সম্পূর্ণ স্যাতস্যাঁতে একটি রুম। নেই কোনো আসবাবপত্র, নেই কোনো ফার্ণিচার, নেই কোনো পাখার ব্যবস্থা, নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ইলেকট্রিসিটির কোনো ব্যবস্থা নেই এই রুমটিতে। তবে বিশাল বড়ো এই রুমটি৷ রুমটির পাশে আবার ছোটো করে দেখতে একটি ওয়াশরুমও আছে। দেখলেই কেমন গাঁ গুলিয়ে আসছে! ব্যবহারযোগ্য নয় এই ওয়াশ রুমটি। তবে রুমটি যেমনই হোক না কেন দরোজা-জানালা সব শক্তপোক্ত-ই আছে! এক ঝলকে পুরো রুমটি দেখে অয়ন্তী শান্ত রাফায়াতের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বিক্ষুব্ধ গলায় বলল,,

“এই? আপনি আমাকে কি’ড’ন্যা’প করেছেন?”

অবিলম্বেই রাফায়াতের শান্ত মুখশ্রীতে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল! ভ্রু উঁচিয়ে সে অয়ন্তীর দিকে এক পলক তাকালো৷ অয়ন্তীর দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে গেল সে। ফিচেল স্বরে বলল,,

“অতি চালাকের গলায় দড়ি বুঝলা? বেশি চালাকি করতে চেয়েছিলে না? দেখলে তো এর ফল? শেষমেশ কি’ড’ন্যা’প হতে হলো তো আমার হাতে? ভালো লাগছে তো এখন? অনুভূতিটা একটু শেয়ার করো!”

প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল অয়ন্তী। চোখে যেন তার আগুনের ফুলকি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সে রাফায়াতের মুখোমুখি এসে বসল। অবিশ্বাস্য ভাবেই রাফায়াতের গলার টুটি চেপে ধরল সে! বিস্ফোরিত গলায় বলল,,

“কু**র বাচ্চা! তুই কোন সাহসে আমাকে কি’ড’ন্যা’প করেছিস বল? তুই তো আমাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিলি। আমার সেন্সও ফিরেছিল। আম্মুর সাথে কথাও বলেছিলাম আমি। কিন্তু অনিকের সাথে কথা বলার আগেই কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল আমার। এরপর থেকে আর কিছু মনে নেই। বল কী করেছিস তুই আমার সাথে বল?”

হু হা শব্দে হেসে উঠল রাফায়াত! ক্ষিপ্র অয়ন্তীর দিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“কীভাবে গলা চেপে ধরতে হয় তা ও তো শিখলা না এখনো! মনে হচ্ছে যেন তুমি আমাকে আদর করান জন্য গলায় শুড়শুড়ি দিচ্ছ! সিরিয়াসলি আমার খুব ফিলিংস হচ্ছে অয়ন্তী! ভুলভাল কিছু করতে উস্কে দিওনা আমায়!”

“এই তুই এত লু’চ্চা কেন হ্যাঁ? এত লু’চ্চা কেন? তুই সত্যি সত্যিই আমার কোনো ক্ষতি করে দেসনি তো?”

কথাগুলো অনর্গল বলেই রাফায়াতের গলাটা এবার ছেড়ে দিলো অয়ন্তী। নিজের সমস্ত শরীরে এবার সে হাত বুলাতে লাগল। রাফায়াত তার কোনো ক্ষতি করল কীনা তা বুঝার চেষ্টা করল! অয়ন্তীর হযবরল অবস্থা দেখে রাফায়াত মনে মনে হেসে কুটিকুটি। নির্বোধ অয়ন্তীকে আরও ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ভূত চেপে বসল তার মাথায়! ঠোঁটের কোণে রসাত্নক হাসি ফুটিয়ে তুলল সে। নির্লজ্জ গলায় বলল,,

“উফফফস! কী হ’ট তুমি! মানে আমার তো তখন মাথা-ই ঠিক ছিলনা। বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম আমি। শুধু যে আমিই বেসামাল ছিলাম তা কিন্তু নয়, সাথে তুমিও! মানে আমাকে খালি গাঁয়ে দেখে তখন তো তোমার মাথা-ই ঠিক ছিলনা!”

ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দিলো অয়ন্তী। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে বসল। কান্নায় জর্জরিত হয়ে সে আর্ত গলায় বলল,,

“আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না রাফায়াত। কখনো না। আপনি হলেন মানুষরূপী জা’নো’য়া’র! আপনাকে চিনতে আর বাকী নেই আমার।”

,
,

বিকেল থেকেই পুলিশ স্টেশানে দৌঁড়োদৌঁড়ি করছেন অয়ন্তীর বাবা এবং মা। জানে পানি নেই তাদের। বড়ো মেয়েকে হারানোর পর এখন ছোটো মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা! অয়ন্তীই তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল। সেই শেষ সম্বলটাকেও এখন তারা নিজেদের বাড়ি থেকে খুঁজে পাচ্ছেনা! আশ্চর্য কাহিনী যতসব। বাড়ি থেকে অসুস্থ অয়ন্তীকে কে কোথায় নিয়ে যাবে? তাছাড়া অয়ন্তী নিশ্চয়ই একা অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে বের হবেনা? আর বের হলেও অন্তত তার মাকে জানিয়ে যাবে। তাহলে অয়ন্তীকে কে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে? কার এত বড়ো সাহস হতে পারে?

আলিজা যদিও প্রথমে রাফায়াতকে সন্দেহ করেছিল তবে অয়ন্তীর নিঁখোজের সময় রাফায়াত বাড়িতে-ই ছিল! একসাথে তারা বিকেলের নাশতা করেছিল। সেই জায়গায় রাফায়াতকে সন্দেহ করার মত কোনো কারণ-ই থাকতে পারেনা!

অয়ন্তীর নিঁখোজের খবরটা পেয়ে-ই অনিক তার সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে ঢাকায় ছুটে এসেছে। সেও নিজের মত করে অয়ন্তীকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে। আলিজাকে নানানভাবে জেরা করছে। ভার্সিটিতে অয়ন্তীকে কেউ বিরক্ত করত কীনা বা অয়ন্তী কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কীনা সব খবরাখবর সে এই মাঝরাতে আলিজার থেকে নিচ্ছে। ঘুম টুম যেন তার হারাম হয়ে গেছে!

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

অয়ন্তীর নিঁখোজের খবরটা পেয়ে-ই অনিক তার সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে ঢাকায় ছুটে এসেছে। সেও নিজের মত করে অয়ন্তীকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে। আলিজাকে নানানভাবে জেরা করছে। ভার্সিটিতে অয়ন্তীকে কেউ বিরক্ত করত কীনা বা অয়ন্তী কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কীনা সব খবরাখবর সে এই মাঝরাতে এসে আলিজার কাছ থেকে নিচ্ছে। ঘুম টুম যেন সব হারাম হয়ে গেছে তার!

আলিজার সাথে কথাবার্তা শেষ করে অনিক যেইনা হম্বিতম্বি হয়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাবে ঠিক তক্ষণি কোনোভাবে তার চোখ পড়ল ড্রয়িংরুমের পূর্ব-পার্শ্বে থাকা রাফায়াতের ছোট্টো রুমটির দিকে! খোলা দরোজা। ভেতর থেকে পুরুষালী কণ্ঠের সুমধুর গান ভেসে আসছে! এই মাঝরাতে আবার কে গান গাইছে? কার মনে এত সুখ, এত রঙ? তীব্র কৌতূহল নিয়ে অনিক তার শার্টের কলার ঝেড়ে যেইনা খোলা দরোজা ডিঙিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করল অমনি সে দেখতে পেল একজন সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষ তার ঠিক উল্টোদিক ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। শূন্য আকাশের দিকে মুখ তার। ড্রিম লাইটের আধো আলোতে তার পেছনের দিকটা অনিক তার আবছা নয়নে দেখতে পারছে। উন্মুক্ত ছেলেটির শরীর। মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে ফরফর করে ইংরেজি গান! যে গানের অর্থ সে সঠিক ধরতে পারছেনা। কণ্ঠটা যদিও তার পূর্ব পরিচিত বলে মনে হচ্ছে তবে ছেলেটি কে? তা সে এখনো অবধি আন্দাজ করতে পারছেনা! কৌতূহল তার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে লাগল। এইদিকে আলিজার বুকের ভেতরে সাইক্লোন বইতে লাগল! শুধু আলিজা-ই নয় বরং তার পরিবারের সবার মনে তীব্র ভয়-ভীতি কাজ করতে লাগল। সবার ভয় রাফায়াতকে নিয়ে। অনিক না আবার কোনোভাবে রাফায়াতকে দেখে ফেলে! অনিক সম্পর্কে তাদের সবার কম-বেশি ধারণা আছে। কতটা মা’স্তা’ন টাইপের এই ছেলে! তার উপর অনিক বর্তমানে চট্টগ্রামে থাকছে। রাফায়াতের বাড়িও চট্টগ্রাম! কোনোভাবে যদি তাদের কানেকশান থেকে থাকে বা দুজন দুজনকে আগে থেকে চিনে থাকে তাহলে তো রাফায়াতের জন্য তা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে! এই মুহূর্তে তাদের ঠিক কী করণীয় আদোতেই বুঝতে পারছেনা তারা!

কিছু জানার বা দেখার আগ্রহ বেশিক্ষণ ছাপিয়ে রাখতে পারলনা অনিক। পা বাড়িয়ে সে যেইনা ছেলেটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করল অমনি পেছন থেকে আরিফ এসে অনিকের নাম ধরে ডেকে উঠল! তার উদ্দেশ্য-ই যেন ছিল অনিককে তার লক্ষ্য থেকে আটকে দেওয়া! কার্য উদ্ধার হতেই সে উত্তেজিত গলায় অনিককে ডেকে বলল,

“অনিক ভাই অনিক ভাই। আমরা হয়তো অয়ন্তী ভাবির খোঁজ পেয়ে গেছি!”

মুহূর্তের মধ্যেই অনিক পিছু ঘুরে তাকালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আরিফের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে আরিফকে ঝাঁকিয়ে বলল,,

“কোথায় অয়ন্তী বল?”

“নিচে চলুন। পরে বলছি।”

হুট করেই অনিকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো! ভ্রু যুগল ঈষৎ কুঁচকে সে আরিফের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“তুই তো আমার শত্রু ছিলি তাইনা? হুট করেই আমার সাথে এত ভাব জমাতে এলি কেন হ্যাঁ? কারণ কী?”

থতমত খেয়ে গেল আরিফ! তবুও সন্তপর্ণে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করল। বিচলিত না হয়ে বরং স্পষ্ট গলায় বলল,,

“কী যে বলেন না ভাই? আমাদের মধ্যে যতই শত্রুতা থাকুক না কেন একই এলাকার ভাই ব্রাদার তো আমরা নাকি? এখন যেমন আপনার বিপদে আমি পাশে এসে দাঁড়িয়েছি তদ্রুপ আমার বিপদেও তো আপনি পাশে এসে দাঁড়াবেন তাইনা? আরিফ স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করেনা ভাই। ভেবে নিন এর পেছনেও আমার স্বার্থ আছে!”

আরিফের মুখের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো অনিক! বিশ্বাস করবে-ই বা না কেন? আরিফ যেভাবে ভোলাভালা কণ্ঠে হৃদয় নিংড়ানো সমস্ত অনুভূতি মাখিয়ে কথাগুলো বলছিল সেই জায়গায় যেকোনো কেউ এক কথাতেই তার মুখের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য! আরিফের বাঁ কাঁধে ভরসার হাত রাখল অনিক! আরিফকে নিয়ে বাড়ির সদর দরোজার দিকে অগ্রসর হলো। অমনি মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো আরিফ। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা আলিজার দিকে বাঁকা চাহনিতে তাকালো। শার্টের কলারটা খানিক উঁচিয়ে বেশ ভাব নিয়ে তার ক্ষমতা দেখালো! স্বস্তির শ্বাস ফেলল আলিজা! বুকে হাত রেখে মাথা নুয়ালো। বিড়বিড় করে বলল,,

“ভাগ্যিস! ঠিক সময়ে আরিফটা এসেছিল!”

বাড়ির প্রত্যেককে এক এক করে যার যার রুমে পাঠিয়ে দিলো আলিজা! ধীর পায়ে হেঁটে সে একাই রাফায়াতের রুমে প্রবেশ করল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রাফায়াত কেমন যেনো পৈশাচিক হাসি হাসছে। একাধারে সিগারেট টেনে-ই চলছে! উন্মাদ হওয়া গলায় বলছে,,

“তোর খেলা শেষ হয়ে আসছে অনিক! ইউ আর ফিনিশড অনিক! ইউ আর টোটালী ফিনিশড!”

অবাক হলো আলিজা! শুধু অবাক নয় খুব বেশি অবাক হলো। রাফায়াতের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আপনি অনিক ভাইকে চিনেন রাফায়াত ভাই?”

মুহূর্তের মধ্যেই সিগারেটটি হাত থেকে ছুড়ে ফেলল রাফায়াত! ঘটনার আকস্মিকতায় সে প্রসঙ্গ পাল্টে নেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করল। আলিজার দিকে তাকিয়ে ঝেড়ে কেশে বলল,,

“এসব নিয়ে পরে কথা হবে আলিজা। নাও আই নিড টু স্লিপ।”

রাফায়াতের কথা মেনে নিলো আলিজা। মাথায় শত শত প্রশ্নের ঝুঁড়ি নিয়ে সে রাফায়াতের রুম পরিত্যাগ করল। আলিজা রুম থেকে বের হতেই রাফায়াত ঠাস করে রুমের দরোজাটি লাগিয়ে দিলো! ভয়ে আঁতকে উঠল আলিজা। বুকে থু থু ছিটিয়ে দৌঁড়ে সে তার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। রুমে প্রবেশ করেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল! অয়ন্তী কোথায় যেতে পারে বা কোথায় থাকতে পারে এই ভেবে তার কষ্টের পরিমাণটা যেন বেগতিক বাড়তে লাগল!

কিয়ৎক্ষণ পর বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়তে-ই রান্নাঘর থেকে চুপিচুপি খাবার নিয়ে রাফায়াত বাড়ি থেকে আবারও বের হয়ে গেল! ভোরের আনাগোনা তখন ধীর গতিতে শুরু হতে লাগল। এখন থেকে রাফায়াতের মোট তিনটি দিকেই ব্যালেন্স রাখতে হবে। প্রথমত, অয়ন্তীর কাছাকাছি থাকা। দ্বিতীয়ত, ঢাকা থেকেও চট্টগ্রামের খবর রাখা। তৃতীয়ত, সময় মতো আলিজাদের বাড়িতেও উপস্থিত থাকা। যেন কেউ কিছু সন্দেহ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা!

,
,

হাঁটুতে মাথা রেখে এখনো পূর্বের ন্যায় কেঁদে চলছে অয়ন্তী! ভয়ে, আতঙ্কে, যথেষ্ট খাবার এবং ঘুমের অভাবে তার দিন-দুনিয়া নিরান্দন ঠেকছে। তার উপর স্যাতঁস্যাতে অন্ধকার রুম। ওয়াশরুমের খুবই বিচ্ছিরি অবস্থা। টয়লেট পেলেও যাওয়ার মত কোনো উপায় নেই! ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসে তার মরি মরি অবস্থা। রাফায়াতের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জমাট বাঁধতে লাগল তার মনে। সামনে পেলে এক্ষুণি রাফায়াতকে খাবলে খুবলে খাবে এই দুঃসাধ্য ভাবনা-ই তার মস্তিষ্কে চেপে বসল! অমনি অয়ন্তী খেয়াল করল খাটটা কেমন যেন নড়ছে। এক মুহূর্ত পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা কারো ফোন সাইলেন্ট মোডে বাজছে। তার মানে রাফায়াত কী ভুলে তার ফোনটা এখানে ছেড়ে চলে গেছে? আশার আলো যেন খুঁজে পেল অয়ন্তী! ঝট করে সে হাঁটু থেকে মাথাটা তুলল। হাতড়ে তার পাশ থেকে বাজতে থাকা ফোনটির স্ক্রীনে তাকালো। অশ্রুসিক্ত অসম্ভব ফোলা ফোলা চোখে সে স্ক্রীণে ভাসতে থাকা সেভ করা নাম্বারটি স্পষ্টভাবে দেখতে পারছিল না! চোখে প্রচণ্ড জ্বালা করছিল। চট জলিদ কলটি কেটে সে অনিকের নাম্বারে কল করার মত দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিলো। তবে অতি উত্তেজনায় কলটি কাটতে গিয়ে হঠাৎ রিসিভ হয়ে গেল! অমনি হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকা একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হলো! ভরাট গলায় নিদারুন কাকুতি মিনতি করে মেয়েটি বলল,,

“আমাকে মাফ করে দাওনা রাফায়াত প্লিজ। আমি যা করেছি ভুল করেছি। চরম ভুল করেছি। তোমার সাথে সম্পর্কে থাকার পরেও আমি অন্য কারো সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়েছি! বিশ্বাস করো আমি জড়াতে চাইনি তার সাথে। কথায় আছেনা? দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা? আমি তার মিষ্টি কথাতেই জড়িয়ে পড়েছিলাম রাফায়াত। এবারের মত আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে কিন্তু আমি সত্যি বলছি সু’ই’সা’ই”ড করব!”

অয়ন্তী তাজ্জব বনে গেল! মুখে হাত দিয়ে সে থম মেরে বসে রইল। মেয়ের কণ্ঠটি তার বড্ড চেনা চেনা লাগছিল। এর আগেও স্বরটি কোথাও শুনেছে এমনটা মনে হচ্ছে। কান থেকে ফোনটি সরিয়ে এনে সে স্ক্রীণের দিকে এবার ভালো করে তাকাতেই আকস্মিকভাবে রুমের দরোজা খুলে রাফায়াতের আগমন ঘটল। সঙ্গে সঙ্গেই হাত থেকে ফোনটি ছিটকে পড়ে গেল অয়ন্তীর! প্রিয়া ঐ প্রান্ত থেকে হরদমে হ্যালো হ্যালো করতে লাগল। কী হয়েছে রাফায়াত? কিছু বলছ না কেন? কেবল এই কথাগুলোই মৃদু আওয়াজে আওড়াতে লাগল। রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি পাওয়া মাত্রই অয়ন্তীর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কেমন যেন পালপিটিশান হতে লাগল।

ইতোমধ্যেই হাতে থাকা মাঝারি আকৃতির চার্জ লাইটটি জ্বালিয়ে দিলো রাফায়াত। অমনি সে দেখতে পেল অয়ন্তী ভয়ে থরথর করে কাঁপছে! দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা অনর্থ করেছে সে! নতুবা আকস্মিক কারো আগমনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। খাবারের বক্সটি একপাশে রেখে রাফায়াত দৌঁড়ে এলো অয়ন্তীর কাছে। অমনি তার শ্রবণশক্তিতে প্রিয়ার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বরটি ভেসে এলো। পাশে তাকিয়ে দেখল তার ফোনের স্ক্রীণ জ্বলছে! ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে প্রিয়া এক নাগাড়ে হ্যালো হ্যালো করছে। দাঁত গিজগিজিয়ে উঠল রাফায়াত। প্রথমে তার ফোনটি হাতে তুলে নিলো। ঝট করে ফোনটি কেটে দিলো সে! তাড়াহুড়ো করে প্যান্টের পকেট থেকে একটি নতুন সিম কার্ড হাতে নিলো। পুরাতন সিমটি খুলে নতুন সিমটি ফোনে ইন করল। পাওয়ার অন করে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। হাতে থাকা পুরোনো সিমটি সে মুহূর্তের মধ্যেই দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিলো। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা তার। হিংস্র বাঘের ন্যায় রাগে গর্জন করে উঠছে। কেমন যেন গোঙিয়ে গোঙিয়ে উঠছে!

রাফায়াতের এহেন মহা প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখে ভয়ে আরও সিঁটিয়ে গেল অয়ন্তী। পুনরায় খাটের কার্ণিশের সাথে সে ঘেঁষে বসল। কান্না চেপে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করল। অমনি রাফায়াত তার ফোনটি হাত থেকে খাটের উপর রাখল। রগচটা হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অয়ন্তীর দিকে অনেক খানি এগিয়ে গেল। খাটের মাঝ বরাবর সে এত জোরে এক ঘু’ষি মারল যে খাটটি গটগট করে নিচের দিকে তলিয়ে গেল! মাঝখান থেকে পুরোপুরি ভেঙে গেল খাটটি। এমনিতেই প্রথম থেকে নড়বড়ে ছিল খাটটি। এখন তো আধম”রা হয়ে যা ইচ্ছে তা অবস্থা! খাট ভেঙে নিচে পড়ে যাওয়ার পরেও সেদিকে ঘুনাক্ষরেও ধ্যান নেই রাফায়াতের! আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকা অয়ন্তীর দিকে সে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই? অনিককে আমার নাম্বার থেকে কল করেছিলে তুমি?”

নির্বিকার অয়ন্তী। মুখ চেপে ধরে শুধু অঝরে কাঁদতে ব্যস্ত। দম যেন বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয়েছে তার! অচিরেই এই দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চায়। অয়ন্তীর নীরবতা রাফায়াতকে আরও ভীষণভাবে আক্রোশের দিকে ঠেলে দিলো! অয়ন্তীর ডান হাতটি সে শক্তভাবে চেপে ধরতে বাধ্য হলো। গলা উঁচিয়ে বলল,,

“চুপ করে থেকো না অয়ন্তী। যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও।”

“নানানায়ায়ায়া। কককরি নি।”

“মিথ্যে বলছ তুমি হ্যাঁ? মিথ্যে বলছ?”

“সত্যি আমি কল করিনি।”

“যদি কল করেও থাকো। এতে কিন্তু ক্ষতি তোমারই হবে!”

“আমি কল করিনি বললাম তো!”

“পারমিশন ছাড়া কারো ফোনে হাত দিতে নেই জানো না?”

রাফায়াতের কঠিন চোখে বিভীষিকাময় চাহনি অয়ন্তীর! ভেতরের করুণ যন্ত্রণা সে মুখে উচ্চারিত করে বলল,,

“নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্যও কি এখন শত্রু পক্ষের থেকে পারমিশন নিতে হবে?”

“তুমি এখন এখানে আছো বলেই বেঁচে আছো, ভালো আছো। অনিকের কাছে থাকলে না? এতক্ষণে তুমি ম’রে যেতে! সুখ সহ্য হচ্ছেনা তাইনা?”

“কীসের সুখ হ্যাঁ? কীসের সুখ? এখানে কী সুখ আছে বলুন? এখানে শুধু ভয় আছে, আতঙ্ক আছে। বেঁচেও ম’রে থাকার মত বিষাক্ত অনুভূতি আছে।”

“একটু সময় দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার পারমিশন ছাড়া অনিকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবেনা তুমি।”

ইতোমধ্যেই রাফায়াতের নতুন সিম থেকে তার সেল ফোনটি বেজে উঠল। স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়ে-ই রাফায়াত তড়িঘড়ি করে ফোনটি কানে তুলল। এই নাম্বারটিতে চঞ্চল এবং আরিফ ছাড়া অন্যকেউ কল করবেনা তা তার আগে থেকেই জানা! অমনি ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে বেশ চঞ্চল প্রফুল্ল গলায় বলল,,

“গুড নিউজ আছে বস!’

“কী গুড নিউজ?”

“ইয়াদের জ্ঞান ফিরেছে। তুই এখন নিশ্চিন্তে চট্টগ্রাম ব্যাক করতে পারিস! এলাকা এখন আমাদের।”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here