এক_খণ্ড_কালো_মেঘ #পর্ব_২৪,২৫

0
1058

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৪,২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
২৪

“শরীরে খুব কা’রে’ন্ট না? সকাল থেকে এই পর্যন্ত না খেয়ে আছো? তুমি কী ভেবেছ? এভাবে না খেয়েদেয়ে থাকলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিব? এত সহজ রাফায়াতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া?”

অত্যধিক ভয়ে জর্জরিত হয়ে অয়ন্তীর সমস্ত শরীর তালগোল পাকিয়ে কাঁপতে আরম্ভ করল। এক জায়গাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। একই সাথে থুতনী চেপে ধরে রাখার দরুন পুরো মুখটাও তার কেমন যেন ব্যথা ব্যথা করছিল। অয়ন্তীর আতঙ্কিত দু’চোখে যেন এখন রাফায়াতকে জ’ল্লা’দ মানব বলে মনে হচ্ছিল! এত ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা সহ্য করার পরেও অয়ন্তীর মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের হলো না! আত্নচিৎকার করা তো থাক দূরের ব্যাপার। মূলত ইচ্ছে করেই অয়ন্তী তার শরীরের ব্যথাটা বাইরে প্রকাশ করতে চাইছেনা। কী লাভ এই পি’শা’চ মানুষটার কাছে তার যন্ত্রণা প্রকাশ করে? সে কী বুঝবে এই যন্ত্রণার মানে? তার নিজের মধ্যেই তো নিজের জন্য কোনো আবেগ, অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। যে মানুষ নিজের শরীর এবং মনের যন্ত্রণাই বুঝতে চায়না সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সে অন্য কারো যন্ত্রণা কীভাবে বুঝবে?

যন্ত্রণা প্রকাশ করতে না পারার শেষ পর্যায়ে এসে অয়ন্তী দরদরিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো! চোখদুটোও অবিলম্বে বুজে নিতে বাধ্য হলো। থেমে থেমে রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল। একে তো পেটে সাংঘাতিক ক্ষুধা। দ্বিতীয়ত, শরীরের যন্ত্রণা। উভয় দিক মিলিয়ে তার বর্তমান অবস্থা খুবই ব’র্ব’র! এই পর্যায়ে এসে ক্রোধ থেকে যেন মুহূর্তের মধ্যেই বেরিয়ে এলো রাফায়াত! টনক নড়ল এতক্ষণে তার। ঝট করে অয়ন্তীর থুতনীটা ছেড়ে দিলো সে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে পাঁজা কোলে তুলে নিলো দুর্বল অয়ন্তীকে! ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে উঠল অয়ন্তী। ঘোলা ঘোলা দু’চোখে সে রাফায়াতের বিচলিত মুখশ্রীতে তাকাল। উদ্বিগ্ন হয়ে রাফায়াত দ্রুত পায়ে হেঁটে অয়ন্তীকে নিয়ে বিছানার ধারে গেল। বালিশের উপর ভর দিয়ে সোজা করে অয়ন্তীকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। ঝাপসা হয়ে আসা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে অয়ন্তী কেবল রাফায়াতকে প্রত্যক্ষণ করতে লাগল। খু’নিটা হঠাৎ এত ব্যস্ত হয়ে উঠছে কেন তার জন্যে? খু’নির কাজ তো শুধু যাকে তাকে খু’ন করা। যার তার প্রতি তো দয়া মায়া দেখানো নয়!

অস্থির ভাবাপন্ন হয়ে রাফায়াত খাবারের প্যাকেট গুলো খুলে সর্বপ্রথম বিরিয়ানির প্যাকেটটা হাতে তুলে নিলো। বেসিন থেকে হাতটা ভালো করে ধুঁয়ে এসে সে তড়িঘড়ি করে বিরিয়ানির প্যাকেটটা খুলল। অয়ন্তীর নেতিয়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখমণ্ডলে সে আ’হ’ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাকানো যাচ্ছেনা রুক্ষ হয়ে আসা এই কাতর মুখটির দিকে। হম্বিতম্বি হয়ে অয়ন্তীর পাশে এসে বসল রাফায়াত। অয়ন্তীর চিবুকের সামনে বিরিয়ানির একটা লোকমা ধরল। অমনি অয়ন্তী অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো! কথা বলার শক্তিটুকু যদিও আপাতত তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই তবুও সে তুখোড় জেদ দেখিয়ে বলল,,

“খু’নির হাতের খাবার খাব না আমি। হতে পারে খাবারে বি’ষ মিশিয়ে এনেছেন আপনি! খু’নির কাজই তো এসব। নিরীহ মানুষদের কোনো কারণ ছাড়া-ই অকাতরে খু’ন করা!”

মাথায় প্রচণ্ড রাগ চেপে বসলেও রাফায়াত এই মুহূর্তে ধৈর্য্যধারণ পথটি বেছে নিলো! অয়ন্তীকে বুঝানোর জন্য ঠাণ্ডা মাথায় বলল,,

“সকালে যা দেখছ তা ভুলে যাও। ছেলেটা মোটেও ভালো ছিলনা। তাই তাকে এতটা নি’ষ্ঠু’রভাবে মা’র’তে হয়েছিল। তবে ভয়ের কিছু নেই। সে এখনও বেঁচে আছে। কৈ মাছের প্রাণ তার! এত সহজে ম’র’বে না।”

ক্ষে’পে উঠল অয়ন্তী। সূচালো দৃষ্টিতে রাফায়াতের শূণ্য দু’চোখে তাকালো। ধারালো গলায় বলল,,

“আপনি কে হ্যাঁ? ভালো/খারাপ বিচার করার? ছেলেটা যদি এতই খারাপ ছিল তাহলে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলেন না কেন তাকে? কেন এতটা নি’ম’র্মভাবে তাকে ছু’রি’কা’ঘা’ত করলেন?”

ধৈর্যের পরীক্ষায় এবার আট ঘাট বেঁধে নেমেই পড়ল রাফায়াত! পুনরায় শান্তশিষ্ট ভাব নিলো। কোমল গলায় অয়ন্তীকে বুঝিয়ে বলল,,

“সব কাজ পুলিশদের দ্বারা হয়না অয়ন্তী! কিছু কিছু কাজ সাধারণ মানুষদেরও করতে হয়। এসব তুমি বুঝবে না ওকে? অনেক রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার আছে এতে। কথা না বাড়িয়ে খাবারটা খেয়ে নাও। দেখছ না? অসুস্থ হয়ে পড়ছ তুমি?”

অভিমানে অয়ন্তী আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিলো! কাঁদো কাঁদো হয়ে একরোঁখা গলায় বলল,,

“খাব না আমি বললাম তো। আপনি এখন যান এখান থেকে।”

মেজাজ হারিয়ে ফেলল রাফায়াত এবার! ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে জোর করে অয়ন্তীর মুখটা তার দিতে ঘুরিয়ে নিলো। হাতে থাকা বিরিয়ানির লোকমাটা ঠেসেঠুসে অয়ন্তীর মুখে ঢুকিয়ে দিলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,,

“তুই খাবিনা তোর ঘাড় খাবে। নে এবার খা। সোজা আঙুলে ঘি ওঠেনা। যতক্ষণ না আঙুল বাঁকানো হয়!”

জোর করে খাওয়ানোর দরুন অয়ন্তীর যেন চোখ-মুখ উল্টে আসছিল! মুখের খাবারটাও নাড়তে চাড়তে তার বড্ড বেগ পেতে হচ্ছিল। ইতোমধ্যেই মুখভর্তি খাবার সে কাশতে কাশতে রাফায়াতের গাঁয়ে ঢেলে দিলো! দাঁতে দাঁত চেপে রাফায়াত শক্ত হয়ে একই জায়গায় বসে রইল! রুদ্ধশ্বাস ফেলতে থাকা অয়ন্তীর দিকে সে আগুন ঝড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! মনে হচ্ছিল যেন এক্ষণি সে অয়ন্তীকে কাঁচা চি’বি’য়ে খেয়ে ফেলবে! ভয়ে আরও কাবু হয়ে গেল অয়ন্তী। থেমে থেমে শুকনো ঢোঁক গিলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

“এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না প্লিজ। ভয় করে আমার।”

বিক্ষুব্ধ হয়ে রাফায়াত তার নোংরা শরীরের দিকে একবার করে তাকালো! অতঃপর অয়ন্তীর দিকে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁজালো গলায় বলল,,

“এগুলা কী করছ তুমি হ্যাঁ? ছোটো বাচ্চাদের মত সব খাবার আমার গাঁয়ে ঢেলে দিলা?”

“কী কবর আর? খুব বমি পাচ্ছিল আমার। জোর করে খাবার খেতে পারিনা আমি। বমি হয়ে যায়।”

রাগে ছ্যাঁত করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। নোংরা শরীরের দিকে তাকিয়ে সে খরতরভাবে নাক সিঁটকালো! মুখ উল্টে রুক্ষ গলায় বলল,,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। এসেই যেন দেখি খাবারটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। যদি এর বিপরীত হয় তো আজ তুমি গেছ!”

অয়ন্তীকে স্পষ্ট ভাষায় হুমকি দিয়ে রাফায়াত রাগে গটগট করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। রাফায়াতের যাওয়ার পথে তাকিয়ে অয়ন্তী স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বুকে হাত রেখে চোখা জোড়া বুজল। হাঁফ ছাড়া গলায় বলল,,

“ইশশ! একটুর জন্য আজ জ’ল্লা’দটার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। তবে একটা জিনিস বুঝলাম না? গাঁয়ে বমি করে দেওয়ার পরেও ঐ জ’ল্লা’দটা কেন কোনো ওভার রিয়েক্ট করলনা? এত ভালো হয়ে যাওয়ার কারণটা ঠিক কী?”

এসব আকাশ কুসুম চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অয়ন্তী এবার বিরিয়ানিটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলো। এমনিতেই একটা মস্ত বড়ো অপ’রাধ করে ফেলেছে সে। তার উপর যদি এখন আবার রাফায়াতের কথার নড়চড় হয় তো আজ তার খবর আছে! হয়তো সকালের দেখা ভিডিও ক্লিপটির মতই তাকেও এতটা বর্ব’রভাবে আ’হ’ত করা হবে! যেই ভাবা সেই কাজ। রাফায়াতের ভয়ে অয়ন্তী প্যাকেটে থাকা প্রায় অর্ধেক বিরিয়ানি গপাগপ করে গিলে খেলো! ফ্রেশ হয়ে রাফায়াত বদরাগী ভাব নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখল অয়ন্তী রা’ক্ষু’সীর মত বড়ো বড়ো লোকমা তুলে কোনো রকম চিবানো ছাড়াই বিরিয়ানিগুলো গিলে খাচ্ছে! চোখে-মুখে তার অঢেল আতঙ্কের ছাপ। কপালের ভাঁজে ভাঁজে প্রখর দুঃশ্চিন্তার লহর। এতটুকু সময়ের মধ্যে বিরিয়ানিটা শেষ করাই যেন তার পরম কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! খাবার গলায় আটকে আসার পরেও যেন পানির তেষ্টা পাচ্ছেনা তার! বিষয়টায় খুব অবাক হলো রাফায়াত। ভেতরে ভেতরে খুব হাসিও পাচ্ছিল তার! অয়ন্তীর এই করুন দশা তাকে হাসাতে বাধ্য করল!

যাই হোক, ডেস্কের উপর থেকে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া অয়ন্তীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সে গলা খাঁকিয়ে বলল,,

“এই নাও পানি।”

রাফায়াতের খরখরে গলার আওয়াজ অয়ন্তীর কানে আঘাত হানা মাত্রই যেন পিলা চমকে গেল তার! সঙ্গে সঙ্গেই নাকেমুখে ওঠে গেল তার। কাশতে কাশতে সে চোখ উল্টিয়ে রাফায়াতের দিকে তাকালো। অয়ন্তীর এই করুন দশা দেখে রাফায়াত কপাল চাপড়ালো! এমন ডার পোক মেয়ে আগে কখনো দেখেনি রাফায়াত। কাশিটা যেন ভারী হতে লাগল অয়ন্তীর। অস্থির হয়ে উঠল রাফায়াত। বোতলের ছিপিটা খুলে সে অয়ন্তীর মুখ চেপে ধরে পানিটা তাকে গড়গড় করে খাইয়ে দিলো। মাথায় দু/একটা চাপড় মেরে সে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ঠিক আছো এখন?”

জিরিয়ে জিরিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলতে লাগল অয়ন্তী। মাথা উঁচিয়ে রাফায়াতের দিকে টলমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অস্ফুটে গলায় বলল,,

“ঠিক আছি।”

“পানি খাবে আর?”

“না।”

“খাওয়ার সময় একটু দেখেশুনে খেতে পারো না?”

“আপনিই তো ভয় দেখাচ্ছিলেন!”

“কথা শুনছিলে না বলেই ভয় দেখাতে বাধ্য হয়েছিলাম। এমনি এমনি নিশ্চয়ই রেগে যাইনি আমি?”

“একটা কথা শুনবেন?”

“কী?”

“বাড়ি যাব আমি!”

অসহায়ত্ব যেন প্রগাঢ়ভাবে ফুটে উঠল অয়ন্তীর চোখে-মুখে! মায়াভরা এই মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকত পারলনা রাফায়াত। চোখ দুটো যেন তার ভেঙে আসছিল। অয়ন্তীর এই অবুঝ আবদারটাকে যেন কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যায়না! তবে এই মুহূর্তে রাফায়াতকে এতটা দুর্বল হলে চলবেনা। যতটা সম্ভব শক্ত থাকতে হবে। নিমিষেই অয়ন্তীর মায়াভরা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো রাফায়াত। প্রসঙ্গ পাল্টে বিধ্বস্ত অয়ন্তীকে ভুলাতে চাইল। বিছানার এক কোণায় পড়ে থাকা শপিং ব্যাগটি সে হাত বাড়িয়ে নিলো। অয়ন্তীর দিকে ব্যাগটি তাক করে বলল,,

“ট্রায়াল দিয়ে দেখো তো। সাইজ ঠিক আছে কী-না?”

ক্ষোভে বশ হয়ে থাকা অয়ন্তী যেন পলকের মধ্যেই রাফায়াতের হাত থেকে ব্যাগটি কেড়ে নিলো। ছুঁ মেরে ব্যাগটি আবার মেঝেতে ছুড়ে ফেলতেও বেশী দেরী হলোনা তার! হিংস্র সাপের ন্যায় সে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,,

“লাগবে না আপনার এই দয়া! এক কাপড়েই আমি যুগ যুগ পাড় করে দিব। এই বদ্ধ রুমে একা পঁচে গলে ম’র’ব।”

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অয়ন্তী বিছানার চাঁদর আঁকড়ে ধরে অবিরত কান্নায় ভেঙে পড়ল। রাগটা যদিও রাফায়াতের নাকের ডগায় চলে এসেছিল তবুও আকাশচুম্বী রাগটাকে সে সন্তপর্ণে সামলে নিলো। অবিশ্বাস্যভাবেই অয়ন্তীর পাশে বসে সে অয়ন্তীর দিকে ঈষৎ ঝুঁকল। সবধরনের জড়তা কাটিয়ে সে তার সীমালঙ্ঘন করতে প্রয়াত হলো! মনের খচখচানি দূর করে কোমল হাতে অয়ন্তীর মাথায় হাত বুলাতে লাগল! রাগের পাহাড় যেন চেপে বসল অয়ন্তীর মাথায়। ঝট করে সে রাফায়াতের হাতটা তার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার কিঞ্চিৎ পূর্বেই রাফায়াত অয়ন্তীকে ঘুরিয়ে তার বুকের মাঝে চেপে ধরল! পরম আবেশে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল অয়ন্তীকে সে। প্রশান্তিতে চোখজোড়া বুজল। সানন্দে বলল,,

“অনেক হয়েছে। আর রাগ দেখাতে হবেনা। ঘুমুও এবার।”

রাফায়াতের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর অন্তপ্রাণ চেষ্টা করল অয়ন্তী। উদ্দেশ্যে ব্যর্থ সে এবার রাফায়াতের বুকে একের পর এক কি’ল/ঘু’ষি মা’র’তে লাগল। রাগে গজগজ করে বলল,,

“ছাড় আমাকে শ’য়’তা’ন। আমাকে কি’ড’ন্যা’প করে এনেও শান্তি হসনি তুই? এখন আবার র‌্যা”প করতে এসেছিস?”

ব্যগ্র হাসল রাফায়াত। অয়ন্তীর হাত দুটো খপ করে চেপে ধরল! উষ্ণ শ্বাস ফেলে অয়ন্তীর কর্ণতলে তার নরম ওষ্ঠদ্বয় ঠেকালো। মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন কেঁপে উঠল অয়ন্তীর! শরীরময় কাঁটা দিয়ে উঠল তার। উষ্ণ প্রেমের আবেশে দেহ মাতাল হয়ে উঠল। আবেগে অতি রঞ্জিত হয়ে রাফায়াত ডানপিটে গলায় বলল,,

“র‌্যা”প তো এমনি করেনা জান! অন্যভাবে করে। করে দেখাব না-কী?”

বিচলিত হয়ে উঠল অয়ন্তী। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় আঁতকে উঠল। মনের ভেতরটা উসখুস করতে লাগল তার। দিশা টিশা হারিয়ে সে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,,

“নায়ায়ায়া। প্লিজ আমার কোনো ক্ষতি করবেন না।”

দেঁতো হাসল রাফায়াত। অয়ন্তীকে পুনরায় জাপটে ধরল বুকের মাঝে। স্বস্তি ফিরে পেতেই সে প্রেম মাখানো গলায় অয়ন্তীকে বলল,,

“ওকে ফাইন। তাহলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। আর একটা সাউন্ডও যেন মুখ থেকে বের না হয় ওকে?”

নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল অয়ন্তী! সম্মান বাঁচানোর তাগিদে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিলো! হাত-পা নিশপিশ করছে তার। রাফায়াতকে চ’ড়/থা’প্প’ড়/লা’ত্থি মা’রার জন্য! রাফায়াতের বলিষ্ঠ শরীরের চাপে যেন নরম শরীরটা চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল অয়ন্তীর! শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। আর একটু নড়েচড়ে ধীরে সুস্থে ঘুমানো তো দূরে থাক! এত অসুবিধা নিয়ে আবার ঘুমানো যায় না-কী? একজন ম’র’ছে নানা রকমের অস্বস্তি নিয়ে আর অন্যজন ভাসছে মহাসুখে! ভালো থাকার ঔষধটাকে বুকে পেতেই যেন যত রাজ্যের সর্বনাশা ঘুম রাফায়াতের দু’চোখে ভর করল! রাফায়াতের চরম এই সুখ দেখে যেন অয়ন্তীর গাঁ টা জ্বালা-পোঁড়া করছিল! শরীরের জ্বলন নিয়েই একপর্যায়ে অয়ন্তীও গভীর ঘুমে ডুব দিলো।

__________________________

গভীর আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে অনিক ঈষৎ ঝুঁকে প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! অস্থিরতা যেন তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। তর সইছেনা তার কাঙ্ক্ষিত জবাবটি প্রিয়ার কাছ থেকে শুনতে। অনিকের ছটফটানি বুঝতে পারল প্রিয়া। রাফায়াতের কথামতো ঠিক এই অস্থিরতাটিই অনিকের কাছ থেকে প্রিয়া আশা করেছিল! ইতোমধ্যেই প্রিয়া হেঁতো হেসে হাতটা অনিকের দিকে বাড়িয়ে দিলো। মিচকে হেসে বলল,,

“আগে তোমার শর্ত রাখো। এরপর বলছি অয়ন্তী কোথায়!”

“তুমি শিওর জানো? অয়ন্তী কোথায়?”

“জানি বলেই তো তোমাকে এখানে ডেকে আনা। রি’স্ক আছে জেনেও তোমার সাথে মিট করা।”

“সব বুঝলাম। কিন্তু তুমি হঠাৎ আমার ফোন চাইছ কেন? এর কারণটা তো বুঝলাম না?”

“কারণ তেমন কিছুই না। তবে আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা! হতে পারে তুমি আমাদের কথা বলার মুহূর্তটা ভিডিও করে রাখলে! পরে উদ্দেশ্য সফল না হলে ভিডিওটা রাফায়াতকে সেন্ড করলে! এতে তো হীতে আমারই ক্ষতি হবে তাইনা? সো এত বড়ো রি’স্ক আমি নিতে চাইছিনা!”

“খুব চালাক না? বুদ্ধি খুলে গেছে ইদানিং?”

“হোয়াই নট? দুই পলি’টিশি’য়ানের সাথে ওঠা বসা আমার। পলি’টি’ক্স তো আমিও কিছু শিখেছি তাইনা?”

কদাচিৎ হেসে অনিক তার সেলফোনটি প্রিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো! মুখের মাক্সটা ঠিক করে পড়ে সে এবার পায়ের উপর পা তুলে বসল। বেশ ভাবসাব নিয়ে ঝেড়ে কেশে বলল,,

“তো এবার বলো? অয়ন্তী কোথায়?”

“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আগে তো তোমার ফোনের পাসওয়ার্ডটা বলো?”

“হোয়াট? ফোনের পাসওয়ার্ড দিয়ে তুমি কী করবে?”

প্রতিউত্তরে কী বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলনা প্রিয়া! এদিকে আবার রাফায়াতের ঠিক করে রাখা ছেলেটির শকুনের দৃষ্টিও যেন প্রিয়ার দিকে সীমাবদ্ধ! কোনদিক টের বেটের হওয়া যাবেনা। বুদ্ধি খাটিয়ে ঝেড়ে কাশল প্রিয়া। পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার সর্বাত্নক চেষ্টা করল। হুট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো সে! গড়গড়িয়ে বলল,,

“ওকে বাবা। পাসওয়ার্ডটা না দাও তবে অন্তত আমাকে তো একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার পারমিশনটা দাও!”

“হোয়াট? এই সময়ে আবার ওয়াশরুম?”

“ইয়ে তো আর বলে কয়ে আসেনা তাইনা?”

“রা’বি’শ। আমার ফোন রেখে যাও।”

“আরে ফ্ল্যাশলাইট লাগবে তো! আমার ফোনটা আবার বাসায় ফেলে এসেছি।”

“হোয়াট দ্যা ফাঁ*! টয়লেটে কী লাইটের ব্যবস্থা নেই?”

“মেবি নেই৷ নতুন রেস্টুরেন্ট তো তাই!”

বিরক্তিতে নাক চুলকালো অনিক। প্রিয়ার দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,

“গেট আউট। দশ মিনিটের মধ্যে আমার ফোন ব্যাক চাই।”

হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল প্রিয়া! স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,,

“থ্যাংস অ্যা লট অনিক। জাস্ট ফাইভ মিনিট সময় দাও আমায় ওকে?”

হম্বিতম্বি হয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো প্রিয়া। অমনি পাশের টেবিলের খবরের কাগজ দ্বারা মুখ ঢেকে বসে থাকা ছেলেটি প্রিয়ার পিছু নিলো! অন্যদিকে রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল অনিক। এদিক-ওদিক তাকানোর মুড নেই তার। নিজের খেয়ালেই ব্যস্ত সে। কখন কোন দিক থেকে বিপদ এসে তার ঘাড়ে পড়ে এসব নিয়ে চিন্তিত সে। রাফায়াত যেমন অনিককে নিয়ে ভয় পায়, তেমনি অনিকও কিন্তু রাফায়াতকে নিয়ে আতঙ্কে থাকে!

অনিকের অন্যমনস্কের সুযোগ নিলো প্রিয়া। পেছনের দিকে আঁড়চোখে তাকালো। ইতোমধ্যে সেই ছেলেটিও এসে প্রিয়ার পেছনে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই প্রিয়া ফোনটা ছেলেটির হাতে তুলে দিলো। ফোনটি হাতে পাওয়া মাত্রই ছেলেটি রকেট গতিতে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে দৌঁড়ে পালালো!

#চলবে…?

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

অনিকের অন্যমনস্কের সুযোগ নিলো প্রিয়া। পেছনের দিকে আঁড়চোখে তাকালো। ইতোমধ্যেই সেই ছেলেটিও এসে প্রিয়ার পেছনে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই প্রিয়া ফোনটি ছেলেটির হাতে তুলে দিলো। ফোনটি হাতে পাওয়া মাত্রই ছেলেটি রকেট গতিতে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে দৌঁড়ে পালালো!

প্রিয়াও এবার এক ছুটে রেস্টুরেন্টের টয়লেটে ঢুকে পড়ল! ভেতর থেকে দরোজার খিলটা আটকে সে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে লাগল। আধো আলোতে ঘেরা টয়লেটটিতে তাকিয়ে সে নাক সিঁটকালো।অতঃপর মুখে ওড়না চেপে ধরে হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“থ্যাংকস গড। একটা কাজ তো অন্তত ঠিকঠাক মত হলো। এবার দ্বিতীয় কাজটা ঠিকঠাক মত করার পালা।”

ওয়াশরুমে আরও কিছুক্ষণ থেকে প্রিয়া অযথা সময় অপচয় করল। সেকেন্ড প্ল্যানিং অনুযায়ী নিজেকে তৈরী করতে লাগল। ট্যাব ছেড়ে হাতে কোষ ভর্তি পানি নিলো। সেখান থেকে দু’ফোঁটা জল তার চোখের কোটরে অনায়াসে ভরে নিলো! টলটলিয়ে পানি ঝড়তে লাগল চোখের কোণ থেকে। এমন করে আরও তিন থেকে চারবার প্রিয়া এই একই কাজ করল। মিথ্যে কান্নার ভান ধরল সে! যতটা সম্ভব মুখশ্রীতে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলল। মুখো ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তার মত অসহায় ব্যক্তি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই! তার নাটক করার অভিজ্ঞতা যেন সিনেমার হিরোইনদের ফেল করাবে!

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়া টয়লেট থেকে বের হয়ে এলো! যেহেতু সকাল টাইম তাই রেস্টুরেন্টে কাস্টমারদের ভীড় একদম নেই বললেই চলে। পুরো ফাঁকা এক রেস্তোরা। তাই এই মুহূর্তে রেস্টুরেন্টে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটলেও হীতে কোনো ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরাও এখন তাদের নানাবিধ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবে প্রিয়ার গলা ফাটানো চিৎকারের আওয়াজ শোনা মাত্রই যেন তারা তাদের সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ঘটনাচক্রে আসতে বাধ্য হলো। অন্যদিকে অনিকও বেশ বিচলিত হয়ে পিছু ঘুরে তাকালো। ক্রন্দনরত প্রিয়াকে দেখামাত্রই তার কলিজাটা অস্বাভাবিকভাবেই মোচড় দিয়ে উঠল! খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা তাকে গ্রাস করতে লাগল। যদিও সে প্রথম থেকেই খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করতে পেরেছিল! প্রিয়ার বর্তমান অবস্থা দেখে এবার সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল। আশঙ্কা তার সত্যিতে পরিণত হলো।

উত্তেজিত হয়ে টেবিল ছেড়ে ওঠে এলো অনিক। প্রিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে রুদ্ধশ্বাস ফেলতে লাগল। ক্ষুদ্ধ হয়ে দু’হাত দ্বারা প্রিয়াকে ঝাঁকাতে লাগল। প্রিয়ার আতঙ্কিত দু’চোখে তার অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই আমার ফোন কোথায়?”

অতিরিক্ত কান্নার সাথে সাথে শুকনো ঢোঁকও গিলল প্রিয়া। অনিকের আগুন ঝড়া দু’চোখে তার ভয়ানক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অনিকের চোখেমুখের এহেন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে কথা জড়িয়ে আসছিল তার। তবুও যেন সে বুকে সাহস রেখে ভীরু গলায় বলল,,

“সরি অনিক। আমার অসাবধানতার জন্যই তোমার ফোনটা টয়লেটের ভেতরে পড়ে গেছে!”

“কু”ত্তা”র বাচ্চা! তুই ইচ্ছে করে এমন করেছিস না?”

ঠাস ঠাস করে প্রিয়ার দু’গালে দু চ’ড় লাগিয়ে দিলো অনিক! মুহূর্তেই প্রিয়াকে ছেড়ে সে এক দৌঁড়ে টয়লেটের দিকে চলে গেল। হন্ন হয়ে টয়লেটের ভেতরে প্রবেশ করে সে হাই কমোডের দিকে এগিয়ে গেল। কমোডের ঢাকনাটি খুলে সে অন্য হাত দ্বারা তার নাক টিপে ধরল। পারছেনা সে কমোডের ভেতরে এক্ষণি হাত ঢুকিয়ে দিতে! কীভাবে তার মহামূল্যবান ফোনটি সে উদ্ধার করবে তার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছিল।টয়লেটের ভেতরে থেকেই সে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের চিৎকার করে ডাকতে লাগল। অনিকের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা প্রত্যেকে টয়লেটের ভেতর চলে এলো। রাগে অস্থির হয়ে অনিক হাত-পা ঝাড়তে লাগল। চুল টেনে ঝাঁজালো গলায় কর্মচারীদের বলল,,

“এট অ্যানি কস্ট আমার ফোন ব্যাক চাই। আমার ফোনের মেমোরীটা ব্যাক চাই। তোরা যেভাবেই পারিস আমার ফোন ব্যাক করে দে।”

ভেতরে এত বেশী চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার দৌঁড়ে এলেন ওয়াশরুমে। নির্বোধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারীদের দিকে একবার তাকিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। গলা ঝেড়ে উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“কী হয়েছে স্যার? অ্যানি প্রবলেম?”

“আমার ফোনটা কমোডের ভেতর ঢুকে গেছে। এটা অ্যানি কস্ট আমার ফোনটা আমি ব্যাক চাই। এবার আপনারা যেভাবে পারুন আমার ফোনটা ব্যাক করে দিন।”

“সরি স্যার। এখানে তো আমাদের কোনো ফল্ট নেই। এমন তো নয় যে আমি বা আমার রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা আপনার ফোনটা কমোডে ফেলে দিয়ে গেছে। যদি এমন হত নিশ্চয়ই আমরা রিস্ক নিতাম। ভুলটা যেহেতু আপনার কারণেই হয়েছে সো সেখানে আমাদের কিছু করার নেই স্যার। প্লিজ বিষয়টা লজিক্যালি ভাবুন।”

মাথা যেন অচল হয়ে গেল রাফায়াতের! কোনো বুদ্ধিই কাজ করছেনা তার। কেবল হাইপারটেনশন কাজ করছে তার। মুহূর্তেই কর্মচারীদের ঠেলে সে প্রিয়াকে খুুঁজতে খুঁজতে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে এলো। ওমা! সে কী? রেস্টুরেন্টের কোথাও তো প্রিয়ার ছায়াটিও দেখা যাচ্ছেনা! তবে কী প্রিয়া তাকে গোল দিয়ে পালালো? এই ছিল প্রিয়ার মনে? তার মানে কী প্রিয়া ইচ্ছে করেই তার ফোনটা কমোডের ভেতরে ফেলে দিয়েছে? কোনোভাবে ভিডিওটি লোপাট করার জন্য? রাফায়াতও কী এই প্ল্যানিংয়ের সাথে যুক্ত আছে? মাথাটা যেন ঘুরে এলো অনিকের। দিশেহারা হয়ে সে মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তার সাজানো প্ল্যানিং রাফায়াত এভাবে চোপাট করে দিলো? তার সাথে ট্রিপল গেম খেলল?

প্রিয়ার গাল দুটি অসম্ভব জ্বালা করছে! না চাইতেও চোখ থেকে তার টলটলিয়ে পানি ঝড়ছে। তবুও যেন সেই ব্যথা তার কাছে তুচ্ছ! রাফায়াতের আগে তার কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাসায় পৌঁছেই প্রিয়া প্রথমে অনিকের ফোন থেকে সিম এবং মেমোরি কার্ডটি আলাদা করল। সিমটি ভেঙে গুড়িয়ে সে মেমোরি কার্ডটি সযত্নে তার বিছানার তলায় রেখে দিলো। রাতে রাফায়াত বাড়ি ফিরলেই সে মেমোরিটি রাফায়াতের হাতে তুলে দিবে। অনিক যে কখনও এই বাড়িতে আসার দুঃসাহস দেখাবেনা তা প্রিয়া বেশ ভালোভাবেই জানে। জানের ভয় তো সবারই আছে! মনে মনে ভীষণ খুশি প্রিয়া। জীবনে প্রথমবার রাফায়াতকে সে খুশি করতে যাচ্ছে!

___________________________

রাত্রী প্রায় এগারো বেজে পয়ত্রিশ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। অয়ন্তী তার মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে চোখে বুজে যেন প্রশান্তির ঘুম ঘুমুচ্ছে! তার মা ও অতি যত্নে,আদরে,ভালোবাসায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ তিন থেকে চারদিন পর মেয়েকে তিনি কাছে পেয়েছেন। পারছেন না যেন এক্ষণি তিনি মেয়েকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেন। চুমোয় চুমোয়ে মেয়েকে ভরিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

অন্যদিকে অয়ন্তীর বাবা, রাফায়াত এবং চঞ্চল মিলে তাদের পূর্ণ মনোযোগ সহকারে অয়ন্তীদের জায়গা-সম্পত্তির দলিলপত্র ঘাটছে। সব তল্লাশির পর দেখা গেল তাদের জায়গা-সম্পত্তির আসল দলিলপত্র একটাও নেই ফাইলে! সব নকল দলিলপত্র! এতদিন ধরে অনিক ঢাকায় থেকে চুপিসারে সব আসল দলিলপত্র হাতিয়ে নিয়েছে। তার পরিবর্তে নকল দলিলপত্র সব ফাইলে রেখে দিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় অয়ন্তীর মা এবং বাবাকে এতদিন যাবত পা’শ’বিক নির্যাতন করে তাদের হাতের সিগনেচার ও রেখে দিয়েছে! আজ সকালে যখন রাফায়াত এবং চঞ্চল ঢাকায় অয়ন্তীদের বাড়ি গেল অনিকের ল্যাপটপটি উদ্ধার করতে তখনি তারা বাড়ির মেইন দরোজা ভেঙে অয়ন্তীর মা এবং বাবাকে রুমে বন্দি অবস্থায় পেল! পরে আরিফ এবং আলিজার সাহায্যে তারা বদ্ধ রুম থেকে অয়ন্তীর মা এবং বাবাকে উদ্ধার করে। অনিকের বিরুদ্ধে এই নিয়ে পুলিশ কেইসও করা হয়। তবে সকাল থেকেই অনিক ফেরার! তবুও রাফায়াত রি’স্ক নিতে চায়নি। অয়ন্তীর মা এবং বাবাকে তার সাথে করে চট্টগ্রাম অয়ন্তীর ফ্লাটে নিয়ে আসে। সরাসরি তাদের নিয়ে বাড়ি যাওয়া রাফায়াতের পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়ির লোকজন নানা ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারে। হয়ত বাড়িতে তাদের থাকতে দিতেও অসম্মতি প্রকাশ করতে পারে। এতদূর থেকে দুজন মানুষকে তার ভরসায় এনে অপমান করতে চায়নি রাফায়াত।

অনিককে ধরা এখন রাফায়াতের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ল্যাপটপ থেকে সমস্ত প্রমাণও সে লোপাট করে দিয়েছে। মেমোরি খুলে ল্যাপটপ ভেঙেচূড়ে খান খান। রাত গভীর হতেই অয়ন্তীকে অয়ন্তীর মা-বাবার কাছে রেখে রাফায়াত তার বাড়ি ফিরে গেল। প্রথমে প্রিয়ার কাছ থেকে ফোনের মেমোরি কার্ডটি হাতিয়ে নিলো। মেমোরিটা কোনো কারণে নষ্ট করতে চাইলনা সে। নিজের কাছেই রেখে দিলো। এর মধ্যে আবার বাড়িতে রাফায়াত এবং প্রিয়ার বিয়ে নিয়ে কথা চলছিল! আগামী সপ্তাহে-ই তাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হলো। রাফায়াতের কানে খবরটা যেতেই রাফায়াত সরাসরি তা প্রত্যাখান করে দিলো! প্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়েই রাফায়াত তার মা’কে বলল,,

“আমার কিছুটা সময় লাগবে মা। প্লিজ এক্ষণি তোমরা আমার বিয়ে নিয়ে ভেবো না।”

প্রিয়াসহ বাড়ির প্রত্যেককে উপেক্ষা করে রাফায়াত বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল! বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চঞ্চলকে নিয়ে ফারার অনিককে খুঁজতে বের হয়ে গেল। রাফায়াতের যাওয়ার পথে তাকিয়ে প্রিয়া চোখের জল ছেড়ে দিলো! তবে কী রাফায়াতও তার সাথে অভিনয় করল? অনিকের মত রাফায়াতও প্রিয়াকে ব্যবহার করল?

পুলিশের সাহায্য নিয়ে রাফায়াত ঢাকা শহরের চেনা-জানা প্রতিটা অলিগলি চুষে ফেলল৷ এমনকি চট্টগ্রাম অনিক যে ফ্লাটটি নিয়ে থাকে সেই ফ্লাটটিতেও তল্লাশি চালালো। কোথাও অনিকের কোনো অস্তিত্ব বিশেষ খুঁজে পাওয়া গেল না। এত বড়ো শহরে অনিককে খুঁজে বের করাও এখন দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত সহজে অনিককে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। একটা বিষয় নিয়ে রাফায়াত বড্ড দুঃশ্চিতায় আছে। অনিক না নিজের গাঁ ঢাকা দেওয়ার জন্য আবার ডুবাই তার বাবা-মায়ের কাছে ডুব দেয়!

রাতভর অনিককে খুঁজল রাফায়াত এবং চঞ্চল। নেতার আশেপাশে থেকে কন্সট্রাকশন নিয়ে কিছু টুকিটাকি কাজও রাফায়াত সেরে নিলো। ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই চঞ্চল তার বাড়ি ফিরে গেল। রাফায়াত হয়ে গেল একলা। এই মুহূর্তে তার বাড়িতে যাওয়া ঠিক নাকি অয়ন্তীর ফ্লাটে যাওয়া উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছিলনা সে। তবে বাড়ি ফিরলে এখন প্রিয়াসহ বাড়ির সবার ঘ্যান ঘ্যান শুনতে হবে তাকে। এরচেয়ে বরং ফ্লাটেই যাওয়া যাক। অয়ন্তীকে একবার চোখের দেখা দেখে আসা যাক।

সকাল সাতটা অবধি রাফায়াত তার বাইক নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালো। সাতটার পর হোটেল থেকে নাশতা নিয়ে সে ফ্লাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অস্বস্তি নিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীর রুমের কলিংবেল চাপতেই হুড়োহুড়ি করে অয়ন্তী এসে দরোজা খুলে দিলো! ঘুম জড়ানো নিবিড় চোখে সে রাফায়াতের দিকে তাকালো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

“কাল রাতে আর আসলেন না কেন?”

অয়ন্তীর এই অদ্ভুত প্রশ্নে অবাক হলো রাফায়াত। ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচিয়ে সে নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? আসার কথা ছিল নাকি আমার?”

দীর্ঘ এক হামি তুলে চোখ কচলালো অয়ন্তী। ঘুমের ঘোরে সে মনের সমস্ত ভাবনাচিন্তা আর একটুর জন্য উগলে দিচ্ছিল! সম্বিত ফিরে পেতেই সে রাফায়াতের বিস্মিত দৃষ্টিতে আবিষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্রসঙ্গ পাল্টে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“পাশের রুমটাও কী আপনি ভাড়ায় নিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। তোমার বাবা-মায়ের জন্য।”

“আমরা আর কতদিন থাকব এখানে?”

“যতদিন অবধি না অনিককে খুঁজে পাচ্ছি ততদিন।”

“বাইরে দাঁড়িয়ে কেন কথা বলছেন? ভেতরে আসুন।”

“না। ভেতরে আসব না। একচুয়েলি তোমাদের সকালের নাশতাটা দিতে এসেছিলাম।”

“কিন্তু ভেতরে আসবেন না কেন?”

“আঙ্কেল, আন্টি আছেন। মাইন্ড করতে পারেন।”

“একটা কথা বলার ছিল আপনাকে!”

“কী?”

“সরি!”

“সরি ফর হুয়াই?”

“এইযে এতদিন আপনাকে খারাপ লোক ভেবে আসছিলাম তাই! আচ্ছা এতদিন আপনি বললেন না কেন? অনিক ভাইয়া যে ভেতরে ভেতরে আমাদের ক্ষ’তি করে আসছিল? আর এই খারাপ লোকটার থেকে বাঁচানোর জন্য-ই আপনি আমাকে কি’ড’ন্যা’প করে এনেছিলেন।”

“কারণ, আমি চাইতাম না রাফায়াতকে তুমি ভালোবেসে ফেলো! তাহলে তো রাদিফের সাথে অন্যায় করা হবে তাইনা?”

অয়ন্তীকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে রাফায়াত নাশতার প্যাকেটটা অয়ন্তীর হাতে ধরিয়ে দিলো। অচিরেই অয়ন্তীর দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মন ভুলানো এক অদ্ভুত হাসি হাসল। দ্রুত কদমে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। পেছন থেকে রাফায়াতকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল অয়ন্তী। তার দূরদৃষ্টি পড়ল হঠাৎ রাফায়াতের পকেট থেকে পড়ে যাওয়া ভোটার আইডি কার্ডটির দিকে!

_________________________________

বাড়ি ফিরেই রাফায়াত পড়ে গেল মহা মুশকিলে। বিছানার উপর একটি চিরকুট রেখে প্রিয়া চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে! চিরকুটটিতে কেবল পাঁচ শব্দের একটি বাক্য লিখা ছিল। “আমাকে ক্ষমা করে দিও রাফায়াত।” ব্যস এটুকুই বার্তা বহন করল সেই চিঠিটি। এতেই যেন বাড়ি শুদ্ধু লোক সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেল রাফায়াতের উপর। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল সবাই। রাফায়াতের মা তো রাগে অতি ক্ষুব্ধ হয়ে রাফায়াতের গালে জোরেশোরে এক চ’ড়’ বসিয়ে দিলেন! আর্ত গলায় চিৎকার করে বললেন,,

“তোর জন্য আমার মা ম’রা মেয়েটা আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি তোকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না রাফায়াত। কখনো না।”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here