#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৬,২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
২৬
“তোর জন্য আমার মা ম’রা মেয়েটা আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমি তোকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না রাফায়াত। কখনও না।”
প্রিয়ার করা সমস্ত পা’প’ক’র্ম যদিও রাফায়াত আজ চেয়েছিল সবার সামনে ফাঁস করে দিতে, তবে প্রিয়ার প্রতি সবার মনে খারাপ ধারণা তৈরী হতে পারে বলে সে চুপ হয়ে গেল! যে মেয়েটা নিজের ভুল বুঝে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেছে অযথাই তার নামে বদনাম রটিয়ে লাভ আছে? তাছাড়া প্রিয়া যদি আদোতেই ভালো না হয়ে যেত তবে নিশ্চয়-ই তার জায়গাটা এভাবে নির্দ্বিধায় ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারত না? জো’র খাঁটিয়ে হলেও, রাফায়াতের প্রতি জু’লু’ম করে হলেও থেকে যেত! রাফায়াতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও রাফায়াতকে বিয়ে করার জন্য নানানভাবে হুমকি ধমকি দিত। যদিও তার কাছে থ্রে’ড দেওয়ার মত সুবর্ণ একটা সুযোগও ছিল! এত সুযোগ থাকার পরেও প্রিয়া কিন্তু এসবের কিছুই করেনি। বরং রাফায়াতের কাছে ক্ষমা চেয়ে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে! তাই এখন বরং যা হচ্ছে হতে থাক। সবাই যেহেতু রাফায়াতকে দোষী ভাবছে সেই দোষ নিয়েই রাফায়াত নিজের মত করে থাকুক। এমনিতেও দুনিয়ার সবাই রাফায়াতকে খারাপ হিসেবে-ই জানে।
মাথা নিচু করে রাফায়াত সবার কটুক্তি শ্রবণ করল। নতুন করে তার বাবার হাতের চ”ড়ও তার গালে পড়ল! ছোটোবেলা থেকেই প্রিয়া এ’তি’ম, অ’না’দ বলে তার প্রতি সবার দুর্বলতা কাজ করে। আর সেই দুর্বল জায়গা থেকে সবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠাটাই স্বাভাবিক। সবার মা’র’ধ’র খেয়ে রাফায়াত সবশেষে নিজের রুমে গেল। ভেতর থেকে রুমের দরোজা আটকে সে ঘর্মাক্ত এবং ক্লান্ত শরীর নিয়েই বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। একে তো চোখে প্রচুর ঘুম। দ্বিতীয়ত, মাথা যন্ত্রণা। প্রিয়ার জন্য তারও বেশ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে! কোথায় যেতে পারে প্রিয়া? এই বাড়ির লোকজন ছাড়া তো তার আপন বলতে আর কেউ নেই। চাচারা, ফুফুরাও তেমন ভালো নয় তার। দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে প্রিয়া এই বাড়িতে আছে। তারা কখনও একবারের জন্যও প্রিয়ার খোঁজ খবর নেয়নি! কখনও প্রিয়ার সাথে যোগাযোগ করার সামান্য চেষ্টাটিও করেনি। এত অবহেলা নিয়ে নিশ্চয়ই প্রিয়া তাদের কাছে যাবেনা? গেলেও তো তারা প্রিয়াকে থাকার জায়গা দিবেনা৷ তাহলে কোথায় যেতে পারে প্রিয়া? তার হোস্টেলে? নাকি কোনো বান্ধবীর বাড়িতে? অথবা অনিকের কাছে? শেষমেশ প্রিয়া আবারও অনিকের সাথে যোগ দিলো না তো?
এমন হাজারো রকমের দুঃশ্চিন্তা করতে করতে রাফায়াত কখন যেন ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেল বুঝতে পারলনা। সেই ঘুম ভাঙল তার বিকেল পাঁচটায়! ঘুম থেকে ওঠেই সে প্রথমে তার ফোনটা চেক করল। চঞ্চলের নাম্বার থেকে প্রায় চার/পাঁচটা কল। এর ফাঁকে আবার নেতার নাম্বার থেকেও একটা কল এসেছে। এলাকার জুনিয়র/সিনিয়র ভাইদের নাম্বার থেকেও প্রায় অনেকগুলো কল। ফোনটা হাত থেকে রাখল রাফায়াত। অতি রাগে রঞ্জিত হয়ে কপাল চাপড়ালো। আজ এত ঘুম সে কীভাবে ঘুমালো? এই সর্বনাশা ঘুমের কারণেই আজ অনেকগুলো কাজ তার জমে গেল। এত কাজ সে একসাথে কীভাবে সামলাবে তা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠল। এর ফাঁকে প্রিয়াকেও একবার খুঁজতে বের হতে হবে! অয়ন্তীর ফ্লাটেও একবার যেতে হবে। সকালের খাবারটা না হয় রাফায়াত তাদের জন্য ব্যবস্থা করে এসেছিল। কিন্তু দুপুরের খাবার? দুপুরে কী তারা না খেয়ে আছে?
হুড়োহুড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। মিনিট দশকের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে সে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। গাঁয়ে গাঢ় নীল রঙের একটি শার্ট জড়িয়ে সে ভেজা চুলে অগোছালোভাবেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। যদিও পেটে সরষে পরিমাণ দানা পানি নেই তার। তবে এই মুহূর্তে বাড়ির যা পরিস্থিতি খাবার খুঁজলে ঝা’ড়ু পে’টা খেতে হবে বৈ কী! তাই গাঁ বাঁচিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই রাফায়াত অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল ড্রয়িংরুমে বসে বাড়ির সবাই বলাবলি করছে প্রিয়া নাকি তার চাচা, ফুফুদের বাড়িতেও যায়নি! হোস্টেল, ফ্রেন্ডস সার্কেল কারো বাড়িতেও নেই! প্রিয়ার চেনা পরিচিত সব জায়গাতেই তারা তল্লাশি দিয়ে এসেছে। তবে কোথাও প্রিয়া নেই। এখন পুলিশ কেইস ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের হাতে।
বাইকে ওঠে পড়ল রাফায়াত। প্রিয়ার বিষয়ে আপাতত নাক গলাতে চাইল না সে! এখান থেকে প্রথমে তার অয়ন্তীদের বাসায় যেতে হবে। তাদের খোঁজ খবর নিয়ে চঞ্চলের সাথে দেখা করতে হবে। এরপর দুজন একসাথে নেতার বাড়ি যাবে। কোনো কাজ পড়ে গেল কিনা তা দেখবে। এরপর প্রিয়ার সন্ধানে লেগে পড়বে তারা। এর ফাঁকে অনিকের বিষয়টাও হ্যান্ডেল করবে! কোথায় গাঁ ঢাকা দিয়েছে সে খুঁজে বের করবে। বাইক নিয়ে রাস্তায় উঠতেই হঠাৎ রাফায়াতের মাথাটা ঘুরে এলো! সমস্ত শরীর তার নিঃশক্তি হয়ে এলো। এক্ষণি কিছু একটা খেতে হবে তাকে। না হয় অঘটন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাইকটা সাইডে রেখে বাড়ির পাশের হোটেলটিতে ভাত খেতে বসল রাফায়াত। খাবারদাবার অর্ডার করতেই হঠাৎ তার ফোনে নেতার নাম্বার থেকে কল এলো। তাড়াহুড়ো করে কলটি তুলল রাফায়াত। নম্র গলায় সালাম দিতেই ঐ পাশ থেকে নেতা সালামের জবাব নিলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন,,
“শোন রাফায়াত। একটা দরকারে তোকে কল করেছিলাম।”
“কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আসছি বস। সামনা- সামনি বসে না হয় কথা বলি?”
“ঠিক আছে। সামনাসামনিও কথা হবে সমস্যা নেই। তবে তোর রাদিফ নামের আইডি কার্ডটা আমার একটু লাগবে! আসার সময় কার্ডটা নিয়ে আসিস তো।’
“কিন্তু কেন বস? ঐ আইডি কার্ডটা তো এখন আমি তেমন কোনো কাছে ব্যবহার করিনা। অপ্রয়োজনীয়।”
“ঠিক আছে৷ বাট ঐ কার্ডটা এখন আমার দরকার। তুই এক কাজ কর আসার সময় কার্ডটা সাথে করে নিয়ে আসিস। এরপর না হয় এই বিষয় নিয়ে আমরা সামনাসামনি কথা বলব। এখন রাখছি ওকে?”
মুহূর্তেই কলটা কেটে দিলেন মির্জা ফখরুল হক। এরমধ্যেই সামনে খাবার চলে এলো রাফায়াতের। ভাবুক হয়ে উঠল রাফায়াত। যে মানুষটার অস্তিত্ব এখন আর নেই। সেই মানুষটার এন আই ডি কার্ড দিয়ে কী করবে মির্জা ফখরুল হক? এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতেই রাফায়াত তার খাবারটা খেয়ে শেষ করল। বিল পরিশোধ করে সে হোটেল থেকে বের হয়ে এলো। প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! এন আই ডি কার্ডটি তার পকেটে নেই। হম্বিতম্বি হয়ে রাফায়াত তার বাড়ি ফিরে গেল। পুরো রুম ঘেটেও সে তার এন আই ডি কার্ডটি খুঁজে পেলনা। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল রাফায়াত। কোন ভূতে চেপেছিল তার মাথায়? ঢাকায় যাওয়ার আগে কেন সে পুরাতন এন আই ডি কার্ডটি সাথে নিয়ে গেল? ঢাকা থেকে যু’দ্ধ বি’গ্র’হ করে চট্টগ্রাম আসা। চট্টগ্রাম এসে আবার পুরো চট্টগ্রাম হাতে নিয়ে ঘুরা। এর ফাঁকে এন আই ডি কার্ডটি হঠাৎ কোথায় পড়ে গেল? নেতাকে কী জবাব দিবে এখন সে? তিনি তো ভাববেন রাফায়াত ইচ্ছে করেই কার্ডটি সরিয়ে ফেলেছে! দিশেহারা হয়ে রাফায়াত এবার চঞ্চলের নাম্বারে কল করল৷ প্রথম কল বেজে উঠতেই চঞ্চল কলটি তুলে নিলো। খরখরে গলায় বলল,,
“কী রে? কই তুই?”
“আরে ভাই। ব্লান্ডার হয়ে গেছে একটা।”
“কী হইছে?”
“আমার পুরাতন এন আই ডি কার্ডটা খুঁজে পাচ্ছিনা।”
“কী বলিস? হারালো কীভাবে?”
“পকেটে ছিল। পকেট থেকে হয়ত কোথাও পড়ে গেছে।”
“এত দুঃশ্চিন্তার কী আছে? ঐ আইডি কার্ডটা তো এখন তোর আর কোনো কাজে লাগবেনা।”
“হ্যাঁ। কিন্তু নেতা সাহেব হঠাৎ আইডি কার্ডটা চাইছে।”
“কী বলিস? তাহলে তো মহা ঝামেলা।”
“হ্যাঁ। কার্ডটা এখন কোথায় খুঁজব বুঝতে পারছিনা।”
“কাল আমাদের জার্নিটা কিন্তু কম হয়নি। ঢাকা টু চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম টু অয়ন্তীর ফ্লাট। এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড। অয়ন্তীর ফ্লাটে আবার আইডি কার্ডটা ফেলে আসিসনি তো তুই? তাছাড়া কাল কিন্তু অয়ন্তী আমার মাক্সের উপর থেকেও বার বার আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল! সন্দেহ টন্দেহ কিছু করেনি তো আবার?”
“শিট! আই থিংক অয়ন্তীদের ফ্লাটেই আমি আইডি কার্ডটা ফেলে এসেছি। অয়ন্তীর হাতে আইডি কার্ডটা যাওয়ার আগেই কার্ডটা আমার উদ্ধার করতে হবে।”
কলটি কেটেই রাফায়াত ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বাইক নিয়ে অয়ন্তীদের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনটা ভীষণ কুহ্ গাইছে তার। বার বার মনে হচ্ছে অয়ন্তীর কাছে আজ ধরা পড়ে যাবে সে। অথচ সে চাইছেনা এখনি অয়ন্তীর কাছে ধরা পড়ে যাক! শুধু এখনি কেন? সে তার জীবদ্দশায়ও চাইছেনা অয়ন্তীর কাছে ধরা পড়ে যেতে! চাইছেনা অয়ন্তী আবারও তার হারিয়ে ফেলা রাদিফকে ভালোবেসে ফেলুক! আবারও রাদিফকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুক, নতুন আশায় বুক বাঁধুক! অবশ্য এরও কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে!
বেসামাল কিছু ভাবনাচিন্তা নিয়ে রাফায়াত দ্রুত গতিতে বাইক ছেড়ে দিলো। প্রায় আধঘণ্টার মধ্যেই সে অয়ন্তীদের ফ্লাটে চলে এলো। পাগল পাগল অবস্থা তার। জানে যেন পানি নেই। এক সিঁড়ির বদলে সে তিন সিঁড়ি টপকে উপরে উঠছে! ঘেমে নেয়ে শরীর তার ডুবু ডুবু। প্রচুর হাইপার টেনশন হচ্ছে।
চারতলার ব্যালকনিতে একটি দোলনার ব্যবস্থা রয়েছে। রুম থেকে বের হয়নি বলে অয়ন্তীর চোখে এতদিন দোলনাটি পড়েনি। তবে আজ যেহেতু সে অনেকটা স্বাধীনভাবে-ই রুম থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাই এই দোলনায় দোল খাওয়ার সুযোগটি সে মোটেও হাতছাড়া করতে চাইল না। এমনিতেও আজ অয়ন্তীর মনে রঙ লেগেছে বলা যায়! গোপন কিছু বের করতে পারার সুখ যেন তার আর ধরছে না। অধীর অপেক্ষায় আছে সে। কখন রাফায়াত দৌঁড়ে তার কাছে আসবে! কখন অয়ন্তী তার মনের গোপন সত্যিটা রাফায়াতকে বলবে।
খোশমেজাজে দোলনায় বসে সে দোল খাচ্ছিল অয়ন্তী। হাতে ছিল তার “আলুজ” চিপসের একটি প্যাকেট। চিপসের স্বাদে সে তালু তালু করছিল। সেদিনের রাফায়াতের আনা নাশতাগুলো এখন সে এক এক করে খেয়ে শেষ করছে।
ইতোমধ্যেই রাফায়াতকে সে তার রুমের দরোজার দিকে ছুটে আসতে দেখল। অমনি চিপস খাওয়া থামিয়ে অয়ন্তী বাঁকা চাহনিতে হম্বিতম্বি হয়ে দৌঁড়ে আসা রাফায়াতের দিকে তাকালো। তুড়ি মেরে গলা ঝেড়ে কাশল সে। অদূর থেকেই হেয়ালী গলায় রাফায়াতকে ডেকে বলল,,
“এই রাদিফ শোন? আমি এখানে!”
থেমে গেল রাফায়াত। মাথায় হাত চলে গেল তার। বিধ্বস্ত দৃষ্টি পড়ল দোলনায় বেশ চতুর ভাবসাব নিয়ে দুলতে থাকা অয়ন্তীর দিকে। যা বিপত্তি ঘটার এবার ঘটেই গেছে। এন আই ডি কার্ডটা অয়ন্তীর হাতে-ই পড়েছে! পরিস্থিতি সামলে উঠাও এখন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এভাবে হাল ছাড়লে চলবেনা। আজভাজ কিছু একটা বুঝিয়ে অয়ন্তীর ধারণা পাল্টে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই মুখমণ্ডলে নির্বোধ ভাব ফুটিয়ে তুলল রাফায়াত। উল্টে পাল্টে থাকা শার্টের কলারটা ঠিক করল সে। অবুঝের মত হেঁটে এসে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। কপালের ভাঁজে ফুটিয়ে তুলল অপার বিস্ময়ের ছাপ। গলা ঝেড়ে বলল,,
“হোয়াট? কে রাদিফ?”
দোলনা থেকে ওঠে দাঁড়ালো অয়ন্তী। শেষ হয়ে যাওয়া চিপসের প্যাকেটটি সে আঙুল দ্বারা চেটে খেলো। খাওয়া শেষে প্রশ্নবিদ্ধ রাফায়াতের দিকে এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। ধারালো গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,
“নাটক করছেন আমার সাথে না?”
“আজব! কীসের নাটক?”
“শুনুন? এসব সস্তা নাটক করে আর কোনো ফয়দা নেই। আমি বুঝে গেছি আপনিই রাদিফ!”
“মানে? কীভাবে?”
“ঐযে এন আই ডি কার্ড!”
“কোন এন আই ডি কার্ড?”
ধৈর্যহারা হয়ে উঠল অয়ন্তী। মুখশ্রীতে রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলল। দোলনায় তার পাশে থাকা এন আই ডি কার্ডটি নিয়ে সে রাফায়াতের মুখের কাছে তাক করল। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এটা কী হ্যাঁ? রাদিফ ভাইয়ার আইডি কার্ড নিশ্চয়ই এমনি এমনি আপনার কাছে আসবেনা? হয় আপনি রাদিফ ভাই নয় রাদিফ ভাইয়ার সাথে আপনার কোনো কানেকশন আছে!”
সুযোগ বুঝে রাফায়াত ছোঁ মেরে অয়ন্তীর হাত থেকে এন আই ডি কার্ডটি কেড়ে নিলো। আইডি কার্ডটি তৎক্ষণাৎ পকেটে ঢুকিয়ে সে অয়ন্তীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শানিত গলায় বলল,,
“নিজেকে অতি চালাক ভেবো না ওকে? আর রাদিফের সাথে তো আমাকে ভুলেও মিলাবে না। আমরা দুজনই সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ! না আছে চেহারার কোনো মিল। আর না আছে মনের মিল। যা আছে সব তোমার বুঝার ভুল!”
তেঁতে উঠল অয়ন্তী। ভয়ঙ্কর রাগী ভাব ধারণ করে যতটা সম্ভব রাফায়াতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। চোঁয়াল উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তার মানে আপনি রাদিফ ভাইয়ার সাথে কোনো না কোনোভাবে কানেক্টেড তাই তো?”
“হ্যাঁ! তো?”
চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ চিকচিক করে উঠল অয়ন্তীর। ঠোঁটের আলিজে তার মন মাতানো হাসি। একবুক আশা নিয়ে সে রাফায়াতকে বলল,,
“পারবেন? একবার রাদিফ ভাইয়ার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিতে?”
“রাদিফ তোমার সাথে দেখা করতে চায়না!”
একটু আগেও অয়ন্তীর মুখশ্রীতে ভেসে ওঠা আনন্দের ঢেউটা যেন কোথায় মিলে গেল! বিষাদের হাসি ফুটে উঠল তার শুষ্ক ঠোঁটে! কেমন যেন ভরাট গলায় বলল,,
“রাদিফ ভাইয়া নিজে আপনাকে এই কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ!”
টুপ করে দু’চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল অয়ন্তীর! অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো সে। বুকের ভেতর যন্ত্রণারা যেন দলা পাকালো তারা। ঘটা করে হৃদয়টা ভেঙে গেল! ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে এলো। মনে হলো যেন পাথর চেপেছে বুকে। কান্নার মাত্রা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে উঠতেই অয়ন্তী রাফায়াতকে ডিঙিয়ে দৌঁড়ে তার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। অমনি অয়ন্তীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রাফায়াত তার লুকিয়ে রাখা চোখের জলগুলো অকাতরে ছেড়ে দিলো! আবারও সেই লুটিয়ে পড়া চোখের জলগুলো সে অতি যত্নে মুছে নিলো। মিইয়ে আসা গলায় সে অয়ন্তীকে পেছন থেকে ডেকে বলল,,
“রাদিফ বলেছে তার নষ্ট জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চায়না! দু’বছর আগের দেখা রাদিফ আর এখনকার দেখা রাদিফের আকাশ পাতাল তফাৎ। কোনো লাইফ গ্যারান্টি নেই তার! এনি হাউ যে কেউ তাকে রাস্তা-ঘাটে ইন’কা’উ’ন্টার করে দিতে পারে! না হয় স’ন্ত্রা’সীদের হাতে তার খু;ন হতে পারে! তাই সে তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চায়না অয়ন্তী। ভুলে যাও তুমি রাদিফকে। তাহলেই তুমি ভালো থাকতে পারবে।”
রাফায়াতের কোনো কথাই কানে তুলল না অয়ন্তী। ঠাস করে রুমের দরোজাটি সে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো। দরোজায় হেলান দিয়ে বসে সে অঝড়ে চোখের জল ফেলতে লাগল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বোবা কান্নায় সিক্ত হয়ে বলল,,
“আমি শুধু তোমাকে একটি বার দেখতে চাই রাদিফ। শুধু একটি বার। আমি জানি তুমি আমাকে কখনও ভালোবাসো নি! কিন্তু আমি তো অতীতেও অনেক ভালোবাসতাম বলো? এখনও তো অনেক বাসি। হয়ত আগামী দিনগুলোতেও ঠিক এভাবেই ভালোবেসে যাব। আমার লক্ষ্য থেকে কেউ আমাকে নড়াতে পারবেনা রাদিফ। কাল থেকেই আমি তোমার সন্ধানে লেগে পড়ব! যে করেই হোক তোমার সন্ধান আমি খুঁজে বের করবই করব।”
শূণ্য মনে আকাশসম যন্ত্রণা নিয়ে রাফায়াত পিছু ঘুরল। মাথা নুইয়ে সে অয়ন্তীর রুমের দরোজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। অমনি অয়ন্তীর বাবার সাথে দেখা হয়ে গেল তার! দুপুরে তারা খেয়েছে দেয়েছে কিনা তার খোঁজ-খবর নিলো রাফায়াত। এর ফাঁকেই হঠাৎ চঞ্চলের নাম্বার থেকে কল এলো রাফায়াতের ফোনে। ধীরেসুস্থে রাফায়াত ফোনটি তুলতেই চঞ্চল আর্ত গলায় ঐ পাশ থেকে বলল,,
“অনিক মা’র্ডার”র হয়েছে রাফায়াত!”
#চলবে….?
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“অনিক মা’র্ডার”র হয়েছে রাফায়াত!”
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল রাফায়াতের। মুহূর্তেই সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। শান্ত মুখশ্রীটি যেন ক্ষণিকের মধ্যেই বিবর্ণ রূপ ধারণ করল। চোখ দুটিতে অসম্ভব আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। গলায় যেন শব্দরা তার জড়িয়ে আসছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন এক্ষণি শরীর থেকে তার প্রাণবায়ুটা বের হয়ে যাবে! হঠাৎ করেই অনিকের এই ম’র্মা’ন্তিক মৃ’ত্যু’র খবর পাবে তা কস্মিনকালে ও আশা করেনি রাফায়াত! তাই তার বর্তমান অবস্থা খুবই সূচনীয়। রাফায়াতের এহেন বিভৎস রূপ দেখে অয়ন্তীর বাবা রফিকুল ইসলাম বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন। রাফায়াতকে কিছু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে গলা ঝাঁকালেন। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,
“কী হয়েছে রাফায়াত? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
সম্বিত ফিরে পেল যেন রাফায়াত। রফিকুল ইসলামের দিকে একবার অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে সে পিছু ঘুরে আচমকা দৌঁড়াতে লাগল। রাফায়াতের এই উদ্ভট আচরণে ব্যাপক আশ্চর্যিত হলেন রফিকুল ইসলাম। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও তিনি রাফায়াতকে এই মুহূর্তে পিছু ডাকতে চাইলেন না। হয়ত বিশেষ কোনো কাজ পড়ে গেছে এই ভেবে বিষয়টা তিনি আমলে নিলেন না! দৌঁড়োতে দৌঁড়োতে রাফায়াত ফোনের ঐ প্রান্তে থাকা চঞ্চলকে উদ্দেশ্য করে আর্ত গলায় বলল,,
“লা’শ কোথায় এখন?”
“বাকলিয়ার কাছে। ফাঁকা একটি ফ্লাটে।”
“আমি আসছি। তুই কোথায় এখন?”
“আমি স্পটেই আছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়।”
কীসের উপর দিয়ে যে রাফায়াত ফ্লাট থেকে দৌঁড়ে বের হলো তার কোনো নাজার আন্দাজ করতে পারলনা! বাইকটা কোনো রকমে ছেড়ে সে বাকলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পাল্লা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হতে লাগল তার। চোখের কোণে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল! ঝাপসা হয়ে আসছে তার আশাপাশ। বাইকটা সুস্থভাবে চালিয়ে সে বাকলিয়া অবধি পৌঁছাতে পারবে কী-না সেই সম্ভাবনাও নেই। অনিক তার সাথে অনেক বড়ো বড়ো অন্যায় করা সত্ত্বেও মৃ’ত্যু’র মত এত কঠিন শাস্তি তার পাওনা ছিলনা! পাঁচ থেকে ছয় বছরের ফ্রেন্ডশিপ তাদের। অনিকের সাথে থেকে সে যেমন অনেক খারাপ মুহূর্ত কাটিয়েছে? তেমনি অনেক ভালো মুহূর্তও কাটিয়েছে। সে ভালো মুহূর্তগুলোই তাকে বেশী যন্ত্রণা দিচ্ছে! শাস্তি দিচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার! বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা অনেক। যা তাকে ধুঁকে ধুঁকে মা’র’ছে। বন্ধু খারাপ হোক বা ভালো, “বন্ধু বন্ধুই হয়!”
মা”র্ডা”র স্পটে পৌঁছাতেই রাফায়াত অতিরিক্ত লোকজনদের সমাগম দেখতে পেল। সবাই বেশ আতঙ্ক নিয়ে খু;ন সম্পর্কিত ব্যাপারে হরদম বলাবলি করছে। যে রুমটিতে অনিককে খু;ন করা হয়েছে সে রুমটি আপাতত সিল করে রাখা হয়েছে। রুমের মধ্যে শুধু কয়েকজন পুলিশ, সি. আই.ডি অফিসার এবং ফরেনসিক অফিসাররা রয়েছেন। সোফার উপর পড়ে থাকা অনিকের ম’রা লা’শ”টি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে! গলা থেকে এখনও টাটকা র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার! গাঁয়ের লোম হুড়হুড়িয়ে খাঁড়া হয়ে উঠল রাফায়াতের। চোখদুটো এখনও কেমন পাকিয়ে আছে অনিক। দেখে মনে হচ্ছে যেন রাফায়াতের দিকে সে বড়ো বড়ো চোখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! এই প্রথম কোনো ম’রা লা’শ দেখে রাফায়াত ভয়ে এতটা আঁতকে উঠল! এই সময়ে আবার তার কাঁধে হাত পড়ল চঞ্চলের। ভয়ে হঠাৎ গোঙ্গিয়ে উঠল রাফায়াত! ভ’য়া’নক দৃষ্টিতে পাশ ফিরে চঞ্চলের দিকে তাকালো। অবাক হলো চঞ্চল। ভ্রু কুঁচকালো রাফায়াতকে দেখে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী রে? কী হয়েছে তোর? ভয় পেয়ে গেছিস মনে হচ্ছে?”
শুকনো ঢোঁক গিলল রাফায়াত। চঞ্চলের দিকে ঘাবড়ানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভীরু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“খু;ন হলো কীভাবে?”
“গলায় ছু’রি’কা’ঘা’ত করা হয়েছে। অতিরিক্ত র’ক্ত’ক্ষরণের ফলে মৃ’ত্যু হয়েছে।”
“কে খু’ন করেছে এখনো জানা যায়নি?”
“না। মাত্র তো লা’শ উদ্ধার করা হলো। আইনের লোকজন এলো। এত সহজে কী জানা যাবে কে খু’ন করেছে?”
“ভেতরে যাওয়া যাবে?”
“প্রশাসনের লোক ছাড়া কেউ এলাউড না।”
“বাট আমাদের একবার ভেতরে যাওয়া উচিৎ।”
“বাট হুয়াই? ভেতরে আমাদের কাজ কী?”
“ওকে। এখন চল তাহলে। আমরা আবার পরে আসছি।”
উদ্ভট কিছু ভাবনাচিন্তা যেন রাফায়াতের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। চঞ্চলকে নিয়ে সে ঘটনাচক্র থেকে বের হয়ে গেল। রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা বাইকটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সে। গভীর চিন্তায় মশগুল হয়ে উঠল। কিছু একটার সমীকরণ মিলিয়ে সে উত্তেজিত গলায় চঞ্চলকে বলল,,
“আচ্ছা? এই খু;নের সাথে আবার প্রিয়া জড়িত নয় তো?”
“হোয়াট? এসব তুই কী বলছিস বলছিস? প্রিয়া কেন এই খু;নের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে?”
“আই ডোন্ট নো। বাট আমার মনে হচ্ছে।”
“প্রিয়াকে সরাসরি জিজ্ঞাসা কর তাহলেই তো হয়ে গেল।”
“প্রিয়াকে খুঁজে পেলে তো জিজ্ঞাসা করব!”
“মানে? প্রিয়া বাড়িতে নেই?”
“না। তোকে বলতে ভুলে গেছি। আসলে সকাল থেকেই প্রিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যাওয়ার সময় শুধু একটি চিরকুট রেখে গেছে। চিরকুটটিতে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে ব্যস এতটুকুই।”
“সাংঘাতিক ব্যাপার তো। তবে প্রিয়ার পক্ষে কী আদো সম্ভব কাউকে খু;ন করা?”
“আঘাত পাওয়া মানুষদের পক্ষে সব সম্ভব চঞ্চল। ঘাঁ যতক্ষণ না শুকায় ততক্ষণ মানুষ তার ক্রোধ ভুলতে পারেনা। মাথায় কিছু কাজ করছেনা আমার। বের হবি একটু আমার সাথে? প্রিয়াকে খুঁজতে?”
“এতবড়ো শহরে কোথায় খুঁজবি তুই প্রিয়াকে?”
ইতোমধ্যেই হঠাৎ ফ্লাটের সামনে রাফায়াতের বিরোধি দলীয় নেতাদের কয়েকটি গাড়ি এসে থামলো! অনিক যার দলের হয়ে কাজ করত সেই দলের নেতা স্বয়ং ঘটনাচক্রে এসে হাজির! তাদের দেখতে পাওয়া মাত্রই রাফায়াত এবং চঞ্চল আস্তে করে তাদের জায়গা থেকে সরে এসে তাদের থেকে অনেকটাই দূরে এসে দাঁড়ালো। রাফায়াতের দিকে একবার সেই দলের নেতা এবং চ্যা’লা’ফ্যা’লারা আক্রোশিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! দেখে মনে হচ্ছিল যেন এখনই তারা রাফায়াতের গলার টুটি চেপে ধরবে! কঠোর বিদ্রোহী ভাব তাদের চোখে-মুখে। সময় এবং পরিস্থিতি কেবল তাদের হার মানিয়ে রেখেছে। অপর দিকে তাদের এসব বিস্ফোরক ভাবমূর্তি তুচ্ছজ্ঞান করল রাফায়াত! ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে সে তাদের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো। শার্টের কলারটা বেশ ভাবসাব নিয়ে ঝাড়ল। মোট কথা তাদের এড়িয়ে যাওয়ার শতভাগ চেষ্টা করল!
রোষানলের এক পর্যায়ে এসে বিরোধী দলীয়রা রাফায়াত এবং চঞ্চলকে ডিঙিয়ে ফ্লাটের ভেতর ঢুকে পড়ল৷ এর পিছু পিছু আবার রাফায়াতের দলের নেতাও তার চ্যালাফ্যালা নিয়ে হাজির হয়ে গেল! একে একে সব নেতার আগমন ঘটল ঘটনাচক্রে। রাফায়াত এবং চঞ্চল যেন এবার বুকে সাহস খুঁজে পেল। নেতার পাশাপাশি হেঁটে তারাও আবার ফ্লাটের ভেতরে রওনা হলো। রাফায়াতের কাঁধে নেতা তার হাত রাখলেন। তৎপর গলায় হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বললেন,,
“খু;নটা কী তুই করেছিস রাফায়াত?”
ভড়কে উঠল রাফায়াত। নিষ্ক্রিয় দৃষ্টিতে সে চোখ ঘুরিয়ে তার নেতার দিকে তাকালো! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এসব কী বলছে নেতা? তার এতটা বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে নেতা কীভাবে পারল তাকে এতটা অবিশ্বাস করতে? অহেতুক তার দিকে আঙুল তুলতে? রাফায়াতের এহেন বিশৃঙ্খল চাহনি দেখে নেতা হঠাৎ বাঁকা হাসলেন! ঝেড়ে কেশে তিনি রাফায়াতের কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,,
“আ’ম জাস্ট জোকিং রাফায়াত। প্লিজ ডোন্ট টেইক ইট সিরিয়াসলি।”
এরমধ্যে হঠাৎ মিডিয়ার লোকেরা এসে চর্তুপাশ থেকে তাদের ঘিরে ধরলেন। অনিকের হত্যাকাণ্ডের লাইভ টেলিকাস্ট হতে লাগল। দুই দলের নেতা দুই পাশে দাঁড়িয়ে। তারা একে অপরের গাঁয়ে কাঁদা ছিটাছিটি করতে ব্যস্ত। রাফায়াত তার গাঁ বাঁচিয়ে কিছুটা দূরে সরে এলো! তার সামনে হতে থাকা হুড়োহুড়ি সামলে সে অনিকের ড্যা’ডব’ডির কাছে পৌঁছে গেল! মৃ’ত অনিকের মুখটার দিকে কিছুক্ষণ সে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো। না চাইতেও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল সে। এরমধ্যেই হঠাৎ তার সর্তক দৃষ্টি পড়ল কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুলিশ অফিসারের দিকে। হাতে একটি লাভ আকৃতির লকেট নিয়ে তারা কী যেন বলাবলি করছে। লকেটটির ভেতরে ইংরেজী একটি বর্ণ খোঁদাই করা রয়েছে। দূর থেকে রাফায়াত যতটুকু আন্দাজ করতে পারছে সেই খোঁদাই করা ইংরেজী বর্ণটি ছিল কেপিটাল লেটার ‘P’!
আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় অপচয় করতে চাইল না রাফায়াত! ভেতরে তুমুল আতঙ্ক চেপে বসল তার। প্রিয়া নামক আতঙ্ক! খুবই দূ’র্ধ’র্ষ এক আতঙ্ক! বাইরে হতে থাকা সমস্ত দাঙাদাঙি ঠেলে রাফায়াত চঞ্চলকে নিয়ে দৌঁড়ে ফ্লাট থেকে বের হয়ে এলো। ফ্লাটের নিচে আসতেই চঞ্চল বিস্মিত গলায় রাফায়াতকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রস্তুতি নিলো। অমনি রাফায়াত উত্তেজিত গলায় চঞ্চলকে বলল,,
“এট অ্যানি কস্ট আমাদের প্রিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“মানে? এখানের ঝামেলা ফেলে রেখে তুই প্রিয়াকে খুঁজতে যাবি এখন?”
“হ্যাঁ। কথা না বাড়িয়ে চল।”
“তুই পাগল হয়ে গেছিস রাফায়াত? এই মুহূর্তে আমাদের এখানে থাকাটা জরুরি।”
“এই মুহূর্তে আমাদের প্রিয়াকে খুঁজে বের করাটা জরুরী গবেট। মা-বাবাকে আটকানো উচিৎ। প্রিয়া মিসিং এই খবরটা যেন কোনভাবেই পুলিশের কানে না যায়।”
রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে রাফায়াত যেইনা চঞ্চলের হাতটা ছেড়ে চঞ্চলের মুখোমুখি দাঁড়ালো অমনি মনে হলো পেছন থেকে কেউ তার শার্টের কলার চেপে ধরল! শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে আগন্তুকটি তাকে পেছন দিকে ঘুরিয়ে নিলো। আগন্তুকটির মুখ দেখার পূর্বেই চঞ্চল পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল। ঝাঁজালো গলায় বলল,,
“ইয়াদ? কু”ত্তা* বাচ্চা।”
ইয়াদের মুখটিও এতক্ষণে রাফায়াতের হকচকানো দু’চোখে স্পষ্ট হলো। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই ইয়াদ আক্রোশিত ভাব নিয়ে রাফায়াতের নাক বরাবর জোরে এক ঘু’ষি বসিয়ে দিলো! ঘু’ষি খেয়ে রাফায়াত কয়েক ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। নাক থেকে তার টপটপ করে র’ক্ত গড়াতে শুরু হলো। রাফায়াতের এই র’ক্তা’ক্ত অবস্থা দেখে চঞ্চল এবার ক্ষেপে গেল। অতিরিক্ত রাগে নিবিষ্ট হয়ে সে ইয়াদকে আক্রমন করার পূর্বেই রাফায়াত বিক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াদের দিকে তেড়ে এলো। বিধ্বংসী রূপ ধারণ করল সো। রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইয়াদের বুকে, পিঠে, নাকেমুখে এলোপাতাড়ি কি’ল/ ঘু’ষি মারতে লাগল। রুষ্ট হয়ে থাকা চঞ্চলকে দু’হাত দ্বারা সরিয়ে দিয়ে সে চঞ্চলকে বলল,,
“তুই সামনে থেকে সরে যা চঞ্চল৷ আমার এসব মা’রধর খেয়ে অভ্যাস আছে। তোর এসবে অভ্যাস নেই। যা তুই।”
বিপরীতে এত মা’রধর খাওয়ার পরেও ইয়াদ বড়ো গলায় আর্তনাদ করে রাফায়াতকে বলল,,
“অনিককে তুই-ই খু;ন করেছিস বা”স্টা’র্ড! একবার তো আমাকেও খু;ন করার জন্য চেষ্টা করেছিলি। আর এখন খু;ন করলি অনিককে।”
“জাস্ট শাট আপ ইয়াদ। অনিককে আমি খু;ন করিনি।”
বলেই রাফায়াত তার হাতের কাছে পাওয়া একটি পাথর দিয়ে ইয়াদের মাথায় আঘাত করার পূর্বেই অপ্রত্যাশিতভাবে পেছন থেকে অয়ন্তী এসে রাফায়াতের হাতে থাকা পাথরটি টেনে ধরল! প্রচণ্ড আতঙ্ক সমেত সে আর্ত গলায় রাফায়াতকে বলল,,
“ছেড়ে দিন প্লিজ। ইয়াদ ভাইকে মা”রবেন না।”
হতভম্ব হয়ে রাফায়াত পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই প্রিয়া দাঁতে দাঁত চাপল। ঠাস করে রাফায়াতের গালে জোরে এক চ’ড় বসিয়ে দিলো। চোখের পলক পড়ার পূর্বেই অয়ন্তী রাফায়াতকে ঠেলেঠুলে ইয়াদের বুকের থেকে উপর উঠালো। অকাতরে চোখের জল ছেড়ে দিলো সে। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় আ’হ’ত ইয়াদকে লক্ষ্য করে বলল,,
“আপনি জানেন ইয়াদ ভাইয়া? রাদিফ ভাইয়া কোথায়?”
র’ক্ত বমি করে দিলো ইয়াদ। তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াত এবং চঞ্চলের দিকে অস্ফুটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। রাফায়াতের চোখ রাঙানোকে অগ্রাহ্য করে ইয়াদ অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাতা অয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে হেয় গলায় বলল,,
“নাটক করছ তুমি আমার সাথে না?”
“কীসের নাটক ইয়াদ ভাই? প্লিজ বলুন রাদিফ ভাই কোথায়?”
“তোমার পেছনে কে ওটা?”
পিছনে ঘুরে তাকালো অয়ন্তী। রাফায়াতের ভীতসন্ত্রস্ত মুখের দিকে একবার ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! অয়ন্তীর এই ঘৃণাভরা চাহনি যেন রাফায়াতক ভেতরে ভেতরে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। আচমকাই চোয়াল উঁচিয়ে তুলল অয়ন্তী। টপটপ করে চোখের পানি ছেড়ে রাফায়াতকে ধি”ক্কার জানিয়ে বলল,,
“রাফায়াত। এক নাম্বারের স’ন্ত্রা’স এই লোক!”
পৈশাচিক হাসি হাসল ইয়াদ! র’ক্তমাখা মুখেও তার তীব্র হাসির ঝলকানি। হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে তার কাশি ওঠে গেল! অসুস্থ গলাতেই বলল,,
“হা হা হা। এই স’ন্ত্রা’স ছেলেটিই হলো রাদিফ!”
#চলবে….?