#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৮,২৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
২৮
“হা হা হা এই স’ন্ত্রা’স ছেলেটিই হলো রাদিফ!”
তাৎক্ষণিক অয়ন্তীর বিস্ফোরক দৃষ্টি পড়ল তার থেকে কিঞ্চিৎ দূরে অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতের দিকে! দু’চোখের কোটর জুড়ে যেন রাফায়াতের দ্বিধার জল! এই মুহূর্তে অয়ন্তীকে কিছু বুঝাতে না পারার যন্ত্রণা তার ভেতরটাকে ক্রমশ গ্রাস করে তুলছে। ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা টুকুনিও গতানুগতিক ভাবে লোপ পাচ্ছে। অয়ন্তী যেন তার কান দুটিকে বিশ্বাস করতে পারছেনা! শোঁ শোঁ বেগে এক বিদঘুটে আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার দুই কর্ণকুহর জুড়ে। মনে হাজারো প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে৷ তার। সন্দেহরা দানা বাঁধছে। দোটানা কাজ করছে তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান জুড়ে। এই স’ন্ত্রা’স ছেলেটি কী করে রাদিফ হতে পারে? তার সাথে তো রাদিফের না আছে চেহারার কোনো মিল, না আছে স্বভাবচরিত্রের মিল!
নিষ্পলক দৃষ্টিতে অয়ন্তী কিয়ৎক্ষণ রাফায়াতের ছন্নছাড়া মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা ভেবে হঠাৎ পিছু ঘুরে তাকালো। লুটোপুটি খেয়ে হাসতে থাকা ইয়াদের দিকে সে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অবিশ্বাস্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই লোকটি কী করে রাদিফ ভাই হতে পারে? এর সাথে তো রাদিফ ভাইয়ার চেহারার কোনো মিল নেই।”
পুনরায় কাশি ওঠে গেল ইয়াদের! কাশতে কাশতে নাকমুখ বেয়ে র’ক্ত গড়াতে লাগল তার। দীর্ণ বিদীর্ণ গলায় সে হেলেদুলে বলল,,
“আরে ভাই তুমি দেখি কিছুই জানো না। আমার দলের নেতা মিন্টু ভাই আছে না? উনি তো সেই দুই বছর আগেই তোমার জানে জিগার রাদিফ ভাইকে মে’রে কে’টে মুখটা একদম থে’তলে দিয়েছিল! যার ফলস্বরূপ তার সাধের মুখটাকে প্লা’স্টিক সা’র্জারী করতে হয়েছিল! আমরা তো ভেবেছিলাম এই জা’নো’য়ারটা বাঁচবেই না! কিন্তু এর জান দেখো? কৈ মাছের প্রাণ নিয়ে ঠিক বেঁচে ফিরেছে!”
ভেতরটা ধক করে কেঁপে উঠল অয়ন্তীর। ধীরে ধীরে যেন তার সকল চেতনাশক্তি লোপ পেতে লাগল! গাঁয়ের প্রতিটা লোমকূপ তার হুড়মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আশপাশ সব ঝাপসা হয়ে এলো। মাথাটা কেমন যেন ঘুরেও এলো। দুনিয়ার সমস্ত বিষাদ যেন একান্তেই তার বুকের ভেতর এসে ভর করল। অতি শীঘ্রই দৃষ্টি জোড়া ঘোলাটে হয়ে এলো তার। গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কাছে থেকেও এতদিন ভালোবাসার মানুষটিকে চিনতে পারার যন্ত্রণা তাকে ধুকেধুকে শেষ করে দিচ্ছিল! এ কেমন ভালোবাসা তার? যে ভালোবাসায়, ভালোবাসার মানুষটিকে চিনতে পারার তেমন কোনো গাঢ় গভীর অনুভূতিই ছিলনা! পাশাপাশি থেকেও মনের মানুষটির মনের খবর রাখার কোনো ইচ্ছাশক্তি ছিলনা! শ্বাস-প্রশ্বাস পাল্লা দিয়ে ভারী হয়ে উঠতেই অয়ন্তী রাফায়াতের উদ্দেশ্যে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। তবে রাফায়াতকে তার দৃষ্টির সীমানায় দেখতে পেলনা! হুট করে যেন পেছন থেকে ইয়াদের আত্নচিৎকার তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো। ঘোর আতঙ্ক সমেত পেছন ঘুরে তাকাতেই অয়ন্তী দেখতে পেল ভয়ঙ্কর হিংস্র রূপ ধারণ করে রাফায়াত ইয়াদের মেইন পয়েন্টে জোর এক লাথ বসিয়ে দিয়েছে! দাঁত গিজগিজিয়ে বলছে,,
“তোদের প্রত্যেককে আমি দেখে নিব ইয়াদ৷ আমার লাইফটাকে তোরা প্রত্যেকে মিলে ধ্বংস করে দিয়েছিস। যতদিন অবধি না আমি তোদের ধ্বংস করতে পারব ততদিন অবধি আমার শান্তি নেই।”
সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে অয়ন্তী কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই রাফায়াত দৌঁড়ে এসে খপ করে অয়ন্তীর ডান হাতটি চেপে ধরল! অয়ন্তীকে নিয়ে সে প্রাণপনে দৌঁড়াতে লাগল। কিছু বলার বা করার পরিস্থিতিতে রইল না অয়ন্তী। রাফায়াত তাকে যেভাবে চালনা করছিল অয়ন্তী ঠিক সেভাবেই চলতে লাগল। ঝট করে বাইকের পেছনে অয়ন্তীকে বসিয়ে দিলো রাফায়াত। অয়ন্তীও নিজেকে সামলে বাইকে বসে পড়ল! কেবল নিথর দৃষ্টিতে রাফায়াতকে দেখতে লাগল। ভালো/ মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করার জায়গাটিতেও রইল না। তখনি হঠাৎ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা চঞ্চলকে রাফায়াত ইশারায় বলল,,
“ফলো আচ।”
চঞ্চল আর এক মুহূর্ত সময় ব্যয় করলনা। রাফায়াতের ইশারা বুঝে পেছনের সি.এন.জি টিতে ওঠে পড়ল। দ্রুত বেগে বাইক ছেড়ে দিলো রাফায়াত। তাল সামলাতে না পেরে অয়ন্তী ঝাঁকি দিয়ে রাফায়াতের গাঁয়ে এসে ছিটকে পড়ল। বাধ্য হয়ে রাফায়াতকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল! হাওয়ার তালে তালে অয়ন্তীর চুল এবং গাঁয়ে থাকা ওড়নাটি উড়তে লাগল। অস্বস্তিবোধ হতে লাগল তার। সম্বিত ফিরে পেতেই সে মৃদু আওয়াজে রাফায়াতকে বলল,,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি রাদিফ?”
অয়ন্তী কৌতূহল জনিত প্রশ্নকে আমল দিতে চাইল না রাফায়াত। প্রসঙ্গ পাল্টে উল্টো খরতর গলায় বলল,,
“চুপ করে বসে থাকো। একটা সাউন্ডও করবেনা।”
“অনেক হয়েছে রাদিফ। আমি আর চুপ করে থাকতে পারব না। প্লিজ সত্যিটা এবার আমার কাছে ক্লিয়ারলি বলুন।”
অয়ন্তী এহেন হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে রাফায়াত মুখ খুলে সত্যিটা বলতে বাধ্য হলো। রূঢ় গলায় বলল,,
“আমরা এখন প্রিয়াকে খুঁজতে যাচ্ছি ওকে?”
“মানে?”
“মানেটা পরে বলছি।”
“প্রিয়া কোথায়? প্লিজ বলুন?”
“প্রিয়াকে খুঁজে পাচ্ছিনা।”
“কেন খুঁজে পাচ্ছেন না? কী হয়েছে প্রিয়ার?”
“তুমি একটু চুপ করে বসে থাকবে প্লিজ?”
“না। আমি আর চুপ করতে পারব না রাদিফ। অতীতের সব সত্যি আমি জানতে চাই। বাইকটা প্লিজ এখানেই থামান রাদিফ। না হয় আমি বাধ্য হব বাইক থেকে ঝাঁপ দিতে!”
চিন্তায় পড়ে গেল রাফায়াত। অয়ন্তীর জেদ সম্পর্কে সে আগে থেকেই অবগত! এমনিতেই তার উপর ক্ষেপে আছে অয়ন্তী। এখন আবার অয়ন্তীর কথামত কাজ না হলে বড়ো সড়ো একটি অঘটন ঘটে যেতে পারে। অয়ন্তীকে আর কোনো আঘাত করতে চাইছেনা রাফায়াত। তাকে আর অন্ধকারেও রাখতে চাইছেনা। সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাতে চাইছে। সত্যিটা জানার পর যদি অয়ন্তী চায় তাকে ছেড়ে দিতে তো ছেড়ে দিবে! জোর করে আটকে রাখতে চাইবেনা অয়ন্তীকে। এমনিতেও রাফায়াত চায়না তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে অয়ন্তী কোনোভাবে জড়িয়ে পড়ুক।
বাধ্য হয়ে রাফায়াত তার বাইকটি একটি নিরিবিলি জায়গায় দাঁড় করালো। চঞ্চলও তখন রাফায়াতকে অনুসরণ করে সি.এন.জি থেকে নেমে পড়ল। পায়ে হেঁটে তাদের দুজনের পিছু পিছু বড়ো একটি খোলা মাঠের কাছে হেঁটে এলো। হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় রাফায়াত এবং চঞ্চলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অয়ন্তী। মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সহযোদ্ধার দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। রাগী রূপ ধারণ করে অয়ন্তী হুট করে এসেই রাফায়াতের শার্টের কলার চেপে ধরল! ঝাঁজালো গলায় তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কেন আপনি এই স’ন্ত্রা’সী জীবনের সাথে জড়ালেন রাদিফ? দু’বছর আগে কী ঘটেছিল? কীসের জন্য আজ আপনার এই অবস্থা?”
এরমধ্যেই চঞ্চল হঠাৎ গলা ঝাঁকালো। শুকনো ঢোঁক গিলে সে অস্থির চাহনিতে দো’মনা অয়ন্তীর দিকে তাকালো। আতঙ্কিত গলায় বলল,,
“এসব কথা পড়ে হবে অয়ন্তী। এখন তোমরা আমার ফ্লাটে চলো। প্রিয়ার মুখোমুখি বসে ফেস টু ফেস কথা হবে!”
অয়ন্তীর আগেই রাফায়াত হকচকানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল চঞ্চলের দিকে। এক ঝটকায় তার শার্টের কলার থেকে অয়ন্তীর হাতটি ছাড়িয়ে নিলো। সন্দিহান গলায় চঞ্চলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ার পূর্বেই চঞ্চল কম্পিত গলায় রাফায়াতকে বলল,,
“আজ ভোরে যখন আমি তোকে রেখে আমার ফ্লাটে যাই না? তখন হঠাৎ আমার ফ্লাটের দরজায় দেখি প্রিয়াকে! কোনো প্রশ্ন করার আগেই প্রিয়া আমার হাতে-পায়ে ধরে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করে বলে আজকের দিনটার জন্য যেন তাকে আমার ফ্লাটে থাকতে দিই। কাল সকাল হলেই সে তার ফুফুর বাড়ি চলে যাবে! তার এই কান্নাকাটি দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছিল রাফায়াত। তাই তার রিকুয়েস্টটা আমি ফেলতে পারিনি।”
মাথায় হাতে চলে গেল রাফায়াতের। বিরক্তি ভরা চাহনিতে সে চঞ্চলের দিকে তাকালো। কপালের ভাঁজে তিক্ততার ভাব ফুটিয়ে তুলল। মেজাজ বিগড়ে সে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“আগে বললি না কেন এই কথাগুলো আমাকে হ্যাঁ? প্রিয়াকে এক্ষণি আমাদের একটা সেইফ জায়গায় রেখে আসতে হবে চঞ্চল। কাক পক্ষিটিও যেন প্রিয়ার খোঁজ জানতে না পারে!”
“মানে? কেন?”
“অনিকের ড্যা’ডব’ডির কাছে অয়ন্তীর গলার লকেট পাওয়া গেছে চঞ্চল! আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে গতবছর প্রিয়ার জন্মদিনে মা এই লকেকটটিই প্রিয়াকে গিফট করেছিল। গতকাল রাতেও আমি প্রিয়ার গলায় লকেটটি দেখেছিলাম।একটু আগে সেই লকেটটিই আমি পুলিশের হাতে দেখেছি!”
“তোর কোথাও ভুল হচ্ছে রাফায়াত। প্রিয়াকে দেখতে আমার মোটেও অপরাধী মনে হয়নি! বরং তাকে শান্তশিষ্ট নিবিড় দেখাচ্ছিল।”
“আচ্ছা এসব কথা না হয় আমরা প্রিয়ার সামনাসামনি বসে ডিসকাস করি? এখন প্লিজ এখান থেকে চল।”
নির্বোধ অয়ন্তীর দিকে সুশৃঙ্খল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাফায়াত। অয়ন্তীর হাতটা খপ করে ধরে বলল,,
“চলো অয়ন্তী।”
মুহূর্তেই রাফায়াতের হাতটি ঝেড়ে ফেলে দিলো অয়ন্তী! মেজাজ গরম করে রগচটা গলায় বলল,,
“না আমি যাবনা! প্রিয়ার মুখোমুখি আমি হতে চাইনা রাদিফ। তাছাড়া ডুবাই থেকে আমার জেঠা আসছে। অনিক ভাইয়ার মা’র্ডা’রের খবর শুনে। আমার এখন অনিক ভাইয়ার লা’শের কাছে যেতে হবে। বাবা-মায়ের পাশে থাকতে হবে।”
অয়ন্তীকে এই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়াটা নিরাপদ মনে করলনা রাফায়াত। প্রিয়া যে এই খু;নের সাথে সম্পৃক্ত রাফায়াতের কথাবার্তায় এতক্ষণে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরে গেছে অয়ন্তী! সন্দেহ থেকে অয়ন্তী প্রিয়ার বিষয়টা প্রসাশনকে বলে দিতে পারে। তাই এই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে রাফায়াত প্রিয়াকে এসবের মধ্যে জড়াতে চাইছেনা। অয়ন্তীকেও এই মুহূর্তে ছাড়তে চাইছেনা। কথার জালে অয়ন্তীকে ফাঁসাতে চাইল রাফায়াত। কোমল স্বরে বলল,,
“তুমি জানতে চাওনা অয়ন্তী? অতীতে কী ঘটেছিল?”
রাফায়াতের নিবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বরফের মত গলে গেল অয়ন্তী! আবেগঘন গলায় বলল,,
“চাই রাদিফ।”
“তাহলে চলো।”
_________________________________
চঞ্চলের ফ্লাট থেকে প্রিয়াকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামের বাইরে একটি নিরাপদ জায়গায় আনা হলো প্রিয়াকে। রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল তখন! প্রিয়ার মুখোমুখি তিনটি টুল পেতে বসে আছে রাফায়াত, চঞ্চল এবং অয়ন্তী। কাঁদতে কাঁদতে নাক টানল প্রিয়া। চোখ-মুখ ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার। হেঁচকি তুলে কেঁদে সে তাদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“বিশ্বাস করো তোমরা। অনিককে আমি খু;ন করিনি। কালরাত থেকে তো অনিকের সাথে আমার কোনো যোগাযোগই নেই। সো তাকে আমি খু;ন করব কীভাবে?”
ভ্রু কুঁচকালো রাফায়াত। সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রিয়ার দিকে। প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,
“তাহলে তোর গলার ঐ গোল্ডের লকেটটা মা’র্ডা’র স্পটে গেল কীভাবে?”
“ভোরে যখন আমি লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠি না? ঠিক তখন মনে হলো পেছন থেকে কেউ এসে আমার মুখে স্প্রে পুশ করে! হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি। এরপর আমার সাথে কী ঘটেছে না ঘটেছে কিছুই আমার মাথায় নেই রাফায়াত। চেতনা ফিরে পেতেই আমি নিজেকে চঞ্চল ভাইয়ার ফ্লাটের সামনে আবিষ্কার করি। এরপর নিরুপায় হয়ে চঞ্চল ভাইয়ার হেল্প নিই!”
ক্ষেপে উঠল অয়ন্তী। প্রিয়ার সব কথা তার মাথার উপর দিয়ে গেল। তুখোড় রাগের বশবর্তী হয়ে অয়ন্তী বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। রাগ ঝেড়ে চিৎকার করে বলল,,
“কী হচ্ছে কী এসব? তোমাদের কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। প্লিজ আমাকে সব ক্লিয়ারলি বলো। এত প্যাঁচ ঘোঁচ আমার মাথায় ঢুকছেনা। প্রিয়া কেন অনিক ভাইয়াকে খু;ন করতে চাইবে?”
বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো রাফায়াত। ধীর পায়ে হেঁটে সে উত্তেজিত অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। কিয়ৎক্ষণ অয়ন্তীর অস্থির দু’চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দু’বছর আগে হারিয়ে গেল সে। অয়ন্তীর চোখের মায়ায় টুক করে ডুব দিলো অতীতে। আচমকা সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল। হুট করেই অয়ন্তীকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো! স্নিগ্ধ গলায় বলল,,
“মনে আছে তোমার অয়ন্তী? সেই দু’বছর আগে যখন তোমাকে আমি অনিকের সাথে প্রথম দেখি? চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলে তুমি। সেই প্রথম দেখাতেই তোমার জন্য মনে মনে কিছু অসম্ভব সুন্দর অনুভূতি ফিল করি আমি….
#চলবে…?
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_২৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
“মনে আছে তোমার অয়ন্তী? সেই দু’বছর আগে যখন তোমাকে আমি অনিকের সাথে প্রথম দেখি? চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলে তুমি। সেই প্রথম দেখাতেই তোমার জন্য মনে মনে কিছু অসম্ভব সুন্দর অনুভূতি ফিল করি আমি।
কাজল কালো হরিণীর ন্যায় মায়াবী দুটি চোখ। কপালের মাঝখানে ছোটো দেখতে একটি কালো টিপ। দূর থেকে যদিও বুঝতে পারিনি কপালে কালো টিপ পড়েছিলে তুমি। তবে কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম। মূলত সেদিন তোমার চোখের প্রেমেই আমি ডুবেছিলাম অয়ন্তী! দূর থেকেও যেন সেই সুনিপুণ, সুনয়না চক্ষু জোড়া আমাকে টানছিল। এক প্রকার মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় টানছিল। আমিও সেই অবাধ্য টানে দিশেহারা হয়ে বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে ছুটে যাই তোমার কাছে! ভেবেছিলাম তুমি একা। আশেপাশে কেউ ছিলনা তখন। ভার্সিটিতে প্রথম এসেছ হয়ত। তাই চোখে-মুখে এতটা নিগূঢ় ভয়ের ছাপ। শুষ্ক ঠোঁট দুটিতে ছিল বিবর্ণ হাসির রেখা! তোমার সেই ভীতসন্ত্রস্ত মুখটি যেন সেই মুহূর্তে আমাকে বড্ড ভাবাচ্ছিল। ভাবলাম তোমাকে হেল্প করাটা ভীষণ প্রয়োজন। বন্ধুরা সবাই অবাক হয়েছিল তখন আমার এই অদ্ভুত আচরণে। কারণ, কখনও কোনো মেয়ে বিপদে পড়ে চ্যাঁচিয়ে আমার কাছে হেল্প চাইলেও যে ছেলে কী-না কখনও তাকে হেল্প করতে চায়নি সেই ছেলেটিই কীভাবে কোনো মেয়ে হেল্প না চাওয়ার আগেই তার কাছে দৌঁড়ে যায় হেল্প করতে? কঠিন এক প্রশ্ন সেদিন চঞ্চলসহ বাকী ফ্রেন্ডসরা আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল! সেদিন কোনো উত্তর দিতে পারিনি আমি তাদের। কেবল চুল টেনে খানিক লাজুক হেসেছিলাম।
এরপর তোমাকে হেল্প করার জন্য যখন আমি হন্ন হয়ে তোমার কাছে ছুটে যাই তখনই পেছন থেকে অনিককে দেখতে পাই! মৃদু হেসে সে তোমার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিঃসংকোচে তোমার কাঁধে হাত রাখে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,,
“কী রে? ভয় পাচ্ছিস?”
অনিককে পাশে পাওয়া মাত্রই তোমার শুষ্ক ঠোঁটের কোণে ঘায়েল করা সেই মোহময়ী হাসি ফুটে ওঠে! হৃৎস্পন্দন তখন আমার থমকে আসে! একটু আগেই যে মেয়েটি কি-না হাসি কী জিনিস তাই ভুলতে বসেছিল প্রায়, মুহূর্তের মধ্যেই মেয়েটির পক্ষে কীভাবে সম্ভব বিপরীত পাশের মানুষটিকে দেউলিয়া করে দেওয়ার মত হাসি দেওয়া? আমি সত্যিই দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলাম তোমার ঠোঁটের সেই মিষ্টি হাসিতে। ডুবে যাচ্ছিলাম তোমার চোখের নেশায়। মনে হচ্ছিল যেন আমার আশেপাশে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি! হেসে হেসেই তখন তুমি অনিককে প্রতি উত্তরে বললে,,
“এখন আর পাচ্ছিনা।”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল অনিক। হাঁফ ছাড়া গলায় বলল,,
“ওকে চল তাহলে। হলটা দেখিয়ে দিচ্ছি তোকে।”
উৎকণ্ঠিত গলায় তুমি অনিককে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছিলে,,
“এক্সাম শেষ হওয়ার পর তুমি আসবে তো অনিক ভাইয়া?”
“আমি তো যাবনা কোথাও। গেইটের বাইরেই তোর জন্য অপেক্ষা করব। যেহেতু এক্সাম চলছে তাই এখন ক্যাম্পাসে থাকা যাবেনা। তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিসনা তো। নিশ্চিন্তে এক্সাম দে।”
তুমি স্বস্তির শ্বাস ফেললে তখন। জড়তা ভুলে হাসোজ্জল গলায় বললে,,
“থ্যাংকস ভাইয়া। আসলে এই প্রথম তোমাদের ভার্সিটিতে আসা তো। তাই অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। তবে এখন আর ভয় নেই। তুমি তো আমার পাশেই আছো।”
তোমাদের সামনে থেকে তখন সরে দাঁড়াই আমি। এতক্ষণে অনিক তোমাকে নিয়ে তোমার এক্সাম হলের দিকে চলে যায়। বুঝতে পেরেছিলাম তোমরা হয়ত রিলেটিভ হবে। যেহেতু তুমি অনিককে ভাই ভাই বলে সম্বোধন করছিলে। আর অনিকও তোমাকে তুই তুকারি করছিল! তবে তোমার কথা অনিকের মুখে কখনো শুনিনি আমি। তাই খুব কিউরিসিটি হচ্ছিল কী হও তুমি অনিকের। যতক্ষণ অবধি না সেই কিউরিসিটি দূর হচ্ছিল আমার ততক্ষণ অবধি আমার শান্তি হচ্ছিলনা। দলবল নিয়ে তখন আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যাই। এক্সাম চলাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসে থাকাটা এলাউড না তাই। গেইটের বাইরে তখন অনিকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি। বার বার গেইটের ভেতরে তাকাচ্ছিলাম। কখন অনিক আসবে। কখন তার মুখ থেকে তোমার সম্পর্কে কিছু জানতে পারব।
আমার এই হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যেই অনিক গেইটের বাইরে আসে। তখন তার থেকে জানতে পারি তোমরা কাজিন হও৷ অনিকের চাচাতো বোন হও তুমি। এডমিশন এক্সাম দিতে এসেছ। সাথে অবশ্য তোমার পরিবারও এসেছে। তোমার মা-বাবা এবং বড়ো বোন। অনিক তখন তার পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম থাকত। তাদের ফ্লাটেই তোমরা এক মাসের জন্য উঠেছ। পরীক্ষার পাশাপাশি মূলত বেড়াতে আসাটাও তোমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
অনিককে সেদিন বলিনি প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভালো লেগে গেছে! সময় উপযোগী মনে করিনি তখন। ভেবেছিলাম আরও কয়েকটা দিন যাক। আমাদের আবার দেখা হোক। প্রথম দেখাতেই প্রেম? তাও আমার মত একটা আনরোমান্টিক ছেলের? ভাবতেই কেমন যেন দ্বিধা হচ্ছিল আমার। নিজের এই বেসামাল অনুভতি গুলোকেই তখন বিশ্বাস হচ্ছিলনা আমার। তাই কিছুটা সময় নিয়েছিলাম। অনিকের সাথে গ্রুপ স্টাডির বাহানা করে রোজ তার ফ্লাটে যাওয়া হত আমার! তোমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টায় কত শত মিথ্যে অযুহাতই না দিয়েছি সবাইকে! তোমার বড়ো বোন অনামিকা খুব মিশুক প্রকৃতির ছিল। খুব দ্রুত আমার সাথে মিশে গিয়েছিল। কথায় কথায় জানতে পারি সে নাকি অনিককে পছন্দ করে! তবে বলতে পারেনা মুখ খুলে। অনিক কী না কী ভাবে তাই। যদিও আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি অনিককে বলার তবে অনামিকার রিকুয়েস্টে বলতে পারিনি কখনও।
রোজ নিয়ম করে আমাদের দেখা হত। তবে আমার চোখে কখনও পড়েনি তুমি চোখ তুলে একবারের জন্যে হলেও আমার দিকে তাকিয়েছ! সবসময় মাথা নিচু করে রাখতে না হয় লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নিতে। কখনো সখনো আবার মিটিমিটি হাসতে! আমি অবাক হয়ে তোমার সেই লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মুখখানি দেখতাম। তোমার ঠোঁটের সেই চঞ্চলা হাসি দেখতাম। মাঝে মাঝে খুব সাহস নিয়ে তোমার নুইয়ে রাখা মুখটি খানিক উঁকি দিয়ে দেখতাম! বারংবার তোমার ঐ কাজল কালো চোখের প্রেমে পড়তাম। চোখের মায়ায় ডুবে যেতাম। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতাম তোমার সাথে একটুখানি কথা বলার। একটু ফ্রি হওয়ার। তোমার আশেপাশে থাকার। তবে তুমি কখনও সেই সুযোগটি দাওনি আমায়। সবসময় কেমন যেন এড়িয়ে চলতে আমায়। তোমার থেকে পাওয়া এই নিদারুন অবহেলা রাতে ঘুমুতে দিতো না আমায়। দিন-রাত যে আমার কীভাবে কাটত বুঝতেও পারতাম না৷ দীর্ঘ একমাসে প্রায় শ’খানিক স্বপ্ন দেখেছি তোমায় নিয়ে! দিনের বেলাতেও কল্পনায় ডুবে থাকতাম তোমায় নিয়ে।
রাজনীতির মাঠ তখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম। মিছিল, মিটিং, সেমিনার কিছুতেই তেমন এটেন্ড থাকতাম না। কলেজের কোনো প্রোগ্রামেও তেমন মন ছিলনা আমার। সারাক্ষণ শুধু তুমি তুমিতেই ছিলাম। তোমাকে একটুখানি দেখার জন্য অনিকের ফ্লাটের সামনে নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলাম! যদি সম্ভব হত রাস্তার উপর সত্যিই একটা বাড়ি বানাতাম! যেন তোমাকে দেখতে কোনো অসুবিধা না হয় আমার।
রাজনীতি থেকে তখন আমার পুরোপুরি মন ওঠে যায়। এও কারণে অবশ্য সিনিয়র ভাইদের রোষের মুখেও বহুবার পড়তে হয়েছিল আমাকে। হাতাহাতি ও হয়ে ছিল কয়েকজনের সাথে। আমার সেই খামখেয়ালির সুযোগ নিয়েই অনিক তখন আমার জায়গা দখল করতে শুরু করে। নেতাদের সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করে। তাদের আগে পিছে ঘুরতে শুরু করে। বিভিন্ন মিছিল, মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। এতে অবশ্য আমার কোনো হিংসা /বিদ্বেষ বা খারাপ লাগা কাজ করত না। বরং খুশি লাগত অনিক তার স্বপ্নের রাজনীতি নিয়ে কিছু একটা করার চিন্তা করছে। এলাকার বড়ো ছোটো ভাই ব্রাদাররা সবাই অনিককে তাদের দিকে টানতে শুরু করে।
এরমধ্যে হঠাৎ একদিন অনিকের বার্থডে তে আমাদের প্রথমবারের মত কথা হয়! সেদিনটা ছিল আমার কাছে চিরস্মরণীয় একটি দিন। হুট করেই চমকে যাওয়ার মত একটি দিন৷ এতদিন ধরে আমার স্বপ্নে দেখা বাস্তবিক একটি দিন। মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি আসার দিন। আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছিলামনা, যে মেয়েটি সবসময় আমাকে দেখলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত, প্রতিবার আমাকে খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যেত, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও তার লজ্জাবোধ কাজ করত আজ হুট করে সে মেয়েটি নিজ থেকে কী করে আমার সাথে কথা বলতে আসল? তাও আবার পিংকিশ লেহেঙ্গাতে তাকে কেমন লাগছে তা জানার জন্য আমার কাছে এসেছিল!
হার্টবিট তখন আমার এতটাই অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিল যে আমি ঠিকঠাকভাবে বলতে পারছিলাম না পিংকিশ লেহেঙ্গাটিতে তাকে ঠিক কতখানি রূপসী দেখাচ্ছিল! ঐদিন অনিকের বার্থডে সেলিব্রেশনের অজুহাতে প্রায় অনেকবার আমাদের কথা হয়। চোখাচোখি হয়। লজ্জায় তুমি তখন মুখ লুকিয়ে নিলেও আমি ততক্ষণ অবধি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম যতক্ষণ অবধি না তুমি পুনরায় আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচছ!
আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না তুমি আদোতেই আমাকে নিয়ে কিছু ফিল করো কী-না। আমায় নিয়ে পজেটিভ কিছু ভাবো কি-না। তাই তোমার মনের কথা জানাটা বড্ড জরুরী হয়ে পড়েছিল আমার। খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমার সাথে একদিন এই বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলব। তোমার মুখ থেকে তোমার মনের কথাটা শুনব। একটা ডেইটও আমি ফিক্সড করে ফেলেছিলাম অবশ্য। কিন্তু এর আগেই অনিক কোনোভাবে বুঝতে পেরে গিয়েছিল আমি তোমাকে মনে মনে ভালোবাসতে শুরু করেছি! তখন অনিক ভার্সিটিতে আমায় ডেকে নিয়ে যায়। আমিও সরল মনে যাই অনিকের সাথে দেখা করতে। অনিক আমাকে সেদিন যা বলল তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না!
রাফায়াতের বুকে কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলল অয়ন্তী। টিমটিমে গলায় বলল,,
“কী বলেছিল?”
“বলেছিল, তুমি অনিককে ভালোবাসো! আর অনিকও তোমাকে অনেক ভালোবাসে! তোমরা দু’জন দুজনকে ছাড়া বাঁচবেনা। তোমাদের মাখখান থেকে আমাকে সরে দাঁড়াতে। সেদিন আমি ভেতর থেকে পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিলাম অয়ন্তী। জীবনে প্রথম কাউকে মন দিয়ে বসেছিলাম আমি। বহু যত্নে সামলে রাখা মনটি এভাবে ভেঙে যাবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি আমি। অনামিকার জন্যও বড্ড মায়া হচ্ছিল তখন। বেচারি আমার মতই একতরফা ভালোবেসেছিল অনিককে!”
“তারপর?”
“তারপর একমাস পর তুমি ঢাকায় ব্যাক করো! একলা হয়ে যাই আমি। তোমার প্রতি গড়ে ওঠা অভ্যেসগুলো আমাকে রোজ যন্ত্রণা দিতে থাকে। মেন্টালি উইক হয়ে পড়ি আমি। নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রাখি। বদ্ধ রুমে নিজেকে বন্দি করে রাখি। খাওয়াদাওয়া সব ভুলে বসি। এভাবে প্রায় দশ বারো দিন কেটে যায়। চঞ্চলের বার্থডে ঘনিয়ে আসে। মনে প্রবল অশান্তি থাকা সত্ত্বেও আমাকে বাধ্য হয়ে চঞ্চলের বার্থডেতে এটেন্ড করতে হয়। সেদিন মা-বাবারা সবাই তাদের কোনো এক আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যায়। প্রিয়া বাড়িতে একলা পড়ে যায়৷ তাই সেদিন আমি বাধ্য হয়েই প্রিয়াকে আমার সাথে চঞ্চলের বার্থডেতে নিয়ে যাই। প্রিয়াকে দেখে আমার সব ফ্রেন্ডরা একপ্রকার ফিদা হয়ে যায়! আমার সামনেই প্রিয়াকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে। কাজিন হিসেবে ব্যাপারটা আমার খুব মাইন্ডে লাগে। ফ্রেন্ডদের সাথে প্রচুর কথা কাটাকাটিও হয় আমার।
তখন সবাই ভাবতে থাকে প্রিয়ার সাথে হয়ত আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে অনিক! সবার সামনে প্রমাণ করার চেষ্টা করল প্রিয়া আমার গার্লফ্রেন্ড। মাথা গরম হয়ে যায় তখন আমার। রাগের মাথায় বলে বসি, হ্যাঁ প্রিয়া আমার গার্লফ্রেন্ড! যদিও সবাই বুঝতে পেরেছিল রাগের মাথায় আমি কথাটা বলেছি। বলা বাহুল্য, আমার আবার একটি খারাপ স্বভাব আছে। রাগের মাথায় আমাকে যে যা বলে আমি তখন তাই করি৷ অনিক তখন আমার সেই দুর্বলতারই সুযোগ নিয়েছিল! হুট করেই বাজি ধরে বসে প্রিয়াকে আমার ভালোবাসার জালে ফাঁসাতে! প্রিয়াকে ইমপ্রেস করতে। যদি আমি এই কাজটি করতে পারি তবেই বুঝতে পারবে আমি সত্যিকারের পুরুষ! মাথা ঠিক ছিলনা তখন আমার। ছাইপাশ গিলে আরও মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম! তার উপর আবার তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা। সব মিলিয়ে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। বাজিতে হারতে চাইনি তখন। প্রিয়াকে সত্যি সত্যি ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেছিলাম তখন।
এরমধ্যে আবার জানতে পারি পরিবার থেকে আমার এবং প্রিয়ার বিয়ের কথাবার্তা চলছে! তারা চায় যেন আমি প্রিয়াকে বিয়ে করি। এক প্রকার ফোর্স করছিল তারা আমাকে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয় মা। দুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাকে বুঝাতে থাকে প্রিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হলেই মা সুস্থ হয়ে উঠবে। মানসিক প্রেশার কমবে। প্রিয়াকে নিয়ে করা দুঃশ্চিন্তাও কমে যাবে। নানানভাবে তারা আমাকে রাজি করায় প্রিয়াকে বিয়ে করতে। উভয় দিক থেকে চাপ পড়ছিল তখন। না পারছিলাম তোমাকে ভুলতে। না পারছিলাম প্রিয়াকে মন থেকে আপন করে নিতে। বিশেষ করে তোমাকে হারানোর কষ্টটা আমি মানতে পারছিলাম না অয়ন্তী! ভেতরের কষ্টটা কাউকে দেখাতেও পারছিলাম না। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য তখন আমি রাজনীতির সাথে আবারও জড়িয়ে পড়ি! বলতে পারো খুব ঘোরতরভাবে জড়িয়ে পড়ি। ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি তখন যুব রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ি। তবে অনিকের বিরোধী দলের হয়ে! আমাদের পথ তখন আলাদা হয়ে যায়। ক্রমশ আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঝগড়া ঝাটি, মা’রা’মা’রি নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার হিংস্রতা তখন অনিকের থেকেও দ্বিগুন বাড়তে থাকে। দুই দলের খু’না’খু’নি যেন প্রতিদিনকার রুটিন। ভাগে বনাবনি না হলেই দলের হয়ে মা”রামা”রি, কা”টাকা”টি পেশা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের। একবার আমার দলের নেতার সাথে অনিকের দলের নেতার ওপেন কথা কা”টাকা”টি হয়। দু’দলের মধ্যেই তখন সংঘর্ষ লেগে যেতেই মিন্টু ভাই এসে হঠাৎ আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে! ছু’রি, চা’পা’তি যা আছে তা দিয়ে আমার উপর হামলা করে। তাদের মূল উদ্দেশ্যই যেন ছিল আমাকে শেষ করে দেওয়া!
বিশ্বাস করো এত এত ছু”রির আঘাত, পাশবিক মা’র’ধরের আঘাত সহ্য করেও আমার মনের মধ্যে শুধু তুমি ঘুরছিলে! ম’রে যাব সেটা আমার জানা ছিল! এতজনের সাথে আমি একা পেরে উঠব না। যেখানে তারা আমার মুখটা অবধি থেতলে দিচ্ছিল! তখন শুধু একটা আপসোসই হচ্ছিল’ কেন তুমি আমার হলে না? কেন আমাদের ভালোবাসাটা শুরু হওয়ার আগেই এভাবে ভেঙে গেল? আর কী কখনো আমাদের দেখা হবেনা? মৃ’ত্যুর আগে শেষ বারের জন্যও কী আমি তোমার মুখটা একটুখানি দেখে যেতে পারব না? মৃ”ত্যুর পরও কী তুমি একটি বারের জন্যে হলেও আমার মরা লা”শটি দেখতে আসবে না? আমার মা-বাবাকে সামলে বলবেনা,,
“আঙ্কেল আন্টি আপনারা কাঁদবেন না। আপনাদের ছেলে যেখানেই থাকবে ভালো থাকবে।”
#চলবে…
বাকিটুকু প্লিজ ?