#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৩৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
“অনেক হয়েছে নিজের মত থাকা! তবে আর নয়। এবার একটু তোমার ভালো মন্দের কথা আমাকেও ভাবতে দাও!”
অয়ন্তীর মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া প্রতিটি প্রেমময় বাক্যও যেন রাফায়াতের গাঁয়ে ছ্যাত করে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল! এই মুহূর্তে অয়ন্তীকে সহ্য করাও তার ধৈর্যশক্তির বাইরে এসে ঠেকল! আর একদন্ড ও এখানে নয়৷ রাগ যেন এবার তার সীমাহীন ভালোবাসাকেও ছাপিয়ে গেল! অয়ন্তীকে উপেক্ষা করে সে শার্টের হাঁতা ভাজ করতে করতে চৌকাঠের বাইরে পা বাড়াল। অমনি অয়ন্তী খপ করে এসে রাফায়াতের ডান হাতটি চেপে ধরল! উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে রাগমিশ্রিত গলায় বলল,,
“হচ্ছে কী এসব? প্রিয়ার জন্য তুমি আমাকে এভোয়েড করছ?”
রাফায়াতের সোজাসাপটা উত্তর,,
“হ্যাঁ করছি! কারণ তুমি অন্যায় করেছ। তোমার মনগড়া একটি স্টেটমেন্টের জন্য তোমার মতই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে যাচ্ছে। আমি অন্তত তোমার কাছ থেকে এমনটি আশা করিনি অয়ন্তী। ইনফ্যাক্ট আমি এখনো ভাবতেই পারছিনা আমার অয়ন্তী কারো সাথে এত বড়ো একটি অন্যায় করতে পারে।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল অয়ন্তী! হেয়ালী গলায় শুধালো,,
“প্রিয়াকে এত বিশ্বাস করার কারণ? অতীতেও কিন্তু প্রিয়াকে বিশ্বাস করে তুমি ঠকেছিলে!”
“অতীতের সিচুয়েশন আর এখনকার সিচুয়েশন এক নয় অয়ন্তী। মন ভাঙা আর একটা মানুষকে খু’ন করার মধ্যে পার্থক্য অনেক।”
“আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমার চেয়ে তুমি বরং প্রিয়াকেই বেশী বিশ্বাস করো! আমার মুখের কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা তোমার। অথচ প্রিয়ার মুখের কথা এত অনায়াসেই বিশ্বাস হয়ে যাচ্ছে তোমার!”
“এই মুহূর্তে আমি তোমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইছি না অয়ন্তী। আমাকে যেতে দাও প্লিজ।”
রাফায়াতের হাতটি আরও শক্তভাবে চেপে ধরল অয়ন্তী। পিছু ঘুরেই অভিমানী স্বরে বলল,,
“ছাড়ছি না কিছুতেই। এবার তুমি আমাকে যত ইচ্ছা খারাপ ভাবতে পারো। আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার।”
মাথা যেন সাংঘাতিক গরম হয়ে উঠল রাফায়াতের! এক ঝটকায় সে অয়ন্তীর হাত থেকে তার হাতটি ছাড়িয়ে নিলো। আঘাত পেল অয়ন্তী! ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড আঘাত পেল। অশ্রুসজল ঘোলাটে দু’চোখে পিছু ঘুরে তাকালো। উল্টোদিকে রাফায়াত তেড়েফুঁড়ে হেঁটে চলল সামনের দিকে। গিজগিজিয়ে বলল,,
“সহজ কথাটা সহজভাবে বুঝতে পারো না বলেই অযথা আমাকে কঠিন হতে হয়।”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাফায়াত যেন অয়ন্তীর দৃষ্টির সীমানা থেকে উধাও হয়ে গেল। টুপ করে এক ফোঁটা জল তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে। বিষণ্ণতায় মাথা নুইয়ে নিলো অয়ন্তী। চাপা কান্নায় লিপ্ত হয়ে বলল,,
“আমার বুঝতে আর বাকী নেই রাদিফ। তুমি এখন আমাকে নয় বরং প্রিয়াকে ভালোবাসো! তাইতো আমার কোনো কথাই তোমার এখন গাঁয়ে লাগেনা। অসহ্য লাগে আমাকে। আমার এতদিনের অপেক্ষা তাহলে মিথ্যা ছিল রাদিফ। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম আমি!”
______________________________
কেটে গেল মাঝখানে দুইদিন! রাফায়াত চেয়েও প্রিয়ার জন্য কিছু করতে পারেনি এই দুইদিনে। গাঁধার মত খাটুনি করেও সে প্রিয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। সেদিন ভোর বেলায় প্রিয়াকে কে অজ্ঞান করে তাকে অনিকের খু/নে মিসইউজ করেছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মিলল না তার কাছে। রাস্তাঘাটে কোনো সিসিটিভি ফুটেজও ছিলনা যে এর থেকে কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। মির্জা ফখরুল হকও এই ব্যাপারে রাফায়াতকে কোনো হেল্প করতে পারলেন না! বরং ইচ্ছে করেই চাইলেন না হেল্প করতে। রাফায়াতকে তিনি এই মহা ষ’ড়’যন্ত্র থেকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এই যেন অনেক। এখন নতুন করে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না তিনি।
প্রিয়ার পক্ষে রাফায়াত উকিল ঠিক করতে চাইলেও প্রিয়া এই বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানালো! যদিও এর কারণ রাফায়াত তখন বুঝতে পারেনি তবে প্রিয়াকে কোর্টে উঠানোর পর সব যেন তার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। কোর্টে ওঠে প্রিয়া নিজের মুখে সব স্বীকার করল যে অনিককে সে নিজেই খু/ন করেছে! মো’টিভ তার সুস্পষ্ট এবং পরিকল্পিত! দীর্ঘ এক বছর ধরে অনিক তাকে ঠকিয়ে আসছিল। তাকে ম্যা’ন্টা’লি এবং ফি’জি’ক্যা’লি ট’র্চা’র করছিল। বাচ্চা এবর্শন করার মত পাপ কাজও তাকে দিয়ে করিয়েছিল। রেস্টুরেন্টে সবার সামনে তার গালে চ’ড় মেরেছিল! ছোটো বড়ো কথা শুনিয়েছিল তাকে। তাকে মা’রধরের হুমকি দিয়েছিল। এত অপমান, লাঞ্চনা, গঞ্চনা আর সহ্য হচ্ছিল না তার। তাই সে প্রতিশোধের নেশায় প্রয়াত হয়ে প্ল্যান মাফিক অনিককে নির্মমভাবে খু/ন করে!
সেদিন রাতের বেলাই প্রিয়া রাফায়াতদের বাড়ি ছাড়ে। অনিকের সাথে রাত কাটাবে বলে প্রথমে অনিকের ফ্লাটে ঢুকে। সারারাত অনিকের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার পর সে ভোরের দিকে সুযোগ বুঝে ঘুমন্ত অনিককে খু/ন করে! প্রথমে গলায় ছু/রি/কাঘাত করে এবং পরে হাতে-পায়ে। অনিকের মৃ/ত্যু সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে সে এরপর ফ্লাট ছাড়ে! ফ্লাটের ভেতরে এবং বাইরে সিসি ক্যামেরা না থাকার দরুন সবদিক থেকে তার সুবিধাই হয়েছিল! প্ল্যানমাফিক চঞ্চলের ফ্লাটে চলে যায় সে। চঞ্চলের সাথে মিথ্যে অভিনয় করে। একই ভাবে চঞ্চল এবং রাফায়াতের সহানুভূতি অর্জন করে। নিজেকে সেইফ রাখার জন্য সে রাফায়াতকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চঞ্চলের ফ্লাট ছেড়ে চট্টগ্রামের বাইরে চলে যায়। এই পুরো ব্যাপারটাতেই প্রিয়া আগে থেকে জানত অনিকের খু/নে সবাই রাফায়াতকেই সন্দেহ করবে! কিন্তু এটা জানত না যে শেষমেশ তার ঘাড়েই এসে সব পড়বে। প্রতিশোধের নেশায় বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল সে। যার ফল এখন সে একাই ভোগ করতে চায়!
প্রিয়ার পুরো স্টেটমেন্ট শুনে তব্ধ হয়ে যায় সবাই। বিশেষ করে রাফায়াত এবং তার গোটা পরিবার। অনিকের বাবা-মায়ের চোখে তখন একমাত্র ছেলেকে হারানোর আর্তনাদ এবং প্রিয়ার প্রতি জমতে থাকা অসজ্ঞায়িত ক্ষোভ। চোখ ঘুরিয়ে অয়ন্তী তখন রাফায়াতের দিকে তাকালো! চোখে চোখ পড়ে গেল দুজনের। হেয় হাসল অয়ন্তী। ইশারায় রাফায়াতকে বলল,,
“দেখলে তো? অতি বিশ্বাসের ফল?”
লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো রাফায়াত। প্রিয়াকে দেখে কোথাও মনে হচ্ছিল না প্রিয়া সব বাধ্য হয়ে বলছে বা ভয়ভীতি থেকে কিছু বলছে। বরং মনে হচ্ছিল সব তার মনের গহীন থেকে বলা কথা। সম্পূর্ণ নির্ভেজাল। বেশিক্ষণ একই জায়গায় বসে থাকতে পারলনা রাফায়াতের মা! প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি কোটের বাইরে চলে গেলেন। প্রিয়া অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে নিলো। চোখ থেকে টপটপিয়ে জলও গড়িয়ে পড়ছিল। কোর্ট থেকে প্রিয়াকে যাবত জীবন শাস্তি দিলো! অনিকের ভুল গুলোকেও জর্জ বড়ো করে দেখলেন। তাই প্রিয়াকে মৃ/ত্যু/দন্ড থেকে যাবত জীবনের সাজা দিলেন। থানায় তুলে নেওয়া হলো প্রিয়াকে। একটি বারের জন্যেও প্রিয়া চোখ তুলে তার পরিবারের দিকে তাকালো না। বরং মাথা নুইয়ে পুলিশদের সাথে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল!
বিষণ্ন মনে রাফায়াত কোর্ট থেকে বের হতেই অয়ন্তী পেছন থেকে রাফায়াতকে ডাকল। পিছু ঘুরে তাকাতেই অয়ন্তী কাতর হয়ে রাফায়াতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। দ্রুত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী? প্রিয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাফায়াত। কেমন যেন ভরাট গলায় বলল,,
“আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা প্রিয়া এই কাজটা করতে পারে!”
“আজব তো! প্রিয়া নিজের মুখে সবকিছু স্বীকার করার পরেও তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা?”
“না হচ্ছে না।”
মনমরা ভাব নিয়ে রাফায়াত সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অয়ন্তী আবারও পিছু ডাকল রাফায়াতকে। গুরুগম্ভীর গলায় বলল,,
“আজই আমি ঢাকায় ব্যাক করছি রাদিফ!”
থেমে গেল রাফায়াত। পিছু ঘুরে তাকালো অয়ন্তীর দিকে। উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“আজই?”
“হ্যাঁ?”
“কিন্তু কেন? এখানের অনেক কাজ তো এখনো বাকী তোমাদের।”
“আমার ভালো লাগছেনা আর এখানে থাকতে। মনে হচ্ছে যেন কিছুই আর আগের মত নেই। তুমি বদলে গেছ রাদিফ!”
“কে বলল আমি বদলে গেছি?”
“ঠিকভাবে কথা বলছ না আমার সাথে। কেমন যেন এড়িয়ে চলছ। প্রিয়াকে নিয়ে একটু বেশীই ভাবছ!”
“কাজিন হিসেবে প্রিয়াকে নিয়ে ভাবছি। অন্যকিছু হিসেবে নয়। তুমি অযথা আমাকে ভুল বুঝছ।”
“আমি অযথা কাউকে ভুল বুঝছি না। আজ রাতেই আমি একা ঢাকায় চলে যাব। আমার বাড়ি। আমার নিজের বাড়িতে।”
প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে অয়ন্তী গটগট করে হেঁটে রাফায়াতের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। অয়ন্তীকে আর পিছু ডাকল না রাফায়াত। রাগটাকে আরও একটু গাঢ় হতে দিলো! সঠিক সময়ে অয়ন্তীর এই মিষ্টি অভিমান ঠিক ভাঙিয়ে নিবে সে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাফায়াত। চঞ্চলকে নিয়ে দলীয় একটা মিটিংয়ে গেল। এত সহজে রাজনীতি ছাড়তে পারবে না সে। অনেক সময় লাগবে ছাড়তে হলে।
প্রিয়ার শোকে রাফায়াতের পরিবারের নাওয়া খাওয়া বন্ধ। বিশেষ করে রাফায়াতের মায়ের! প্রেশার বাড়ে তো কমে। শরীর ঠিক হওয়ার নামই নিচ্ছেনা। প্রিয়াকে লালন পালন করতে কোথায় উনার ভুলত্রুটি ছিল তাই তিনি খুঁজে বের করতে পারছেন না। এ যেন মহা এক জ্বালা। খালা থেকে মা হয়ে উঠার জ্বালা!
_________________________________
অভিমান যেন তীব্র রাগে পরিণত হলো অয়ন্তীর। প্রায় আধঘণ্টা যাবত অয়ন্তীর সামনে রাফায়াত কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে! তবুও যেন পাষাণীর মন গলছে না। বরং ভাব বাড়ছে! রাত তখন আস্তে ধীরে গভীর হতে লাগল। বাড়ির ছাদে মশা মাছির উপদ্রব বাড়তে লাগল। কানে হাত থাকার দরুন মনের সুখে রাফায়াতের শরীরের র’ক্ত চু’ষ’তে থাকা মশাদেরও কোনো কুল কিনারা করতে পারছেনা রাফায়াত। কেবল ভোক্তভোগীদের ন্যায় মশার কামড় খেয়ে চলছে! তবে এই বিষয়টিতে অয়ন্তী বেশ মজা পাচ্ছে! মুখ টিপে হাসতে ব্যস্ত সে। আচ্ছে মত শায়েস্তা করা যাচ্ছে এই নাছোড়বান্দাক! পরিশেষে রাফায়াত দিশা বিশা খুঁজে না পেয়ে কাচুমাচু মুখে অয়ন্তীর দিকে তাকালো। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত মানুষটির রূপ নিলো। মোলায়েম গলায় বলল,,
“জান? শাস্তি শেষ হয়েছে এবার?”
কঠোর ভাব নিলো অয়ন্তী। বুকের উপর দু’হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। উল্টোদিকে তাকিয়ে বলল,,
“না হয়নি। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকুন।”
“ওমা! এখন আবার আপনি কেন?”
“কারণ, আমি আপনার সাথে এখন রাগ করে আছি তাই।”
“কিন্তু আমি তো অনেকবার সরি বলেছি তাইনা? আধঘণ্টা ধরে কান ধরেও দাঁড়িয়ে আছি। তাহলে এখনও রাগ কমছে না কেন জান?”
“কারণ, এই দুইদিনে আপনি আমাকে অনেক হার্ট করেছেন। রীতিমত এড়িয়ে চলেছেন আমাকে। একদণ্ডের জন্যেও কথা বলতে আসেন নি আমার সাথে।”
“তখন তো আমার মন ভালো ছিলনা জান। তাইতো কথা বলিনি। কিন্তু এখন তো আমার মন ভালো হইছে জান। দেখোনা তোমার কথামত কেমন কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি! একটুও রাগ দেখিয়েছি বলো? তুমি যা বলছ তাই করছি না?”
“কিন্তু হাতে করে তো একটা ফুল আনতে পারতেন! তা ও তো করেননি। কেমন ঠ্যাং ঠ্যাংয়াতে ঠ্যাং ঠ্যাংয়াতে চলে এসেছেন। রোমান্টিকতার বালাই মাত্র নেই!”
#চলবে…?