#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৫২
#নিশাত_জাহান_নিশি
রাফায়াত বহুকষ্টে অয়ন্তীকে বুঝালো সকাল অবধি অপেক্ষা করতে। দু-এক ঘণ্টা দেরী হলেও বিরাট কোনো সমস্যা হবেনা। রাফায়াতের কথামত অয়ন্তী এই বাড়িতে রাখা তার সমস্ত সাজ সরঞ্জাম, আগের ব্লাউজ পেটিকোটগুলো গুছিয়ে নিলো। এরমধ্যেই রাফায়াতের মনে পড়ল নাক ফুলটির কথা! এত কিছুর মধ্যে রাফায়াত প্রায় ভুলেই গিয়েছিল অয়ন্তীর জন্য সে একটি সারপ্রাইজ গিফট এনেছে!
মেঝেতে বসে ব্যাগ গোছাতে থাকা অয়ন্তীকে টেনে এনে রাফায়াত বিছানার উপর বসালো। অয়ন্তীর মুখোমুখি সেও হাঁটু গেড়ে বসল। ম্লান হেসে চমকে থাকা অয়ন্তীর দিকে মিনিট কয়েক নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আচমকাই অয়ন্তীর কপালে ছোট্টো চু’মু এঁকে দিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল,,
“একটা গিফট আছে!”
মুহূর্তেই খুশি হয়ে গেল অয়ন্তী। কৌতূহল ক্রমাগত তার বাড়তে লাগল। হেঁতো হেসে সে রাফায়াতের দিকে ঈষৎ ঝুকল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী গিফট?”
“উমমম। গেইস করো!”
থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে অয়ন্তী কিছু একটা গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। চোখেমুখে তার তীব্র নাটকীয় ভাব। মনে হচ্ছিল যে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই সে গোটা মহাভারত ভেবে নিচ্ছে! আর ভাবুক হয়ে কেমন যেন বিড়বিড় করে বলছে,,
“কী হতে পারে, কী হতে পারে।”
অয়ন্তীর ভাবনাচিন্তার এহেন নাটকীয় ভাব দেখে ফিক করে হেসে দিলো রাফায়াত। আহ্লাদী হয়ে সে অয়ন্তীর গাল দুটো টেনে দিলো। আদুরে গলায় বলল,,
“ঢঙী বৌ আমার!”
অমনি অয়ন্তী নাকমুখ কুঁচকে তার দু’গালে হাত রাখল। সম্পূর্ণ অধৈর্য্য গলায় বলল,,
“আরে বলেন না কী গিফট?”
অয়ন্তীকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাতে মন চাইলনা রাফায়াতের। কেমন যেন চুপসে গেছে অয়ন্তীর চঞ্চল মুখ খানি। ঝট করে রাফায়াত তার পকেট থেকে নাক ফুলের বক্সটি বের করল। অতি শীঘ্রই অয়ন্তীর মুখের সামনে বক্সটি ধরে বলল,,
“এবার বলো কী হতে পারে?”
ঠোঁটের কোণে অফুরন্ত হাসি নিয়ে অয়ন্তী বক্সটির দিকে তাকালো। বক্সটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে এবার রাফায়াতের দিকে হাসোজ্জল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জবাবে বলল,,
“রিং?”
মুখটা ভার করে নিলো রাফায়াত! বিষণ্ন গলায় বলল,,
“অন্যকিছু। পার্সোনালি রিং গিফট করার মত তৌফিক আমার এখনো হয়নি!”
“আশ্চর্য! এখানে মন খারাপ করার কী আছে? বিয়েতে আপনারা আমাকে কম স্বর্ণ গহনা দেননি। যা দিয়েছেন প্রচুর দিয়েছেন। আমি এতেই অনেক খুশি। তাছাড়া মা-বাবার দেওয়া যে কথা। আপনার দেওয়া একই কথা। আপনার কাছ থেকে বাড়তি কিছু পাওয়ার প্রয়োজন-ই নেই আমার। জাস্ট কৌতূহল থেকে আস্ক করেছিলাম এটা রিং কি-না। এর জন্য এত মন খারাপ করতে হবে হুম?”
“আচ্ছা বাদ দাও। এখন বলো কী হতে পারে?”
“নৌজ পিন?”
”ইয়াহ্!”
বলেই রাফায়াত বক্সটি খুলল। অমনি অয়ন্তীর দু’চোখে ডায়মন্ডের নাক ফুলটি জ্বলজ্বল করে উঠল। মুহূর্তেই চমকে গেল অয়ন্তী। বক্সটিকে হাত বাড়িয়ে নিলো। নাক ফুলটির দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে আমোদিত গলায় রাফায়াতকে বলল,,
“ডায়মন্ড হবে আশা করিনি।”
মৃদু হাসল রাফায়াত। কৌতূহলী হয়ে অয়ন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“পছন্দ হয়েছে?”
“অনেক।”
ব্যস্ত হয়ে পড়ল অয়ন্তী নাকফুলটি নাকে পড়তে। নাক থেকে প্রথমে সে তার স্বর্ণের নাকফুলটি খুলল। অতঃপর রাফায়াত নিজ হাতে অয়ন্তীকে তার আনা নাকফুলটি পড়িয়ে দিলো। অমনি যেন শুভ্র মুখের আদলটি অয়ন্তীর আরও দ্বিগুনভাবে ফুটে উঠল! নাকফুলটির চকচকানিতে তার সমস্ত মুখ চকচক করে উঠল। রাফায়াত কেবল অপলক দৃষ্টিতে অয়ন্তীকে দেখতে লাগল। এ দেখার যেন শেষ নেই। চোখ দুটো তার ফেরাতেই ইচ্ছে করছিল না অয়ন্তীর থেকে। ইদানিং অয়ন্তীর দিকে একবার তাকালে তার আর সেই দৃষ্টি ফেরাতে মন চায়না! এক ধ্যানে কেবল তাকিয়ে-ই থাকতে মন চায়। যদিও এর কারণ রাফায়াতের জানা নেই। হয়ত দিন যত বাড়ছে ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে সে অয়ন্তীর প্রতি।
এমনি এমনি করেই রাত কাটিয়ে সকাল নেমে এলো। ঘড়িতে সকাল সাতটার কাটা পৌঁছোতেই অয়ন্তী তার শ্বশুড় বাড়ি ফিরে এলো। রাফায়াত তার মা-বাবা-ভাই এবং ভাবিকে জানিয়ে দিলো আজ তারা সাজেক যাচ্ছে। সবাই বেশ খুশি তাদের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে। অয়ন্তী তো ব্যস্ত তার শাড়ি- কাপড়ের ব্যাগ গোছাতে। খবরটা শুনে রাফায়াতের ভাবিও চলে এলো অয়ন্তীকে সাহায্য করতে। সেই ফাঁকে অয়ন্তী শাওয়ার নিতে চলে গেল। কারণ, আর খুব বেশী একটা সময় নেই তাদের হাতে। গোসল করে সাজতে গুজতেই অয়ন্তীর আরও ঘণ্টা খানিক লেগে যাবে। অন্যদিকে রাফায়াতের মা রাফায়াতকে বুঝাচ্ছে অয়ন্তীকে চোখে চোখে রাখতে। যা চঞ্চল মেয়ে অয়ন্তী। কখন কোথায় থেকে কোথায় চলে যায়। তাই তার দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে। শুধু ঘুরলেই চলবেনা ঘুম, খাওয়া দাওয়া সব ঠিক রাখতে হবে।
সকাল নয়টা বেজে গেল তাদের রওনা হতে হতে। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে অয়ন্তী আজ লাল পরী সেজেছে! চুলে বেলীফুলের খোঁপা বাঁধাতে যেন তার সৌন্দর্যের পরিমান আরও তিনগুণ বেড়ে গেছে! রাফায়াত অনেক করে বলেছে অয়ন্তীকে এত না সাজতে। ঠোঁটে এত লিপস্টিক না ঘঁষতে। নজর লেগে যাবে লোকজনের! কে শুনে কার কথা? চোখের কাজল এবং লিপস্টিক সে এতটাই গাঢ়ভাবে পড়েছে যে সবার দৃষ্টি তার দিকে পড়তে বাধ্য! চারদিনের ট্রিপে অয়ন্তী মোট তিনটি ল্যাকেজ গুছিয়েছে! সেগুলোর ভার বহন করতে করতেই রাফায়াতের অবস্থা কাহিল! যদিও বাড়ির গেইটের সামনে আরিফের ঠিক করা প্রাইভেট কার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তবুও যেন বাড়ি থেকে গেইট অবধি ল্যাকেজপত্রগুলো এগিয়ে আনতে রাফায়াতের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।
সবশেষে দুই পরিবারের সবার থেকে বিদায় নিয়ে অয়ন্তী এবং রাফায়াত আল্লাহ’র নাম করে তাদের যাত্রা শুরু করল। রাফায়াত তার সাথে আরিফকে ও নিয়ে নিলো! এতদূরের পথ অয়ন্তীকে একা নিয়ে সে ঝুঁ’কি নিতে চাইলনা। ইদানিং তার একা চলাফেরা করতেও কেমন যেন ভয় হয়! বিপদ তো আর বলে কয়ে আসেনা! এমনিতেই তার জানের প্রতি অনেকের-ই বদনজর!
গাড়িতে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত অয়ন্তী নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে রাফায়াতের কাঁধে মাথা রেখে কাটালো। বকবক করতে করতে সে রাফায়াত, আরিফ এবং ড্রাইভারের মাথা প্রায় খেয়ে নিলো! তার আগ্রহের ফুলঝুড়ি যেন ফুরচ্ছেই না! বরং ক্রমাগত বাড়ছে। সাজেক পৌঁছাতে আর কত সময় লাগবে? বিকেলের মধ্যেই সাজেক পৌঁছানো যাবে কি-না? সাজেক পৌঁছে তারা কোন হোটেলে উঠবে? কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবে? এসব নানাবিধ প্রশ্ন করতে করতে সে রাফায়াত শুদ্ধু সবার মাথা আউট করে দিচ্ছিল! মোট কথা তার কৌতূহল এবং উচ্ছ্বাসের যেন কমতি ছিলনা!
নিরাপদে তাদের সাজেক পৌঁছাতে মোটামুটি সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। রাস্তায় অনাকাঙ্ক্ষিত যানজট, খাবার খেতে ওঠা-নামা এই করতে করতে সন্ধ্যা গড়ালো। সাজেক ভ্যালির কাছাকাছি হোটেলটিতে দুটি রুম বুক করল রাফায়াত। একটি আরিফের জন্য এবং অন্যটি অয়ন্তী এবং তার জন্য। হোটেলে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে নিতেই রাত ঘনিয়ে এলো। অয়ন্তী ঘ্যান ঘ্যান করলেও এই রাতের বেলা ঝুঁকি নিয়ে রাফায়াত অয়ন্তীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলোনা। রাতের খাবার খেয়ে অয়ন্তীকে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল!
মেঘের শহর সাজেকে তাদের আসা যাওয়া নিয়ে প্রায় চারদিন থাকা হলো! দিব্যি ঘুরাঘুরি করা হলো দুইদিন। মেঘেদের সাথেই যেন কাটানো হলো তাদের সাজেকে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত। অয়ন্তীর হাজার হাজার ছবি দিয়ে ভরে গেল আরিফের ডি.এস.এল.আর! যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই তার শ’খানিক ছবি তোলা হচ্ছে। একেক শাড়িতে একেক রকম ছবি তার। ঢঙয়ের যেন কমতি নেই তার। মাঝেমধ্যে জোরপূর্বকভাবে রাফায়াতকেও টেনে এনে অয়ন্তীর অনেক কাপল পিক তোলা হলো। শ’খানিক ভিডিও করল। মোট কথা, অয়ন্তী তার ইচ্ছেমত সব করল। রাফায়াতও এই নিয়ে কোনো বিধি-নিষেধ দিলোনা। অয়ন্তীর খুশি দেখে তার আর কিছু বলার-ই থাকল না। বরং এই দেখে ভালো লাগছে যে, অয়ন্তীর সব শখ, ইচ্ছে, আহ্লাদ একটু একটু করে পূরণ করতে পারছে সে। স্বামী হিসেবে এই বা কম কীসে?
সপ্তাহ খানিক হয়ে গেল তাদের সাজেক থেকে বাসায় ফেরার। রাফায়াত যথারীতি তার কাজে জয়েন করে ফেলল। কাজ নিয়ে রাতারাতি ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। সকাল নয়টায় বাসা থেকে বের হয় আর ফিরে আসে রাত দশটা কী এগারোটায়। বাড়ি ফিরেও অর্ধেক রাত অবধি তাকে ল্যাপটপে কাজ করতে হয়! অয়ন্তীকে এখন তার খুব কমই সময় দেওয়া হয়। এদিকে বিগত চারদিন বাইরে থেকে ইচ্ছেমত ঘুরে টুরে এসেও অয়ন্তীর মন ভরল না! সাজেক থেকে ফিরে আসার পর থেকেই তার মন খারাপ। আবারও অন্য কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে তার! কিন্তু ভয়ে রাফায়াতকে বলা হচ্ছেনা। যদি তা শুনে রাফায়াত রেগে যায়?
রাত এগারোটায় অফিস থেকে ফিরে এসে রাফায়াত প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নিলো। লাল রঙের একটি টি-শার্ট এবং কালো রঙের একটি টাইজার পড়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার অর্ধ ভেজা চুলগুলো শুকনো হাত দ্বারা মুছতে লাগল। অন্যদিকে অয়ন্তী এক হাতে পানি এবং অন্য হাতে কফির মগ নিয়ে রাফায়াতের সামনে পেছনে কেবল ঘুরঘুর করছে। মানে আজ সে যে করেই হোক রাফায়াতকে রাজি করাবে কাল সে তার ফুফু শ্বাশুড়ীর বাড়িতে বেড়াতে যেতে চায়! রাফায়াত তাকে বেড়াতে যেতে দিবেনা বিধায় রাফায়াতের মা এবং ভাবিও বেড়াতে যেতে পারছেনা। এইদিকে রাফায়াতের ফুফু বিয়ের পর থেকেই তাদের বিরক্ত করছে কয়েকদিনের জন্যে হলেও তাদের বাড়িতে ঘুরতে যেতে। দাউদকান্দি তো ঢাকা থেকে বেশী দূরে নয়। তাছাড়া রাফায়াতের ফুফু যদিও অনেকবার ফোন করে রাফায়াতকে বলেছিল অয়ন্তীকে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যেতে দিতে তবে ফায়াত খুবই সূক্ষ্ণভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে! মানে রাফায়াত নারাজ অয়ন্তীকে কোথাও বেড়াতে যেতে দিতে।
চুল মুছে রাফায়াত পিছু ফিরতেই হঠাৎ অয়ন্তীর মুখোমুখি পড়ে গেল। আকস্মিক অয়ন্তীকে সামনে দেখতে পেয়ে খানিক কেঁপে উঠল রাফায়াত! ভাবশূণ্য হয়ে সে অয়ন্তীর মাথায় গাড্ডা মারল। মিহি স্বরে বলল,,
“পেছনে দাঁড়িয়ে কী করছ? ভয় দেখাচ্ছ না-কি?”
নাকমুখ কুঁচকে অয়ন্তী যথেষ্ট স্বাভাবিক স্বরেই বলল,,
“না। কফি দিতে এসেছিলাম।”
অয়ন্তীর হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে রাফায়াত সোজা খাটের উপর বসল। ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে বেশ তৃপ্তির স্বরে বলল,,
“কফিটা বেশ ভালোই বানাও তুমি।”
রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অয়ন্তী বেশ ভাব নিয়ে বলল,,
“শুধু কফি কেন? রান্নাটাও বেশ ভালো করতে পারি আমি!”
সঙ্গে সঙ্গেই নাকেমুখে ওঠে গেল রাফায়াতের! কাশতে কাশতে সে ঠাট্টার স্বরে বলল,,
“সেজন্যই আজ দুপুরে এক লোকমার বেশী ভাত খেতে পারিনি!”
অপমান বোধ করল অয়ন্তী। মুহূর্তেই যেন ক্ষেপে গেল সে। কোমড়ে হাত চেপে ধরে রাফায়াতের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুকে দাঁড়ালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“কী বললেন আপনি? ইনডিরেক্টলি বুঝালেন আমার রান্না খারাপ?”
যদিও রাফায়াত সত্যিটা বলতে চাইছিলনা। তবে অয়ন্তীকে রাগানোর জন্য সে মিচকে হেসে বলল,,
“না তেমন কিছুনা। মুরগি তরকারিটা ভালো হলেও মাছ তরকারীটা মুখেই দিতে পারিনি! নির্ঘাত মাছ তরকারিটা তুমি রান্না করেছ?”
শুড়শুড়িয়ে রাফায়াতের হাত থেকে কফির মগটা কেড়ে নিলো অয়ন্তী। রাফায়াতের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে চোয়াল উঁচিয়ে বলল,,
“আমার হাতের রান্না যেহেতু এতই খারাপ। তো এবার থেকে আমার হাতের কফিও খেতে হবেনা আপনার!”
রাগে রিরি করে অয়ন্তী রাফায়াতের শার্টের কলারটি ছেড়ে দ্রুত পায়ে রুমের দরজার দিকে হাঁটা ধরল। অমনি রাফায়াত হাসতে হাসতে এসে অয়ন্তীকে পেছন থেকে জাপটে ধরল। আহ্লাদি স্বরে বলল,,
“আরেহ্ আরেহ্! রাগ করছে কেন আমার বৌটা?”
রাফায়াতকে গাঁ থেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল অয়ন্তী। তবে যেন রাফায়াতের পুরুষালী শক্তির সাথে পেরে উঠছিলনা সে। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সে রাগী স্বরে রাফায়াতকে বলল,,
“দেখি ছাড়ুন৷ আপনার সাথে আমি আর থাকবই না। চলে যাব ফুফু আম্মার বাড়িতে!”
এবার উল্টো ক্ষেপে গেল রাফায়াত! অয়ন্তীকে তার দিকে ঘুরালো। কফির মগটা অয়ন্তীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পাশেই ওয়াড্রবের উপরে রাখল। মুহূর্তেই চোখমুখ রাঙিয়ে ওঠে সে ভয়ে চুপসে থাকা অয়ন্তীর দিকে তাকালো। শাণিত গলায় বলল,,
“শুধু ঘুরাঘুরি না? পা দুটো বেশী বড়ো হয়ে গেছে?”
নরম হয়ে এলো অয়ন্তী। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে ক্ষিপ্ত রাফায়াতের দিকে তাকালো। শুকনো গলাটা ঈষৎ ভিজিয়ে ভীতিকর গলায় বলল,
“দু-তিনদিনেরই তো ব্যাপার। কী হয় গেলে?”
“না তুমি যাবা না। ফুফুকে তো অনেকবারই বলা হয়েছে। তবুও তোমাকে উস্কাচ্ছে তাইনা?”
“উস্কানোর কী হলো রাদিফ? নতুন নতুন বিয়ের পর তো আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি থেকে দাওয়াত আসবেই। কেন এই সহজ বিষয়টাকে সহজভাবে নিচ্ছেন না বলুন তো?”
“কারণ তোমাকে ছাড়া এখন আমার একটা মুহূর্তও ভালো লাগেনা! সারাদিনের ব্যস্ততার পর বাড়ি ফিরে যখন তোমার মুখটা দেখি তখন আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়! স্বস্তি ফিরে পাই। বুঝো না তুমি? সবসময় কেন বলে বলে বুঝাতে হবে?”
“এজন্য আমি কোথাও বেড়াতে যাবনা বলুন? তাছাড়া দু-একদিনেরই তো ব্যাপার। এরপর তো সবসময় আপনার চোখের সামনেই থাকব। ম’রে তো যাচ্ছি না আর!”
“তুমি কেন ম’র’বা? আমি-ই ম’র’ব। খুব শীঘ্রই ম’র’ব! তখন আর তোমাকে জ্বালানোর মত কেউ থাকবেনা। তোমাকে একটা নজর দেখার জন্য কেউ হাসফাস করবেনা! তোমার হাসিমুখটা দেখার জন্য কেউ নিজের সবটা বিসর্জন দিয়ে পাগলের মত পাগলামো করবেনা! বেড়াতে যাবা না বলছ? যাও। ফিরে এসে দেখবে আমি নেই!”
অত্যধিক রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অয়ন্তী ঠা’স করে রাফায়াতের দু’গালে দু’চ’ড় মে’রে বসল! হেঁচকি তুলে কেঁদে অয়ন্তী দৌঁড়ে রাফায়াতের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! একছুটে সে তার বাপের বাড়ি চলে এলো! ঐদিকে গালে হাত দিয়ে রাফায়াত রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। বাপের বাড়ি গেছে তবুও ঠিক আছে! তাকে ছেড়ে বেশী দূরে যেন না যায় এটাই উদ্দেশ্য তার! কান্নাকাটি করে অয়ন্তী বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই উদ্বিগ্ন হয়ে রাফায়াতের মা রাফায়াতের রুমে ঢুকলেন। অধিক আগ্রহী হয়ে তিনি কী হয়েছে জানতে চাইলেই রাফায়াত রগচটা হয়ে সব খুলে বলে। অয়ন্তীকে কোথাও যেতে দিবেনা বলেও তার মা’কে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়! সব শোনার পর মিসেস শায়লা হক রাফায়াতের এই সিদ্ধান্তটিতে বিরক্ত বোধ করলেন। সব বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলে গেলেন! কিছু কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। বিয়ের পর মেয়েরা এমনিতেও কিছুদিন বেড়াতে যাওয়া বা ঘুরাফেরা করতে পছন্দ করে। সেক্ষেত্রে অয়ন্তীও এর অন্যথায় নয়।
ঝগড়াঝাঁটির প্রায় একঘণ্টা পর যখন রাফায়াতের মাথা ঠাণ্ডা হলো তখন রাফায়াত অয়ন্তীকে আনতে ঐ বাড়িতে গেল। তার শ্বশুর এবং শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সে অয়ন্তীর রুমে ঢুকল। যদিও তার শ্বশুড় এবং শ্বাশুড়ী মা তাদের ঝগড়ার কারণ জানতে চায়নি তবুও তার শ্বাশুড়ী মা আকার ইঙ্গিতে তাকে বুঝালো তারা সব জানে! আর শীঘ্রই অয়ন্তীর রাগ ভাঙাতে। তাদের ইন্ধন পেয়ে রাফায়াত অয়ন্তীর রুমে প্রবেশ করতেই দেখল অয়ন্তী ঘুমে প্রায় কাত! নাকেমুখে কাঁথা টেনে সে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে রাফায়াত ঘুমন্ত অয়ন্তীকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো! দু-এক কদম হাঁটতেই অয়ন্তী ঘুম ভেঙে ওঠে গেল। কারো কোলে নিজেকে অনুভব করা মাত্রই অয়ন্তী ঘুম ভুলে বি’স্ফো’রিত দৃষ্টিতে সামনে তাকালো। রাফায়াতকে এক পলক দেখামাত্রই সে চোখমুখ লাল করে রাফায়াতের কোল থেকে নামার চেষ্টা করল। অমনি ব্যগ্র হেসে ক্ষুব্ধ অয়ন্তীকে বুকের মাঝে চেপে ধরল সে। অয়ন্তীকে বুঝিয়ে বলল,,
“এখানে চিৎকার চ্যাঁচামেচি বা রাগারাগি করবেনা প্লিজ। তোমার মা-বাবার কাছে আমার ফেইস লস হবে। প্রয়োজনে বাড়ি পৌঁছে আমাকে আচ্ছেমত মে’রে দিও। তবুও এখানে চুপ থাকো।”
রাফায়াতের সম্মানহানির ব্যাপার স্যাপার আছে বিধায় অয়ন্তী সত্যিই চুপ হয়ে গেল! খামোশ খেয়ে সে রাফায়াতের কোলে করেই ঐ বাড়ি পৌঁছালো। তার শ্বাশুড়ী মায়ের কথামত সবার সাথে রাতের খাবারটাও খেল। সুদৃষ্টিতে সে একটিবারের জন্যও রাফায়াতের দিকে তাকালো না। বরং রাগে দাঁতে দাঁত চাপছিল! পরিস্থিতির চাপে পড়ে আজ তাকে শান্ত হতে হচ্ছে! নয়ত এক্ষুণি রাফায়াতের বারোটা বাজাত সে। খাওয়াদাওয়া শেষে অয়ন্তী জগ ভর্তি পানি নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। বিছানার উপর শুয়ে রাফায়াত অয়ন্তীর জন্য অপেক্ষা করছিল। অয়ন্তীকে দেখামাত্রই রাফায়াত দৌঁড়ে গিয়ে রুমের দরজাটি বন্ধ করল! সশব্দে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলো। হঠাৎ দরজা লাগানোর শব্দে অয়ন্তী যেন ভড়কে উঠল। জগটা ডেস্কের উপর রেখে সে পিছু ফিরে তাকাতেই রাফায়াত তাকে নিয়ে বিছানার উপর ছিটকে পড়ল! ক্ষিপ্র হয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের বুকে চ’ড় ঘু’ষি মা’র’তে মা’র’তে বলল,,
“ছাড়ুন বলছি। ম’রে যেহেতু যাবেনই তো এত মায়া বাড়াচ্ছেন কেন?”
“রাগ উঠেছিল তাই কথার কথা বলেছি। তোমাকে ছেড়ে আমি থোরাই না এত দ্রুত ম’র’তে যাব!”
“থাক হইছে ছাড়েন। নাটক করতে হবেনা। আপনার নাটক আমি বুঝি।”
আর বেশী অপেক্ষা না করে রাফায়াত জোরপূর্বক অয়ন্তীর কোমল ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল! অয়ন্তীর হাত দুটো শক্ত করে বিছানার সাথে চেপে ধরে সে অস্ফুটে গলায় বলল,,
“হানিমুন থেকে আসার পর থেকেই তোমার ধারে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছনা। তাই আজ আর কোনো বারণ শুনছিনা আমি। তাছাড়া কাল তো সত্যি সত্যিই বেড়াতে চলে যাবে! আরও দু-তিন দিনের জন্য কাছে পাবনা!”
#চলবে….?