#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৮,০৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
০৮
“আমি অনেককিছু হই নাক গলানোর! অনেক কিছুই হই। অনিক আমাকে বলেছিল সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তার চোখে-মুখে আমি সেই ভালোবাসা দেখেছিলাম। ট্রাস্ট করেছিলাম আমি তাকে। নিজের থেকেও বেশী। আজ সবকিছু জানতে পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে অয়ন্তী! খুব বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে!”
নির্লিপ্ত নির্বিকার দৃষ্টিতে অয়ন্তী তাকিয়ে রইল কঠোর ভাবাপন্ন রাফায়াতের দিকে। হঠকারিতায় তার মুখের জবান রুদ্ধ প্রায়। কৌতূহল, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা যেন বেগতিক গাঢ় হতে লাগল। বিক্ষুদ্ধ রাফায়াতের দিকে একনিষ্ঠ মনোযোগ তার। এই মুহূর্তে পৃথিবী ধ্বসে গেলেও বোধ হয় তার মনোযোগ একচুল এদিক থেকে ওদিক হবেনা! আচমকাই এভাবে অপরিচিত একটা লোককে এতটা পরিচিত বলে মনে হবে তা যেন অয়ন্তী তার দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এক অদ্ভুত মনঃসংযোগ অনুভব করছে অয়ন্তীর ভেতর। মনে হচ্ছে যেন একটা সময় এই মানুষটাকে ছাড়া তার চলত না!
রাফায়াতের অগ্নিঝড়া চাহনি রীতিমত বেদনায় পরিণত হলো। অন্তঃকরণে জমে থাকা ব্যথারা, আঘাতেরা, অপ্রকাশিতব্য যন্ত্রনারা নির্দ্বিধায় মুখশ্রীতে বিচরণ করতে লাগল। অয়ন্তীর চোখে যখন টলমল জল তখন-ই রাফায়াতের অবাধ প্রস্থান! বুকে ভারী এক পাথর চেপে যেন রাফায়াত সাইক্লোনের বেগে অয়ন্তীর সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। ঘর পরিত্যাগ করে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। অয়ন্তী একই জায়গায় থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। রাফায়াতের হঠাৎ প্রস্থান তাকে একচুলও ভাবালো না! কল্পনা তাকে তার বাস্তব থেকে টলাতে পারল না। কেবল নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল,,
“কে সে? কী তার পরিচয়? সে কি আমার পূর্ব পরিচিত? একটা সময় কী তাকে ছাড়া আমার চলত-ই না?
পেছন থেকে তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে থাকা আলিজা পিলপিলিয়ে হেঁটে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। দু’হাত দ্বারা স্তব্ধ অয়ন্তীকে ঈষৎ ঝাঁকিয়ে বলল,,
“কী রে অয়ন্তী? রাফায়াত ভাইকে তুই চিনতিস নাকি আগে থেকে? কীসব বলে গেল রাফায়াত ভাই? তাছাড়া অনিক ভাইকেও কি রাফায়াত ভাই আগে থেকে চিনে?”
তব্ধতা কাটিয়ে উঠল অয়ন্তী। আকস্মিক দৃষ্টি ফেলল প্রশ্নবিদ্ধ আলিজার দিকে। তৎক্ষণাৎ পেছনের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলো অয়ন্তী। চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে দু’কানে হাত চেপে বলল,,
“আমি চিনিনা কাউকে। জানিনা তোর রাফায়াত ভাই এসব কী বলছে! আমার মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরছে আলিজা। আই নিড টু রেস্ট।”
অয়ন্তীর মানসিক অবস্থা বিপর্যের পথে। তা আলিজা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে! অনিক অয়ন্তীর গাঁয়ে হাত তুলেছিল তাও আলিজা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে৷ অনিক মাঝেমধ্যেই অয়ন্তীর গাঁয়ে হাত তুলে। তা আলিজার অজানা কিছু নয়! অয়ন্তীকে শান্ত করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলিজা। ধীর পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রাফায়াতের নাম্বারে অনেকবার ট্রাই করার পরেও রাফায়াতের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারল না সে। এতো রাতে আলিজাকে একা ছাড়তেও সাহস পাচ্ছিলেন না অয়ন্তীর মা। তাই তিনি আলিজাকে তাদের প্রাইভেট কারে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
,
,
মধ্যরাত তখন তিনটা প্রায়। বেঘোরে ঘুমের মধ্যেই অয়ন্তী হঠাৎ অনুভব করল কেউ তার চোখে-মুখে বেসামালভাবে আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছে! শিরশিরিয়ে উঠছে তার সমস্ত শরীর! উন্মাদনা কাজ করছে প্রতিটা অঙ্গে-প্রতঙ্গে। উত্তেজিত হয়ে উঠছে দেহ। দম আটকে আসার মত অনুভূতি তার। আচমকাই আঁতকে উঠল অয়ন্তী। লাফ দিয়ে উঠল ঘুম থেকে। চোখ বুজেই চিৎকার করে বলল,,
“রাদিফ ভাভাভাভাই!”
অবিলম্বেই ঘুমন্ত চোখজোড়া খুলে নিলো অয়ন্তী। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে বিকট চাহনিতে তার আশেপাশে চোখ বুলালো। তবে কাউকে কোথাও দেখতে পেলনা! কোথাও কেউ নেই। ড্রিমলাইটের আলোতে সমস্ত ঘর আলোময়। এই আলোতে কাউকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। হয়রান হয়ে উঠল অয়ন্তী। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে লাগল। অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল। শীঘ্রই বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো সে। ডেস্কের উপরে রাখা গ্লাস ভর্তি পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে সামনের চুলগুলো টেনে ধরে বলল,,
“তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম?”
নিজেকে স্থির করে তোলার প্রয়াসে লিপ্ত হলো অয়ন্তী। শেষবারের মত একদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে তুলল। মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ধীর পায়ে হেঁটে আলমারির কাছে গেল। আলমারির দরজা খুলে ড্রয়ার থেকে একটি আধপুরোনো ডায়েরী বের করল! নীল মলাটে মোড়ানো সেই ডায়েরীটি যদিও খুব দামী ডায়েরীর পর্যায়ে পড়েনা, তবে অতি সাধারণ একটি ডায়েরী হিসেবে এই ডায়েরীটিই তার খুব প্রিয়। সাধারণ যেকোনো জিনিসই যদি অসাধারণ মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া যায় তবে সেই সাধারণ জিনিসটিই অতি অসাধারণ হয়ে ওঠে। এরমধ্যে নতুন বিশেষত্ব যোগ হয়। তেমনি এই ডায়েরীটিও তার অন্যথায় নয়!
হাঁটতে হাঁটতে ডায়েরীটি নিয়ে অয়ন্তী বিছানার উপর এসে বসল। ভারী নীল মলাটটিতে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। অমনি তার বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল! দীর্ঘ দু’বছর পর ডায়েরীটিতে হাত পড়ল তার। ফেলে আসা সেই দু’বছর আগের আবেগ, অনুভূতি, পাওয়া, না পাওয়ার যন্ত্রণা গুলো অচিরেই ধরা দিলো তার মনে। সেইসব অনুভূতি আঁকড়ে ধরে অয়ন্তী মলাট উল্টে ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় গেল। সঙ্গে সঙ্গেই একটি রঙিন ছবি তার চোখের আলিজে ঠায় পেল! এবার আর নিজের দমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলোকে সন্তপর্ণে ধরে রাখতে পারলনা অয়ন্তী। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল! ছবি টিকে তার বুকের মাঝে চেপে ধরল। দুঃসহ বেদনায় আর্ত গলায় বলল,,
“কেন আমার অনুভূতিগুলোকে আপনি বুঝতে পারলেন না রাদিফ ভাই? কেন আপনি প্রিয়াকে ভালোবাসলেন? আমাকে কেন নয়? কেন আমাকে এতটা কষ্ট দিলেন বলুন? কেন সবসময় আমাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝাতেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন? যখন আমি আপনাকে আমার মনের কথা বলতে গেলাম, তখনই কেন বললেন আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? বলুন কেন? জানিনা দু’বছর পর আজ কেন হঠাৎ আপনার কথা খু্ব মনে পড়ছে আমার! আপনার প্রতিচ্ছবিই যেন আজ অন্য একজন মানুষের মাঝে আমি আবিষ্কার করলাম!”
,
,
ব্রীজের উপর মাথা নুইয়ে বসে আছে রাফায়াত। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বার থেকে মাত্রই ড্রিংকস করে ফিরেছে সে! শরীরের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। কিয়ৎক্ষণ পর পর বেসামালভাবে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। যেকোনো সময় সে ব্রীজ থেকে পড়ে অঘটন ঘটাতে পারে! জীবনের এত বড়ো ঝুঁকি নিয়েও তার মুখে শুধু একটাই অস্ফুটে বুলি,,
“কেন আমাকে ঠকালি অনিক? বল কেন?”
নে’শা’খো’রদের মত অবস্থা তার। বিবর্ণ মুখমণ্ডলে চোখদুটো হায়েনাদের মত জ্বলছে। শত্রুকে সামনে পেলে খাবলে খুবলে খাবে দেখে এতটাই হিংস্র মনে হচ্ছে! বারংবার সিগারেটটিতে ফুঁক দিচ্ছে সে। মিনমিনে গলায় বলছে,,
“আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি অয়ন্তী! বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। আমি অনিককে বিশ্বাস করেছিলাম। অন্ধের মত বিশ্বাস করেছিলাম। যার ফলস্বরূপ আমাদের দুজনকেই এত বাজেভাবে ঠকে যেতে হলো।”
ইতোমধ্যেই পেছন থেকে দৌঁড়ে এলো আরিফ। রাফায়াতকে শক্ত হাতে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরল। উত্তেজিত গলায় বলল,,
“আরে ভাই করছেনটা কী আপনি? পড়ে যাবেন তো। ওঠে আসুন এখান থেকে।”
রাফায়াত মা’তাল’লদের মত আলুথালু গলায় কিছু বলার পূর্বেই আরিফের হাতে থাকা রাফায়াতের সেলফোনটি পুনরায় বেজে উঠল! ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে আরিফ মৃদু আওয়াজ করে রাফায়াতকে বলল,,
“ভাই? আপনার আব্বা অনেকক্ষণ যাবত কল করছে। আপনার সাথে নাকি কী ইমার্জেন্সি কথা আছে।”
চোখ মেলে তাকালো রাফায়াত। কম্পিত দৃষ্টিতে অস্থির আরিফের দিকে তাকালো। সিগারেটটিতে শেষবারের মত ফুঁক দিয়ে টিমটিমে স্বরে বলল,,
“ফোনটা স্পিকারে রাখ।”
রাফায়াতের কথা মত আরিফ ফোনটা স্পিকারে রাখল। অমনি ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে আফজাল শেখ বিস্ফোরিত গলায় বললেন,,
“এই কোথায় তুই? ফোনে তোকে কানেক্ট করা যাচ্ছিলনা কেন? কেন বউমার খালা-খালুরা তোর প্রতি এত বিরক্ত হ্যাঁ? ওখানে গিয়েও তুই আমাদের শান্তি দিবিনা বল? সারাটা জীবন তো জ্বালিয়ে এলি আমাকে। তোর মা-কে, ভাইকে, ভাবিকেও। আর কী জ্বালানোর বাকি আছে? লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি তোর পেছনে! এখনো অবধি করে আসছি। তুই কী জীবনেও মানুষ হবিনা? আর তুই জানিস না? প্রিয়া সু’ই’সা’ই’ড করতে গিয়েছিল কয়েকবার? প্রিয়ার সাথে কথা বলছিস না কেন?”
“শুনো বাবা। প্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো কথা থাকলে বলো।”
“কেন? প্রিয়া সম্পর্কে কেন কোনো কথা বলবনা? বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তোর প্রিয়ার সাথে। ভুলে গেছিস তুই?”
“আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে পারব না বাবা! প্রিয়া সম্পর্কে তুমি কিছুই জানোনা। আর এই মুহূর্তে আমি তোমাকে কিছু জানাতেও চাইনা। মোট কথা আমি প্রিয়াকে বিয়ে করতে চাইনা। ফোনটা রাখো তুমি প্লিজ। এই বিষয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছেনা!”
আরিফের থেকে ছোঁ মেরে ফোনটি কেড়ে নিলো রাফায়াত। ঠাস করে কলটি কেটে দিলো। ফোনের পাওয়ার অফ করে আরিফের হাতে ফোনটি ধরিয়ে দিলো। আরিফের থেকে মুখ ফিরিয়ে আক্রোশিত গলায় বলল,,
“অয়ন্তীর সাথে আমাকে একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবি?”
“কী বলেন ভাই? এত রাতে?”
“পারবি কিনা বল?”
“ট্রাই করে দেখতে পারি।”
“ট্রাই না। আমি এক্ষণি, এই মুহূর্তে প্রিয়াকে দেখতে চাই। ম’রে যাওয়ার মত ফিলিংস হচ্ছে আমার। তাকে দেখে যেন এতদিনের জমানো শরীরের ব্যথাগুলো অনুভব হচ্ছে! তার যত্ন পেতে চাইছে।”
বিগলিত হয়ে উঠল আরিফের মন! কথা না বাড়িয়ে সে নে’শা’গ্রস্থ রাফায়াতকে টেনেটুনে ব্রীজের উপর থেকে উঠালো। রাস্তার পাড় ধরে যেইনা সামনে অগ্রসর হতে গেল অমনি দুজন কনস্টেবলের সম্মুখস্থ হয়ে গেল দুজন!
#চলবে….?
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
বিগলিত হয়ে উঠল আরিফের মন! কথা না বাড়িয়ে সে নে’শা’গ্রস্থ রাফায়াতকে টেনেটুনে ব্রীজের উপর থেকে নিচে নামালো। রাস্তার পাড় ধরে তারা যেইনা সামনে অগ্রসর হতে গেল অমনি দুজন কনস্টেবলের সম্মুখস্থ হয়ে গেল!
থতমত খেয়ে গেল আরিফ! মুখমণ্ডলে তার অভেদ্য হকচকানো ভাব। সে নিজেই একজন ক্রিমিনাল, পাশে অন্য একজন কুখ্যাত ক্রিমিনাল দাঁড়িয়ে! এই দুঃষ্কর পরিস্থিতি সে কীভাবে একা সামাল দিবে তা ভেবেই তার প্যান্ট ভিজে যাচ্ছিল! গাঁ বেয়ে দড়দড়িয়ে ঘাম ঝড়ছিল। মনে মনে জপ করছিল,,
“ইয়া আল্লাহ্! আজ শেষবারের মত আমাকে এই পুলিশের ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি এবার থেকে আমি আর খারাপ কাজ করবনা! শুধু আমাকেই না আল্লাহ্। রাফায়াত ভাইকেও তুমি আজকের মত বাঁচিয়ে দাও! রাফায়াত ভাই মানুষটা কিন্তু খারাপ নন। মন থেকে ভীষণ ভালো। তবে তিনি এখন পরিস্থিতির শিকার। যে করে-ই হোক রাফায়াত ভাইকে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে আমাকে সাহায্য করো।”
নেশার ঘোরে বুদ রাফায়াত। তাই তার সামনের- পেছনের-আগের-পরের কোনো পরিস্থিতির দিকেই তেমন কোনো মনোযোগ নেই তার। কনস্টেবল দুজন তাদের হাতে থাকা শক্ত লাঠিটি ঘুরাতে ঘুরাতে আরিফ এবং রাফায়াতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। ভাবখানি দেখে মনে হচ্ছে যেন জেল পলাতক দুজন আসামীকে খুঁজে পেয়েছে তারা! দৃষ্টি তাদের শকুনের! তৎক্ষণাৎ আরিফ হুডির টুপিটা টেনেটুনে রাফায়াতের মুখটা নয়া বৌদের মত ঢেকে দিলো! বিরক্তি প্রকাশ করল রাফায়াত। মুখে বিব্রতকর আওয়াজ তুলে বলল,,
“আরে বেটা। মুখটা ঢেকে দিলি কেন? নেশা এখন ঘাম হয়ে ঝড়ছে আমার শরীর থেকে! ইন দিস টাইম আই নিড টু লট অফ রিফ্রেশ এয়ার! তাছাড়া এই রাতের বেলায় আমাকে কে দেখতে আসবে হ্যাঁ?”
আরিফ দাঁতে দাঁত চাপল। রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। রাফায়াতের মুখের কাছে কান ঠেকিয়ে বলল,,
“আরেহ্ ভাই, চুপ থাকুন। সামনে আমাদের ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুর মানে বুঝছেন তো?”
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রাফায়াত! বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা আরিফ কোন ঠাকুরকে বুঝাতে চাইছে! শীঘ্রই নেশার ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো রাফায়াত। ফিসফিসিয়ে আরিফকে বলল,,
“টাকা ছাড়। এট অ্যানি কস্ট এখান থেকে আমাকে বের কর।”
কনস্টেবল দুজন ভ্রু কুচকালো। সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আরিফ এবং রাফায়াতের দিকে৷ সামনে থাকা কনস্টেবলটি রাগী গলায় আরিফের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই তোরা দুজন মিলে কী ফুসুর ফুসুর করছিস হ্যাঁ? তাছাড়া এতরাতে তোরা ব্রীজের মাথায় কী করছিস? কোনো ক্রাইম ট্রাইম করে আসিসনি তো?”
“আরেহ্ না ভাই৷ আপনি আমাকে চিনেন না? ক্রাইম করা আমার পেশা নাকি? এইযে আমার পাশে যে ছেলেটাকে দেখছেন? সে হলো আমাদের চেয়ারম্যান্যানের ডান হাত! অনেক দূর থেকে এসেছে তো? তো চাচা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন ছেলেটাকে ভালো করে খাতির যত্ন করতে। নেশা ছাড়া এর আবার চলেনা। তাই খাতির যত্ন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এতরাত হয়ে গেল!”
“এত কথা বুঝিনা আমি। চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলব ফোনটা লাগিয়ে দে!”
“কত টাকা লাগবে ভাই সেটা বলুন? খামোখা চেয়ারম্যানকে দিয়ে কী করবেন? এই মাঝরাতে গেঞ্জাম ভালো লাগছেনা।”
“বুঝেছিস যেহেতু আই হোপ বলতে হবেনা টাকার পরিমাণটা!”
পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে আরিফ মুঠ করে কনস্টেবলের হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিলো! বিরক্তিভরা গলায় দুই কনস্টেবলকে বলল,,
“ভাই আর কিছু চাইয়েন না। পকেটে আর একটাও কানাকড়ি নাই। আল্লাহ্’র ওয়াস্তে আজ মাফ করেন।”
এক হাজার টাকা পেয়েই কনস্টেবল দুজন বেশ খুশি হয়ে গেল! না চাইতেও মাঝরাতে এমন দু’একজন মক্কেল পেলে মাঝরাতের খুশিটা যেন তাদের দ্বিগুন বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষদের র’ক্ত চুষে খেতে তারা আনন্দ পায়। রাফায়াতকে নিয়ে আরিফ হনহনিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। দুজনই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। এবার উদ্দেশ্য তাদের অয়ন্তীদের বাড়ি। যদিও আরিফ বুঝতে পারছেনা অয়ন্তীর সাথে রাফায়াতের দেখা করাবে কীভাবে। তবে কোনো একটা মাধ্যম তো খুঁজে বের করতেই হবে।
,
,
অয়ন্তীদের বাড়ির বিশাল গেটের সামনে পায়চারী করছে রাফায়াত এবং আরিফ। বাড়ির ভেতর কীভাবে ঢুকবে বা অয়ন্তীকে কীভাবে ডাকবে সেই চিন্তায় দুজনই প্রায় অস্থির। তবে এরমধ্যে রাফায়াতের পাগলামী যেন দ্বিগুন হারে বাড়ছে! আবারও নেশাখোরদের মত আচরণ করছে সে। কেমন যেন হেলেদুলে পড়ছে। অস্থিরতায় আকুলিবিকুলি করছে। আরিফকে বার বার করে বলছে,,
“অয়ন্তীকে আমার এই মুহূর্তে চাই-ই চাই। একবার হলেও শুধু চোখের দেখা দেখতে চাই৷ বিশ্বাস কর নিঃশ্বাসটা আমার থমকে আসছে। অনুভূতিরা বারংবার আঘাত করছে। শরীরের ব্যথা সহ্য করতে পারলেও মনের ব্যথাটা আজ সহ্য করতে পারছিনা! মনের কী কোনে জাত ধর্ম নাই?”
রাস্তাঘাট এখন জনমানব শূণ্য। প্রকৃতি যেন আজ থমকে আছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, নির্বিকার। ঘুমের নেশায় বুদ সবাই। যাদের রাত জাগার স্বভাব তারাও হয়ত এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। চাঁদের আলো মাথার উপর মিটিমিটি করে জ্বলছে। হাওয়া বাতাস সব প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মধ্যরাত তখন তিনটা চলমান। এই অবস্থায় আরিফ কীভাবে কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না! রাফায়াতের আহাজারি যেন কোনোক্রমে হ্রাসই পাচ্ছেনা! অয়ন্তীর রুমের লাইট জ্বলছে কেবল! রাদিফ নামক ছেলেটির ছবি আঁকড়ে ধরে সে বিছানার উপর উবুড় হয়ে শুয়ে অবলীলায় চোখের জল ছাড়ছে!
ইতোমধ্যেই কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো! হকচকিয়ে উঠল অয়ন্তী। তাৎক্ষণিক শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়ালো। বাম পাশের জানালার দিকে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দেখল জানালার কাঁচ ভেঙে তার পায়ের কাছ অবধি ছিটকে পড়েছে! স্যাতঁস্যাতে একটি পাথর পড়ে আছে পাশে। জানালা ভাঙার কাজে কেউ এই পাথরটি কাজে লাগিয়েছে। আঁতকে উঠল অয়ন্তী! বুকে হাত রেখে শুকনো ঢোঁক গিলল। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে উঁকি দিলো ভাঙা জানালা বরাবর। অমনি বাড়ির রাস্তায় নজর পড়ল তার। সোডিয়ামের টিমটিমে আলোতে সে অস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রাফায়াতকে অস্বচ্ছ ভাবে আবিষ্কার করল! চক্ষুজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল তার। ভুল দেখছে কিনা তা যাচাই করতে পুনরায় চোখ দুটো কচলালো৷ তবে পাল্টালো না কিছু। সত্যি সত্যিই আরিফের পাশে সে রাফায়াতকে দেখছে! রাফায়াত তার দূরদৃষ্টিতে অস্পষ্টভাবে অয়ন্তীকে দেখামাত্রই হাত নাচালো! হাত দুটো নাড়িয়ে অয়ন্তীকে ডেকে ইশারায় বলল,,
“নিচে নেমে এসো!”
অয়ন্তী এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা সত্যি সত্যিই এই ঘটনাগুলো তার সাথে ঘটছে। রাফায়াতের সাথে আরিফকে দেখে তো তার সব চিন্তাভাবনাই উল্টে যাচ্ছে! এই মাঝরাতে তারা দুজন তার আবার ক্ষতি করতে এলো না তো? দুজনই তো তার শত্রু! কাকে বিশ্বাস করবে সে? রাফায়াতের কথায় পাত্তা দিলোনা অয়ন্তী। দৌঁড়ে রুমের লাইট নিভিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল! অয়ন্তীর এহেন কর্মকাণ্ড দেখে রাফায়াত খুব বেশী বিরক্ত না হলেও আরিফ বড্ড বিরক্ত হলো! রাস্তার মাঝখানে আসাম পেতে বসল সে! গালে হাত ঠেকিয়ে দুঃখি দুঃখি গলায় বলল,,
“কী নাটক রে ভাই! মেয়েদের সাথে সাথে ছেলেরাও দেখি এখন নাটক করা শিখে গেছে!”
রাফায়াত তার জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না! কোথাও না কোথাও তার বিশ্বাস ছিল অয়ন্তী আসবে! তার ডাকে অয়ন্তী না এসে পারবেনা! স্থির এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে রাফায়াত অয়ন্তীর রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। অয়ন্তী কাঁথার তলায় মুখ ডুবিয়ে রাখলেও তার ধ্যান জ্ঞান সব জানালার দিকে! খানিক ক্ষণ বাদে বাদে সে উঁকি দিয়ে জানালার দিকে তাকাচ্ছে। বার বার রাফায়াতকে সেই একই জায়গায় আবিষ্কার করছে! মনটা কেমন যেন উসখুস করছে তার! ঘরে থাকতে চাইছে না। বাইরে রাফায়াতের কাছে যেতে চাইছে এই বেহায়া মন। চতুর্থবারের বেলায় সে হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠল। লক্ষ্যে অটুট থেকে বলল,,
“যাই! একবার গিয়ে শুনে আসি ল’ম্প’টটা কী বলতে চাইছে! আমার এলাকায় এসে নিশ্চয়ই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। ঠেং ভেঙে রেখে দিব ঠিক। তবে সেইফটির জন্য সাথে একটা ছু’রি নিলে মন্দ হয়না!”
দাঁত বের করে হেসে অয়ন্তী জামার পেছনে ফল কাটার একটি ছু”রি গুজে নিলো। রুমের লাইট অন না করেই গলায় ওড়না ঝুলিয়ে যেইনা অগ্রে কদম বাড়াতে গেল অমনি তার পায়ে কাঁচ ফুটে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই অয়ন্তী ঠোঁট কামড়ে আর্তনাদ করে উঠল। চোখ বুজে পেছন থেকে পা টা একটু উঁচু করে ধরল। কাঁচের অংশটা পা থেকে টান দিয়ে বের করল। রুদ্ধশ্বাস ফেলে চোখের জল ছেড়ে দিলো! রক্ত পড়ে জায়গাটা ভেসে যাচ্ছিল প্রায়। নেহাতই অয়ন্তীর সহ্য ক্ষমতা অনেক। তাই সে এই কাঁচ ঢোকার ব্যথাটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো। কাঁটা পা ও যেন তার যাত্রাপথে বাঁধা দিতে পারলনা! অদৃশ্য এক টানে সে রক্তাক্ত এবং আ’হত অবস্থাতেই রাফায়াতের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল!
সমস্ত আশা খুুঁইয়ে রাফায়াত যখন অয়ন্তীর আসার হাল ছেড়ে দিলো তখনই রাফায়াতের সামনে অয়ন্তীর আকস্মিক আগমন ঘটল! তাজ্জব বনে গেল রাফায়াত! ঘোলা ঘোলা দৃষ্টি পড়ল তার অয়ন্তীর ব্যথা জড়ানো কান্নারত মুখের দিকে। ধক করে উঠল রাফায়াতের বুকটা তখন। দুকদম বাড়িয়ে সে অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। অস্থির গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই? কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন তুমি?”
দম নেওয়ার সময়টাও পেলনা রাফায়াত। ঠাস করে কঠিন এক চড় পড়ল তার গালে! রণরঙ্গিণী রূপ নিয়ে অয়ন্তী পা কাটার সব রাগ রাফায়াতের উপর ঝাড়ল। ঝাঁজালো গলায় বলল,,
“আপনার সাহস হয় কী করে হুম? আমার রুমের জানালার কাঁচ ভাঙার?”
চড় খেয়েও রাফায়াত মৃদু হাসল! অয়ন্তীর গরম দৃষ্টিতে প্রেমময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ফিচেল স্বরে কেমন যেন আবদার করে বলল,,
“লাগে নাই। আরেকটা দাও!”
অবিলম্বেই আরিফের মুখে হাত চলে গেল! বেচারা বসা থেকে চ্যালচ্যালিয়ে ওঠে দাঁড়ালো। হঠকারিতায় বিড়বিড় করে বলল,,
“আইলা! এ তো দেখছি মজনু সুপার প্রো ম্যাক্স!”
রাগটা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল অয়ন্তীর। রাফায়াতের অনুমতি পেয়ে সে ইচ্ছেমত রাফায়াতকে চড় মারতে লাগল! কোনোভাবেই থামতে চাইল না। চোখ-মুখ লাল করে চোখের জল ছেড়ে বলল,,
“তোর জন্য আমার পা কাটছে বুঝছিস? এক ব্যাগ র’ক্ত বের হইছে! হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। ব্যথায় রুহটা বের হয়ে যাচ্ছে।”
ব্যাকুল হয়ে উঠল রাফায়াত। অয়ন্তীর পা কেটে গেছে শুনতেই তার বুকের ব্যথাটা আরও গাঢ় হতে লাগল। খপ করে সে অয়ন্তীর হাতটা চেপে ধরল। দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলল অপার উদ্বিগ্নতার ছাপ। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,
“কোথায় কেটেছে পা? দেখাও।”
হেচকি তুলে কেঁদে অয়ন্তী তার কাটা পা টা উপরে তুলল। পেছনের দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে কান্নাজড়িত গলায় বলল,,
“এইযে এখানে।”
ব্যস্ত হয়ে উঠল রাফায়াত। ছুটে এসে অয়ন্তীর পায়ের কাছে বসল। কা’টা জায়গাটায় উষ্ণ হাত ছুঁয়ালো। আহত গলায় বলল,,
“এই ব্যথাটা তো রাদিফের দেওয়া কষ্টের চেয়ে বেশী কিছুনা তাইনা?”
#চলবে…?