#এক_চিলতে_রোদ-২,২৩.(১ম অংশ),২৩.(২য় অংশ)
#Writer_Nondini_Nila
২৩.(১ম অংশ)
ছোটখাটো একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। আমার পাশের লিনা। আর আমাদের সামনে ব্রেঞ্চে ইহান ও আবীর ভাইয়া দুজনে বসে আছে। আর খুব আড্ডা দিচ্ছে। কতো শত কথা যে বলছে আল্লাহ। ইহান আবীর ভাইয়ার ছোট এক ইয়ারের ছোট দেখে মনে হচ্ছে না। দুজনে কিছুক্ষণের মধ্যে শত জনমের বন্ধুদের মতো বিহেভ করছে। কথার ফাঁকে এক দুই পলক আমার দিকে তাকিয়েছে ইহান। আমি চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি তীক্ষ্ণ চোখে। লিনা কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,
‘ তুই ভাইয়াকে জানিয়ে এসেছিস তাইনা। তোরা ফোনে ও কথা বলিস। এটাও বললি না এতো নাটক করতে পারিস।’
আমি কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে ঠাস করে গাল থাপ্পড় মেরে দিলাম। লিনা গালে হাত দিয়ে বোকা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বললাম,
‘ আর একটা কথা বললে মেরে তোর গাল লাল করে দিবো আমি।’
আর কথা বলার সাহস করে নি। আমার হাতে মার খেয়ে লিনা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। দোকানদার এটা দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলো। আমি অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসি। ইহান ও বাই বলে চলে গেছে। আমার সাথে কোন কথা হয়নি। লিনা আর আবীর ভাইয়ার সাথে কথা বলেছে অনেক। বাসায় আসার পর থেকে লক্ষ্য করলাম লিনা আমার সাথে কথা বলছে না। সেই সময়কার ব্যবহারে মন খারাপ করেছে বুঝতে অসুবিধা হলো না। ইহান আর আমার পরিচয় থেকে সব কিছু ওকে খোলে বললাম। সব শুনে ও রাগ ভুলে গেলো। আর আমাকে সরি বললো। ভুল বুঝার জন্য। তাছাড়া আরো কথা বলেছে ইহান কে আমি পছন্দ করি কিনা! ও করে কিনা! আমি সব কিছু তে না করে দিয়েছে।
তিনজন রাত জেগে ভূতের মুভি দেখার প্ল্যান করল আবীর ভাইয়া। আমি সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলাম। দিনের বেলায় হরর মুভির দেখতে পারি না। আবার রাতের বেলা অসম্ভব। আমার এই ভীতু মুখ দেখে দুজনে হাসাহাসি করলো। আমাকে বাদ দিয়ে নিজেরাই দেখবে বলল। আমি রুমে চলে এলাম।
পরদিন আবীর ভাইয়া চলে গেলো।
একদিন বিকেলে লিনাকে নিয়ে শপিং করতে চলে এলাম। আর দুইদিন পর লিনা চলে যাবে এজন্য আম্মু বলেছে ওকে নিয়ে শপিং করতে। লিনাকে ড্রেস কিনে দিতে। আম্মু আসতে চেয়েছিলো কিন্তু হঠাৎ জ্বর আসার আসতে পারলো না। আমাকে আর লিনা কেই যেতে বললো। আব্বু গাড়ি নিয়ে সিলেট গিয়েছে অফিসের দরকারে। তাই আমাকে আর লিনাকে রিকশা করেই যেতে হলো।
দুজনে গল্প করতে করতে শপিং মলে চলে এলাম। এখানে এসে তুষারের সাথে দেখা। হাসি মুখে তুষার এগিয়ে এসে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ তোমরা এখানে…?
খুশিতে লাফানোর মতো অবস্থা লিনার। ও চটপট উত্তর দিলো, ‘ আমরা তো এখানে শপিং করতে এলাম। তুমি এখানে কি করছো?’
তুষার বললো,’ আমার বাবার দোকান ওই যে ওইটা!’
‘ ওওওও’
আমার দিকে তাকিয়ে ও কেমন আছি জিজ্ঞেস করলো আছি হাসি ফুটিয়ে ভালো বললাম। আমি আগে আগে হাটছি আর তুষারের সাথে কথা বলতে বলতে লিনা হাঁটছে। আমি একবার ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে দোকানে ঢুকলাম তাও সেটা তুষারদের দোকান। ইচ্ছে করেই ঢুকেছি দেখতে চাই তুষার ভাইয়া গার্লফ্রেন্ডকে কিছু গিফট করে কিনা? আমি দোকানে ঢুকে শয়তানি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তখন আমার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে দৌড়ে এলো লিনা।
আর আমার হাত ধরে বললো,’ ঊষা বোন প্লিজ তুই একাই শপিং কর। আমাকে না তুষার ওর সাথে একটু বের হতে বলছে। কালদিন পর তো আমি চলে যাব। আবার কতোদিন দুজনের দেখা হবে না। একটু ওর সাথে সময় কাটাতে চাই।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘ মানে কি আমি কি নিজের জন্য এসেছি নাকি। তোর জন্য ই তো শপিং করবো তুই না থাকলে কিভাবে হবে?’
‘তুই তোর পছন্দমত শপিং কর। আমার তাতে হবে প্লিজ একটু ম্যানেজ করে নে না।’
এত কাকুতি-মিনতি করলে কি আর তাকে বাধা দেওয়া যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলাম। লিনা চলে গেলো খুশি হয়ে। যাওয়ার আগে বলে গেল এখানে অপেক্ষা করতে। এখান থেকে নাকি আবার একসাথে বাড়ি ফিরবে। আমি ঘুরে ঘুরে ওর জন্য দুই সেট ড্রেস নিলাম। আজই প্রথম একা শপিং করছি এর আগে কখনো একা শপিং করিনি আমি। অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু কিছু করার নাই।লিনা বেসলেট খুব পছন্দ করে একটা বেসলেট নিলাম। আর কানের দুল নিলাম। চারটায় বের হয়েছিলাম। এখন 5:15 বাজে। লিনা আসছে না। ওর জন্য অপেক্ষা করছি মলের বাইরে এসে। পৌনে ছয়টা বাজে। 6:25 এই আযান দেয় আসছে না কেন? এত সময় নিচ্ছে কেন? এদিক ওদিক তাকাচ্ছি শুধু আমি হাতে দুটো ব্যাগ ও একটা পার্স তাতে ফোন আছে। লিনার নাম্বারে কল করলাম ঢুকলো কিন্তু রিসিভ হলো না। দুইবার কল করলাম রিসিভ করলো না।
এবার আমার খুব রাগ হচ্ছে আমাকে অপেক্ষায় রেখে এমন লেট করছে কি করে! ফোন পার্সে রেখে ডান পাশে তাকাতেই কেঁপে উঠলাম একটা ছেলে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। চাহনীটা মোটেও সুবিধা জনক না লোভনীয় তাকানো। আমি আচমকা ভয় পেয়ে গেলাম। আশেপাশের মানুষের সমাগম কম। কারণ রাস্তায় আমার মতো কেউ দাঁড়িয়ে নাই সবাই নিজেদের কাজে বিজি। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। লিনা ও আসছে না। আমি এখন ভাবছি না এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না। আমি বাসায় ফিরে যাই লিনাকে ওর বয়ফ্রেন্ড পৌঁছে দিবেনি। আমি ভয় পেয়ে যাওয়ার তাড়ায় পরলাম।
কিন্তু বিপদে সময় কি আর কোন রাস্তা খোলা রেখে আসে নাহ। তখন এক সাথে সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমার বেলায় ও তাই হলো। এতক্ষণ কত অটো- রিকশা গেল কিন্তু আমি তখন যাওয়ার ইচ্ছা ছিলাম না। কিন্তু এখন যখন আমি রিক্সা খুঁজছি তখন একটা রিক্সা ও পাচ্ছিনা খালি। আর যে একটা দুইটা আসছে সব ভর্তি। ছেলেটার লালসা ভরা দৃষ্টি দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম কি করব বুঝতে পারছি না। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছয়টা দশ বাজে। আজান পড়তে আর বেশী সময় নাই। এদিকে গাড়ি পাচ্ছি না। অন্ধকার হয়ে আসছে। কি করবো? কি করবো? ভাবতে ভাবতে দেখলাম ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে তার আগে ফোন করলো কাকে যেন আমি লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেলাম। আর সামনের দিকে হাঁটা ধরলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ছেলেটাকে আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পরছে না। ভাবতে ভাবতে আজ হেঁটে বাসায় ফিরবো এমন একটা ভাব নিয়ে হাঁটছি। ঘার ঘুরিয়ে দেখলাম ছেলেটা পেছন পেছন আসছে। আমার হাতটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ব্যাগ শক্ত করে ধরে ওরনা টানতে টানতে জোরে জোরে পা চালাচ্ছি।
বাইকের তীব্র হন বাজতেই থমকে দাঁড়ালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আরো দুটো ছেলে বাইক করে এসেছে। আগের ওই ছেলেটার পাশে থেমেছে।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না ছেলে গুলো ওই ছেলেটার পরিচিত। তারমানে আগের ছেলেটার মতোই খারাপ হবে। আমাকে ধরা তো সেকেন্ড এর ব্যাপার তাদের কাছে। আমি আরো ভয় পেয়ে দৌড়ে দিলাম। এবার আমি আলো ছেড়ে অন্ধকার এ এসে ঠেকলাম। এদিকটায় ল্যাম্পপোস্টের আলো নাই। আর দোকান পাট ও নাই। আমি ভয়ে এবার আরো জরোসরো হয়ে গেলাম পেছনে থেকে বাইকের আওয়াজ আসছে আমি দৌড়ে হঠাৎ ধপ করে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পারলাম।
থুতনিতে খুব জোর ব্যথা পেলাম। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ব্যাথায়’ আহ ‘করে উঠলাম আমি। আমাকে পরতে দেখে ছেলে গুলো কিছুটাই পিছে বাইক থামিয়ে তিনজন নেমে পড়েছে। আর বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে হাসতে বাজে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। অনেক কষ্টে উঠে বসলাম পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা পেয়েছি। দাঁড়াতে পারছি না হাটুতে ও ব্যথা পেয়েছি। এ কোন বিপদে পরলাম আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে এই জানোয়ারদের হাত থেকে। তিনজনই আমাকে ঘিরে ধরল। ভয়ে আতকে উঠলাম। হঠাৎ আমার চোখে মেলার সেই দিনের কথা মনে পড়ল। সেদিনও এইরকমই কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরেছিল। ঝাপিয়ে পড়তে চেয়েছিল আমার উপর কিন্তু সেদিন ইহান আমাকে বাঁচিয়ে ছিলো। অবচেতন মন আজকেও ইহানের আগমন চাইছে। সেদিনের মত আজকেও যদি তার দেখা মিলতো।এই নরপশুদের থেকে আমাকে বাঁচিয়ে নিতো। আর তার সাথে আমি ঝগড়া করতাম না। আবুল তাবুল অনেক কথা ভাবছি। ভয়ে চোখ উপচে অশ্রু গড়িয়ে গাল ভিজে যাচ্ছে আমার। এমন বিপদ থেকে কিভাবে বাঁচবো আমি। আল্লাহ আমাকে রক্ষা করো।
ছেলেগুলোর কথা শুনে বুঝতে পেলাম সেই দিনের মেলা লোক গুলো এরাই ছিলো। এজন্যই তো প্রথমে একজনকে দেখে চেনা চেনা লেগেছে। কিন্তু মনে করতে পারিনি।
ছেলেগুলো একটা কথা কয়েকবার বললো খুব ক্রোধের সাথে,’ সেইদিন পালিয়ে গিয়েছিলি বয়ফ্রেন্ডের সাথে। পরে বয়ফ্রেন্ড দিয়ে মার খাওয়াইছিস। অনেকদিন ধরে তোকে খুঁজছিলাম আজ এভাবে পেয়ে যাব ভাবিনি। আজ সব সুদে আসলে বুঝে নিবো। কিছু না করেই মার খেয়েছি। আজ তার সুদ তুলবোই এই রিমন তোল শালীকে।’
আমি তাদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ হাতের মধ্যে পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেয়ে ভয়ে আতকে উঠলাম। ছেলেটা আমাকে টেনে দাঁড় করালো সাথে সাথে একটা সিএনজি এসে থামলো। আর আমাকে টানতে টানতে জোর করে সিএনজি তে তুললো। আমি চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলছি কাদতে কাদতে অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাম কিন্তু তারা আমার কথা শুনলো না মুখ বেঁধে দিতে লাগলো। আমি হাত নারিয়ে লাফালাফি করছি চিমটি দিচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছেনা দুই হাত ও বেধে ফেলল। তারপর টেনে হেঁচড়ে সিএনজি তে তুলে দুপাশে দুজন বসলো। আর একজন বাইরে বাইক চালিয়ে আসতে লাগলো। আমার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পড়ছে। হাত-পা সমানে ছড়াছড়ি করছি। আমাকে এমন করতে দেখে গালি দিয়ে ঠাস করে গালে থাপ্পড় মেরে বসলো। এত জোরে থাপ্পড় টা মেরেছে যে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। শব্দ হচ্ছে না। মুখ বেধে রাখার জন্য।
সিএনজি থামল একটা নিস্তব্ধ নিরিবিলি জায়গায়। আমাকে টেনে হেঁচড়ে গাড়ি থেকে নামালো। তারপর টেনে অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। সারা শরীর আমার শিরশির করে উঠলো। চোখের সামনে নিজের সর্বনাশ দেখছি আমি। আজ আর কেউ আমাকে বাঁচাতে আসবে না। আজ এই জানোয়ার গুলো আমাকে খুবলে খাবে। তারপর কি হবে! আমি তো আর বাঁচতে পারবো না এই রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরা ছাড়া আমার কোন গতি নাই। আল্লাহর নাম নেওয়া ছাড়া কোন উপায় আমার কাছে নাই।
আবসা আলোতে দেখতে পাচ্ছি ছেলেগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার উপর ঝাপিয়ে পরবে তখন পেছনে থেকে হট্টগোল শোনা গেলো। আরো কিছু পায়ের আওয়াজ শুনে ছেলেগুলো থেমে গেলো। ভয় পেয়ে তিনজন পেছনে তাকানোর আগেই চারজন লোক তিনজনের উপর ঝাপিয়ে পরে। এলোপাথাড়িভাবে মারতে লাগে এখন শুধু আর্তনাদ কানে আসছে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে কি হচ্ছে এমন আর্তনাদের আওয়াজ আসছে কেন? তখন কারো স্পর্শ হাতে পাই। তিনি আমার হাতের বাঁধন ও মুখের বাঁধন খুলে দিলো। আর বললো,
‘ ঊষা আর ইউ ওকে?’ পরিচিত কন্ঠ শুনে আমার ভয়টা কেটে যায়। আমি লোকটার দিকে তাকালাম। মুখ স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে না! কিন্তু আমি বুঝতে পারছি এটা ইহান!!
আমি ভয়ার্ত গলায় তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘ ই–হা–ন?
ইহান ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে নিজের মুখের দিকে ধরতেই আমি ঝাপিয়ে পড়লাম ওর বুকে দুহাতে শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘ওরা আমাকে এখানে…..
ইহান আমাকে কথা বলতে দিলো না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,’ আমি আছি ভয় পেয়ো না তোমার কিছু হবে না।’
আমি আর কথা বললাম না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ইহান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শান্ত হতে বলছে। বললেই কি আর নিজেকে শান্ত করা যায়! ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে! দ্বিতীয়বারের মত ইহান আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করল। আমি ও তার আগমন চাইছিলাম। আল্লাহ এইভাবে আমার চাওয়া পূর্ণ করবে কল্পনা ও করতে পারিনি।
#চলবে…….
#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila
২৩.(২য় অংশ)
‘ নাও পানি খাও।’ আমার দিকে বোতল এগিয়ে দিলো ইহান। আমি মাথা নিচু করে থেকে থেকে কাঁপছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছি। ইহান আমাকে ধরে রাস্তায় ওনার বাইকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। শো শো করে গাড়ি যাচ্ছে তাতে আলো এসে আমাদের উপর পরলো। ইহান আমার দিকে বোতল এগিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা তুলে তাকালাম। আর বললাম,
‘ খাব না।’ বলেই চুপ করে গেলাম।
ইহান আর জোর করলো না। হাত গুটিয়ে নিলো। আমি দুহাতে নিজেকে ডাকার চেষ্টা করছি। ছেলেগুলোর টানা হেচড়াতে কোথায় যে ওরনা পরে গেছে জানা নাই। গাড়ির আলোতে নিজের গায়ে ওরনা নাই দেখে আঁতকে উঠছি। অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। ইহান তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। তাই উনার আমার অস্বস্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ইহান উনার গায়ের কালো জ্যাকেট আমার গায়ে জরিয়ে দেয়। আমি চমকে উঠি। উনি ঝটপট স্বরে বলে,
‘ রাত করে বাসার বাইরে কি করছিলে তুমি?’ গম্ভীর স্বরে বলে উঠে ইহান।
ইহানের কথা শুনে আমি জ্যাকেট গায়ে ভালো করে জড়াতে জড়াতে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ইহানের গম্ভীর চেহারাটা আবছা দেখা যাচ্ছে। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে বলি,
‘ লিনাকে নিয়ে শপিং করতে এসেছিলাম?’
‘লিনা? কোথায় লিনা?’
‘লিনা ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেড়াতে গেছে!’ মাথা নিচু করে বললাম।
‘হোয়াট! ও তোমাকে একা রেখে চলে গেল?’
‘ও পরশু চলে যাবে এজন্য অনেক রিকুয়েস্ট করল এজন্য আমি রাজি হয়ে গেছিলাম।ও আবার আসবে বলে অপেক্ষা করতে বলেছিলো। আমি শপিং শেষ করে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এলো ও এলো না তারপর অটো খুঁজলাম পেলাম না। তারপর এই ছেলেদের দেখলাম আর আমি ভয় পেয়ে কি করবো বুঝতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে বিপদ হাতের কাছে নিয়ে এলাম।তারপর ওই ছেলেগুলো…
‘ থাক আর বলতে হবে না। তোমার মতো গাধা আমি আর দেখছি বলে মনে হয়না। পাকনামি করে এগুতে কে বলেছিলো। সেদিন ও তুমি এই ভুলটাই করেছিলে আর আজ ও!
বলেই একটা লাথি মারলো বাইকে আমি কেঁপে উঠে পিছিয়ে গেলাম। আমি ভয়ার্ত চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছি। ইহান একটা লাথি মেরে ক্ষান্ত হলো না আরো কয়েকটা দিলো। তারপর চুল খামচে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি হাঁ করে তার রাগ দেখছি।
হঠাৎ ছুটে এসে আমার কাঁধ চেপে ধরল শক্ত করে। আমি ব্যথা পেলাম খানিকটা। আমার সারা শরীর ই এখন ব্যথা হয়ে আছে কারণ ছেলে গুলো আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলো। যার জন্য আমার শরীর ও ব্যথা সাথে মাটিও লেগে আছে।
ইহান রাগ মিশ্রিত গলায় বলল, ‘ আমি যদি সময় মতো না আসতাম কি হয়ে যেতো ভাবতে পারছো! এতোটা কেয়ারলেস কি করে হলে তুমি ডাফার!’
কান্না ভুলে আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি ইহানের দিকে। ইহান আমাকে ঝাঁকিয়ে ধমকাচ্ছে। এদিকে আমি ব্যাথা পাচ্ছি উনার এমন শক্ত করে আমার কাঁধ চেপে ধরায়। আমি মৃদু স্বরে বললাম,
‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি!’
আমার কথা ইহানের কানে যেতেই ফট করে ছেড়ে স্বরে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তখন তার বন্ধুদের কেউ হয়তো কল করে উনাকে উনি ফোন কানে নিয়ে শুধু একটা কথাই বলে, ‘ তোরা হসপিটালে রেখে চলে যা। হুম আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি যাব।’
ফোন কেটে পকেটে রেখে বাইকে উঠে বসলো। আমি ইহানের দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেলাম। ইহান একবার ও আমাকে বাইকে উঠতে বলে নি। আমি তার বলার অপেক্ষা না করেই পেছনে উঠে বসলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে ইহান। আমি সেসব এ তোয়াক্কা করলাম না। আমার এখন বাসায় যাওয়া দরকার।
আগে যতবার বাইকে উঠতে বলেছে আমি না করেছি কিন্তু আজ নিজে থেকে উঠলাম এটা দেখে ভারি অবাক হয়েছে ইহান যা তার মুখ স্পষ্ট ভাবে বলেই দিচ্ছে।
‘ কি হলো যাবেন না?’
আমার কথা শুনে ইহান বললো, ‘ তুমি বাইকে উঠলে কেন? তোমার না ভয় করে!’
‘ আজ করছে না। চলুন প্লিজ আমার ভালো লাগছে না।’
ইহান আর কথা বাড়ালো না। বাইক স্টার্ট দিলো। কাঁপা হাত বাড়িয়ে ইহানের কাঁধে রাখলাম। সারা রাস্তা আর কোন কথা হলো না আমাদের মধ্যে। নিরবতায় কেটে গেলো বাকি সময়টা। রাস্তায় আমার ব্যাগ পরে গেছে সাথে শপিং ও পার্স হারায় গেল। বাসায় যে কিভাবে ঢুকবো। আম্মু এসব জানতে পারলে কি যে হবে। গন্তব্যে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম যেন। বাইক থামতেই হালকা হেলে পরলাম আমি ইহানের উপর। বাসায় সামনে দেখেই তারাতাড়ি নেমে দাঁড়ালাম।
ভেতরে ঢুকার সহজ পাচ্ছিনা। আমার এই অবস্থা দেখে আম্মু সব বুঝে যাবে। আমি চিন্তিত মুখে গেটের দিকে তাকিয়ে আছি।
‘ কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে যাও!’
ইহানের কথায় আমি অসহায় মুখ করে উনার দিকে তাকালাম। আমার শুকনো ভয়ার্ত মুখ দেখে ইহান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ কি হলো মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ কি করে বাসার ভেতরে ঢুকে আমার ভয় করছে। আম্মু জিজ্ঞেস করলে কি বলবো? খুব বকবে আমাকে। এদিকে লিনা বাসায় ফিরেছে কিনা তাও জানি না। আমার ও এই অবস্থা সবকিছু নিয়ে আমার খুব ভয় করছে।’
‘তাহলে কি সারা রাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান করেছো নাকি?’
আমি ইহানের দিকে চোখ করে তাকিয়ে আছে কি বলব বুঝতে পারছি না। ইহান আমার অবস্থা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বাইক পার্ক করে নেমে দাঁড়ালাম। আমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছি। কি করতে চাইছে এইহান সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। ইহান আমাকে রেখেই গেটের দিকে এগিয়ে গেল। আমি হকচকিয়ে দৌড়ে তার পাশে গিয়ে বললাম,
‘একি আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘তোমার বাসায়! চলো আমার সাথে আমি আন্টির সাথে কথা বলে নেব!’
‘কিন্তু আপনি…
‘তুমি না বলেছিলে আন্টির সাথে সব শেয়ার করো।বিশেষ করে আগেরবারের কথাটাও তো বলেছিলে তাই না! আমার মনে হয় না আমি গেলে আন্টি আমাকে ভুল বুঝবে!’
ইহানের কথা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।এই কথাটা তো আমার মনেই ছিল না। ইহানের কথা তো আমি অনেক আগেই আম্মুকে বলেছি। আর আম্মু ইহানকে খুব পছন্দ করে।
আমি ইহানের পিছন পিছন ভেতরে চলে গেলাম। কলিংবেল চাপতেই লিনা এসে দরজা খুলে দিল। ভেতরে এসে দরজার কাছে লিনাকে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ভয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে আছে। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো।
ইহান আমার সাথেই ভেতরে এলো। আম্মুকে আসেপাশে দেখলাম না। আমি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ইহানকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। লিনা টেনে আমাকে নিয়ে এলো।
‘ তোর এতো দেরি হলো কেন? আসতে কোথায় ছিলি তুই?’
আমি ঠাস করে একটা চর দিলাম লিনাকে। চড় খেয়ে ও লিনার কিছু হলো না। আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল। এত রাত হলো কেন থাকে না কি হয়েছিল? কোথায় ছিলাম? নানান কথা।
‘তুই একটুখানি সময়ের কথা বলে হাওয়া হয়ে গেছিলি কোথায়?’
‘সরি রে ওর সাথে সময় কাটাতে গিয়ে আমি তোর কথা ভুলেই গেছিলাম। পরে যখন মনে পড়ল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। আমি ভাবছি তুই বাসায় চলে গেছিস।তাই তুষার আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। আমি ভয়ে ভয়ে বাসায় এসে ভাবছিলাম ফুপিকে কি মিথ্যে কথা বলব? তুই আগে চলে এসেছিস আমি পরে কেন এলাম! কিন্তু বাসায় এসে দেখি তুই আসিস নাই। ফুপি তোর কথা বলে আমার মাথা খেয়ে দিয়েছিল। আমি চিন্তায় পড়ে যাই রাত হয়ে গেছে তুই এখনো বাসায় আসিস না কোথায় গেলি। আমি ফুপিকে বলেছি মিথ্যা করে, যে তুই তোর ফ্রেন্ডের সাথে তার বাসায় গেছিস আমাকে চলে আসছে বলে তুই একটু পর আসবি। কোন বান্ধবী? কেন রাতে গেলি? নানা কথা বিশ্বাস করেছে কিনা তাও জানিনা কিন্তু আমাকে সন্দেহ করেছে আর বকেছেও একা যেতে দিছি আমাকে নিলি না কেন? আমি বলেছি আমি যাইনি একাই আপার জন্য জেদ করেছি। আমি তুষারকে কল করেছিলাম তোর খোঁজ করতে ও তোকে খুঁজছে। আল্লাহ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল রে। তুই সুস্থ ভাবে ফিরেছিস আমি বেঁচে গেছি না হলো আমি চিন্তায় ই মরে যেতাম। ভয়ে আমি হাঁসফাঁস করছিলাম।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আর কি হয়েছিল? রাগী গলায় সব কিছু বললাম। সব শুনে ও আরো ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো আমার কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা।
‘ না ইহানের জন্য বেঁচে গেছি। না হলে আজ আমার সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারত না।’
আম্মুর আওয়াজ আসতেই দুজনে চমকে উঠলাম। ইহানকে যে বাইরে বসিয়ে রেখেছি ভুলেই গেছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি গায়ের জ্যাকেট খুলে ওরনা একটা জরিয়ে বাইরে এলাম। ইহান কিছু বলার আগেই আম্মুকে লিনার বলা মিথ্যে কথাটা বলতে হবে। না হলে দুজনের কারো রক্ষে থাকবে না। যদি এতক্ষণে বললে দেয় তাহলে.
তাড়াতাড়ি নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বের হলাম। টানা হেচরায় আমার অবস্থা তো নাজেহাল হয়ে গেছিলো।
ড্রইং রুমে এসে আমার চোখ চড়কগাছ। আম্মু আর ইহান অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে কি যেন কথা বলছে। আমাকে দেখে দুজন কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমাকে দেখেই হুংকার দিয়ে উঠলাম আম্মু,
‘ এই তুই লিনাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে রাতের বেলা? কোন বান্ধবীর বাড়ি হ্যা বল?’
আমি ঢোক গিলে কিভাবে মিথ্যে কথাটা সাজিয়ে গুছিয়ে বলব তাই সাজাচ্ছি মনে মনে।এদিকে ইহানের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি সত্যি কথাটা বলার জন্য মুখ খুলবে। আমি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে আম্মুর দিকে তাকালাম। লিনা আমার পাশে দাড়িয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে অনবরত বলার জন্য।
ইহান এগিয়ে এসে বলতে যাবে আমি ছুটে এসে আম্মুর সামনে এসে দাড়িয়ে বলতে লাগলাম,
‘ আম্মুকে আই এ্যাম সরি। আসলে কি হয়েছে বলো তো। আমার সাথে শপিং মলে ইমা আপুর সাথে দেখা হয়েছিল। ইমা আপু কে বলতো ওই যে একদিন ওনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল আমি তার সাথে ছিলাম। আব্বু রক্ত দিয়েছিল। সেই আপুটার সাথে দেখা আর আপুটা আমাকে দেখেই ছুটে এসে বললো তার সাথে তার বাসায় যেতে। না নিয়ে নাকি এক পা ও নড়বে না। এতো বলায় আমি রাজি হলাম কিন্তু লিনা যাবে বলে দিলো ওর নাকি মাথা ব্যাথা তাই বলে চলে এলো একাই আমি নিষেধ করেছি শুনেনি। আর আমাকেও আপুর জোরাজুরিতে যেতে হলো। পরে রাত হওয়ায় ওযে ওনার ভাই। মানে ইহান ভাইয়াকে আমায় পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছে। তুমি যদি বিশ্বাস না করো এজন্য ইহান ভাইয়াকে রুমে এনে বসিয়ে রেখেছি।’
ইহান ভাইয়া আমার দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে এতো বড় মিথ্যা কথা কেন বললো ফাজিল মেয়েটা। আমার দিকে ইহান কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। আর লিনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আমার কথা শুনে।
#চলবে……