এক_চিলতে_রোদ-২,২৭,২৮

0
521

#এক_চিলতে_রোদ-২,২৭,২৮
#Writer_Nondini_Nila

২৭.

আরমোড় ভেঙে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ না হয়েই বাইরে চলে এলাম। আসার অবশ্য কারণ আছে।কারণটা হলো বাইরে আমি হাসির শব্দ পাচ্ছি জোরে জোরে। এই ভোরে কে এসেছে বাসায় যার সাথে আম্মু আব্বু এমন হাসাহাসি করছে। আব্বু বাসায় আছে কিন্তু হাসিতে আমি একটা অপরিচিত হাসির শব্দ পাচ্ছি ঠিক চিনে উঠতে পারছিনা। এটা আম্মু-আব্বুর না মনে হচ্ছে তিনজনের হাসি। হাসির রহস্য উদঘাটন করতে আমি ‌ বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ড্রইং রুমে আসতেই ইহানের হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠলো। তিনজনে বসে কি যেন কথা বলছে আর গলা ফাঁটিয়ে হাসছে। আমি কপালে সুক্ষ্য চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবছি,কি কথা বলে এত হাসছে তারা! আর সকাল সকাল ইহান‌ই বা এখানে কি করছে?
কালকের রাতের কথা মনে পড়তেই রাগে আমার নাক লাল হয়ে গেল। দুই বার ফোন করেছিলাম রিসিভ করেনি। এত ভাব দেখাতে পারে। গা জ্বলে উঠে আমার।আমি কপালে আর মুখে এলোমেলো হয়ে আসা চুল গুলো সরাতে সরাতে রাগে ফুঁসছি।হঠাৎই ইহান হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকাল আর সাথে সাথে ওর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আমি চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু ইহানের চাহনি একদম আলাদা। হা করে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলছে না। আমি কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছি। কিন্তু ইহানের দৃষ্টি আমার কাছে নেশাময় লাগছে। অপলক তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের এমন দৃষ্টি দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। আমার চোখ রাঙ্গানি কি তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি এমন হা করে তাকিয়া আছে কেন?

আমি চিন্তা করতে করতে নিজে দিকে তাকালাম। আর দিলাম এক চিৎকার সাথে সাথে উল্টা ঘুরে ভৌ দৌড়। ওরনা বিহীন প্লাজো আর গেঞ্জি পরেই চলে গিয়েছিলাম ঘুমঘুম চোখে। ওই ভাবে দেখে নিয়েছি আমাকে ইহান তাই তো ওমন হা করে তাকিয়ে ছিলো। ছিঃ কি বেশরম ছেলে!! পেছনে থেকে আম্মুর ডাক শুনেছি কিন্তু আমি থামিনি।
ফ্রেশ হয়ে রুমেই বসে আছি আমার হাতে ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ইহানের নাম্বার। ইহান কল করছে আমি রিসিভ করছি না। করবো না। রুম থেকেও বের হবো না ভাবছি। ইহান না যাওয়া পর্যন্ত আমি রুমের বাইরে যাব না। কিন্তু আম্মুর ডাকে টিকতে পারলাম না। যেতেই হলো।

আব্বুর খাওয়া শেষ। আমার দেরি হলো কেন জিজ্ঞেস করেছে আমি কোন রকম কাটিয়েছি মিথ্যা বলে। তারপর আব্বু উঠে বেরিয়ে গেলো অফিসে। আমি ইহানের সামনের চেয়ার টেনে বসলাম। চুপচাপ খাচ্ছি। ইহান ফিসফিস করে কি যেন বলছে আমি পাত্তা দিচ্ছি না।
খেয়েই রুমে চলে এলাম। আমি আসার কিছুক্ষণ পর‌ই ইহান ও রুমে এলো আর দরজা আটকে ফেললো। আমি লাফ দিয়ে নেমে পরলাম বিছানায় থেকে।

‘ এ-একি আপনি আমার রুমে এসেছেন কেন? আর দরজা আটকালেন কেন??’

আমার কথার উত্তর দিলো না ইহান। সারা রুমে চোখ বুলাতে লাগলো। তারপর বিছানায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পরলো আয়েশি ভঙ্গিতে তারপর বললো,

‘ বাচ্চাদের মতো রুম সাজিয়ে রেখেছো দেখছি। এ রুমে আসলে তো সবাই বাচ্চা খুজবো কিন্তু তোমাদের বাসায় কোন পিচ্ছি বাচ্চা নাই। আছে সেতো বড় বাচ্চা।’

একথা শুনতেই আমার মনে পরে গেলো আমিও ইহানের রুম দেখতে গেছিলাম আর ইহান কি ভাবটাই না নিয়েছিলো।

আমি বললাম, ‘ বের হোন বলছি আমার রুম থেকে। আপনি কোন সাহসে আমার রুমে এসেছেন? নিজের রুমে গেছিলাম বলে কতো অপমান করেছেন এখন আবার আমার রুমে এসে আমার বিছানায় বসে আছেন উঠুন আর বের হোন।’

আমার কথা কানে নিলো না ইহান। ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো।

‘ আরে আরে কি করছেন! বের হতে বলছি শুতে না। আমার বিছানায় শুচ্ছেন কেন? আমাকে অপমান করেছিলেন আপনার রুমে গিয়েছিলাম বলে এখন আমার রুমে আসতে লজ্জা করলো না আপনার।’

‘ না তো লজ্জা করবে কেন? আমি তো আর কারো ঘুমের সুযোগ নিয়ে আসে নি। আর তাছাড়া আমার এতো লজ্জা নাই। লজ্জা তো নারীর ভুষণ আমি নারী না।’

আমি তেরে বিছানায় কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাগ না আমার অভিমান হচ্ছে এখন।আমি অভিমানী গলাতেই বললাম, ‘ কি বললেন আমি সুযোগ নিয়েছি কি করেছি? আমি তো বলেছি আমি জানতাম না আপনি বাসায় আছেন জানলে কি যেতাম। আর তাছাড়া ও গিয়েছি বলে ওইভাবে অপমান করবেন কেন?’
ইহান কিছু বললো না। আমি আবার বললাম,

‘ কাল কল করলাম রিসিভ ও করলেন না এতো ভাব কেন আপনার। ভাবে মাটিতে পা পরে না যেন। কল করলে রিসিভ করেন না বাসায় আসলেও কথা বলতে চাইলে আমাকে এমনভাবে ইগনোর করেন যেন আমাকে চেনেন ই না। আর ভুল করেও যদি কখনো ফোন রিসিভ করেন যা তা বলে ফোন রেখে দেন। আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন আপনি জানেন আপনি আমার সাথে এমন করলে কত কষ্ট লাগে আমার। সবকিছু অসহ্য লাগে। রাগ হয়। অভিমান হয়। কান্না পায়। আবার সব ভুলে সেদিন আপনাদের বাসায় গিয়েছি বলে কেমন করলেন। ওটাতো আমার ও দাদু বাসা। আমি কি সেখানে যেতে পারব না। আজ যদি আব্বুর সাথে চাচাজানের সমস্যা না হত তাহলে কি আমি ও বাসার বাইরে থাকতাম। আপনার মত আমিও ওই বাসায় বড় হতাম। আগে না হয় আপনি আমার অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন তো তা না এখন তো আপনি আমার সম্পর্কে ভাই হোন।এটা জানার পর থেকে আমি আপনার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছি আর আপনি আমাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করছেন। কেউ তার বোনের সাথে এরকম করে বোনের সাথে কেউ ভাব দেখায়? আগে তো এমন করতেন না। আর এখন আমি আপনার পরিবারের কেউ জানার পর থেকেই এমন ভাব দেখানো শুরু করছেন কেন ? বড় ভাই কি বোনের সাথে এরকম করে বলুন!’ অভিমানে আমার চোখ দুটো ভড়ে উঠেছে। পলক ফেললেই তা গাল বেয়ে পরবে।

ইহান ফট করেই উঠে দাঁড়ালো। আর সোজা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি গাল মুছে ইহানের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলাম। ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। ইহান রক্ত লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের রাগের কারণটা বুঝতে পারছে না। আমি তো ভেবেছিলাম যে আমার কথা শুনে উনি ইমোশন হবেন আর আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে। ক্ষমা চাইবে। কিন্তু এ তো দেখি উল্টা হলো উনি তো রেগে বোম হয়ে গেছে মনে হচ্ছে‌।

ইহান এগিয়ে আমার কাধ চেপে ধরলো শক্ত করে আর কঠিন গলায় বলল, ‘ কি বললে তুমি ভাই? বোন মাই ফুট! গাধা আরেকদিন ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে ফোন বা কথা বলতে আসলে থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো ইডিয়েট। মাইন্ড ইট।’

বলেই গটগট করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আমার আম্মু সাথে পাশের বাসার রিতা আন্টি দেখা করতে আসায় তাকে নিয়ে আম্মু রুমে গিয়ে কি যেন করছিলো। ইহানকে সোফায় বসিয়ে। তখন ইহান সুযোগ পেয়েই আমার রুমে এসেছিলো। এখনো আম্মু রুমেই আছে। ইহান রাগে গজগজ করছে সোফায় বসে। আম্মু আসলেই চলে যাবে তাই উপরের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তো থ মেরে কতোক্ষণ ওইখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আম্মু তাড়াতাড়ি চলে এলো রিতা আন্টি কে নিয়ে। তখন আম্মু কে ইহান বায় বলে হতদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।

আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করলাম। আমার মাথায় হাত ইহান আমাকে ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে মানা করলো কেন? আমাকে কি বোন ভাবা যায় না এতটাই অপছন্দ করেন উনি আমাকে।

নাকি???

তুলির সাথে সব শেয়ার করার পর জানতে পারলাম ইহান আমাকে হয়তো খুব ভালোবাসে এজন্য বোন বলায় রাগ করেছে নাহলে খুব অপছন্দ করে এজন্য কিছুই ভাবতে চায় না। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। ইহান আমাকে কি সত্যি ভালোবাসে? আমার তো মনে হয় না। ভালো বাসলে এতোটা খারাপ বিহেভ করতে পারতো বলে মনে হয়না।
আমি আর তাকে নিয়ে ভাববো না বলে ভাবলাম। কিন্তু আমার ভাবনাকে সত্যি হতে দেবে না বোধহয় প্রকৃতি। ইহানের ওপর দুর্বলতা নিজের মধ্যে পেয়েছিলাম।
সেটা আমি কাটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম দূরে থেকে কিন্তু এখন তো দেখছি একদম সারাদিন আমার তার সাথেই থাকতে হবে এমন বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। চোখের সামনে তিনি ঘুরঘুর করবেন।কিন্তু নিজের দাদা বাড়ি আপন মানুষদের সাথে মেশার, থাকার লোভটা তো আমি সামলাতে পারলাম না এজন্যই তো ইমা আপুর বিয়ের খবর শুনেই আমি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। আব্বু আম্মুকে ও দাওয়াত করেছে ইমা আপু এসে। কিন্তু অদ্ভুত হলো ইমা আপু আব্বুকে চাচচু বলে নি। অপরিচিতদের মতো কথা বলেছে সৌজন্য নিয়ে। পরে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়েছে আপু যখন আব্বু আম্মুকে রাজি করালো তারপর যখন আমাকে ফিসফিস করে বলল,

‘ঊষা আমি কিন্তু জেনে গেছি তুই আমার চাচাতো বোন। আমার ছোট্ট মিষ্টি বোন। কিন্তু আমি
তাদের এখনই সবটা জানাতে চায় না যে আমি তাদের ভাইয়ের মেয়ে। জানলে তারা বিয়েতে কখনো যাবেনা। আর তারা না গেলে কখনই তারা মুখোমুখি হবেনা। আর তাদের মুখোমুখি হওয়া টা খুব দরকার।’

বিয়েটা যেহেতু কমিউনিটি সেন্টারে হবে এ জন্য একদিন আগে ইমা আপু দের সাথে আমার সেখানে যেতে হবে। আর আব্বু রাজি হয়েছে তারা শুধু বিয়ের দিন যাবে এর আগে যেতে পারবেন। ইমা আপু তাতে কোন আপত্তি করেনি।
১. মেহেন্দি, ২.গায়ে হলুদ, ৩. বিয়ে।
তিন দিনের অনুষ্ঠান। ইমা উডবি রিফাত ভাইয়া রা ও সেখানে উপস্থিত হবে খুব মজা হবে। ইমা আপুরা একদিন আগেই যাবে সেদিন আমাকে তাদের বাসায় যেতে হবে। সেখান থেকে কমিউনিটি সেন্টারে তাদের সাথে যাব। তার আগেরদিন একদিন আপু আমাকে নিতে এসেছিল বিয়ের শপিং করার জন্য। সেদিন ইহান ও ছিলো সেখানে আমার সাথে কথাও বলেছে স্বাভাবিক ভাবেই। সেদিনই রিফাত ভাইকে দেখেছি। আপু আমাকে জোর করে একটা ড্রেস কিনে দিয়েছে আমি অবশ্য নিতে চাইনি
কিন্তু এমন ভাবে জোর করলো না নিয়ে ও পারলাম না। ড্রেসটা আমি বাসায় আনিনি বিয়েতে যেতে হবে তখন যেন নিয়ে যায় সেটা বলে দিয়েছি।
আজ‌ই সেই দিন আমি ইমা আপুদের বাসায় চলে এলাম। বাসা ভর্তি লোকজন। সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কাউকে চিনি না সবাই অপরিচিত। এ বাসায় আমি ইমা আপু, ইলা আপু, ইহান, চাচি জাদু আর চাচাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছি তখন কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। আর ধাক্কা খেয়ে দুজনেই পরে গেলাম আমি অসাবধানতায় তার উপর পরলাম। আমি মানুষটার হাঁটুতে বসে পরেছি। তাকিয়ে দেখলাম একটা ফর্সা মেয়ে। বিদেশিদের মতো ফর্সা আমি আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। আর মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়েছে। আমি অসহায় মুখ কথূ তাকিয়ে সরি বলছি। মেয়েটা ভালোই ব্যাথা পেয়েছে কারণ তার কোলে বসে পরেছিলাম আমি। আমি ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ আমাকে লক্ষ্য করেছে কিনা আমি উল্টা ঘুরে দৌড় দিলাম।মেয়েটা আমাকে দেখে নি কারন সে হাঁটু ধরে কাঁদছে।
আমি দৌড়ে ইহানে সামনে এসে পরলাম ইহান কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড? হুয়ে আর ইউ রানিং লাইক দ্যাট?’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম,

‘ ক‌ই কিছু না তো এমনি। সবাই আমাকে রেখে চলে গেল কিনা ভেবে দৌড়াচ্ছি।’

ইহান কতোটুকু বিশ্বাহ করলো জানি না বললো, ‘ মনে হল চুরি করে ধরা খাওয়ার ভয়ে দৌড়াচ্ছ!’

আমি কিছু বলতে যাব। পেছন থেকে চেঁচামেচি আসতেই ইহান আমাকে রেখে এগিয়ে গেলো আমিও গেলাম সেই মেয়েটাকে নিয়ে সবাই আদিখ্যেতা করছে। আর মেয়েটা ফর্সা মুখ লাল করে ফেলেছে কাঁদতে কাঁদতে।
ইহান ও মেয়েটার কাছে গিয়ে চোখের জল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হয়েছে মিষ্টি? কাঁদছিস কেন?’

ইহানের এত কেয়ার করা দেখে আমার রাগে সারা শরীরে আগুন ধরে উঠলো মনে হয়। আমি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছি। ইহানের এমন কেয়ার করা আমার মোটেও ভালো লাগছে না একটুও না।

#চলবে……

#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila

২৮.

দুইটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে একটা চেয়ার নিয়ে ঝগড়া করছে। মেয়ে বাবুটা বসে ছিলো ছেলে বাবু টা মেয়ে বাবুটা কে থাপ্পর মেরে টেনে নিচে নামায়। এবার মেয়েটা কান্না করে দিয়ে খামচি দিল ছেলেবাবুকে তারপর তাকে ধরে টেনে নামায়। এবার দুজনেই টানাটানি করছে আর এক চেয়ারের দুজনের এক জন রাজত্ব করার জন্য ঝগড়া করছে। আমি বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবার দুজনেই ভালো গড়াগড়ি খাচ্ছে এগিয়ে যাব ভাবছিলাম তখনই তাদের মা এলো দুজনকে বকতে বকতে। মেয়েটা তার মা’র কাছে গিয়ে ছেলেটার নামে বিচার দিলো। এবার ছেলেটার মা ও এলো দুজন দুজনের মায়ের কাছে গিয়ে বিচার দিতে লাগলো। দুজনের বিচার দেওয়া আর গাল ফুলিয়ে নিজেদের দিকে তাকাতে দেখে আমি হেসে দিলাম। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছি দশ মিনিট হলো। সবাই রুম ঠিক করে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি একাই একজন রুমে ঢুকে ফ্রেশ না হয়েই আবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কীর্তিকলাপ দেখছিলাম।

‘একা একা দাড়িয়ে হাসছো কেন?’ পুরুষালী কন্ঠ কানে এসে বারি খেতে আমার সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে গেলো। চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই ইহানকে ভ্রু যুগল কুটি করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে থমকালাম। আস্তে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আচমকা কানের কাছে কারো কথার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম।

‘হুয়াই আরন্ট ইউ টকিং অ্যাবাউট ইউর প্রবলেম?’

‘নো প্রবলেম! একা কোথায় আমি তো ওই বাচ্চা দুটোর কান্ড দেখে হাসছিলাম।’ বলেই হাত বাড়িয়ে সামনে দেখলাম। ইহান ভ্রু কুটি করে সামনে তাকালো।
সামনে কাউকে না দেখে বলল, ‘আর ইউ ম্যাড? কি সব বলছো! ক‌ই বাচ্চা?’

আমি চমকে সামনে তাকিয়ে দেখলাম ফাঁকা কেউ নাই। এরা কোথায় গেল। সিওর মাকে বিচার দিতে দিতে চলে গেছে।

‘এখানেই ছিল। খুব ঝগড়া করছিলো। চলে গেছে এখন।’

‘ তো তারা চলে গেছে তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে আর তুমি তার কোন কিছু করছ না। উল্টা বাচ্চা দের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের কীর্তিকলাপ দেখছো? গাধা একটা। রুমে যাও আর ফ্রেশ হ‌ও গিয়ে।’

বলেই বড় বড় পা ফেলে সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি নাকের পাটা ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি‌। আমাকে গাধা বললো। গন্ডার কোথায় তুই গাধা তো ব‌উ গাধা। বিরবির করে বকতে বকতে রুমে চলে এলাম। রুমে আরেকজন আছে। ইহানের মামাতো বোন ফারজানা আপু। আমাকে তার সাথে থাকতেই দিয়েছে। তিনি বিছানায় শুয়ে হাট উঁচু করে পায়ের উপর পা তুলে ফোন টিপছে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘ ঊষা তুমি কোথায় ছিলে তোমাকে ডাকলাম আমি যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো।’

আমি বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে গেলাম। ফারজানা আপুকে আমার প্রথম সাক্ষাতেই খুব ভাল পছন্দ হয়েছে। উনি ইহানের সেম ব্যাস। যাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম সেই মেয়েটা হচ্ছে আমি আমার মেজ কাকার মেয়ে কলেজে পরে নাম জেরিন। সেই সেই ধাক্কা খেয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো আমি প্রথমে মেয়েটার উপর তীব্র রাগ প্রকাশ করলেও নিজেরই বড় বোন হয় জানার পরে রাগ মাটি হয়ে গেছিলো। ইহান তো বোন বলেই এতো কেয়ার করছিল আর আমি কিনা কি ভাবছিলাম।
নিজের বোকামী তিনি নিজেই অবাক।
বাইরে এসে দেখলাম ফারজানা আপু ঘুমিয়ে গেছে আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো দুপুরে। বাইরে আসতেই ইমা আপু টেনে আমাকে খাবার রুমে নিয়ে গেলো। আপুর সাথে আমাকে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ওই জেরিন তা হতে দেয়নি। জোর করে আপু সাথে থেকেছে আপু তিনজন মিলে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু জেরিন আমাকে এলাও করলো না। আমিও আপুকে মানিয়ে ফারজানা আপুর সাথে তার রুমে চলে এলাম।

খাবার টেবিলে বসে আরেক ঝটকা খেলাম। আমার পাশের চেয়ারে জেরিন বসেছে। আমি বসতেই ফিসফিস করে কানের কাছে বললো,

‘ ইউ প্রসেড মি ইন দি মর্নিং। আই নো ইউ।’

জেরিনের কথা শুনে আমি বিহ্বল হয়ে তাকালাম ওর দিকে। জেরিন আমার দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হবে। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা কিছুই দেখেনি এ তো দেখছি সব জানে। কিন্তু তখন মেয়েটা আমার কথা কাউকে বললে না কেন। সবাই জানলে খুব বকবে নিশ্চয়ই আমাকে। জেরিনকে নিয়ে সবাই কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আমি দেখেছি। এখন আমার কি হবে। ধুর কি আবার হবে আমি ইচ্ছে করে পড়েছিলাম নাকি।

তখন ইহান এসে বসলো আমার ডান পাশের সিটে। আমি চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। আশেপাশে আর একটা সিট ও খালি ছিলো না তাই বোধহয় এখানে বসেছে। কিন্তু ইহানের পাশে বসে খেতে হবে ভেবেই অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ইহানকে দেখে জেরিন কথা থামিয়ে দিলো। আর কিছু বললো না। আমি অবশ্য প্রথম কথা ছাড়া আর কোন কথাও শুনিনি ও।
আমি আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাতে তাকাতে খাবার না দেখেই মুখে পুরে নিলাম। প্লেটে যে আমার জাত শত্রু আছে তা দেখলাম ও না। ওইভাবেই চিংড়ি মাছের বড়া দিয়ে খেয়েই যাচ্ছি। অন্য কিছু নিচ্ছি না। এতোটাই অন্য মনষ্ক ছিলাম যে চিংড়ি তে যে আমার মারাত্মক এলার্জি আছে মনেই ছিলো না। খাওয়ার মাঝেই আমার গলা গাল চুলকানি উঠলো। স্বাভাবিক ভাবেই চুলকাচ্ছি। এবার পিঠ হাত চুলকাচ্ছে ধ্যাত এতো চুলকাচ্ছে কেন শরীর। ঘুমানোর আগে তো গোসল ও করেছি। তাহলে চুলকানি হচ্ছে কেন? খাওয়া অফ করে চুলকাচ্ছি। হঠাৎ জেরিন চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ ও মাই গড কি হয়েছে এসব।’ বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি। হাত এখনো আমার গলায়। জেরিনের কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি না এমন করে তাকিয়ে আছে কেন সবাই আমার দিকে। ফারজানা আপুর কথা শুনে আমি নিজের গলায় ও হাতের দিকে তাকালাম। লাল লাল ফোসকা পড়ে আছে। যেখানেই চুলকাচ্ছি সেখানেই এমন হয়ে যাচ্ছে
আমি চোখ বড় করে দেখছি এমন তো আমার চিংড়ি গেলে হয় এখন এমন হলো কেন? আমি তো আজ চিংড়ি খায়নি। প্লেটে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ছিটে সরে গিয়ে বললাম,

‘ আমাকে চিংড়ি দিয়েছেন কেন এটাতে তো আমার খুব এলার্জি আমি সহ্য করতে পারিনা। এখন কি হবে।’
সারা শরীর লাল করে ফেলেছি আমি চুলকাতে চুলকাতে। ইহান একবার আমার প্লেট তো একবার আমার দিকে তাকিয়ে তেরে এলো আমার দিকে।আমার রেখে চিৎকার করে বললো,

‘ তোমার মতো অপদার্থ আমি আর একটাও দেখিনি। মাথা খারাপ নাকি তোমার। সমস্যা আছে তাও কোন সাহসে এটা মুখে দিয়েছো ইডিয়েট। কোন কমনসেন্স নাই তোমার!’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। ইমা আপু দৌড়ে আমার কাছে এসে পানি খাওয়ালো তারপর আমাকে নিয়ে রুমে এলো। ওষুধ বের করে হাতে দিলো। আমি ওষুধ খেয়ে ও শান্ত হতে পারছি না। শরীর ব্যাথা করছে। নিস্তেজ হয়ে আসছে।
ইহান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মনে মনে রাগে ফুঁসছে এতটা কেয়ারলেস কেন মেয়েটা!!

ঘুম ভাঙলো রাতে চুলকানি কমেছে ফোসকা ও চলে গেছে হালকা লাল হয়ে আছে শুধু এখন‌। ইমা আপুর রুমেই এখনো শুয়ে আছি। পাশে মলম রাখা আপু দিয়ে দিয়েছিলো বোধহয়। রুমে কেউ নাই আমি একাই তাই উঠে পরলাম ফটাফট।
বাইরে এসে দেখলাম সবাই গোল হয়ে বসে আছে। আর কালকের প্লান করছে রিফাত ভাইয়ার কাল আসবে এখানে। আমি ও তাদের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তাদের কাছ অবধি পৌঁছাতে পারলাম না। হঠাৎ কেউ আমার হাত শক্ত করে ধরে নিলো। হাঁটা থামিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইহান। আমি বললাম,

‘ কি হয়েছে?’ প্রশ্নতুক চোখ তাকিয়ে বললাম।

‘ কোথায় যাচ্ছ?’ আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ইহান পাল্টা প্রশ্ন করল।

‘ ওই যে ওইখানে। সবাই গল্প করছে আমি একাই রুমে শুয়ে ছিলাম। তাই তাদের সাথে গল্পে জয়েন করতে যাচ্ছি।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! এই শরীর নিয়ে এখন আড্ডা দিতে যাচ্ছ। চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকো যাও।

কি আমি তো। তিন ঘণ্টার মত ঘুমিয়ে ছিলাম এখন আবার ঘুমাবো কেন? আর আমি এখন একদম ঠিক আছি।’

‘স্টুপিড গার্ল তোমার মত মাথামোটা আমি দুটো দেখিনি চিংড়িতে যেহেতু তোমার সমস্যা তারপরও তুমি ওইটা কোন আক্কেলে খেয়েছিলা?’

আমি ধপ করে মাথা নিচু করে ফেললাম আর ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। কি করে ইহানকে এখন বোঝাবো যে আমি শুধু মাত্র তার জন্য কতটা অস্বস্তি আর অন্যমনস্ক ছিলাম।এতটাই অন্যমনস্ক ছিলাম যে চিংড়ি মাছ খেয়ালই করিনি চিংড়ি মাছ কে অমৃত ভেবে খেয়ে গিয়েছে।

‘কি হল কথা বলছো না কেন? তোমার মত কেয়ারলেস মেয়ে আমি দুটো দেখি নাই!’

‘আচ্ছা আমি না হয় কেয়ারলেস তাহলে ইহান ভাইয়া আপনি না হয় আমার একটু টেক কেয়ার করুন! এখানে তো আর আমার আব্বু আম্মু নাই যে তারা টেক কেয়ার করবে। আর আপনি আমার বড় ভাই হিসেবে একটু না হয় আমার খেয়াল রাখুন‌।’

‘ আবার ভাইয়া বললে? তোমাকে আমি ভাইয়া বলতে মানা করেছিলাম না?’

‘কেন মানা করেছিলেন? আপনি তো আমার ভাই হোন। তাহলে ভাইকে কি আমি এখন মামা বলবো?’

‘ মামা!! হোয়াট? কিছুই বলার দরকার নাই।’

‘ কেন দরকার নাই। অফকোর্স দরকার আছে ভাইয়া আপনি এত বড় আমার থেকে আপনাকে কি নাম ধরে ডাকা যাবে। মামা, ভাইয়া, খালু, চাচা কিছু একটা তো বলতেই হবে তাই না। এখন আপনি বলুন আপনাকে আমি কি বলব? ভাইয়া বলতো যদি সমস্যা হয় তাহলে আমাকে মামা কাকাই বলতে হবে!!’

ইহান আমাকে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। বিছানার উপর সাজানো প্লেট দেখতে পেলাম। মুরগির গোশত দিয়ে ভাত রাখা। আমাকে সামনে বসিয়ে খেতে বলল, আজেবাজে কথা বলা অফ করে।

আমি তাও বললাম, ‘ এত ইম্পর্টেন্ট একটা কথা আপনার কাছ আজেবাজে মনে হচ্ছে বলেন না আমি আপনাকে কি বলবো?

‘ উফফ এতো পাগলামো করছো কেন? আচ্ছা ভাই ই ব‌ইলো। মামা কাকা থেকে এটা বেটার।’

আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, ‘ ওক্কে ভাইয়া!’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here