#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_০৩
#অধির_রায়
হুট করেই অল্প বয়সী একটা তরুণী সাথে ধাক্কা খায়৷ নিয়তি বুঝতে পারছে না; অল্প বয়সী তরুণীটিকে? নিয়তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই তরুনীটি চোর বলে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়৷
.
নির্বণ মুচকি হেঁসে বলে উঠে,
“ও বাচ্চা মানুষ৷ ওর কথায় কিছু মনে করো না৷ তোমাকে হুট করে দেখে চোর ভেবে নিয়েছে। আমার ছোট বোন ছোঁয়া। ওর মন ভিষণ ভালো৷”
.
নিয়তি মলিন হাসি দিয়ে,
“আমি কিছু মনে করিনি৷ হঠাৎ করে দেখেছে তাই ছোয়াঁ আমাকে চোর ভেবেছে৷ আর আমাকে দেখতে একজন চোরের মতোই লাগছে।”
.
নির্বণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,
“বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ বাড়ির ভিতরে যাওয়া যাক। কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভিতরে চল৷”
.
নিয়তি বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই নির্বণের বোন দৌড়ে আসে নিয়তির সামনে৷ নিয়তিকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। চোখ রাঙিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিয়তি গালে কষিয়ে চর বসিয়ে দেয়৷ নিয়তি গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পড়ে যায়৷ ছোঁয়া চিৎকার করে বলে উঠে,
“এই ছোট লোকের বাচ্চা৷ তুই এখানে কি করছিস? তোর এতো বড় সাহস তুই আমার বাড়িতে ঢুকে পড়েছিস৷ বাড়ির বাহিরে চুরি করে তোর স্বাদ মিটেনি৷ এখন বাড়ির ভিতরে চুরি করতে এসেছিস৷”
.
নিয়তি হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে৷ নিয়তির জীবনে শুধু কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই। এক ফোঁটা সুখ লিখে রাখেনি ভগবান ৷ ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে৷ মায়ের ভালোবাসা কোনদিন পেলো না৷ বাবা থেকেও না থাকার মতো৷ বাবা টাকার বিনিময়ে তাকে আজ বিক্রি করে দিয়েছেন৷ মানুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে গেছে নিয়তি৷ নিয়তি শুধু নির্বণের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নির্বণ কোন প্রতিবাদ করে কিনা৷
.
ছোঁয়া রেগে বলে উঠে,
“তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস৷ বাড়ি থেকে এখনই বের হয়ে যা৷”
.
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
“ও এখানে চুরি করতে আসেনি৷ আজ থেকে নিয়তি এই বাসায় কাজ করবে৷ সে এই বাসার কাজের লোক হয়ে থাকবে৷”
.
ছোঁয়া অহংকারের সাথে বলে উঠে,
“এই মেয়ে তুই কোনদিন আমার সামনে আসবি না৷ গাইয়া মেয়ে কোথাকার। আমার সামনে আসলে লাথি দিয়ে বাহিরে ফেলে আসবো৷”
.
ছোঁয়া ফ্রীজ থেকে আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে উপরে চলে যায়৷ ডাইনিং রুমে শব্দ শুনে হুইলচেয়ারে করে মাঝ বয়সী একজন ভদ্র মহিলা আসেন৷ নির্বণ ভদ্র মহিলাটিকে দেখে দৌড়ে যান৷ ভদ্র মহিলাটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোলে মাথায় রাখে৷ মহিলাটি বলে উঠেন,
“নির্বণ ছোঁয়া এভাবে জোরে কথা বলল কেন? তার সাথে কে কি করেছে?”
.
নির্বণ মুচকি হেঁসে,
“মা ছোঁয়া নিয়তিকে দেখে এমন ব্যবহার করেছে৷ সে নিয়তিকে মেনে নিতে পারেনি৷” নিয়তিকে উদ্দেশ্য করে, “নিয়তি আমার ‘মা।’ মাকে প্রণাম করো৷”
.
নিয়তি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নির্বণের মায়ের পা স্পর্শ করে প্রণাম করে৷ নির্বণের মাথা নিয়তির মাথায় হাত রেখে রেখে আশীর্বাদ করেন৷ নিয়তির চোখের জল মুছে দিয়ে বলে উঠেন,
“খুব মিষ্টি একটা মেয়ে৷ ছোঁয়ার ব্যবহারে মন খারাপ করো না৷ ছোঁয়া একটু অহংকারী মেয়ে৷ সে গরিব দুঃখীদের একদম সহ্য পারে না৷ তোমার কোন কিছু দরকার পড়লে আমাকে বলবে৷ তুমি তোমার রুমে যাও৷ ফ্রেশ হয়ে কাল থেকে কাজ করলেই চলবে৷”
নির্বণকে উদ্দেশ্য করে,
“নিয়তিকে তার ঘর দেখিয়ে দাও৷ তাকে উপরের তলায় ঘর দাও৷ সে অন্য সার্ভেন্টদের সাথে থাকতে পারবে না৷”
.
নিয়তি নির্বণের মায়ের ভালোবাসা পেয়ে সকল কষ্ট ভুলে যায়৷ এই বাড়িতে নির্বণ, ছোঁয়া উৎশৃঙ্খল ছেলে মেয়ে হলেও নির্বণের মায়ের মন খুব ভালো৷ তিনি অল্পতেই সবাইকে আপন করে নেন৷
________
নিয়তি নির্বণের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ নির্বণ এক ধ্যানে অফিসের কাজ করে যাচ্ছে৷ রুমের দ্বার খোলা থাকাই নিয়তি নির্বণকে দেখতে পাচ্ছে৷ নির্বণ কাজ শেষ করে দ্বার বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়ে৷ নির্বণ ঘুমানোর পর নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের রুমে আসে৷ নির্বণের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে মনে মনে নিয়তি বলে উঠে,
“আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন বা না মানেন আমি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি। আপনার স্থান আমি অন্য কাউকে দিতে পারবো না৷ আর আপনাকে অন্য কারো কাছে যেতে দিব না৷ আমি আপনাকে সব রকম অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবো৷ আর কোন মেয়ের জীবন নিয়ে আপনাকে খেলতে দিব না৷”
.
নিয়তি নির্বণের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে৷ আর সকল রাগ অভিমান চোখের জলে ধোঁয়ে ফেলে দিচ্ছে। কখন যে নিয়তি ঘুমিয়ে পড়েছে জানা নেই? ভোর ছয়টায় নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়। নির্বণ যেন কিছু জানতে না পারে সেজন্য তাড়াতাড়ি করে নির্বণের রুম থেকে চলে আসে৷ ফ্রেশ হয়ে রান্না করে যায়৷ বাড়ির সকলের জন্য চা বসাই৷ নিয়তি বাবা অন্যত্র বিয়ে করায় নিয়তি রান্নার সব কাজ ভালোভাবে শিখে নিয়েছে৷ সৎ মায়ের ঘরে থাকলে হলে নিজেকেই সব কাজ করে থাকতে হয়৷ শুধু নিজের কাজ নয়৷ পরিবারের অন্যদেরও কাজ করে দিতে হয়৷ জুতা সেলাই থেকে চন্ডি পাত সবই করতে হয় যদি থাকে ঘরে সৎ মা৷
.
নিয়তি প্রথমে চা নিয়ে যান নির্বণের মায়ের ঘরে৷ তিনি বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করছেন৷ এক্সিডেনে নির্বণের মায়ের কোমরের পাঁজর ভেঙে যায়৷ যার ফলে তিনি আর হাঁটতে পারেন না৷ হুইলচেয়ার করে চলাফেরা করেন৷ নিয়তি তাড়াতাড়ি করে নির্বণের মায়ের কাছে আসে৷ তার মাকে অতি যত্ন সহকারে হুইলচেয়ার বসিয়ে দেয়। ~অধির~
.
নির্বণের মা মুচকি হেঁসে,
“এতো সকালে তোমাকে উঠতে কে বলেছে? বাড়ির সকলের ঘুম সকাল নয়টা না বাজলে ভাঙে না৷ তুমি নয়টা অব্দি ঘুমাতে পারো৷”
.
নিয়তি চা এগিয়ে দিয়ে,
“না মা। আমি এতো সকাল অব্দি ঘুম আসি না৷ আমার অভ্যাস হয়ে গেছে সকাল সকাল উঠা৷ গরম গরম চা খেয়ে নেন ভালো লাগবে৷”
.
নিয়তি হাত কাচুমাচু করে যাচ্ছে৷ কারণ সে হুট করেই বাড়ির মালকিনকে মা বলে সম্মোধন করেছে। অসহায় দৃষ্টিতে ছলছল নয়নে নিয়তি নির্বণের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে,
“বাহ্ তুমি খুব ভালো চা বানাতে পারো৷ তোমার চা বানানোর হাত খুব ভালো৷ আমি কিন্তু প্রতিদিন তোমার হাতে চা খাবো৷”
চায়ের কাপ ট্রি টেবিলে রেখে নিয়তির হাত ধরে,
“খুব সুন্দর চা খাওয়ানোর জন্য মা বলার অধিকার দিয়ে দিলাম৷”
.
মুখে এক রাশি আনন্দের হাসি রেখা টেনে বলে উঠে,
“আজ থেকে আমি আপনাকে মা বলে ডাকতে পারবো৷ আমার আর কিছু লাগবে না৷ আমি পৃথিবীর সব থেকে বড় পাওয়া পেয়ে গেছি৷”
.
নিয়তি তোমার বাসা কই? তোমার মা বাবা কি করে?
.
নির্বণের মায়ের মুখে মা বাবার কথা শুনে নিয়তি হাসি মুখটা নিমিষেই আষাঢ়ের ঘনঘটার মতো অন্ধকার নেমে আসে৷ নিয়তি মাথা নিচু করে বলে উঠে,
“আমার মা বাবা কেউ নেই৷ আমার জন্মের কিছুদিন পর মা মারা যান৷ বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা যান৷”
.
“মন খারাপ করো না৷ ইশ্বর যেন তাদের স্বর্গ বাসী করেন৷”
.
নিয়তি আর কিছু না বলে রুম থেকে চলে আসে৷ আজ বাবা বেঁচে থাকার সত্ত্বেও উনাকে মৃত বলতে হচ্ছে৷ চোখের জল মুছে সবার জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ ঘড়ির কাঁটায় নয়টা বাজতেই নিয়তি চা নিয়ে চলে আসে ছোঁয়ার রুমে। ছোঁয়ার ঘুমে ঢুকতেই ছোঁয়া বলে উঠে,
“কারো রুমে ঢুকতে গেলে তার পারমিশন নিতে হয় তা জানা নেই৷ গাইয়া মেয়ে৷ লেখাপড়া আছে কিছু?”
.
ছোঁয়ার কথায় কান না দিয়ে,
“সরি! আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে আছো? কিন্তু তোমার ঘুম ভেঙে গেছে জানা ছিল না৷ আর হ্যাঁ তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকবো।”
.
ছোঁয়া কর্কশ কন্ঠে,
“এই তুমি কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতো থাকো৷ চা দিতে এসেছিলে চা দিয়ে নিজের কাজে যাও৷ আমার বিষয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না৷”
.
নিয়তি চা দিয়ে চলে আসতে নিলেই ছোঁয়া পিছন থেকে বলে উঠে,
“এই মেয়ে তোমার নাম কি?”
.
নিয়তি পিছনে ফিরে,
“আমি মেয়ে নয়৷ আমাকে ‘দিদি’ বলে ডাকবে৷ আর হ্যাঁ আমার নাম নিয়তি৷”
.
ছোঁয়া অট্টহাসি দিয়ে উপহাস করে,
“তোমার মতো মেয়েকে আমি ‘দি’ বলে ডাকবো। একটা ছোট লোকের বাচ্চা৷ তোমার মতো ছোটলোক আমার বোন হবে।”
.
নিয়তি কোমল কন্ঠে,
“আমি এখানে এসেছি তোমাদের চিন্তা ধারণা পরিবর্তন করতে। তাই তুমি হাজার বকা দিলেও আমি গায়ে মাখিয়ে নিব না৷”
.
নিয়তি দ্বারের কাছে আসতেই ছোঁয়া বলে উঠে,
“এই ধারাও।”
.
ছোঁয়ার কথা শুনে নিয়তি আবারও পুনরায় দাঁড়িয়ে যায়৷ ছোঁয়া বিছানা থেকে নেমে তার সমস্ত কাপড় আলমারি থেকে নামিয়ে নেয়৷ নিয়তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে,
“আমার সব গুলো কাপড় ধোঁয়ে দাও৷ আমিও দেখি তুমি কতদিন এই বাড়তে ঠিকতে পারো৷ আমার পরীক্ষায় আগে সফল হও৷”
.
নিয়তি কোন কথা না বলে সবগুলো কাপড় নিয়ে চলে আসে৷ ছোঁয়া ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে মনে মনে বলে উঠে,
“নিয়তি আমার প্রিয় দিদি৷ তোমার জীবনকে আমি নরকে পরিণত করে তুলবো৷ আমার দিদি হওয়ার খুব শখ৷ আমি দেখিয়ে দিব তোমার জায়গা কোথায়৷”
___________
নিয়তি সবার ঘরে চা দেওয়ার পর নির্বণের ঘরে চা দিতে আসে৷ এইভার নিয়তি কোন ভুল করতে চাইনা৷ তাই সে রুমে ঢুকার আগে নির্বণের রুমের দ্বারে শব্দ করে৷ কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই৷ কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে নিয়তি ধীরে ধীরে নির্বণের রুমে প্রবেশ করে৷ ট্রি টেবিলের উপর নির্বণের চা রেখে ফিরে আসতে চাইলেই…ইতিহাস।
চলবে….