এক_চিলতে_সিঁদুর #পর্ব_১১,১২

0
809

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১১,১২
#অধির_রায়
পর্ব_১১

নিয়তির মামা বলে উঠেন,
“তোমরা নিয়তির খোঁজ করছো কেন? নিয়তি আমার এখানেই আছে৷”
.
নির্বণ নিয়তির মামার কথা শুনে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে৷ মুখে এক ঝিলিক হাসি নিয়ে,
“নিয়তির সাথে আমি একবার দেখা করতে চাই৷ নিয়তি কোন জায়গায় আছে৷”
.
নিয়তির মামী নির্বণের সামনে এসে,
“অনেক সহ্য করেছি৷ আর নয়৷ তোমরা এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও৷ আমি থাকতে কিছুতেই দেখা করতে পারবে না নিয়তির সাথে৷”
.
নির্বণ নিয়তির মামীর হাত ধরে,
“প্লিজ মামী নিয়তির কাছ থেকে আমাকে আলাদা করবেন না৷ আমি ঢাকা থেকে সিলেটে এসেছি শুধু নিয়তির সাথে দেখা করার জন্য।”
.
নিয়তির মামী কর্কশ কন্ঠে বলে উঠেন,
“তুমিই তো নিয়তির জীবনটা ধ্বংস করেছো৷ এখন কোন মুখে নিয়তির সামনে দাঁড়াবে৷ তোমার মাঝে লজ্জাবোধ বলতে কিছুই নেই৷”
.
মামীর কথা শুনে নির্বণ মাথা নিচু করে ফেলে৷ মামী ভুল কিছু বলেননি৷ তিনি যা বলেছেন সব সত্য কথা বলেছেন৷ নিয়তির মামা তাদের দিকে চকিত হয়ে তাকিয়ে আছেন৷ তিনি বুঝার চেষ্টা করছেন কি হচ্ছে? তিনি কিছু বুঝতে না পেয়ে বলে উঠেন,
“তোমরা নিয়তির সাথে দেখা করতে চাও কেন? তুমি নিয়তির কি হও?”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“আমি নিয়তির হাসবেন্ড। নিয়তির আমার উপর রাগ করে চলে এসেছে৷”
.
নিয়তির মামার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে৷ কারণ তিনি নিয়তির সিঁথিতে কোন সিঁদুর দেখেন নি৷ হিন্দু বিবাহিত মেয়েরা শাখা সিঁদুর ছাড়া বের হয়না৷ কিন্তু নিয়তির হাতে সিঁথিতে কিছুই নেই৷
.
নিয়তির মামা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“আর কোন কথা নয়৷ আর একটা মিথ্যা কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷”
.
ছোঁয়া নিয়তির মামার সামনে হাত জোর করে,
“আপনি ভুল ভাবছেন৷ আমরা কোন মিথ্যা কথা বলিনি৷ নিয়তিকে ডাক দেন৷ সে আসলে সব সত্য বেরিয়ে আসবে৷”
.
“বেশি কথা বলতে কে বলেছে? বের করে দাও এদের৷ মিথ্যা পরিচয় নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে৷” (নিয়তির মামী)
.
নিয়তির ঘুম ভেঙে যায় কথার শব্দে ৷ নিয়তি বুঝতে পারে নির্বণ আর ছোঁয়া এসেছে৷ নিয়তি একবার ভাবে সে মামা মামীর রুমে আসবে না৷ মামা নির্বণের সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন৷ নিয়তি আর বসে থাকতে পারল না৷ নিয়তি মামা মামীর রুমে ছুঁড়ে আসে৷
.
নিয়তি নির্বণের দিকে তাকিয়ে,
“মামা নির্বণ যা বলেছেন সব সত্যি। নির্বণের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে৷ ধরতে গেলে সেটা বিয়ে নয়৷ একটা এক্সিডেন ছিল৷ আমি এই বিয়ে মানি না৷”
.
নির্বণ তেড়ে নিয়তির কাছে আসে৷ নিয়তি তো নির্বণের আসা দেখে ভয় পেয়ে যায়। নিয়তির হাত ধরে,
“আমাকে একটা সুযোগ দাও৷ আমি কোনদিন তোমার অযত্ন করবো না৷”
.
নিয়তি ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়৷ ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠে,
“আমি আপনার সাথে থাকতে চাইনা৷ যেহেতু আপনি এখানে এসে পড়েছেন তাই রাতটুকু থেকে সকালে চলে যাবেন৷”
.
নিয়তি নির্বণের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে রুমে চলে আসে৷ রুমে এসে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই নির্বণ রুমের ভিতরে প্রবেশ করে৷ নির্বণ রুমে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দেয়৷ নিয়তি নির্বণকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। নিয়তি এক কদম করে পিছিয়ে যাচ্ছে নির্বণ এক কদম করে এগিয়ে আসছে৷ এক সময় নিয়তির পীঠ দেয়ালের সাথে আটকে যায়৷ নির্বণ নিয়তির একদম কাছে চলে আসে৷ নির্বণের ভারী শ্বাস নিয়তির মুখের উপর পড়ছে৷ নিয়তি সাইট কেটে চলে যেতে নিলেই নির্বণ দেয়ালের দুইপাশে দুই হাত দিয়ে আটকায়৷ নিয়তির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নিয়তি কিছু বলতে নিবে তখনই নিয়তির মুখে আঙ্গুল দিয়ে নিয়তিকে থামিয়ে দেয়৷ নির্বণ দুই নয়ন ভরে নিয়তিকে দেখে যাচ্ছে৷
______

“এই ছেলে নিয়তির রুমে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে দিল কেন?”
.
“মামী চিন্তা করবেন না৷ তাদের সমস্যা তাদের কাঁধে ছেড়ে দেন৷”
.
নিয়তির মামী তেড়ে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলেন,
“আমি কিন্তু তোমাদের কাউকে ছাড়বো না৷ তোমার দাদাকে দরজা খুলে বাহিরে আসতে বলো৷”
.
ছোঁয়া নিয়তির মামীকে পরম আদরের সহিত আলাপে বলে,
“মামী চিন্তা করবেন না৷ এক্সিডেনে বিয়ে হলেও তো তাদের বিয়ে হয়েছে৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটা আমাদের হাতে নেই৷ সৃষ্টি কর্তা যখন চাইবে তখনই হবে৷”
.
“বড় বড় কথা বলা বন্ধ করো৷ যেখানে নিয়তি থাকতে চাইনা সেখানে আমি তাকে যেতে দিব না৷”
.
“আপনি তো চান নিয়তি সুখী থাকুক৷ নিয়তি সৎমার পাল্লায় পড়ে একটুও সুখের মুখ দেখতে পাইনি৷ এখন যখন তার জীবনে সুখ আসতেছে তখন নিয়তি বুঝতে পারছে না৷ নিয়তিকে বুঝিয়ে বলেন৷”
.
ছোঁয়া নিয়তির মামীকে ইমোশনাল কথা বলতে থাকে৷ যেন তিনি এই বিয়ে নিয়ে খুশি থাকেন৷ তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিছানার উপর বসে পড়েন৷ নিয়তির মামা বলে উঠেন,
“তোমরা তো অনেক দূর থেকে এসেছো৷ মনে হয় কিছু খাওয়া হয়নি৷ তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি৷”
“এভাবে বসে না থেকে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো৷ তাদের তো না খাইয়ে রাখতে পারি না৷”
.
“তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও৷ আমি তোমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি৷”
.
নিয়তির মামী চাউল নিয়ে রান্না বসান৷ খুব তাড়াতাড়ি গরম গরম ভাত রান্না করেন৷ গরম গরম ভাতের সাথে ডিম ভাজি করে নেন৷ তিনি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে বলে উঠেন,
“তাদের আজ রাতের জন্য খাবার হয়ে যাবে৷ আলুর বর্তা, ছোট মাছ, ডিম ভাজি৷”
________

নিয়তি আমতা আমতা করে বলে উঠেন,
“এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে? আমি আপনার সাথে ফিরে যাব না৷”
.
“তোমাকে ফিরে যেতে কে বলেছে? তোমাকে ফিরে যেতে হবে না৷”
.
নিয়তি মনে মনে বলে উঠে,
“কই বলবে আমি আমার কাজের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি৷ তুমি আমার সাথে যাবে৷ আমি তোমাকে নিতে এসেছি৷ সবকিছু ভুলে আমরা নতুনভাবে শুরু করবো৷
.
নির্বণ নিয়তির কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে,
“তুমি না যেতে চাইলে যাবে না৷ কিন্তু আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাব৷ এখানে তোমাকে থাকতে দিব না৷”
.
নিয়তির কানে এতোটাই নেশা ভরা কন্ঠে বলে যে নিয়তি কেঁপে উঠে৷ একদম জড়োসড়ো হয়ে দেয়ালের সাথে লেগে যায়৷ নিয়তি এমন অবস্থায় দেখে নির্বণের মাথায় দুষ্টামির বুদ্ধি কাজ করে৷ নির্বণ নিয়তির কোমরে হাত দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে৷ না চাওয়া সত্ত্বেও নিয়তির ঠোঁট জোড়া নির্বণের ঠোঁটে লেগে যায়৷ নিয়তি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,
“আপনি মনে হয় আজ কিছু খাননি৷ ফ্রেশ হয়ে নেন আমি খাবার নিয়ে আসছি৷”
.
“আমি কিছু খাবো না৷ আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে হবে না৷”
.
“আপনি এখনো অনেক অসুস্থ। খাবার না খেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন৷”
.
“আমার কিছু হবে না৷ আমি একদম ঠিক আছি৷ ছোঁয়ার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো৷ সে একদম ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না৷”
.
“আমি জানি, কে কে ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না? আর হ্যাঁ একটা কথা৷ গ্রামের খাবার শহরের খাবারের থেকে আলাদা৷ মামী যা খেতে দিবেন তাই খেয়ে নিবেন৷ মামী খুব যত্ন করে রান্না করেছেন৷”
.
তাদের কথা বলার মাঝেই দরজায় ঠকঠক শব্দ করে ছোঁয়া। ছোঁয়া দরজার বাহির থেকে বলে উঠে,
“দাদা তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছে৷ খেতে চলে আসো৷”
.
ছোঁয়া আর বিরক্ত না করে চলে আসে৷ নির্বণকে জোর করে নিয়তি নিয়ে আসে৷ মামী তাদের থালায় গরম গরম ভাত দেন৷ সাথে ডিম ভাজি, আলুর বর্তা, ছোট মাছ। ছোঁয়া প্রথম ভেবেছিল সে এসব খাবার খাবে না৷ নিয়তি চোখের ইশারায় খেতে বলে। ছোঁয়া এক লোকশা খাবার মুখে দিয়ে খুব তৃপ্তি পায়৷ তারপর কে আটকায় তাকে? একের পর এক লোকমা করে খাবার মুখে দিয়েই চলছে৷ মামী বলে উঠেন,
“আস্তে আস্তে খাও৷ খাবার মুখে আটকে যাবে৷”
.
ছোঁয়া জল খেয়ে,
“খাবারগুলো খুব টেস্ট। আমার খুব ভালো লেগেছে৷ আমাকে আরও ভাত দেন। আমি এসব খাবার কোনদিন খায়নি৷ এসব খাবারে এতো টেস্ট আগে জানতাম না৷”
.
নিয়তির মামী খুশি মনে ছোঁয়ার থালায় আরও কিছু পরিমাণ ভাত দেন। ছোঁয়া তো পাগলের মতো খেয়েই যাচ্ছে৷ ছোঁয়া খাওয়া দেখে নির্বণ মনে মনে বলে উঠে,
“রাক্ষস একটা। যেন কোনদিন খায়নি। কিভাবে পাগলের মতো খাচ্ছে? ভুলেই গেছে সে অন্য বাড়িতে আছে।”
.
নিয়তির মামী বলে উঠেন,
“তোমাকেও অল্প পরিমাণ ভাত দেয়৷”
.
“না মামী আমি আর খেতে পারবো না৷ খাবারগুলো খুব স্বাদ হয়েছে৷ আমার কাছে তো ছোট মাছটা বেস্ট হয়েছে৷”
.
“আর একটু ছোট মাছ নিয়ে নাও৷ আরও অনেকটুকু আছে৷”
.
“আমার পেটে আর কোন জায়গা নেই৷ আমি আর কিছু খেতে পারবো না৷ আপনি এতো রাতে আমাদের জন্য রান্না করতে গেলেন কেন?”
.
“তোমরা এতো দূর থেকে এসেছো। তোমাদের না খাইয়ে রাখতে পারি৷ আর অতিথি দেবঃভব।”

খাবার খাওয়ার পর নির্বণ নিয়তির সাথে ঘুমাতে যায়৷ ছোঁয়াকে একটা ছোট বিছানায় ঘুমাতে দেন৷ তারা মানুষ মাত্র দুইজন। তাই বিলাসিতার জন্য এতো কিছু করেননি৷ দুইটা বড় বড় বিছানা করেছেন৷ একটাতে তারা থাকেন৷ অন্যটায় কেউ আসলে তাদের জন্য৷ আগের ছোট একটা বিছানা আছে৷ সেটাও অনেক ভালো৷ একজন মানুষ অনায়াসে ঘুমাতে পারবে৷
.
ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“ছোট বিছানায় ঘুমাতে অসুবিধা হবে না তো৷”
.
ছোঁয়া হাসিমুখে বলে উঠে,
“একদমই না৷ আমার কোন অসুবিধা হবে না৷ আমি মানিয়ে নিতে পারবো৷”
.
“কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাও৷ শীত লাগবে৷”
.
“অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনারা ঘুম আসেন৷ আমিও ঘুমিয়ে পড়বো৷”
________

“আপনি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন৷ আমি মাদুর বিছিয়ে নিচে শুয়ে পড়ছি৷”
.
নির্বণ বিছানায় বসে আছে৷ নিয়তির কথার কোন জবাব দিল না৷ নিয়তি মাদুর বিছিয়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে৷ নির্বণ নিয়তিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাদুরের উপর শুয়ে পড়ে৷
.
“আপনি বিছানায় ঘুমাতে যান৷ আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।”
.
নির্বণ নিয়তির চুলে মুখ লুকিয়ে,
“আমি ফ্লোরে ঘুম আসলে আমার ঠান্ডা লেগে যাবে৷ কিন্তু তোমার ঠান্ডা লাগবে না৷”
.
“আমি মাটিতে শুয়ে অভ্যস্ত৷ আপনি তো মাটিতে ঘুম আসেননি কোনদিন।”
.
নিয়তির কথার কোন জবাব না দিয়ে নিয়তিকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে আসে। নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে৷ নিয়তি নির্বণের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলে নির্বণ আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। নিয়তি বাধ্য হয়ে সেভাবে ঘুমিয়ে পড়ে৷
.
সকাল বেলা ঢাকা ফিরার সময়….

চলবে…..

#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১২
#অধির_রায়

নিয়তি টলমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামা মামীর দিকে। চাহনি দেখে বুঝা যাচ্ছে নিয়তি কিছুদিন থেকে যেতে যায়৷ মনের কথা মুখে বলতে না পেরে মনের ইশারায় বলে যাচ্ছে৷ নিয়তির মামী সেই সকাল থেকে অনবরত কান্না করেই যাচ্ছে৷ চোখ থেকে অশ্রু পড়া বন্ধই হচ্ছে না৷ বুকটা ফেটে যাচ্ছে নিয়তির জন্য৷ নিয়তি ঢাকার উদ্দেশ্য বাহিরে পা রাখার আগেই নিয়তির মামী নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন৷ শাড়ির আঁচলে আর কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারলেন না৷ নিয়তির প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা দেখে নিয়তির মামা বসে থাকতে পারলেন না৷ তিনি নির্বণের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠেন,
“নির্বণ তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ ছিল৷ আমার অনুরোধটা রাখবে৷”
.
নির্বণ হাসিমুখে আশ্বাস দিয়ে,
“অনুরোধ নয়৷ আপনি আমাদের গুরুজন৷ আপনি আমাকে আদেশ করবেন৷”
.
ভেজা ভেজা নয়নে নির্বণের দিকে তাকিয়ে,
“তোমরা এই গরিব মামার বাড়িতে আর দুই দিন থেকে যাও৷ নিয়তি অনেক দিন পর আমাদের এখানে এসেছে৷ তোমরা থাকলে এক সাথে গ্রামটা ঘুরে দেখতে পারবে।”
.
“কিন্তু মামা…” নির্বণ কিছু বলার আগেই ছোঁয়া পাশ থেকে বলে উঠে,
“আমরা আরও দুইদিন থেকে যাবো৷ প্লিজ এভাবে কান্না করবেন না।”
.
ছোঁয়ার কথা শুনে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না৷ টুপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো৷ নিয়তির মামা মামীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা হাতে চাঁদ ফিরে পেয়েছেন। সত্যি বলতে ছোঁয়াও থেকে যাওয়ার ইচ্ছা৷ চা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা৷
________

নিয়তি চা বাগানের আঁকা বাঁকা মেঠোপথ ধরে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে৷ নির্বণ নিয়তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ আজ প্রথম নিয়তিকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে৷ ছোঁয়া নিজেকে ফটো ফ্রেমে বন্ধি করতে ব্যস্ত।
.
সিলেটের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে নজরকাড়া চা বাগানগুলোর সৌন্দর্য দেশী বিদেশী পর্যটকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে স্ব-মহীমায়। চা বাগানের পাশাপাশি সিলেটে রয়েছে রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, তামাবিল, জাফলং ও বিছানাকান্দি সহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে৷
.
সিলেট শহরের অদূরে চা বাগান অবস্থিত হওয়ায় প্রতি বছর অনেক লোক আসেন৷ সব থেকে বড় হলো যেকোন পথ থেকেই চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়৷ চা বাগানের চায়ের রং, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে সজীব প্রকৃতি। উচু-নিচু, টিলাঘেরা সমতলে সবুজের সমারোহ। যাকে বলে প্রকৃতির মিলন কেন্দ্র।
.
নির্বণ, নিয়তি, ছোঁয়া প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছে৷ তিন জনে মন থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করে যাচ্ছে। নিয়তি নির্বণের হাত ধরে মেঠো পথে হেঁটে যাচ্ছে৷ ছোঁয়া তাদের হেঁটে যাওয়াকেও ক্যামারা বন্ধি করতে ভুলেনি৷ চা বাগান ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে বুঝতেই পারেনি৷ তিনজনে সিলেট সুস্বাদু চা, ফুসকা, আইসক্রিম নাম না জানা আরও অনেক কিছুই খান৷ সন্ধ্যার দিকে সিলেট সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠেছে৷ লালচে সূর্যের কিরন চা পাতাকে রং বেরং এ সাজিয়ে দিচ্ছে৷ মামা মামী চিন্তা করবে তাই তারা জলদি বাড়ি ফিরে আসে।
.
রাতে সবার সাথে ডিনার করে যে যার মতো শুয়ে পড়ে৷ সব থেকে বড় সমস্যা হয় ছোঁয়ার৷ ছোঁয়ার ফোনে একটুও নেট পাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য ছোঁয়া আবিরের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না৷ কথা আটকে আটকে পড়ছে, না হয় ফোন কেটে যাচ্ছে৷ ছোঁয়া অভিমান, রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ে৷
.
নিয়তি নির্বণের থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে আছে৷ নির্বণের ভালো লাগছে না৷ নির্বণ পিছন থেকে নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে। নিয়তি ক্ষেপে কিছু বলতে নিয়েও থেমে যায়। ধীর গতিতে কোমল কন্ঠে আস্তে আস্তে বলে উঠে,
“আপনি দয়া করে আমাকে ঘুমাতে দেন৷ আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷”
.
নিয়তির চুলে মুখ লুকিয়ে নেশা ভরা কন্ঠে,
“আমারও ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ তুমি কাছে থাকলে ঘুমাতে পারবো। দূরে সরে গেলে ঘুম আসবে না৷”
.
নিয়তি কোন কথা না বাড়িতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়৷ নিয়তি ঘুমানোর পর নিয়তিকে একদম বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে ভাবে জড়িয়ে ধরে৷
——
আঁধার কাটিয়ে নতুন দিনের সূচনা করলেন সূর্যদেব। সকালে পাখির কিচির মিচির শব্দ শুনতে কার না ভালো লাগে৷ পাখিগুলো রাত না পোহাতেই কিচির মিচির শব্দ করতে থাকে৷ নির্বণ, নিয়তি, ছোঁয়া ফ্রেশ হয়ে সকালের সূর্য গায়ে মাখাতে ব্যস্ত। শীতের দিন সূর্যদেবের কিরণ আমাদের কাছে অমৃত। পিছন নিয়তির মামা ডাক দিয়ে বলে উঠেন,
“কই তোমরা? তোমাদের জন্য টাটকা খেজুরের রস নিয়ে এসেছি৷”
.
নিয়তি খেজুরের রসের কথা শুনে দৌড়ে মামার কাছে আসে৷ মামার দুই কাঁদে দুইটা মাটির কলসি ভর্তি খেজুরের রস নিয়ে এসেছেন৷ নিয়তি চকিত হয়ে,
“মামা এতো রস খাবে কে?”
.
নিয়তির মামা মুচকি হেঁসে বলেন,
“কে খাবে মানে? আমরা খাবো৷ তোমার মামীকে গ্লাস নিয়ে আসতে বলো৷”
.
মামী ট্রে করে তিনটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে আসতে আসতে,
“আমাকে ডাকতে হবে না৷ আমি হাজির হয়ে গেছি৷ বাচ্চাদের খেতে দাও তাড়াতাড়ি।”
.
“হুম খেতে দিচ্ছি৷ যতটুকু থাকবে তাদের জন্য পীঠা বানিয়ে দিবে৷”
.
নিয়তির মামা সবাইকে এক গ্লাস করে খেজুরের রস দেন৷ এক গ্লাস খাওয়ার পর তিনি আরও তাদের খেতে দেন৷ যতটা পারে সবাই প্রাণভরে টাকটা খেজুরের রস খেয়ে নেয়৷
____

জাফলং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে সবাই৷ আজ শুধু নির্বণ, নিয়তি, ছোঁয়া নয়৷ তাদের সাথে মামা মামীকেও সাথে নিয়ে এসেছে৷ নিয়তি চায় তাদের সাথে তার মামা মামীও আনন্দ পাক। তাদের ছেলে মেয়ে হলে কি তাদের ফেলে আসতো?

জাফলং (Jaflong) প্রকৃতির কন্যা হিসাবে পরিচিত। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে জাফলং সবার পছন্দ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারতের মেঘালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপলীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছেআকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেলপানি,উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদেরদারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিকস্পট, সৌন্দর্যের রাণী- এসব নামেও পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ভ্রমনপিয়াসীদের কাছে জাফলং এর আকর্ষণই যেন আলাদা। সিলেট ভ্রমনে এসে জাফলং নাগেলে ভ্রমনই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
.
নিয়তির মামী প্রবাহমান জলপ্রপাত দেখে ছোট বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে যাচ্ছে৷ নিয়তির মামা মানা করেই যাচ্ছে৷ কিন্তু তিনি নিজের আনন্দে মর্ত্য। কারো কথায় কান দিচ্ছেন না৷ তিনি আজ প্রথম এতো ভালোবাসা পেলেন৷ কেউ নিজেকে ক্যারামা বন্ধি করতে একদম ভুলে নি৷ স্বচ্ছ হিমেল পানিতে পা ঢুবিয়ে সবাই বসে আছে৷ সকলের মুখে হাসি৷ আজকের দিনটা তাদের জীবনে স্বরণীয় হয়ে থাকবে৷
.
নিয়তি স্পিড বোর্ডে ভয়ে নির্বণকে জড়িয়ে ধরে৷ নির্বণ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে,
“আমার একটু হলেও লজ্জা আছে৷ কিন্তু তোমার কোন লজ্জা নেই৷”
.
নির্বণের কথা শুনে নিয়তি নির্বণের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নির্বণ দুষ্টু হাসি দিয়ে,
“তুমি রাগ করলে তোমার অনেক কিউট লাগে৷ এভাবে মাঝে মাঝে আমার সাথে রাগ করবে৷”
.
“আমার কোন লজ্জা নেই।”
.
প্যাচার মতো মুখ করে,
“কতোগুলো মানুষের সামনে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছো।”
.
“আমি ভীতু নয়৷ আপনাকে ধরতে যাব কেন? নিজের উপর আমার আস্তা আছে৷”
.
নিয়তি নির্বণকে ছেড়ে দিলেও নির্বণ নিয়তিকে ছেড়ে দেয়না৷ নিজের সাথেই জড়িয়ে ধরে রাখে৷ নির্বণ কোমল মায়াভরা কন্ঠে,
“তুমি আমাকে ছেড়ে দিলেও আমি তোমাকে কোনদিন ছেড়ে দিব না৷ সব সময় তোমাকে আগলে রাখবো৷”
.
“ছোঁয়া নিজের কয়েকটা পিক তুলে তাদের রোমান্স ভিডিও করছে৷ ছোঁয়া মেয়েটা কি বিচ্ছু? কি বুচ্ছু?”
.
সারাদিন ইনজয় করে রাতে বাহিরে খেতে আসে সবাই৷ সবাই খুব ক্লান্ত সেজন্য আসার পর পরই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে মামীর ডাকে নিয়তির ঘুম ভাঙে৷ চোখ মেলে নিজেকে নির্বণের বুকে আবিষ্কার করে। লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে তাড়াতাড়ি করে কেটে পড়ে।
.
মামীর সাথে পিঠা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ মামী একা হাতে পারছিল না। সেজন্য নিয়তিকে ডাক দিয়েছেন৷ আজই তাঁরা চলে যাবে৷ মামী বেশি করে পিটা বানানোর ব্যবস্তা করেন৷ নিয়তির সাথে পিঠা দিয়ে দিবেন৷ মামা সকাল বেলা ঘুম থেকেই উঠে নিয়তির জন্য ছোট মাছ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন৷ মামী পিটা বানানোর পর নিয়তির পছন্দ মতো শুটকি মাছ দিয়ে কচুর শাক, নিজের পালিত দেশি মুরগি, গরুর মাংস। ছোট মাছ, মাছ ভাজি৷ তিনি কোন কিছুতেই ত্রুটি রাখতে চাননা৷ দুপুরে খাওয়ার পর ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে৷ নিয়তি মামা মামী তাদের গাড়ি চলে গেলেও তাকিয়ে আছেন৷ নিয়তির মামা মামীর চোখ তাদের যাওয়া প্রাণে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছেন৷ আর চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ নির্বণ যাওয়ার আগে তাদের বাসার ঠিকানা দিয়ে যায়৷ নিয়তির জন্য মন খারাপ হলে তাঁরা যেন চলে আসেন৷
_______
নিয়তি গাড়িতে বসে কান্না করে যাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে তার মামা মামীকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে৷ ছোঁয়া নিয়তিকে সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছে৷ ঢাকা ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে যায়৷ নিয়তি সবাইকে পিটা খেতে দিয়ে ঘুমাতে চলে যায়৷ নির্বণ ছোঁয়াও ঘুমিয়ে পড়ে৷
.
দুপুরে ঘুম ভাঙে নিয়তির। নির্বণের মায়ের জন্য খাবার বানায়৷ উনার হাত পায়ে মালিশ করে দেন৷ উনাকে খেজুরের রস গরম করে খেতে দেয়৷
.
রাতের খাওয়ার পর নিয়তি নির্বণের রুমে ঘুমাতে না গিয়ে নিজের দেওয়া রুমে ঘুমাতে যায়৷ কথা ছিল আজ থেকে নির্বণের রুমেই ঘুম আসবে৷ নির্বণ নিয়তির হাত ধরতেই…..

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here