#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পর্ব_১৯,পব_২০ (অন্তিম পর্ব)
#অধির_রায়
পর্ব_১৯
ডক্টর রিপোর্ট গুলো নির্বণের দিকে এগিয়ে দেন। নিয়তির করুণ চাহনি ডক্টরের দিকে৷ ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ ডক্টরের মুখ গুরুগম্ভীর হয়ে আছে৷ ডক্টর মলিন কন্ঠে,
“মিসেস নিয়তি আপনার লাইফ রিস্ক আছে৷ আমি চাই, আপনি সন্তানকে এবোরশান করে নেন৷”
.
ডক্টরের কথা শুনে নির্বণ, নিয়তি দুই জনই আকাশ থেকে পড়ে৷ নিয়তি ভাবতেই পারেনি এমন কোন আশঙ্কা ৷ নিয়তি চোখ মুখ শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে৷ দু’জনেই কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷ নির্বণ ভয়ে ভয়ে বলে উঠেন,
“ডক্টর আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আপনি ভালো করে আবার রিপোর্ট গুলো দেখেন৷”
.
“আমি কিছু ভুল বলিনি৷ গতকাল নিয়তির রিপোর্ট দেখে আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি৷ সেজন্য আজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়তির সবগুলো চেক আপ করিয়েছি৷”
.
নির্বণ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে উঠে,
“রিপোর্টে কি আসছে৷ প্লিজ আমাদের একটু বুঝিয়ে বলেন!”
.
ডক্টর দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলে উঠেন,
“নিয়তির দেহে হিমোগ্লোবিনের উৎপন্ন পরিমাণ খুব কম। যার ফলে প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্লাড উৎপন্ন হয়৷ এমন অবস্থায় আপনার স্ত্রী সন্তান নিলে আপনার স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের জীবন সংকট আছে৷ সেজন্য বলবো আগে আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলেন৷ তারপর আপনারা সন্তান নেওয়ার চিন্তা করেন৷”
.
নিয়তি চিৎকার করে বলে উঠে,
“আমি কিছুতেই আমার সন্তানকে হত্যা করতে পারবো না৷ আমি তাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসবো৷”
.
ডক্টর নিয়তির দিকে তাকিয়ে দু’জনকেই উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপনারা বুঝার চেষ্টা করেন৷ আপনার গর্ভে এখনো সন্তান আসেনি৷ এখনও ভ্রুণ রয়েছে৷ এমন অবস্থায় এবোরশান করলে কিছুই হবে না৷”
.
নিয়তি ডক্টরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“আপনি সব মিথ্যা বলছেন৷ আমি কিছুই বিশ্বাস করিনা৷”
.
নিয়তি দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়৷ নির্বণ নিয়তির পিছন পিছন দৌড়ে চলে আসে৷ এক দৌড়ে বাহিরে গাড়ির কাছে আসে৷ গাড়ির দ্বার খোলে গাড়িতে বসে কান্না শুরু করে। নির্বণ নিয়তির কাঁধে হাত রাখে৷
.
নিয়তি কান্না করতে করতে,
“আমি বাড়িতে যাব এখনই৷ আমি আর এক মিনিটও লেট করতে চাইনা৷”
.
নির্বণ নিয়তির মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না৷ ডক্টরের সাথে আর কিছু না বলেই নিয়তিকে বাড়িতে নিয়ে আসে৷
__________
নিয়তি চুপচাপ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়৷ নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলো না৷ পেটে হাত রেখে কান্না করতে থাকে। নির্বণ দরজার বাহির থেকে নিয়তিকে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে৷ নিয়তি কান্না করেই যাচ্ছে। নির্বণের কোন কথা নিয়তির কান অব্ধি পৌঁছাচ্ছে না৷ নির্বণের চিৎকারের শব্দ শুনে নির্বণের মা তাদের রুমের সামনে আসে৷ নির্বণের পীঠে হাত রেখে বলে উঠেন,
“নিয়তিকে কিছু সময়ের জন্য একা ছেড়ে দাও৷ সে কান্না করে নিজের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছে৷ কান্না করলে কষ্ট অনেকটা কমে যায়। ”
.
নির্বণ তাঁর মাকে নিয়ে তার মায়ের রুমে আসে৷ মায়ের কোলে মাথা রেখে নির্বণও কান্না করতে থাকে৷ নির্বণের মা নির্বণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ ছেলের কান্না দেখে মায়ের চোখও ছলছল করছে৷ চোখ থেকে না চাইতেও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷
.
কিছু সময় পর নির্বণের মা নির্বণের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। নির্বণের মাথায় বিলি দিয়ে,
“কি হয়েছে? তোমরা দু’জনেই এভাবে ভেঙে পড়ছো কেন?”
.
নির্বণ কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
“মা ডক্টর যা বলেছে সব ভুল বলেছে৷ নিয়তির কিছু হয়নি৷ সব রিপোর্ট ভুল এসেছে৷”
.
আভয় বানী দিয়ে বলেন,
“কি হয়েছে? আমাকে একটু খোলে বলো৷”
.
“আমাদের বাচ্চাকে এবোরশান করাতে বলে৷ নিয়তি তার সন্তানকে এবোরশান করাবে না৷ সে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চায়।”
.
“এবোরশানের পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে৷ কারণ ছাড়া ডক্টর এবোরশানের কথা বলতে পারতো না৷”
.
“নিয়তির দেহে ব্লাডের পরিমাণ খুব কম৷ ডক্টর বলেছে এমন অবস্থায় সন্তান নিলে লাইফ রিস্ক আছে৷ পরবর্তীতে সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷”
.
“ডক্টরের কথা মেনে নেওয়াই ভালো। আমি কাউকে আর হারাতে পারবো না৷ হারানোর কষ্ট আমি জানি৷ তুমি নিয়তিকে বুঝিয়ে বলো৷ সন্তান পরে নিতে পারবে৷ এখনো ভ্রুণ আছে৷ এবোরশান করলে তেমন কষ্ট হবে না৷”
.
“কিন্তু নিয়তি…”
.
নির্বণকে থামিয়ে দিয়ে,
“আমার কাছে নিয়তির জীবনের মূল্য অনেক বেশি৷ আমি চাইনা অকালে কেউ মৃত্যুর কোলে ঢেলে পুড়ুক।”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“ওকে মা৷ আমি নিয়তিকে বুঝানোর চেষ্টা করবো৷ এবোরশান একমাত্র রাস্তা তাকে বুঝাবো আমি।”
.
“তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে৷ তুমি নিয়তির কাছে যাও৷”
_________
নিয়তি কান্না করতে করতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে৷ নির্বণের ডাক শুনে নিয়তি দরজা খোলে। নির্বণকে দেখেই নিয়তি জড়িয়ে ধরে৷ কান্না করতে থাকে৷ মাথায় হাত ভুলিয়ে নিয়তিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে৷
.
রাতে না খেয়ে নিয়তি নির্বণকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে৷ নিয়তি ঘুমিয়ে পড়লেও নির্বণের চোখে ঘুম নেই৷ বার বার নিয়তির ইনোসেন্ট মুখটা দিকে তাকাচ্ছে। একদম ছোট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে৷
.
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে থেকে কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই৷ জীবন চলার পথে কতো বাঁধা কতো বিপদ আসে৷ এখন ধীরে ধীরে জীবন চলার পথের বাঁধা বিপত্তি গুলো জানতে পারছে৷
.
মাঝ রাতে নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়৷ নিয়তি ঘুম থেকে উঠে ডক্টরের কথাগুলো কানে বাজাতে থাকে৷ সব সময় এক কথা কানে বাজে এবোরশান৷ নিয়তি উঠে বসে৷ পেটে হাত দিয়ে,
“আমি তোমার কিছু হতে দিব না৷ আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাকে বাঁচাবো৷ তুমি কোন চিন্তা করো না৷ ডক্টরগুলো টাকার লোভে মিথ্যা কথা বলে৷”
.
নিজেকে নানা ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ শুকানো কথায় চিঁড়া ভিজে না৷ তেমনি যতই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন বারং বার এবোরশানের কথা কানে আসে৷
.
নির্বণের পায়ের কাছে বসে কান্না করে দেয়৷ কান্নার শব্দ পেয়ে নির্বণের ঘুম ভেঙে যায়৷ নির্বণ ঘুম থেকে উঠে দেখে নিয়তি আবারও কান্না করছে৷ নির্বণ নিয়তির কাছে আসে৷ নিয়তিকে বিছানায় বসিয়ে বলে উঠে,
“তুমি কি চাও? তুমি যা চাইবে তাই হবে! তোমার কথার কোন অমান্য করবো না৷”
কথাগুলো বলার সময় বার বার চোখে জল এসে পড়েছিল৷
.
নিয়তি নিজের উদরে হাত রেখে,
“আমি আমার বাচ্চার সাথে কোন অন্যায় করতে পারবো না৷ আমি আমার বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই৷”
.
নিয়তির চোখের জল মুছে দিয়ে,
“তুমি কোন চিন্তা করো না৷ তোমাকে এবং আমাদের ভালোবাসার কিছু হতে দিব না৷ আমি অন্য ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব তোমাকে৷”
.
নিয়তি হতভম্ব হয়ে বলে উঠে,
“আমি আর ডক্টরের কাছে যাব না৷ আমি ডক্টরদের বিশ্বাস করি না৷”
.
নির্বণ ভারী শ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে,
“আমি তোমার কথা রেখেছি৷ তুমি আমার কথা মতো চলবে এখন৷”
.
নিয়তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়৷ নিয়তির চোখ থেকে আবার অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নির্বণ নিয়তির চোখের জল মুছে দেয়৷ নিয়তিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে৷
_____
পরের দিন সকাল বেলা নির্বণ নিয়তি অন্য ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টর কিছু বলার আগেই নির্বণ বলে উঠে,
“আমি আগে আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই৷”
.
ডক্টর হাসি মুখে বলে উঠে,
“কোন কিছু লুকানোর প্রয়োজন নেই৷ আপনাদের কথা শুনে খুশি হলাম৷ অন্যরা তো লজ্জার কারণে বলতে পারে না৷”
.
নির্বণ মাথা নিচু করে,
“আমরা চাই আমাদের সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু নিয়তির দেহে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয় কম৷ এবোরশান ছাড়া এর থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই৷”
.
ডক্টর নির্বণ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে উঠেন,
“আমি আপনার কাছ থেকে কিছু লুকাতে চাইনা৷ আপনি যে সমস্যার কথা বললেন৷ সে সমস্যা থাকলে এবোরশান করাই ভালো৷ যদি এবোরশান না করে বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চান তাহলে একটা উপায় আছে৷”
.
নিয়তি আনন্দের সাথে বলে উঠে,
“কি উপায় ডক্টর? যতই কষ্ট হোক না কেন, আমি সব সহ্য করে নিব৷”
.
“আপনাকে প্রচুর পরিমাণ সবুজ শাকসবজি, ফলমূল খেতে হবে৷ মেডিসিন রেগুলার খেয়ে যেতে হবে৷ সব থেকে বড় কথা হলো…”
.
নির্বণ অতি আগ্রহ নিয়ে,
“কি হলো থেমে গেলেন কেন? আমরা সব কিছু করতে প্রস্তুত৷ নিয়তিও ভালো থাকবে তো৷ আমি মা, বাচ্চা দুই জনকেই চাই৷”
.
ডক্টর মলিন কন্ঠে,
“আপনার স্ত্রীর বাচ্চা নরমালে হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ রিপোর্ট দেখে যা বুঝতে পারলাম৷ অপারেশনের সময় আপনার স্ত্রীর প্রচুর পরিমাণের রক্ত ক্ষরণ হবে৷ তখন উনার জীবন সংকটে পড়তে পারে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্লাড না পাওয়া যায়।”
.
নির্বণ নিয়তির দিকে তাকিয়ে,
“আপনাকে ব্লাড নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি ব্লাডের ব্যবস্থা করে নিব।”
.
নিয়তিও মনে ভয় নিয়ে মুখে সাহস দেখিয়ে বলে উঠে,
“আপনাকে ব্লাড নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে৷ আপনি আমার সন্তানকে ভালোভাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন৷ সবকিছু সৃষ্টি কর্তার হাতে আমি অর্পণ করলাম৷ আমি জানি উনি আমাদের সাথে খারাপ কিছু করবেন না৷”
.
ডক্টর মুচকি হেঁসে,
“আপনাদের মনে সব সময় এমন সাহস বজায় রাখবেন৷ দেখবেন সৃষ্টি কর্তা আপনাদের নিরাশ করবেন না৷”
.
নিয়তিকে উদ্দেশ্য করে,
“আপনাকে প্রতি মাসে চেক আপ করতে হবে৷ মেডিসিন মিস দেওয়া কোন ভাবেই চলবে না৷ আমার কথামতো সব সময় চলতে হবে৷ আমি আপনাকে একটা রুটিন করে দিব চব্বিশ ঘণ্টার৷”
.
নিয়তি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠে,
“কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি সব সময় আপনার কথা মতো চলবো৷ আমি আমার সন্তানের গায়ে কোন প্রকার আঁচ লাগতে দিব না৷”
.
পৃথিবীতে মা জাতীর কোন তুলনা হয়না৷ নিজের জীবন নিশ্চিত সংকটে জেনেও সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে ব্যস্ত। পৃথিবীর সকল মা জাতীর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা রইল।
চলবে…..
#এক_চিলতে_সিঁদুর
#পব_২০ (অন্তিম পর্ব)
#অধির_রায়
দেখতে দেখতে বয়ে যায় সময়৷ এগিয়ে আসতে থাকে হারানোর সুর৷ নিয়তি এখন আগের মতো চলাফেরা করতে দেয় না৷ নির্বণ অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ নিয়তির খেয়াল রাখে আর কিছ অফিসের কাজ অনলাইনে করে৷
.
গভীর রাতে নিয়তির ঘুম ভেঙে যায়৷ নিয়তি কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না৷ গর্ভের ভিতর বাচ্চা নাড়াচাড়া করছে। পেটে লাথী দিচ্ছে৷ নিয়তি সহ্য করতে না পেরে নির্বণকে ডাক দেয়৷ নির্বণ ধর ফরিয়ে উঠে বসে। নিয়তি পেটে হাত রেখে কান্না করে যাচ্ছে৷ নির্বণ নিয়তিকে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে তুলে বসায়৷ বাচ্চা একটু শান্ত হলে নির্বণ বাহিরে যেতে নিলেই নিয়তি তার হাত ধরে ফেলে৷ নির্বণ অবাক চোখে নিয়তির দিকে তাকায়৷
.
নিয়তি কান্না জনিত কন্ঠে বলে উঠে,
“আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই৷ আমার কথা রাখতে হবেই
.
নিয়তির মুখে হাত রেখে,
“এখন কোন কথা নয়৷ আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছি৷”
.
ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো,
“আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না৷ আমি কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চাচ্ছি৷ কথা গুলো পরবর্তীতে বলার সুযোগ নাও পেতে পারি৷”
.
নিয়তির এমন কথা নির্বণের বুকে বিষাক্ত তীরের মতো লেগেছে৷ নির্বণ বুকে চিন চিন ব্যথা অনুভব করতে থাকে৷ অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে৷ নির্বণ মুচকি হেঁসে,
“কোন কথা নয়৷ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো!”
.
নিয়তি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কথা গুলো না বলতে পারলে আমার ঘুম আসবে না৷ কথাগুলো আমাদের ভালোবাসা এবং আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে৷”
.
নির্বণ মলিন হেঁসে বলে উঠে,
“তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি কালই গাড়ি পাড়িয়ে তোমার মামা মামীকে নিয়ে আসবো৷ তাদের জন্য তোমার মন খারাপ করছে।”
.
নিয়তি চোখ বড় করে বলে উঠে,
“আমি মামা মামীর কথা বলতে….”
.
নিয়তিকে থামিয়ে,
“আরে লজ্জা কিসের? আমি জানি তুমি তোমার মামা মামীকে খুব মিস করছো? তোমার মামী এই তো বলেছেন তারা খুব তাড়াতাড়ি আসবেন৷”
.
নিয়তি নির্বণের কথা আর নিতে পারছে না৷ নিয়তি উচ্চ স্বরে কান্না শুরু করে দেয়৷ নির্বণ নিয়তির চোখের জল মুছে দিতে নিলেই নিয়তি নির্বণের হাত ধরে ফেলে৷ নির্বণের হাত পেটে নিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বলে উঠে,
“আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি আমার সন্তানকে কোনদিন অবহেলা করবেন না৷ আমাকে কথা দেন৷”
.
নিয়তির কথাগুলো একদম বুকের মাঝে তীরের মতো লাগল৷ নির্বণের চোখ ছলছল করছে৷ নির্বণ এক বুক কষ্ট নিয়ে কোন কথা না বলে মূর্তির ন্যায় বসে আছে৷ নিয়তি নির্বণকে হালকা ধাক্কা দেয়৷ নির্বণের বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসে।
.
“আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আমাকে কথা দেন, আমার সন্তানের কোন অবহেলা করবেন না৷”
.
নিয়তিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে৷ নির্বণ কান্না জনিত কন্ঠে,
“আমি তোমার কিছু হতে দিব না৷ আমাকে যদি তোমার এবং আমার সন্তানের মাঝে একজনকে বেছে নিতে বলে আমি তোমাকে বেছে নিব৷”
.
নিয়তি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে,
“আমি আমার সন্তানের গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দিব না৷”
.
নির্বণ মায়া ভরা কন্ঠে আটকে আটকে বলে উঠে,
“তোমার কিছু হলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না৷”
.
নির্বণের মুখে আঙুল দিয়ে,
“এমন বাজে কথা কখনো মুখে আনবেন না৷ আমি না থাকলেও আমার সন্তান আপনার সাথে থাকবে৷ আমাদের ভালোবাসার জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন৷ আপনাকে বেঁচে থাকতেই হবে আমাদের ভালোবাসার জন্য।”
.
নিয়তিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে,
“আমি তোমাকে ছাড়া একদম বেঁচে থাকতে পারবো না৷ তুমি আমার নিঃশ্বাস৷ তুমি আমার শ্বাস প্র-শ্বাসে জড়িয়ে আছো৷”
.
নিয়তি নিজের চোখের জল মুছে,
“এভাবে ভেঙে পড়বেন না৷ আপনি আমার শক্তি। আপনি ভেঙে পড়লে আমিও যে ভেঙে পড়বো৷”
.
“আগে বলো, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না৷ আমি সব সময় আমাদের ভালোবাসা এবং তোমাকে আগলে রাখবো৷”
.
নিয়তি নিজের কষ্ট লুকিয়ে রেখে বলে উঠে,
“আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে৷ আমি এখন ঘুম আসবো৷”
.
নির্বণ নিয়তি আলতো করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
________
পরের দিন রাতের বেলা নিয়তির মামা মামী এসে হাজির৷ নিয়তি খুব খুশি আজ৷ মামীর সাথে মন খোলে কথা বলছে৷ মামীর কোলে মাথা রেখে নিয়তি শুয়ে আছে৷ মামী নিয়তিকে রুপকথার বিভিন্ন গল্প শুনাচ্ছেন৷ গল্প শুনতে শুনতে কখন যে নিয়তি ঘুমিয়ে পড়ে জানা নেই!
.
।
।
দেখতে চলে আসে সেই দিন৷ হসপিটালের করিডরে সবাই বসে আছে৷ নিয়তিকে রক্ত দিবে তার মামী৷ মামীর রক্তের গ্রুপের সাথে নিয়তির রক্তের গ্রুপের মিল আছে৷ নিয়তিকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাওয়ার আগে সেখানে উপস্থিত হয় আগুন চৌধুরী৷ নিয়তি চোখ আকাশ প্রাণে আগুন চৌধুরীকে দেখে৷ আগুন চৌধুরী সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমিও নিয়তিকে রক্ত দিব৷ আমার ব্লাড গ্রুপের সাথে নিয়তির ব্লাড গ্রুপের মিল আছে৷”
.
আগুন চৌধুরীর কথা শুনে নির্বণ নিয়তি দুই জনই চকিত হয়ে যায়৷ আগুন এসব কিছু কিভাবে জানতে পারলো? সকলের এমন অবস্থা দেখে আগুন চৌধুরী বলে উঠে,
“নিয়তিকে বিকেল চারটার দিকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাবে তো৷ নিয়তি তুমি কোন চিন্তা করবে না৷ তোমার কিছু হবে না৷”
.
নিয়তির মনে ভয় কাজ করছে৷ নিয়তির একমাত্র উক্তি,সে তার বাচ্চাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাবে৷ কান্না করেই যাচ্ছে নিয়তি৷
.
নির্বণকে দেখে হবে হচ্ছে কোন মানসিক হসপিটাল থেকে পালিয়ে এসেছে৷ ঠিলেঠালা পোশাক পড়ে আছে৷ চুলগুলো উসকো খুসকো। আগুন চৌধুরী তাদের সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে৷
.
আগুন চৌধুরী নিয়তিকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলে৷ যেদিন নিয়তিকে তার মনের কথা বলতে যাবে সেদিন জানতে পারে নিয়তি বিবাহিত। নিয়তির হাসব্যান্ড হলো নির্বণ৷ আগুনের ভুলের জন্য যে মৃত্যুর পথে ধাপিত হয়েছিল৷ ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে কোন কথা নেই৷ দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। ত্যাগের মাঝে ভালোবাসা নিহিত। আগুন মন থেকে সারাজীবন নিয়তিকে ভালোবেসে যাবে৷ কিন্তু আগুনের ভালোবাসা হলো এক প্রেক্ষিক ভালোবাসা৷ আগুন ভেবে নিয়েছে, নিয়তির সুখে না থাকতে পারলেও নিয়তির বিপদে সব সময় পাশে থাকবে৷ সেজন্য আগুন চৌধুরী সব সময় নিয়তির উপর নজর রাখতো৷
______
অপারেশন থিয়েটারের সামনে কান্না রুল পড়ে গেছে৷ নিয়তির মামী কান্না করেই যাচ্ছেন৷ নির্বণের চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নিয়তি নির্বণের হাত ধরে আছে৷ ডক্টর তাড়া দিচ্ছে৷ তবুও কোন কথা শুনছে না নিয়তি৷ নিয়তি নির্বণের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে৷
.
নিয়তি কান্না করতে করতে বলে উঠে,
“আমার সন্তানকে কখনো অবহেলা করবেন না৷ সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবেন।”
.
নির্বণ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
“কোন কথা বলবে না৷ তোমার মাথায় বাজে চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু আসে না৷ ভালো কিছু ভাবতেও তো পারো।”
.
নিয়তি মলিন হাসি দিয়ে,
“ভালো ভাবলেই কি হবে? আমি আমার মায়ের কাছে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারবো৷ কোনদিন মায়ের ভালোবাসা পায়নি৷ মৃত্যুর পর মায়ের ভালোবাসা পাবো৷”
.
মামীর হাত ধরে মামীকে উদ্দেশ্য করে,
“মামী তুমি আমাকে তোমার মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসা দিয়েছো৷ তুমি আমার জন্য যা করেছো নিজের মা থাকলেও এমন করতো না৷”
.
মামী নিয়তির কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে,
“তোমার কিছু হবে না৷ আমি তোমাকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনি।”
.
“মামী আজ তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো তুমি আমায় দিবে৷”
.
“আমি তোমার জন্য আমার জীবন দিয়ে দিতেও প্রস্তুত৷ তোমার জন্য আমি সব করতে পারবো৷”
.
“তুমি আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছো আমার সন্তানকে ততটাই ভালোবাসা দিবে৷ আমি না থাকলে মায়ের অভাব বুঝতে দিবে না৷ আর একটা সুযোগ দিবে৷”
.
“আমি সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করবো৷ তোমার কিছু হবে না৷ সৃষ্টি কর্তা আমার মেয়েকে কেঁড়ে নিতে পারবে না৷”
.
“আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে ‘মা৷’ অসহায় দৃষ্টিতে মামীর দিকে তাকিয়ে আছে।
.
মামী নিয়তিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়৷ কান্না করতে করতে বলে উঠেন,
” আজ থেকে আমার কোন আফসোস নেই৷ আমি আমার মেয়েকে পেয়ে গেছি৷”
.
ডক্টর তাড়া দিয়ে,
“প্লিজ এখানে ভিড় করবেন না৷ আমাদের কাজ করতে দেন৷”
.
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিয়তিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান৷ আগুন চৌধুরী এক পাউন্ড ব্লাড, মামী এক পাউন্ড ব্লাড দেন৷ নির্বণ মাথা চেপে ধরে করিডরে আসে আছে৷ নির্বণকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে আগুন৷ কিন্তু আগুন চৌধুরীর কোন কথা নির্বণের কান অব্দি যাচ্ছে না৷ নিয়তির কথাগুলো নির্বণের কানে বাজছে৷
________
বাচ্চার কান্নার শব্দে সকলের মুখে হাসি ফুটে৷ কিন্তু নির্বণ একদম ভেঙে পড়ে৷ নির্বণ নিয়তি বলে চিৎকার করে উঠে৷ নির্বণের আর কিছু মনে নেই৷ নিয়তি বলার পরই নির্বণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
.
নির্বণের জ্ঞান ফিরে আসার পর আগুন চৌধুরী কোলে করে নির্বণের বাচ্চাকে নিয়ে আসে৷ নির্বণ বাচ্চার দিকে না তাকিয়ে বলে উঠে,
“আমার নিয়তি কোথায়৷ আমি নিয়তি কাছে যেতে চাই৷”
.
নার্স বলে উঠেন,
“মা ও ছেলে দু’জনই ভালো আছে৷ আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারেন৷”
.
নির্বণ ছেলেকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে নিয়তির কেবিনে প্রবেশ করে৷ ছেলেকে মামীর কাছে দিয়ে নিয়তিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে,
“হ্যাঁ সৃষ্টি কর্তা, আপনি আমাদের কথা রেখেছেন৷ আমার আর কিছু চাওয়া নেই আপনার কাছে৷”
______
নির্মল তার বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে খেলছে৷ নিয়তি বাবা, ছেলের এমন কান্ড দেখে হেঁসে বলে উঠে,
“ছেলেকে পেয়ে আমার কথা ভুলেই ছেলে৷”
.
নির্বণ ছেলের কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে,
“নির্মল তুমি তোমার দাদুর কাছে যাও৷ তোমার দাদু তোমাকে ডাকছে৷”
.
নিয়তি চোখ ছোট করে,
“নির্মল কোথাও যাবে না৷ বাবা আমার কাছে আসো৷ আমরা খেলা করবো৷”
.
নির্বণ ছেলে নির্মলকে কোলে নিয়ে মামীর কাছে দিয়ে আসেন৷ মামা মামীকে আর যেতে দেয়নি৷ মামা মামীকে এখানেই রেখে দিয়েছে৷
.
নিয়তি পিছন ফিরে চলে আসতে নিলেই নির্বণ নিয়তির কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়৷ নিয়তির ঘাড়ে ডিপ কিস দিয়ে,
“তুমি সারা জীবন আমার ভালোবাসার সঙ্গী হয়ে থাকবে৷ তোমাকে কেউ আমার কাছ থেকে আলাদা করতে হবে না৷”
.
নিয়তিও নির্বণকে জড়িয়ে ধরে,
“আমি এক চিলতে সিঁদুর নিয়ে মরতে চাই৷ আমি থাকতে আপনার কিছু হতে দিব না৷ আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি৷”
সমাপ্ত