#এক_চিলতে_হাসি,০২ শেষ_পর্ব
#আসেফা_ফেরদৌস
একটু এগিয়ে গিয়ে কী ভেবে ফিরে তাকাল পুষ্পা। শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মাঝখানে স্বচ্ছ কাঁচের দরজা। পুষ্পা হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ইশারায় বলল, ফোন করবে পরে। এরপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।
চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছিল শিহাবের। স্পষ্ট বুঝে গিয়েছে, ওর আর পুষ্পার সম্পর্কটা তার দিক থেকে আর বন্ধুত্বের পর্যায়ে নেই। তারচেয়েও অনেক বেশি গভীর হয়ে গিয়েছে হয়ত।
চুপচাপ বসে এসবই ভাবছিল শিহাব। চোখটা বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গেই মনের পর্দায় ভেসে উঠল দৃশ্যটা। আগের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছে সে এবার। হৃদয় গভীরে গুমরে উঠছে চাপা অসহ্য কষ্ট! শিহাব আপনমনে বলল, অনেক কিছু বলার ছিল পুষ্পা তোকে, কিন্তু জানতামই না, জীবনের জার্নিটা তোর সঙ্গে করার কত ইচ্ছে ছিল, তোর লজ্জারাঙা হাসিমুখ প্রতিদিন দেখার কেমন প্রতীক্ষা ছিল, হ্যাঁ আমাদের এই ভালো লাগারও একটা গল্প ছিল, যে গল্পের মোড়টা অন্যরকম হলেও হতে পারত, বিশ্বাস কর আমি সবটা বলতে চাই! কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে!
লম্বা একটা দম নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে শিহাব। হেঁটে গিয়ে বাতি জ্বালাল। ঘড়িতে চোখ চলে গিয়েছে নিজের অজান্তেই। সময় রাত আটটা পঁচিশ। আপন ভাবনায় হারিয়ে গিয়ে কফিটা কখন শেষ করছে ও নিজেও বলতে পারবে না। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। আচ্ছা, আরও এক মগ কফি খেলে কি ভালো লাগবে? না, থাক!
মনটা ভীষণ অস্থির। বিছানায় এসে বসল শিহাব। এমন সময বাজল ফোন। ফোনটা পুষ্পার।
ও তাকিয়ে আছে। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সবসময় বোধহয় চাইলেও ইচ্ছে অনিচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়া যায় না। তাই বেশ কয়েকটা রিং হয়ে যাবার পর মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে শিহাব বলল, বল, পুষ্পা।
ব্যস্ত নাকি শিহাব?
হ্যাঁ ভীষণ ব্যস্ত। দম ফেলার সময় নেই আমার একদম!
কেন হঠাৎ কী হলো আবার?
সব কথা তো সবাইকে বলা যায় না!
ওহ্ আচ্ছা! পুষ্পা শব্দ করে হাসছে। বলল, আচ্ছা কেন ব্যস্ত সেটা নাহয় না ই বললি, আমার পেছন পেছন এসেছিলি কেন সেটা তো বলবি!
এবার শব্দ করে হাসল শিহাব। বলল, সবার সব কথা বলা হয় না পুষ্পা, কিছু কথা কারো অজানা থেকে যাবে এটাই হয়ত ভাগ্য।
আরে! ফস করে মুখের উপর কথা বলা তুই আজ দার্শনিকদের মতো কথা বলছিস সমস্যাটা কী?
হ্যাঁ, অনেক বড়ো সমস্যা আসলে, কিন্তু সেটা এ মুহূর্তে আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত না, তুই বল, শফিক ভাই কি তোকে বাসায় ড্রপ করেছেন আজকে?
না, না, অযথা কেন তাকে কষ্ট দেবো, উনি উনার বাসায় গিয়েছেন, আমি উবার নিয়ে ফিরেছি! রোজা রেখে ক্লান্ত ছিলাম বেশ, বাসে উঠতে ইচ্ছে হয়নি।
শিহাব চুপ করে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে কেমন যেন, মনের কথাগুলো আটকে আছে মুখে। ভীষণ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বলা যাচ্ছে না। ও একটা দম নিয়ে বলল, আচ্ছা আমি রাখিরে। ঘুমাব এখন।
-আরে আশ্চর্য! তুই নিজের এত গুরুত্ব বাড়াচ্ছিস কেন? পরিস্কার করে কথা বল! আমি জানি এ মুহূর্তে কোনো কাজ নেই তোর, শুয়ে বসে আছিস, অযথা মিথ্যে বলবি না! কয়েকদিন থেকেই দেখছি তুই কেমন যেন বদলে যাচ্ছিস, চুপচাপ থাকিস, সারাক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে তাকাস আমার দিকে, ঘটনা কী? কী হয়েছে বলবি তো, না বললে বুঝব কী করে?
শিহাব হাসল আবার। বলল, জেনে খুশি হলাম যে, এই কদিনে আমাকে লক্ষ্য করার মতো সময়টা তুই পেয়েছিস, তবে গত কদিনে আমিও অনেক কিছু খেয়াল করেছি পুষ্পা, শুধু তোর মতো অভিযোগটা করিনি।
চুপ করে গেল পুষ্পা। লম্বা একটা দম নিয়ে, মায়াভরা কন্ঠ জানতে চাইল, হয়েছেটা কী শিহাব, খুলে বল প্লিজ! আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছিস?
এত আহ্লাদ করে জানতে চাস না তো, মুখ ফসকে সত্যিটা বেরিয়ে গেলে ভালো লাগবে না তোর!
পুষ্পা হাসছে। বলল, ভালো লাগবে না মন্দ লাগবে সেটা আমি বুঝব, তুই প্লিজ এত নাটক না করে সত্যি কথাটা বল তো দেখি!
শিহাব চুপ করে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না, সত্যি জানলে মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়বে নির্ঘাত। কিন্তু এখন কী বলে কথা ঘোরাতে হবে জানা নেই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও বলল, পুষ্পা, আমি আসলে নিজের মধ্যে কথা চেপে রাখতে খুব একটা পটু নই, তাছাড়া, জীবনে কষ্ট আঁকড়ে বসে থাকাও স্বভাব না আমার, জীবনে যা পেয়েছি, তাতেই খুশি থাকতে চেষ্টা করেছি সবসময়, যা পাইনি তা নিয়ে খুব একটা আক্ষেপ করিনি। কিন্তু গত কদিন ধরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে জানিস, তোর উপেক্ষা আমি মেনে নিতে পারছি না, শুধুমাত্র বন্ধুর জন্য এতটা কষ্ট তো হবার কথা নয়, আসলে আমি জীবনের সুখ দুঃখ জড়িয়ে ফেলতে শুরু করেছি তোর সঙ্গে, বারবার ভেবে চলেছি তোর সঙ্গে জীবনটা কাটলে, আমাদের আনন্দ বেদনাগুলো কতটা রঙিন হতো, জীবনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, হাসি কান্নার মিলনমেলা কেমন হতো, জীবনের পথে আমরা যদি পরস্পরের হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতাম, তবে সে যাত্রাটা কেমন হতো, কিংবা প্রতিদিন খাবার টেবিলে আমার পাশে যদি তুই বসতি তাহলে কেমন হতো, আমাদের দুজনের একটা সংসার হলে কেমন হতো! আসলে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি পুষ্পা! কিন্তু তুই আমার কাছে, শুধু একটা লালিত স্বপ্ন হয়েই থেকে গেলি! যাকে গোপন করা যায়, কিন্তু হয়ত আপন করা যায় না!
এ কথার পর খানিকক্ষণ নীরবতা। শিহাব বুঝতে পারছে, বলাটা বেশি হয়ে গেছে। ও সামলাবার জন্য বলল,দ্যাখ পুষ্পা, সমস্যাটা আমার, তুই প্লিজ এসব নিয়ে মাথা ঘামাবি না, ভুলে যাবি এই কথাগুলো এক্ষুনি, আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না দেখেই সরাসরি বলে ফেললাম। একসময়ের বন্ধু ভেবে ক্ষমা করে দিস। আর প্লিজ ভুলেও শফিক ভাইকে বলবি না কিছু!
হঠাৎ ফোনের ও প্রান্তে কেমন যেন একটা শব্দ হলো, পুষ্পা হাসছে না কাঁদছে বোঝা মুশকিল! ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে শিহাবের।
ও কী বলবে ভাবছে, ঠিক এমন সময় পুষ্পা বলল, শফিক ভাই একটা জিনিয়াস! উনি যে এত মেধাবী বিষয়টা আমি আগে বুঝতে পারিনি! আসলেই শফিক ভাইয়ের জুড়ি মেলা ভার! ইশ, কী যে আনন্দ হচ্ছে!
রেগে গেল শিহাব। বলল,আ্যই তুই কি বুঝতে পারছিস আমার মানসিক অবস্থাটা এখন কেমন? সবসময় হাসি ঠাট্টা করি বলে কি আমার কষ্ট হয় না? দ্যাখ পুষ্পা, শফিক ভাই ভীষণ ভালো মানুষ, সেটা আমারও জানা, কিন্তু এ মুহূর্তে তোর মুখ থেকে তার গুনগান শুনতে পারব না, সরি! আমি এত ভালো মানুষ না!
অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে পুষ্পা। বলল, আহারে! তোর চেহারাটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে শিহাব, দাঁড়া, আমি নাহয় ভিডিও কল দেই।
না, না, পুষ্পা, প্লিজ! এ মুহূর্তে তোর মুখোমুখি হতে পারব না আমি! ক্ষমা কর।
হাসছে পুষ্পা। বলল, আচ্ছা, মেনে নিলাম যা, কিন্তু ইদের ছুটির পর যখন অফিসে দেখা হবে তখন কী করবি? পালিয়ে বেড়াবি সারাক্ষণ, নাকি চাকরিই ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছিস?
জানি না! সোজাসাপ্টা উত্তর শিহাবের।
আবার শব্দ করে হাসল পুষ্পা। বলল, আজ যে কথাগুলো তুই বললি শিহাব, তেমনই কিছু গত কয়েকমাসে আমিও তোকে বলতে চেয়েছি বহুবার। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। তোর উত্তর কী হবে তা ভেবে ভয় পেয়েছি বারবার, সবসময় মনে হতো নিশ্চয় তোর পছন্দের কেউ আছে। তোর প্রতি আমার এই দুর্বলতার ব্যাপারটা শফিক ভাই কীভাবে যেন আঁচ করে ফেলেছিলেন, একদিন কথায় কথায় সত্যটা তিনি জানতে চাইলেন।
আমি আমার মনের অবস্থা, সিদ্ধান্তহীনতা সবটা বললাম, বুদ্ধিটা তখন তিনিই দিলেন, বললেন, কয়েকদিন তোর প্রতি আমি মনোযোগটা একটু কম দিতে, যদি তোর মনে আমার প্রতি কোনো ভালোলাগা, ভালোবাসা থেকে থাকে তবে আমার অভাব এসময় তুই নিশ্চয় অনুভব করবি যেটা তোর আচরণে স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ পাবে। এবং দ্যাখ, কথাটা শতভাগ সত্য হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই, তুই কেমন গড়গড় করে মনের সব কথা বলে ফেললি!
শিহাব বিস্মিত! বলল, এই যে কদিন ধরে তুই আর শফিক ভাই এত হাসাহাসি, গল্প গুজব করলি সব তাহলে আমাকে দেখানোর জন্য? আশ্চর্য তো! শফিক ভাই ভেতরে ভেতরে এত চালাক? উনাকে তো একদম সরল সোজা মানুষ ভাবতাম, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না! অথচ তিনি তো দেখি আমার উপরই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন! মারাত্মক ব্যাপার!
শিহাবের কথা শুনে পুষ্পার পক্ষে হাসি থামানো কষ্টসাধ্য। কোনো রকমে বলল, কেনরে, যাদেরকে নিয়ে তুই প্রায়ই হাসাহাসি করিস, তারা তোকে বোকা বানিয়ে মনের কথাটা বের করে নিয়েছে ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে?
যা কথা বলব না! শিহাব মেকী রাগ দেখিয়ে বলল।
উত্তরে উচ্ছল হাসি পুষ্পার।
শিহাব চুপ করে আছে।
একটু পর পুষ্পা বলল, আচ্ছা হয়েছে, হয়েছে! ম্যুডটা ঠিক কর এখন! বল তো, আংকেল আন্টির জন্য শপিং শেষ?
না, এখনো না, দেখি কালকে যাব হয়ত।
ভালো কথা আমারও কাল একবার শপিঙে যাবার ইচ্ছে আছে। আচ্ছা শিহাব চল না, কাল আমরা নাহয় একসঙ্গে বাইরে ইফতার করি!
কেন?
ওমা, তুই, জীবন, স্বপ্ন, আপন, গোপন এত কথা বললি, কথাগুলো আরো বিস্তারিতভাবে শুনতে হবে না? তবেই না মনটা ভরবে।
হেসে ফেলল শিহাব। বলল, আচ্ছা,তুই কি ইফতার খেতেও ব্যাগে করে বিস্কুট নিয়ে আসবি?
ইফতারের পর তুই চা খাওয়ালে অবশ্যই নিয়ে আসব। চা তুই খাওয়াচ্ছিস,আর আমার প্রিয় ব্র্যান্ডের বিস্কুটটা সঙ্গে থাকবে না তা কি হয়, আসলে এই বিস্কুটটা ছাড়া চা খেয়ে আমি মজা পাই না!
শিহাব উত্তর দিলো না। হাসছে চুপচাপ।
পুষ্পা বলল,কেন, আমি সঙ্গে করে বিস্কুট নিয়ে এলে তুই বুঝি বিরক্ত হবি? সেটা কি ঠিক হবে বল, আমাকে যখন ভালোবেসে ফেলেছিস,তখন, আমার এই অদ্ভুত অভ্যাসগুলোকেও যে একটু আধটু ভালোবাসতে হবে!
হেসে ফেলল শিহাব, ভীষণ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোর এই অভ্যাসগুলো আমি প্রচন্ড ভালোবাসি পুষ্পা, কারণ এগুলোই তোকে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা করে। কিন্তু সব কথা একবারে বলে ফেললে সমস্যা, মেয়েটা হাসাহাসি করতে পারে। ও বলল, মনের সব কথা একবারে জেনে নিতে নেই পুষ্পা!
পুষ্পা হাসছে। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আচ্ছা শিহাব এবার তো ঢাকায় তোর প্রথম ইদ না রে?
হ্যাঁ কেন?
বাড়িতে তো অনেক ইদ করেছিস, ভীষণ আনন্দও করেছিস নিশ্চয়, বলছি তোকে শুনে রাখ, ঢাকার ইদও কিন্তু কম আনন্দের না, ইদের ঢাকা অন্যরকম, ঢাকার রাস্তা অন্যরকম, উৎসব আনন্দ অন্যরকম! মন খারাপ করে বসে না থেকে আনন্দটা উপোভোগ করিস কিন্তু! আমিও দেখি ইদের দিন দুজন মিলে কিছু প্ল্যান করা যায় কি না!
আচ্ছা দেখা যাক! বলল শিহাব। ওর ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়েছে এক চিলতে মিষ্টি হাসি। ভাবছে, আসলেই এবারের ইদটা অন্যরকম আনন্দ নিয়ে আসছে!
সমাপ্ত