#এক_পশলা_বৃষ্টি,পর্ব-১৮ শেষ
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
সাদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে সেই এক পশলা বৃষ্টিতে পথের ধুলোর সাথে মিশেই। শোভা যখন জানতে পারলো তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মানুষটা আর নেই পৃথিবীতে। নবিজি (সাঃ) বলেছেন, যদি তুমি তোমার চরিত্র হারিয়ে ফেলো, তাহলে তুমি সবকিছুই হারিয়ে ফেললে। সাদও তার সাক্ষী।
শোভা প্রথমে বুঝতে বা মানতেই পারলোনা সাদের মৃত্যুর ব্যাপারটা। কিন্তু মানতে হলো। চিৎকার করে কাঁদলো, কেন কাঁদলো নিজেই জানেনা। তবে কী ওর মনের কোথাও সাদের জন্য অনুভূতির কোনো টুকরো রয়ে গিয়েছিল? ভালোবাসা কখনো মরে যায়না, হয়তো চাপা পড়ে যায় কোনোকিছুতে। সাদের লাশ নিয়ে আসা হলো শোভাদের বাড়িতে। শোভা দেখলো না সাদকে। ঘরে বসে রইলো। রাফু-তুতুল মাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমাদের বাবা কী আর নেই আম্মু?’
কী বলবে শোভা? এটাই ওর কপালে লিখা ছিলো? মানুষটার মৃত্যু তো সে কামনা করেনি? তবু কেন এমন হলো!
‘ না নেই।’
‘ মরে গেছে?’
শোভা কান্না চেপে বললো,
‘ হুম মরে গেছে।’
‘ আম্মু তোমার কান্না পাচ্ছে! তাহলে কাঁদছো না কেন?’
‘ কাঁদতে নেই বাবা।’
‘ তাহলে দাদুমা কাঁদছে কেন?’
‘ তুমি কষ্ট পেলে যেমন আমি কাঁদি, তেমনই তোমার বাবাও তো ওনার ছেলে তাই কাঁদছে।’
‘ আমাদের বাবা কী আর ফিরে আসবেনা?’
‘ জানিনা বাবা। তুমি চুপ করো। নানাভাইয়ের কাছে যাও।’
‘ আম্মু তুতুল কাঁদছে।’
‘ কোথায় ও?’
‘ বারান্দায় একা বসে আছে। এলো না আমার সাথে।’
‘ আচ্ছা।’
‘ আম্মু আমরা অনেক বড় হবো, তোমার দুঃখ ঘুচিয়ে দেবো।’
রাফুর এই কথাটাই শান্তির বার্তার মতো ছড়ালো চারদিকে। শোভা আর কিছু বললো না। সন্তানদের বাবা ছাড়া কী শোভা নিজেই করলো? ও-ই কী দায়ী ছেলেমেয়ের কান্নার জন্য? এসব কেন ওর ভাগ্যে লিখা ছিলো? কেন? শোভা কী জীবনে কষ্ট পেতে আর কাঁদতেই এসেছে!
রাফুকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তোমরা কী মনে মনে আমাকে খারাপ ভাবছো? চাইলে যেতে পারতে বাবার সাথে!’
‘ চাইছিলাম না। ওনি যদি ভালো হতো তাহলে তোমাকে নিয়েই ফিরতাম আম্মু।’
‘ রাফু তুমি আমাকে একা থাকতে দাও।’
‘ আমার ওসব রক্ত দেখতে ভালো লাগেনা, কিন্তু ওনার জন্য মায়া হচ্ছে। আচ্ছা আম্মু একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘ হুম।’
‘ মরে যাওয়ার সময় কী ওনার খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা?’
‘ হুম।’
‘ তখন কী আমাদের কথা ওনার মনে হয়নি?’
শোভার মনটা খচখচ করতে লাগলো। সত্যিই কী ওই কঠিন সময়টাতে শোভাদের কথা সাদের মানসপটে ভেসে উঠেছিলো? ঠিক কী চাইছিলো ওই খারাপ মানুষটা? ওদেরকে কী তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবছে? নাকি অনুতপ্ততার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো সাদ? এক পশলা বৃষ্টি কী ওর জীবনটাতে শান্তি এনে দিয়েছে! আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে তো কোনো ক্ষতি হতোনা। তবে কেন এই একটা জীবন অতি স্বল্প সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেলো আর শোভার জন্য রেখে গেলো কষ্টের পাহাড়। এতোদিন তো শোভা নিজেকে মানিয়েই নিয়েছিল জীবনের সাথে, লোকটা আবার উলটপালট করে দিয়ে গেলো। কী শান্তি পায় ওকে এমন কষ্ট দিয়ে সেটা ওই সাদ নামক ব্যক্তিটিই জানে। রিডিকিউলাস!
রাফু ঘর থেকে চলে গেলে কয়েকজন প্রতিবেশী, আত্মীয় এসে শোভাকে নিয়ে বিলাপ শুরু করলো। কীভাবে থাকবে, বাচ্চা নিয়ে চলবে কীভাবে, আরেকটা বিয়ে করবে কিনা এইসব। তারা জানতো না শোভার সাথে কাগজে কলমে ওই ব্যক্তিটির ছাড়াছাড়ি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। অথচ এই মানুষগুলোই এতোদিন শোভাকে বাঁকা নজরে দেখতো, রাস্তায় বেরুলে আড়চোখে দেখতো, কানাঘুষা করতো। বিকেলবেলা মহিলাদের আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো রমজান সাহেবের মেয়ে শোভার বর কই? বাচ্চাগুলো কী অবৈধ নাকি। এগুলো শুনতে শুনতে এতকাল কেটেছে শোভার। আর আজ এসেছে সিমপ্যাথি দেখাতে। ওসব মনমানসিকতার মানুষগুলোর জন্যই সমাজে আজও মেয়েরা নর্দমার কীটের মর্যাদা পায়। এর শেষ কোথায় জানেনা শোভা। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থা খুব দ্রুতই পাল্টানো প্রয়োজন, পরিবর্তন প্রয়োজন।
ডিভোর্সি নারী মানেই খারাপ নয়। হতে পারে সে অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার। তাই সবসময় নারীদেরকে বাঁকা চোখে না দেখে বিষয়টা তলিয়ে দেখুন৷ দেখবেন বিপরীত পক্ষ থেকে মেয়েটি কতোটা কষ্ট, অপমান, নির্যাতন সহ্য করে এসেছে। পরকীয়া, শারীরিক চাহিদা, যৌতুক এসবই আজকাল সমাজকে দূষিত করে ফেলছে। অথচ সবাই বাঁকা চোখে তাকিয়ে আঙ্গুল তুলে দেখাবে, “মেয়েটা ডিভোর্সি, চরিত্রহীন, বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় তাইতো ওর সংসার ভাঙলো!”
মহিলাদের এসব বিলাপ শুনে শোভার ভেতর খারাপলাগা কাজ করলো। কেঁদেই দিলো। একসময় ভালোবাসতো সাদকে। কষ্ট যতোই দিক, ভালোবাসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ওদের কখনো মিল হওয়ার সম্ভাবনা ছিলোনা। ভাগ্যটাই হয়তো এমন ছিলো। ইচ্ছে করলেই পাল্টানো যেতো জীবন। মিলি এলো, ওর ও ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু মহিলাদের এসব দেখে ও সবাইকে একপ্রকার রেগেমেগে কিছু কড়া কথা বলে ঘর থেকে বের করে দিলো। বিরক্ত হয়ে ওরা চলে গেলো।
মিলি শোভাকে বললো,
‘ যাবি শুভি?’
‘ কোথায়?’
‘ সাদ ভাইকে দেখতে?’
‘ তোর মুখে অনেক বছর পর শুনলাম সাদ ভাই!’
‘ সবসময়ই ডাকতাম। কিন্তু মেজাজ খারাপ হলে ভুলে যেতাম।’
‘ বুঝি আমি।’
‘ যাবি?’
‘ না।’
‘ আর কখনো দেখতে পারবিনা, শেষবেলা দেখে নে।’
‘ আমি দেখতে চাইনা।’
‘ অন্তত ওনার মায়ের জন্য?’
‘ কেন?’
‘ ওনি নইলে কষ্ট পাবে শুভি। মহিলাটা বড্ড ভালো। কেউই নেই আর ওনার। স্বামী-সন্তান সবাই তো ছেড়ে গেলো। তোকে তো মেয়ে মেনেছে, যা না একটু।’
‘ তুই বলছিস?’
‘ হুম। সময়ে কঠিন, সময়ে নরম। যখন যা হওয়া দরকার তখন তাই-ই হতে হয়!’
সাদের মা রোমেলা খবরটা শুনে অনেক শকড হলো। ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সবাইকে একনজর দেখানো হলো। মিলি নিয়ে এলো শোভাকে। দেখলো খারাপ মানুষটাকে একবার। তারপর চলে গেলো। কাফন-দাফন করানো হলো চট্টগ্রামেই।
রোমেলা একপর্যায়ে স্ট্রোক করে ফেললো। ওনাকে হসপিটালাইজড করা হলো। অবস্থা শোচনীয়, কিন্তু সাইফের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেবার ওনি বিপদমুক্ত হলেন। ছেলের কথা ভেবে ওনি কান্না করলেন। কিন্তু তখন পৃথিবী নামক গ্রহটিতে ওনি একটা বিন্দুর মতোই একা। পাশে আর কেউই রইলোনা। সেই সময় ওনার পাশে দাঁড়ালেন শোভা। শ্বাশুড়িকে নিয়ে শুরু করলো নিজের পথচলা। যে পথচলাতে প্রতিটা ধাপে ধাপে অপমানিত হয়েছে শোভা। কারণ ওর স্বামী নেই, সংসার নেই। সমাজে এমন নারীর কোনো দামই নেই। সিঙ্গেল মাদার, বিধবা নারীরা যে কতোটা অবহেলিত সেটা বলে বোঝানোর ক্ষমতা কারোর নেই।
মিলির নিজের সংসার হলেও ওর সব ভাবনা আজও শোভার জন্য বরাদ্দ। ছোট্ট একটা মেয়ে ওর। নাম মিশু। রাফু তুতুল ওকে নিজের বোন ভাবে। মা-বাবা, শ্বাশুড়ি, নিজের সন্তানদের নিয়ে শোভার জীবনটা এগুতে লাগলো। খুবই কষ্টের সেই যাত্রা ছিলো। কিন্তু কষ্টের পরেই আসে সুখ।
বছর কয়েকের মাঝেই রোমেলা মারা গেলো। শোভার মা-বাবাও পর পর কয়েক বছরের ব্যবধানে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো। সবচেয়ে বড় আশ্রয়, ছায়া হারালো শোভা। শাফিন দেশে এলো বউ নিয়ে। এখনো সে নিঃসন্তান। কয়েকমাস থেকে আবারও পাড়ি জমালো বিদেশে। এবার কানাডাতে স্যাটেল হলো ও। এর মধ্যে শোভার অতি পরিচিত, সবচেয়ে বড় বন্ধু মিলির আশ্রয়টাই ছিলো। শোভাদের পাশের ফ্ল্যাটটাতেই উঠে এলো সাইফের ফ্যামিলি। মিলি নিজের স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলো। যেহেতু শোভা চাকরি করে তাই রাফু-তুতুলকে পালন করার দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে নিলো অনেকাংশেই। মাঝে মাঝে শোভা ভেবে পায়না এমনও মানুষ হয়, এতো ভালো বান্ধবী ও কীভাবে পেলো। কখনো এই ঋণ শোধ হবে কিনা! কিন্তু এটা শোধ হওয়ার নয়, কারণ পুরোটাই ভালোবাসা। ভালোবাসার কোনো ঋণ হয়না, শোধও হয়না। শোভার মাথায় হাত রাখার মতো মিলিটা সবসময় শুভির মিলিই রয়ে গেলো।
দিন, মাস, বছরগুলো এভাবেই কাটতে লাগলো। নরম, নমনীয় শোভাকে এই সমাজের জন্য হতে হলো কঠোর। মানুষের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলতে লাগলো। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলো, একটা ব্যাংকের ম্যানেজারের পদে ওর চাকরি হলো। শোভার রুপ, গুণ দেখে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতোন কর্মকর্তা, যিনি বিবাহিত এবং যার দুটো মেয়ে সন্তান আছে সেই মাহফুজুর রহমান শোভাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। এছাড়া কিছু চরিত্রহীন কলিগরা ওকে কুপ্রস্তাব দিলো। শোভা লজ্জ্বায় বা ভয়ে গুটিয়ে রইলো না। আগের শোভা সে নেই। লিখিত অভিযোগ জমা দিলো বড় বড় কর্মকর্তাদের কাছে, কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে তাদেরকে বরখাস্ত করা হলো। মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
শোভা ওদেরকে বুঝিয়ে দিলো, মেয়েরা দুর্বল নয়। কিন্তু এর ফল হলো ভয়ানক। একদিন অফিস শেষে ফিরতে গিয়ে রাত হয়ে গেলো। এসময় চট্টগ্রামের এই এলাকাটাও খুব বেশি নীরব হয়ে পড়ে। সাইফ ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলো সাহায্য লাগবে কিনা বা একা আসতে পারবে কিনা। কিন্তু শোভা সাহায্য নিলোনা। মাহফুজুর রহমান প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সেদিন শোভাকে ফলো করছিলো এবং সুযোগ বুঝে ওনার ভাড়া করা দুজন গুন্ডা ওর পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলো। শোভার ওপর যখন ওরা এ্যাটাক করলো তখন ফাঁকা রাস্তায় একা শুভি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। মুহূর্তের জন্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বুঝতে পারছিলো না কী করবে। তারপর হঠাৎই ভাবলো মরবেই যখন তখন লড়াই করে মরাই ভালো। অন্তত নিজের কাছে নিজের জিত হবে। শোভা প্রাণপণে একটা লোকের পেটে লাথি মারলো, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে লোকটা মাটিতে বসে পড়লো। অপর লোকটা শোভার এই ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলো। এই সুযোগে শোভা দৌড় শুরু করলো। দ্বিগবিদিক হারিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখতে পেলো। ওদিকে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কিছু একটা এসে পড়লো ওর গায়ে। হতভম্ব শোভা পেছনে তাকিয়ে দেখলো সেই গুন্ডা লোক দুটোর হাতে একটা বোতল, ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শোভার গলা, হাত, পায়ের কিছু অংশ জ্বলছে। বুঝতে পারলো ওকে এসিড মারা হয়েছে।
চায়ের দোকানদারটা দৌড়ে এলো শোভার কাছে। দেখেই দৌড়ে পালালো গুন্ডা দুজন। দোকানদার যখন বলল,
‘ তোমারে এসিড মারছে মা।’
তখন শোভার হুশ এলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তাই। বিশ্বাসই করতে পারছিলো না শোভা। গলা, হাত, পা যখন জ্বলেপুড়ে যেতে লাগলো তখনই চিৎকার করে উঠলো। মাটিতে বসে পড়লো। পেটের কাছে মাংস উঠে গিয়েছে। প্রচন্ড ব্যথা আর জ্বলুনিতে শোভার মনে হচ্ছে ওর জীবনের সমাপ্তি এখানেই। চিৎকার করে কান্না করছে কিন্তু কেউ নেই সাহায্য করার। জ্ঞান হারানোর আগে দোকানদারের
উদ্দেশ্যে শোভা বলতে পারলো,
‘ আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি চাচা।’
দোকানদার কাশেম মিয়া তাঁর মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এভাবে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কোনোমতে দুজন লোক জোগাড় করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ব্যাগপত্র ঘেটে ফোন নম্বর জোগাড় করে কাশেম মিয়া
সবকিছু জানালো মিলিকে। খবর শুনেই একটা চিৎকার করে মিলি অজ্ঞান হয়ে গেলো। তার শুভির একি অবস্থা হলো!
সাইফ মিলিকে বাবা-মা’য়ের কাছে রেখে দ্রুত হসপিটালে চলে এলো। শোভার এমন অবস্থা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলোনা। বোনের মতো ভালোবাসে শোভাকে। ওর সব কষ্ট অনুভব করতে পারে সাইফ। কিন্তু মেয়েটা আর কত সহ্য করবে? কে করলো এই কাজ?
অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা হলো শোভার। কণ্ঠনালী, গণ্ডদেশ মারাত্নক ক্ষতির সম্মুখীন হলো। খাবার খেতে পারতোনা। পোড়া মাংসগুলোতে পচন ধরায় সার্জারি করা হলো শোভার। পোড়া মাংসগুলো তুলে সেখানে প্লাস্টিক সার্জারি করা হলো। মুখে এসিড পড়েনি সেটাই বাঁচোয়া। পুরোটা সময় সাইফ-মিলি শোভার পাশে ছিলো। দীর্ঘ দুইমাস হসপিটালে একপ্রকার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জয়ী হয়ে শোভা ফিরে এলো।
শাফিনকে এই ঘটনার কিছুই জানানো হলোনা। শোভা বারণ করেছে। একবার যদি শাফিন শোনে শোভার এই অবস্থা তাহলে দুনিয়া উলটপালট করে ফেলবে। এমনিতে চলে আসতে চায়, কিন্তু শোভা মানা করে দিয়েছে। এতো সিকিউর একটা ভবিষ্যত ফেলে কেন শোভার জন্য চলে আসবে। কিন্তু মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা ঠিকই পাঠায়, শোভার মানা স্বত্তেও। বোনপাগল ভাই যে। শোভা পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পরে শাফিনকে এই ঘটনা শোভা নিজেই জানালো এবং শাফিন ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ দেশে ফিরতে চাইলো কিন্তু শোভা আসতে দিলোনা। ব্ল্যাকমেইল করলো একপ্রকার। ফলে শাফিন আর কিছুই করতে পারলোনা।
এই ঘটনা এখানেই শেষ নয়। শোভা অভিযোগ দায়ের করলো থানায়। সন্দেহভাজন হিসেবে অফিসের কলিগদের দায়ী করলো। পুলিশরা তদন্ত করলো জোরালোভাবে, কারণ শাফিন ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করেছে। যার ফলাফলসরুপ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট অত্যন্ত জোর দিয়ে এই কেসটা হ্যান্ডেল করছে। তদন্ত চালানো হলো এবং ওই দুজন গুন্ডা ধরা পড়লো। সাক্ষী ছিলো চায়ের দোকানদার কাশেম আলী। ফলে মূল আসামি মাহফুজুর রহমানকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। কেস কোর্টে উঠলো এবং মাহফুজুর রহমানের দশ বছরের জেল হলো। চারদিকে শোভার মতো নারীর জয়-জয়কার। কারণ এই লোকের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ আরো ছিলো। প্রমাণের অভাবে ক্ষমতাশালী এই লোকটার কিছুই করা যায়নি। শোভার সাহসের জন্য খুব প্রশংসা করলো মানুষ ওর!
পুড়ন্ত গলা, হাত-পা শোভার। তবুও মায়ের মিষ্টি চেহারাটা রাফুর জীবন। ছোট থেকে মায়ের সাথে ঘটা অন্যায় দেখে রাফুর এই সমাজের প্রতি খুবই ঘৃণা এসে পড়ে। মাকে কোনোদিন কষ্ট পেতে দেয়নি ওরা দুজন। বুঝতে শিখেছে আঘাত মানুষকে শক্ত হতে শেখায়। মায়ের মতো ভুল যাতে আর কেউ না করে, সেজন্য রাফু নিজেও মেয়েদের থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। তবে বন্ধুত্ব ছিলো ছেলেমেয়েদের সাথে, সেই বন্ধুত্বটাকে সম্মান করেছে। প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ করেছে মেয়েদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলোর জন্য। শোভা সবসময় সন্তানদের সাথে ছিলো। একুশটা বছর পার হয়ে গেলো এভাবেই।
তুতুল মেডিকেলে ভর্তি হলো, রাফু কানাডা চলে গেলো পড়াশোনা করতে। কিন্তু তবুও ওরা মায়ের শিক্ষা ভুলেনি। নারীদের কীভাবে সম্মান করতে হয় বা মানুষ হিসেবে কীভাবে বাঁচতে হয় সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু দিনশেষে শোভা একা। মিলি আছে আজও, থাকবে সবসময়।
প্রকৃতিতে বসন্ত। সাজবে সবুজ, বাসন্তী সাজে। তুতুল মিলি আর মিশু কে নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়েছে। শোভা ওদেরকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। শোভা ঘরে একা। বিগত বসন্ত দিনগুলো কথা ভাবছে ও। কোনোদিন পালন করা হয়নি জাঁকজমকভাবে। কিন্তু আজ তার মেয়ে তুতুল সেটা করেছে। পুরাতন সব ভুলে নতুন বসন্তকে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। রাফুর কথা মনে হচ্ছে। ওর ছোট্ট ছেলেটা কাছে নেই। মনটা কেমন খচখচ করছে শোভার। সবসময় বলে, ‘মা! জীবনটা সাজাতে শেখো।’ কিন্তু চাইলেই কী সব সাজিয়ে নেওয়া যায়? শোভা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে রইলো। সমুদ্র দেখা যায় এখান থেকে। রাফুটা থাকলে ভালো হতো, কিন্তু ছেলেটা আসতে পারছেনা। বড্ড ভালোবাসতো সমুদ্র। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে শোভাকে। স্থির থাকতে পারলোনা শোভা, বেরিয়ে এলো। একা একা যখন বালিয়াড়িতে হাঁটতে লাগলো তখন ঝুপ করে নেমে এলো বৃষ্টিধারা। একুশ বছর আগের সেই শুভিটাই আজও রয়ে গিয়েছে, পাল্টায়নি একটুও। দূর থেকে বৃষ্টিতে ভেজা সেই দুর্দান্ত মানবীটির মধ্যে রাফু ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।
এগিয়ে দিয়ে হাঁটতে লাগলো মহিলাটির সাথে। শোভা পাশে না তাকিয়েই বলল,
‘ বৃষ্টিতে ভেজার মতো বয়স তোমার হয়েছে রাফু?’
‘ কেন হবেনা আম্মু?’
‘ বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার জ্বর হবে!’
‘ বৃষ্টিতো আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপভোগ করার জন্যই পাঠায় তাইনা? বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। আমার বয়সও হয়েছে বৃষ্টিতে ভিজার।’
শোভা মুচকি হাসলো। বাবার মতো কথা শিখেছে ছেলেটা।
রাফু বলল,
‘ তোমার সাথে সমুদ্রের পাড়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজার জন্যই আমি চাই, আরো হাজারবার আমার জন্ম হোক।’
শোভা ছেলের দিকে তাকালো। চমকে লক্ষ্য করলো, সাদের অবয়ব। সেই নাক, চোখমুখ, কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি। এই ক’টা বছরে এতো পরিবর্তন! আজ সাদের কথা মনে পড়ছে খুব। মানুষটা বেঁচে থাকলে এতোদিনে হয়তো আরও কষ্ট সহ্য করতে হতো। ভালোই হয়েছে মরে গিয়ে। শোভার খুব ইচ্ছে ছিলো সমুদ্রের পাড়ে সাদকে নিয়ে হাঁটবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। ভিজছে, তবে সাদের একটা অংশের সাথে, যেটা আজ তাঁর পুত্র রাফু। মাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফু হেসে বললো,
‘ বাবার মতো হয়ে গিয়েছি তাইনা?’
শোভা উত্তর দিলো না। ঠোঁটের কোণে বেদনাদায়ক একটুকরো হাসি ফুটে ওঠলো। রাফু মায়ের দিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে সুদূরপ্রান্তে তাকিয়ে ধীরগলায় বলল,
‘কিন্তু ওনার মতো হলেও, চিন্তাধারা ওমন নয়। তোমার মতোই স্বচ্ছ!’
শোভা এবারেও হাসলো শুধু। রাফুও হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘ আচ্ছা, তুমি বুঝলে কীভাবে আমি এসেছি?’
‘ মায়েরা সব বুঝতে পারে। আমার মন বলছিলো তুমি আসবে।’
‘ তাইতো সুদূর কানাডা থেকে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।’
‘ ভালো করেছো।’
‘ আম্মু চলো সমুদ্রে নামি!’
‘ নাহ।’
‘ কেন?’
‘ এমনিতে বৃষ্টিতে ভিজছি, সমুদ্রে নামতে হবেনা।’
‘ তোমাকে কিন্তু পঁচিশ বছরের যুবতীই লাগছে, মোটেও পঁয়তাল্লিশ বছরের মহিলা লাগছেনা।’
‘ তোমাকে পাঁচ বছরের সেই রাফুই দেখাচ্ছে।’
রাফু হেসে গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ আজ বৃষ্টিটা অন্যরকম, শত বছর পরপর
মনে হয় এমন বৃষ্টি হয়। তাইনা?’
শোভা হাসে। রাফু কিছুক্ষণ চিন্তা করার ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ এই বৃষ্টিটার কী নাম দেওয়া যায় বলোতো!’
শোভা দূরে, সমুদ্রের গভীরে দৃষ্টি রেখে টুপটাপ করে ঝরে পড়া বৃষ্টিরাজির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এক পশলা বৃষ্টি!’
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। সাদের হয়তো আরও শাস্তি পাওয়া উচিৎ ছিলো, তাড়াহুড়ায় বিশ্লেষণ দিতে পারিনি। আর এখানেই অগোছালো গল্পটার ইতি টানলাম। ভুল-ত্রুটি মাফ করবেন। হয়তো আপনাদের আশানুরূপ হয়নি।
সমাপ্ত___________