#এক_পশলা_বৃষ্টি,০৫,০৬
#লেখনীতে:ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
সময় খুব দ্রুত বদলায়। জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায়, সেখান থেকেই সামনে পথচলার শক্তিটুকু অর্জন করে নিতে হয়। নইলে এ জগতে টিকে থাকা আর আগুনে জ্বলে মরা একই কথা। এতো অবাস্তব কিছু আর দ্বিতীয়টি নেই। শোভাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, সামনে মাসেই একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। আশা করা যায় চাকরিটা হয়ে যাবে, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এর মাঝেই ঘটে গেলো আরেক কান্ড! সকালবেলা বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেলো পেটে।
তাড়াতাড়ি করে নিয়ে আসা হলো হসপিটালে। চেক আপ করে ডাক্তার শোভাকে এডমিট হয়ে যেতে বললো, কারণ ডেলিভারির ডেইট দুদিন আগেই ছিলো। ডাক্তারের এমন কথায় রমজান সাহেব খুব ভয় পেয়ে গেলো। অবশেষে এডমিট করানো হলো শোভাকে। আপাতত স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বারোটার দিকে অপারেশন। সিজার করতে হবে।
সালমা বেগম বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মিলিও এলো। সে শোভাকে বোনের মতো এতোটা দিন আগলিয়ে রেখেছে, সাহস জুগিয়েছে। মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘মানুষটার সাথে তোর যোগাযোগ আছে রে মিলি?’
মিলি অবাক হয়ে বলে, ‘কোন মানুষটা?’
‘ সাদ!’
মিলি রাগলেও কিছু প্রকাশ করলো না। বলল, ‘ যোগাযোগ নেই।’
‘ কোনো খবর জানিস?’
‘ শুনেছি বউ সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে। ইন্সট্রাতে ছবি আপ দিয়েছিলো, কে যেন আমাকে দেখিয়েছিলো। বউ নিয়ে সুখেই আছে।’
‘ ওহহ!’
‘ হুম।’
‘ মিলি?’
‘ বল!’
‘ আমার বাচ্চাটা কাকে বাবা ডাকবে?’
মিলি থমকায়। বলে, ‘তুই নিজেই ওর মা, নিজেই ওর বাবা।’
‘ লোকটা আমার সাথে কেন এমন প্রতারণা করলো বলতে পারিস? আমি কী খুব খারাপ ছিলাম?’
‘ তুই কেন খারাপ হবি? খারাপ তো সে, আর তার ভাগ্য!’
‘ তাহলে লোকটা আমাকে এখনো কেন ডিভোর্স দেয়নি?’
‘ হয়তো ভুলে গিয়েছে যে সে একটা বিয়ে করেছিলো, তার একটা বউ আছে।’
‘ মিলি!’
‘ হুম!’
‘ এমন একটা ব্যবস্থা কর যাতে ডিভোর্সটা হয়ে যায়। আমার অসহ্য লাগছে।’
মিলি আশ্বস্ত করে শোভাকে যে ডিভোর্সটা হবেই। পাঁচমাসেও কী ওদের সময় হয়নি এটা শেষ করার? যত্তসব! শোভা ঘুমিয়ে পড়েছে, সেদিকে তাকিয়ে মিলি ভাবে কেন শুভিকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে। ভালোবাসা কী শুধু কষ্ট দিতেই জানে? মিলি জানে, শুভি সাদকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসাটা বিষাদে ছেয়ে আছে। এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। সেদিনের শুভিটার আজ বাচ্চা হবে। একটা প্রিন্স নয়তো প্রিন্সেস আসবে। কোথায় পাবে বাচ্চাটা তাঁর বাবাকে? জন্মের আগেই বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে গেলো, এমন দিনও দেখতে হলো ওর!
ঘুমন্ত শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে মিলির মায়া হয়। মনে পড়ে তার বড় বোন ঝিলি’র কথা, সেও শোভার মতো এমন ভুল করে। যার ফল গুনতে হয় মিলির পুরো পরিবারকে। সমাজের মানুষের কাদা ছিঁটাছিঁটিতে ওর বোনটা গলায় ফাঁস দিয়ে সুসাইড করে। মেয়ের এসব দেখে মিলির বাবাও সেদিন হার্ট-অ্যাটাকে দুনিয়া ছাড়ে। স্বামী-সন্তানের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে বিকারগস্ত হয়ে পড়ে মিলির মাও। ছয়মাস পর মা-ও ছেড়ে চলে যায় মিলিকে। এতিম হয়ে পড়ে মিলি। সেই থেকেই ঘেন্না এসে পড়ে মানুষের প্রতি। হোস্টেলে উঠার পরে অহরহ এসব কাহিনী দেখে মিলির রক্ত টগবগ করে ফুটতো। এমন ভুলভাল কাজে মেয়েরাও যে সায় জানায় সেটাও দেখেছে মিলি। এতসব সহ্য করে আজ এতো কঠিন মিলি। বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্টটা সে কাউকে জানায়নি, শুধু শুভি ছাড়া। একটা পরিবার ধ্বংস করার জন্য কিছু অমানুষ, আর সমাজই যথেষ্ট। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে শুভিও এমন কাহিনীর শিকার, অবশেষে সেই কাহিনীরও ইতি ঘটতে চলেছে ডিভোর্সের মাধ্যমে।
_____
সাদ অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র! ক্লান্ত শরীরটা নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক’দিন যাবৎ বেশ চাপ পড়েছে অফিসে। হানিমুনে একমাস কাটিয়ে এসে সে যে কী ভুল করেছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এতোদিন থাকতো না, কিন্তু টিনার জেদ। সে একমাস না থেকে কিছুতেই ফিরবেনা, অগত্যা থাকতেই হলো।
টিনা গ্লাসে পানি ঢেলে সাদের দিকে এগিয়ে ধরলো। সাদ উঠে বসলো। ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো। টিনা অভিযোগের সুরে বললো, ‘কতদিন হয়ে গেলো বাইরে যাইনা।’
সাদ বলে, ‘কেন? কী হয়েছে বউটার?’
‘ উফফ,, এসব কী বলো তুমি?’
‘ কী বললাম?’
‘ বউ বলবেনা, নাম ধরে বলবে।’
‘ তুমি তো আমার বউই!’
‘ জানি। কিন্তু বউ ডাকটা গেঁয়ো, ব্যাপারটা কেমন ব্যাকডেটেড।’
‘ ওহহ, আচ্ছা।’
সাদ ভাবনায় পাড়ি দেয়। শোভার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সাদ যখন ওকে “আমার বউ” বলে ডেকেছিলো শোভা লজ্জ্বায় মাথা তুলে তাকায়ইনি। বউ বললেই মেয়েটার গাল লাল হয়ে যেতো, মিষ্টি দেখাতো খুব। সবসময় নরম গলায় ওর সাথে কথা বলতো, সাদ যা বলতো তা-ই করতো। কখনো বলেনি নিজের শখ-আহ্লাদের কথা। অথচ টিনার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে করতে আজকাল নিজের শখগুলোর কথা সে ভুলেই গিয়েছে। কী তফাৎ নিজের দুই বউয়ের মাঝে।
টিনা সাদের বুকে মাথা রেখে বলে, ‘চলোনা আজ ডিনারে যাই,কতদিন যাইনা!’
ভাবনা থেকে ফিরে আসে সাদ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাসায় এসেও দুদন্ড শান্তি নেই। গত পরশুই টিনাকে নিয়ে বেরিয়েছে। শপিং সেরে ডিনার সেরে এসেছে। যেনতেন ডিনার নয়। একদম রাজকীয় ভোজ ছিলো। সেটাই টিনার কাছে অনেকদিন মনে হচ্ছে? বলে কী মেয়ে!
‘ এ্যাই, কিছু বলছোনা কেন?’
‘ আমি খুব কান্ত।’
টিনা মুখ ফুলিয়ে বললো, ‘ কিছুই তো করোনি, অফিসেই তো ছিলে। তাহলে ক্লান্ত হলে কী করে? এই তুমি আবার অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাওনাতো?’
সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘মানে?’
‘ তোমার আরেকটা বউ আছেনা? ওর কাছেই নিশ্চয়ই যাও?’
‘ কী বলছো তুমি?’
‘ ঠিকই বলছি। ওর তো বাচ্চা হবার কথা ছিলো, তুমি কী আবার ওই বাচ্চার কাছে যাও নাকি?’
সাদের মগজে কথাটা ঠোক্কর খায়। আরে, সে তো বাবা হতে চলেছিলো। পরমুহূর্তেই সেসব ভুলে টিনাকে বাহুডোরে আগলে নেয়। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলে, ‘এতো সুন্দরী বউ থাকতে অন্য কারো কাছে কেন যাবো?’
টিনা ওর বুকে কিল দিয়ে বলে, ‘ওই মেয়েটাও নাকি সুন্দরী ছিলো, তাও তো ফেলে চলে এলে।’
সাদ আহত হয়। তবুও টিনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমার তো তোমাকেই চাই।’
টিনা হাসে। বলে, ‘জানিতো বাবুমশাই। এবার বলো ডিনারে যাচ্ছি কিনা।’
সাদ ক্লান্ত গলায় বললো, ‘কাল যাই?’
‘ না আজ।’
‘ উহু, এখন শুধু তোমাকে চাই।’
বলে টিনার ওষ্ঠজোড়া দখল করে নেয় সাদ। কেমন অদ্ভুত লাগে। একসময় শোভার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে কতই না কসরত করতে হতো ওকে। আজ! আজ শোভাও নেই, আর বাঁধাও নেই। সুখেই তো আছে ও, খুব সুখে। টিনা ওকে সুখেই রেখেছে, তবে শারীরিকভাবে। মনটা তো কবেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছে অন্য কারো চিন্তায়, অন্য কারো ভাবনায়।
_______
সাদিদ সাহেব ইজি চেয়ারে বসে চোখবুঁজে আছেন। মাথাটা বড্ড ধরেছে। গরম একমগ কফি হলে ভালো লাগতো। তিনি রোমেলাকে ডাক দেন। রোমেলা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন, হাতে মশলা লেগে আছে। কপালের ঘাম মুছার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করেন, ‘ডাকছো কেন?’
‘ কফি দাও!’
‘ কফি তো বানাইনি।’
‘ মানে? তুমি জানোনা সন্ধ্যায় আমি কফি খাই?’
‘ মনে ছিলোনা।’
‘ ভুলে গেলে কীভাবে? রান্নাঘরেই তো ছিলে?’
‘ টিনা তার বান্ধবীদের দাওয়াত করেছে। রাতের এতোসব আয়োজন আমাকে একা করতে হচ্ছে। বিকাল থেকে একাই সব করছি। আমার তো দশটা হাত নেই যে সবদিক সামলাবো।’
‘ কেন? টিনা কই? রান্না করবেনা সে?’
‘ কোনোদিন দেখেছো নিজের খাবারটা নিয়ে খেতে? বিয়ের পাঁচমাসে একদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছো?’
‘ না!’
‘ তাহলে আশা করো কীভাবে সে রান্না করবে?’
সাদিদ সাহেব রেগে যান। বাড়ির বৌ কী সামান্য কাজও করতে পারেনা নাকি? রোমেলা এই বয়সে একা একা দশজনের রান্না করতে পারবে নাকি! কাজের বুয়াও আর আসেনা, ছেলে বিয়ে করিয়েছে কী এই দিন দেখার জন্য! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কোথায় টিনা?’
‘ সে ঘরে। সাদ এসেছে অফিস থেকে।’
‘ আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি!’
রোমেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাদিদ সাহেব উঠে রওনা দিলো সাদের ঘরের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি টোকা দিতে গিয়ে থমকে যান। দুজন হাসাহাসি করছে। সাদ কিছু একটা বলছে, আর টিনা জোরে জোরে হাসছে। ঘরের ভেতর কী হচ্ছে তার আভাস পেয়ে তিনি লজ্জ্বা পেয়ে যান। উল্টো ঘুরে নিজের ঘরেই ফিরে আসেন।
ভাগ্য! ছেলে-ছেলের বউ থাকতে আজ তাঁর বউকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। এটি প্রকৃতির প্রতিশোধের শুরু।
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
রাত বারোটায় শোভাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই চিন্তিতমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা খুব খারাপ নয়, কিন্তু ডেইট যেহেতু দুদিন আগে ছিলো তখন ঠিকঠাক কিছু বলা যাচ্ছেনা। শোভার চোখের কোণে জমে থাকা পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। বাবাহীন সন্তান হিসেবে সমাজে পরিচয় পাবে ওর সন্তান। আচ্ছা, ছেলে হবে নাকি মেয়ে? কার মতো দেখতে হবে? সাদ নাকি শোভার মতো? শোভার ভাবনার গতি এখানে এসে স্থির হলো। চোখ দুটো আস্তেধীরে বুজে এলো। মানুষের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে আশেপাশে। কথাও শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু সব অস্পষ্ট।
করিডোরে সবাই বসে আছে। মিলি করিডোর পেরিয়ে একটু বাঁক নিতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো। বিপরীত দিকে থাকা ব্যক্তির হাত থেকে ফোন ছিঁটকে পড়ে ডিসপ্লে ড্যাম হয়ে গেলো। ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে মিলি দেখলো সেদিনের ওই হাঁদা ডাক্তার সাইফ ওর দিকে চেয়ে আছে। বললো, ‘এই যে মিস চাশমিশ, চোখে দেখতে পান না?’
‘ এই প্রশ্ন আমিও করতে পারি।’
‘ পারেন না। কারণ আপনি আমাকে ধাক্কা মেরেছেন।’
‘ মোটেও আমি ধাক্কা দিইনি।
‘ তাহলে কী আমি ভূতের সাথে ধাক্কা খেয়েছি? আই মিন আপনিই সেই ভূত!’
‘ দেখুন বাজে কথা বলবেন না।’
‘ একশোবার বলবো। জানেন এই ফোনটার দাম কত? ধারণা আছে আপনার?’
মিলি বললো, ‘আমি এর দাম শুনে কী করবো? ওকে ওকে..আপনি আবার এই ফোনের দাম আমার থেকে চাইবেন নাকি? আপনি তো মিয়া ধরিবাজ!’
‘ হোয়াট দ্যা ধরিবাজ। একদম ওসব ডাকবেন না।’
‘ তাহলে কী বাপ্পারাজ বলবো?’
‘ আমার নাম আছে। সেই নামে ডাকবেন।’
‘ সরেন তো মিয়া!’
‘ সরবোনা। আপনি ধাক্কা মেরে আমার ফোন ভেঙ্গে দিয়েছেন তাও কিছু মনে করিনি, অন্তত স্যরি তো বলবেন।’
‘ যে সে মানুষকে মিলি স্যরি বলে না। আর এখানে দোষ আমার একার নয়। আমি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম, আর আপনি? আপনার চোখদুটো কী আকাশে রেখে হাঁটছিলেন? মোবাইলে এতো কী দেখেন যে হাঁটতে হাঁটতে, ঘুমুতে ঘুমুতে, খেতে খেতেও ওই যন্ত্রে চেয়ে থাকেন?’
ডাক্তার সাইফ বোকা বনে গেলো। দোষ এখানে তাঁরও আছে। সে তো পারতো ধাক্কা এড়াতে। একটু সাবধানে হাঁটলেই তার সাধের মোবাইলটা বেঁচে যেতো। পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার ফোনটার অবস্থা দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মিলি ফ্লোর থেকে তুলে ফোনটা ওর হাতে দিয়ে চলে গেলো। ওর হুঁশ ফিরতেই ভাবলো ধুর! মেয়েটার সাথে একটু সমীহ করে কথা বলা উচিৎ ছিলো। ডেঞ্জেরাস পার্সনদের সাথে ভাব জমাতে পারলে নিজেরই লাভ। অবশ্য ডাক্তার সাইফ এজন্য ভাব জমাতে চাচ্ছেন না। সে চাচ্ছে মিলিকে আরও ভালোভাবে জানতে, বুঝতে। অনেকদিন পরে দেখা ওর সাথে। এ সুযোগে নিজেকে একটু স্মার্ট দেখানোর সুযোগ এসেছিলো যেটা নিজের হাতেই নষ্ট করেছে।
আচ্ছা, মিলি নামক মেয়েটা কী জানে, সে ইতিমধ্যে সাইফের জীবনের অন্যতম একটা স্থানে বসবাস করছে? সেই স্থানটা শুধু একজনকেই দেওয়া যায়। মন নামক জিনিসটা কারো সাথে ভাগ করা যায়না। সাইফ শুধু মিলি নামক ফুলটির সাথেই ভাগ করতে চায়, ওর সাথে যৌবন কাটাতে চায়, ওর হাত ধরেই বুড়ো হতে চায়। আচ্ছা মিলি কী এসব শুনলে হাসবে? মেয়েটাকে কখনো সামনে থেকে হাসতে দেখেনি সাইফ। হাসলে নিশ্চয়ই ওকে মোনালিসার মতো সুন্দর দেখায়!
_____
চৌধুরী বাড়ি!
সাদ’দের পরিবারের সবাই খুব মিশুক হলেও টিনা মোটেও সেরকম নয়। সে সহজেই সবার সাথে কথাবার্তা বলেনা। নিজের একটা আলাদা উদ্ধতস্বভাব আছে, যার কারণে ওকে কেউ ঘাটায় না। সাদের সাথে একান্তে কিছুসময় কাটিয়ে নিজের মনটা ফুরফুরে করে নিলো। তার বন্ধুরাও এসে খাবার-দাবার সেরে নিয়েছে। কয়েকজন বিদায় নিলেও টিনা মুন্নি, ডেইজিকে থেকে যেতে বললো। ওদের স্বভাবও টিনার মতোই। কলেজ জীবনে ছিলো একপ্রকার কলগার্ল, টিনাও মাঝে মাঝে এসব করতো। তবে সেটা সবার অজানা। মুন্নি আর ডেইজিই শুধু জানে। ওদের তিনজনের আত্মার সম্পর্ক। বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান হলেও ওরা কাউকেই এসব বুঝতে দেয়নি।
ঘরে তিন বান্ধবী বসে গল্প করছে। সাদ নেই ঘরে।
রোমেলা রুমে এসে কিছু নাস্তা দিয়ে গেলো।মুন্নি কয়েকটা আঙুর মুখে পুরে দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, বেইব! তুই আজকে এতো সাজলি কেন?”
টিনা একটা ফিকে হাসি দিয়ে বললো, ‘কই সাজলাম?’
‘ মানে? এই যে তুই শাড়ি পড়লি,ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালি এটা সাজ না?’
‘ ওহহ। এমনি।’
‘ এমন বুইড়া সেজে থাকতে তোর ভাল্লাগে?’
‘ সাদ পছন্দ করে।’
ডেইজি অবাক হয়ে বলল, ‘ কী বলস। তোর জামাই কী গেঁয়ো রে।’
‘ কী আর করবো বল। কপালে জুটলো এমন। তবে ওকে খুশি রাখতে পারলে আমারই লাভ!’
‘ কেমন লাভ?’
‘ ওসব আমিই বুঝবো।’
‘ তাহলে কী আমরা কচি খোকা? যে কিছু বুঝমু না?’
মুন্নি ডেইজিকে বললো, ‘তোরে বলতে হইবো নাকি সব কথা। আমাদের টিনা বেইব সব বুঝে।’
ডেইজি টিনার গাঁ ঘেঁষে এসে বসলো। ওর হাতটা ধরে বললো, ‘প্লিজ তুই বলবি আমারে? আজকাল তোর ভাবসাব আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।’
টিনা মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বললো, ‘আমি এতো আজাইরা না।’
‘ অন্যদিকে ফিরা আছিস কেন?আমার চোখের দিকে তাকাইয়া বল!’
‘ যা তো।’
‘ প্রমিজ দোস্ত। কাউরে কমুনা।’
টিনা ওদের দিকে ফিরলো। তারপর বললো, ‘প্রমিজ?’
‘ হুম।’
‘ তাহলে শোন। ইফতিরে চিনস তো?’
‘ ওই ইফতি? যে তোর বয়ফ্রেন্ড ছিলো?’
‘ হুম।’
‘ তোদের না ব্রেকাপ হয়েছিলো।’
‘ সে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। তুই জানিস ওকে আমি কত পছন্দ করি? একদম হিরো টাইপ। দেখলেই বুক কাঁপে।’
মুন্নি ফোড়ন কেটে বললো, ‘আমরা তো আর জানিনা ও দেখতে কেমন। তুমি তো ওর সাথে দশবার শুইছো, এজন্য হিরো বলতাছো। আমার কাছে কেমন মাকাল ফল লাগে।’
টিনা ধমক দিয়ে বললো, ‘আস্তে বল। শুনবে কেউ।’
‘ কেউ শুনবেনা। তারপর বল।’
‘ সাদের উপর থেকে আমার ইন্টারেস্ট উঠে যাচ্ছে। ভাবছি কী করা যায়। তাই তোদের ইনভাইট করে নিয়ে এলাম। তোরা একটা পরামর্শ দে।’
‘ কেন? ইন্টারেস্ট উঠে যাচ্ছে কেন?’
টিনা চোখমুখ কুঁচকে বললো, ‘ওই ব্যাটা সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে আবারও অফিসের কাজ করে। আর রাতে শুরু করে শরীর নিয়ে খেলা। কোথাও যাওয়ার কথা বললেই বলে আজ না কাল। জীবনে কোনো আনন্দ নাই, বুঝলি।’
‘ বিয়ের তো পাঁচমাস মাত্র হলো। তুই কী চাস?’
‘ সাদের সাথে থাকতাম যদি জীবনে আনন্দ থাকতো৷ কিন্তু এটাই ওর মাঝে নাই।’
‘ মানে ছেড়ে দিতে চাস?’
‘ হুম।’
‘ তোর উচিৎ কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা। এরপর কোনো রিজন থাকলে ছেড়ে দিস। কিন্তু এক্ষুনি যদি এসব ছাড়াছাড়ির কথা বলিস তোর বাবা কী করবে ভাবতে পারিস? জ্যান্ত কবর দিবে তোরে।’
টিনার মুখটা কালো হয়ে গেলো। ওর বাবা ভীষণ কড়া। মেয়ে যে এমন কুকীর্তি করে রেখেছেন এসব কিছুই তিনি জানেন না। তিনি বিয়ে ভাঙ্গাও সাপোর্ট করেন না। সামান্য কারণে যদি সাদকে সে ছেড়ে দেয়, তাহলে মেয়েকে ত্যাজ্য করতে ওনার বুক কাঁপবেনা। হতাশ হলো টিনা।
‘ সাদ তোকে টাকাপয়সা দেয়না?’
‘ দিবেনা কেন। বেতনের কিছুটা নিজে রেখে বাকিটা আমাকেই দেয়।’
‘ তাহলে সমস্যা কই। এসব সামান্য কারণে ছেড়ে দিস না। পরে পস্তাবি। তাছাড়া ইফতির কোনো ঠিক নাই। সে কখন আসবে, কখন যাবে বলতে পারবিনা। তখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারবি৷ এর চেয়ে ক’টা বছর যাক।’
টিনা ডেইজির কথায় সায় জানায়। এমন সময় ঘরে ঢুকে সাদ। তিনজনে চুপ হয়ে যায়। সাদ ইতস্তত করে বললো, ‘ওহহ। থাকুন।’
তারপর ড্রয়ার থেকে ওয়ালেটটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মুন্নি হেসে বললো, ‘বর দেখি বউকে চোখে হারায়।’
টিনা বলে, ‘বউটা সুন্দরী হলে যা হয় আরকি।’
তিনজনেই হাসি-তামাশায় মেতে ওঠে। এসব ঘটনা আর কেউ জানতে না পারলেও রোমেলার কানে পৌঁছলো। তিনি ভাবতেও পারছেন না টিনা বিয়ের আগেই তাদ সতীত্ব আরেকজনকে বিলিয়ে দিয়েছে, আর এখন সাদকে ছেড়ে দেওয়ার পায়তারা করছে। তিনি এই কথাটা কাউকে জানালেন না। দেখা যাক কী হয়। তাছাড়া প্রমাণ ছাড়া এসব কথা তাঁর স্বামী-ছেলে কেউওই বিশ্বাস করবেনা। তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলেন। এভাবেই খোদাতায়ালা ওনাদের শাস্তি দিচ্ছেন।
____
শোভার একটি মেয়ে আর একটা ছেলে হয়েছে। ছোট্ট শরীর দুটো তোয়ালেতে মুড়ানো। মিলি খুশিতে কান্না করে দিয়েছে। কেউ ভাবেইনি শুভির দুটো সন্তান আসতে চলেছে। আল্ট্রা করানোর সময় ওদেরকে জানানো হয়নি। সেসব চুলোয় যাক, সবাই সুস্থ আছে এটাই বেশি। শোভার জ্ঞান এখনো হয়নি। বাচ্চাদের এখনো অভিভাবকদের কাছে দেওয়া হয়নি। অবর্জাভেশন রুমের বাইরে থেকে দেখানো হয়েছে। ফুটফুটে দুটো বাচ্চা দেখে রমজান সাহেবও কেঁদে দিলেন। কী ভীষণ কষ্ট সহ্য করে বাচ্চাগুলোকে দুনিয়ার আলো দেখালো শোভা।
ডাক্তার সাইফ হার্টের ডাক্তার হলেও চাইল্ড জোনগুলোতে আসেন, ওদের দেখেন। চিকিৎসা করেন। এর মধ্যে জানা গেলো শোভার মেয়ের হার্টে একটু সমস্যা হচ্ছে। সাময়িক সমস্যা, তবে ঠিকঠাক মতো যত্ন না নিলে ক্ষতি হবে। মিলি এ খবর শুনে কাঁদতে কাঁদতে সাইফের কেবিনে ঢুকে পড়লো। অনুনয় করে বললো, ‘প্লিজ বাচ্চাটাকে বাঁচাবেন। আমার শুভি এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারবেনা। প্লিজ আপনি দেখুন।’
ডাক্তার সাইফের বুক চিনচিনে ব্যথা করতে লাগলো মিলির চোখে পানি দেখে। গলা শুকিয়ে এলো। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বললো, ‘মিস মিলি, রিল্যাক্স। এটা কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। সাময়িক সমস্যা। আমি অলরেডি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে!’
‘ সত্যিই?’
‘ জি।’
মিলি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। ডাক্তার সাইফ পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। মিলি খেলোনা। বললো, ‘জানেন কত কষ্টের ফল এরা? আমার শুভি কী কী সাফার করেছে। এখন যদি এদেরই কিছু হয়ে যায়, তাহলে ও আর বাঁঁচবেই না।’
‘ খুব ভালোবাসেন শুভিকে?’
‘ জি। আমার এই দুনিয়াতে ও ছাড়া কেউ নেই।’
‘ মানে? ওনি আপনার বোন হন?’
‘ না। আমার বান্ধবী কম বোন বেশি।’
‘ আপনার ফ্যামিলিতে কেউ নেই?’
‘ না। আমি একাই বেঁচে আছি। শুধু শুভির জন্য, শুভিটার কিছু হয়ে গেলে, আমিও আর বাঁচবোনা।’
সাইফ অবাক হয়। অথচ শোভা আর মিলি দুজনকে বোন ভেবেছিলো। বান্ধবীর জন্য কাউকে এমন করতে কখনো দেখেনি সে। এমন বান্ধবী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যে সুখেও পাশে থাকবে, দুঃখের সঙ্গীও হবে। মিলিকে এই মুহূর্তে আরও বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে ওর। কিন্তু মুখ ফুটে বললো, ‘ আপনার শুভি এবং ওনার বাচ্চাদের কিছু হবেনা। আমি আছি তো।’
মিলি চুপচাপ বসে রইলো। অনেকদিন পরে ও কাঁদলো। মনটা খুব ভার লাগছে।
_____
সাদের বন্ধু নিয়ন। সে ফোন করে সাদকে জানিয়েছে শোভা হাসপাতালে। নিয়নের বোন ড্যাফোডিল হসপিটালে ভর্তি, অ্যাপেন্ডিক্স এর ব্যথা। শোভার সাথে সাদের সম্পর্ক কয়েকমাস আগেই জেনেছিলো, আজ যখন শোভাকে ওটিতে নিয়ে যেতে দেখে তখনই ওর সাদের কথা মনে হয় আর তৎক্ষনাৎ ফোন লাগায়।
সাদ নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা। এবার অন্তত যাওয়া উচিৎ শোভাকে একপলক দেখার জন্য ভেবে সে এই গভীর রাতেই বেরিয়ে এসেছে। টিনাকে ফোন করে জানিয়েছে ফিরতে লেইট হবে। ড্যাফোডিলে পৌঁছানোর পরে সোজা নিয়নের কাছে গেলো। নিয়ন ওকে শোভার ওখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। করিডোরে বসে আছে শাফিন। বোনকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় সাদকে দেখতে পেয়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। সাদ এগিয়ে গিয়ে অপরাধী গলায় শাফিনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘স শ শোভার কী হয়েছে?’
শাফিন রাগ দমন করলো। হসপিটালে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায়না। ওখানে গুরুতর অনেক প্যাশেন্টরা আছে, তাঁদের সমস্যা হবে। ঠান্ডা গলায় বললো, ‘কিছুনা, পেটব্যথা।’
‘ এখন কেমন আছে?’
‘ ভালো। ঔষধ দেওয়া হয়েছে।’
‘ ইয়ে ওর সাথে দেখা করা যাবে?’
পেছন থেকে মিলি বলে উঠলো, ‘যাবেনা। ও ঘুমুচ্ছে।’
মিলিকে দেখেই সাদ বিষম খায়। মিলির পাশে ডাক্তার সাইফ। মিলি বললো, ‘যাইহোক আপনি এতো রাতে এখানে?’
‘ ওই এমনি। শুভিকে দেখতে এসেছিলাম!’
মিলি রেগে বললো, ‘শুভি যদি বলেন আর একবার, আমি আমি আপনার অবস্থা খারাপ করে দেবো!’
সাদ চুপ করে মাথা নিচু করে। মিলি বলে, ‘যাইহোক, দেখা হয়ে সুবিধাই হলো।’
সাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মিলি হাতের ফাইলগুলো সাইফের হাতে দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে। তারপর এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নিন এখানে একটা সাইন করে দিন।’
সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘কীসের সাইন?’
‘ বারে! প্যাশেন্ট ম্যারিড। তো হসপিটালের সব ফর্মালিটিতে নিশ্চয়ই তার ভাইয়ের সাইন থাকবেনা! তাঁর স্বামীকেই সাইন দিতে হবে।’
সাইফ অবাক হয় মিলির কথা শুনে। এসব ফর্মালিটি তো শাফিনই করেছে। তাহলে ও কোন ফর্মালিটির কথা বলছে? যাইহোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করে সাদ সাইন করে দিলো। শোভার স্বামী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে কেমন আনইজি লাগছে। কিন্তু আজ কী এমন হলো যে, ওর নিজেকে শোভার স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলো? সাদ ভেবে পেলোনা। বুকটা খাঁ খাঁ করছে, কিছু হারিয়ে ফেলছে মনে হচ্ছে।
সাইন শেষ হওয়ার পর মিলি কাগজ কেড়ে নিলো। তারপর হাসিমুখে বললো, ‘ভেরি ভেরি থ্যাংকস।’
সেদিনের মতো সাদ বাড়ি ফিরে আসে। মিলি মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলে, ‘আশা করি শুভির আর আপনার ডিভোর্সে এবার কোনো প্রবলেম হবেনা!’
ওদিকে শোভা যখন টু-ইন বেবির খবর শুনে, তখন খুবই খুশি হয়। জীবনের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায় ক্ষণিকের জন্য। মা হওয়াতে এত সুখ সে আজ বুঝতে পারছে। পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তি খুশি। ডাক্তার সাইফ একটু পরপরই মিলির কাছ থেকে মুখ ঝামটা খেয়ে বোকা বোকা আচরণ করছে৷
দু-তিনদিন হাসপাতালে কাটিয়ে যথারীতি ওরা বাড়ি ফিরে আসে। সন্তানদের নিয়ে খুব সুখীময় জীবন শোভার।
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।