#এক_পশলা_বৃষ্টি,১২,১৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
চট্টগ্রামে এসে সাদ লোক লাগিয়ে এবং নিজের চেষ্টায় তন্নতন্ন করে খুঁজে শোভাকে। দু’দিন কোনো খোঁজই পেলোনা। এভাবে তো কেউ হারিয়ে যেতে পারেনা, নিয়ন তো জানিয়েছে ওরা এখানেই কোথাও আছে। তাহলে কোথায়? সাদ তবুও হাল ছাড়লোনা। এবং সফলতা এসে ধরা দিলো চতুর্থদিন।
সাদ যখন গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ নজরে আসে সাইফকে৷ ডাক্তার সাইফকে হঠাৎ চিনতে না পারলেও একসময় চিনে ফেলে। এর সাথেই তো সাদের মারামারি হয়ে গিয়েছিলো, এরপর থেকেই শোভা উধাও। নিশ্চয়ই এ সব জানে। সাইফ তার মাকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। সাদ সন্দেহ করলো, সাইফ হয়তো সব জানে। এজন্য সাইফের পিছু নিলো।
সাইফের পাশের সিটে তাঁর মা বসা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছেন। ওর মা বেশ কড়া হলেও খুবই ভালো। ছেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? মুখটা এত শুকনো কেন?’
‘ ভাবছি!’
‘ কী?’
‘ মিলি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়।’
‘ দিলে দিবে।’
‘ আম্মু!’
‘ বিয়েটা ও করবে, তোর ইচ্ছাতে তো আর ওর জীবন চলবেনা৷ তাই না?’
‘ কিন্তু আমি মিলিকে পছন্দ করি।’
‘ তোর পছন্দ ধুয়ে তো ও পানি খাবেনা। ওর নিজস্ব পছন্দের কি দাম নেই?’
‘ অবশ্যই আছে।’
‘ তাহলে ওকে ওর মর্জিতে চলতে দে।’
‘ আমি জানি মিলি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তুমিও ওর পক্ষেই চলে গেলে।’
‘ আমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের মনোভাব বুঝবোনা? এমনটা কি করে বলতে পারিস তুই?’
এমন সময় সাইফের বাবা কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘সাইফ! তুমি শুধু শুধু তোমার মাকে বুঝাচ্ছো৷ মেয়ে যদি না করে দেয়, তাহলে তোমার মাও স্ট্রেট না-ই করে দিবে!’
সাইফের মা চোখ গরম করে স্বামীর দিকে তাকালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তোমার মতো হাঁদা ডাক্তার হলো কীভাবে বলোতো? ছেলেকেও হাঁদার পরামর্শ দিচ্ছো।’
‘ আমি কোথায় হাঁদা পরামর্শ দিচ্ছি?’
‘ শোনো, মিলি একটা মেয়ে। সে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাজে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে। শুধু পুরুষ মানুষের খারাপ রুপটাই ও দেখেছে। এখন ও যদি বিয়েতে না করে দেয়, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে আমাদের ওকে জোর করার রাইট নেই।’
‘ তবুও মেয়েটাকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা তো করতে হবে।’
‘ আচ্ছা, গিয়ে দেখি সিচুয়েশন কেমন। তারপর সব ভাবা যাবে।’
তারপর সবাই চুপ করে বসলো। আর কোনো কথা হলোনা। শোভাদের বাসার দিকে গাড়ি এগুতে লাগলো। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। রাস্তাঘাটের কোণায় কোণায় সোডিয়াম বাতির ঝলকানি। পেছনে ফলো করতে করতে আসছে সাদের গাড়ি!
_____
এদিকে মিলিকে যে দেখতে আসছে সেটা শোভা আর ওর মা ছাড়া আর কেউ জানেনা। মিলি সন্ধ্যার নাস্তা বানিয়ে সবাইকে দিলো। রাফু, তুতুল টিভি দেখছে। শোভা এসে বললো, ‘কী করিস মিলি?’
‘ চা বানাই! খাবি?’
‘ না। আজ অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘ কী?’
‘ একটু স্পাইসি খাবার।’
‘ হঠাৎ?’
‘ মন চাইলো আরকি।’
‘ আচ্ছা আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘ তোর বানাতে হবেনা, আমিই বানাবো।’
‘ কেন?’
‘ নিজের হাতে কতোদিন কিছু বানিয়ে খাইনা।’
‘ পাগল!’
শোভা ফ্রিজ থেকে স্লাইস করা মুরগীর মাংস, ডিম, মশলা বের করলো। পোলাওয়ের চাল, মাছ, সবজি বের করে রাখলো। মিলি অবাক হয়ে বললো, ‘স্পাইসি খাবার না বানিয়ে এসভ খাবার বানানোর মানে কি?’
শোভা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘জর্দা বানাতে পারিস?’
‘ না।’
‘ তুই যা এই বিচ্ছিরি ফতুয়া ছেড়ে একটা ভালো শাড়ি পরে আয়।’
মিলি তব্দা খেয়ে বললো, ‘হটাৎ শাড়ি কেন পরবো?’
‘ আহ! এতো প্রশ্ন করিস কেন? যা বলছি কর না।’
মিলি সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ কী হয়েছে তোর বলতো। এতসব কীসের আয়োজন করছিস?’
‘ তোর জানতে হবেনা।’
‘ না বললে আমিও এক পা নড়বোনা।’
‘ ওকে বলছি।’
‘ বল!’
‘ আজ খুব ইচ্ছে করছে ভালো করে সেজেগুজে ছবি তুলতে, ভালো খাবার খেতে। একটু পর গেস্টও আসবে।’
‘ কীসের গেস্ট? বাসায় কোনো অকেশন আছে বলে তো মনে পড়েনা।’
‘ আসলেই দেখতে পাবি। যা না প্লিজ!’
মিলি ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘শাড়ি পরতেই হবে?’
‘ প্লিজ!’
‘ ওকে!’
মিলি না চাইতেও ঘরে যায়। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে নেয়। শোভার মনে কি চলছে আর কোন গেস্ট আসবে বুঝতে পারলোনা। রাফু আর তুতুল মিওখ গম্ভীর করে বসে আছে। ঝগড়া হয়েছে দুজনের মধ্যে। মিলি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কী হয়েছে?’
‘ দাদাভাই আমার সাথে ঝগড়া করেছে।’
‘ কেন?’
‘ আব্বুর কাছে যাবে বলে। আমি বলেছি আমরা মায়ের সাথেই থাকবো। তাই ঝগড়া করেছে!’
মিলির মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। রাফুটা আজকাল বাবার জন্য কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ একটা গম্ভীর ভাব। আসলে স্কুলে সবারই তো বাবা আছে, সেজন্য ওর উপর মেন্টালি একটা চাপ পড়েছে।
মিলি রাফুকে বললো,
‘ তুমি কী সত্যিই যেতে চাও?’
‘ আম্মু গেলে, আমিও যাবো।’
‘ কিন্তু আম্মু তো যাবেনা।’
রাফু একটু রেগে বললো, ‘কেন যাবেনা? কী করেছে আব্বু?’
মিলি শান্ত হয়ে রাফুর পাশে বসলো। তারপর বলল,
‘ আচ্ছা, ধরো! তোমার আম্মুকে কেউ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, সবার সামনে ছোট করেছে, তোমার আম্মুকে মরে যেতে বলেছে, আঘাত দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে, তোমাদেরকে বাজে কথা বলেছে। তুমি কী চাও সেই মানুষের কাছে তোমার আম্মু ফিরে যাক? যে লোকটা তোমাদের বাজে কথা বলেছে, ছুঁড়ে ফেলেছে তুমি কী ওর কাছে যেতে চাইবে?’
রাফু সাথে সাথেই বলে উঠলো,
‘কখনোই না।’
‘ তুমি জানতে চাওনা, তোমার আম্মুকে কে এতো কষ্ট দিয়েছে?’
‘ কে?’
‘ তোমার আব্বু! এখন তোমার আব্বু যদি তোমাদের নিতে আসে, তুমি কি চলে যাবে?’
রাফু এবং তুতুল দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না জানালো। মিলি চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে ওদের গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘গুড গার্ল। এভাবেই মায়ের পাশে থেকো। তোমার আম্মু তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। তোমরা চলে গেলে মা এবার মরে যাবে!’
‘ আমরা যাবো না!’
ওদের এই কথোপকথন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলো শোভা। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সব সন্তানদের অধিকার আছে বাবাকে পাশে পাওয়ার। কিন্তু কোনো খারাপ বাবার এই অধিকার নেই! এমন সময় দরজায় বেল বাজলো। শোভা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাইফ, ওর মা আর বাবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চোখেমুখে অস্বস্তি! ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও শোভা বেশ বুঝতে পারছে সাইফ চিন্তাগ্রস্ত! শোভা ওদেরকে বসতে দিলো।
‘ তুমি বুঝি শোভা?’
সাইফের মায়ের কথায় শোভা বললো,
‘ আসসালামু আলাইকুম, জ্বি আন্টি।’
‘ ওয়ালাইকুম সালাম, ভালো আছো মা?’
‘ জ্বি। আপনি ভালো?’
‘ খুব ভালো। তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?’
‘ বাসায়ই আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।’
শোভা ভেতরে গিয়ে রমজান সাহেব আর সালমা
বেগমকে ওখানে যেতে বললো। সাইফেরা সাথে করে অনেক ফলমূল,মিষ্টি নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে আরো মেহমান আসবে। শোভা রেস্তোরাঁতে খাবার অর্ডার দিলো। এতোজনের রান্না এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়।
মিলি বসার ঘরে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে রাফু, তুতুলকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সাইফের পুরো ফ্যামিলিকে দেখে ওর চক্ষু ছানাবড়া। এরাই তাহলে গেস্ট? শোভার দিকে তাকাতেই ও মুচকি হাসি দিলো।
সাইফ মায়ের কানে কানে মিলির কথা বলতেই ওনি মিলর দিকে তাকালেন। মিষ্টি চেহারার সাথে সাদা রঙের জামদানি শাড়িটা বেশ ভালোই মানিয়েছে মিলিকে। ওনি বুদ্ধি করে শোভার কাছে শাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই৷ মিলিকে খুবই দারুণ দেখাচ্ছে। ওনি হাসিমুখে বললেন,
‘ তুমিই মিলি? আসো, আমার পাশে বসো। হবু শ্বাশুড়ির পাশে বসে মিষ্টিমুখ করে নাও মা!’
মিলি চমকে উঠলো। মানে কী? শ্বাশুড়ি? ও অবাক হয়ে শোভার দিকে তাকাতেই শোভা হেসে ফেললো। মিলি রাগী চোখে ওর দিকে তাকালো। সাইফের মা সবকিছুই লক্ষ্য করে মুচকি হাসছেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ মিলি! আমি তোমার সঙ্গে একা একটু কথা বলতে চাই মা।’
শোভা বললো, ‘আসুন। আমি আপনাদেরকে ঘরে দিয়ে আসছি।’
সাইফের মা আর মিলিকে গেস্টরুমে দিয়ে এলো শোভা। মিলি রেগে আড়ালে শোভার হাতে কয়েকটা চিমটিও কেটেছে। শোভা পাত্তা দেয়নি।।মিলির ঋণ কোনোদিন শোধ করা শোভার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওর জন্য মিলির জীবনটা নষ্ট হোক, শোভা তা চায়না। আর সাইফের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আর মিলি যতোই মুখে না বলুক, শোভা বুঝতে পারে মিলির মনেও সাইফের জন্য একটা অনুভূতি, শ্রদ্ধার জায়গা আছে। তাই শোভা সাইফের মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওদের দুজনের আজই বিয়ে দিবে। ধুমধামে বিয়ে মিলির কখনোই পছন্দ না। কিন্তু এই কথাটা সাইফ বা মিলি কেউই জানেনা। সবকিছু তৈরি করে রেখেছে শোভা। একটু হলেও যদি মিলির জীবনটা স্বাভাবিক করে দিতে পারে তাহলে শোভা খুব সুখী হবে। না হোক নিজের সংসার, মিলি’টারই হোক!
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। সাদের সাথে শোভার মিল চাচ্ছেন কেন অনেকে? ওর সাথেই কী শোভার ভবিষ্যৎ দেখতে চান আপনারা!! রেগুলার দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করছি, তাই হয়তো ছোট হয়ে গিয়েছে। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। রি-চেইক দেওয়া হয়নি।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!
#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
সাইফের মায়ের সাথে ভেতর ঘরে মিলির কী কথা হলো, সেটা কেউওই জানতে পারলোনা। কিন্তু দীর্ঘ আধঘন্টা পরে যখন ওরা ঘর থেকে বেরুলো তখন শোভা আতংকে অস্থির। মিলি যদি বিয়েতে রাজি না হয়? মিলি একবার না করে দিলে সাইফের মাও রাজি হবেনা বিয়েতে।
শোভা চোখমুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইফের মা সোফায় বসলো। মিলি দাঁড়িয়ে রইলো শোভার পাশে। সাইফ মায়ের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু মহিলা কিছু বলছেনা। রমজান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
‘ মিলি বিয়েতে রাজি?’
‘ জি আংকেল।’
মিলির কথায় শোভা অবাক। মেয়েটা এতো সহজে রাজি হয়ে গেলো? কীভাবে সম্ভব! কিন্তু যারপরনাই খুশিও হলো।
রাফু আর তুতুল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। মিলির আঁচল ধরে বললো, ‘তুমি বিয়ে করবে ছোটআম্মু?’
মিলি বললো,
‘ হুম।’
‘ আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?’
মিলি কিছু বললো না।
রাফু বললো,
‘ বিয়ে করে তুমি আমাদের ভুলে যাবে?’
শোভা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ‘কখনো না।’
‘ তাহলে বিয়ে করবে কেন?’
‘ সবাইকে করতে হয় বাবা।’
‘ তুমিও করেছো?’
শোভা সবার সামনে থতমত খেয়ে গেলো। মিলি বললো, ‘হুম। মাও বিয়ে করেছে।’
‘ বিয়ে করলে কী বর হয়? সাইফ আংকেল কী তোমার বর হবে?’
‘ হুম।’
‘ তাহলে মায়ের বর কোথায়?’
এবার মিলি আর শোভার দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সাইফের মা বিষয়টা বুঝতে পারলেন। তিনি আগে থেকেই সাইফের কাছে শোভা, মিলির সব কথা শুনেছেন। তাই তিনি এবার উঠে রাফুকে কোলে নিলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ তোমার মায়ের বর হলো তোমার আব্বু। আর তুমি জানো তোমার আব্বু মাকে পছন্দ করেনা। তাইতো আম্মু চলে এসেছে।’
‘ পছন্দ না করলে বিয়ে করেছে কেন?’
‘ সেটা তোমার আব্বু জানে।’
রাফু কোল থেকে নেমে গিয়ে মিলির কাছে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘তুমি বিয়ে করে নাও ছোটআম্মু। সাইফ আংকেল তোমাকে পছন্দ করে, সে আমার আব্বুর মতো নয়।’
মিলি আলতো হাসলো। শোভার চোখে পানি এসে গেলো। তুতুল চুপচাপ মিলিকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু-ভাইবোন শুধু জানে তাঁদের ছোটআম্মু আর তাঁদের সাথে থাকবেনা। বিয়ে হলে সবাই নাকি বরের বাড়ি চলে যায়।
এদিকে সাইফ দারুণ খুশি। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছেনা মিলির দিকে কীভাবে তাকাবে! কোনোদিন তো বলেওনি যে সে মিলিকে ভালোবাসে। আজ হুট করে মেয়ে দেখতে এসে মা বলছে আজ নাকি ওর বিয়ে। বিয়ের কোনো প্রস্তুতিই তো সে নেয়নি!
যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাত আটটার দিকে শোভার বাড়িতে সাইফের বাড়ির কিছু মেহমান এলো। সাথে বিয়ের যাবতীয় তৈজসপত্র, প্রসাধনী। শোভা মিলিকে সাজিয়ে দিলো। শোভার নিজের বিয়েটা হয়েছিল একদম সাদামাটা। সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সাদ তখন সদ্য চাকুরীতে জয়েন করেছে। নববর্ষ উপলক্ষে সাদ শোভাকে একটা সাদা জামদানী উপহার দিয়েছিলো, সাথে সাদা কাচের চুড়ি। চুলে গুঁজেছিলো বেলী ফুলের সুবাস মোড়ানো সাদা মালা। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপগ্লস। এই সাজেই শোভাকে সেদিন অপ্সরা লাগছিলো। সাদ পরেছিলো ওর সাথে মিলিয়ে সাদা পাঞ্জাবি, ওকেও দারুণ দেখাচ্ছিলো। দুজনেই সেদিন জীবন উলটপালট করা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো পরিবারের কাউকে না জানিয়ে। কাজি অফিসে বিয়ে সারার পর সাদ শোভাকে কথা দিয়েছিলো কখনো ছেড়ে যাবেনা। হাহ, কিন্তু আজ এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও কেউ কারো মুখদর্শন পর্যন্ত করেনি। না করতে চায়! সাদ হয়তো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারে, কিন্তু শোভা পারবেনা। কারণ শোভা বলেছিলো সাদ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ শোভার জীবনে আসবেনা কখনোই। আসেনি, কখনোই দ্বিতীয় মানব শোভার জীবনে আসার পথ পায়নি। শোভা সেই সুযোগ দেয়নি। কী এমন ক্ষতি হবে একলা জীবন কাটালে? কিছুই না। হয়তো বাচ্চাগুলো কাউকে বাবা ডাকার সুযোগ পাবেনা, বাবার ভালোবাসা পাবেনা৷ না পাক, সাদের নোংরা ভালোবাসা কখনোই শোভার সন্তানেরা ডিজার্ভ করেনা।
যাইহোক, শোভা মিলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। লাল শাড়ি, চুড়ি, গয়না সব মিলিয়ে পরী পরী ভাব। মিলি এতকিছু পছন্দ করে না। তাই রেগে বললো, ‘কী করছিস শুভি? আমি তো নিজেকেই চিনতে পারছিনা।’
শোভা বললো, ‘বিয়ের দিন মেয়েরা নিজেদের চিনতে পারবেনা, এটাই স্বাভাবিক।’
‘ তাই বুঝি?’
‘ হুম।’
‘ তোর বিয়েতেও তুই নিজেকে চিনতে পারিসনি?’
‘ নাহ। আমি নিজেকে ঠিকই চিনেছিলাম, কারণ সেদিন আমার সাজগোজ ছিলোনা। যেমন ছিলাম, তেমনই। শুধু চুলে বেলীফুলের মালা গুঁজেছিলাম!’
‘ তো আমাকেও সেভাবেই সাজিয়ে দে।’
‘ না।’
‘ কেন?’
শোভা কঠিন গলায় অদ্ভুতভাবে বললো, ‘ জানিস আমি সেদিন সাদা শাড়ি পরেছিলাম। সাদা শাড়ি
মানে জানিস? বিধবাদের রঙ। সেদিন আমাকে বিধবা বউ লাগছিলো৷ তাইতো দেখলি না, আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। আমিতো বিধবাদের মতোই বাস করছি। তাই আমি তোকে লাল রঙে সাজাচ্ছি। তোর জীবন রঙিন থাকবে সবসময়। তুই খুব ভালো, তুই সুখ ডিজার্ভ করিস। তুই আজীবন আনন্দে কাটা সাইফ ভাইয়ের সাথে। তুই আমার জন্য যা করেছিস, অন্য কেউ হলে কখনোই করতোনা। তুই ঘর-সংসার নিয়ে সুখে থাক, এছাড়া আমি আর কিছুই চাইনা।’
মিলি শোভার গালে হাত রেখে বললো, ‘কাঁদছিস কেন?’
‘ এমনি। পুরোনো কথা আজ খুব মনে পড়ছে।’
‘ এখনো ভুলতে পারিসনি!’
‘ সব অতীত ভোলা সহজ নয়। আর কিছু কিছু অতীত ভুলে যাওয়ারও নয়। এটাই আমাকে আরও সাহসী হতে সাহায্য করে।’
‘ তুই অনেক বড় হবি শুভি।’
‘ তুইও অনেক ভালো থাকবি।’
রাফু গালে হাত দিয়ে বসেছিলো। মিলিকে এতো সাজগোজ করতে দেখে ওর মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। মিলি কখনোই সাজেনা, রঙিন কাপড়ও পরেনা। কিন্তু ওকে আজ খুশি হতে দেখে দু-ভাইবোন খুব আনন্দ পেলো। রাফু সাইফকে বর সাজতে দেখে বললো,
‘ আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দিবেনা কিন্তু।’
সাইফ হেসে বললো, ‘আচ্ছা।’
‘ বকবেনা কিন্তু!’
‘ বকবোনা।’
‘ ইনজেকশন দিবেনা। তুমি খুব পচা ডাক্তার, সেবার আমাকে যেভাবে ইনজেকশন দিয়েছিলে ছোটআম্মু আমার কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলেছিলো।’
সাইফ বোকার মতো বললো, ‘ইনজেকশন তো অসুস্থ হলে দিতেই হবে।’
‘ না দিবেনা।’
‘ ধরো, তোমার ছোটআম্মুর বেবী হবে! তখন কিন্তু তোমার ছোটআম্মুকে ইনজেকশন নিতেই হবে।’
‘ কেন?’
‘ সুস্থ থাকার জন্য।’
তুতুল মুখটা কালো করে বললো, ‘সব আমার ছোটআম্মুকে কষ্ট দেওয়ার ধান্ধা, তাইনা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। সবাইকে গিয়ে বলবো।’
রাফু আর তুতুল দৌড়ে দৌড়ে মেহমান সবাইকে গিয়ে এই কথাটা বলছে। বলতে বলতে হঠাৎ মিলির কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ জানো ছোটআম্মু, তোমার বরটা তোমাকে নাকি বেবী হবার সময় ইনজেকশন দিবে।’
শোভা চোখ পাকিয়ে তাকালো। মিলি অবাক হয়ে বলল,
‘ কীহ?’
‘ হুম। তোমাকে গুঁতো দিবে বলেছে।’
‘ বেবীর কথা কে বলেছে?’
‘ সাইফ আংকেল।’
মিলি রেগে কিড়মিড় করে শোভাকে বললো,
‘ দেখলি? এইজন্য আমি পুরুষ জাতটাকে দেখতে পারিনা। এখনো বিয়েই হয়নাই, আর এই হাঁদা ডাক্তার বেবী অবধি আগায় গিয়েছে।’
শোভা মুচকি হেসে বললো,
‘ তো আগাবেনা? বয়স কত দেখছিস?’
‘ হাঁদার বয়স ধুইয়া পানি খাবো! আমার কোনো বাচ্চার দরকার নাই। আমার অলরেডি বাচ্চা আছে, তাও দুইটা।’
শোভা মুখ কালো করে বললো,
‘ এইরকম কথা বলবি না। তোরও কিউট বাচ্চা হবে।’
মিলি গম্ভীর মুখে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কাজি এলো। মিলি আর সাইফের বিয়েটাও হয়ে গেলো ভালোভাবে। মোনাজাত শেষ করার পর খাওয়াদাওয়া হলো। সাইফের মা অনেক ভালো, নিজেই সব কাজে সালমা বেগমকে সাহায্য করলেন। মিলি রাগী চোখে সাইফের দিকে তাকিয়ে আছে, তার কারণ সাইফ বোকার মতো মিলিকে দেখে ঘামছে। আর সবাই নানা লজ্জ্বাজনক কথা বলছে। আজ রাতটা শোভাদের বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত করা হলো।
বিয়ের পর্ব নির্বিঘ্নে শেষ হওয়ার পর শোভা নিজের ঘরে গেলো। দরজা আটকে বসে রইলো। মনটা বড্ড কেমন কেমন করছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ঘোলাটে হচ্ছেনা কিছুতেই, সব পরিষ্কার। যেন সেদিনের ঘটনা। মিলিটার একটা গতি করে দিতে পেরে শোভার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে দাঁড়ালো জানালার কাছে। অন্ধকার ঘরটাতে শোভার দীর্ঘশ্বাসের শব্দগুলো ভোঁতা হয়ে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি! অসময়ে দুনিয়া উলটপালট করে ধুলো উড়ানো ঠান্ডা বাতাসে পথঘাট ছেয়ে গেলো।
________
রাস্তার পাশের ভাতের হোটেলটায় দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যাবৎ বসে আছে সাদ। সাইফের অপেক্ষা করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো। কিন্তু ডাক্তারের পাত্তা নেই। এর মধ্যেই হোটেল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সাদ বাইরে এসে দাঁড়ালো। আজ কিছুতেই সাইফকে হাতছাড়া করবেনা সে। নিশ্চিয় কিছু না কিছু সাইফ জানে। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। রাস্তায় তো আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না।
কিছু একটা ভেবে সাদ পা বাড়ালো ওই বাড়িটার দিকে, যে বাড়িটাতে সাইফ আছে। দোতলায় উঠে দেখে বাড়ির ভেতর থেকে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। সাদ ভেজা সিক্ত গা নিয়ে পা বাড়ালো। ডোরবেলা বাজাতে লাগলো, কিন্তু বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দে সেই আওয়াজ কারো কানে পৌঁচ্ছাছে না। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি কেন নামলো সাদ বুঝতে পারছেনা। এই অসময়ে বৃষ্টিটা না হলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো!
দীর্ঘ পাঁচ মিনিট পর, যখন বর্ষণ আরো জোরে হচ্ছে তখন কেউ একজন ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো। কিন্তু মানুষটাকে সাদ দেখতে পেলোনা। যেই না সাদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে তখনই বিকট শব্দ করে কারেন্ট চলে গেলো। সাদ চমকে উঠলো সেই শব্দে।
নিজেকে ধাতস্থ করে সাহস নিয়েই সাদ ভেতরে ঢুকলো। মাঝারি আকারের ড্রইংরুমে অন্ধকার চোখে সয়ে নিতে সাদের সময় লাগলো, বেমালুম ভুলে গেলো যে পকেটে সেলফোন আছে। দেখলো একটা ছোট ছেলে সোফার উপর দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখ ভেজা। মোমবাতির হলুদ আলোয় একটা মেয়েকে দেখতে পেলো সাদ। খুব চেনা চেহারা। মেয়েটা শাড়ি পরে আছে, খোঁপা করা চুল। বাচ্চা ছেলেটির মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে মেয়েটি, আর বকবক করছে। সাদ চমকে উঠে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সেদিকে!
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। অনেকদিন পর দিলাম, আমি সবটা গল্প ভুলে গিয়েছি। জানিনা কেমন হয়েছে। এতোদিন ফেসবুকে ঢুকতে পারিনি, তাই দিতে পারিনি। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!