এক_পশলা_বৃষ্টি,১৪,১৫

0
313

#এক_পশলা_বৃষ্টি,১৪,১৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

‘ রাফু তুমি কিন্তু বড্ড দুষ্ট হচ্ছো।’

রাফু গাল ফুলিয়ে বলল,

‘ আমি দুষ্ট নই।’

‘ তাহলে এরকম ভিজলে কীভাবে?’

রাফু মাথা নিচু করে রইলো। শোভা ধমক দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘ বল!’

‘ সাইফ আংকেল।’

শোভা অবাক হয়ে বলল,

‘ কী করেছে?’

‘ ওনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এভাবে বৃষ্টির পানি দিয়ে ছিঁটাছিঁটি করছিলো। আমি ওখানে গেলে আংকেল বলল এটা নাকি অনেক মজার খেলা। বৃষ্টির সাথে খেলা না করলে নাকি জীবন সুন্দর হয়না।’

শোভা ছেলের মুখে পাকাপাকা কথা শুনে মাথায় হাত দিলো। তার শান্ত, ভালো বাচ্চাটা আজকাল বড্ড চটাশ চটাশ কথা বলা শিখেছে। শোভা হেসে তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলল,

‘ ঠিকই বলেছে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে খেলা করতে হয় বড় হলে।’

‘ কত বড়?’

‘ এই ধরো আমার মতো।’

‘ তোমার মতো বড় হতে তো আরও অনেক বছর লাগবে। ততোদিন কী আমি বৃষ্টিতে ভিজবো না?’

‘ ভিজবে, কিন্তু অল্প!’

‘ তুতুল ও ভিজবে?’

‘ হুম। মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে।’

‘ তুমিও!’

শোভা উত্তর দিলোনা। কারণ বৃষ্টিতে ভিজার মন সেদিনই মরে গিয়েছিলো যেদিন ওর রঙিন জীবনটা
সাদ নামক মানুষটার হাতে মরে গিয়েছিলো। হঠাৎ চোখের কোণ মুছে ড্রইংরুমের কর্ণারে রাখা টিস্যু পেপারের বক্সটা আনতে ঘুরলো তখনই ওর চোখ গেলো দরজার দিকে। আবছা আলোয় একটা সুঠামদেহী পুরুষের অবয়ব মেঝেতে লুকোচুরি খেলছে। শোভা ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দুরু দুরু বুক নিয়ে যেই না সামনে এগুলো, তখনই দেখতে পেলো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।এবং লোকটা আর কেউ নয় ওর অতিপরিচিত, একসময়ের প্রিয় মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, শোভার প্রাক্তন স্বামী সাদ চৌধুরী। পরনের বসন ভেজা। মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু শোভা সে দৃষ্টিকে প্রাধান্য দিল না। কারণ এখন শুধুই তার প্রাক্তন। ওর সাথে কোন সম্পর্ক হবার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই। তারচেয়ে বড় কথা এই লোকটা একটা প্রতারক এইসব ভেবে ভাবতে-ভাবতে শোভা একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখা এক পশলা বৃষ্টি ওর কাছে ভয়ানক হয়ে উঠল। শোভা ভাবনার জগৎে ঢুকে প্রাণপণে চাইছে মুছে যাক এই এক পশলা বৃষ্টি পৃথিবীর বুক থেকে। দীর্ঘ কয়েকটা ক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো।

এই অন্ধকার রাত্রিতে শোভা যখন দরজার সামনে সাদ কে দেখতে পেল তখন সে চমকে উঠলো! মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, একি দেখছে ও? আদৌ সত্যি এটা? নাকি চোখের ভুল! এতোক্ষণ ভেবেছিলো এটা বুঝি হ্যালুসিলেশন। কিন্তু অবয়বটা তো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি সতেজ।

তাহলে কী সত্যি! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে কেন এসেছে মানুষটা ওর গোছানো জীবনটা তছনছ করতে আবারো? সাদ কী এখনো শান্তি পায়নি শোভার জীবন নষ্ট করে।

সাদ নিজেকে ধাতস্থ করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,

‘শোভা?’

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শোভা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আপনি?’

‘হুম আমি।’

‘আপনি কী সত্যিই এসেছেন?’

‘হুম।’

‘একটা খারাপ মেয়ের কাছে কী দরকারে?’

সাদ বলার ভাষা খুঁজে পেলোনা। ভেজা গায়ে বেশিক্ষণ থাকার ফলে হাঁচি-কাশি দিতে লাগলো। শোভা হাতে থাকা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলো ওর উপর। মুখে বলল,

‘ মুছে নিন।’

সাদ নিলো তোয়ালেটা। মাথার চুলগুলো মুছে সেভাবেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘ আপনি কী এখন চলে যাবেন? বাইরে যেহেতু আবহাওয়া খারাপ, একটু পরে গেলে ভালো হয়। বসুন।’

‘ আসলে তোমার সাথে আমার খুব প্রয়োজন আছে।’

‘ কী প্রয়োজন?’

‘ বাসায় কী আর কেউ নেই?’

‘ আছে। অনেক মানুষ আছে, ভেতরের ঘরে।’

‘ ওহহ!’

শোভা বলল,

‘ বাসায় অনেক মেহমান আছে। আশা করি আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে সিনক্রিয়েট হয়।’

‘ কী হয়েছে বাসায়?’

‘ মিলির বিয়ে।’

‘ মিলি মানে? আমাদের মিলি?’

‘ আমাদের নয়, আমার মিলি।’

সাদ চুপ করে রইলো। এতোক্ষণ শোভা ওর সাথে নম্রভাবেই কথা বলেছে। সাদ চাইছে এভাবেই ওকে শান্ত রাখতে। কারণ ওকে উত্তেজিত করলে পরিস্থিতি উল্টোদিকে চলে যাবে। সাদ সোফায় বসলো। ভেতরের ঘরগুলো থেকে মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। কারেন্ট এখনো আসেনি, যার ফলে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। আর মোমবাতির আলোয় যতটুকু
দেখা যাচ্ছে তাতে শোভার অবয়ব শুধু ছায়ার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে। ওর চেহারা সাদ দেখতে পাচ্ছেনা, কারণ শোভা আগেই ওর মুখ ঢেকে নিয়েছে। লোকটাকে নিজের মুখ দেখাতে ও চায় না। সাদ বুঝতে পারলো এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

কিন্তু রাফু এতোক্ষণ মাকে একটা অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে দেখে চুপ হয়ে ছিলো। শোভা ওকে নিজের সাথে আগলে রেখেছিলো। ও ভাবতেও পারছেনা সাদ এখানে অবধি পৌঁছে গিয়েছে। বুকের ভেতর ভয়ের বিশাল একটা দেয়াল তৈরি হলেও নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে ও লোকটার সাথে কথা বলছে। পাছে না রাফুকে চিনে ফেলে। এটারই আভাস পাচ্ছিলো কী শোভা? পুরোনো স্মৃতিগুলো একারণেই মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছিলো! এইসব খারাপ স্মৃতি কেন মুছে না ওর জীবন থেকে? অভিশপ্ত অতীতের থেকে যেন পালানোর কোনো পথ নেই।

শোভা রাফুকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। সাদ একা সোফায় বসে আগের দিনগুলোর কথা ভাবছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। আনন্দও হচ্ছে। আচ্ছা ওর বাচ্চাগুলো কোথায়? এতোক্ষণ তো ওদের কথা মনেই পড়েনি। আরে, শোভা যে বাচ্চাটার মাথা মুছে দিচ্ছিলো ওটাই! ওয়েট ওয়েট…ডিজগাস্টিং। এটা নিশ্চয় ওর সন্তান। এত কাছাকাছি থেকেও সাদ বাচ্চাটার দিকে একবার তাকালো না, ড্যাম ইট! ওর রাগ হতে লাগলো। কিন্তু এখন রাগলে চলবেনা। এখানে যেহেতু এসেছে ড্যাম শিওর বাচ্চাদের নিজের কাছে পাবেই। তাই সাদ রিল্যাক্স হয়ে বসলো। বাইরে এখনো ঝড়ো বৃষ্টি। সাদের বুকে জমে আছে হাজারো মেঘের টুকরো। শোভাকে যদি সবসময় ও কাছে পেতো, চিরদিন যদি একসাথে থাকতে পারে এটাই বোঝাবে ও শোভাকে। ও নিশ্চয়ই রাজি হবে। জানালার দিকে একমনে তাকিয়ে সাদ গুনগুনিয়ে গান ধরলো!

“কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয়না,
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না
?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না?”

____________________

মিলি বসে আছে সোফায়। সামনে খাটে বসে আছে সাইফ। দুজনেই চুপ। মিলি বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো। সাইফ ভয়কে জয় করে বলল,

‘ মিলি!’

মিলি সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ কী?’

‘ মানে বলতে চাইছিলাম আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন?’

‘ আপনি যে কারণে রাজি, আমিও সেকারণেই।’

‘ বুঝতে পারলাম না।’

‘ আপনার আম্মু খুব করে আমাকে পছন্দ করেছে, আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে নিয়েছে, ওনি খুব করে চায় যাতে আমি আপনাকে বিয়ে করি, শুভিও চায়। আমার সন্তানেরাও মত দিয়েছে আপনাকে বিয়ে করতে। আন্টি-আংকেলরাও চায়। সবচেয়ে বড় কথা আপনার আম্মুর চিন্তাভাবনা আর আমার চিন্তাভাবনা এক, আমাদের মাঝে কোনো ফারাক নেই। আমি এমন একজনকে মা হিসেবে পেয়ে খুবই খুশি। এসব কারণেই আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।’

সাইফ একটু রাগলো। সবার চাওয়া-পাওয়া মিলি দাম দিলো। কিন্তু প্রথম থেকেই যে সাইফ ওকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, ওর জন্য পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছে সেটা কী মিলির কাছে কিছুই নয়? মিলি এতো নিষ্ঠুর? সাইফের জন্য কী ওর মনে একটু জায়গাও নেই? এতগুলো বছরেও সাইফ ওর জীবনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি? মিলিকে বিয়ে করে কী ও কোনো ভুল করেছে!

এসব ভেবেই একপ্রকার রাগের মাথায় সাইফ মিলিকে বলল,

‘ আপনি সবার কথাই বললেন। কিন্তু আমার কথা তো একবার ভাবলেনও না আপনি প্রিয়তা! আমি যে আপনার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করলাম, সেগুলোর কোনো দাম নেই? দেখুন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আপনার প্রতীক্ষায় রয়েছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি কেন বুঝেও না বোঝার ভান করেন? কেন?’

মিলি প্রথমে অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর দ্বিতীয়বারের মতো থাপ্পড় পড়লো সাইফের গালে। ভেজা চোখ নিয়ে সাইফ মিলির ফিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সাইফের কাছে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,

‘ বিশাল বড় ভাষণ দিতে পারেন, আর এই ছোট্ট কথাটা বলতে পারেন না যে “আমি আপনাকে ভালোবাসি?” এটা বলতেই আপনার পাঁচ বছর খরচ হয়ে গিয়েছে?’

সাইফ অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আপনি ভালোবাসার কথায় বিশ্বাস করেন না বলেই বলিনি।’

‘ তাহলেও বলতে হয়।’

‘ বলতে গেলেই আপনার হাতের থাপ্পড়ের শিকার হতাম। নয় কী?’

‘ হুম। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির হাতে থাপ্পড় খাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

সাইফ হাসলো। মিলিকে বলল,

‘ আপনাকে এখন সত্যি সত্যি আমার মনে হচ্ছে।’

‘ তাই নাকি?’

‘ হুম।’

মিলি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ প্রিয়তা কে?’

‘ আমি যাকে পছন্দ করি সে কল্পিত আপনি!’

মিলি কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলতে রেডি হচ্ছিলো, কিন্তু তা হলোনা। কারণ বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচি আসছে। শোভার চেঁচামেচি। মিলি বুঝতে পারলো না বৃষ্টিভেজা এই মুহূর্তে, এতো রাতে, শোভা ঘরভর্তি মেহমান রেখে কীভাবে চেঁচামেচি করছে। কিন্তু কিছু একটা না হলে শোভা কখনো এমন করবেনা। সাইফও অবাক হলো। দুজনে নিজেদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে ড্রইংরুমে গেলো। এবং অন্ধকারে টর্চ লাইটের আলোয় যাকে দেখলো সেটার জন্য ওরা কেউই প্রস্তত ছিলো না।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। আপনারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন গল্প থেকে। লিখার গতি তাই কমে গিয়েছে। আজকের পর্বপুরোটাই ভয়েজ টাইপ, তাই ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন। পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

কিছুক্ষণ আগে।

শোভার হাতে থাকা মোমবাতিটা বাতাসে নিভে যায়। রাফুকে টুলের ওপর বসিয়ে দেয়। ও রাফুকে ছেড়ে দেশলাই খুঁজতে থাকে। তারপর আবার মোমবাতিটা জ্বালিয়ে রান্নাঘরের এঁটোবাসন গুলো ধুতে থাকে। কফির জন্য পানি বসায়। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস, রাতে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খায়। তাছাড়া সাদ আছে বাসায়, ভাবতেই ওর প্রচন্ড মনখারাপ হলো। এই যা, বৃষ্টিটা আরেকটু কমলেই ওকে বের করে দেবে বাসা থেকে। ভাবনায় মগ্ন থাকার এই ফাঁকে রাফু ড্রইংরুমে চলে আসে। ওর কৌতূহল হয় সোফায় বসে থাকা লোকটার প্রতি। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রাফু সাদের কাছে আসে। সাদ চোখ বন্ধ করে ছিলো বিধায় রাফুকে দেখতে পায়নি।

রাফু সাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কে আপনি?’

সাদ চোখ খুলে রাফুকে দেখে। দ্রুত নিজের কাছে টেনে নেয়। অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর। রাফুর মায়াভরা মুখটা দেখে ও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। শোভার সাথে প্রচুর মিল চেহারায়। তাহলে এটা কী ওরই ঔরসজাত সন্তান? ওর ছেলে?

সাদ জিজ্ঞেস করে,

‘ আমি সাদ চৌধুরী। তুমি কে?’

‘ আমি আল-রাফি। সবাই রাফু বলে ডাকে।’

‘ বয়স কত তোমার?’

‘ আম্মু বলে পাঁচ।’

‘ কীসে পড়ো?’

‘ বলবো না।’

সাদ হেসে বললো,

‘ আচ্ছা, আচ্ছা।’

‘ আপনি কে বললেন না তো?’

‘ একটু আগে যে মেয়েটা তোমার চুল মুছে দিচ্ছিলো ওনি কে হন তোমার?’

‘ আমার আম্মু।’

‘ তোমার আব্বু নেই?’

‘ আছে।’

‘ কী করে সে?’

‘ জানিনা। আমি কখনো দেখিনি।’

সাদ এবার নিশ্চিত হয় যে রাফু ওরই সন্তান। সে ওকে বুকে আগলে নেয়। তার আগে রাফুর বয়স যাচাই করে নিশ্চিত হয় যে শোভার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে কিনা। কারণ নিয়ন বলেছিলো শোভাকে বিবাহিত লাগে। যদিও সাদের সেরকম মনে হয়নি।

রাফুর প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগলো। সে শুনেছে যারা বাচ্চাদের সাথে বেশি ঘেঁষতে চায়, ওরা ছেলেধরা হয়। তাই রাফু বলল,

‘ আমাকে ছাড়ুন।’

সাদ ওকে ছেড়ে দিয়ে গালে আর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে নিচু গলায় বলল,

‘ আমার ছেলে।’

রাফু শুনতে পেলোনা। ও নিজের গাল মুছতে মুছতে বলল,

‘ আপনি কে হন আমার আম্মুর?’

সাদ কিছুই বলল না। রাফুর দিকেই তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,

‘ তোমার আম্মুর খুব কাছের একজন।’

‘ বুঝিনি।’

‘ মানে খুব গভীর সম্পর্ক আমাদের।’

‘ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা আংকেল। আপনার কথাগুলো ভালো না। আপনি কী কোনো চোর-ডাকাত?’

সাদ ধাক্কা খেলো ছেলের কথা শুনে।

রাফু ওর থেকে দূরে সরে যেতে চাইলো। বৃষ্টি কমে গিয়েছে একটু। রাফুর মুখে ভয় ফুটে উঠলো। লোকটা আবার সত্যিই ছেলেধরা নয় তো? রাফুর ভয়ার্ত দৃষ্টি সাদের চোখ এড়ালোনা। চট করেই মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেলো সাদের। ভাবলো, এখন যেহেতু ওর আশেপাশে কেউ নেই, রাফুকে নিয়ে চলে গেলেই তো পারে। বাই চান্স যদি শোভা ওর সাথে যেতে বা থাকতে রাজি না হয় তাহলে তো একূল-ওকূল সবকূলই হারাবে। শোভাও সতর্ক হয়ে যাবে বা অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে এই কাজটা করে ফেলাই বেটার। দুজন সন্তান না হোক, একজনকে নিজের কাছে রাখতে পারলেও অন্তত সাদের বুকটা কিছুটা হালকা হবে। আর শোভা! প্রথম কিছুদিন ছেলেকে ছাড়া থাকতে হয়তো একটু কষ্ট হবে, কান্না করবে৷ তারপর ভুলে যাবে। হুম, প্ল্যানটা বেশ ভালো।

যেই ভাবা সেই কাজ। সাদ রাফুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। বলল,

‘ এদিকে আসো তো একটু।’

‘ কেন?’

‘ ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘ তাহলে কেন এসেছেন?’

‘ বন্ধুত্ব করতে।’

‘ কার সঙ্গে?’

‘ তোমার সঙ্গে। আচ্ছা, তোমার আরও একটা ভাই আছে তাইনা?’

‘ না না। বোন।’

‘ নাম কী ওর?’

‘ উম্মে রুফি। সবাই তুতুল বলে ডাকে।’

‘ বাহ! কিউট নেইম।’

এভাবেই রাফুকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, গল্প করে দীর্ঘ পাঁচমিনিট যাবৎ। কৌতুক বলে রাফুকে হাসায়। জাদুকরের মতোই মিশে যায় রাফুর সাথে। বাচ্চাদের ইম্প্রেস করার জন্য একেবারে পারফেক্ট সাদ। রাফুও সহজেই মিশে যায় লোকটার সাথে। এরই সুযোগ কাজে লাগায় সাদ।

‘ রাফুবাবা!’

‘ জ্বি!’

‘ বৃষ্টি ভালো লাগে?’

‘ হুম।’

‘ ভিজবে?’

‘ নাহ।’

‘ কেন?’

‘ আম্মু না করেছে। ছোটআম্মু বকা দেবে।’

‘ কেউ কিছু বলবেনা৷ আমার সাথে চলো।’

রাফু আঁৎকে উঠে বলল,

‘ কোথায়?’

সাদ হেসে বললো,

‘ ছাদে। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় বাবা, নইলে তুমি এর মজাই বুঝবেনা। এতো এতো পানি কী আল্লাহ তায়ালা এমনি এমনি ফেলছে? আমাদের জন্যই তো ফেলছে যাতে আমরা আনন্দ করতে পারি। তুমি কী এই আনন্দ উপভোগ করতে চাওনা?’

রাফু গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলো। সাদ যেহেতু বলেছে ওর সাথে ভিজলে মা কিছু বলবেনা, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু বলবেনা। ও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘ চাই।’

সাদ মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

‘ তাহলে দেরি কেন? চলো।’

ওদিকে থালাগুলো ধুয়ে শোভা মুছে রেখে দিলো। কফির পানিটা ফ্লাস্কে ঢেলে নিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো রাফু টুলের উপর বসা নেই। টুলটা একটু উঁচু হওয়ায় রাফু নামতে পারেনা সেখান থেকে। এজন্যই শোভা নিশ্চিত মনে কাজ করছিলো। তাহলে নামলো কীভাবে? সাদ! ওহ মাই গড। ভেবেই দৌড়ে করিডোর আর বারান্দা পেরিয়ে ধুপধাপ করে ড্রইংরুমের দিকে ছুট লাগালো শোভা।

হাত থেকে টর্চটা যেন পড়ে যাবে। শরীর কাঁপছে। কেউ তো জানেই না সাদ এখানে, তাহলে এতোক্ষণে ওকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতো সবাই। নাহ, ভুলটা শোভারই। সাদকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া বা বসতে দেওয়াটাই ওর সবচেয়ে বড় ভুল। কীভাবে পারলো এই মস্ত বড় ভুল করতে? এতোটাও নির্বোধ ও হলো কী করে?

একছুটে ড্রইংরুমে এসে শোভা দেখলো সাদ নেই। রাফুকে খুঁজে দেখলো সেও নেই। দরজা হাট করে খোলা, শোভা দ্রুত সিঁড়িঘরে এলো। ভেজা জুতোর কর্দমাক্ত পায়ের ছাপ সিঁড়িতে। দ্রুত নামার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে। শোভা একপ্রকার দৌড়ে নামলো নিচে। গিয়ে দেখে রাস্তার ওপাশে রাখা একটা গাড়িতে একটা লোক উঠছে। কোলের বাচ্চাটা দেখে শোভা বুঝতে পারলো এটাই সাদ। রাফুকে নিয়ে পালাতে চাইছে!

বৃষ্টির ঝাপটার তোয়াক্কা না করেই শোভা সেদিকে ছুট লাগালো। হুমড়ি খেয়ে পড়লো একবার রাস্তায়। উঠে আবারও ছুট লাগালো এবং সাদকে একটা ধাক্কা মারলো। ফলে রাফু সাদের কোল থেকে আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। লোহার শিকে লেগে ওর হাত কেটে গেলো, তবে সামান্যই।

আচমকা সাদ হকচকিয়ে উঠলো। টাল সামলে ঘুরে দেখলো শোভা। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সরাসরি দুজন দাঁড়িয়ে আছে। সাদ অনেকবছর পর শোভাকে লক্ষ্য করতে পারলো। ভীষণ সুন্দর হয়েছে শোভা, ভীষণ! চোখ ফেরানো দায়। শাড়িতে আর এলোমেলো চুলে বৃষ্টিতে ভেজা শোভাকে যে এই অন্ধকারেও কেমন লাগছিলো সেটার বর্ণনা করার শক্তিটুকু পর্যন্ত পেলোনা সাদ। কষে একটা থাপ্পড় মারলো শোভা ওর গালে। ভাতের হোটেলের ছাউনির নিচে রাফুকে বসিয়ে দিয়ে দোকানের কাছে পড়ে থাকা একটা ছোটখাটো লাঠি এনে সাদের পিঠ বরাবর কয়েকটা বারি মারলো। রাগে শোভা এতোটাই জর্জরিত যে এটা যে রাস্তা ও বেমালুম ভুলে গেলো।

এদিকে সাদের ভাবান্তর নেই। বুঝে গিয়েছে যে প্ল্যান ফ্লপ করেছে। তাই এভাবেই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো শোভার সুন্দর মুখপানে। রাফু যে ব্যথায় কাঁদছে সেদিকেও শোভার হেলদোল নেই। সাদকে ইচ্ছেমতো মেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রাস্তায়। তারপর রাফুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলো। একটা কথা পর্যন্ত বললো না শোভা।

সাদ শোভার পেছন পেছন গেলো। ডাকছে, দাঁড়াতে বলছে শোভাকে।

‘ প্লিজ দাঁড়াও, শুভি।’

শোভা দাঁড়ালোনা। দৌড়ে বাসার ভিতর ঢুকে পড়লো। সাদও গেলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোভাকে প্রায় ধরেই ফেললো সাদ। আঁচলে টান দিবার চেষ্টা করতে লাগলেই শোভা চেঁচামেচি করতে লাগলো। আর মায়ের কোলে রাফু ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে আছে। এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে যে এই লোকটা একটা ছেলেধরা।

শোভার চেঁচামেচি যখন পৌঁছালো মিলি আর সাইফের কানে, আর তক্ষুণি ওরা ছুটে এলো। এসে সাদকে দেখে ওরা রীতিমতো অবাক হলো। শোভাকে এরকম করতে দেখে দুজনেই ঘাবড়ে গেলো। মিলি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

‘ আপনি এখানে কেন?’

সাদ বলল,

‘ সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে কেন দেবো?’

‘ কারণ আপনার কোনো অধিকার নেই আমার শুভিকে এভাবে হেনস্তা করার!’

‘ আমি কাউকে হেনস্তা করিনি।’

শোভা সাইফের কোলে রাফুকে দিয়ে ধাক্কা দিলো সাদকে। বলল,

‘ তাহলে আমার বাচ্চাকে কেন চুরি করতে এসেছেন?’

মিলি অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে?’

শোভা কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটা বললো মিলিকে। শুনে মিলি রেগে শোভাকেই চড় মেরে বলল,

‘ কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না, জানার পরেও তুই একে খাতির করে ঘরে ঢুকিয়েছিস? তোর বোধবুদ্ধি কবে হবে? তুই এতো সরল, এতো ভালো কেন? এজন্যই সবাই তোকে ঠকাতে চায়।’

‘ আমি পারিনা মিলি। আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনা। কিন্তু ওনি বারবার আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছেন। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে কিছু বলিনি, কিন্তু আমার সন্তানদের দিকে হাত বাড়ালে সেই হাত আমি কেটে রেখে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো। ভালো শুভি যেমন নরম, খারাপ শুভি ঠিক ততোটাই কঠিন। এবার আমি আর কোনো কম্প্রোমাইজ করবোনা, নিজ হাতে শাস্তি দিবো।’

সাদ শোভাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,

‘ ওদের প্রতি তো আমার অধিকার আছে। তা নয় কী?’

‘ নাহ। কোনোদিনই ছিলোনা। আপনি ভুল করছেন। তাছাড়া আপনার নিজের এখন সংসার আছে, নিশ্চয়ই বউ-বাচ্চা, বাবা-মাকে নিয়ে সুখেই আছেন। তাহলে আমার রক্তজল করা বাঁচার প্রেরণাটা বারবার কেন খুন করতে আসেন?’

‘ আমার এখন কেউ নেই শোভা। না হলো ঘর-সংসার, না হতে পেরেছি বাবা। না নিজের বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে পেরেছি। আমার সব এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেলো।’

অট্টহাসিতে মেতে উঠলো মিলি। একেই বোধহয় বলে রিভেঞ্জ অব নেচার বা যেমন কর্ম তেমন ফল। মিলির চোখের কোণে পানি জমে গেলো।

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন। রি-চেইক করিনি।

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here