এক_পশলা_বৃষ্টি #পর্ব-১

0
901

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#পর্ব-১
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

তখন গোধূলির শেষভাগ। সন্ধ্যে নামি নামি করছে। উত্তুরে বাতাস বইছে। আকাশ তার লালাচে আলোখানি নিয়ে টুপ করে ঢুকে পড়েছে মেঘের ভিতর। সেই লালচে আলোটুকু তার অবারিত সৌন্দর্য নিয়ে সন্ধ্যের কালচে রঙের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। কালো মেঘের ঢাকা পড়া সেই গোধূলির আলোর ছটা ঝুম বৃষ্টির সঙ্গে নেমে এসেছিলো পৃথিবীর মাটিতে। গ্রীষ্মের দাপটে তপ্ত হয়ে মানুষ এক ফোটা বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বৃষ্টি এলো অবশেষে। ঢাকা শহর সদ্য বর্ষার পানিতে ভিজে টইটম্বুর। গাছগাছালি ঝাপটা খাচ্ছিলো হাওয়ায়। তুমুল এক বর্ষণের রাত তার সৌন্দর্য ক্ষণিকের জন্য শহরবাসীকে জানান দিচ্ছিলো। বাতাসে কামিনীর গন্ধ, হাসনাহেনার সুঘ্রাণ। রাজধানী ঢাকা শহরের মানুষজন বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দে নিজেদেরকে পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন ভাবছিলো। যখন বর্ষণ কারো কারো জন্য আশীর্বাদ হয়ে নেমেছিলো, তখনই কারো কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছিলো।

প্রেগ্ন্যাসি টেস্টের রিপোর্টটা ঠিক টেবিলের ওপর পড়ে আছে। বিস্ফোরিত চোখে রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে আছে শোভা। স্পষ্ট লিখা আছে প্রেগ্ন্যাসি পজেটিভ। তার মানে শোভা ‘মা’ হতে চলেছে। শোভার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠলো আর আচমকাই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো । ওর রুমমেট মিলি দৌড়ে এসে ধরলো ওকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে শোভার জ্ঞান ফিরলো। ওকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়ে মিলি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো শরীর কেমন লাগছে এখন। শোভা মাথা নাড়িয়ে জানালো এখন ঠিক আছে, ভালো আছে।

মিলি শোভার হাতটা মুঠোতে নিয়ে বললো,
-‘ কী হয়েছে তোর? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করিস না নাকি?’
শোভা কিছু বললোনা। কাউকে বলার মতো মুখই নেই ওর। কী বলবে ও? মা হতে চলেছে? শোভার চোখের কোণে পানি জমে গেলো।
মিলি আবারো জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে রে শুভি? বলনা।’
এবার শোভা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।কেঁদে উঠলো বাচ্চাদের মতো। মিলিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘আমি মা হতে চলেছি মিলি!’
এই কথা শোনার জন্য মিলি প্রস্তুত ছিলোনা। শোভার মুখে হুট করে এমন একটা কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,
-‘কীহ?’
শোভা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
-‘হুম।’
-‘তুই ফাজলামো করছিস কেন? সত্যিটা বল প্লিজ শুভি।’
শোভা শোয়া অবস্থায়ই মিলির কোল জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘আমি সত্যি বলছি মিলি। একবর্ণও মিথ্যে নয়। বিশ্বাস কর।’
মিলি তখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা শোভা এমন কাজ করতে পারে। কাঁপা গলায় বলল,
-‘ক কার সাথে…!’
শোভা মিলির কথা না শুনেই বলল,
-‘সাদ!’
এই নামটা শোনার জন্যও মিলি প্রস্তুত ছিলো না। হতভম্ব হয়ে বলল,
-‘শুভি তুই এসব কী বলছিস? সাদ মানে আমাদের সাদ ভাই?’
-‘হুম।’
-‘ওনি? কীভাবে? এই শুভি বলনা এসব মিথ্যা? দেখ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।’
শোভা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
-‘সত্যি। ক’দিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছিলো না, বমি পাচ্ছিলো। সন্দেহবশত সেদিন হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করালাম, এখন পজেটিভ ফলাফল। এমন কিছু হবে আমি ভাবতে পারিনি।’
মিলি সবকিছু শুনে হতভম্ব। গালে হাত দিয়ে অঙ্ক মিলাচ্ছে। ওকে এমন চুপচাপ থাকতে দেখে শোভা বলল,
-‘ মিলি, প্লিজ বলনা আমি এখন কী করবো?’
-‘ভাবছি আমি।’
মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বললো,
-‘সাদ ভাইকে জানিয়েছিস?’
শোভা মাথা নাড়িয়ে না বোধক জবাব দিলো। মিলি চেঁচিয়ে বললো,
-‘তাহলে জানা যে তুই ওনার সন্তানের মা হতে চলেছিস!’
-‘ওনাকে আমি কী করে বলবো। আমার সাহস নেই এই কথা বলার।’
মিলি রেগে গেলো। এখন এসব কথা বলার মানেটা কী? ধমক দিয়ে বলল,
-‘কেন? এসব করার আগে মনে ছিলো না? এটা তোদের অবৈধ প্রেমের ফসল!’
শোভা মিলির দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এই অপবাদ দিস না প্লিজ!’
-আমি না হয় দেবোনা। সমাজ কী আর চুপ করে থাকবে? তুই এটা কী করলি?’
শোভার চোখমুখ কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা বরাবরই রুপসী। কিছু কিছু সুন্দরী মেয়েরা নাকি একটু বোকা আর ভীতু হয়। শোভাও সে কাতারেই পড়ে। অল্পতেই কেমন চুপসে যায়। মিলির দু’হাত ধরে বলল,
-‘আমায় মাফ করে দে প্লিজ!’
-‘আমার মাফ করা না করায় কিছু আসে যাবেনা। বাচ্চার বাবাকে বল এখন সে কী করবে! নাকি অন্যদের মতো বেঁকে বসবে। আর তোদের দুজনের পাপের ফলে এই নিষ্পাপ ভ্রুণের জায়গা হবে কোনো ডাস্টবিনে। যেখানে কুকুরের দল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে!’

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। হোস্টেলের এই ঘরটাতে শোভা আর মিলি থাকে। মিলি যতোটা স্ট্রং, শোভা ততোটা নরম। আঘাত সইতে পারেনা। এই মুহূর্তে শোভা মাথা নিচু করে কাঁদছে। মিলির প্রচুর রাগ হচ্ছে। এই আলাভোলা মেয়েটাও কিনা আজ এতো বড় ভুলের ফাঁদে পা দিলো। আর সাদ ভাই? ওনি? ছিহ! কীভাবে করতে পারে এই কাজ? মিলির ইচ্ছা করছে শোভাকে কুচিকুচি করে কাটতে। রাগটা সামলে ধমকে সাদকে ফোন কর‍তে বললো। কিন্তু শোভা ফোন না করে হাতে নিয়ে বসে রইলো। মাঝে মাঝে হিঁচকি তুলে কাঁদছে। এসব ন্যাকামি দেখে মিলির আরও রাগ হচ্ছে। আগে মনে ছিলো না এসব করলে ফল কী হয়! এখন এসব করার মানে কী!

মিলির কথায় শোভা অনেক ভেবেচিন্তে ফোন হাতে নিলো। ডায়াল করলো সাদে’র নাম্বারে।
অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্ট নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত সাদ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এসে বসলো সে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, সারাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেলো।। মনটা কেমন খচখচ করছে, ঢকঢক করে বরফ গলা ঠান্ডা পানি গিলে নিলো। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো ওর। নামটা দেখে মুচকি হেসে কল রিসিভ করলো।
-‘হুম বলো!’
শোভার গলা ভারী হয়ে আছে। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলো,
-‘আ আপনি কোথায়?’
-‘অফিসে। কেন?’
-‘দরকার ছিলো।’
-‘আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে নাকি? শোনো এসবের কোনো দরকার নেই। অনেক রাত হয়েছে আর বৃষ্টিও বাড়ছে।’
-‘না সেজন্য নয়!’
সাদ অবাক হয়ে বলল,
-‘তাহলে?’
শোভা ভয়ে ভয়ে বলল,
-‘একটা কথা বলার ছিলো!’
সাদ হেসে ফেললো শোভার ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে।
-‘বলে ফেলো সুন্দরী।’
শোভার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বললো,
-‘আ আমি প্রেগন্যান্ট!’
সাদ শব্দ করে হাসলো। বললো,
-‘রাতেরবেলা এসব মজা না করলেই নয়?’
এই পর্যায়ে এসে শোভা কেঁদে দিলো।
-‘সত্যি বলছি। আমি আপনার সন্তানের মা হতে চলেছি।’
সাদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কী বলছে শোভা? মা হতে চলেছে মানে? সত্যিই? শোভা কখনো মিথ্যে বলেনা, আর গলা শুনেও মনে হচ্ছে কথা সত্য। সাদ শোভাকে বললো,
-‘ফোন রাখো!’
শোভা অবাক হয়ে বললো,
-‘ফোন রাখবো মানে? আপনি কিছু বলুন।’
সাদ বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আমি কী বলবো?’
-‘আমি এখন কী করবো?’
-‘সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি মা, তুমি বাচ্চা রাখবে নাকি রাখবেনা সেটা একান্তই তোমার উপর ডিপেন্ড করছে।’
শোভার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। এটা সাদ? এই কথা কীভাবে বলতে পারছে ও? শক্ত গলায় বলল,
-‘সাদ! আপনি বাচ্চার বাবা।’
-‘জানিনা আমি!’
শোভা অবাক হয়ে বলল,
-‘জানেননা মানে? আপনার সন্তান আমি আমার গর্ভে ধারণ করছি সেটা শুনে আপনি বলছেন কিছু জানেন না? স্বীকার করছেন না কেন সত্যটা?’
সাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
-‘ফোন রাখো। কে জানে কার বাচ্চা।’
শোভা রেগে গেলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
-‘এসব রাখুন। বলুন কী করবো। আপনার মতামতের উপর সবকিছু ডিপেন্ড করছে!’
সাদ ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে বলল,
-‘তাহলে শোনো। বাচ্চা যদি রাখতে চাও, ইট’স টোটালি ইউর প্রবলেম। তাছাড়া আমি শিওর না এটা কার বাচ্চা, আর যদি আমারই হয় তবে আমি ওর সমস্ত খরচ দেবো। আর যদি না রাখতে চাও সেটা সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর করছে। তাতেও আমি হ্যাঁ। কিন্তু কখনো আমার সন্তানের পরিচয় পাবেনা।’
শোভা আহত গলায় বলল,
-‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না সাদ!’
-‘না বোঝার মতো কিছু বলিনি। বাচ্চার সমস্ত খরচ আমার, বাট কখনো আমার ফ্যামিলির সামনে ওকে আনবেনা, আর না আমার পরিচয় দেওয়া যাবে!’

শোভা বজ্রাহত হলো। মানেটা ও খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। ফোন রেখে দিলো। মিলি জানতে চাইলো কী হয়েছে। শোভা কিছু বললোনা। মুখ ঢেকে বিছানায় শুয়ে রইলো। মিলির আর কিছু বোঝার বাকি রইলোনা। যা ভেবেছিলো তাই, সাদ মেনে নেয়নি। সাদ এরকম কাপুরষ হবে মিলি ভাবতেও পারছেনা। বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হোস্টেলে থাকার বদৌলতে এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী মিলি। ফলাফল ওই সিটি হসপিটালের পেছনের ডাস্টবিনে ছোট ছোট নিষ্পাপ শরীরগুলো, যেগুলো কুকুর খুবলে খুবলে খায়। ভালোবাসার নামে এসব অনাচার আজ মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। ক্ষণিকের আনন্দ আর জৈবিক চাহিদা মেটাতে মানুষ কত ভুল পথে পা বাড়ায় সেগুলো দেখে মিলি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। এসব অনাচার কখন সমাজ থেকে উঠে যাবে তা জানেনা মিলি।

শোভা। মধ্যবিত্ত বাবামায়ের দ্বিতীয় সন্তান। মা-বাবা, বড় এক ভাই আর শোভাকে নিয়ে সুখী সংসার। খুব বড়লোক না হলেও যথেষ্ট স্বচ্ছল।
বাসায় থেকে পড়াশোনা ঠিকমতো হয়না বলে শোভা ভার্সিটির হলে থাকে। তাদেরই ভার্সিটির সিনিয়র ছাত্র সাদ চৌধুরী। পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরি করছে। মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক , হাসিখুশি ছেলেটা প্রথম দেখায়ই প্রেমে পড়ে শোভার। অমন সুন্দর মেয়ে দেখে তার মাথা ঘুরে যায়। অথচ কেউ টেরই পায়নি এসব। শোভার প্রতি সবসময় আলাদা কেয়ার দেখাতো, একদিন মনের কথা প্রকাশ করে শোভার কাছে। শোভা প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী না বলে সাদের কাছ থেকে দূরে থাকে। কিন্তু সাদের পাগলামি দেখে অন্যান্য মেয়েদের মতো শোভাও একসময় স্বীকার করে যে, সে সাদকে ভালোবাসে। আবেগের বশবর্তী হয়ে দুজন বিয়ে করে নেয় কাউকে না জানিয়েই, যার ফলে আজ শোভার গর্ভে বেড়ে উঠছে সাদের সন্তান। এসব কথা ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমনকি মিলিও নয়!

এসব ভেবে শোভা চিন্তা করে কীভাবে বাবা-মা’কে মুখ দেখাবে? অনাগত সন্তানের পরিণতি কী? সাদ তো বিশ্বাসঘাতকাই করলো। টাকা দিয়ে কী বাবার ভালোবাসা কেনা যায়? তাহলে সাদ কেন বললো এই সন্তানের খরচ ও দেবে, কিন্তু পরিচয় দিতে পারবেনা? এই বিশ্বাস নিয়ে সারাজীবনের জন্য বাঁধা পড়েছিলো বিয়ে নামক বন্ধনে? ছিহ সাদ! ধিক্কার আপনাকে। মিলির কোলে মাথা রেখে শোভার রাত কাটলো কাঁদতে কাঁদতে। বৃষ্টির সাথে সাথে ওর চোখের জলও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছিলো। বর্ষণের এই রাত শোভার জীবনের একটা অভিশপ্ত রাত হয়ে রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here