#এক_পশলা_বৃষ্টি
#পর্ব-২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
প্রেগন্যান্সির এই ঘটনা শোভা লুকাতে চাইলেও আর লুকিয়ে রাখা গেলোনা। এই খবর মিলি শোভার বাড়িতে জানালো। বাড়ির সবাই যখন জানতে পারলো ওদের শত্রুতা যাদের সাথে, সেই সাদিদ চৌধুরীর ছেলে সাদের বাচ্চা শোভার গর্ভে তখন তারা একপ্রকার মিঁইয়ে গেলো। রাগে, দুঃখে শাফিনের চোখে পানি এসে গেলো। বড় ভাই হয়েও শাফিন শোভাকে ইচ্ছেমতো মারতে লাগলো।
‘ হারামজাদি, তোকে এজন্য বাসার বাইরে পাঠানো হয়েছিলো? এসব বেলাল্লাপনা করতে? তোর একটু লজ্জ্বাও করলোনা? অবৈধ সন্তান পেটে ধরেছিস ছিঃ!’
‘ চুপ করো ভাইয়া। ও অবৈধ নয়, আমাদের বিয়ে হয়েছে!’
শাফিন বোনের মুখে একথা শুনে বাক্যহারা হয়ে গেলো। বললো, ‘কী বলছিস তুই? বিয়ে করেছিস মানে?’
‘ মানে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার বাচ্চা অবৈধ নয়।’
শাফিন আর শোভা। দুজনে পিঠাপিঠি প্রায়। ভাইবোনের সম্পর্ক কেমন হতে হয় তা এই দুজনকে দেখেই বোঝা যায়। স্কুল-কলেজে পড়াকালীন দু’ভাইবোনের মাঝে কোনো গোপনীয়তা ছিলোনা। সারাদিন কী কী হয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কোন ছেলেটা কী বলেছে দুজন দুজনকে শেয়ার করতো। অথচ আজ! শাফিনের আদরের ছোট্ট বোনটা নাকি ওকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। সম্পর্ক কী এমন? দূরে গেলে নাকি সম্পর্ক মজবুত হতো, কিন্তু কই? ওদের মাঝখানে যে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। কী করবে শাফিন? যে বোনটা চুপচাপ, হাসিখুশি ছিলো। প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাস করতোনা। যাকে দিনের পর দিন আগলে রেখেছে সেই বোন যে ওকে না জানিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে, বড় ভাই হয়েও শাফিন আটকাতে পারেনি। বিবেকবান বোনটাও আর সবার মতো আবেগী হয়ে গেলো।
এদিকে সালমা বেগম আর রমজান সাহেব নিশ্চুপ। ওদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে শোভা। এতো বড় ভুল করার আগে শোভার কী একবারও ওদের মুখটা মনে পড়েনি? একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি? ভালোবাসায় কী এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো যে সামনের পৃথিবীটা সে দেখতে পায়নি? দুজন শোভাকে কিছু বলতেও পারেননি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে রমজান সাহেব সাদের সাথে দেখা করলেন। অনেক কাকুতিমিনতি করলেন, কিন্তু সাদ আবারও একই কথা বলে রমজান সাহেবকে ফিরিয়ে দিলো।
শোভা এবার আর কিছু ভাবতে পারলোনা। মিলি প্রচন্ড রেগে গেলো। সে শোভাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এলো সাদদের বাড়িতে। দারোয়ান প্রথমে ঢুকতে দিতে চাইছিলো না। মিলি তাকে ধাক্কা মেরে শোভাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন সাদিদ চৌধুরী। অচেনা দুটো মেয়েকে দেখে তিনি উঠে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কে তোমরা?’
‘ আমি মিলি আর ও শোভা।’
‘ তোমাদের চিনি বলেতো মনে পড়েনা।’
‘ আপনার সাথে আমাদের পরিচয় নেই!’
‘ কী দরকার এখানে? কারো সাথে দেখা করতে এসেছো?’
‘ জি।’
‘ কাকে চাই?’
‘ সাদ ভাইকে!’
‘ সাদ তো ঘরে ঘুমুচ্ছে।’
মিলি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘একটা মেয়ের সর্বনাশ করে সে এখন ঘুমাচ্ছে? বাহ, বাহ!’
সাদিদ সাহেব বললেন, ‘মানে?’
‘ আপনার ছেলেকে ডাকুন, সে এলেই ক্লিয়ার হবে সব।’
‘ কিন্তু করেছেটা কী সে?’
‘ আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন না।’
‘ মিনুর মা, যাও তো। সাদকে ডেকে নিয়ে আসো।’ বুয়াকে বললেন সাদিদ সাহেব। মেয়ে দুটো কী বলছে ওনি বুঝতে পারছেন না। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। সামনেই সাদের বিয়ে, এইসময় যদি মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার ঘটিয়ে থাকে তাহলে সমাজে ওনার উঁচু মাথা হেঁট হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে সাদের মা রোমেলাও এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন, বুঝতে পারছেন না।
শোভা আর মিলি সোফায় বসে রইলো। শোভার মাথা নিচু। চোখের নিচে কালি পড়েছে। উস্কুখুস্কু এলোমেলো চুল কপালের কাছে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে সাদ এলো। ওদেরকে খেয়াল না করেই জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বু তুমি ডেকেছো?’
‘ হুম।’
‘ কিছু হয়েছে?’
‘ সেটা তুমিই ভালো বলতে পারবে!’
সাদ বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখগুলো এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে যখন সোফায় থাকা মেয়ে দুটোর উপর পড়লো, ঘটনা বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। একী হাল তার শোভার? মেয়েটাকে মৃত মনে হচ্ছে।
সাদিদ সাহেব কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ দুটো মেয়েকে তুমি চেনো?’
‘ জি আব্বু।’
‘ কী হয় তোমার?’
‘ আমার বন্ধু।’
শোভা এবার মুখ খুললো। ‘ সত্যি কথাটা বলছেন না কেন?’
সাদিদ সাহেব বললেন, ‘কীসের সত্যি?’
‘ আমি আপনার ছেলের সন্তানের মা হতে চলেছি। ওনি আমায় বিয়ে করেছেন।’
সাদ চুপ। সাদিদ সাহেব এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মুহূর্তেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বলছে কী এই মেয়ে?
তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এসব কী বলছে ও?’
সাদ অকপটে বলে উঠলো, ‘সব সত্য নয়। মিথ্যা। আমি ওকে বিয়ে করেছি ঠিক, বাচ্চা আমার নয়।’
ঘরে যেন বজ্রপাত হলো। মিলি প্রচন্ড রেগে সাদের গালে থাপ্পড় মারলো। থাপ্পড়ের সেই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। শোভা বিস্মিত, কুন্ঠিত। সাদ নিজের বাচ্চাকে স্বীকার করছেনা? এই দিনও দেখতে হচ্ছে ওকে? এর চেয়ে মরে যাওয়াটাও বেশ শান্তির।
সাদ গালে হাত দিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। পারলে কাঁচা গিলে খাবে। মিলি চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘সাদ ভাই! আপনি এতো পাল্টে গেলেন কখন? আমার দেখা সেরা মানুষদের মধ্যে আপনি একজন। আর সেই আপনি নিজের সন্তানকে অস্বীকার করছেন?’
সাদ আবারও অস্বীকার করলো। ‘ ও আমার বাচ্চা নয়। যদি হতোই তাহলে আমি অস্বীকার করতাম না।’
‘ বাহ, খুব ভালো! আপনি যে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শয়তান সেটা আজ বুঝতে পারছি।’
‘ মুখ সামলে কথা বলো। তোমার বান্ধবী কার না কার বাচ্চার মা হতে চলেছে, বিয়ে করেছি বলে এখন আমার উপর চাপাতে চাইছে? ভালোই শিখলে।’
শোভা ধরা গলায় বলে উঠলো, ‘সত্যিই তো। বাচ্চার বাবা আপনি নন। আমার সন্তানের বাবার নাম সাদ চৌধুরী, যিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আর আপনি তো সাদ নন, একটা মানুষরুপি জানোয়ার। আপনি কীভাবে কারো বাবা হতে পারেন। ছিঃ!’
সাদিদ সাহেব এবার কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘দেখো আমার ছেলের ক’দিন পর বিয়ে। তোমরা এসব নাটক অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও। হোস্টেলে থাকো, তোমাদের আর কে বিশ্বাস করবে। মানছি আমার ছেলে বিয়ে করেছে, কিন্তু তুমি যেটা করেছো এরপর পুত্রবধূ হিসেবে তোমায় মেনে নেওয়া যায়না। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো, যত টাকা চাও ততোই দেবো। এবার যাও এখান থেকে।’
শোভা যেন এই কথাটা শোনার অপেক্ষাই করছিলো। বললো, ‘থাক আঙ্কেল। শত্রুর মেয়েকে টাকা দিতে হবেনা। কিন্তু সাদ চৌধুরী এটাও মনে রাখবেন, যে মেয়ে অল্পতেই কাঁদতে পারে সেই মেয়ে কঠোর আঘাতে বাঁচতেও পারে। আমি তো আমার সন্তানকে দেখেই রাখবো। কোনোদিন না এমন হয় যে, আপনি আমার কাছে ফিরে আসতে চাইবেন। ভালো থাকবেন।’
‘ শত্রুর মেয়ে মানে?’
‘ আমার আব্বুর নাম রমজান।’
সাদিদ সাহেব বাঁকা হেসে বললেন, ‘বাপ যেমন , মেয়েও তেমন। একেবারে উচিৎ শিক্ষা হয়েছে!’
‘ শিক্ষা তো খোদাতায়ালা দিবে আপনাদের। এই অন্যায় করার জন্য।’
‘ বাপের মতোই পটরপটর কথা বলতে শিখেছো!’
‘ নাহ। আপনার ছেলের আঘাতে মুখ দিয়ে এমনিই কথা আসছে।’
‘ ভালো। আঘাত পেয়ে শক্ত হওয়া ভালো।’
‘ উল্টো আঘাত সহ্য করতে পারবেন তো আংকেল?’
সাদিদ সাহেব রেগে গেলেন। বললেন, ‘বেরুও এখান থেকে!’
মিলি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। এবার ফিরে আসার পথে হাতের কাছে থাকা ফুলদানিটা সাদের মাথায় ছুঁড়ে মারলো। এরকম অমানুষদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। কাপুরুষ সাদ তখন মাথা নিচু করে ভালো মানুষ সেজে দাঁড়িয়ে ছিলো। শোভা মিলিকে টেনে নিয়ে চলে এলো। ছিঃ ছিঃ! এমন মানুষকে কীভাবে বিশ্বাস করেছিলো সে?
_______
সেদিনের পর সাদের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করলো শোভা। রমজান সাহেব সাদিদ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলো, শোভা দিলোনা। হোস্টেল ছেড়ে চলে এলো বাসায়। প্রথম প্রথম কিছুদিন নিজেকে ঘরে আটকে রাখলো। একবার ভেবেছিলো মরে যাবে, এসময়টাতে পুরোপুরি ওর পাশে থেকেছে মিলি। মাঝে মাঝে মনে হয় মিলি বুঝি শোভাকে বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছে। পুরোদমে পড়াশোনায় সাহায্য করলো শাফিন। বোনের উপর চাপা রাগ থাকলেও প্রকাশ করেনা।
এদিকে সাদের আজ গায়ে হলুদ। ধুকধাম আয়োজন। ওর মনটা কু গাইছে। কেন এরকম লাগছে বুঝতে পারছেনা। বিয়ে হচ্ছে বড়লোক বাড়ির মেয়ের সাথে। তাও এমন লাগার কারণটা বুঝতে পারছেনা। খবরটা এলো মাঝরাতে, যখন ও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোবাইল বেজে উঠলো।
‘ হ্যালো, কে বলছেন?’
‘ আমি মিলি।’
‘ কোন মিলি?’
‘ থাপ্পড়ের কথাটা ভুলে গেলেন?’
‘ তুমি? কেন ফোন করেছো?’
‘ গায়ে হলুদ বেশ ভালো কাটলো তাইনা?’
‘ এসব জানতে ফোন করেছো?’
‘ হুম। তবে একটা গুডনিউজও আছে।’
‘ কীসের নিউজ?’
‘ এই যে! আপনি নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছেন আর অন্যদিকে একজন দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চলেছে!’
‘ বুঝলাম না।’
‘ বোঝার কথাও না। মাথায় কিছু আছে নাকি মানুষ ঠকানো ছাড়া!’
‘ স্পষ্ট করে বলো!’
‘ আমাদের শুভি! শুভি বোধহয় আর বাঁঁচবেনা, মরে যাবে।’
বুক কেঁপে উঠলো। হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে লাগলেও সাদ সামলে নিলো। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে শোভার?’
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।