#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
অনল ছাদে এসে হাত মুচড়ে ধরে অনুর। ব্যথায় টু শব্দ করতেই যেন অনু ভুলে বসেছে। যেই ভয়ে ট্যাঙ্কির পেছনে লুকিয়েছিল; অথচ লাভ কিছুই হলো না। ঠিক ঠিক খুঁজে বের করেছে! শালা ডাফার! মনে মনে গালি দিয়েও অনু ক্ষান্ত হয় না। অনল এবার আরও জোড়ে হাত মুচড়িয়ে বলে,’আমার সাথে বিটলামি করার সাহস কোথায় পেলি তুই?’
‘আমি কোনো বিটলামি করিনি। সত্যি বলছি।’ আর্তনাদ করে বলল অনু। অনল দাঁতমুখ খিঁচে বলে,’কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা আমি জানি। তুই যদি ডালে ডালে চলিস, তাহলে আমি চলি পাতায় পাতায়। বুঝছিস?’
‘আমায় বিশ্বাস করেন।’
‘মরে গেলেও না। তোকে এখন আমি ট্যাঙ্কির পানিতে চুবাবো চল।’
‘না, না, না! ট্যাঙ্কির পানি অনেক ঠান্ডা। জমে বরফ হয়ে যাব আমি।’
‘আমি তো সেটাই চাই। আমার সাথে বিটলামি করার আগে এটা মাথায় ছিল না?’
মনে মনে বারবার আল্লাহ্কে ডাকছে অনু। অনলকে সে ভালো করেই চিনে। ট্যাঙ্কির পানিতে চুবানোর সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছে তখন একটা হলেও নাকানিচুবানি খাওয়াবেই! অনুর মনের ডাক আল্লাহ্ শুনেছে। ঐ সময়ে ছাদে এসে উপস্থিত হয় অনিক। অনলের ছোটো ভাই। সে ছাদে এসে বলে,’ভাইয়া তুমি ছাদে! আর আমি তোমায় কত জায়গায় না খুঁজলাম।’
‘কেন কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করে অনল।
‘মা তোমায় খুঁজছে। কিন্তু তোমরা এখানে কী করছ?’
অনল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’এই বজ্জাত মেয়ে আমার গায়ে ঠান্ডা পানি ঠেলে দিয়েছে।’
অনলের হাতটা কিঞ্চিৎ আলগা হওয়ায় দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় অনু। অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,’বিশ্বাস করো অনিক ভাইয়া, আমি ইচ্ছে করে কাজটা করতে চাইনি। আমি তো ভেবেছি উনার….’
‘চুপ! একদম চুপ। মিথ্যাবাদী!’ রাম ধমক দিয়ে অনুকে থামিয়ে দেয় অনল। ধমকে কিছুটা চমকেও যায় অনু। ওদের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসে অনিক। ছোটো থেকেই দুজনের সাপে-নেউলে সম্পর্ক দেখে আসছে। সুযোগ একবার পেলেই হচ্ছে। কেউ কাউকে জব্দ করতে সেই সুযোগ এক তিল পরিমাণ পর্যন্ত ছাড়বে না। তবে এর একটা বিহিত এখন করতেই হবে। নয়তো দুজনের ঝগড়া চলতে চলতে রাত হয়ে যাবে; তবুও ঝগড়া থামবে না। অনিক পণ্ডিতের মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলে,’আচ্ছা আচ্ছা ঝগড়া অনেক হয়েছে। এখন অনু ঘরে যাও। আর ভাইয়া আমার সঙ্গে বাসায় চলো।’
‘কীসের বাসায় যাব? আগে এই পাজি মেয়েটাকে আমি শায়েস্তা করব।’ অনুর দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল অনল।
‘আপু গাছে পানি দেওয়া শেষ হয়নি?’ ছাদের দরজার সামনে এসে বলল তিনু। সঙ্গে অনল এবং অনিককে দেখে একটু চমকিতই হলো যেন। আসলে চমকায়নি। অবাক হওয়ার অভিনয় করেছে মাত্র। অনিক আসার আগে তিনুকে বলেই এসেছে। ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,’আরে অনিক এবং অনল ভাইয়াও তো দেখি এখানে।’
উত্তরে অনিকও হেসে বলল,’হ্যাঁ, ছাদটা একটু ঘুরতে আসলাম। ভালো আছো?’
‘জি। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্।’
আরও কিছু কথা অনিক এবং তিনু চোখে চোখে বলে নিল। এখান থেকে পালানোর জন্য অনু তাড়া দিয়ে বলল,’মা আমায় ডাকছে তাই না? হ্যাঁ তাড়াতাড়ি ভেতরে চল।’
অন্য দিকে তাকিয়ে আছে অনল। অনু তিনুর হাত ধরে হাঁটা ধরে। অনল এবং অনুর দৃষ্টির অগোচরে তিনুকে চোখ মারে অনিক। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় তখন তিনু। বড়ো দুজনের সম্পর্ক সাপে-নেউলে হলেও ছোটো দুজনের ভাব গলায় গলায়। তিনু যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন থেকেই দুজনের সম্পর্ক হয়। এখন তিনু ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। অনল পড়ছে মাস্টার্সে। অনিক অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। একই ভার্সিটিতে। অনু অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নিয়েও কত কাহিনী করতে হয়েছে। কিছুতেই অনলের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায়নি। কিন্তু ওর চাওয়াতেই বা কী? বাবা-মায়ের কথাই শেষ কথা। আর তাদের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে বজ্জাত অনল হুহ!
.
আমেনা বেগম রান্না করছিলেন। পিলুর জন্য মনটা ভালো নেই অনুর। খাওয়ার প্রতি রুচি মরে গেছে। একটু ঝাল ঝাল করে চিংড়ী দিয়ে নুডলস্ খেতে ইচ্ছে করছে। অনু রান্নাঘরের দিকে এগোয়। মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,’আম্মা।’
‘কী?’
‘নুডলস্ খাব।’
‘এই সময়ে?’
‘হু। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা রান্না শেষ হোক।’
কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনি আবার বললেন,’ময়লাওয়ালা আসছে মনে হয়। যা তো ময়লাগুলো দিয়ে আয়।’
‘আমি রান্নাঘরে তোমার ময়লা নিতে আসছি?’
‘বেশি কথা না বলে যা বলছি তাই কর। যা।’
‘হুহ।’
প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে ময়লার ঝুড়ি হাতে তুলে নেয় অনু। রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে ময়লাগুলো সামনে ধরে বলে,’ময়লা নিয়ে বিদায় হন।’
সামনের লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইতস্তত করে ক্ষীণস্বরে বলে,’আমাকে দেখে কি আপনার ময়লাওয়ালা মনে হচ্ছে?’
এবার অনু ভালো করে খেয়াল করে ময়লার ঝুড়ি নামিয়ে রাখল। লোকটিকে দেখে তো ময়লাওয়ালা মনে হচ্ছে না। ফর্মাল ড্রেস, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখতে ভদ্রলোক লাগে। অনু জিজ্ঞেস করল,’কে আপনি?’
‘জি আমি অয়ন।’ চোখের চশমা ঠিক করে বলল ছেলেটি।
‘অয়ন না কয়েন সেটা জানতে চাইনি। এখানে কেন এসেছেন? কাকে চান?’
‘জি আমি একজন ডাক্তার। ডা. কামাল স্যার আমায় পাঠিয়েছেন।’
অনু এবার উচ্ছসিত হয়ে বলল,’ডাক্তার! আপনি কি পাখির ডাক্তার?’
অয়ন বিব্রতবোধ করতে লাগল এই প্রশ্নে। পূণরায় চশমার ফ্রেম ঠিক করে বলল,’জি না।’
‘তো আপনি কি গরু ডাক্তার? কিন্তু আমরা তো গরু পালি না।’
‘জি না। আমি গরুর ডাক্তারও না। আমি মানুষের ডাক্তার।’
‘ওহ। আমরা তো কেউ অসুস্থ না। আমার তিতুস একটু অসুস্থ। তাই মানুষের ডাক্তার প্রয়োজন নেই। তাহলে কামাল আঙ্কেল আপনায় কেন পাঠিয়েছেন?’
‘তিতুস কে?’
‘আমার টিয়া পাখি।’
‘ওহ! জি আসলে উনার বন্ধুর প্রেশার মাপার জন্য।’
‘মানে বাবার?’
‘উনার নাম খালেদ রহমান।’
‘হু। উনি আমার বাবা হন। আসুন ভেতরে আসুন। আর কিছু মনে করবেন না। আমি ভেবেছিলাম, ময়লাওয়ালা এসেছে।’
‘সমস্যা নেই।’
ডাক্তারকে বাবার রুমে রেখে অনু নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে খাঁচা থেকে তিতুসকে বের করে হাতের ওপর রাখে। মাথা চুলকে দেয়। কথা বলে।
আমেনা বেগম রুমে এসে বলেন,’আবার পশু-পাখি নিয়ে বসছিস!’
‘উহ্! মা। কতবার বলছি ওদের পশু-পাখি বলবে না। সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছি আমি। আর এই টিয়ার নাম তিতুস। ওকে তিতুস ডাকবে।’
‘তোর মতো এত রং ঢং তো আমি করতে পারব না। সারাজীবন কুকুরকে কুত্তা আর বিড়ালকে বিলাই বলে এখন উনি পশু-পাখির নাম রাখা শুরু করেছে। তাও আজগুবি সব নাম! টেবিলের ওপর বিরিয়ানির বাটি রাখা। অনিকদের বাসায় দিয়ে আয়।’
‘আমি কেন? তিনুকে পাঠাও।’
‘তুই কিন্তু সব কথায় ঘাড়ত্যাড়ামি করিস অনু। তিনুকে পাঠানোর হলে তোকে বলতাম? তিনু কাজ করতেছে।’
আমেনা বেগম চলে যাওয়ার পর অনু বিড়বিড় করে বলে,’সুযোগ পেলেই শুধু আমাকে খাটাতে চায় হুহ!’
__________________
অনলদের বাড়ির বাগানে একটা দোলনা আছে। এখানে বসলে ফুলের ঘ্রাণে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। দোলনায় বসে অনল দোল খাচ্ছিল আর গুণগুণ করে গান গাইছিল। বাড়ির গেটে এসে অনলকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় অনুর। আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে অনলকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ভাবে। তখন অনলের ডাক পড়ে,’চোরের মতো পালাচ্ছিস কেন? এদিকে আয়।’
‘কই পালাচ্ছি? আমি তো ভেতরেই যাচ্ছি।’
সামনে এসে বলল অনু। হাতের বাটি নিজের হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলল অনল। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে বলে,’আহ্! বিরিয়ানি! ঘ্রাণ শুনেই পেট অর্ধেক ভরে যায়।’
‘তাহলে ফিরিয়ে দেন। বাসায় নিয়ে যাই। আপনার পেট তো ভরেই গেছে।’
অনল ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’তুই ভীষণ কিপ্টা অনু। যাকগে, ওসব বাদ দে। একটু আগে তোদের বাসায় একটা ছেলেকে যেতে দেখলাম। কে রে?’
‘ডাক্তার। আব্বুর প্রেশার মাপতে এসেছে।’
‘আগে না কামাল আঙ্কেল আসতো?’
‘উনিই পাঠিয়েছেন।’
‘সত্যি বলছিস নাকি কাহিনী অন্যকিছু?’
‘অন্য কি কাহিনী হবে?’
‘তোকে দিয়ে বিশ্বাস কী? যাই হোক, ডাক্তারদের থেকে দূরে থাকবি। মোট কথা ছেলেদের থেকে দূরে থাকবি।’
‘ঢং যত্তসব! আপনার এত মাথাব্যথা করা লাগবে না। ঐ ডাক্তার বিবাহিত, দুইটা বাচ্চাও আছে।’
‘এর মধ্যে খোঁজ নেওয়া’ও শেষ?’
‘খোঁজ নেব কেন? আন্দাজ করে বলেছি।’
‘তোর যেই গবেট মার্কা আন্দাজ!’
‘আচ্ছা আমি এখন যাই? আপনি বাটি বাসায় নিয়ে যাইয়েন।’
‘আরে দাঁড়া। এত তাড়া দেখাস কেন? তোর সঙ্গে একটা ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে।’
‘ইম্পোর্ট্যান্ট কথা? তাও আমার সাথে? ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা শুনি কী কথা?’
বাটির ঢাকনা লাগিয়ে অনুর ওড়নায় হাত মুছে নিল অনল। রাগে মুখ বিকৃত করে ফেলে অনু। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ঢেকুর তুলে অনল বলে,
‘তোর পুরো নামটা যেন কী? অনীতা না? কী একটা নাম! ছ্যাহ্! মনে হচ্ছে গণিত এর সঙ্গে একটা আকার যোগ করে গণিতা বানানো হয়েছে; আর সেখান থেকে অনীতা। তোর বাচ্চাকাচ্চা যখন হবে তখন তাদেরকে তোর জামাই গল্প শুনাবে, ‘শোনো আমার গুলুমুলু কুলুকুলু আন্ডাবাচ্চারা। তোমরা কি জানো তোমাদের মায়ের আদি নাম কী ছিল? গণিতা ছিল। গণিতা থেকে অনীতা। এরপর আরও শর্ট করে রাখা হয়েছে অনু। তোমরা তোমাদের মাকে এখন থেকে ডাকবে গণু। নাহ্! নাহ্! মাকে তো নাম ধরে ডাকা যায় না। ডাকবে গণু মাম্মাম! মনে থাকবে? দেখো যেন আবার গণু ডাকতে গিয়ে গরু ডেকে ফেলো না। তোমাদের মা যেই দজ্জাল! কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে বাড়িতে।’ এই হবে তোর ভবিষ্যৎ।’
অনলের কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে অনু। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’প্রথমত আমার নাম আমি নিজে রাখি নাই। আব্বা-মা আকিকা দিয়ে রাখছে। দ্বিতীয়ত, আমার জামাই আপনার মতো বদ, অসভ্য, ইতর হবে না যে এসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা বা কল্পনা তার মাথায় আসবে। বুঝছেন?’
চলবে…