এক_ফালি_চাঁদ #পর্ব_৬

0
1118

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
তিনুকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে বেরিয়েছে অনু। শীতের দিনে আইসক্রিম খাওয়ার আলাদা রকম মজা আছে। কিন্তু বাবা-মা একদম পছন্দ করে না। তাই দু’বোন লুকিয়ে বের হয়েছে। দোকানে যাওয়ার পর দেখা হয় এক পরিচিত ভিক্ষুকের সঙ্গে। অনু তাকে চেনে। বৃদ্ধা মহিলা। এই বয়সে কই আরাম-আয়েশ করে খাবে তা না; ভিক্ষা করতে হচ্ছে। ছেলেরা তাদের বউ নিয়ে আলাদা থাকে। একবার ভিক্ষা করা চালের ব্যাগ নিয়ে তাকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বসে পড়ে সেখানেই। অনু কাছে গিয়ে দেখে বৃদ্ধার প্রচণ্ড জ্বর শরীরে। সেদিন তার থেকে ঠিকানা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে রিকশা করে। বাড়ি না বলে বস্তি বলা যায়! বাড়ি যাওয়ার আগে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ আর কিছু খাবার কিনে দিয়েছিল। আবেগে বৃদ্ধা চোখের পানি ঝরঝর করে ছেড়ে দেন। সেই থেকেই বৃদ্ধা প্রায়ই এই এলাকায় আসতো।

‘দাদু এখানে কী করছেন?’
তিনি পিছু ফিরে অনুকে দেখে খুশি হন। ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন,’দুধের প্যাকেট নিতে আইছিলাম বইন। কিন্তু আমার কাছে ১২ টেকা আছে শুধু।’
অনুর মায়া হলো তার কথা শুনে। সে নিজেই তাকে দুধের প্যাকেট কিনে দিল।
তিনি অনুর মাথায় হাত রেখে দোয়া দেন,’আল্লাহ্ তোরে বাঁচাইয়া রাখুক বইন। সারজীবন ভালো থাক, দোয়া করি।’
অনু মুচকি হাসে। তাকে একটা রিকশা ঠিক করে ভাড়াও দিয়ে দেয়। ছোটো বেলা থেকেই এমন পরোপকারীর স্বভাবটা অনুর মাঝে আছে। সাধ্যের মধ্যে সবসময়ই চেষ্টা করে আশেপাশের মানুষদের সাহায্য করতে।

আইসক্রিম খেতে খেতে দু’বোন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। অনুর এমন পরোপকারী স্বভাব দেখে তিনু জিজ্ঞেস করে,’তুমি যে সবাইকে এত সাহায্য করো এতে কী লাভ হয় আপু?’
অনু হেসে বলে,’আজ ওদের বিপদে আমি সাহায্য করছি। একদিন ওরা আমার বিপদে সাহায্য করবে।’
‘ছাই করবে। তোমার মন অনেক নরম আপু। এরা স্বার্থের জন্যই তোমায় এত ভালোবাসা দেখায়। একদিন বিপদে পড়ে দেখো সবাই লেজ গুটিয়ে পালাবে। আসল চেহারা বের হবে তখন।’

তিনুর কথায় অনুকে বিচলিত হতে দেখা গেল না। বরঞ্চ মৃদু সহাস্যে বলল,’বেশ তো! তাতেই বা সমস্যা কী? আমার আল্লাহ্ আছে না? তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। আমার বিপদের সময় তার থেকেই আমি সাহায্য পাব আমার বিশ্বাস।’
‘আপু।’
‘বল।’
‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা।’
অনু বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,’পাগলী।’
বাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পর আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’দুজনে মিলে কই গেছিলি?’
‘একটু নিচে গেছিলাম মা।’ বলল তিনু।
‘সারাক্ষণ শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়ানো না? যা পড়তে বোস।’

তিনু অনিচ্ছা নিয়েই পড়তে বসলো। কিন্তু পড়াতে মন নেই। অনিকের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এখন ফোন করাটা কী ঠিক হবে? না, থাক! দরজা লাগালেই মা খ্যাচখ্যাচ করবে। ইশ! আমার আর অনিকের সম্পর্কটা যদি আপু আর অনল ভাইয়ের মতো হতো তাহলেই ভালো হতো। যখন তখন ঝগড়া করতে অনিকও বাড়িতে চলে আসতো। উল্টাপাল্টা চিন্তা করে তিনু একাই আনমনে হাসে।
.
.
পা টিপে টিপে ঘরে আসে অনল। চুপচাপ অনুকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছে। অনু বিড়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে আর হাসছে। অনলের আগমন টের পায়নি। দেখে তো মনে হচ্ছে মেজাজ ভালোই। খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে অনল, ‘এহেম! এহেম!’

অনু মাথা তুলে পেছনে তাকায়। অনলকে দেখেই হাসি উধাও হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। অনলকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে বিড়ালের দিকে মনোযোগ দেয়।
‘কী করছিস অনু?’ মন গলানোর জন্য নরম স্বরে বলল অনল। অনু কিছুই বলল না। নিশ্চুপ রইল।
‘কথা বলবি না অনু? বোবা হয়ে গেছিস?’
মেজাজ খারাপ করে তাকায় অনু। অনল বলে,’তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।’
‘তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হন। অসহ্য!’
‘শোন গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, তুই তো ঢং করে আবার পশু-পাখির নামও রাখিস। তাই আগেই বলে রাখি এই বিলাইর নাম ভু্লেও পিলু রাখবি না।’
‘কেন?’ অনলের কথায় ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো অনু। অনল কোমরে হাত রেখে বলল,’এই বিলাই তো আর তোর সো কোল্ড বয়ফ্রেন্ড দেয়নি। আমি দিয়েছি।’
‘তো?’
‘তো ওর নাম রাখবি গলু। নামটা সুন্দর না? অবশ্য হতেই হবে। কে রেখেছে সেটাও তো দেখতে হবে!’
‘এত ভাব নেওয়ার কিছু নাই। আমার আপনাকে পছন্দ না। আপনার দেওয়া নামও পছন্দ হয়নি।’
‘তাইলে আমার বিলাই আমারে দে।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল অনল। অনু ঝড়ের গতিতে বিড়ালছানাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,’এহ্! তা আর হচ্ছে না। এই বিড়াল এখন আমার।’
‘তুই বড্ড চালাক রে অনু।’
বিড়ালছানাটি দ্রুত সরাতে গিয়ে বিড়ালের নখের আঁচড় লাগে অনুর হাতে। অনু ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে।অনল দ্রুত বিড়ালটি কোলে নিয়ে বলে,’আহারে! দেখি দেখি কোথায় লাগল?’
হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অনু বলে,’এখানে?’
অনল ধমক দিয়ে বলে,’তোকে জিজ্ঞেস করেছি নাকি? আমি তো বিলাইকে জিজ্ঞেস করেছি।’
‘আমি কী করে জানব আপনি মানুষ রেখে প্রাণীকে জিজ্ঞেস করবেন?’
‘ইশ! কী আমার মহারাণী আসছে গো।’
অনুর মুখের দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে বলে,’তুই কি ভেবেছিস তুই ব্যথা পেলে আমার টেনশন হবে? ভুল! আমার আনন্দ লাগে। খুশি হই আমি। হুহ!’
তারপর অনুর কপালে টোকা দিয়ে ঘর থেকে চলে আসে অনল। অনু কটমট করে তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। বিড়বিড় করে বলে,’বজ্জাতের বজ্জাত অনইল্লাই!’

অনল চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে,’অনু?’
‘আপনি এখনো যাননি?’
‘তোর কি মনে হয় তাসিন তোকে সত্যিই ভালোবাসে?’
‘অবশ্যই।’
‘বেশ। ওকে বিয়ের কথা বলতে বলছিলাম বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ। ও বলছে চাকরী পেলে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।’
‘আচ্ছা চল আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
‘চল তো আগে।’

অনলের সাথে ঝামেলা করার ইচ্ছে নেই। সে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। খাইয়ে মন গলানোর চেষ্টা? তা হচ্ছে না।
‘এখানে নিয়ে আসলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল অনু।
‘আয়। চল।’
অনল এবার অনুকে দু’তলায় নিয়ে গেল। সামনে হাতের তর্জনী দ্বারা একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। হাতের ইশারা অনুযায়ী অনুও সেখানে তাকায়। তাসিন একটা মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। হাসাহাসি করছে। অনুর মুখটা হা হয়ে যায়। রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। অনলের দিকে তাকাতেই সে বলে,’এই হলো তোর সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড। ও তোকে বিয়ে করবে মনে হয়? কক্ষনো না। টাইমপাস! সব টাইমপাস।’
অনু হনহন করে তাসিনের দিকে গেল। টেবিলের ওপর থাপ্পড় বসিয়ে দু’হাত রেখে তাসিনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায়। ভূত দেখার মতে চমকে যায় তাসিন। তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে,’ত…তু..মি!’
অনু তাসিনের গলা টিপে ধরে বলল,’শালা তোতলা, গাধা, বলদ, হারামজাদা আমার সাথে প্রেম করে এখন আবার অন্য মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসছিস। তোর কলিজা কত্ত বড়ো! আজ তোর কলিজা বের করে দেখব আমি। দাঁড়া!’
অনু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক খুঁজে টেবিলের ওপরই একটা ছোটো চাকু পায়। উপস্থিত সকলেই প্রায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এমনকি তাসিনের নতুন গার্লফ্রেন্ডও! অনল দৌঁড়ে গিয়ে অনুকে আটকায়। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো অনু বলে,’ছাড়েন আমায়। আজ এই শালার কলিজা বের করবই আমি।’
‘থাম, থাম অনু। এমন করিস না।’

অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে অনুকে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে অনু। তাসিন সাহস করে বলে,’আমার কথা…’
অনু ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় বসায় তাসিনের গালে। কাঁটাচামচ হাতে তুলে নিয়ে একদম তাসিনের মুখের সামনে ধরে বলে,’দেখছিস হাতে কী? নেক্সট টাইম আর যদি আমার সামনে আসিস তাহলে কাঁটাচামচ দিয়ে তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলব। আজ থেকে তোর সাথে আমার ব্রেকাপ!’
কাঁটাচামচ রেখে একটা টিস্যু নিয়ে বেরিয়ে আসে অনু। তাসিন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। থাপ্পড়টা খুব লেগেছে! অনল ওর নতুন গার্লফ্রেন্ডকে বলে,’আপু আপনি কিছু বলবেন না?’
মেয়েটি দাঁত কটমট করে তাসিনকে বলে,’লুচ্চা ছেম্রা কতগুলা মেয়ের লগে রিলেশন করস তুই? ভাগ্যিস শুরুতেই সব জানতে পারছিলাম। বেয়াদব! আমারও তোর সাথে ব্রেকাপ।’

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর অনল সেখানে বসে। কাঁটাচামচ টেবিলের ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,’প্রথমে যদি ভালো কথায় নিজেই অনুর জীবন থেকে সরে যেতে; তাহলে আজ সবার সামনে তোমায় অপমানিত হতে হতো না। আবার নতুন গার্লফ্রেন্ডও হাতছাড়া হতো না।’
তাসিন নির্বাক। অনল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’এতগুলো গার্লফ্রেন্ড পালতে শুধু চেহারা আর টাকা থাকলেই হবে না। বুদ্ধিও থাকা লাগবে। গবেট!’

অনল রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দেখে অনু কাঁদছে আর একটু পরপর টিস্যু দিয়ে নাক মুছছে। এজন্যই তাহলে টিস্যুটা নিয়ে এসেছিল। অনলকে দেখে অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে বলে,’ঐ বজ্জাতটা…’ এইটুকু বলে আবার নাক মুছে নিল। তারপর বলা শুরু করল,’কেমনে পারল!’
অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনল বলে,’আহারে! থাক কাঁদিস না অনু। চল আজ তোকে ঘুরতে নিয়ে যাব।’
অনু রাজি হলো। এখন তার মন ফ্রেশ করা দরকার। সারা বিকেল ঘুরেফিরে সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। বাড়ির ভেতর যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনু বলে,’তাসিনের আসল চেহারা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য থ্যাঙ্কস। আর সারা বিকেল আপনার সাথে ঘুরেছি বলে ভাববেন না, আপনার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। রাগ আছে। অনেক রাগ আছে।’
‘কেন? আমি আবার কী করলাম?’
‘নাটক করবেন না। আপনি অনেক স্বার্থপর একটা লোক। সকালে যে আমি জ্যাকেট চাইলাম তখন তো আমায় দিলেন না। অথচ সাথীকে ঠিকই দিলেন।’
‘সিচুয়েশনটা অন্যরকম ছিল অনু। তুই আমায় ভুল বুঝছিস।’
‘আমি কোনো ভুল বুঝছি না। আমি স্পষ্ট দেখেছি, সাথী কেমন করে যেন আপনার দিকে তাকাচ্ছিল। বিশ্বাস না হলে জেসি আর শুভাকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’

অনল হ্যাঁচকা টানে অনুকে কাছে এনে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করায়। অনলের হাত দেয়ালে। অনু ওর দু’হাতের মাঝে বন্দি। বেশ অবাক এবং ভয়ও পায় এমন কাণ্ডে। এত কাছে অনল এর আগে কখনো আসেনি। অনলের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুর মুখের ওপর পড়ছে। ধীরে ধীরে অনুর নিঃশ্বাসও কেমন জানি ভারী হয়ে আসে। মোহমীয় দৃষ্টিতে অনুর চোখে চোখ রেখে অনল জিজ্ঞেস করে,’ভালোবাসিস আমায়?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here