#এক_ফালি_চাঁদ
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
‘চোর আমি অনেক রকম দেখেছি অনু! কিন্তু কচু চুরি করতে তোকেই প্রথম দেখলাম।’
মশকরাসূচক তীরের ফলার মতো বলা কথাগুলো ভেসে এসেছে পুরুষালী ভারী কণ্ঠস্বর থেকে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে অনু দেখতে পেল অনলকে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। বিরক্তিতে আর সহ্যের সীমা রইল না অনুর। রাগান্বিতস্বরে বলল,’কচু চুরি করছি মানে? দেখেন অনল ভাই, উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি।’
‘যাহ্ বাব্বাহ্! উল্টাপাল্টা কথা বললাম নাকি আমি? তুই-ই দেখ তুই এখন কোথায়? তুই কচুর বাগানে কী করিস বল?’
‘নাগিন ডান্স দেই। আপনার কোনো সমস্যা?’
‘না, না। আমার কেন সমস্যা হবে? তবে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।’
অনুর কপালে এবার ভাঁজ পড়ে। এই লোকটি সুযোগ পেলে অনুকে হেনস্তা করতে ছাড়ে না সে নাকি আবার অনুরই জন্য চিন্তা করছে! ‘তা কী চিন্তা হচ্ছে শুনি?’ দু’হাত বগলদাবা করে জানতে চাইলো অনু।
অনল ঠোঁটের হাসিটা চওড়া করে বলল,’তুই তো এমনিতেই চুলকানি মানুষ। আবার নাকি কচু ক্ষেতে নাগিন ডান্স করছিস! চুলকাতে চুলকাতেই তো পটল তুলবি।’
রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে অনু। রাগের চোটে বলার মতো কোনো কথাও খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু থেমে থাকার মেয়ে অনু নয়। শাসিয়ে শাসিয়ে সে বলল,’আপনার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে তারপর আমার সামনে আসবেন বলে দিচ্ছি অসভ্য লোক।’
‘একি রে! তোর ভালোর জন্যই তো বললাম।’
‘রাখেন আপনার ভালো! অযথা বিরক্ত না করে এখান থেকে চলে যান।’
‘দেখ অনু, তুই কিন্তু সবসময় আমার সাথে বাজে ব্যবহার করিস।’
‘আপনি লোকটাই যে অমন।’
‘কেন রে, তোর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি আমি? তুই কচু চুরি করছিস কর। আমি মাকে বলব না।’
‘আমি মোটেও কচু চুরি করছি না অনল ভাই। আমি তো…’
অনুকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই অনল বলে উঠল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি। তুই কচুর লতি চুরি করছিলি? আচ্ছা কর। সমস্যা নেই। এটাও আমি মাকে বলব না। তবে শর্ত একটাই। চিংড়ী মাছ দিয়ে সুন্দর করে লতি রান্না করে এক বাটি আমাদের বাসায়ও দিয়ে যাবি। একটা লেবু কেটে দিস তরকারিতে। তাহলে আর গলা চুলকাবে না।’
রাগে মনে হয় মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগার অনুর। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’হয়েছে? বলা শেষ আপনার? একবার বলতে শুরু করলে আপনার আর থামাথামির কোনো নাম নাই। আশ্চর্য লোক আপনি! ভাই কেমনে পারেন আপনি? আমি একবারও বলেছি কচুর লতি চুরি করতে আসছি আমি?’
‘ওহ! কচুর লতিও না? তাহলে কি কচুমুখী?’
এবার ক্ষেপে অনেকটা কাছে এগিয়ে যায় অনু। অনলের দিকে একটু ঝুঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’আপনাকে খুন করে ফেলব আমি!’
রাগের চোটে কচু তুলে নিয়েছিল অনু। কাচুমুচু ভঙ্গিতে অনল বলল,’এই কচুতে আমি মরব না রে অনু। কিন্তু চুলকাবে খুব। সরা প্লিজ!’
‘ধ্যাত!’ বলে অনু সরে যায়। আবারও গাছ-গাছালির ভেতর খুঁজে বেড়ায় পিলুকে। সকাল থেকেই পিলুকে পাচ্ছে না। ছোটো বোন তিনু বলল অনল ভাইয়ের বাড়ির বাগানে নাকি পিলুকে দেখেছিল। অনল সম্পর্কে ওদের প্রতিবেশী। তবে আরও একটা পরিচয়ও রয়েছে। সে অনুর মায়ের বেষ্টফ্রেন্ডের ছেলে। অন্যদিকে পিলু হচ্ছে অনুর খোরগোশ। দু’দিন হবে অনুর বয়ফ্রেন্ড তাসিন গিফ্ট করেছে। অনল গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’অনু তুই যে রেগে গেলে দাঁতে দাঁত পিষিস তখন এক কাজ করবি। কয়েক টুকরা আদা, রসুন দাঁতের নিচে দিয়ে রাখবি। তাহলে তোর রাগও কমবে আবার আদা-রসুন বাটা-ও হয়ে যাবে।’
অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে একবার অনলের দিকে তাকিয়ে আবারও পিলুকে খুঁজতে শুরু করে। কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে অনল জিজ্ঞেস করে,’তুই কি কিছু খুঁজছিস?’
‘হু।’ ছোটো করেই বলল অনু।
‘কী খুঁজিস?’
‘পিলুকে।’
‘ওহহো! তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি অনু। তোর পিলুকে তো আমাদের বাগানে দেখেছিলাম। পরে আমার রুমের বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম একটা কুকুর মুখে করে তোর পিলুকে নিয়ে যাচ্ছে। আহারে কী খারাপটা যে লেগেছে আমার!’
মুহূর্তেই চোখ ফেঁটে অশ্রু নির্গত হয় অনুর। সে পিলুকে ভীষণ ভালোবাসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,’আর আপনি চুপচাপ দেখলেন? নিচে এসে কেন আটকালেন না?’
‘এসেছিলাম তো! তার আগেই চলে গেছে।’
অনু আর কিছু বলল না। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাসায় চলে যায়।
বাড়িতে ফিরে এসে ঘরে বসে কাঁদছে সে। তখন ওর মা আমেনা বেগম ঘরে প্রবেশ করেন।
কীরে তুই কাঁদছিস কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম। মায়ের প্রশ্ন শুনে ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে অনুর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,’আমার পিলুকে কুকুর নিয়ে গেছে। তোমার বান্ধবীর ছেলে দেখেও পিলুকে বাঁচায়নি।’
‘বেশ হয়েছে! পশুপাখি দিয়ে ঘোরদোর একদম ভরে ফেলেছিস। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় পশুপাখি আমাদের বাড়িতে থাকে নাকি আমরা ওদের বাড়ি থাকি।’
‘তুমি এভাবে কেন বলছো মা?’
‘তাহলে আর কীভাবে বলব বল? এত পশুপাখি কেউ শহরের বাড়িতে পালে? এটা কি গ্রাম পেয়েছিস?’
‘শখ করি পালি মা। আমার ভালো লাগে।’
‘তাহলে গরু-ছাগলও কিনে দিই? এগুলো কেন বাকি থাকবে? ঘরের মধ্যে গরু-ছাগলও পালা শুরু করে দে।’
কথাগুলো বলে রাগে গজগজ করতে ঘর থেকে বের হয়ে যান তিনি। অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অনু। একটু মায়া-দয়াও বুঝি তার অনুর জন্য হয় না! হবেই বা কী করে? সব ভালোবাসা, মায়া তো তার বান্ধবীর ছেলের জন্য। ওই বজ্জাত অনলের জন্য! অনলের কথা মনে পড়তেই রাগে দাঁতমুখ খিঁচে বিড়বিড় করে অনু।
.
ভগ্ন হৃদয় এবং বিষাদিত চক্ষুযুগল মেলে আকাশমুখী হয়ে সোফায় শুয়ে আছে অনু। বারবার পিলুর শোকে সে মূর্ছা যাচ্ছে। এই শোকে দুপুরে খাওয়াও হয়নি। এ নিয়ে আমেনা বেগমের রাগের শেষ নেই। খোরগোশ তো নয় যেন ওর বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে কেউ। তিনু পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে অনু ডাকে। তিনু পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’ জিজ্ঞেস করল অনু। হাতের বালতির দিকে দেখিয়ে তিনু বলল,’ছাদে যাই গাছে পানি দিতে।’
‘আমায় দে। আমি যাচ্ছি।’
‘সমস্যা নেই আপু। আমি পারব।’
‘আমি জানি তুই পারবি। মন ভালো নেই। প্রকৃতির সঙ্গে কিছু সময় কাটালে ভালো লাগবে।’
‘তবে যাও।’
পানিভর্তি বালতি নিয়ে হেলতে-দুলতে ছাদে যায় অনু। ছাদের উঠোনজুড়ে মিষ্টি রোদ। শীতের সময়টায় এই মিষ্টি রোদ অমৃতের মতো লাগে। কিন্তু অনুর এখন কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। সে গাছে পানি দিচ্ছে আনমনে। হঠাৎ করে চোখ যায় নিচে। অনল খালি গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রোধে ফুঁসে ওঠে অনু। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,’অসভ্য, ইতর লোক! তুই ইচ্ছে করে আমার পিলুকে বাঁচাসনি। আজ দেখ আমি কী করি!’
বালতিতে থাকা অবশিষ্ট সবটুকু পানি সে অনলের গায়ে ঢেলে দেয়। দু’তলা ছাদ থেকে পানি ফেলার সুবাদে একদম ঠিকঠিক সব পানি অনলের গায়ে পড়েছে। একই তো শীতের দিন; তারওপর ঠান্ডা পানি। অনলের বিস্ময়ের শেষ নেই। উপরে তাকিয়ে অনুকে দেখতে পেয়ে রাগান্বিতস্বরে জিজ্ঞেস করে,’এটা কী করলি তুই?’
অনলকে রাগতে দেখে পেট ফেঁটে হাসি পাচ্ছে অনুর। কিন্তু সে কোনো রকমে ঠোঁট টিপে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করে বলে,’কী হলো অনল ভাই?’
অনুর চোখে মুখে স্পষ্ট দুষ্টুমির ছাপ। অনলের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই অনু কাজটা করেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’কী হলো আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছিস? পানি ফেললি কেন?’
‘ওহহো! আপনি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমি ভাবলাম আপনার বোধ হয় গরম লাগছে। তাই তো পানি ফেললাম। ঐগুলো ভালো পানিই ছিল। আপনার গায়ে কি আর আমি নোংরা পানি ফেলতে পারি?’
‘কষে মারব এক থাপ্পড় ফাজিল মেয়ে! শীতের দিনে কারো গরম লাগে? মাত্রই গোসল করে এসে আমি রোদে দাঁড়িয়েছিলাম। আর তুই গায়ে পানি ঢেলে দিলি?’
‘হুহ! এতে আমার কী দোষ? আমি কি জেনে বুঝে দিয়েছি নাকি? ছাদে রোদ থাকতে আপনি উদোম গায়ে নিচে দাঁড়িয়ে যে রোদ পোহাচ্ছেন আমি বুঝব কী করে?’
‘আমার সঙ্গে তুই চালাকি করিস না। আমি বেশ ভালো করেই জানি যে, তুই ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছিস।’
‘একদমই না। সত্যি বলছি।’
‘অনুর বাচ্চা! তুই ঐখানেই দাঁড়া! আজ তোকে আমি মজা দেখাচ্ছি।’
এই বলেই অনল বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ছাদে যাওয়ার জন্য। এদিকে ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে অনুর। না জানি, ছাদে এসে কোন কাণ্ড করে বসে!
চলবে…