এক_শহর_প্রেম?,০৬,০৭

0
1111

#এক_শহর_প্রেম?,০৬,০৭
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল পাঁচটা বেজে যাবে। আদিরা সাড়ে চারটায় টিউশনের সময় এগিয়ে এনেছে যাতে জলদি পড়িয়ে মেসে ফিরতে পারে। আদিরা আশেপাশে কাউকে খুঁজছে যার কাছে নাচের সময় পড়া ড্রেসটা দিয়ে যেতে পারবে। খুঁজতে খুঁজতে সুমিকে পেয়ে গেলো। সুমির কাছে ড্রেসটা দিয়ে সে চারটার দিকে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যায়। স্টুডেন্টের বাড়ি বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগে। আগের দিন গলিতে গলিতে ঘুরার কারণে খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছিল। আদিরা টিউশন করাতে গেলো।
….

মাহি চারুকলা ভবনের কাছে একটা পদ্ম জলাশয় আছে সেখানে বসে বসে ছোট ছোট ইটের কণা ছুড়ছে আনমনে। আজ তার রঙ তুলিও তার মন খারাপের সঙ্গী হচ্ছে না। হঠাৎ আচমকা তার পাশে কারও উপস্থিতির আভাস পেয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে আহনাফকে দেখলো সামনের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। মাহি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আবারও একই কাজ করতে নিলে আহনাফ মাহির হাত ধরে ফেলে বলে,

–এতো সুন্দর ফুটন্ত পদ্ম দেখেও তোমার মনের বিষন্নতা কাটে নি?

মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–উহুম। মন আমার কথা কোনো কালেই শোনে না। তার যখন যা ইচ্ছে হয় সে তাই করে।

আহনাফ মাহিকে কিছু বলল না। ওদিকে মারসাদও একাকি থাকার জন্য কোথায় একটা গেলো আহনাফকে বলে নি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যেকোনো সময় কাঁদতে শুরু করবে। আহনাফ ও মাহি পাশাপাশি বসে আছে নিঃশব্দে। নীরবতায় আচ্ছন্ন তাদের মাঝে। কিয়ৎক্ষণ পর মাহি আনমনে বলে,

–তিন বছর আগে আপিলির আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়ার কী কোনো দরকার ছিল? আপিলি চলে গেলো সাথে করে দাভাইকে ঘর ছাড়া করে গেলো। আমার শান্তশিষ্ট দাভাই হয়ে গেলো রাগী ও বদমেজাজি। খুব কী দরকার ছিল?

আহনাফ জবাব দিলো না। সন্ধ্যা নেমে আসছে খুব দ্রুত। মূলত ভারী বর্ষণ হবার পূর্বাভাস হিসেবে সূর্য সময়ের আগেই লুকিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের মেঘের আড়ালে। আহনাফ আকাশের অবস্থা দেখে মাহিকে বাড়ি ফিরতে তাগদা দিলে মাহি ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলে।

_______

মারসাদ একটা সোনালু ফুল গাছের নিচে বসে আছে। বসে বসে ফোন টিপছে। সন্ধ্যার আজানের আরও আধ ঘণ্টা বাকি। রাস্তার পথচারি হাঁটার জায়গায় মারসাদ বসে আছে। সাথে একটা রিকশাওয়ালাকে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। সোনালু ফুল পুরো রাস্তায় চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে। গতকাল রাতে বৃষ্টির দরুণ ফুলগুলো ভেজা অবস্থায় লেপ্টে আছে। আরেকটু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেও ফুল ভেজা অবস্থায় চাদরের মতো বিছিয়ে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসার মতো অবস্থায় নেই। ভিজে স্যাঁতসেঁতে তাই এখানে সোনালু ফুল গাছটার কাছে বসেছে। এই রাস্তায় বাস ও ট্রাক চলাচল করে না। প্রাইভেট কার ও রিকশা চলে। আশেপাশে বড়ো বড়ো দুই-একটা অট্টালিকা থাকলেও রাস্তাটা নিরব থাকে প্রায় সময়।
ঘরিতে সোয়া ছয়টা বাজার কিছুক্ষণ আগেই আদিরা হন্তদন্ত হয়ে একটা গলির থেকে বেরোলো। আজ তাকে স্টুডেন্টের মা জোর করে ছুটির পর চা নাস্তা খাইয়েছে। পড়ানোর সময় নাস্তা দেয় নি কারণ স্টুডেন্টের মা প্রকৃতির রূপ বিশ্লেষণ করে মেয়ের টিচারের সাথে একসাথে চা পান করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। আদিরা বারবার আকাশে জমা কালো মেঘের দিকে তাকাচ্ছে আবার হাতের বাটন মোবাইলে সময় দেখছে। তার অসাবধানতার কারণে একটা রিকশার সাথে লেগে যেতেও যায় নি। একদম নাক বরাবর রিকশাটা গেলো তার।

আশেপাশে কে আছে নাকি নেই তাতে তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। সে তো বৃষ্টি ও সন্ধ্যার আগে মেসে ফিরতে পারলেই হলো। আদিরা মারসাদের পাশ দিয়ে যাওয়া ধরলে মারসাদ আদিরাকে ডেকে উঠে,

–ওহ মিস পার্পল কুইন! এতো তাড়া কিসের তোমার যে আশেপাশে নজর নেই?

আদিরা চমকে তাকালো। চেনা কন্ঠস্বর শুনে ঘুরে মারসাদকে দেখতে পেলো। মারসাদ বসা থেকে উঠে আদিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পকেটে ফোন ঢুকিয়ে। আদিরা অবাক কন্ঠে সুধায়,

–আপনি এখানে ভাইয়া?

মারসাদ রুষ্ঠ হলো। আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
–কেনো? জায়গাটা কী তোমার নামে রেজেস্ট্রি করা? না তো। তাহলে আমি এখানে আসতে পারবো না কেনো? আর মুখ দিয়ে তো ভাইয়া! ভাইয়া! বলে ফেনা তুলে ফেলছো। একটু তো দম নেও। চলো আমার সাথে।

আদিরা ভীত হলো। নাচ শেষ করার মাধ্যমে তো সে মারসাদের হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? আদিরা আমতা আমতা করে বলে,

–ভাইয়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে মেসে ফিরতে হবে।

মারসাদ কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে,
–আমি কী বলেছি আমার সাথে ডেটে চলো?

আদিরা তাজ্জব বনে গেলো। আদিরার মনোভাবে,
“লোকটা বেশি অহেতুক কথা বলে। কখন কী বলে বোঝাই যায় না।”

মারসাদ ভ্রুঁ চুলকাতে চুলকাতে বলে,
–তোমাকে বুঝতেও হবে না। চলো আমার সাথে।

আদিরা বেঁকে বসলো। সে যাবে না। মারসাদের কথায় নাচ তো করলো। তারপরেও কেনো পিছু পরে রয়েছে! মারসাদ গলার স্বরে গম্ভীর্যতা এনে বলে,

–দেখো আদিরা, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তখন তোমারই বিপদ। আমি তোমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবো না। তোমাকে তোমার মেস অব্ধি পৌঁছে দিবো। দেখো রিকশাওয়ালা মামাকে সেই আধঘণ্টা ধরে দাঁড়া করিয়ে রেখেছি।

আদিরা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
–আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া। আপনাকে কস্ট করতে হবে না।

মারসাদ কপাল কুঁচকে বলে,
–তোমায় কে বলল আমি কস্ট করছি? আমি এখানে প্রায়ই একা একা বসে থাকতে আসি। আর এই রিকশা আমার জন্যই ঠিক করা। পথিমধ্যে তোমাকে দেখলাম তাই ভাবলাম এটা আমার দায়িত্ব তোমাকে সেফলি তোমার মেসে পৌঁছে দেই। চলো এবার। আমাকেও তো ফিরতে হবে। তোমার জন্য অযথা সময় নষ্ট করতে পারবো না।

আদিরা কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা ছেলের সাথে একসাথে রিকশায় গেলে মানুষজন কতো রকম মন্তব্য করবে আর যদি রুমমেটদের কেউ দেখে ফেলে!
মারসাদ মনে হয় আদিরার ভাবনা বুঝলো। মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

–তোমাকে কিছুটা দূরেই নাহয় নামিয়ে দিবো। আর এই রাস্তাটার সামনে একটা একদম নিরব গলি পরে। সেই গলিতে মাঝেমধ্যে কিছু ছেলেদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। ওদের মনে কী আছে তা না তুমি জানো আর না আমি। এখন ভেবে দেখো।

আদিরা পরশুদিনের কথা চিন্তা করলো। সেদিন সে কয়েকটা ছেলেকে দেখেছিল। তবে তারা কিছু বলে নি বা করে নি। এমন সময় রিকশাওয়ালা বলে উঠে,

–আফামনি, ভাইজান ঠিকই কইছে। কিছু পোলাগো ওই মোরের দিকে দেহা যায়। আর আইজকা তো আন্ধার হইয়া আইছে। আপনার লাইগ্যাই ভালা হইবো ভাইজানের লগে গেলে। ভাইজানরে মুই চিনি। হে বহুত ভালা মানুষ। আপনে চলেন। ডরাইয়েন না।

আদিরা দ্বিমনা করতে করতেও রিকশায় উঠলো। মারসাদ বাঁকা হেসে নিজেও রিকশায় আদিরার পাশে উঠে বসলো। আদিরা কিনারার দিকে চেপে বসলো যা দেখে মারসাদ আলতো হাসলো। রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করলো। দশ মিনিটের মধ্যে আদিরার মেস থেকে কিছুটা দূরে আদিরাকে নামিয়ে দিয়ে মারসাদ রিকশাতে করে চলে গেলো। মাগরিরের আজান হয়ে যাবে দুই মিনিটের মধ্যে। মারসাদ ভার্সিটির হলের কাছে মসজিদের দিকে রিকশাওয়ালাকে যেতে বললো।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৭
হোস্টেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মারসাদ ও আহনাফ সিগরেট ফুঁ*কছে। এটা ওদের এক বাজে স্বভাব বলা যায়। রবিন, রিহান ও মৃদুল মোবাইলে গেইম খেলছে এখন। আহনাফ সিগরেটের ধোঁয়া ছেড়ে কৃষ্ণ অম্বরে দৃষ্টিপাত করে মারসাদকে জিজ্ঞেস করে,

–আদিরার পেছোনে গিয়েছিলি?

মারসাদ নিরব হাসলো কিন্তু জবাব দিলো না। আহনাফ প্রতিউত্তর না পেয়ে বলে,
–আমি কিভাবে জানলাম জানতে চাইলি না?

মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–আমার বোনকে সঙ্গ দিতে গিয়েছিলি। তারপর সেখান থেকে স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়েছিস।

আহনাফও হাসলো। ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছে দুই বন্ধু একে অপরকে নজরবন্ধী করে রাখে! মারসাদ একটু রম্য স্বরে পি*ঞ্চ করে বলে,
–তা তোর টিউশন তো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা ও নয়টায় ছিল তাই না? তাহলে ওই সময় কেনো গেলি?

আহনাফ বাঁকা হেসে মারসাদকে বলে,
–তুই কোনো ওই রাস্তায় গেলি? আমাকে ছাড়া তো তুই একা যাস না ওখানে।

মারসাদ ও আহনাফ দুইজন দুজনের দিকে তাকিয়ে জোড়ালো হাসলো। ভেতর থেকে রিহান ওদের হাসি শুনে আওয়াজ করে বলল,

–কী-রে? তোদের কী পে ত্নী ধরছে? এমন করে হাসোস কেন?

আহনাফ জোরে বলে,
–তুই তোর গেইম খেল আর চিৎকার করতে থাক। পরে হেরে না যাস আবার!

মারসাদ লম্বাশ্বাস ফেলে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,

–এভরিথিং ইজ এট্রাকশন এন্ড ইনফেচুয়েশন।

আহনাফ মারসাদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–ইনফেচুয়েশন থেকে লাভ। মায়া থেকে ভালোবাসা। প্রতিটা মূহুর্তে নিজের মধ্যে বিপরীত পাশের মানুষটার জন্য প্রেম প্রেম পায় তারপর এক প্রেমকাহিনী। আমরা বিভিন্নরকম ভাবে প্রেমে পরি। তুইও পরেছিস!

মারসাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আহনাফকে পর্যবেক্ষণ করলো। আহনাফের চোখে মুখে চাপা হাসি। মারসাদ জেদী স্বরে বলল,

–এসব কোনো লাভ-সাব না বুঝেছিস? মেয়েটার ভীতু সরল মুখাবয়ব দেখতে ভালো লাগে তাই আরকি!

আহনাফ ব্যাঙ্গ করে বলে,
–তাই বুঝি মারসাদ ইশরাক তার আপিলির প্রিয় ড্রেসটা আদিরাকে পড়তে দিলো!

থমথমে হলো মারসাদের মুখশ্রী। আহনাফ বুঝতে পারে নি মারসাদের খারাপ লেগে যাবে। আহনাফ কিছু বলতে উদ্যত হলে মারসাদ থমথমে কন্ঠে বলে,

–তার প্রয়োজন ছিল সেটার। আপিলির কিছু যদি কারও প্রয়োজনে ব্যাবহৃত হয় তবে আমার আপিলির নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।

মারসাদ সিগরেটটা ফেলে রুমের ভিতরে চলে যায়।
__________

সপ্তাহখানেকের বেশি কেটে যায়। আদিরার সাথে মারসাদের খুব একটা দেখা হয় নি। দেখা হলেও চোখাচোখি পর্যন্ত সিমাবদ্ধ। আদিরা পরের মাসের জন্য সকালের দিকে একটা টিউশন খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছেই না। মাস শেষ হতে আর ১০-১৫ দিনের মতো আছে। স্টুডেন্টের মাকেও বলে রেখেছে। তিনি দেখবেন বলেছেন। সামনের মাসে এক্সামও আছে। বই তো কেনা হয় নি তার তাই সে সময় পেলে লাইব্রেরিতে চলে যায়। আজও লাইব্রেরিতে বসে একটা বই থেকে কিছু নোট করছিল তখন কেউ একজন এসে সামনে থেকে আদিরার বইটা বন্ধ করে দেয়। আচমকা এমন হওয়াতে আদিরা চমকে তাকায়। সামনে অচেনা কিছু ছেলে। বেশভূষা আদিরার কাছে সুবিধার লাগছে না। একটা ছেলে আদিরার থেকে বইটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো। তারপর ধ*পাস করে বইটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে ছেলেটা তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,

–এসব পড়াশোনা করার কী দরকার তোমার? তোমার তো রিচ বয়ফ্রেন্ড আছেই। মারসাদ ইশরাক! ভার্সিটির সিনিয়রকে তো নিজের ইশারায় এনে ফেলেছো তাহলে এসব মোটাসোটা বই পড়ে সময় নষ্ট করা তো ইউজলেস! তা মারসাদকে কীভাবে তোমার দিওয়ানা বানালে? রূপ দিয়ে বুঝি?

আদিরার গা ঝিমঝিমিয়ে উঠলো। প্রতিটা কথার কতোটা ঘৃণ্য গভীরতা আছে তা স্পষ্ট। ছেলেগুলোর বাজে মন্তব্যে আশেপাশের কিছু ছাত্র-ছাত্রী নিজেদের কাজ ফেলে উৎসুকভাবে চেয়ে আছে। ওই ছেলেটাই আবার বলে,

–চলো। তোমাকে সাগর ডেকে পাঠিয়েছে। মারসাদকে কীভাবে নিজের জাঁলে ফাঁসালে তা আমরাও জানতে চাই।

কথাটা বলেই ছেলেটাসহ সাথের যারা ছিল তারা বিশ্রি হাসলো। আদিরার চোখে অশ্রুরা টলমল করছে। আশেপাশের কেউ এগিয়ে এলো না। দুই-একজন ছেলে উঠে বাহিরে চলে গেলো লাইব্রেরি থেকে। আদিরা কারও কিঞ্চিত পরিমানও সহোযোগিতা না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হলো। নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ওদের মধ্যে আরেকটি ছেলে আদিরাকে কাঁদতে দেখে ব্যাঙ্গ করে বলে,

–এমনভাবে কাঁদে না খুকুমণি। চলো আমাদের সাথে।

ছেলেগুলো আদিরাকে নিয়ে যেতে চাইলে আশেপাশে লক্ষ্য করে দেখে সবাই তাকিয়ে আছে তাই লাইব্রেরি থেকেই একটা মেয়েকে ডাক দেয় যাতে সেই মেয়েটা আদিরাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ওই মেয়েটাও বাধ্য হয়ে আদিরার কাছে আসে। অসহায়ভাবে আদিরার ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেগুলোর সাথে নিয়ে যেতে থাকে। আদিরা না যাওয়ার জন্য অনেক বারণ করলেও ছেলেগুলো তোয়াক্কা করে না। লাইব্রেরি থেকে বের হওয়া মাত্রই যখন ডান দিকে মোড় নিবে তখনি এক ভরাট কন্ঠস্বরের অধিকারী মানুষ ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

–নিলয় ভালোয় ভালোয় আদিরাকে ছেড়ে দে। নয়তো পস্তাতে হবে।

আদিরা কান্নারত ঝাপসা চোখে ভরাট কন্ঠস্বরের অধিকারী ছেলেটির মুখমণ্ডল পরিষ্কার ঠাওর করতে পারলো না তবে গলার স্বরে পরিচিত মনে হলো। ছেলেগুলোর মধ্যে নিলয় নামের ছেলেটি বলে উঠে,

–দেখ মারসাদ, তুই তোর মতো থাক। তোর সময় আমরা কেউ বাঁধা দিতে আসিনি তাই আমাদের সময়ও তুই আসবি না। মেয়েটাকে সাগর নিয়ে যেতে বলেছে তাই ওকে নিয়ে যাবো। বাগড়া দিতে আসবি না। মারসাদ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

–তা মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার কারণটা তো আমাকেই বানানো হয়েছে তাই না? আমার জন্য তো আমি কোনো নির্দোষের ক্ষতি হতে দিতে পারি না। ভালোয় ভালোয় বলছি আদিরাকে ছেড়ে দে আর নিজেদের মতো থাক।

মারসাদ আদিরার হাত ধরে রাখা মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটি সাথে সাথে আদিরার হাত ছেড়ে দিয়ে লাইব্রেরিতে চলে গেলো আবার। আদিরা সেখানে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে চলেছ। নিলয় নামের ছেলেটা মারসাদকে উদ্দেশ্য করে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,

–ভালো করছিস না মারসাদ। এর মূল্য চু*কাতে হবে। এই মেয়ের জন্য তোর এতো দরদ কেনো? যা খুশি হোক ওর। তুই আমাদের মাঝে নাক গলাস কেন?

মারসাদ নিলয়ের কাছে এসে নিলয়ের কাঁধে হাত দিয়ে শার্টের উপর ময়লা ঝাড়ার মতো করে শান্ত স্বরে বলে,

–নিজেদের মতো থাক। বাকিটা তোদের না জানাই উত্তম। সাগরকে বলে দিবি, মারসাদকে ভিপির পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে শুনে এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। মারসাদের প্রতিচ্ছবি এখনও আছে। নিজের ভাগ্যের কথা ভাব তোরা।

নিলয় ও সাথের ছেলেদের নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে যায়। মারসাদ গিয়ে আদিরার সামনে দাঁড়িয়ে রুক্ষ স্বরে বলে,

–এতো অবলার মতো চুপচাপ থাকো কেনো তুমি? এতো ভীতু কেনো তুমি? নিজের সেফটির ব্যাপারে কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই তোমার। ছেলেগুলো কিছু বাজে মন্তব্য করলো আর তুমি কাঁদা শুরু করলে। সাগরকে ভয় পাও বলেই সে তোমাদের দিয়ে যা-তা করায়। টিচারের সাহায্য নিবে বা ভিপি আশিক ভাই ও রাসেল ভাইয়ের সাহায্য নিবে। অবশ্য তোমাকেই বা বলছি কেনো? তোমাকে যখন নাচ করতে বলেছিলাম তখনও তুমি নিশ্চুপ ছিলে। আমি চাইলেই সেটার বাজে ফায়দা তুলতে পারতাম তবে যেটুকু দরকার ছিল কাজ সেটুকুই করেছি। আজ আমি এখানে না এলে তোমাকে যে কী বাজে পরিস্থিতিতে পরতে হতো তা তোমারও ধারণা নেই। যাও ক্লাসে যাও। মাহির সাথে সাথে থাকবে। আমার ফোন নাম্বার নিয়ে রাখবে মাহির থেকে। মাহি এখনই চলে আসবে।

আদিরা নিরবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে রা পর্যন্ত নেই। মারসাদ লক্ষ্য করলো। এবার নরম কন্ঠস্বরে বলে,

–এই শহর বড্ড নিষ্ঠুর। তোমার মতো সবাই এতো সরল হয় না। এতো সহজ সরল হলে হাঁপিয়ে উঠবে তুমি। বন্ধু বানাও। জানি তুমি গ্রাম থেকে এসেছো। গ্রামের মেয়েরা তো ডানপিঠে হয়। তুমি একা বলে হয়তো এতো চুপচাপ। আমাকে যদি রাফি মেসেজ করে না জানাতো তবে আজ তুমি কতো বড়ো বিপদে পরতো তার ধারণাও নেই তোমার।

আদিরা কিছু বললো না। মাহিকে আসতে দেখে মারসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়। মাহি এসে আদিরার দুই গালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,

–কী হয়েছে আদু? তুই কাঁদছিস কেনো? দাভাই জলদির মধ্যে ফোন করে বলল এখানে আসতে। আর কিছু বলল না।

মাহি আদিরাকে লাইব্রেরির ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসায় তারপর কারও থেকে পানি চেয়ে নিয়ে আদিরাকে দেয়। আদিরা কিছুক্ষণের মধ্যো স্বাভাবিক হয়ে যতোটুকু সম্ভব মাহিকে বলে। মাহি আদিরাকে নিয়ে ক্লাসে গেলো।

________

সাগর রাগে ক্ষোভে ক্রুদ্ধ হয়ে হাতে থাকা বি*য়ারের ক্যান মাটিতে ছুঁড়ে মা র লো। সাগর ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

–ওই মারসাদকে আমি দেখে নিবো। ওর সবকিছু ছিনিয়ে নিতে আমি কুণ্ঠাবোধ করি না। ওই আদিরা মেয়েটাকে আমি মারসাদের জীবন থেকে দূরে সরাবোই। এতো কেয়ার ওই মেয়ের জন্য? কিছু একটা তো আছেই। এই সাগর তোর জীবন ন র ক সমতূল্য করে তুলবে মারসাদ। সামিরাকে বাগে পেয়ে গেছি তোর কারণেই। এবার পালা আদিরার। সামিরা এখন আমার চালের গুটি। ওর আদিরার প্রতি রাগ-ক্ষোভকেই আমি কাজে লাগাবো।

………

পদ্ম জলাশয়ের কাছে বসে আছে আদিরা, সাবিহা ও রিন্তি। আর মাহি রঙ তুলির সংমিশ্রণে ক্যানভাসে কিছু আঁকছে মোবাইল দেখে দেখে। আজ ক্লাসের পর মাঝের গ্যাপটা একটু দীর্ঘ। দুই ঘন্টার মতো। কিছু খাবার কিনে এনে ওরা এখানে এসে বসেছে। আদিরা মাহির বই থেকে কিছু নোট করছে আর একটু পরপর মাহির ক্যানভাসে কি আঁকছে তা দেখার চেষ্টা করছে। সাবিহা ও রিন্তি ফেসবুক নিয়ে ব্যাস্ত। দীর্ঘ এক ঘন্টা যাবত কিছু আঁকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মাহি। তাও হচ্ছে না। শেষে অর্ধেকের বেশি কাজ সমাপ্ত করে মাহি ক্যানভাসটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে শুকাতে দিলো। বাকিটা ছুটির পর আঁকবে। মাহি এসে আদিরার পাশে বসে খাবারের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল,

–আদু তুই চাইলে বইটা আজ নিয়ে যেতে পারিস। আমি নাহয় মোবাইলে ছবি তুলে রাখবো। তুই দুইদিন রেখে আমাকে দিয়ে দিস।

আদিরা খুশি হলো। মাহি আদিরার দিকে খাবার দিলে আদিরা ইতস্ততভাবে অল্প একটু নেয়। মেস থেকে যা নিয়ে এসেছে তা মাহি ওদের দিতে তার কেমন যেনো লাগছে। মাহি আদিরার টিফিন বক্স খুলে আলু ভাজি দিয়ে রুটির টুকরো ছিঁড়ে নিজেই খেয়ে নেয়। সাবিহা ও রিন্তিও রুটি ছিঁড়ে নিলো। মাহি রুটি খেতে খেতে বলে,

–দারুন স্বাদ তো। আমার রুটি ভাজি খাওয়া না হলেও স্বাদটা অনেক মজা। সাবিহা, রিন্তি তোদের কেমন লাগলো?

রিন্তি বলে,
–অনেক মজা। আমার তো আলুভাজি সবসময় প্রিয়। কিন্তু হোস্টেলে আলুর সাথে পেঁপে দিয়ে ভাজি করে যা আমার একটুও ভালো লাগে না। পেঁপে কেন দিবে! বিরক্ত লাগে।

সাবিহাও একই ভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে। ওরা চারজনে মিলেমিশে টিফিন শেষ করে। এখন ক্লাসের জন্য যাবে। আদিরা উৎসুক কন্ঠে মাহিকে বলে,

–মাহি তোমার চিত্রটা দেখাও না।

মাহি নাচক সুরে বলে,
–উহু। আগে পুরোটা শেষ করি তারপর। এখন উপরে পর্দা দিয়েই রাখবো। এখন দেখলেও বুঝবি না কিছু তোরা।

ওরা চারজন ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ্

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here