#এক_শহর_প্রেম?,৩৬,৩৭,৩৮
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
সকালে ঘোরাঘুরি করে বেলা বারোটার আগেই খাগড়াছড়ি এসেছে। খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নামল আর ওরা সবাই কক্সবাজার কলাতলী পৌছাল। কলাতলী বিচের ও সুগন্ধা বিচের মাঝামাঝিতে হোটেল নিয়েছে। দুইটা ডাবল বেডের ও দুইটা সিঙ্গেল বেডের রুম নিয়েছে। হোটেলে গিয়ে ফর্মালিটি পূরণ করে ফ্রেশ হয়ে বিচে যাওয়ার জন্য বের হলো। সমুদ্র সৈকতে ওরা পাঁয়ে হেঁটেই যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশে সারি সারি দোকান। শুঁটকি মাছের দোকান বেশি দেখা যায়। বার্মিজ মার্কেটে এখন রমরমা অবস্থা। সুগন্ধা বিচের দিক দিয়ে ওরা বিচে গেল। বিচের কিছুটা আগে সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, অক্টোপাস, কাঁকড়া এসব ফ্রাই করা ও বিক্রির দোকান। ওরা আগে সৈকতে ঘুরবে তারপর এসে খাবে।
আদিরা সবকিছু অবাক নজরে দেখছে। আদিরার পাহাড় ও সমুদ্রের মধ্যে দুইটাই প্রিয় তবে সমুদ্র ওর ভিষণ ভালো লাগে। হুমায়ুন আহমেদের “দারুচিনির দ্বীপ” বইটাও সে আহনাফদের বাড়িতে পড়েছিল তাছাড়া গ্রামে দোকানের সাদা-কালো টিভিতে এই মুভিটা ছোটোবেলাতে দেখেছিল। সাজেকে ঘন সবুজ পাহাড় ও মেঘ দেখে সে অনেকটাই উৎফুল্লিত। এখন সমুদ্র দেখে তার দৌঁড়ে পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে। সমুদ্রের শীতল নোনাজলের ছোঁয়া পেতে মন বারংবার আঁকুপাঁকু করছে। গ্রামে থাকতে ছোটোবেলায় সে পুকুরের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াত। সমুদ্র সৈকতের শীতল বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ছে ওর আর ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করছে। আঁধারে ঢাকা অম্বরে একফালি চাঁদ সমুদ্রের জলের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে। জোয়ারের সময় তাই সৈকতে বড়ো-ছোটো ঢেউয়ের আছড়ে পরছে। সমুদ্রের গর্জনে হৃদয়ে কাঁপন সৃষ্টি করে। আদিরা মারসাদকে টেনে নিয়ে যায় পানিতে পা ভিজাবে বলে। দুজন একত্রে পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিরার দৃষ্টি সম্মুখপানে যেখানে বিশাল জলরাশির কোনো কূল-কিনারা দৃশ্যমান না। আর মারসাদের নজরে সমুদ্রের জোৎসনা প্রতিফলিত জলরাশির থেকেও নিজের হৃদয়রাণীর চোখে-মুখে প্রশস্ত হাসিটা বেশি আকর্ষণীয়। আদিরার পায়ের উপর যখন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পরছে তখন শীতল জলের ছোঁয়ায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এদিকে রিন্তি এই অন্ধকারে সেলফি তোলার চেষ্টা করছে তখন রাহিন এসে বলে,
–তুমি কী অন্ধকারে কিছু দেখবে? ক্যামোরায় তো কিছুই উঠবে না। এক কাজ করো। আমি ফোনের ফ্লাশলাইট অন করি তারপর তুমি ছবি তুলো।
রিন্তির কাছে আইডিয়াটা পছন্দ হয় তাই সে রাজি হয়। রাহিন রিন্তির হাতে একটা ঝিনুক দেয়। ঝিনুকটা সে এতক্ষণ যেখানে ঝিনুকে নাম লেখে সেখান থেকে নাম লিখিয়ে এনেছে। রিন্তি ঝিনকা হাতে নিয়ে একবার রাহিনের দিকে তাকায় আরেকবার ঝিনুকের দিকে। রাহিন মাথা চুলকাতে চুলকাতে রিন্তির কাছ থেকে চলে যায়। রিন্তি অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে। তার মনে প্রশ্ন, এটা কী কোনোরকম প্রপোজ ছিল?
সাবিহা সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে তার ফিয়ন্সে আহানের সাথে ফোনে কথা বলছে। আহান অফিসের কাজের জন্য ওদের সাথে আসতে পারেনি। এমনিতেও আহানের সাথে সাবিহার খুব একটা দেখা হয়না। আহান একমাস হলো ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে। সাবিহার ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলে আহানের সাথে বিয়ের কথা বলছে সাবিহার বাবা-মা। সুমি, মৃদুল ও রবিন হাঁটছে তখন ওদের সাথে রাহিন এসে যোগ দিল। মাহি ও আহনাফ পাশাপাশি হাঁটছে। মাহি অন্যমনা হয়ে আহনাফকে জিজ্ঞেসা করে,
–সব কি ঠিক করা যায় না? মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না তাতে আমার আফসোস নেই কারণ উনি উনার মতো ব্যাস্ত। আমার কেয়ার করে বলেই আমি তাকে খুব একটা বাজে কথা বলি না। শুধু তার সব কথা চুপচাপ শুনে যাই আর দাভাইকে নিয়ে কিছু বললে বলি। উনি একটু স্বাভাবিক হলে খুব কী ক্ষতি হতো? জানেন? বাবার হার্টে প্রবলেম বাড়ছে। আমাদের না বললেও সে লুকিয়ে ডাক্তার দেখায়। আমি কয়েকদিন আগে তার স্টাডিরুমে তার রিপোর্ট দেখেছি। বাবাকে সে কোনোদিনও বিয়ে করতে পারত না যদি না মীরামা বাবাকে জোর করত। মীরা মায়ের মৃ*ত্যুর পরে তো বাবা বিয়ে করতোই না। মীরামা তার জীবিত অবস্থায় বিয়ে দিয়েছে বলে। অকৃতজ্ঞ আমার মা। নিজের মায়ের সম্পর্কে এসব ভাবতেও খারাপ লাগে। বিশ্বাস করুন, আপিলির মৃ*ত্যুর আগ পর্যন্ত আমি মায়ের সাথে ভালোই কথা বলতাম। দাভাই ও আপিলিকে নিয়ে বাজে কথা না বললে তার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু আপিলির মৃ*ত্যুতে আমি মনে করি আমার মায়ের অবহেলাটা বেশি ছিল। বাবা তো আগে থেকেই ছন্নছাড়া। তাও বাবা আমাদের সাথে কথা বলত। সবকিছু এখন আমাকে বিষণ্ণ করে। দাদীর শরীরও অতো ভালো নেই। দাভাই বিয়ে করেছে তা নিজে না জানানোতে দাদী ও বাবা খুব কস্ট পেয়েছে।
আহনাফ মনোযোগী শ্রোতার মতো মাহির প্রতিটা অভিযোগ শুনলো। আহনাফ সবসময় খুব ভালো শ্রোতা। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–সবকিছু নিমিষেই মিটে যায় না। অনেক অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। আদিরা পারলে পারতে পারে মারসাদ ও আঙ্কেলের সম্পর্ক ঠিক করতে। মারসাদের মনে আঙ্কেলের প্রতি রাগ নেই আমি জানি কিন্তু আছে একরাশ অভিমান। অভিমান ভাঙাতে হবে। আদিরা এখন মারসাদের স্ত্রী। সে পারবে বলে আমি মনে করি।
মাহি ও আহনাফ বালু উপত্যকায় বসল। দুজন বিশাল জলরাশি উপভোগ করছে নিরবে নিভৃতে।
_________
ফেরার পথে রাস্তার ধারে রেস্তোরায় ওরা সামুদ্রিক মাছ খেলো। ছেলেরা সবাই অক্টোপাস ও কাঁকড়াও নিয়েছে। মাহিও এগুলো নিয়েছে। আদিরা অক্টোপাস দেখে মুখ চেপে বসে আছে। ওর কাছে অক্টোপাসের নাম শুনেই পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে। মারসাদদের খেতে দেখে আদিরা চোখ মুখ কুঁচকে বিদঘুটে মুখের ভাব করে তাকিয়ে আছে আর বারবার মুখে হাত দিচ্ছে। মারসাদ খেতে খেতে বলে,
–মুখ এমন বিদঘুটে করেছ কেনো? তুমি আমাদের দিকে তাকিও না তাহলেই হলো। নিজের প্লেটে তাকিয়ে খাও। এমনেই বমি করে শরীর খারাপ।
আদিরা চুপ করে চোখমুখ খিঁচে নিজের খাবার খাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার শেষে হোটেলে ফিরে গেল। আদিরা একটা ঝিনুকের মালা ও খোঁপার কাঠি কিনেছে সাথে কিছু প্রবাল। সবাই টুকটাক কিছু কিনেছে। বাকি কেনাকাটা কাল সকালে করবে।
আদিরা হোটেলে গিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে পরেছে। কক্সবাজার আসার পথে বাস থামিয়ে সে বমি করেছিল তাই শরীর দুর্বল। সমুদ্র দেখে তার দুর্বলতা এক নিমিষেই উবে গিয়েছিল। এখন তার শরীর ভাড় ছেড়ে দিচ্ছে। মারসাদ হোটেলের হেল্পলাইনে কল করে লেবুপানি আনিয়েছে। এখন আদিরার সামনে ধরে বলে,
–এটা খাও তারপর ঘুমাও। কালকে অনেক জায়গায় ঘুরব আমরা। সমুদ্রে ভিজবও তো।
আদিরা পানিটা পান করে। তারপর শুয়ে পরে। মারসাদের হঠাৎ ফোন বাজাতে সে ব্যালকনিতে গিয়ে রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ থেকে নিহাদ বলে,
–রুহুল আমিনের আজকে রাত তিনটায় একটা বড়ো এমাউন্টের টাকার ড্রা*গ পাচার হবে। আমি অলরেডি শফিক ভাইকে ইনফর্ম করেছি। শফিক ভাই বর্ডারে ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছে।
মারসাদ কপালে ঘষতে ঘষতে চিন্তিত স্বরে বলে,
–এটাকে সে আগেরবারের মতো ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিবে। তার ফ্যাক্টরির খোঁজ পেলে ভালো হতো।
নিহাদ হাসতে হাসতে বলে,
–সেটাও পেয়েছি। গাজিপুরে আরেকটা রূপগঞ্জে। সেখানে একটু পরে রেট হবে। (কাল্পনিক)
মারসাদ অবাক হয়ে বলে,
–কখন করলে এসব?
নিহাদ বলে,
–এক গুপ্তচর ঢুকিয়েছি তার ফ্যাক্টরিতে। সেই খোঁজ দিলো। কাল ব্রেকিং নিউজে চোখ রেখো। তুমি এখন তোমার হানিমুন এন্জয় করো ব্রো।
মারসাদ বাঁকা হেসে ফোন রেখে দেয়। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করে,
“এবার রুহুল আমিনের চাপ্টার ক্লোজ। দুইটা ফ্যাক্টরিতে কয়েক কোটি টাকার চালান। জেলের চারদেয়াল তার অপেক্ষায়।”
_________
সূর্যোদয়ের সময় সকলে সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হয়। সবাই উদীয়মান সূর্যের সাথে অনেক ছবি তুলল। সূর্যোদয় দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির তল থেকে আ*গুনের গোলক বের হয়ে পূর্বাকাশে দিকে জ্বলজ্বল করছে। এখন ভাটার সময়। ওরা সকলে গল্প করতে করতে সৈকতে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটে। সুগন্ধা বিচ থেকে কলাতলী বিচে হেঁটে সকাল আটটায় নাস্তা খেতে একটা রেস্তোরাতে ঢুকল। তারপর সমুদ্রে গোসল করা, খেলা করা, বাইক চালিয়ে বারোটার দিকে হোটেলে ফিরল। হোটেলে ফিরে শরীরের বালি ছাড়িয়ে গোসল করে একটুক্ষণ রেস্ট করে দুপুরের খাবার খেয়ে হিমছড়ি, ইনানী বিচ ও তার থেকে কিছুটা দূরে যাবে।
হিমছড়িতে ঝর্ণার কাছে পাশ দিয়ে ঘুরে হালকা করে হাতে পানির ছোঁয়া নিয়ে ওরা পাহাড়ে উঠছে। মারসাদ আদিরাকে বলেছিল উঠতে না পারলে না যেতে। কারণ খাড়া সিঁড়িতে অনেক রিস্ক থাকে। কিন্তু কৌতুহলী মন কী মানে? ওরা পাহাড়ের উপর উঠার সময় অনেক ছবি তুলেছে তারপর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সেখান থেকে আশেপাশের পরিবেশ দেখছে। আশেপাশের ছোটো বড়ো পাহাড় গুলো অনিন্দ্য সুন্দর দেখায়। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়া যায় তবে পথ অনেকটা সরু ও পরে যাবার সম্ভাবনা অনেকটা।
এরপর ওরা ইনানী বিচে কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে হালকা করে পা ভিজিয়ে গাড়িতে করে আরও কিছুটা দূরে একটা জায়গায় ওরা গেল। সেখানে প্রবাল পাথরের সমাহার। যেতে কিছুটা সময় লাগে তবে জায়গাটা অনেক সুন্দর। প্রবালের উপর বসে সমুদ্রের পানে চেয়ে হেলে পরা সূর্য আকর্ষণীয় দেখায়। সেখানেই ওরা সূর্যাস্ত দেখবে। সেখানে আর্মি ক্যাম্পও আছে। ওরা বারোজনে একটা গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। মাহি সমুদ্রের অনেকটা দূরে গিয়েছে কারণ এখানে গভীরতা কম। অন্যসব বিচে ঢালু থাকলেও এখানে ঢালু না। সূর্যাস্ত দেখে ওরা গাড়িতে উঠল ফিরে আসতে। সূর্যাস্তের পর এখানে কারও থাকার অনুমতি নেই। ফেরার পথে আবারও হিমছড়ি নেমে কিছু আচার ও বাদাম কিনে নিলো। কোনো রেস্তোরা থেকে ডিনার শেষে হোটেলে ফিরল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭
মারসাদ ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে আদিরা সকালের কেনা ঝিনুক, শামুক গুলো দেখছে। সকালে আদিরা ঝিনুকের অনেক কিছু কিনেছে। ঘরের জন্য ঝালর, দরজার জন্য ঝালর, ব্যালকনির জন্য ঝালর সাথে কতোগুলো মালা, ব্রেসলেট এসব। মারসাদ নিঃশব্দে হেসে আদিরার পাশে বসল। আদিরা মারসাদের দিকে একবার তাকিয়ে হেসে আবার ঝিনুক দেখতে দেখতে বলল,
–এই রাতেরবেলাও গোসল করলেন? তাও শীতকালে?
মারসাদ তোয়ালেটা বিছানায় রেখে বলে,
–আমরা পাঁচজন তো সমুদ্রে আবারও নেমেছিলাম ইনানীতে। তোমরা বাকিরা শুধু হেঁটেছ। তাই আমার শরীরে বালি কিচকিচ করছিল।
আদিরা মারসাদকে ভেজা তোয়ালেটা বিছানায় ফেলতে দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে তোয়ালেটা নেয় অতঃপর বিছানা থেকে নেমে মারসাদের বরাবার দাঁড়িয়ে বলে,
–ভেজা তোয়ালেটা ব্যালকনিতে মেলে দিলে কী হয় হ্যাঁ? আপনার এই স্বভাব যাবে না!
আদিরা তোয়ালেটা ব্যালকনিতে মেলে দিতে অগ্রসর হবে ঠিক তখনি মারসাদ আদিরার বাম হাতে হেচকা টান দিয়ে আদিরাকে নিজের কোলে এনে ফেলল। আদিরা হঠাৎ টানে হকচকিয়ে হালকা চিৎকার করে উঠলে মারসাদ শব্দ করে হেসে উঠে। মারসাদ বলে,
–এতো ভয় কেনো পাও হ্যাঁ? আমিই তো। তোমার হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড।
কথাটা বলে মারসাদ আদিরার কাঁধে নিজের অধর স্পর্শ করায়। আদিরা কেঁপে উঠে। কিছু বলতে নিচ্ছিল সে কিন্তু মারসাদের এমন স্পর্শে সে থতমত খেয়ে গেছে। মারসাদ এবার আদিরার গলার কাছে নাক ঘষতে ঘষতে বলে,
–কিছু বলো?
আদিরা হাত দিয়ে মারসাদকে সরিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
–আমি ঘুমাব। আজ কতো ঘুরাঘুরি হলো। টায়ার্ড লাগছে।
আদিরা ঠেলে উঠে যেতে নিলে মারসাদ ওকে টেনে এবার বিছানায় ফেলে। আদিরা চোখ-মুখ খিঁচে রেখেছে। মারসাদ নিঃশব্দে হেসে আদিরার বন্ধ নয়নযুগলে ফুঁ দেয়। আদিরা ঈষৎ কেপে উঠে। মারসাদ সম্মোহিত কন্ঠে বলে,
–আমার নিদ্রা কেড়ে তুমি সুখনিদ্রায় কী করে যাও মনোহারিণী?
আদিরা নিশ্চুপ। তার উজ্জ্বল কায়া অনুভূতির মহালগ্নে শিহরিত। আলো নিভিয়ে প্রিয়তমাকে গভীর আলিঙ্গনে প্রেমের শহরে আবারও অবাধ বিচরনে রজনী পার।
_________
পরেরদিন সমুদ্রপাড়ে হালকা ঘোরাফেরা করে ওরা বেলা বারোটায় ঢাকা ফিরতে রওনা হয়। পরেরদিন সকালে ঢাকা পৌঁছে ওরা। আবার শুরু আগের মতো জীবন। মারসাদ ঢাকা এসেই রুহুল আমিনের খোঁজ নেয়। কক্সবাজার থাকা অবস্থায় সেই চিন্তা নিতে চাচ্ছিল না। রুহুল আমিনের দুইটা ফ্যাক্টরির ডকুমেন্ট চেক করছে ডিবি। আর সব অবৈধ মা*লামা*ল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। রুহুল আমিন মিডিয়ার সামনে আসছে না এবার কারণ তার ওই দুইটা ফ্যাক্টরিই ছিল মূল। বাকি শাখা সেগুলোর সূত্র ধরে বের হয়ে আসবে। মারসাদ প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিলো।
…….
সাগর নিউজে যেদিন দেখেছে সেদিন থেকে সে কিছুটা দিশাহারা অবস্থায়। কিসের সাথে সে জড়িয়ে গেছে তাই ভাবছে। এতো সলিড পরিকল্পনাও যদি ধরা পরে যায় তাহলে সাগরের সব পরিকল্পনা তো তুচ্ছ। তাছাড়া সাগরের কাছে ওর এক বন্ধু আরেকটা খবর দিয়েছিল যে, নিলয় রাত্রীর সাথে যোগাযোগ রাখছে এবং ওদেরকে রেস্টুরেন্টে হাত জড়িয়ে ঢুকতে দেখেছিল। সাগরের বিষয়টা হজম না হওয়ায় সে নিলয় ও রাত্রীর উপর নজরদারী করতে বলেছিল। আজকে খবর পেয়েছে, নিলয় ও রাত্রীকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছে। সাগর নিলয়কে আসতে বলেছে। নিলয় এসে সাগরকে বলে,
–হ্যাঁ দোস্ত বল। কী অবস্থা?
–ভালোই। তোর কী অবস্থা?
–এইতো ভালো। তা হঠাৎ জরুরী তলব?
–তুই হোস্টেল ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে অনেকটা চেঞ্জ হয়েছিস সেই ব্যাপারে জানতে।
নিলয় ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–কেমন চেঞ্জ?
–এই যে পুরানো প্রেম জেগে উঠেছে। খুব মা*খোমা*খো প্রেম!
নিলয় নড়েচড়ে বসে। সাগর কী কিছু সন্দেহ করল? এরকম ভয় তার। সাগর তা দেখে বাঁকা হেসে বলে,
–তোর আর রাত্রীর প্রেম তো জমে উঠেছে শুনলাম। তা কবে থেকে? আমাদের জানালি না পর্যন্ত! কী প্রেম!
নিলয় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দৃষ্টি লুকাচ্ছে। সাগর বলে,
–সত্যি বলবি। আমি শিউর হয়েই তোকে ডেকেছি। রাত্রীর জন্যই বুঝি তোর আমাদের সাথে মন নেই? সত্য না বললে আমি কী করতে পারি তা তো তুই জানিসই।
নিলয় হাত দিয়ে কপাল ঘষে চিন্তায় পরে যায়। রাত্রির পরিবারে রাত্রির বিয়ে নিয়ে আবারও কথা হচ্ছে। নিলয় মাস দুয়েক হলো একটা পার্ট টাইম জবে ঢুকেছে যা বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর টিউশন দুইটা ব্যাচ শুক্রবার সহ সপ্তাহে চারদিন করে পড়ায়। নিলয় যেহেতু বিবিএ এর স্টুডেন্ট আর তার রেজাল্ট মোটামোটি ভালো। প্রথম দুই বছর তো রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল তারপর সাগরদের সাথে হোস্টেলে উঠার পর তার রেজাল্ট আগের তুলনায় খারাপ হচ্ছিল। সে স্টুডেন্ট হিসেবে পার্টটাইম জব নিয়েছে। এখন সে লেখাপড়াতেও মনোযোগ দিচ্ছে তার সদ্য শেষ হওয়া সেমিস্টার ভালো হয়েছে। সাগরের ঝাঁকুনি দেয়াতে নিলয় কল্পনা থেকে বাস্তবে ফেরে। সাগর বলে,
–তুই আমাদের ধোঁকা দিচ্ছিস নাতো? তুই মুখে বললে ভালো আর তুই না বললেও আমি তোর সবই জানতে পারব। তখন তোকে খুব পস্তাতে হবে। আর রাত্রী তো..!
নিলয় ভয় পেয়ে যায়। নিলয় হড়বড়িয়ে বলে,
–রাত্রীর কিছু করিস না। ওর সত্যি কোনো দোষ নেই। ও এখন মারসাদদের সাথে চলাফেরাও কম করে। এইযে মারসাদরা সবাই ঘুরতে গেল রাত্রী যায়নি। ও এখন শুধু আমার সাথে থাকে।
সাগর অট্টহাসি হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
–তুইও তো আমাদের সাথে কম চলিস। আমাদের বেশিরভাগ আড্ডায় তুই থাকিস না। শুধু ওই রাত্রীর জন্য। তাই না?
নিলয় মাথা নিচু করে আছে। নিলয় হতাশ স্বরে বলে,
–দেখ সাগর, আমরা যা করছি তাতে আমাদের লাভ তো কিছুই হচ্ছে না। রুহুল আমিন যদি তোকে ফাঁসায় তাহলে কিন্তু তোকেও জেলে যেতে হবে। প্রতিটা ধাপে বিফল। এর চেয়ে ভালো আমি দেড় বছর আগে যেমন ছিলাম তেমনটাই হয়ে যাই। আমার কোনো বড়ো ভাই নেই। বাবার রিটায়ার্ডের সময় চলে আসছে। তাছাড়া রাত্রিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি অনেক। আমি চাইনা ওর কোনো ক্ষতি হোক। তাছাড়া সি ইজ মাই ওয়াইফ!
সাগর হতভম্ব দৃষ্টিতে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় হাত জোর করে বলে,
–বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের জায়গায় আর পারসোনাল লাইফ তার জায়গায়। আমি চাইনা দুইয়ে সংঘর্ষ হোক। অনেক তো করলি। এবার অন্তত আমার দিকটা ভাব। তোকে মারসাদের কিছু করতে আমি বাধা দেইনি। সবসময় রিস্কটা জানিয়েছি। জানি আমিও সমান দোষী তোর সব কাজে। আমার পারসোনাল লাইফটাকে রেহাই দে। তোকে একদিন ইমার্জেন্সিতে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিলাম আমি। তোর দুই ব্যাগের মতো রক্ত লাগত কিন্তু রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না বলে তৎক্ষণাৎ আমি এক ব্যাগ দিয়েছিলাম সেই ফার্স্ট ইয়ারে। সেইদিন কিন্তু তুই নিজের দোষেই মাথা ফা*টিয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ছিলি। তোকে আমি আরও অনেক কিছু থেকে বাঁচিয়েছিলাম প্রথম দুই বছর। তারপর তোর সাথে বন্ধুত্ব গাড়ো হয়। সেটাই বলছি, এবার আমার পারসোনাল লাইফ নষ্ট করিস না। তাছাড়া তোর কোনো কাজে আমি থাকব না যে বাধা দিব। বন্ধুত্ব কী এমনিতে থাকে না?
নিলয় সাগরের একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ভাষা বুঝল না। সে কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। নিলয় জানে সাগর নিলয়ের প্রতিটা কথা কিছুটা হলেও চিন্তা করে। অন্যদের সাথে সাগর রুড ব্যবহার করলেও নিলয়ের সাথে করেনা। নিলয় আজ নিজের পরিবার ও রাত্রীর জন্য স্বার্থপর হয়েছে। তার আর কিছুই যে করার নেই।
_________
আরও অনেকগুলো দিন চলে গেছে। শীতের রিক্ত বিদায়ে প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন। ফুলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় ঋতুরাজ তার সমস্ত রূপ নিয়ে হাজির। গাছে গাছে নতুন কুড়ি ও মুকুল। হালকা শীত, হালকা গরম। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আদিরা আর মারসাদ বিকেলে রাস্তায় হাঁটছে। হিমেল হাওয়ায় দুজনের মন বিভোর। আজ আদিরা মারসাদকে ফোন করে আসতে বলেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। বিকেলের টিউশনটা আদিরা সকালের দিকে পড়িয়ে ফেলেছে। মারসাদ জানতে চায়নি আদিরা কেনো ডেকেছে। তার মনোহারিণীর সাথে সে অসীম দিগন্তে হারাতে চায়। আদিরা আজ অন্য উদ্দেশ্যে হাঁটছে। অনেকটা সময় হাঁটার পর মারসাদ লক্ষ্য করল এই পথটা তার চিরপরিচিত। সে তৎক্ষাণাত আদিরার দিকে চাইল। আদিরা সামনের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে হাঁটছে। মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে প্রশ্ন করল,
–তুমি এখানে কোথায় এসেছ?
আদিরার সরল জবাব,
–শ্বশুরবাড়ি!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
মারসাদ হতবুদ্ধির মতো আদিরার দিকে তাকিয়ে রইল। আদিরার সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। সে তো মারসাদের হাত ধরে পথ চলছে। মারসাদ হুট করে থেমে গেল। হাতে টান লাগায় আদিরাও থামতে বাধ্য হলো। মারসাদ গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–এসবের মানে কী?
আদিরা দাঁত কেলিয়ে বলল,
–কিছুই না। আমার আজ খুব ইচ্ছে শ্বশুরবাড়ি যাব। মাহিকে আমি কথা দিয়েছি আর শ্বশুরবাড়ি স্বামী ছাড়া গেলে খারাপ দেখায় তো। প্লিজ! প্লিজ! না করবেন না।
মারসাদ শান্ত স্বরে আদিরার কাছে গিয়ে বলে,
–তোমাকে ওখানে বাকিরা ভালো ভাবে নাও নিতে পারে। একটু বুঝো। তখন তোমারই খারাপ লাগবে।
আদিরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,
–না না না। আমি যাবোই। আপনিও যাবেন। আমি টেনে নিয়ে যাব। নয়তো রাস্তার মাঝে বসে কান্না শুরু করব। তখন থামিয়েন।
মারসাদ দুহাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মুছে নিয়ে আদিরার হাত ধরে বলল,
–সময় করে অন্যদিন দেখিয়ে আনব। আজ একটু পর সন্ধ্যা নামবে।
আদিরা মারসাদের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। মারসাদ অগ্যতা আদিরার পেছোনে গেল। আদিরা মুখ ফুলিয়ে হেঁটে চলেছে। মারসাদ বার কয়েক ডাক দিয়েও যখন দেখল শুনছে না তখন দৌঁড়ে গিয়ে আদিরার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আদিরা নিঃশব্দে হাসল।
মারসাদ ও আদিরা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। মাহি ও ওর দাদী ওদের সাদরে গ্রহণ করল। মাহি এক ছুটে তার বাবার কাছে গেল বলতে। মারসাদের দাদী আদিরাকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে টুকটুক করে কথা বলছে। আদিরার সম্পর্কে জানছে। মারসাদ অপরপাশের সোফায় বসে তা হাসিমুখে দেখছে। বাড়ির পুরোনো কাজের লোক ট্রেতে করে নাস্তা ও জুস আনল। মারসাদের দাদী মিষ্টির প্লেটটা হাতে নিয়ে মারসাদকে বললেন,
–এদিকে আয় তুই। অতো দূরে বসেছিস কোনো? একে তো আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিস আর এখন আসার পর থেকে কথাই বলছিস না।
মারসাদ উঠে গিয়ে তার দাদীর পাশে বসল তারপর দাদীকে জড়িয়ে ধরল। মারসাদের দাদী তার কপালে চুমু দিয়ে আদিরাকে প্রথমে মিষ্টি মুখ করালো তারপর মারসাদকে করালো। আদিরার কপালে চুমু দিয়ে তিনি বলেন,
–ভারী মিষ্টি মেয়েগো। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার দাদুভাইয়ের পছন্দ খারাপ হতেই পারেনা।
আদিরা ও মারসাদ দুইজনে আলতো হাসল। দাদী আদিরার হাতে সেমাইয়ের প্লেট দিয়ে বলেন,
–আগে সেমাই খাও। আজকে সব নাস্তা আমি রান্না করেছি। হরেক রকম পিঠাও আছে।
মারসাদ আগে পাটিসাপটা পিঠা নিল। মাহি কিছুক্ষণ পর ওর বাবাকে অনেক জোর করে নিয়ে এসেছে। মিস্টার আরসাদ দরজার কাছে এসে দূর থেকে ছেলের পিছন সাইড দেখছেন। তার চোখে পানি টলমল করছে। মিস্টার আরসাদকে মাহি টেনে নিয়ে আসেন। আদিরা শ্বশুরকে দেখে সেমাইয়ের খালি প্লেট রেখে সালাম দেন। মিস্টার আরসাদ খুব খুশি হোন। আদিরা দাঁড়িয়ে বলে,
–বাবা বসেন।
মিস্টার আরসাদ বসেন। মারসাদ নিচের দিকে চেয়ে আছে। আদিরা তার শ্বশুরের সাথে কথা বলছে। শরীর কেমন এখন এসব জিজ্ঞাসা করছে। মিস্টার আরসাদও আদিরার সম্পর্কে টুকটাক জিজ্ঞাসা করল। মাহি তো তাকে সবই বলেছে। মাগরিবের আজান হলে মারসাদ বেরিয়ে যায় নামাজ পড়তে। আদিরাও এখানে নামাজ পড়ে দাদীর ঘরে বসে আছে। মাহি নিজে সকাল থেকে মারসাদের ঘরটা ঠিক করেছে কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে। মাহি এখন মারসাদের রুমে গিয়ে কাজের মহিলাকে বলে,
–আন্টি, ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলেন তো ফুল গুলো দিয়ে যেতে। আমি ফ্লাওয়ার ভাষে ফুল গুলো রাখব। সাথে ওই বড়ো পাত্রটাতেও মোমবাতির সাথে কাঠগোলাপ, পদ্ম, বেলি ফুল রাখব।
কাজের মহিলাটি ফুল আনতে চলে গেল। মাহি যা যা বাকি সব করে ফেলেছে। মাহির মা দরজায় দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল। তার ভাবভঙ্গিতে বিরক্তির ছাঁপ। তিনি বলেন,
–এসব করছ শুধু শুধু। টাইম ওয়েস্ট। ওই বে*য়াদ*বটা এসবের তোয়াক্কাই করবে না। আর বিয়ে করেছে এক গ্রামের মেয়েকে। সামিরা কী খারাপ ছিল নাকি! যতসব ন্যাকা।
মাহি জোরপূর্বক হেসে বলে,
–তোমার অপিনিয়ন কেউ চায়নি মম। প্লিজ নিজের মতো থাকো। কারও কোনো কিছুতে নাক গলিও না। তোমার কথা শোনার মতো টাইম আমাদের নেই। আর হ্যাঁ, আমার দাভাই ও ভাবিকে একটা বাজে কথাও বলবে না। বললে কিন্তু আমিও সবার সামনে মুখ খুলব।
মিসেস মনিকা রেগে বলেন,
–দিন দিন বে*য়া*দব হচ্ছো তুমি।
তিনি চলে গেলে মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজ করতে থাকে। নামাজ পড়ে মারসাদ আদিরাকে ফোন করে বাইরে আসতে। তাদের ফিরতে হবে। আদিরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আজ ফিরবে না। আজ এখানেই থাকবে। মারসাদ আদিরাকে কয়েকবার বলেছে চলে আসতে কিন্তু আদিরা আসবে না বরং মারসাদকে বাড়িতে আসতে বলছে। মারসাদ শেষমেশ রাগে আদিরাকে থাকতে বলে সেখান থেকে হোস্টেলে চলে গেছে। আদিরা ফোন হাতে নিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। মারসাদের দাদী ও মাহিও মন খারাপ করে আছে।
_________
মারসাদ একটা টিউশন করিয়ে হোস্টেলে ফিরে চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। রাত ৯টার কিছুটা বেশি বাজে। আদিরার নাম্বার থেকে কয়েকটা কল এসেছে কিন্তু মারসাদ রিসিভ করেনি। মেসেজ করে দিয়েছে, যদি ফিরতে চায় তাহলে বলতে। রবিন এসে মারসাদকে বলে,
–যা না। মেয়েটা প্রথম শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে আর তুই জেদ ধরে রেখে চলে আসলি। মিসেস মনিকা এখন কথা শোনাবে মেয়েটাকে।
মারসাদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–উনার তো ভালো লাগবে আমি না থাকাতে। আদিরাকে আমি বলেছি চলে আসতে চাইলে বলতে। আমি রাস্তায় অপেক্ষা করব ওর জন্য।
রবিন বলে,
–আজ ওখানে থাকলে কী এমন হতো? ওটা তোরও বাড়ি। তোর ছোটোবেলা সেখানে। তোর মায়ের ও আপিলির স্মৃতি সেখানে।
মারসাদ কিছু বলল না। রবিন কিছুক্ষণ মারসাদের দিকে চেয়ে থেকে মৃদুলদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। ওরা প্রত্যেকে মারসাদকে বলেছে ওই বাড়িতে যেতে কিন্তু মারসাদ যাবে না।
ঘড়ির কাটা যখন দশটার ঘরে তখন আহনাফের ফোন বেজে উঠে। আহনাফ স্ক্রিনে মাহির নাম্বার দেখে রিসিভ করলে মাহি হড়বড়িয়ে বলে,
–আদু ছাদে গিয়ে একা একা বসে আছে অনেকক্ষণ হলো। আর দাভাই চলে যাবার পর বাবা ও দাদী অনেক কস্ট পেয়েছে। দুইজনেই নিজেদের রুমে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আদিরাকে ডাকতে গেলাম তাও আসল না। তার এক কথা সে দাভাই না আসলে সারারাত ছাদেই বসে থাকবে। শীতকাল চলে গেলেও রাতের বেলা শীততো পড়েই তাই না?
আহনাফ চিন্তিত সুরে বলে,
–আমি মারসাদকে বলছি। দেখি রাজি হয় কীনা। তুমি তাও একটু চেষ্টা করো তাদের মানাতে।
মাহি সম্মতি দিয়ে ফোন রেখে দেয়। আহনাফ মারসাদের পাশে বসে। তারপর মারসাদকে টেনে তুলে বলে,
–এখুনি ওই বাড়িতে যাবি। আদিরা অনেকক্ষণ যাবত ছাদে বসে আছে। সারারাত সেখানেই থাকবে তুই না গেলে। আর তোর বাবা ও দাদীর কথা নাই বা বলি। তোর তো ওদের কেয়ার নেই। তারা দুইটা বছর ধরে তোকে এতো বলল শুনলি না। এবার নিজের বউয়ের জন্য নাহয় যা! দাদী বৃদ্ধা মানুষ। তুই যখন সেখানে গিয়ে না থেকে ফিরে আসিস তখন তার কেমন লাগে? ভাব একটু। যা চলে গেছে তা কী ফিরবে? তোর সকলের শাস্তি দেওয়াও তো শেষ। তাহলে? কেনো সম্পর্কের দূরত্ব আরও বাড়াচ্ছিস? আমরা চারজন জানি তুই তোর পরিবারকে কতোটা ভালোবাসিস। ভালো না বাসলে কী মাহি তোর সৎ বোন! মিসেস মনিকার উপর রাগটা ওর উপর ঝাড়তে পারতি না? জবাব দে!
মারসাদ চুপ করে আছে। তার মনের অভ্যন্তরে ঝড় বয়ে চলেছে। পুরোনো সকল কিছু তাকে এতোটাই স্পর্শ করে যে সে কিছু ভাবতে পারেনা। আহনাফকে প্রতিউত্তর না করে সে শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পরে। প্রায় রাত এগারোটা নাগাদ সে তার বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে। মারসাদ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আদিরাকে মেসেজ করে,
“ছাদ থেকে নেমে দরজা খুলো। তোমার দাদী শাশুড়িকে বলো, তুমি পেরেছ। তোমার জেদের কাছে এই মারসাদ আজ পরাজিত হয়েছে দেখবে না!”
আদিরা মেসেজটা দেখে তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে দাদীর দরজার সামনে গিয়ে মারসাদের আসার কথা জানিয়ে মুখ ভর্তি হাসির ফোয়ারা তুলে দরজা খুলে। মারসাদ ভেতরে আসে। মারসাদকে আসতে দেখে সবাই খুশি হলেও মিসেস মনিকা খুশি হলেন না। তার কাছে মারসাদকে নিজের সুখের অন্তরায় মনে হয়। তার স্বামী, সন্তান তার হয়েও যেন তার না! আদিরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিসেস মনিকা নিজের রুমে ঢোকে দরজা লাগিয়ে দেয়। মারসাদের দাদী মারসাদকে টেনে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যায়। মাহি ও আদিরা গিয়ে মিস্টার আরসাদকে জোর করে ডেকে নিয়ে আসেন। সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে। মারসাদের দাদী তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। মারসাদ নিশ্চুপে খেয়ে নেয়। দাদী কাঁদছে বলে মারসাদ তাকে বসিয়ে চোখ মুছিয়ে নিজে দাদীকে খাইয়ে দেয়। মিস্টার আরসাদ আড়ালে নিজের চোখ মুছে নেন।
মাহি মারসাদ ও আদিরাকে ওদের ঘরে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় মাহি দাঁত কে*লিয়ে বলে যায়,
–হ্যাপি ফার্স্ট নাইট ইন দিস হোম! ভাইয়া এন্ড ভাবী!
মারসাদ চোখ রাঙালে মাহি দৌঁড়ে চলে যায়। মারসাদ ঘড়ি খুলতে খুলতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বলে,
–ননদ-ভাবী মিলে দারুন প্ল্যানিং করেছ! দিন দিন আরও জেদি হচ্ছো তুমি।
আদিরা মুচকি হাসে। তারপর বলে,
–দেখলেন, দাদী ও বাবা কতো খুশি হয়েছে। তাদের চোখে আনন্দ অশ্রু ছিল। আর এতোদিন পর নিজের বাড়িতে নিজের রুমে থাকবেন। রুমটাও আপনাকে মিস করছিল। আমার কিন্তু রুমটা খুব পছন্দ হয়েছে।
মারসাদ ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বলল,
–কাল আমরা চলে যাচ্ছি। সবার খুশি দেখলাম কিন্তু যার জন্য বাড়ি ছাড়লাম সে তো একবারও আমায় কিছু বলল না। ঘরছাড়া পাখি সহসা ঘরে ফেরেনা।
আদিরার মন আবার খারাপ হয়ে গেল। মারসাদ ব্যালকনিতে চলে গেল। তার পিছু পিছু আদিরাও গেল। মারসাদের পাশে বসল আদিরা। আদিরাকে বসতে দেখে মারসাদ আদিরার কোলে মাথা রেখে ব্যালকনিতেই শুয়ে পরল। আকাশে অর্ধ চন্দ্র অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টারত। নিরবতায় সকল না বলা অনুভূতি রাতের আঁধারে বিলীন হচ্ছে।
___________
সকালে আদিরা ঘুম থেকে নামাজ পড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেছে। মারসাদ নামাজ পড়ে ঘুমোচ্ছে। রাতে ওরা অনেকটা সময় ব্যালকনিতে চন্দ্রবিলাশ করে রুমে এসে ঘুমিয়েছে। আদিরা রান্নাঘরে খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় সব বের করে নাস্তা বানালো। সাধারণ নাস্তা। রুটি ও সবজি সাথে ডিম ভাজি। তারপর চা বানিয়ে সবাইকে দিতে গেল। সবার জন্য লেবুচা করল। লেবুচা হার্টের জন্য ভালো। মারসাদ ও মাহির জন্য কফি। মাহিকে কফি দিয়ে এখন গেছে মারসাদকে ডাকতে। রুমে গিয়ে আদিরা কফির মগটা বেড সাইড টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে গ্লাস খুলে দিল। পর্দা সরানোর সাথে সাথে রোদের ঝিলিক গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে এখন ঘুমন্ত মারসাদের মুখের উপর পরছে। আদিরা মারসাদের পাশে বসে মারসাদকে আস্তে আস্তে ডাকছে। ঘুমন্ত ব্যাক্তিকে জোরে ডাকা ঠিক না। এতে স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। মানুষের ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করার হার বেশি থাকে।
মারসাদ চোখে হাত দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে আদিরার দিকে তাকালে আদিরা বিনিময়ে মিষ্টি হেসে মারসাদকে কফির মগটা দেখায়। আদিরা এরপর উঠে যেতে নিলে মারসাদ ওর হাত টেনে ধরে বলে,
–থ্যাংকিউ ফর কামিং ইন মাই লাইফ। থ্যাংকিউ ফর এভরিথিং মাই লাভ।
আদিরা মারসাদের ঘুমে ভাব ধরা চুল কপারে পরে থাকা মুখাবয়বে খানিক চাইল অতঃপর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মারসাদের কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করাল। তারপর মিষ্টি হেসে চলে গেল।
সকালের নাস্তার টেবিলে সকলে উপস্থিত হলেও মিসেস মনিকা এলো না। সবাই আদিরার রান্নার প্রশংসা করল। নাস্তা খেয়ে ওরা ভার্সিটির জন্য চলে গেল। আদিরা তার দাদীশাশুড়ি ও শ্বশুরকে বলে গেল খুব জলদি ওরা আবার আসবে। দাদী আদিরার মাথায় হাত রেখে কপারে চুমু দিলেন। এরপর ওরা চলে আসল।
_________
আরও কয়েকদিন কেটে গেল। হুট করে একদিন রাত এগারোটায় মাহি মারসাদকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–দাভাই বাবা!
চলবে ইনশাআল্লাহ,